১২. সত্যতা ও মিথ্যাত্ব
আমাদের সত্যতার জ্ঞানের একটি বিপরীত দিক রয়েছে যা হল ভ্রান্তি, যা আমাদের বিষয়ের জ্ঞানর থেকে আলাদা। বস্তুর কথা বলতে গেলে হয় আমরা তাদের জানি অথবা জানি না, কিন্তু মনের এরকম ধরনের কোন সদর্থক অবস্থা নেই যাকে বিষয়ের ভ্রান্তজ্ঞান হিসেবে বর্ণনা করা, যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা, যেভাবেই হোক না কেন, নিজেদেরকে পরিচিতির জ্ঞানের মধ্যে আবদ্ধ রাখি। যখনই আমরা পরিচিত হই তখনই কোন বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত হই। আমরা আমাদের পরিচিতি থেকে ভুল অনুমান করতে পারি কিন্তু পরিচিতি নিজে কখনও প্রতারিত করে না। এভাবে পরিচিতির ব্যাপারে কোন দ্বৈতনীতি নেই। আমরা যা মিথ্যা ও যা সত্য দুই-ই বিশ্বাস করতে পারি। আমরা জানি অনেক বিষয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি ভিন্ন ভিন্ন ও বিরোধী মতবাদ পোষণ করেন? অতএব কিছু বিশ্বাস অবশ্যই ভ্রান্তিমূলক। যেহেতু ভ্রান্তিমূলক বিশ্বাসকে প্রায়শই সত্য বিশ্বাসের মতই দৃঢ়তার সঙ্গে মানা হয়, সেহেতু এটি একটি দুরূহ প্রশ্নে পরিণত হয় যে কিভাবে সত্য বিশ্বাসের থেকে এদের পার্থক্য করা সম্ভব। কোন নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে আমরা কিভাবে জানব যে আমাদের বিশ্বাস ভ্রান্তিমূলক নয়? কোন প্রশ্নটি খুবই দুরূহ, যার কোন সম্পূর্ণ সন্তোষজনক উত্তর দেয়া সম্ভব নয়। অবশ্য আরও একটি প্রাথমিক প্রশ্ন আছে যা কম দুরূহ এবং সেটি হল : সত্যতা ও মিথ্যা বলতে আমরা কি বুঝি? এই প্রাথমিক প্রশ্নটিই এই অধ্যায়ে আলোচিত হবে।
এই অধ্যায়ে আমরা এই প্রশ্ন করছি না যে কিভাবে আমরা একটি বিশ্বাসকে সত্য বা মিথ্যা বলে জানি। আমরা প্রশ্ন করছি কোন একটি বিশ্বাস সত্য বা মিথ্যা এই প্রশ্নের দ্বারা কি বোঝা যায়। আশা করা যায় এই প্রশ্নের একটি পরিষ্কার উত্তর আমাদের এই প্রশ্নের উত্তর পেতে সাহায্য করবে যে কোন্ বিশ্বাসগুলো সত্য, কিন্তু বর্তমানে আমরা শুধু প্রশ্ন রাখছি সত্যতা কি? ও মিথ্যাত্ব কি? কোন বিশ্বাসগুলো সত্য ও কোন বিশ্বাসগুলো মিথ্যা সে প্রশ্ন আমরা করেছি না। এই ভিন্ন প্রশ্নগুলোকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এদের মধ্যে কোন বিভ্রান্তি এমন একটি উত্তর তৈরি করবে যা কোনটি ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে না।
সত্যের প্রকৃতি আবিষ্কারের প্রচেষ্টার তিনটি দিক দেখা প্রয়োজন, এমন তিনটি আবশ্যই পূরণ করা প্রয়োজন।
(১) আমাদের সত্যের তত্ত্ব এমন হবে যে তার বিপরীত অর্থাৎ মিথ্যার তত্ত্বকে স্বীকার করবে। অনেক দার্শনিক এই শর্তটি যথাযথভাবে পূরণ করতে অসমর্থ হয়েছেন। তাঁরা এমন একটি তত্ত্ব খাড়া করেন যার মতে আমাদের সমস্ত চিন্তাকে অবশ্যই সত্য হতে হবে এবং তার ফলে মিথ্যাত্বকে জায়গা দেবার ব্যাপারে বিপুল অসুবিধার সম্মুখীন হন। এই দিক থেকে আমাদের সত্যতার তত্ত্ব অবশ্যই আমাদের পরিচিতির তত্ত্বের থেকে আলাদা হবে, কেননা পরিচিতির ক্ষেত্রে বিপরীতের কোন ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজনীয় নয়।
(২) এটাকে স্বাভাবিকভাবে সিদ্ধ মনে হয় যে যদি কোন বিশ্বাস না থাকত তাহলে কোন মিথ্যাত্বও থাকত না এবং সত্যতাও নয়, এই অর্থে যে সত্যতা মিথ্যাত্বের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত। যদি আমরা শুধুমাত্র দ্রব্য সম্বলিত জগৎ কল্পনা করি, তাহলে সেই জগতে মিথ্যাত্বের কোন জায়গা থাকবে না এবং যদি তাতে সেসব থাকে যাকে আমরা ঘটনা বলি, তাহলে তাতে কোন সত্যতা থাকবে না, এই অর্থে যে সত্যতা মিথ্যাত্বর মতই একই বিষয় হবে। আসলে সত্যতা ও মিথ্যাত্ব হল বিশ্বাস ও বক্তব্যর গুণাবলি : অতএব শুধুমাত্র দ্রব্যের জগতে, যেহেতু তাকে কোন বিশ্বাস বক্তব্য থাকবে না, কোন সত্যতা বা মিথ্যাত্বও থাকবে না।
(৩) কিন্তু যা আমরা এইমাত্র বললাম তার বিরুদ্ধে এটা দেখা প্রয়োজন যে একটি বিশ্বাসের সত্যতা বা মিথ্যাত্ব সবসময় এমন কিছুর উপর নির্ভর করে যা নিজে বিশ্বাসের বাইরে থাকে। যদি আমি বিশ্বাস করি যে প্রথম চার্লস ফাঁসিকাষ্ঠে মারা গিয়েছিলেন তাহলে আমি সত্যিই বিশ্বাস করি। এটা আমার বিশ্বাসের কোন গুণগত কারণের জন্য নয় যা বিশ্বাসটি পরীক্ষা করে আবিস্কার করা যাবে, বরং এক ঐতিহাসিক ঘটনার জন্য নয় যা বিশ্বাসটি পরীক্ষা করে আবিষ্কার করা যাবে, বরং এক ঐতিহাসিক ঘটনার জন্য যা দুশো পঞ্চাশ বছর পূর্বে ঘটেছিল। যদি আমি বিশ্বাস করি যে প্রথম চার্লস শয্যায় মারা গিয়েছিলেন, তাহলে সেটি আমি ভুলবশত বিশ্বাস করিঃ আমার বিশ্বাসের স্পষ্টতার কোন মাত্রাই বা এতে উপনীত হবার জন্য কোন সাবধানতাই একে মিথ্যা হওয়ার থেকে বাঁচতে পারবে না, কেননা তা বহুকাল আগে ঘটেছিল এবং আমার বিশ্বাসের কোন গুণগত ধর্মের জন্য নয়। এভাবে সত্যতা ও মিথ্যাত্ব বিশ্বাসের গুণগত ধর্ম হলেও এরা হল এমন ধর্ম যা নির্ভর করে অন্য বিষয়ের সঙ্গে বিশ্বাসের সম্বন্ধের উপর, বিশ্বাসের কোন অন্তর্নিহিত গুণের উপর নয়।
উপরিউক্ত আবশ্যকীয়তার মধ্যে তৃতীয়টি আমাদের এই মত গ্রহণ করতে বলে-যা দার্শনিকদের মধ্যে সাধারণভাবে প্রচলিত-যে সত্য হল বিশ্বাস ও ঘটনার মধ্যে এক প্রকারের অনুরূপতা। অবশ্য এমন এক প্রকারের অনুরূপতা আবিষ্কার করা খুব সহজ ব্যাপার নয় যাতে কোন অখন্ডনীয় আপত্তি নেই।
অংশত এর দ্বারা এবং অংশত এই অনুভবের দ্বারা যে যদি সত্যতা মন এবং মনের বাইরের মধ্যে কোন অনুরূপতা হয়, মন জানতে সক্ষম হবে না কখন সে সত্যতায় উপনীত হবার জন্য চেষ্টা করেছেন যা বিশ্বাসের বাইরে কোন সম্বন্ধে থাকবে না। এই ধরনের একটি সংজ্ঞায় উপনীত হবার জন্য সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ চেষ্টা হল সেই মতবাদ যা বলে সংবদ্ধতা হল সত্যতা। বলা হয় যে মিথ্যাত্বের চিহ্ন হল আমাদের সমগ্র বিশ্বাসের সঙ্গে সংগতির অভাব এবং সত্যতার সারবত্তা হল সত্য এই পুরো বিষয়ের অংশ বলে পরিচিত হওয়া।
এখানে অবশ্য এই মতের এটি বড় অসুবিধা রয়েছে, বা বলা ভাল দুটি অসুবিধা রয়েছে। প্রথমটি হল, এরকম মনে করার কোন যুক্তি নেই যে শুধুমাত্র একটি সংবদ্ধ বিশ্বাসের স্থলই থাকা সম্ভব। এটা সম্ভব যে পর্যাপ্ত কল্পনার সঙ্গে একজন গল্পকার জগতের জন্য এমন এক অতীত আবিষ্কার করতে পারেন যেখানে আমরা যা জানি তা যথাযথভাবে খাপ খাবে এবং তা সত্ত্বেও প্রকৃত অতীতের থেকে তা সম্পূর্ণ আলাদা হবে। আরও বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে, এটা নিশ্চিত যে এরকম দুই বা ততোধিক প্রকল্প থাকতে পারে যা কোন বিষয়ের সমস্ত জ্ঞাত ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে পারে। এসব ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিকরা এরকম ঘটনাকে বার করতে সচেষ্ট হতে পারেন যা একটি ছাড়া সমস্ত প্রকল্পকে বাদ দিয়ে দেবে, তবুও এমন কোন কারণ নেই যে কেন তারা সবসময় সফল হবে।
দর্শনের ক্ষেত্রেও দুটি বিরোধী প্রকল্পের সমস্ত ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে এটা মোটেই অসাধারণ নয়। এভাবে, দৃষ্টান্তস্বরূপ, এটা সম্ভব যে জীবন হল একটি দীর্ঘ স্বপ্ন এবং বাইরের জগতের সেইটুকুই সত্যতার মাত্রা রয়েছে যে রকম স্বপ্নের বিষয়ের থাকে, এবং এরকম মত জ্ঞাত ঘটনার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ না হলেও সাধারণ মতবাদের চেয়ে এই মতকে অগ্রাধিকার দেয়ার কোন কারণ নেই, যে মত অনুযায়ী অন্য ব্যক্তি ও বস্তুরা সত্যিই অস্তিত্বশীল। এভাবে সত্যতার সংজ্ঞার ক্ষেত্রে সংবদ্ধতা গ্রহণযোগ্য হয় না, কেননা এমন কোন প্রমাণ নেই যে এরকম একটি সংবদ্ধ তন্ত্র আছে।
সত্যতার এই সংজ্ঞার বিরুদ্ধে আর একটি আপত্তি হল যে এটি সংবদ্ধতার অর্থকে আগে থেকে ধরে নেয়, যেখানে প্রকৃতপক্ষে সংবদ্ধতা তর্কবিজ্ঞানের নীতির সত্যতা ধরে নেয়। দুটি বচন একে অপরের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয় যখন দুটিকেই সত্য বলে ধরে নেয়া হয়, এবং অসংগতিপূর্ণ হয় যখন অন্তত একটি অবশ্যই মিথ্যা হয়। এখন দুটি বচনই সত্য কিনা তা জানতে হলে আমরা অবশ্যই বিরোধবাধক নিয়মের সত্যতাকে জানব। দৃষ্টান্তস্বরূপ, এই দুটি বচন এই গাছটি হল বীজ ও এই গাছটি বীজ নয় বিরোধবাধক নীতির জন্য সংগতিপূর্ণ নয়। কিন্তু যদি বিরোধবাধক নীতিকে এই সংবদ্ধতার পরীক্ষায় ফেলা হয়, আমরা দেখব যে, যদি আমরা একে মিথ্যা বলে গ্রহণ করি, তাহলে কোন কিছুই কোন কিছুর সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ হবে না। এভাবে যুক্তিবিজ্ঞানের নীতি এমন একটি কাঠামো দেয় যার মধ্যে সংবদ্ধতার পরীক্ষার প্রয়োগ করা চলে, এবং তারা নিজে এই পরীক্ষার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।
উপরিউক্ত দুটি কারণে সত্যতার অর্থ হিসেবে সংবদ্ধতাকে গ্রহণ করা যায় না, যদিও এটি প্রায়শই অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু নির্দিষ্ট সত্যতা জ্ঞাত হবার পর, পরীক্ষা।
এভাবে আমরা সত্যতার প্রকৃতি গঠনের জন্য ঘটনার সঙ্গে অনুরূপতায় ফিরে যাই। এখন বাকী থাকে ঘটনা বলতে আমরা সঠিকভাবে কি সংজ্ঞা দিই এবং অনুরূপতার প্রকৃতি কি যা বিশ্বাস এবং স্বভাবের মধ্যে থাকে যাতে বিশ্বাসটি সত্য হতে পারে।
আমাদের তিনটি আবশ্যকীয়তা অনুযায়ী এখন আমাদের এমন একটি সত্যতার তত্ত্ব খুঁজতে হবে যা (১) সত্যের বিরোধীকে অর্থাৎ মিথ্যাত্বকে থাকতে দেবে, (২) সত্যতাকে বিশ্বাসের ধর্ম করবে, কিন্তু (৩) এটিকে এমন ধর্ম করবে যা পুরোপুরি বিশ্বাসের সঙ্গে বাহ্য বস্তুর সম্বন্ধের উপর নির্ভর করে।
মিথ্যাত্বের প্রয়োজনীয়তা বিশ্বাসকে মনের সঙ্গে একক বিষয়ের সম্বন্ধরূপে অসম্ভব করে তোলে, যা নাকি যা বিশ্বাস করা হয়েছে তার সম্বন্ধে বলা যায়। যদি বিশ্বাসকেও এভাবে মানা হয়, আমরা দেখব যে পরিচিতির মত এটি সত্যতা ও মিথ্যাত্বের মধ্যে বিরোধিতা মানে না, বরং সবসময় সত্য বলে জানে। উদাহরণের সাহায্যে এটি স্পষ্ট করা যায়। ওথেলো ভ্রান্তভাবে বিশ্বাস করে যে ডেসডিমোনা ক্যাসিওকে ভালবাসে। আমরা বলতে পারি না যে এই বিশ্বাসটি একটি বিষয়ের সঙ্গে সম্বন্ধবদ্ধ, ক্যাসিওর প্রতি ডেসডিমোনার ভালবাসা, যদি এরকম কোন বিষয় থাকত, তাহলে বিশ্বাসটি সত্য হবে। কিন্তু এরকম কোন বিষয় নেই, সুতরাং এরকম ধরনের কোন বিষয়ের সঙ্গে ওথেলোর সম্বন্ধ থাকতে পারে না, এ কারণে তার বিশ্বাস কখনই এই বিষয়ের প্রতি সম্বন্ধবদ্ধ হতে পারে না।
হয়তো বলা যায় যে তার বিশ্বাসটি হচ্ছে ভিন্ন বিষয়ের প্রতি সম্বন্ধ অর্থাৎ যে ডেসডিমোনা ক্যাসিওকে ভালবাসে; কিন্তু এটি মনে করা খুবই দুরূহ যে এরকম ধরনের কোন বিষয় আছে যখন ডেসডিমোনা ক্যাসিওকে ভালবাসে না, এটা মনে করা যে ডেসডিমোনার ক্যাসিওর প্রতি প্রেম আছে। সুতরাং এরকম ধরনের বিশ্বাসের তত্ত্ব খোঁজা প্রয়োজন যা মনের সঙ্গে শুধু একক বিষয়ের সম্বন্ধ গঠিত করে না।
এভাবে সম্বন্ধকে চিন্তা করা খুবই স্বাভাবিক যেন তারা সবসময় দুটি পদের মধ্যে রয়েছে, কিন্তু আসলে ব্যাপারটা সর্বদা এরকম নয়। কিছু সম্বন্ধ তিনটি পদ দাবি করে, কিছু চারটি ইত্যাদি। দৃষ্টান্তস্বরূপ মধ্যে এই সম্বন্ধটিকে নেয়া যাক। যতক্ষণ পর্যন্ত শুধুমাত্র দুটি পদ আসছে ততক্ষণ মধ্যে এই সম্বন্ধটি অসম্ভব : তিনটি পদ হল সবচেয়ে ক্ষুদ্র সংখ্যা যা এটিকে সম্ভব করতে পারে। লন্ডন ও এডিনবার্গের মধ্যবর্তী হল ইয়র্ক, কিন্তু যদি পৃথিবীতে শুধুমাত্র লন্ডন ও এডিবার্গই একমাত্র স্থান হত তাহলে এমন কোন কিছুই থাকত না যা একটি স্থান ও আরেকটি স্থানের মধ্যবর্তী হবে। একইভাবে ঈর্ষার ক্ষেত্রেও তিনজন ব্যক্তির প্রয়োজন : এমন কোন সম্বন্ধ নেই যা অন্তত তিনজনকে অন্তর্ভুক্ত করে না। এরকম বচন যেমন ক চায় খ যেন গ-এর বিবাহ ঘ-এর সঙ্গে ঘটায় চারটি পদের সম্বন্ধকে অন্তর্ভুক্ত করে থাকে; অর্থাৎ, ক, খ, গ, ঘ সবাই রয়েছে এবং যে সম্বন্ধ এতে রয়েছে তাকে চারজনকেই অন্তর্ভুক্ত না করে প্রকাশ করা যায় না। দৃষ্টান্তগুলো সংখ্যায় অনন্তভাবে বাড়ানো যায়, কিন্তু এটা দেখাতে যথেষ্ট বলা হয়েছে যে এরকম ধরনের সম্বন্ধ রয়েছে যা সংঘটিত হবার আগে দুয়ের বেশি পদকে জড়ায়।
বিচার বা বিশ্বাস এদের সম্বন্ধকে অবশ্য শুধুমাত্র দুই পদের মধ্যে নয় বরং বহু পদের সম্বন্ধ বলে নেয়া উচিত-যদি মিথ্যাত্বকে উপযুক্ত প্রবেশাধিকার দেয়া হয়। যখন ওথেলো বিশ্বাস করে যে ডেসডিমোনা ক্যাসিওকে ভালবাসে, তখন তার মনের সামনে অবশ্যই কোন একটিমাত্র বিষয় থাকে না। ডেসডিমোনার ক্যাসিওর প্রতি প্রেম বা ডেসডিমোনা ক্যাসিওকে ভালবাসে এদের জন্য প্রয়োজন বিষয়গত মিথ্যাত্বের আবশ্যিক উপস্থিতি যা কোন মন-নিরপেক্ষ হয়ে স্বাধীনভাবে থাকতে পারে; এবং এটি যদিও যুক্তিগতভাবে খন্ডন করা যায় না, হল এক ধরনের মতবাদ যা সম্ভব হলে এড়িয়ে চলা উচিত। এভাবে মিথ্যাত্বের ব্যাখ্যা দেয়া সহজ হয় যদি আমরা বিধানকে একধরনের সম্বন্ধ বলি যেখানে মন ও তার বিভিন্ন বিষয় বহুবার আসে, অর্থাৎ, বলতে গেলে, ডেসডিমোনা, ভালবাসা ও ক্যাসিও হল সেসব পদ যা সেই সম্বন্ধের মধ্যে থাকে যখন ওথেলো বিশ্বাস করে যে ডেসডিমোনা ক্যাসিওকে ভালবাসে। সুতরাং এই সম্বন্ধটি হল চারটি পদের সম্বন্ধ যেহেতু ওথেলোও এই সম্বন্ধের একটি অংশগ্রহণকারী পদ। যখন আমরা বলি যে এটি হল চারটি পদের সম্বন্ধ, তখন আমরা মনে করি না যে। ওথেলোর ডেসডিমোনার প্রতি কোন নির্দিষ্ট সম্বন্ধ আছে এবং একই সম্বন্ধ ভালবাসার ও ক্যাসিওর প্রতিও আছে। এটি বিশ্বাস ছাড়া অন্য কোন সম্বন্ধের ক্ষেত্রে সত্য হতে পারে। কিন্তু বিশ্বাস করা সাধারণভাবে কোন সম্বন্ধ নয় যা ওথেলোর এই তিনটি পদের প্রত্যেকটির জন্য রয়েছে, বরং সবগুলোতে একত্রে রয়েছে; বিশ্বাসের সম্বন্ধ নিয়ে শুধুমাত্র একটি দৃষ্টান্ত চারটি পদকে একত্রে বেঁধে রাখে। এভাবে বাস্তব ঘটনা, সেই মুহূর্তে যখন ওথেলো তার বিশ্বাস পোষণ করছে, হল সেই সম্বন্ধ যা বিশ্বাস করা বলে পরিচিত। এটি হল একটি জটিল ক্ষেত্র যা একত্রে বাঁধে এই চারটি পদকে-ওথেলো, ডেসডিমোনা, ভালবাসা ও ক্যাসিও। যাকে বিশ্বাস বা বিদ্বান বলা হয় তা অন্য কিছু নয় বরং বিশ্বাস করার সম্বন্ধ বিধান দেয়া যা মনকে নিজেকে ছাড়া, বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে যোগসূত্রে গ্রথিত করে। বিশ্বাস করা বা বিধান দেয়া হল কয়েকটি নির্দিষ্ট পদের মধ্যে কোন বিশেষ সময়ের ঘটনা, বিশ্বাসের সম্বন্ধ বিধান বিষয়ক।
আমরা এখন বোঝার মত অবস্থায় পৌঁছেছি যে সত্য বিধানকে যা মিথ্যা বিধানের থেকে আলাদা করে সেটি কি। এই কাজের জন্য আমরা নির্দিষ্ট সংজ্ঞা গ্রহণ করব। প্রত্যেক বিচারের ক্ষেত্রে একটি মন আছে যা বিচার করে এবং কিছু পদ থাকে যার সম্বন্ধে বিচার করা হয়। আমরা মনকে বিধানের কর্তা বলব এবং অবশিষ্ট পদগুলোকে বলব বিষয়। এভাবে যখন ওথেলো বিচার করে যে ডেসডিমোনা ক্যাসিওকে ভালবাসে, তখন ওথেলো হল কর্তা, অপরদিকে বিষয়গুলো হল ডেসডিমোনা, ভালবাসা ও ক্যাসিও। কর্তা ও বিষয় একত্রিতভাবে বিধানের উপাদান। দেখা যায় যে বিধানের সম্বন্ধের একটা অর্থ বা দিক রয়েছে। রূপকার্থে আমরা বলতে পারি যে এটি এর বিষয়কে একটি নির্দিষ্ট ধারায় রাখে, যা আমরা নির্দেশ করতে পারি বাক্যের মধ্যে শব্দের বিন্যাসের দ্বারা। ওথেলোর বিধান যে ক্যাসিও ডেসডিমোনাকে ভালবাসে তার বিধানের থেকে আলাদা যে ডেসডিমোনা ক্যাসিওকে ভালবাসে, এতদসত্ত্বেও যে এটিতে একই উপাদান রয়েছে, কেননা বিধানের সম্বন্ধ উপাদানগুলোকে এই দুই ক্ষেত্রে ভিন্ন। বিন্যাসে রেখেছে। একইভাবে যদি ক্যাসিও বিচার করে যে ডেসডিমোনা ওথেলোকে ভালবাসে, তাহলে বিধানের উপাদানগুলো একই, কিন্তু এদের বিন্যাস আলাদা। সম্বন্ধের অর্থ হল বিন্যাস, শ্রেণি ও একগুচ্ছ গাণিতিক ধারণার আদি উৎস। কিন্তু এই দিকটি নিয়ে আমাদের আর আলোচনার প্রয়োজন নেই।
আমরা বিচার ও বিশ্বাসের বিষয় ও বিষয়ীর একটি একত্রিত জটিল ক্ষেত্র বলেছি। এই দিক থেকে বিশ্বাস হল অন্য প্রত্যেক সম্বন্ধের মত একই। যখনই দুই বা ততোধিক পদের মধ্যে কোন সম্বন্ধ ঘটে, তখন তা পদগুলোকে একটি জটিল ক্ষেত্রে পরিণত করে। যদি ওথেলো ডেসডিমোনাকে ভালবাসা। এই সম্বন্ধের দ্বারা যুক্ত পদগুলো নিজেরা জটিল হতে পারে বা সহজ হতে পারে, কিন্তু যে পূর্ণাঙ্গতা এদের একত্রিত হবার ফলে তৈরি হয়েছে তা অবশ্যই জটিল। যেখানেই কোন সম্বন্ধ থাকে যা কয়েকটি পদকে যুক্ত করে, সেখানেই এই পদগুলোর একীকরণের মাধ্যমে জটিল বিষয় তৈরি হয়; এবং উল্টোভাবে, যেখানেই জটিল বিষয় থাকে, সেখানেই একটি সম্বন্ধ থাকে যা বিভিন্ন উপাদানগুলোকে যুক্ত করে। যখন একটি বিশ্বাসের ক্ষেত্র তৈরি হয়, একটি আধার থাকে বিশ্বাসযোগ্যতা। এটি হল যুক্ত করার সম্বন্ধ এবং বিষয় ও বিষয়ীকে একটি নির্দিষ্ট বিন্যাসে রাখা হয় বিশ্বাস করা এই সম্বন্ধের অর্থকে কেন্দ্র করে। বিষয়ের মধ্যে, যা আমরা আলোচনার সময় দেখেছি, ওথেলো বিশ্বাস করে যে ডেসডিমোনা ক্যাসিওকে ভালবাসে, অবশ্যই একটি সম্বন্ধ হবে–এই দৃষ্টান্তে যা ভালবাসার সম্বন্ধ কিন্তু এই সম্বন্ধ, যা বিশ্বাস করার মধ্যে ঘটে, তা সেই সম্বন্ধ নয় যা বিষয় ও বিষযীকে নিয়ে গঠিত অসম্পূর্ণ আধারের একতাকে তৈরি করে। ভালবাসা এই সম্বন্ধ যা বিশ্বাস করার মধ্যে আসে, তা হল অনেক বিষয়ের মধ্যে একটি–এটি কাঠামোর মধ্যেকার একটি ইট, কিন্তু সিমেন্ট নয়। এখানে সিমেন্ট হল বিশ্বাস করা এই সম্বন্ধটি। যখন বিশ্বাসটি সত্য হয়, তখন আর একটি একতার আধার তৈরি হয় যাতে সম্বন্ধটি, যা বিশ্বাসের অনেকগুলো বিষয়ের মধ্যে একটি, অন্য বিষয়গুলোকে যুক্ত করে। এভাবে, যেমন যদি ওথেলো সত্যিই বিশ্বাস করে যে ডেসডিমোনা ক্যাসিওকে ভালবাসে, তাহলে একটি একতার আধার তৈরি হয়, ডেসডিমোনার ক্যাসিওর প্রতি ভালবাসা, যা সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাসের বিষয়গুলো নিয়ে তৈরি, সেই এই বিন্যাসে যেভাবে তারা বিশ্বাসে ছিল, সম্বন্ধের সঙ্গে যা এখন সিমেন্ট হিসেবে কাজ করছে, যা বিশ্বাসের অন্য বিষয়গুলোকে একত্রে বেঁধে রাখে। অন্যপক্ষে, যখন একটি বিশ্বাস মিথ্যা হয়, তখন এরকম কোন একতার আধার থাকে না যা শুধু বিশ্বাসের বিষয়গুলো নিয়ে তৈরি। যদি ওথেলো ভ্রান্তভাবে বিশ্বাস করে যে ডেসডিমোনা ক্যাসিওকে ভালবাসে, তাহলে ডেসডিমোনার ক্যাসিওর প্রতি ভালবাসা এরকম কোন একতার আধার থাকবে না।
এভাবে একটি বিশ্বাস সত্যে পরিণত হয় যখন এটি কোন নির্দিষ্ট আধারে অনুরূপতা দেখায় এবং ভ্রান্ত হয় যখন এটি তা দেখায় না। নিশ্চয়তার জন্য কল্পনা করে নেয়া যাক যে বিশ্বাসের বিষয়গুলো হল দুটি পদ ও একটি সম্বন্ধ, পদগুলোকে বিশ্বাস করার অর্থে একটি নির্দিষ্ট বিন্যাসে রাখা হয়েছে, তাহলে যদি দুটি পদ ওই বিন্যাসে সম্বন্ধের দ্বারা আধারে যুক্ত করা হয়ে থাকে তাহলে মিথ্যা। আমরা সত্যতা ও মিথ্যাত্বের যে–খোঁজে ব্যাপৃত তা এই দিয়ে তৈরি। বিচার করা বা বিশ্বাস করা হল নির্দিষ্ট একতার আধার, মন হল যার একটি উপাদান; যদি অবশিষ্ট উপাদানগুলো একটি একতার আধার তৈরি করে, যদি তাদের ক্রমান্বয়ে নেওয়া হয় যেভাবে তারা বিশ্বাসে আছে, তাহলে বিশ্বাসটি সত্য হবে; যদি না হয় তাহলে মিথ্যা।
এভাবে সত্যতা ও মিথ্যাত্ব বিশ্বাসের ধর্ম হলেও এক অর্থে তারা বাইরের ধর্ম, কেননা বিশ্বাসের সত্য হওয়ার শর্ত হল এমনকিছু যা বিশ্বাসকে জড়ায় না বা (সাধারণভাবে) কোন মনকে জড়ায় না, বরং শুধু বিশ্বাসের বিষয়গুলোকে জড়ায়। মন, যা বিশ্বাস করে, সত্যভাবে বিশ্বাস করে যখন এর অনুরূপ আধার থাকে যা মনকে জড়ায় না বরং শুধুমাত্র তার বিষয়কে জড়ায়। এই অনুরূপতা সত্যতাকে নিশ্চিত করে, এবং এর না থাকা মিথ্যাকে প্রতিপন্ন করে। এভাবে আমরা একইসঙ্গে দুটি ঘটনার ব্যাখ্যা দিই যে বিশ্বাসগুলো (ক) তাদের অস্তিত্বের জন্যে মনের উপরে নির্ভরশীল, (খ) কিন্তু তাদের সত্যতার জন্য মনের উপরে নির্ভরশীল নয়।
আমরা আমাদের মতবাদকে নিম্নলিখিতভাবে পুনরায় বর্ণনা করতে পারি: যদি আমরা এরকম বিশ্বাস নিই যে ওথেলো বিশ্বাস করে যে ডেসডিমোনা ক্যাসিওকে ভালবাসে তাহলে আমরা বলব ডেসডিমোনা ও ক্যাসিও হল বিষয় পদ এবং ভালবাসা হল বিষয় সম্বন্ধ। যদি এরকম একতার আধার থেকে ক্যাসিওর প্রতি ডেসডিমোনার ভালবাসা, বিষয় পদগুলো নিয়ে বিষয় সম্বন্ধে যেভাবে তারা বিশ্বাসে ছিল সেই একই বিন্যাসে যুক্ত হয়ে, তাহলে এই একতার আধারকে ঘটনার অনুরূপ বিশ্বাস এই নাম দেয়া যেতে পারে। এভাবে একটি বিশ্বাস সত্য হয় যখন তার অনুরূপ ঘটনা থাকে এবং মিথ্যা হয় যখন কোন অনুরূপ ঘটনা থাকে না।
দেখা যাবে যে মন সত্যতা বা মিথ্যাত্ব তৈরি করে না, সে বিশ্বাস তৈরি করে। কিন্তু বিশ্বাসগুলো একবার তৈরি হয়ে গেলে মন এদের সত্য বা মিথ্যা করতে পারে না, শুধুমাত্র বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া যেখানে তারা ভবিষ্যতের বিষয় নিয়ে ভাবে যা নাকি যে ব্যক্তি বিশ্বাস করছে তার শক্তির মধ্যে পড়ে, যেমন ট্রেন ধরা। বিশ্বাসকে যা সত্যে পরিণত করে তাহল ঘটনা এবং এই ঘটনা কোনভাবেই (শুধুমাত্র বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া) যার বিশ্বাস সেই ব্যক্তির মনকে জড়ায় না।
এভাবে আমরা সত্যতা ও মিথ্যাত্ব সম্পর্কে বুঝলাম। এবার আমরা আলোচনা করব এই বা ওই বিশ্বাস সত্য না মিথ্যা, তা জানার কি কি উপায় আছে তাই নিয়ে পরবর্তী অধ্যায়ে এই বিষয়েই আলোচনা করা হবে।