1 of 2

১২. সরকারি মতে বসন্ত এসে গেছে

সরকারি মতে বসন্ত এসে গেছে। টাইমস পত্রিকায় ছাপা হয়েছে রাস্তার ধারের ঘাষফুলের ছবি। কে প্রথম রবিন পাখির ডাক শুনেছে তাও জানিয়েছে খবরের কাগজে চিঠি লিখে। তবু আজ দুপুর থেকে হঠাৎ বেশ ঠাণ্ডা পড়ে গেল! এদেশের আবহাওয়ার মতি গতি বোঝা ভার। এক একদিন সকাল থেকে রাত্তিরের মধ্যেই যেন তিন চারটে ঋতু খেলা করে যায়। আজ সকালে ছিল ঝকঝকে রোদ, দুপুরে বইতে লাগলো হিমেল হাওয়া।

ওভারকোটটা তুলে রেখেছিল তুতুল, আবার বার করতে হলো। জানলার বাইরে লাগানো ছোট্ট থার্মোমিটারে দেখলো তাপমাত্রা নেমে গেছে দশের নিচে। শুধু রেইন কোট দিয়ে কাজ চালানো যাবে না। এখন পৌনে তিনটে বাজে, তুতুলকে এয়ারপোর্টে যেতে হবে পাঁচটার সময়। আকাশের রং স্লেটের মতন, আজ আর রোদ্দুর ওঠার আশা নেই।

তুতুলকে এয়ারপোর্টে যেতে হবে একা। সপ্তাহের মাঝখানে কারুর তো ছুটি নেবার উপায় নেই। পরপর কয়েকটি নাম মনে পড়লো তুতুলের, তাদের কারুকে ফোন করলে হয়তো অফিস। থেকে ঘণ্টাখানেক আগে বেরিয়ে আসতেও পারে, কিন্তু এরকম ভাবে কারুর কাছে সাহায্য চাইতে তুতুলের সঙ্কোচ হয়। সে মুখ ফুটে একজনকেও বলতে পারবে না, তুমি তোমার কাজ নষ্ট করে আমার সঙ্গে চলো। শুধু গতকাল সন্ধেবেলা সে শিরিনকে একবার অনুরোধ করেছিল। শিরিন উপস্থিত কোনো চাকরি করছে না, সে যেতে পারতো। কিন্তু শিরিন একটা অদ্ভুত যুক্তি দিয়ে তুতুলকে প্রত্যাখ্যান করেছে। এয়ারপোর্টে গেলেই তার নাকি দারুণ মন খারাপ হয়ে যায়। তাই সে এয়ারপোর্টে যেতে চায় না।

চারটের সময় সাজগোজ করে সঙ্গে একটা অতিরিক্ত ওভারকোট নিয়ে তুতুল নিচে নামলো। গাড়িটা বার করলো গ্যারাজ থেকে। পেট্রল বেশ কম আছে, ভরে নিতে হবে রাস্তা থেকে। পার্সটা খুলে একবার দেখে নিয়ে তুতল গাড়িতে স্টার্ট দিল। সাধারণত সে গাড়ি না নিয়ে টিউব ট্রেনেই যাতায়াত করে। রাস্তা চিনতে এখনও তার গণ্ডগোল হয় তবে হিথরো ডিরেকশানে যেতে অসুবিধে নেই। কয়েকদিনের উষ্ণতার পর হঠাৎ আবার ঠাণ্ডা পড়েছে বলে বেশী ঠাণ্ডা লাগছে, তুতুল গরম হাওয়া চালিয়ে দিল গাড়ির মধ্যে।

রাস্তার দু’ধারে চেস্টনাট গাছগুলোতে নতুন পাতা এসেছে, ফুল এখনো চোখে পড়ে না। কেউ কেউ বলে, এগুলো নাকি হর্স চেস্টনাট। তুতুল তফাৎ বোঝে না। তার মনে পড়ে একটা কবিতার লাইন, “ঘোড়া নিমে কোরালির ডাক…”। পিকলুদা এই লাইনটা প্রায়ই বলতো, তুতুলের মনে গেঁথে আছে। নিমগাছ দু’রকম হয়। নিম আর ঘোড়া নিম। সেইরকম চেস্টনাটেরও ঘোড়া চেস্টনাট আছে? আশ্চর্য! আগে তুতুল গাছ বা ফুল বিশেষ চিনতো না। কিন্তু লণ্ডনে বাগান নিয়ে কথা বলা একটা ফ্যাসান। যার বাড়ির সামনে এক চিলতে বাগান। আছে, সে সেই বাগানের প্রসঙ্গ তুলবেই, এবং তাতে অন্যদেরও যোগ দিতে হয়। প্রায় সব বাগানেই গোলাপ ও চন্দ্রমল্লিকা ফোটে। লন্ডনে আসবার আগে এরকম গোলাপ তুতুল দেখেইনি। আস্তে আস্তে লন্ডন শহরটা ভালো লাগতে শুরু করেছে তুতুলের, এত ফুলের জন্যই বেশী ভালো লাগে। এই ঘিঞ্জি শহরেও তো প্রায় সব বাড়ির সঙ্গেই একটু না একটু বাগান থাকেই। তুতুল এখন টিউলিপ থেকে ম্যাগনোলিয়া গ্ল্যান্ডিফ্লোরা পর্যন্ত অনেক ফুলই চিনে গেছে।

বসন্তকাল এসেছে তাই ফুলের কথা মনে পড়ছে। আজ কি এয়ারপোর্টে এক গুচ্ছ গোলাপ নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল? তুতুল আপন মনে হাসলো, সেটা বোধ হয় আদিখ্যেতা বলে মনে হতো।

একটা হলুদ রঙের গাড়ি তুতুলের গাড়িটাকে ওভারটেক করতে করতে সেই গাড়ির চালক তুতুলের দিকে তাকিয়ে এক চোখ টিপে দিল। লন্ডন শহরে ফুলের শোভার এই এক বিপরীত দিক। একা কোনো নারীকে দেখলে এখানকার পুরুষরা অনেকেই কোনো না কোনো যৌন কৌতুকের চেষ্টা করে। সত্তর মাইল স্পীডে গাড়ি চলছে, তার মধ্যেও এই কৌতুক! এতে ওরা কী আনন্দ পায়? প্রথম প্রথম তুতুলের বিষম রাগ হতো, এখন গা-সহা হয়ে গেছে। সে একটা সান গ্লাস পরে নিল। এতে আর চোখচোখি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। তুতুল আজকাল সাহেবদের মধ্যেও তফাত বুঝতে পারে, ঐ গাড়ির চালকটি ইংরেজ নয়, খুব সম্ভবত ইলিয়ান কিংবা গ্রীক!

হিথরো এয়ারপোর্টের পার্কিং এরিয়ায় গাড়ি রেখে তুতুল এসে দাঁড়ালো কাস্টমস্ এরিয়ার বাইরে নির্ধারিত জায়গাটিতে। ভারতীয়-পাকিস্তানী চেহারায় বেশ কয়েকজন নারী পুরুষ উপস্থিত সেখানে। তুতুল চোখ বুলিয়ে দেখলো তার চেনা নয় একজনও। কিন্তু একজন শালোয়ার কামিজ পরা মহিলা তার চোখে চোখ ফেলে তাকিয়ে রইলো বেশ কয়েক পলক। মহিলাটি যদি অল্পস্বল্প চেনাও হন। তবু তিনি নিজে থেকে এসে কথা না বললে তুতুল আলাপ করতে পারবে না। এই তার দোষ।

প্রথম দিন বিলেতের মাটিতে পা দেবার পর তুতুল আলমকে দেখেছিল এখানে। আজ সে আলমকে নিতে এসেছে। কিন্তু তুতুলের সেই প্রথম আগমনের তুলনায় আজকের দিনটির গুরুত্ব অনেক বেশী। তুতুল তার আবেগ, উত্তেজনা সব চাপা দিয়ে রেখেছে। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে তার মুখোনি শান্ত। তুতুল একা একা সবই সহ্য করতে পারে, তবু তার বারবার মনে হচ্ছে, আজকে সঙ্গে আর একজন কেউ থাকলে ভালো হতো!

পি আই এর প্লেন ল্যান্ড করার খবর জানা গেছে, ঠিক সময়েই ফ্লাইট পৌঁছেছে। যাত্রীরা বেরিয়ে আসছে একে একে, প্রত্যেকের সঙ্গেই প্রচুর মালপত্র। আলমকে দেখা যাচ্ছে না এখনও। আজ আলম আসতেও পারে, নাও আসতে পারে। টেলিফোনে একটি অচেনা কণ্ঠস্বর তুতুলকে জানিয়েছিল, আজ আলমের ফেরার সম্ভাবনা আছে। লোকটি নিজের নামও বলেনি, তুতুল আরও দু’একটা কথা জানতে চেষ্টা করায় সে লাইন কেটে দিয়েছিল।

পঁচিশে মার্চের পর আলম আটকা পড়ে গিয়েছিল লাহোরে। তার পাসপোর্ট, ট্রাভেলার্স চেক সব চুরি গেছে। লন্ডনে আলমের বন্ধুরা বলেছিল, আলম এখন নন এনটিটি, সে আর পাকিস্তান। থেকে বেরুতে পারবে না। গোটা মার্চ মাস জুড়েই ঢাকায় সাংঘাতিক কাণ্ড চলছিল, তারমধ্যেই জোর করে দেশে চলে গেল আলম। কিন্তু ঢাকা থেকে হঠাৎ লাহোরে কেন গিয়েছিল আলম, তা বোঝা গেল না।

পাকিস্তানে ঠিক যে কী ঘটছে, তা বোঝা যাচ্ছে না স্পষ্ট। ব্রিটিশ প্রেস পঁচিশে মার্চের ক্র্যাক ডাউনের খবর ছেপেছিল, তারপর মাঝে মাঝে দু’একটা গণ্ডগোলের ঘটনা। এখন একেবারে চুপ করে গেছে। কিন্তু ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে গিয়ে কলকাতার কাগজগুলো পড়লে মনে হয়, গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে পাকিস্তানে। সামরিক বাহিনীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের লড়াইতে নেমে গেছে গোটা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ। আলমের বন্ধুরা অবশ্য এইসব কাগজের রিপোর্ট বিশ্বাস করে না। তাদের মতে, ভারতীয় কাগজগুলো একশো গুণ বাড়িয়ে লিখছে। হ্যাঁ, আওয়ামী লীগের সঙ্গে ইয়াহিয়া খানের আলোচনা ব্যর্থ হয়ে গেছে বটে, কয়েকটি জায়গায় কিছু সংঘর্ষও হয়েছে, তা বলে একটা দেশের আর্মি শুধু শুধু সিভিলিয়ানদের গুলি করে মারবে, বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ভাগে তা কখনো হতে পারে? চীন, সোভিয়েত, আমেরিকা চুপ করে আছে, শুধু একা একা চাচাচ্ছে পাকিস্তানের জন্মশত্রু ভারত!

তুতুল কলকাতা থেকে মায়ের চিঠি পেয়েছে গত সপ্তাহে, সে চিঠিতে যুদ্ধ বিগ্রহের কোনো উল্লেখ নেই। অবশ্য মা তো কোনো চিঠিতেই দেশের অবস্থা বা রাজনীতির কথা কিছু লেখেন না। ঢাকা থেকে একখানাও চিঠি বা একজনও চেনা মানুষ লন্ডনে আসেনি গত এক মাসের মধ্যে। আলমও কেন কোনো খবর পাঠাতে পারছে না?

টেলিফোনে কে খবরটা দিল তুতুলকে? সে কি শুধু শুধু তুতুলকে এয়ারপোর্টে পাঠাবার জন্য প্র্যাকটিক্যাল জোক করেছে? এরকম একটা খবর পেলে তুতুলের না এসেও উপায় নেই।

প্রায় সব যাত্রীই তো বেরিয়ে এলো, আর বোধ হয় সম্ভাবনা নেই আলমের আসার। তবু তুতুলকে শেষ পর্যন্ত দেখতে হবে। তার চোখ জ্বালা করছে।

কিছুদিন ধরেই শরীরটা খারাপ যাচ্ছে তুতুলের। মাথার মধ্যে চিড়িক চিড়িক করে একটা ব্যথা হয়। একদিন সে কয়েক সেকেন্ডের জন্য জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। তার কাছে এরকম কোনো পেশেন্ট এলে অবিলম্বে তাকে ই ই জি করাতে বলতো তুতুল। কিন্তু নিজের বেলায় সে ভাবছে, আরও কয়েকটা দিন দেখা যাক না, হয়তো দুশ্চিন্তা থেকেই হচ্ছে এরকম। তিন মাস আগে তার এফ আর সি এস হয়ে গেছে। কিন্তু সে এক বিচিত্র ডাক্তার, চিকিৎসা শাস্ত্রে এতখানি জ্ঞান অর্জন করেও সে নিজে বিশ্বাস করে না ওষুধ খাওয়ায়।

দরজা দিয়ে হঠাৎ আলমকে বেরিয়ে আসতে দেখে তুতুলের শুধু বুক কেঁপে উঠলো না, মাথার মধ্যে ঝনঝন করতে লাগলো। সে চোখ বুজে মনের জোর আনবার চেষ্টা করলো, এসময় তার অজ্ঞান হয়ে গেলে কিছুতেই চলবে না।

এই এক মাসের মধ্যেই অনেক রোগা হয়ে গেছে আলম, তার সুটটা ঢলঢলে মনে হচ্ছে। এমনিতেই সে লম্বা, এখন আরও যেন ঢ্যাঙা দেখাচ্ছে তাকে। একজন অত্যন্ত সুপুরুষ ও সুসজ্জিত ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলতে বলতে এগোচ্ছে আলম। তাকে কেউ নিতে এসেছে কি না, তা সে তাকিয়েও দেখছে না।

তুতুল ভিড় ছেড়ে বাইরে চলে এলো। আলমের অতি নাটক করার অভ্যেস আছে। হয়তে হঠাৎ সে তুতুলের কোমর দুহাতে ধরে শূন্যে তুলে ফেলবে। লোকজনের সামনে তুতুলের লজ্জা করে।

তুতুলকে দেখে আলম এমনই অবাক হয়ে গেল যে কোনো রকম নাটক করার বদলে সে বেশ কয়েক মুহূর্ত ভুরু কুঁচকে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর আস্তে আস্তে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো, কী রে, তুলতুলি, তুই বুঝি ভেবেছিলি, আমি মরে গেছি?

ঠোঁটে ঠোঁট চেপে তুতুল চুপ করে রইলো।

এগিয়ে এসে আলম তুতুলের থুতনিটা আলতো করে ছুঁয়ে বললো, এই দ্যাখ, আমি কোয়াইট অ্যালাইভ অ্যান্ড কিকিং। তবে আর একটু হইলেই দিত সাবাড় করে। তুই কী করে জানলি যে আমি আজ ফিরবো? কে তোকে খবর দিল?

তুতুল এখনও কোনো কথা বলতে পারছে না। তার মাথার মধ্যে ঝনঝনানি থামে নি। আলমের সঙ্গী ভদ্ররলোকটি বললেন, আমি তাহলে যাই। আচ্ছা, গুড বাই! আলম বললো, না, না, দাঁড়ান, আপনাকে ড্রপ করে দেবো। এই তুতুল তুই গাড়ি এনেছিস তো? আলাপ করায়ে দিই, আমার বান্ধবী তুতুল, এর একটা গালভরা ভালো নামও আছে ডক্তর বহ্নিশিখা সরকার, এফ আর সি এস! আর ইনি শাজাহান চৌধুরী, ইন্ডিয়ান সিটিজেন, অ্যাকচুয়ালি কলকাতার মানুষ, লন্ডনে সেটল করেছেন, ব্যবসার সূত্রে ওয়েস্ট পাকিস্তান। গিয়েছিলেন, প্লেনে আলাপ হলো।

শাজাহান চৌধুরী সালাম জানাবার বদলে হাত জোড় করে নমস্কার করলেন তুতুলকে। তারপর বললেন, কেন শুধু শুধু বদার করবেন, আমি টিউব নিয়ে চলে যাবো, মালপত্র বেশি।

আলম বললো, না, না, আপনার বাসা আমাদের পথেই পড়বে।

গাড়ি স্টার্ট দেবার পর তুতুল প্রথম কথা বললো। সে মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করলো, কী। হয়েছিল লাহোরে?

আলম একটা সিগারেট ধরিয়ে বললো, শস্তা থ্রিলারের মতন ব্যাপার স্যাপার বুঝলি! যা ঘটেছে তা যদি আমি বলি, শুনলে মনে হবে গাঁজাখুরি গল্প। কিন্তু আমাকে পাঁচে ফেলার একটা প্ল্যান যে করা হয়েছিল তাও ঠিক!

আলম বসেছে সামনের সীটে, তুতুলের পাশে। পিছনে শাজাহান। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এই গোলমালের মধ্যে ঢাকা থেকে লাহোরে চলে এলেন কেন?

আলম হেসে বললো, সেইটাই মিষ্টি নাম্বার ওয়ান। ঢাকায় এত উত্তেজনা, ছাত্রদের পাল্লায় পড়ে শেখ সাহেব এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এই ঘোষণা করে দিয়েছেন। সেরকম সময় আমার ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। আমি লাহোরে যেতে যাবো কোন দুঃখে। কিন্তু ঠিক চব্বিশ তারিখ আমার নামে একটা টেলিগ্রাম এলো, আমার জাফরমামা খুব অসুস্থ, আমাকে একবার দেখতে চান। এই জাফরমামা প্রায় আমার বাবার মতন। ছোটবেলায় আমি মামার বাড়িতেই মানুষ হয়েছি। বিজনেসের জন্য জাফরমামাকে মাঝে মাঝে করাচী-লাহোরে গিয়ে থাকতে হয়। এরকম একটা টেলিগ্রাম পেলে আমি না গিয়ে পারি কী করে? মামার অসুখ, খবর পেয়েও আমি যদি না যাই, আমি আবার বিলেতি ডিগ্রিওয়ালা ডাক্তার, তা হলে আমি নিমকহারাম হয়ে যাবো না? সত্যি কথা বলতে কী, আমার যেতে ইচ্ছা করছিল না। পঁচিশ মার্চের মধ্যেই একটা কিছু হেস্তনেস্ত হয়ে যাবার কথা? তবু সেইদিন সকালের ফ্লাইটেই আমাকে লাহোরে যেতে হলো।

শাজাহান বললেন, পঁচিশে মার্চ রাত্তিরেই ঢাকা শহরে অন্তত হাজার খানেক মানুষ মারা গেছে।

আলম বললো, তার বেশী ছাড়া কম না। আমার এক বন্ধু, ইত্তেফাকের সাংবাদিক ছিল, সেও মারা গেছে শুনেছি।

তুতুল জিজ্ঞেস করলো, তোমার পাসপোর্ট কোথায় হারালে?

আলম বললো, লাহোর এয়ারপোর্টে নেমে দেখি একজন লোক আমার নাম লেখা একটা বোর্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটারে আমি চিনি না। আমি যে সেই ফ্লাইটেই আসবো তা জানাইনি, আন্দাজে ধরে নিয়েছে। লোকটা পাঞ্জাবী, ভাঙাভাঙা বাংলা জানে, সে বললো, মামুর কম্পানিতে চাকরি করে। কিন্তু সে কোনো গাড়ি আনেনি, ভাড়া করে রেখেছে একটা ট্যাক্সি। তাইতেই আমার সন্দেহ হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু আমি শুধু ভাবছিলাম, মামুর সাথে আমার শেষ দেখা হবে কি না। মামুকে একটু ভালো দেখলেই ঢাকায় ফিরে যাবো। ট্যাক্সিটা যখন জুবিলি পার্কের পাশ দিয়ে যাচ্ছে, হঠাৎ একটা পিকিউলিয়ার ব্যাপার হলো। একটা পুলিশের গাড়ি স্টেশানারি ছিল, হঠাৎ সেটা চলতে শুরু করলো, তারপরই আমাদের ট্যাক্সির সাথে হেড অন কলিশন। আমি ডেফিনিট যে অ্যাকসিডেন্টটা কনককটেড! পুলিশের গাড়িটা ইচ্ছে করে ধাক্কা মেরেছে।

অ্যাকসিডেন্টের কথা শুনেই তুতুল চকিতে আলমের দিকে তাকালো।

আলম সঙ্গে সঙ্গে বললো, না, আমার লাগেনি। সেরকম কিছুই হয়নি। আমি শুধু একটা গুতা খেয়েছিলাম।

তুতুল তবু বুঝতে পারলো, আলমের কণ্ঠস্বর একটু দুর্বল হয়ে গেছে। মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখার চেষ্টা করলেও সে যে সম্পূর্ণ অভাবিত কোনো দারুণ সংকটের মধ্যে পড়েছিল, তা লুকোতে পারছে না।

আলম বললো, তারপরই পুলিশগুলো এসে ট্যাক্সি থেকে ড্রাইভারকে টেনে নামালো। কিন্তু ঐ ড্রাইভারের খুব একটা দোষ ছিল না, কিন্তু আমি তর্ক করতে চাইনি, আমি শুধু বলেছিলাম, আমাকে তাড়াতাড়ি যেতে হবে। আর একটা ট্যাক্সি ধরার জন্য আমি নেমে দাঁড়ালাম। বুঝলে, লাহোরে তো সহজে ট্যাক্সি পাওয়াও যায় না…এর মধ্যে সেখানে ভিড় জমে গেছে, একজন। পুলিশ অফিসার আমাকে বললো, ঐ ট্যাক্সি ড্রাইভারের সাথে আমাকেও থানায় যেতে হবে। বোঝো ঠ্যালা! আমি কেন থানায় যাবো? এইসব গণ্ডগোলের মধ্যে দেখি যে আমার হ্যাঁন্ডব্যাগটা নেই। তার মধ্যে আমার পাসপোর্ট, ট্রাভলার্স চেক, রিটার্ন টিকিট সব কিছু।

শাজাহান জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাগটা আপনার হাতে ছিল?

–না, ট্যাক্সিতে রাখা ছিল। তখন আমাকে যেতেই হলো থানায়, ডাইরি করতে তো হবেই। এর মধ্যে সেই যে লোকটা আমায় এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে গিয়েছিল, সে সরে পড়েছে। দেন ওনলি আই স্মেট র‍্যাট! পুরো ব্যাপারটাই একটা ট্র্যাপ। ক্যান ইউ বিলিভ ইট, থানায় নিয়ে যাবার পর আমাকে ডায়েরি করতে দিল না, আমাকে গারদে ভরে দিল! কোনোরকম কারণ দেখালো না, কিছু না। আমি একটা টেলিফোন করতে চাইলাম, তাও দেবে না।

–আপনার মামার অসুখের কথাটা মিথ্যে?

–সেটা অনেক পরে জানতে পেরেছি। অসুখ বিসুখ কিচ্ছ না। জাফরমামা ঐ টেলিগ্রাম পাঠান নাই, তিনি কিছু জানেনও না। পাকিস্তান ইন্টেলিজেন্সের কারবার। তারা ঠিক খবর নিয়েছিল যে ঐ জাফরমামার গুরুতর অসুখের কথা জেনেই আমি ঢাকা থেকে ছুটে আসবো। ইন ফ্যাকট ওরা আমার সম্পর্কে অনেককিছুই জেনেছিল আগে থেকে। সন্ধেবেলা একজন ইন্টারোগেট করতে এলো আমাকে, এসেই বললো, আপনি ডাক্তারি করেন না পলিটিকস করেন? লন্ডনে আপনি একটা বাংলা আর একটা ইংরেজি কাগজের সাথে কানেকটেড, আপনাদের কাগজে ইস্ট পাকিস্তানের অটোনমি দাবি করা হয়েছে।

তুতুল জিজ্ঞেস করলো, তোমাকে মেরেছে?

–না, মানে, ফিজিক্যাল টরচার বিশেষ করে নাই।

–বিশেষ করেনি মানে, কিছু করেছে? কোথায় মেরেছে?

–সে এমন কিছু না। পরে বলবো। শোনো, তার চেয়েও ডেঞ্জারাস ব্যাপার হলো, থানা থেকে পরদিন আমাকে আর একটা বাড়িতে নিয়া গেল, সে জায়গাটা যে কী কিছু বুঝলাম না, একটা ব্যারাক বাড়ির মতন, চারদিকে কাঁটাতার দিয়া ঘেরা, চব্বিশ ঘণ্টা আর্মড গার্ড। সেখানে দুইদিন থাকার পরই আমার মনে হলো, এরা আমাকে মেরে ফেলবে। কেউ কিছু জানবে না, গুলি করে গোর দিয়ে দেবে। আমার পাসপোর্ট নাই, কোনো আইডেনটিটি নাই, কেউ আমার খোঁজও করবে না লাহোরে। ওরা যতবার আমাকে ইন্টারোগেট করতে আসে, আমি আমার ব্যাগটার কথা তুললেই ওরা হেসে উড়িয়ে দেয়। একজন তো বলেই ফেললো, আপনার আর পাসপোর্ট দরকার হবে না! তখন সত্যি ভয় পেয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, আর বাঁচার কোনো উপায় নাই!

তুতুলের পিঠে হাত রেখে আলম আবেগ চাপবার চেষ্টা করে বললো, সত্যি ভেবেছিলাম, তোমার সাথে আর দেখা হবে না।

তুতুল জিজ্ঞেস করলো, একজন যে আমাকে টেলিফোনে খবর দিল, তোমার পাসপোর্ট টাকা পয়সা হারিয়ে গেছে, সে কে! সেই লোকটি জানলোই বা কী করে? সে বলেছিল, আমি আলমের বন্ধু, লাহোর থেকে এসেছি!

–শোনো না ব্যাপারটা। সেইই লোকের জন্যই তো বেঁচে গেলাম। যে ব্যারাক বাড়িটাতে আমারে আটকে রেখেছিল, সেখানে দু’বেলা শুধু চাপাটি আর সবজি খেতে দিত, চা-টা কিছু না। যে-লোকটা রোজ খাবার দিয়ে যেত, তার বদলে একদিন অন্য একজন লোক এলো। তাকে দেখেই আমার সন্দেহ হলো বাঙালী বলে। সে লোকটাকে আমি কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই সে কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, সার, চিটাগাঙে কী হইতাছে, হুনছেন? তার কাছেই আমি জানতে পারলাম পঁচিশে মার্চের রাত্তিরের ঘটনা। দু’জন বাঙালী আর্মি অফিসারদের কোয়াটারেও সে খাবার দেয়। সেখান থেকে শুনেছে। বাঙালী আর্মি অফিসাররাও পালাবার মতলোব করছে নাকি! সেই কুকটি প্রথমে আমাকে কোনো সাহায্য করতে রাজি হয়নি, সে ভয় পাচ্ছিল, তার ওপরেও নজর রাখা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত একটা উপায় আমার মাথায় এলো। যে লোকগুলো আমায় ইন্টারোগেট করছিল, তাদের কথা শুনে বুঝতে পেরেছিলাম, ওরা আমার সম্পর্কে অনেক কিছু জানলেও একটা খবর জানে না। আমি যে বছর খানেক আগেই ব্রিটিশ সিটিজেনশীপ পেয়ে গেছি, সেটা তারা উল্লেখ করে না। আমি পাকিস্তানী পাসপোর্টও ক্যানসেলড করাই নাই। ব্রিটিশ পাসপোর্ট খানা ঢাকায় রয়ে গেছে, ট্রাভেলার্স চেক ভাঙাবার সুবিধার জন্যই পাকিস্তানী পাসপোর্টখানা লাহোরে যাবার সময় সাথে নিয়েছিলাম।

শাজাহান বললেন, আপনি ব্রিটিশ সিটিজেন হলে তো আপনাকে আটকে রাখার অধিকার ওদের নেই। সে কথা ওদের জানিয়ে দিলেন না কেন?

আলম বললো, সে কথা জানালে, ওরা তখুনি আমাকে মার্ডার করতো। আই ওয়াজ ডেফিনিট অ্যাবাউট দ্যাট। আমাকে ওরা বাঁচিয়ে রেখেছিল শুধু আমার পেট থেকে কথা আদায় করার জন্য। লন্ডন থেকে কোন কোন বাঙালী মুসলমান আওয়ামী লীগকে সাহায্য করে, টাকা। পয়সা তুলে দেয়, সেটাই ওরা জানতে চেয়েছিল। আমার দু’একজন বন্ধুর নাম করে জিজ্ঞেস করেছিল, এরা তো চায়নাপন্থী লেফটিস্ট, এরাও কি শেখ মুজিবকে সাপোর্ট করে? বুঝুন তা। হলে, কতটা ওরা জানে!

তুতুল জিজ্ঞেস করলো, তুমি কী করলে তারপর?

আলম বললো, হঠাৎ আমার মনে পড়ে গেল, ব্রিটিশ ডেপুটি হাই কমিশনে আমার একজন বাঙালী বন্ধু পি আর ও’র কাজ করে। তার নাম মেহেদী আলী ইমাম মিন্টু। সেই মিন্টু আমার পোলাপান বয়েসের বন্ধু। আমাকে একমাত্র সেই বাঁচাতে পারে। কোনো রকমে যদি তারে খবর দেওয়া যায়। ব্যারাকের সেই বাঙালী কুককে কাকুতি-মিনতি করলাম, কোনো রকমে আমার একখানা চিঠি মিন্টুর নামে পোস্ট করে দিতে হবে। আমার মামুরে জানায়ে কোনো লাভ নাই, তিনি কিছু করতে পারবেন না, মিন্টুই ভরসা! এরপর যা একখান কাকতালীয় ব্যাপার হলো, প্রায় অবিশ্বাস্য বলা যায়। আল্লার বোধ হয় হঠাৎ নেক নজর হয়েছিল আমার উপর। আমার চিঠিখানা মিন্টু যখন হাতে পেল, তার ঠিক দু’ঘণ্টা পরেই তার লন্ডনে আসার কথা। তাতে খুব সুবিধা হয়ে গেল। মিন্টু লন্ডনে পৌঁছেই ফরেন অফিসকে সব জানালো। পাকিস্তান হাই কমিশনে গিয়েও হুমকি দিল যে কোনো ব্রিটিশ সিটিজেনকে যদি এরকম ভাবে ডিটেইন করা হয়, তা হলে সে খবরের কাগজে সব ফাঁস করে দেবে! ঐ মিন্টুই তোমাকে ফোন করেছিল তুতুল! যদি আর দুই তিন দিন দেরি হতো, তা হলে বোধ হয় আমারে আর দেখতে পেতে না। সেই বাঙালী কুকটি অ্যারেস্টেড হয়ে যায় পরের দিনই।

শাজাহান বললেন, থ্যাংক ইয়োর স্টারস্। সত্যিই আপনি খুব জোর বেঁচে গেছেন। আমি তো আর্মির সঙ্গে সাপ্লাইয়ের ব্যবসা করি, আর্মির অফিসারদের পার্টি দিতে হয় মাঝে মাঝে। তাদের কাছ থেকে কিছু কিছু যা কথা শুনেছি, হরিবল, আনথিংকেবল! বাঙালীদের ওপর তাদের অসম্ভব রাগ। তারা গর্ব করেই বলেছে যে এবার ইস্ট পাকিস্তান থেকে ওয়ান ফোর্থ পপুলেশন কমিয়ে দেবে! যত পারে মারবে। বাকিদের তাড়িয়ে দেবে ইন্ডিয়ায়। হিন্দুদের সরাতে পারলেই তো কমে যাবে অনেক। আওয়ামী লীগের সাপোর্টারদের খুঁজে খুঁজে বার করে কুকুরের মতন গুলি করবে! এ তো জেনোসাইড!

আলম জিজ্ঞেস করলো, ওখানে মুক্তিযোদ্ধারা নাকি খুব জোর ফাঁইট দিচ্ছে। সে সম্পর্কে শুনেছেন কিছু?

শাজাহান বললেন, আর্মির লোকরা হাসি ঠাট্টা করে তাদের নিয়ে। চট্টগ্রামের বাঙালী

রেজিসটেন্স নাকি তারা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে এর মধ্যেই। ঢাকায় এক হাজার কলেজের ছাত্রকে মেরেছে। ওদের মতে, পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্ররা সবাই ইন্ডিয়ার এজেন্ট। তাদের মরাই উচিত। শুনুন আলম সাহেব, আপনাদের পূর্ব পাকিস্তান যদি আর একটা ভিয়েৎনাম হয়ে ওঠে, তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।

আলম বিবর্ণ মুখে বললো, এক হাজার ছাত্রকে মেরেছে? গর্ব করে বললো এই কথা? নিজের দেশের ছেলেদের–আপনাকেই বা বললো কেন এই কথা?

শাজাহান বিচিত্রভাবে হেসে বললেন, আমি বিলেতে থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে ব্যবসা করি, নামে মুসলমান, সুতরাং ইন্ডিয়ান সিটিজেন হলেও ধরেই ওরা নিয়েছে আমি অ্যান্টি ইন্ডিয়ান, অ্যান্টি হিন্দু হবোই! অনেকেই তো তাই মনে করে।

শাজাহান সাহেবের বাড়ি সাউথ হ্যাঁরোতে, তাঁর নামার সময় এসে গেল। সুটকেস নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে তিনি পকেট থেকে নিজের একটা কার্ড বার করলেন। সেটা আলমের হাতে দেবার আগে তিনি তুতুলের মুখের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে বললেন, অনেকক্ষণ থেকে মনে করার চেষ্টা করছি তোমাকে আগে কোথায় দেখেছি! প্রতাপ মজুমদার তোমার কে হন?

তুতুল বিস্মিত ভাবে বললো, উনি আমার মামা!

শাজাহান বললেন, তোমাকে অনেক ছোট বয়েসে দেখেছি। আমি ত্রিদিবের বন্ধু ছিলাম। তুমি প্রতাপবাবুর ছেলে পিকলুর সঙ্গে ত্রিদিব-সুলেখাদের বাড়িতে আসতে মাঝে মাঝে। পৃথিবীটা আসলে খুব ছোট, তাই না?

তুতুল বিস্ফারিত চোখে আলমের দিকে তাকিয়ে বললেন, ও হাঁ, তাঁ, ত্রিদিব মামাও তো এদেশেই আছেন। আপনার সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে?

সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শাজাহান আলমকে বললেন, এই কার্ডে আমার ফোন নাম্বার আছে, আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখলে খুশী।

তারপর তিনি আর দাঁড়ালেন না।

আলম শরীর এলিয়ে দিয়ে বললো, এখন দুইদিন আমি টানা ঘুমাবো। কোথায় যাবো রে। তুলতুলি, গোল্ডার্স গ্রীনে তোর অ্যাপার্টমেন্টে আমারে থাকতে দিবি?

তুতুল বললো, যেতে পারো। তোমার অ্যাপার্টমেন্টটাও আমি ঠিকঠাক করে রেখেছি। যা ময়লা জমেছিল, এই রবিবার ভ্যাকুয়াম ক্লিনার চালিয়েছি সারা দিন!

আলম হাই তুলে বললো, অর্থাৎ, তোর বাসায় আমাকে নিতে চাস না। একা একা আমার বাসায় নির্বাসন দিতে চাস, তাইই তো? কী মাইয়ার পাল্লাতেই পড়েছি, সিংহের থাবা থেকে কোনোক্রমে বেঁচে ফিরে আসলাম, তাও একটা মিষ্টি কথা বলে না, একটু আদর করে না।

–কে বলেছিল এই মাইয়ার পাল্লায় পড়তে? আরও কত সুন্দরী মেয়ে তোমার জন্য পাগল ছিল, শিরিন বেচারি কত দুঃখ পেয়েছে।

–ইচ্ছে করে কি আর পড়েছি! গ্রহের ফের, একেই বলে গ্রহের ফের!

–এখনো সময় আছে গ্রহের ফের কাটাবার! বলল, নাসিম-রেবেকাদের অ্যাপার্টমেন্টে নামিয়ে দেবো? ওরা কত খুশী হবে তোমায় পেলে!

হঠাৎ তুতুলের পিঠে একটা কিল মেরে আলম বললো, তুমি আমাকে কাটিয়ে দিতে পারলেই খুশী হও, তাই না?

তুতুল আলমের দিকে মুখ ফিরিয়ে পাতলা করে হেসে বললো, হ্যাঁ খুশী হইই-তো! তুমি জানো না?

আলম এবার তুতুলের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ে গাঢ় স্বরে বললো, তুতুল, তুমি কি স্বাধীনতার থেকেও বেশী দূরে?

তুতুল রক্তিম মুখে বললো, এই প্লীজ, ওঠো, আমি ক্লাচ দিতে পারছি না। লোকে দেখছে, লোকে দেখছে!

আলম বললো, লন্ডন শহরে লোকে দেখলেও কিছু আসে যায় না। আর কতদিন আমাকে দূরে দূরে রাখবে? প্রথমে বললে, মায়ের ভীষণ আপত্তি, কিছুদিন অপেক্ষা করা যাক। তারপর বললে, আগে এফ আর সি এস হয়ে যাক। তারপর বললে, এক সাথে দেশে ফিরে…। তুতুল, লাহোরে আটক থাকার সময় সর্বক্ষণ কী ভেবেছি জানো? একেবারে খাঁটি সত্যি কথা বলছি। এতদিন আমি পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য অনেক কাজ করেছি, খেটেছি, এ কাজের জন্য যে হঠাৎ প্রাণটা চলে যেতে পারে তা কি আমি জানতাম না? সে জন্য তো তৈরিই ছিলাম। কিন্তু লাহোরের ঐ কয়েদখানায় বসে মনে হতো, স্বাধীনতা আমি দেখে যাবো কি না জানি না। কিন্তু তুতুলের সঙ্গে আর দেখা হবে না? অন্তত আর একবার…। সেইজন্যই বাঁচার চেষ্টাটা দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল। তুমি বলবে, মানুষ বাঁচার চেষ্টা করে শুধু নিজের জন্য। না, সব সময় তা হয় না, আমি এবারে সেটা অনুভব করেছি। যাক, ছাড়া তো পেয়ে গেলাম। শুনছি, স্বাধীনতার যুদ্ধও পুরোপুরি শুরু হয়ে গেছে। একদিন না একদিন স্বাধীনতা আসবেই। কিন্তু তুমি কি কোনোদিন আমার হবে না? এরকম দূরে দূরেই থাকবে?

–আমি বুঝি দূরে দূরে আছি? তুমি কিছু বোঝে না!

–তুমি কেন সম্পূর্ণ আমার হবে না? শোনো, আমি বড় ক্লান্ত, ভিতরটা একেবারে ফাঁকা হয়ে আছে। তোমার কাছে আমাকে কয়েকটা দিন থাকতে দাও। বিশ্বাস করো, আমি আর কিছু চাই না, শুধু তোমার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে থাকবো, অনেক কথা আছে। প্লিজ, গাড়িটা ঘোরাও।

–উঠে বসো, লক্ষ্মীটি। তোমাকে ওরা মেরেছে কিনা সত্যি করে বলো। কোথায় মেরেছে?

–গাড়ি না ঘুরিয়ে কথা ঘোরাচ্ছো? তোমার বাসার এক কোণায় আমাকে একটু আশ্রয় দিতে পারবে না? বুঝেছি! থাক, আর বলবো না!

–কী বুঝেছো?

–ঐ শাজাহান সাহেব তোমায় পিকলুদার কথা বললেন, তাই শুনেই তোমার মন খারাপ হয়ে গেল। তোমার মুখ দেখেই টের পাওয়া যাচ্ছে। পিকলুদাকে তুমি কিছুতেই ভুলতে পারো না! তোমার পিকলুদা খুব চমৎকার মানুষ ছিল জানি, তোমায় খুব ভালোবাসতো, বাট হি ইজ ডেড লং টাইম এগো! আমার প্রতিদ্বন্দ্বিতা একজন মৃত মানুষের সঙ্গে। দিস ইজ আনফেয়ার! একজন মৃত মানুষের সঙ্গে যুদ্ধ করে কেউ কি জিততে পারে!

তুতুল আলমের চুলে একটা হাত রেখে বললো, তুমি কিছু জানো না, কিচ্ছু বোঝো না! পিলুদার কথা মনে পড়লে আমার এখন আর কষ্ট হয় না, মনটা ভালো লাগায় ভরে যায়। পিলুদা আমার সেই বয়েসেই থেমে আছে, আমার এখনকার সঙ্গী সে নয়। পিকলুদার সঙ্গে তোমার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকতে পারে না! গাড়ির মধ্যে শুয়ে থাকলে কি রাস্তা দেখা যায়? গাড়িটা কোন দিকে যাচ্ছে তাও তোমার খেয়াল নেই। ওঠো, আমরা প্রায় এসে গেছি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *