১২. সমুদ্রবিজ্ঞান

সমুদ্রবিজ্ঞান

আজ আমার আবৃত্তির ক্লাস আছে। নতুন একটি আবৃত্তি ক্লাবে জয়েন করেছি সেদিন। কবিতার প্রতি অন্যরকম ভালোলাগা থেকেই মূলত আবৃত্তি ক্লাবে আসা। সারা দিন গুনগুন করে কবিতা আওড়াই। যেদিন থেকে আবৃত্তি শিখতে শুরু করেছি, সেদিন থেকে আমার মধ্যে অদ্ভুত কিছু ব্যাপার দেখা দিয়েছে। কয়েকদিন আগের কথা। সাজিদসহ ফিরছিলাম সদরঘাট থেকে। দেখতে গিয়েছিলাম বুড়িগঙ্গা নদী। একটি জীবন্ত, সতেজ আর শুদ্ধ স্রোতের নদী মানুষের অত্যাচারে কীভাবে ধুকেধুকে মরে যায়, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এই বুড়িগঙ্গা।

আসার পথে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে খুব সুন্দর একটি বিলবোর্ড দেখলাম। সম্ভবত কোনো বেসরকারি এনজিওর বিলবোর্ড হবে। সাধারণত কোম্পানি আর কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর বিলবোর্ড হয় বলে জানতাম; কিন্তু এরকম এনজিওরও বিলবোর্ড থাকে সেটি আমি ওইদিনই জানতে পারলাম। যাই হোক, ওই বিলবোর্ডে বেশ সুন্দর কিছু কথা লেখা ছিল। মানবসেবাধর্মী কথা। কথাগুলোতে চোখ পড়ে যাওয়ায় আমি থমকে দাঁড়িয়ে সেগুলোর ওপর চোখ বুলাতে লাগলাম। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল। আমি ওদিকে তাকিয়েই আছি। বিলবোর্ডের দিকে তাকিয়ে আমাকে এরকম হাঁ হয়ে থাকতে দেখে সাজিদ বলল, ওটি কবিতা নয়, বিলবোর্ড। এত মনোযোগ দিয়ে পড়ার কিছু নেই।

ওর কথা শুনে আমার সংবিৎ ফিরল। খেয়াল করলাম সে আমার দিকে বেশ বিরক্ত চেহারা নিয়ে তাকিয়ে আছে। আমার দিকে তাকিয়ে সে বলল, মানুষ তো বায়োস্কোপের মধ্যেও এভাবে চোখ ডুবিয়ে দেয় না, তুই বিলবোর্ডে যেভাবে ডুব দিয়েছিস।

আমার এই হয়েছে এক সমস্যা। সবখানে আমি আজকাল সাহিত্য খুঁজে বেড়াই। আমার সেই খোঁজাখুঁজি বিলবোর্ড থেকে শুরু করে ঝালমুড়ির ঠোঙা পর্যন্ত বিস্তৃত।

সকাল থেকে আমি একটি কবিতাই আবৃত্তি করে যাচ্ছি। নির্মলেন্দু গুণের স্ববিরোধী কবিতাটি।

আমি জন্মেছিলাম এক বিষণ্ণ বর্ষায়
কিন্তু আমার প্রিয় ঋতু বসন্ত।
আমি জন্মেছিলাম এক আষাঢ় সকালে
কিন্তু ভালোবাসি চৈত্রের বিকেল।
আমি জন্মেছিলাম দিনের শুরুতে
কিন্তু ভালোবাসি নিঃশব্দ নির্জন নিশি।
আমি জন্মেছিলাম ছায়াসুনিবিড় গ্রামে
ভালোবাসি বৃক্ষহীন রৌদ্রদগ্ধ ঢাকা।
জন্মের সময় আমি খুব কেঁদেছিলাম
এখন আমার সবকিছুতেই হাসি পায়।
আমি জন্মের প্রয়োজনে ছোট হয়েছিলাম
এখন মৃত্যুর প্রয়োজনে বড় হচ্ছি।

কবি নির্মলেন্দু গুণের একটি ব্যাপারের সাথে আমার বেশ মিল পাচ্ছি। কবি জন্মেছেন বর্ষায়; কিন্তু বর্ষার বদলে তার পছন্দের ঋতু হলো বসন্ত। বাবার কাছে শুনেছি, আমি নাকি জন্মেছিলাম ফাগুন মাসে। ফাগুনের আগুন লাগা সময়ে যখন গাছগুলো কৃষ্ণচূড়া ফুলে রক্তাক্ত লাল হয়ে ওঠে, ঠিক ওই সময়টাতেই নাকি আমার জন্ম। ফাগুন মাসে জন্মালেও লাল রং আমার একদম অপছন্দ। বিচ্ছিরি লাগে। নির্মলেন্দু গুণের সাথে আমার এরকম অপূর্ব মিল দেখে আমি যারপরনাই আনন্দিত।

সাজিদ তার বেডের ওপরে শুয়ে ম্যাগাজিন পড়ছে। আমি যে এত সুন্দর করে কবিতা আবৃত্তি করছি সেদিকে তার কোনো ভুক্ষেপই নেই। সবকিছুতেই তার এই নির্মোহ ভাবটি আমার কাছে বিরক্তিকর লাগে।

আমি তাকে উদ্দেশ্য করে বললাম, শুনছিস?

সে মুখের ওপর থেকে ম্যাগাজিন না সরিয়েই বলল, বল।

আমার সাথে না নির্মলেন্দু গুণের একটি ব্যাপারে বেশ মিল আছে।

সাজিদ বলল, হুম। এটি বলেই সে আবার চুপ মেরে গেল। আমি আবার বললাম, কোন ব্যাপারে মিল আছে শুনবি না?

বল।

আমি তার বেডে এসে বসলাম। বললাম, মুখের ওপর এরকম ছাতা টেনে রাখলে কথা বলা যায়?

সে এবার ম্যাগাজিনটি সরিয়ে আমার দিকে তাকাল। বলল, ঠিক আছে, বল।

আমি এবার একটু নড়েচড়ে বসলাম। নিজের গল্প অন্যকে শোনাতে আমার বেশ লাগে। বললাম, কবি নির্মলেন্দু গুণের নাকি বর্ষাকাল পছন্দ না। অথচ তিনি জন্মেছেন ঘোর বর্ষায়।

সাজিদ বলল, হুম।

তার সাথে আমার একটি মিল রয়েছে। আমি জন্মেছি ফাগুন মাসে; কিন্তু লাল রং আমার একদম অপছন্দ। বিচ্ছিরি।

ফাগুনের সাথে লাল রঙের কী সম্পর্ক?, জিজ্ঞেস করল সাজিদ।

ওমা! ফাগুন মাসেই তো কৃষ্ণচূড়া ফুল ফোটে, তাই না?

তো? কৃষ্ণচূড়া ফুল কি তুই পছন্দ করিস না?

তা তো করি।

তাহলে?

লাল রংটি কেমন যেন অপছন্দের।

সাজিদ জোরে একটি নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, ফাগুন মাসের সাথে লাল রঙের কোনো সম্পর্ক নেই। ফাগুন মাসে অনেক অনেক ফুল ফোটে। সেই ফুলগুলোর কোনোটির রং সবুজ, কোনোটি নীল। কোনোটি আবার হলুদ। তার মধ্যে কৃষ্ণচূড়া হলো টকটকে লাল। কবির অপছন্দ হলো বর্ষাঋতু, আর তোর অপছন্দ কেবল একটি নির্দিষ্ট রং। কবির সাথে তাহলে তোর মিল কোথায়?

সাজিদের সাথে আমি কখনো খুব বেশি তর্কে যাই না। আমার ধারণা পৃথিবীতে যদি সেরা তিনজন কাঠখোট্টা তোক নির্বাচন করা হয়, তার মধ্যে সাজিদের নামও থাকবে। দুনিয়ার সবকিছু নিয়েই তার বিশ্লেষণ থাকে। সেই বিশ্লেষণগুলো আবার যুক্তি, দর্শন আর বিজ্ঞাননির্ভর। একজন সুস্থ মানুষের মাথা ধরিয়ে দেওয়ার জন্যে এরকম একজন লোকই যথেষ্ট।

দ্রুতই প্রসঙ্গ পাল্টানো উচিত। তাকে বললাম, হ্যাঁ রে, তোর পছন্দ কীসে? মানে, প্রকৃতির কোন জিনিসটি তোর বেশি পছন্দের?

সাজিদ আবারও চুপ মেরে গেল। হঠাৎ করে ভিন্ন প্রসঙ্গে চলে যাওয়াতে সে হয়তো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছে। আবার বললাম, তোর কি সমুদ্র দেখতে ভালো লাগে?

সে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

আমি বললাম, চল, তাহলে আমরা একদিন সমুদ্র দেখতে যাই।

আমার এই প্রস্তাবে সাজিদ রাজি হয়ে গেল। বললাম, কোথায় যাবি? কক্সবাজার না সেন্ট মার্টিন?

সে কিছুক্ষণ ভেবে এরপর বলল, সেন্ট মার্টিন যাওয়া যায়।

শীতের এই সময়টায় সেন্ট মার্টিনে থাকে দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড়। সমুদ্রবিলাসী মানুষগুলো এই মৌসুমে দল বেঁধে এখানে আসে। স্বচ্ছ নোনা জল, পাথর বিছানো পথ আর দৃষ্টিসীমাজুড়ে জলতরঙ্গ—পৃথিবী যেন তার সব সৌন্দর্যের ডালাহাতে দাঁড়িয়ে আছে এই দ্বীপে।

এমন সময়ে টিকেট পাওয়া খুবই দুরূহ ব্যাপার। তবে আমাদের থিওরি অফ এভ্রিথিং বালক মাশুককে টিকেটের ব্যবস্থা করতে বলামাত্রই সে বলল, এটি কোনো ব্যাপার হলো দোস্ত?

মাশুককে আমরা থিওরি অফ এভ্রিথিং বলে ডাকি। আমাদের যার যা সমস্যা, সবকিছুর সমাধান মাশুকের কাছে পাওয়া যাবে। কারও ক্লাসে প্রক্সি দেওয়া লাগবে? মাশুককে বললেই কাজ হয়ে যায়। ডিপার্টমেন্ট চেয়ারম্যানের কাছে কোনো অভিযোগ করা লাগবে? মাশুকই ভরসা। ডিপার্টমেন্টে কোনো প্রোগ্রামের আয়োজন করা লাগবে? মাশুক একাই একশো। কারও কারও মতে, দুনিয়ায় এমন কোনো সমস্যার জন্ম হয়নি, যেটার সমাধান মাশুকের কাছে নেই। সেই থেকে মাশুকের নাম হয়ে গেছে থিওরি অফ এভরিথিং।

মাশুক ঠিক ঠিক আমাদের জন্য তিনটে টিকেট জোগাড় করে নিয়ে এলো। সে কীভাবে যেন পেরে যায় সবকিছু। সে যখন টিকেট নিয়ে এলো, তখন আমি বেশ বিস্ময় নিয়ে বললাম, কীভাবে ম্যানেজ করলি?

মাশুক তার সেই কমন ডায়ালগ ছেড়ে বলল, এটি কোনো ব্যাপার হলো দোস্ত?

আসলেই তার কাছে এটি কোনো ব্যাপার না। এই কারণেই তার নাম থিওরি অফ এভ্রিথিং।

দু-দিন পর আমরা রওনা করলাম। আমি, সাজিদ আর রাজিব। রাজিবের পরিচয় দিয়ে নিই। পুরো ঢাবি ক্যাম্পাসের সেরা কয়েকজন ফটোগ্রাফারের একজন ও। শুধু ঢাবি বললে অবশ্য ভুল হবে, বাংলাদেশের সেরা ফটোগ্রাফারদের তালিকা করা হলে সেখানেও অনায়েসে ঢুকে পড়বে সে। ফটোগ্রাফিতে আন্তর্জাতিক পুরস্কারও এই বয়সে পকেটে পুরে নিয়েছে। আমার মুখে সেন্ট মার্টিন যাওয়ার কথা শুনেই এক পায়ে খাড়া হয়ে গেল যাওয়ার জন্য।

বাসে করে আমরা ঢাকা থেকে রওনা করলাম। আমাদের বাস যখন টেকনাফে এসে ঢুকল, তখন সন্ধ্যে প্রায়। প্রচণ্ড খিদেয় আমাদের পেটের নাড়িভুড়ি হজম হয়ে যাওয়ার জোগাড়। পাশের একটি হোটেলে ঢুকে খাওয়া-দাওয়া সেরে বের হয়ে এলাম।

আমরা ধরেই নিয়েছিলাম—রাতের সমুদ্রবিলাস উদ্যাপন করতে করতেই আমরা সেন্ট মার্টিন গিয়ে পৌঁছাব; কিন্তু না। এখানে এসে জানতে পারলাম যে, রাতের বেলায় এখান থেকে কোনো জাহাজই সেন্ট মার্টিন যায় না। মহা বিপদ!

আমাদের বন্ধু মাশুক থাকলে এতক্ষণে কোনো না কোনো উপায় নির্ঘাত বের করে ফেলত। জাহাজ না-হলে ট্রলার, ট্রলার না-হলে নৌকায় চেপে সে আমাদের সেন্ট মার্টিন ফেলে আসতই। মাশুকের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিল রাজিব। সে এদিক-ওদিক খোঁজখবর নিয়ে শেষমেশ একটি ট্রলারের সন্ধান পেল যেটি একটু পরেই সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশে ছাড়বে। সাধারণত, এরকম ট্রলারগুলো কতটুকু নিরাপদ সে ব্যাপারে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে বৈকি। তবুও সকল জল্পনা-কল্পনার পরে এই ট্রলারে করে সেন্ট মার্টিন যাওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো।

মাগরিবের সালাত পড়ে এসে ট্রলারে উঠে বসলাম। আমরা একা নই। আরও কিছু সেন্ট মার্টিনগামী যাত্রীও আমাদের সাথে আছে এই ট্রলারে।

দেখতে দেখতে কখন যে নাফ নদী পার হয়ে বঙ্গোপসাগরে এসে পড়লাম তা টের পাইনি মোটেও। ঢেউয়ের আধিক্য আর উপচে পড়ার শক্তিমত্তা দেখেই বুঝলাম যে, আমরা এখন নোনা জলের ওপরে ভাসছি। ঢেউগুলো একটির পর একটি এগিয়ে আসছে আর ভেঙে পড়ছে কূলঘেঁষে। দূরে তাকালে মনে হবে পুরো সমুদ্র দুধে ছেয়ে গেছে। রাতের বেলার সমুদ্র যে এত সুন্দর হয় তা আমি জানতাম না।

আমরা তিনজন বসেছি ট্রলারের সামনের দিকে। এদিক থেকে সমুদ্রটি অন্যরকম লাগছে দেখতে। রাজিব প্রশ্ন করল, আচ্ছা, আমি যতদূর জানি সেন্ট মার্টিনে একশো ভাগ মুসলিম বাস করে। অথচ দ্বীপটির নাম সেন্ট মার্টিন কীভাবে হলো? একজন খ্রিষ্টানের নামে?

রাজিবের প্রশ্ন শুনে মনে হলো—এটি একটি ভালো প্রশ্ন। আস্ত একটি দ্বীপের নাম কীভাবে খ্রিষ্টান ব্যক্তির নামে হয়ে গেল তা জানা জরুরি। উত্তরের জন্য আমরা সাজিদের দিকে তাকালাম। সে তখনো সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরে আমাদের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলল, আমাকে কিছু বলছিলি?

রাজিব বলল, তোমাকেই তো বলছিলাম।

কী বলছিলি?

এই যে এই সেন্ট মার্টিন দ্বীপ, এটার নাম সেন্ট মার্টিন হলো কীভাবে? আমি শুনেছি। এই দ্বীপে নাকি একশো ভাগ মুসলিমের বসবাস। পুরোপুরি মুসলিম অধ্যুষিত একটি অঞ্চলের নাম খ্রিষ্টান কোনো ব্যক্তির নামে, ব্যাপারটি বেশ বেখাপ্পা।

সাজিদ বলল, তোর হঠাৎ এই ব্যাপারটি মাথায় এলো কেন?

সাজিদের পাল্টা প্রশ্নে চুপ হয়ে গেল রাজিব। তাকে চুপ মেরে যেতে দেখে আমার বেশ হাসি পেয়ে গেল। তার মন খারাপ দেখে সাজিদ আবার বলল, তোর ক্যামেরাটি দে।

কেন? জানতে চাইল রাজিব।

তোর একটি ছবি তুলব।

আমার ছবি?

হ্যাঁ।

কেন?

মানুষ তো ফটোগ্রাফারদের ভোলা সুন্দর সুন্দর ছবিই দেখে। মন খারাপের সময়ে ফটোগ্রাফারদের চেহারা যে ব্ল্যাক হোলের মতো অন্ধকার হয়ে যায়, সেটাও তো মানুষের জানা উচিত।

সাজিদের কথা শুনে ফিক করে হেসে ফেলল রাজিব। সম্ভবত চেহারার উপমাটি শুনে সে খুব মজা পেয়েছে। হেসে ফেললাম আমিও। হাসাহাসির পর্ব শেষে সাজিদ আবারও সমুদ্রবিলাসে ডুব দিল। সাঁই সাঁই করে বাতাস বইছে সাগরের বুকে। ট্রলারের দুলুনি খেতে খেতে আমরা ছুটে চলছি। অন্ধকার রাত। এই তল্লাটে কেবল আকাশ আর সাগরের মিতালি।

অনেকক্ষণ পরে রাজিব আবারও প্রশ্ন করে বসল সাজিদকে। বলল, তোমার নাকি সমুদ্র খুব পছন্দের?

হুম।

কেন?

সমুদ্রে একটি বিস্ময় আছে।

সমুদ্রবিজ্ঞান

কীরকম বিস্ময়?

সমুদ্র একই সাথে সুন্দর এবং ভয়ংকর।

যেমন?

সমুদ্রের এই যে বিশালতা, উপচে পড়া ঢেউ, তার বুকে সূর্যের হারিয়ে যাওয়া, নীল জলরাশির উন্মত্ততা, এগুলো হলো সমুদ্রের অপার রহস্য আর সৌন্দর্য। আবার এই সমুদ্র যখন উন্মাতাল হয়ে যায়, সে হয়ে ওঠে বিধ্বংসী আর ভয়ংকর। যে-জলরাশির মাধ্যমে জীবন সঞ্চারিত হয়, সেই জলরাশিই হয়ে ওঠে জীবন হরণের কারণ। খুব অদ্ভুত না?

সাজিদের কথা শুনে রাজিব বেশ অবাক হলো বলে মনে হলো। মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলল, আসলেই অদ্ভুত!

সমুদ্র নিয়ে যে সাজিদ এত দার্শনিকসুলভ চিন্তা-ভাবনা করতে পারে তা আমি জানতাম না। অবশ্য ওর যত দার্শনিকতা সব পেটের মধ্যেই জমিয়ে রাখে। প্রসঙ্গ এসে পড়লেই সেগুলো বের হয়ে আসে।

সমুদ্রের বুক চিরে ছুটে চলেছে আমাদের ট্রলার। সাজিদের ভাষায় ভয়ংকর এই সুন্দরের সাথে এরকম চ্যালেঞ্জ চ্যালেঞ্জ খেলা খেলতে বেশ ভালোই লাগছে আমার।

রাজিব আবারও সাজিদকে উদ্দেশ্য করে বলল, মনে হচ্ছে সমুদ্র নিয়ে তোমার বেশ আগ্রহ আছে?

সাজিদ মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ।

তাহলে তো তোমার ঝুলিতে বেশ চমৎকার-সব গল্প আছে সমুদ্র নিয়ে, তাই না?

সাজিদ আবারও মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। রাজিব বলল, তাহলে তো সেই গল্পগুলো আমাদের সাথে তুমি করতেই পারে। আমার দিকে তাকিয়ে রাজিব আবার বলল, তুমি কী বলল আরিফ?

আমি বললাম, সহমত।

সমুদ্র নিয়ে কোন ধরনের গল্প যে সাজিদ করবে তা আমার জানা নেই। সে বিভিন্ন দেশের সমুদ্রের বুকে ঘুরে বেড়িয়েছে তার বাবার সাথে। সেগুলোর কিছু কিছু গল্প। আমার সাথে সে শেয়ারও করেছিল আগে। পর্তুগিজ জেলেদের সমুদ্র থেকে তিমি মাছ শিকারের কাহিনিটাই সবচেয়ে মজার ছিল। সেটি নিয়ে সাজিদের বাবার লেখা একটি ইয়া বিশাল আর্টিকেলও আছে। সাজিদ সম্ভবত এতক্ষণে ঠিক করে ফেলেছে—সে সমুদ্র নিয়ে কোন ধরনের গল্প করবে। একটু নড়েচড়ে বসে রাজিবকে দিয়েই শুরু করল। বলল, রাজিব, তোকে যদি এখন ধাক্কা দিয়ে ট্রলার থেকে ফেলে দিই, কেমন হবে তাহলে?

রাজিব চোখেমুখে বিস্ময় নিয়ে বলল, কী অদ্ভুত! আমাকে সমুদ্রে ফেলতে যাবে কেন?

আমিও বুঝলাম না ব্যাপারটি। সমুদ্রের গল্পে হঠাৎ করে এরকম ফেলে দেওয়া-দেওয়ি কীভাবে ঢুকল? রাজিবের চেহারার বিষণ্ণতা দেখে হেসে ফেলল সাজিদ। বলল, ভয় পাচ্ছিস কেন? আমি কি সত্যি সত্যিই তোকে ফেলতে যাব নাকি? মজা করে বললাম।

রাজিব বলল, তোমার কোনটি মজা আর কোনটি যে সিরিয়াস সেটি বোঝাই তো দুরূহ ব্যাপার।

আমি মনে করেছিলাম রাজিব খুব সাহসী ছেলে। ফটোগ্রাফারদের বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত, সমুদ্র-অরণ্য চষে বেড়িয়ে প্রকৃতির সবচেয়ে সুন্দর রূপ আর মুহূর্তগুলো ক্যামেরাবন্দী করতে হয়। এরকম কাজ রাজিবের মতো ভীতু টাইপের একটি ছেলেকে দিয়ে কীভাবে সম্ভব হচ্ছে সেটাই এখন আমার কাছে আশ্চর্যের।

সাজিদ বলল, তোদের তাহলে সমুদ্রের গল্পই বলা যাক, কী বলিস রাজিব?

শুরু করো শুরু করো, রাজিব উৎসাহের সাথে বলল।

সাজিদ নড়েচড়ে বসল। এরপর বলতে লাগল, সমুদ্রের অনেক ব্যাপার কম-বেশি আমরা সকলেই জানি। আজ আমি এমন কিছু বলব, যা সম্ভবত তোদের দুজনের কেউই জানিস না।

ওয়াও, বলে চিৎকার দিয়ে উঠল রাজিব। তাকে বেশ উৎসুক আর উৎফুল্ল বলে মনে হচ্ছে। সাজিদ যে নতুন কিছু বলতে যাচ্ছে সেটি নিশ্চিত। সে কখনো একই গল্প দু-বার আমার কাছে বলবে না। তার মানে হলো সে এখন যে-গল্প বলতে যাচ্ছে সেই গল্প আমি আগে শুনিনি। নতুন গল্প শোনার জন্যে আমি নিজেও একপ্রকার উৎসুক হয়ে আছি বলা চলে।

সাজিদ বলতে শুরু করল, সমুদ্রের অপার সৌন্দর্যের মধ্যে একটি হলো তীরে উপচে পড়া ঢেউগুলো। এই ঢেউগুলো নিয়ে অসংখ্য কবিতা লেখা হয়েছে। এই ঢেউয়ের কথা এসেছে গল্প, উপন্যাস আর নাটকেও; কিন্তু যে-ঢেউ সাধারণত আমরা দেখে থাকি সেই ঢেউ ছাড়া আরও এক প্রকার ঢেউ আছে সমুদ্রে। মজার ব্যাপার হলো, এই ঢেউ নিয়ে কোনোদিন কোনো কবিতা লেখা হয়নি। এই ঢেউয়ের কথা কোনোদিন কোনো গল্প, উপন্যাস কিংবা নাটকেও আসেনি। এমনকি, গত শতাব্দীতেও বিজ্ঞানীরা এই ঢেউয়ের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানত না।

রাজিব বেশ অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, সেটি আবার কেমন ঢেউ?

আমি বললাম, ঢেউ তো ঢেউই। ঢেউ আবার দুই প্রকার কীভাবে হয়? হয়, বলল সাজিদ। এই ঢেউয়ের অস্তিত্ব ওপরে নয়, সমুদ্রের গভীরে।

ব্যাপারটি আমি বুঝে উঠতে পারলাম না। সাজিদকে বললাম, তুই বলতে চাইছিস যে সমুদ্রের গভীরেও এক ধরনের ঢেউ তৈরি হয় এবং তা অদৃশ্য থাকে? কেউ দেখতে পায় না?

এক্সাক্টলি, বলল সাজিদ। সমুদ্রের রয়েছে কয়েকটি স্তর। সব স্তরে পানির ঘনত্ব সমান থাকে না। কোনো স্তরে পানির ঘনত্ব কম আবার কোনো স্তরে বেশি। সমুদ্রের গভীরতা যত বেশি, পানির ঘনত্বও তত বেশি। আবার গভীরতা যত কম, পানির ঘনত্বও তত কম হয়।

তো? প্রশ্ন রাজিবের।

তো, সমুদ্রের এসব স্তরের মধ্যে রয়েছে একটি সূক্ষ্ম সংযোগ। বেশি ঘনত্বের পানি যখন কম ঘনত্বের পানির সাথে এসে মেশে, তখন সেখানে একটি ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়।[১]

আমি বললাম, এই ঢেউ চোখে দেখা যায় না?

সাজিদ বলল, না। কেবল পানির লবণাক্ততা এবং তাপমাত্রা পরীক্ষা করেই এই ঢেউয়ের অস্তিত্ব নিরূপণ করা সম্ভব। তাহলে বুঝতেই পারছিস খুব অত্যাধুনিক বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি না হলে এই ঢেউয়ের ব্যাপারে জানা কোনোভাবেই সম্ভব না এবং আরও মজার ব্যাপার হলো, বিজ্ঞানীরা মাত্র কয়েক বছর আগেই এ ব্যাপারে জানতে পেরেছে।

রাজিব বলল, মজার তো!

সমুদ্রের তীব্র বাতাসে আমাদের শরীরে প্রচণ্ড কাঁপনি ধরিয়ে দিল। ভাগ্যিস আমরা ব্যাগে করে চাদর নিয়ে এসেছিলাম। গায়ে চাদর মুড়িয়ে আমরা আবার আড্ডায় মজে গেলাম।

বিস্ময়ের কিন্তু এখানেই শেষ নয়।সমুদ্রের গভীরে রয়েছে এক অদ্ভুত রকমের অন্ধকার।

অদ্ভুত রকমের অন্ধকার?, জানতে চাইল রাজিব।

হ্যাঁ।

কীরকম সেটা?

সূর্য থেকে সাতটি রং সমুদ্রের পানিতে এসে পড়ে। এই সাতটি রং হলো লাল, নীল, বেগুনি, সবুজ, কমলা, আসমানী আর হলুদ।

আমি বললাম, তার মানে রংধনু?

এক্সাক্টলি, বলল সাজিদ। রংধনুর রংগুলো যখন সূর্য থেকে সমুদ্রে এসে পড়ে, তখন সেগুলো সমুদ্রের পানি ভেদ করে গভীরে ঢুকতে থাকে। গভীরে যেতে যেতে এই রংগুলো আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায়।

রাজিব বলল, সাজিদ ভাই, তোমার কথার কিছুই কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম না।

আচ্ছা আমি বুঝিয়ে বলছি তোকে। সূর্য থেকে প্রতিফলিত আলোর রং যখন সমুদ্রের পানিতে মেশে, সেই রং তখন ধীরে ধীরে গভীরে প্রবেশ করতে শুরু করে।

সমুদ্রের প্রথম বিশ মিটার পর্যন্ত পানিতে কেবল লাল রঙেরই আধিক্য থাকে। এরপর বিশ মিটার পার হয়ে যখনই পঁচিশ মিটারে পৌঁছায়, তখন কিন্তু পানিতে আর লাল রং থাকে না। লাল রং এর আগেই মিলিয়ে গেছে।

প্রতি বিশ মিটার পরপরই কি এভাবে একেকটি রং ফিকে হয়ে হারিয়ে যায়?, প্রশ্ন করলাম আমি।

অনেকটাই তা-ই, বলল সাজিদ। বলা চলে প্রতি বিশ থেকে ত্রিশ মিটারের পরেই একেকটি রং হারিয়ে ফিকে হয়ে যায়। একারণেই, সমুদ্রের প্রথম বিশ মিটারে যেকোনো কিছুকে লাল দেখায়, পরের বিশ মিটারে হলুদ, এরপরে নীল, তারপরে সবুজ।

দারুণ তো! এ তো দেখি সমুদ্রের নিচে রঙের খেলা, বলল রাজিব।

হুম। তবে রঙের এই আধিপত্য দুইশো মিটার পর্যন্তই। দুইশো মিটারের ঘরে পৌঁছেই সব রং ফিকে হয়ে হারিয়ে যায়। ফলে সমুদ্রের নিচে দুইশো মিটারের পরে আর কোনো রঙের উপস্থিতি না থাকায় সেই অঞ্চল হয় একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সেখানে যদি কেউ হাত বের করে চোখের সামনে আনে তারপরেও সে তার হাত দেখতে পাবে না।

দুইশো মিটার নিচে কি কোনো মানুষের পক্ষে যাওয়া সম্ভব?, প্রশ্ন রাজিবের।

তা অবশ্য অসম্ভব। তবে সাবমেরিন আবিষ্কারের পরে বিজ্ঞানীরা এমন অনেক অসম্ভব ব্যাপারকে জানার ব্যাপারে আমাদের জন্য সহজ করে দিয়েছে; কিন্তু আজ থেকে মাত্র কয়েক বছর আগেও সমুদ্রের নিচের এই নিকষ কালো অন্ধকার সম্পর্কে কেউ জানত না। এমনকি এটাও জানত না যে, সমুদ্রের গভীরেও একটি ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়। যদি জানত তাহলে সেগুলোও নিয়েও হয়তো কবিতা লেখা হতো। সেগুলোও হয়তো স্থান পেত কবি-সাহিত্যিকদের সাহিত্যে।

রাজিব বলল, আসলেই অদ্ভুত! প্রকৃতিজুড়ে এরকম কত রহস্য যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে আল্লাহ মালুম।

সাজিদ বলল, তবে, আধুনিক বিজ্ঞানের আবিষ্কারের আগে এই ব্যাপারটি সম্পর্কে একজন কিন্তু ঠিকই জানে।

উৎসুক চোখ নিয়ে রাজিব বলল, কে?

আমার দৃষ্টিও সাজিদের দিকে নিবন্ধ। একটু আগেই সে বলল, এই ব্যাপারগুলো সম্পর্কে নাকি সেদিনও কেউ কিছু জানত না, আবার এখন বলছে বিজ্ঞানের আবিষ্কারের আগেও একজন ঠিকই জানত। কে হতে পারে সেই একজন?

আমিও প্রশ্ন করে বসলাম, কে?

হেসে ফেলল সে। বলল, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা। এবং শুধু তা-ই নয়, কুরআনের একটি আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা এই ব্যাপারে আজ থেকে সাড়ে চৌদ্দশো বছর আগেই মানবজাতিকে জানিয়ে রেখেছেন।

রাজিবের চোখেমুখে বিস্ময়ের পারদ সর্বোচ্চ পর্যায়ে এসে ঠেকেছে। সে এতক্ষণ বুঝতেই পারেনি যে, কাহিনি এরকম একটি মোড় নেবে। তা ছাড়া, অতি সাম্প্রতিক এই ব্যাপারগুলো কীভাবে সাড়ে চৌদ্দশো বছর আগের কুরআনে থাকতে পারে সেটাও তার মাথায় ধরছে না। সে বলল, সত্যি সত্যিই?

হ্যাঁ। সত্যি সত্যিই।

বিস্ময়ে তার কণ্ঠে উত্তেজনার আমেজ পাওয়া যাচ্ছে। সে বলল, আমি শুনতে চাই প্লিজ।

সাজিদ আরেকটু নড়েচড়ে বসল। এরপর বলতে শুরু করল, কুরআনের সূরা নূরের চল্লিশ নম্বর আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কাফিরদের দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে এমন কিছু উপমা টেনেছেন, যা আজকের আধুনিক বিজ্ঞানের দ্বারা প্রমাণিত। উক্ত আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলছেন, তাদের (কাফিরদের আমলের) অবস্থা হচ্ছে গভীর সমুদ্রে ঘনীভূত অন্ধকারের মতো, যাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। ঢেউয়ের ওপর ঢেউ। তার উপরিভাগে রয়েছে ঘন মেঘমালা। অন্ধকারের ওপর আরেক অন্ধকার। কেউ যদি তাতে নিজের হাত বের করে তখন সে নিজের হাতটাও আর দেখতে পায় না। আল্লাহ যাকে আলো দান করেন না তার জন্যে আর কোনো আলো থাকে না।

খেয়াল করো, এই আয়াতে উপমার মূল বিষয়বস্তু হিশেবে কোনটি ধরা হয়েছে? সেটি হলো সমুদ্র। এরপর সেখানে নতুন উপমা হিশেবে নিয়ে আসা হয়েছে আরও কিছু ব্যাপার, যা আসলে সমুদ্রের বৈশিষ্ট্যের অন্তর্গত। সেগুলো কী কী? প্রথমে বলা হলো তাদের অবস্থা হচ্ছে গভীর সমুদ্রে ঘনীভূত অন্ধকারের মতো। সমুদ্রের গভীরে যে অন্ধকার থাকে, সেটি সাবমেরিন আবিষ্কারের আগে মানুষ জানতই না। কারণ, সমুদ্রের নিচে যতটুকু পর্যন্ত মানুষ পৌঁছাতে পারত, তাতে কোনো অন্ধকারের লেশমাত্র ছিল না। আগেই বলেছি সমুদ্রের দুইশো মিটার গভীর পর্যন্ত আলো পৌঁছাতে পারে। এর নিচে আর আলো যেতে পারে না। ব্যাপার হচ্ছে, যে জিনিসটি সাবমেরিন আবিষ্কারের আগে বিজ্ঞানীরাই জানত না, সেটি আজ থেকে সাড়ে চৌদ্দশো বছর আগে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কীভাবে জানলেন?

এরপরের অংশে বলা হচ্ছে, সেই অন্ধকারকে আচ্ছন্ন করে আছে ঢেউ এবং তার ওপরে আরও ঢেউ। তার উপরিভাগে রয়েছে ঘন মেঘমালা।

এই অংশটুকু খুবই ইন্টারেস্টিং। আল্লাহ বলছেন, সেই অন্ধকারকে আচ্ছন্ন করে আছে। ঢেউ এবং তার ওপর আরও ঢেউ। এখানে খুবই স্পষ্টভাবে দুইটি ঢেউয়ের কথা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেছেন। ঢেউ এবং তার ওপরে আরও ঢেউ এবং তার ওপরে মেঘমালা। তাহলে, এখানে প্রথম যে-ঢেউয়ের কথা বলা হচ্ছে সেটি হলো

সমুদ্রের গভীরের যে-ঢেউয়ের কথা বলেছিলাম, সেটাই। Internal Waves. এই ঢেউয়ের ওপরে রয়েছে আরেকটি ঢেউ। সেটি কোনটি তাহলে? সেটি হলো সমুদ্রের উপরিভাগের ঢেউ যা আমরা চোখে দেখি, উপভোগ করি। যে-ঢেউয়ের কথা কবি-সাহিত্যিকরা কবিতা-গল্প আর উপন্যাসে লিখে থাকে। এর ওপরে রয়েছে মেঘমালা। একদম ক্লিয়ার। সমুদ্রের উপরিভাগেই তো মেঘ থাকে। একটি আয়াতে উপমা টানতে গিয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা দুই দুইটি সমুদ্রবিজ্ঞানের কথা আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন। এটি আজ থেকে সাড়ে চৌদ্দশো বছর আগে কোনো। মানুষের পক্ষে জানা এবং বলে দেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। এটি সমুদ্রের সৃষ্টিকর্তা, যার নির্দেশে সমুদ্র প্রবাহিত, তার পক্ষ থেকে আসা বলেই সম্ভব।

রাজিবের মুখে কোনো কথা নেই। সে এতটাই হতভম্ব হয়ে গেছে যে—মুখ দিয়ে কোনো শব্দই বেরুচ্ছে না। সাজিদ আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, আরিফ, তোকে একবার ড. গ্যারি মিলারের ব্যাপারে বলেছিলাম না?

কোন গ্যারি মিলার? ওই যে ম্যাথমেটিশিয়ান, যিনি পরে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন?

হ্যাঁ। তার কথাই বলছি। তিনি একবার একটি ঘটনা বলেছিলেন। ঘটনাটি ছিল এরকম, কানাডার টরেন্টোর এক নাবিককে একবার তার এক মুসলিম বন্ধু কুরআনের একটি কপি উপহার দিয়েছিল। বেচারা তখনো ইসলাম এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে কিছুই জানতেন না, তবে কুরআন তিনি বেশ আগ্রহভরেই গ্রহণ করেছিলেন। কুরআন পড়ে শেষ করে যখন সেই মুসলিম বন্ধুর কাছে তিনি সেটি ফেরত দিচ্ছিলেন, তখন বললেন, আচ্ছা বন্ধু, এই বইটির লেখক মুহাম্মদ কি কোনো নাবিক ছিলেন?

অর্থাৎ তিনি জানতে চাইলেন, এই বই যিনি লিখেছেন তিনি কোনো জাহাজের নাবিক ছিলেন কি না, যার সমুদ্র সম্পর্কে বেশ ভালো রকমের জানাশোনা ছিল। তিনি মূলত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেই কুরআনের রচয়িতা মনে করেছিলেন। তখন সেই মুসলিম বন্ধু বলল, না তো। তিনি তো কোনো নাবিক ছিলেন না; বরং তিনি ছিলেন উত্তপ্ত মরুভূমির বাসিন্দা। এই কথা শুনে তিনি খুবই অবাক হলেন। বললেন, কীভাবে সম্ভব? নাবিক কিংবা সমুদ্রবিজ্ঞান সম্পর্কে না। জেনে এত নিখুত সামুদ্রিক অবস্থা বর্ণনা করা তো কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে কোনোদিনও সম্ভব না।

রাজিব বলল, তারপর?

তারপর আর কী। সেই লোকটি ইসলাম গ্রহণ করেন।

রাজিব ওয়াও বলে আবারও চিৎকার দিয়ে উঠল।

আমরা যখন সেন্ট মার্টিন এসে পৌঁছালাম তখন রাত নয়টা বেজে সাইত্রিশ মিনিট। ট্রলার থেকে নেমেই আমরা ভালো একটি হোটেলের সন্ধানে লেগে গেলাম। শেষমেশ যে-হোটেলটায় উঠলাম সেটার নাম সীমানা পেরিয়ে। হোটেলের নাম নির্বাচনের ক্ষেত্রেও মানুষের ক্রিয়েটিভিটি দেখে আশান্বিত হওয়াই যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *