সতী-সাধ্বী নারী হযরত মারয়ামের পুত্ৰ হযরত ঈসা (আ)-এর জন্মের বিবরণ
আল্লাহর বাণী :
বর্ণনা কর এই কিতাবে উল্লেখিত মারিয়ামের কথা, যখন সে তার পরিবারবর্গ থেকে পৃথক হয়ে নিরালায় পূর্ব দিকে এক স্থানে আশ্রয় নিল। তারপর তাদের থেকে নিজেকে আড়াল করার জন্যে সে পর্দা করল। তারপর আমি তার নিকট আমার রূহকে পাঠালাম! সে তার নিকট পূর্ণ মানবাকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করল। মারয়াম বলল, আমি তোমার থেকে দয়াময়ের শরণ নিচ্ছি। যদি তুমি মুত্তাকী হও। সে বলল, আমি তো তোমার প্রতিপালক প্রেরিত, তোমাকে এক পবিত্র পুত্ৰ দান করার জন্যে। মারিয়াম বলল, কেমন করে আমার পুত্র হবে যখন আমাকে কোন পুরুষ স্পর্শ করেনি এবং আমি ব্যভিচারিণীও নই? সে বলল, এরূপই হবে। তোমার প্রতিপালক বলেছেন, এটা আমার জন্যে সহজসাধ্য এবং আমি তাকে এ জন্যে সৃষ্টি করব, যেন সে হয় মানুষের জন্যে এক নিদর্শন ও আমার নিকট হতে এক অনুগ্রহ; এটা তো এক স্থিরীকৃত ব্যাপার। তারপর সে গর্ভে তাকে ধারণ করল; তারপর তাকে নিয়ে এক দূরবতী স্থানে চলে গেল। প্রসব-বেদনা তাকে এক খেজুর গাছের নীচে আশ্রয় নিতে বাধ্য করল। সে বলল, হায়, এর পূর্বে আমি যদি মারা যেতাম ও লোকের স্মৃতি থেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হতাম!! ফিরিশতা তার নীচ দিক থেকে আহবান করে তাকে বলল, তুমি দুঃখ করো না, তোমার নীচ দিয়ে তোমার প্রতিপালক এক নহর সৃষ্টি করেছেন। তুমি তোমার দিকে খেজুর গাছের কাণ্ডে নাড়া দাও, তা তোমাকে পাকা তাজা খেজুর দান করবে। সুতরাং আহার কর, পান কর ও চোখ জুড়াও। মানুষের মধ্যে কাউকেও যদি তুমি দেখ, তখন বলবে, আমি দয়াময়ের উদ্দেশ্যে মৌনতাবলম্বনের মানত করেছি। সুতরাং আজ আমি কিছুতেই কোন মানুষের সাথে বাক্যালাপ করব না। তারপর সে সন্তানকে নিয়ে তার সম্প্রদায়ের নিকট উপস্থিত হল; তারা বলল, হে মারয়াম! তুমি তো এক অদ্ভূত কাণ্ড করে বসেছি। হে হারূনের বোন! তোমার পিতা অসৎ ব্যক্তি ছিল না এবং তোমার মা ছিল না ব্যভিচারিণী। তারপর মারিয়াম সন্তানের প্রতি ইংগিত করল। তারা বলল, যে কোলের শিশু, তার সাথে আমরা কেমন করে কথা বলব? সে বলল, আমি তো আল্লাহর বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন, আমাকে নবী করেছেন। যেখানেই আমি থাকি না কেন তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন, তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যতদিন জীবিত থাকি ততদিন সালাত ও যাকাত আদায় করতে। আর আমাকে আমার মায়ের প্রতি অনুগত করেছেন এবং তিনি আমাকে করেন নি উদ্ধত ও হতভাগ্য। আমার প্রতি শান্তি যে দিন আমি জন্মলাভ করেছি, যেদিন আমার মৃত্যু হবে এবং যেদিন জীবিত অবস্থায় আমি পুনরুথিত হব। এই-ই মারিয়াম-তনয় ঈসা। আমি বললাম সত্য কথা, যে বিষয়ে তারা বির্তক করে। সন্তান গ্ৰহণ করা আল্লাহর কাজ নয়, তিনি পবিত্ৰ মহিমময়। তিনি যখন কিছু স্থির করেন তখন বলেন, হও এবং তা হয়ে যায়। আল্লাহই আমার প্রতিপালক ও তোমাদের প্রতিপালক; সুতরাং তার ইবাদত কর, এটাই সরল পথ। তারপর দলগুলি নিজেদের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি করল; সুতরাং দুর্ভোেগ কাফিরদের মহা দিবস আগমন কালে। (১৯ মারিয়াম : ১৬-৩৭)
আল্লাহ কুরআন মজীদে মারিয়াম ও ঈসা (আ)-এর ঘটনাকে যাকারিয়ার ঘটনার পর পরই আলোচনা করেছেন। মারয়ামের ঘটনার পটভূমি রূপে যাকারিয়ার ঘটনাটি বর্ণনার পর এই ঘটনাটি আল্লাহ তাআলা বর্ণনা করেছেন, সূরা আলে-ইমরানে উভয় ঘটনা একই সাথে বর্ণিত হয়েছে। সূরা আম্বিয়ায় ঘটনাদ্বয়কে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং স্মরণ করা যাকারিয়ার কথা, যখন সে তার প্রতিপালককে আহবান করেছিল; হে আমার প্রতিপালক! আমাকে একা রেখো না। তুমি তো শ্রেষ্ঠ মালিকানার অধিকারী। তাব।পর আমি তার আহবানে সাড়া দিয়েছিলাম এবং তাকে দান করেছিলাম। ইয়াহিয়া এবং তার জন্যে তার স্ত্রীকে যোগ্যতা সম্পন্ন করেছিলাম। তারা সৎকর্মে প্রতিযোগিতা করতো, তারা আশা ও ভীতি সহকারে আমাকে ডাকত এবং তারা ছিল আমার কাছে বিনীত। এবং স্মরণ করা সেই নারীর কথা, যে নিজ সতীত্বকে রক্ষা করছিল। তারপর আমি তার মধ্যে আমার রূহ ফুকে দিয়েছিলাম এবং তাকে ও তার পুত্রকে করেছিলাম বিশ্ববাসীর জন্যে এক নিদর্শন।। (২১ আম্বিয়া ৪৮৯-৯১)
ইতিপূর্বে আমরা আলোচনা করেছি যে, মারয়ামকে তার মা বায়তুল মুকাদ্দাসের খিদমদে তাঁর জন্যে উৎসর্গ করেছিলেন। সেখানে মারিয়ামের বোনের স্বামী বা খালার স্বামী যাকারিয়্যা তার তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। যিনি ছিলেন ঐ যামানার নবী। যাকারিয়্যা (আ) মারয়ামের জন্যে বায়তুল মুকাদাসে একটি উত্তম কক্ষ বরাদ্দ করেন। সেখানে তিনি ব্যতীত অন্য কারও প্রবেশের অনুমতি ছিল না। প্রাপ্ত বয়স্ক হলে মারিয়াম আল্লাহর ইবাদতে এতো গভীরভাবে নিমগ্ন হন যে, সে যুগে তাঁর মত এত অধিক ইবাদতকারী অন্য কেউ ছিল না তার থেকে এমন সব অলৌকিক ঘটনা প্ৰকাশ পেতে থাকে, যা দেখে হযরত যাকারিয়্যার (আ) মনে ঈর্ষার উদ্রেক হয়। একদা ফিরিশতা তাকে সুসংবাদ দিলেন যে, আল্লাহ তাকে বিশেষ উদ্দেশ্যে মনোনীত করেছেন; অচিরেই তাঁর এক পুত্ৰ সন্তান জন্মলাভ করবেন, তিনি হবেন। পূত-পবিত্র সম্মানিত নবী ও বিভিন্ন মুজিযার অধিকারী। পিতা ব্যতীত সন্তান হওয়ার সংবাদে মারিয়াম অবাক হয়ে যান। তিনি বললেন, আমার বিবাহ হয়নি, স্বামী নেই, কিরূপে আমার সন্তান হবে? জবাবে ফিরিশতা জানালেন, আল্লাহ সব কিছু করতে সক্ষম। তিনি যখন কোন কিছু অস্তিত্বে আনতে চান, তখন শুধু বলেন৷ হয়ে যাও। আমনি তা হয়ে যায়। মারয়াম অতঃপর আল্লাহর সিদ্ধান্তের উপর বিনয়ের সাথে আত্মসমৰ্পণ করলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, তার সম্মুখে এক বিরাট পরীক্ষা। কেননা, সাধারণ লোক এতে সমালোচনার ঝড় উঠবে। আল্লাহর শক্তি সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব ও সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে অজ্ঞাত থাকার ফলে শুধু বাহ্যিক দৃষ্টিতে বিচার করেই তারা নানা কথা উঠাতে থাকবে। বায়তুল মুকাদাসে অবস্থানকালে বিভিন্ন প্রয়োজনে মারয়াম কখনও কখনও মসজিদের বাইরে আসতেন। যেমন মাসিক ঋতুস্রাব হলে কিংবা পানি ও খাদ্যের সন্ধানে অথবা অন্য কোন অতি প্রয়োজনীয় কাজে তিনি মসজিদ থেকে বেরিয়ে আসতেন। একদা এ জাতীয় এক বিশেষ প্রয়োজনে তিনি মসজিদ থেকে বের হলেন এবং দূরে এক স্থানে আশ্রয় নিলেন অর্থাৎ তিনি বায়তুল মুকাদ্দাস মসজিদের পূর্ব দিকে অনেক দূর পর্যন্ত একাকী চলে যান। আল্লাহ হযরত জিবরাঈল আমীনকে তথায় প্রেরণ করেন। জিবরাঈল (আ) মারয়ামের নিকট পূর্ণ মানবাকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করল। মারয়াম তাকে দেখেই বলে উঠলেন, আমি তোমার থেকে দয়াময়ের আশ্রয় প্রার্থনা করি যদি তুমি আল্লাহ ভীরু হও। আবুল আলিয়া বলেন, আয়াতে উল্লেখিত তাকিয়্যা বলা হয় এমন ব্যক্তিকে, যে নিষেধাজ্ঞা মেনে চলে, নিষিদ্ধ কাজকে যে ভয় করে। একটি দুর্বল মত অনুযায়ী বনী ইসরাঈলের এক বিখ্যাত লম্পটের নাম ছিল তাকিয়্যা। মারয়ামের নিকট জিবরাঈল মানবাকৃতিতে উপস্থিত হলে তাকে তাকিয়্যা ভেবে তিনি এ কথাটি বলেছিলেন। এ মতটি সম্পূর্ণ ভ্ৰান্ত ও একান্তই দুর্বল; এর কোন ভিত্তি বা प्रॉलीक्ल अभाc (नेरे। w
জিবরাঈল (আঃ) বলল, আমি তো শুধু তোমার পালনকর্তার প্রেরিত এক দৃত। অর্থাৎ আমি মানুষ নই—যা তুমি ভেবেছ; বরং আমি ফিরিশতা। আল্লাহ তোমার নিকট আমাকে প্রেরণ করেছেন। তোমাকে আমি এক পবিত্র পুত্ৰ দান করে যাব। মারিয়াম বলল, কিরূপে আমার পুত্ৰ হবে যখন কোন মানব আমাকে স্পর্শ করেনি এবং আমি ব্যভিচারিণীও কখনও ছিলাম না। অর্থাৎ আমার এখনও বিবাহ হয়নি এবং আমি কখনও অশ্লীল কাজে লিপ্ত হইনি। —এমতাবস্থায় আমার সন্তান হবে কিভাবে? সে বলল, এমনিতেই হবে। তোমার পালনকর্তা বলেছেন, এটা আমার জন্যে সহজসাধ্য। অর্থাৎ পুত্র হওয়ার সংবাদে মারিয়াম বিস্ময় প্রকাশ করে যে প্রশ্ন করেছিলেন, তার উত্তরে ফিরিশতা বললেন, স্বামী না থাকা সত্ত্বেও এবং ব্যভিচারিণী না হওয়া সত্ত্বেও তোমার পুত্ৰ সন্তান সৃষ্টির ব্যাপারে আল্লাহ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন; আর তাঁর জন্যে এ কাজ অতি সহজ। কেননা, তিনি যা ইচ্ছা করেন সব কিছুই করতে পারেন। অতঃপর আল্লাহ বলেন : আমি তাকে মানুষের জন্যে একটি নিদর্শন ও আমার পক্ষ থেকে অনুগ্রহ করতে চাই। অর্থাৎ এই অবস্থায় তাকে সৃষ্টি করে আমি বিভিন্ন পন্থায় আমার সৃষ্টি কৌশলের ক্ষমতার দৃষ্টান্ত পেশ করতে চাই। কেননা, আল্লাহ আদমকে নর-নারী ছাড়াই সৃষ্টি করেছেন, হাওয়াকে সৃষ্টি করেছেন নারী ছাড়া নির থেকে, ঈসাকে সৃষ্টি করেছেন নর ছাড়া নারী থেকে এবং অন্যান্য সবাইকে সৃষ্টি করেছেন নর ও নারী উভয় থেকে। আমার পক্ষ থেকে অনুগ্রহ স্বরূপ—এ কথার অর্থ হল-এই ঈসার সাহায্যে আমি মানুষের প্রতি আমার অনুগ্রহ প্ৰকাশ করতে চাই। কেননা, সে তাঁর শৈশবে মানুষকে কেবল আমার ইবাদতের দিকে আহবান করবে এবং আল্লাহকে স্ত্রী, সন্তান, অংশীদার সমকক্ষ, শরীক ও সাদৃশ্য থেকে মুক্ত থাকার বাণী প্রচার করবে।
এটা তো এক স্থিরীকৃত ব্যাপার-এ কথাটিকে দুই অর্থে নেয়া যায়, যথা: এক, মারিয়ামের সাথে জিবরাঈলের যে কথাবার্তা হয়, এটা ছিল তার শেষ কথা। অথাৎ এ বিষয়টি আল্লাহ। চূড়ান্ত করে ফেলেছেন যার বাস্তবায়ন অবধারিত এবং যা অবশ্যই সংঘটিত হবে। মুহাম্মদ ইব্ন ইসহাক এই অর্থ গ্রহণ করেছেন এবং ইব্ন জারীর এটা সমর্থন করেছেন। দুই, মারয়ামের মধ্যে জিরাবাঈল (আঃ) কর্তৃক ঈসার রূহকে ফুকে দেওয়ার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন সূরা তাহরীমে আল্লাহ বলেছেন : আল্লাহ মুমিনদের জন্যে আরও উপস্থিত করছেন, ইমরান তনয়া মারয়ামের দৃষ্টান্ত — যে তার সতীত্ব রক্ষা করেছিল, ফলে আমি তার মধ্যে রূহ ফুকে দিয়েছিলাম। (৬৬ তাহরীম : ১২)
জিবরাঈল (আ) কিভাবে ফুক দিয়েছিলেন, সে সম্পর্কে একাধিক মুফাসসির লিখেছেন যে, জিবরাঈল হযরত মারিয়ামের জামার আস্তিনে ফুক দিয়েছিলেন। ঐ ফুক জামার মধ্যে দিয়ে তার গুপ্ত অংগে প্রবেশ করে এবং সংগে সংগে তিনি অন্তঃসত্ত্বা হন, যেরূপ নারীরা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে থাকে স্বামীর সাথে সহবাসের মাধ্যমে। যারা বলেছেন, জিবরাঈল (আ) মারিয়ামের মুখে ফুক দিয়েছিলেন অথবা মারিয়ামের সাথে কথোপকথনকারী ছিলেন স্বয়ং ঐ রূহ, যা তার মুখের মধ্য দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করেছিল। তাদের এই বক্তব্য কুরআনের বর্ণনা ধারার পরিপন্থি। কারণ মারিয়ামের ঘটনার বর্ণনা পদ্ধতি থেকে স্পষ্ট জানা যায় যে, মারিয়ামের নিকট যাকে প্রেরণ করা হয়েছিল, তিনি ছিলেন একজন ফিরিশতা এবং সেই ফিরিশতা হলেন। হযরত জিবরাঈল আমীন। (আ)। আর তিনিই তাঁর মধ্যে ফুক দিয়েছিলেন। ফিরিশতা মারয়ামের গুপ্তঅংগে ফুক দেননি। বরং তিনি মারিয়ামের জামার আস্তিনে ফুক দিয়েছিলেন। সেই ফুক ভিতর দিয়ে গুপ্ত অংগে অবতরণ করে। এভাবেই মারিয়ামের মধ্যে ফিরিশতার ফুক প্রবেশ করে, যেমন আল্লাহ বলেন : অতঃপর আমি তার মধ্যে আমার রূহ ফুকে দিই। এ বাণী থেকে বুঝা যায় যে, ফুক তার
মধ্যে প্রবেশ করেছিল। তবে তা মুখের মধ্য দিয়ে নয়-যেমন উবায় ইব্ন কাব বলেছেন, কিংবা তার বক্ষ দিয়ে প্রবেশ করেনি- যেমন সুদী কোন কোন সাহাবার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন। তাই আল্লাহ বলেন : অতঃপর সে গৰ্ভে সন্তান ধারণ করল অর্থাৎ তার পুত্র গর্ভে এল এবং তাকে নিয়ে সে এক দূরবতী স্থানে চলে গেল। কেননা, গর্ভে সন্তান আসার পর মারিয়ামের অন্তরে স্বাভাবিক ভাবেই সংকোচ সৃষ্টি হয়। তিনি বুঝতে পারলেন, অচিরেই লোকজন তাঁর প্রসংগে নানা কথা ছড়াবে। প্রথম যুগের একাধিক তাফসীরবিদ এ ব্যাপারে বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ করেছেন।
ওহাব ইব্ন মুনাবৃবিহ বলেন, মারয়ামের অন্তঃসত্ত্বা হওয়া সম্পর্কে সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি টের পায়, সে হল বনী ইসরাঈলের ইউসুফ ইব্ন ইয়াকুব আন-নাজার নামক এক ব্যক্তি। তিনি ছিলেন মারয়ামেরই খালাত ভাই। মারিয়ামের পূত-পবিত্র চরিত্র, তার ইবাদত-বন্দেগী ও দীনদারী সম্পর্কে তিনি ভালভাবেই অবগত ছিলেন। কিন্তু বিবাহ ব্যতীত অন্তঃসত্ত্বা হওয়ায় তিনি। ভীষণভাবে বিস্মিত হন। একদিন তিনি মারিয়ামকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন, মারিয়াম! বল তো বীজ ছাড়াই কি শস্য হয়। কখনও? মারয়াম বললেন, কেন হবে না? সর্বপ্রথম শস্য কিভাবে সৃষ্টি হল? তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, বৃষ্টি ও পানি ব্যতীত কি বৃক্ষ জন্মায়? মারিয়াম বললেন,জন্মায় বৈ কি? না হলে প্রথম বৃক্ষের জন্ম হল কিভাবে? তিনি বললেন, আচ্ছা, পুরুষের স্পর্শ ব্যতীত কি সন্তান জন্মগ্রহণ করে? মারয়াম বললেন, হ্যাঁ, হয়। আল্লাহ আদমকে সৃষ্টি করছিলেন নর-নারী ব্যতীত; এরপর তিনি বললেন, এখন তোমার ব্যাপারটা আমাকে খুলে বল, কি হয়েছে? মারিয়াম বললেন, আল্লাহ আমাকে তার এক বাণীর সুসংবাদ দিয়েছেন, যার নাম হল মসীহ মারিয়াম তনয় ঈসা; দুনিয়া ও আখিরাতের সে মহা সম্মানের অধিকারী এবং আল্লাহর
ঘনিষ্ঠদের অন্তর্ভুক্ত। যখন সে মায়ের কোলে থাকবে এবং পূর্ণ বয়স্ক হবে তখন সে মানুষের
সংগে কথা বলবে, আর সে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হবে। বর্ণিত আছে যে, হযরত যাকারিয়্যা (আ)-ও মারিয়ামকে এ ধরনের প্রশ্ন করেছিলেন এবং তিনি তাঁকেও অনুরূপ উত্তর দিয়েছিলেন।
সুদী সনদ উল্লেখ পূর্বক কতিপয় সাহাবী থেকে বর্ণনা করেছেন যে, একদা মারিয়াম তাঁর বোনের নিকট উপস্থিত হন। বোন তাঁকে বললেন, আমি যে অন্তঃসত্বা, তাকি তুমি টের পেয়েছে? মারিয়াম বললেন, আমিও যে অন্তঃসত্ত্বা? তখন একে অপরকে জড়িয়ে ধরলেন ও আলিঙ্গন করলেন। অতঃপর ইয়াহয়ার মা বললেন, আমি স্বপ্নে দেখেছি আমার পেটে যে সন্তান আছে সে তোমার পেটের সন্তানকে সিজদা করছে।
কুরআন মজীদের আয়াতে সে ইংগিতই রয়েছে ৪ সে (ইয়াহয়া) হবে আল্লাহর বাণীর সমার্থক। হাদীসে উক্ত সিজদা বলতে এখানে বিনয় ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা বুঝানো হয়েছে। যেমন সালাম করার সময় করা হয়। পূৰ্বেকার শরীয়তে এ রকম নিয়ম চালু ছিল। আল্লাহ আদম (আঃ)-কে সিজদা করার জন্যে ফেরেশতাদেরকে যে হুকুম দিয়েছিলেন, সেটাও এই অর্থেই ছিল। আবুল কাসিম বলেন যে, সিজদা সংক্রান্ত উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় মালিক (র) বলেছেন, আমার ধারণা, এটা ঈসা (আঃ)-এর শ্রেষ্ঠত্ব বুঝানোর জন্যে ছিল। কেননা, আল্লাহ তাঁকে মৃতকে জীবিত করার এবং অন্ধ ও কুণ্ঠ রোগীকে নিরাময় করার ক্ষমতা দান করেছিলেন।
ইব্ন আবি হাতিম। এটি বর্ণনা করেছেন। মুজাহিদ থেকে বর্ণিত আছে, মারিয়াম বলতেন, আমি যখন একাকী নির্জনে থাকতাম, তখন আমার পেটের বাচ্চা আমার সাথে কথা বলত। আর যখন আমি লোক সমাজে থাকতাম, তখন সে আমার পেটের মধ্যে তাসবীহ পাঠ করত।
স্পষ্টত মারিয়াম অন্যান্য নারীদের মত স্বাভাবিকভাবে নয় মাস গৰ্ভ ধারণের পর প্রসব করেছিলেন। কেননা, এর ব্যতিক্রম হলে তার উল্লেখ করা হত। ইকরিমা ও ইব্ন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন, তাঁর এ গর্ভকাল ছিল আট মাস। ইব্ন আব্বাসের অপর বর্ণনায় রয়েছে যে, তিনি গৰ্ভধারণ মাত্ৰই সন্তান প্রসব করেছিলেন। আবার কেউ কেউ তাঁর গর্ভকাল মাত্র নয় ঘন্টা স্থায়ী ছিল বলে বলেছেন।
এ মতের সমর্থনে নিমের আয়াতের উল্লেখ করেছেন : তৎপর সে গর্ভে তাকে ধারণ করল। অতঃপর তৎসহ এক দূরবতী স্থানে চলে গেল। প্রসব বেদনা তাকে এক খেজুর বৃক্ষ মূলে আশ্রয় নিতে বাধ্য করল। (১৯ মারয়াম ২২-২৩)। ৩-৪ (অতঃপর) অক্ষরটি একাধিকবার ব্যবহৃত হয়েছে এবং এ অক্ষরটি দুটি কাজের মধ্যে স্বল্প সময়ের ব্যবধান বুঝাবার জন্যে ব্যবহৃত হয়। তবে বিশুদ্ধতর মত হল, একটি কাজ বা ঘটনার পর আর একটি কাজ বা ঘটনা তার স্বাভাবিক ব্যবধান সহ আসে। যেমন সুৱা হাজে আল্লাহ বলেন, তুমি কি লক্ষ্য কর না যে, আল্লাহ বারি বর্ষণ করেন আকাশ হতে অতঃপর সবুজ শ্যামল হয়ে উঠে। পৃথিবী? (২২: ৬৩) (এখানে স্পষ্ট যে, বারি বর্ষণের অল্পক্ষিণ পরেই পৃথিবী সবুজ শ্যামল হয়ে উঠে না; বরং স্বাভাবিক নিয়মে ব্যবধানের পরেই সে রকম হয়।) অনুরূপ সূরা মুমিনূনে আল্লাহ বলেন : অতঃপর আমি শুক্র বিন্দুকে পরিণত করি আলাকে। এবং আলাককে পরিণত করি অস্থিাপুঞ্জরে অতঃপর অস্থিাপুঞ্জকে ঢেকে দেই গোশত দ্বারা। অবশেষে তাকে গড়ে তুলি অন্য এক সৃষ্টিরূপে। অতএব সর্বোত্তম স্রষ্টা আল্লাহ কত মহান! (২৩৪১৩)
আয়াতে বর্ণিত মানব সৃষ্টির প্রতিটি পর্যায় অতিক্রম করতে সময় লাগে চল্লিশ দিন। এ কথা বুখারী ও মুসলিমের হাদীসে আছে। মুহাম্মদ ইব্ন ইসহাক লিখেছেন, গোটা বনী
ইসরাঈলের মধ্যে এ সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে যে, মারিয়াম অন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন। এতে যাকারিয়া পরিবার দুঃখ শোকে সর্বাধিক মুহ্যমান হয়ে পড়ে। কোন কোন ধর্মহীন ব্যক্তি (যিনদীক) জনৈক ইউসুফের দ্বারা এরূপ হয়েছে বলে অপবাদ রটায়। ইউসুফ বায়তুল মুকাদ্দাসে একই সময়ে ইবাদত বন্দেগী করতেন। মারয়াম লোকালয় থেকে বহু দূরে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান। আল্লাহ বলেন, প্রসব বেদনা তাকে এক খজুর- বৃক্ষ তলে আশ্রয় নিতে বাধ্য করল। ইমাম নাসাঈ (র) আনাস (রা) থেকে এবং বায়হাকী শাদাদ ইব্ন আওস থেকে নির্দোষ সনদে মারফু হাদীছ বর্ণনা করেন যে, যে স্থানে মারয়াম আশ্রয় নিয়েছিলেন সে স্থানের নাম বায়তে লাহম (বেথেলহাম)। পরবর্তীকালে জনৈক রোমান সম্রাট ঐ স্থানে একটি সৌধ নির্মাণ করেন। সে স্মৃতি- সৌধ সম্পর্কে আমরা পরে আলোচনা করব।
আল্লাহর বাণী মারয়াম বলল হায়, আমি যদি কোনরূপে এর পূর্বে মারা যেতম এবং মানুষের স্মৃতি থেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যেতাম! মারয়ামের এ মৃত্যু কামনা থেকে দলীল গ্ৰহণ করা হয়ে থাকে যে, ফিতনা বা মহা বিপদকালে মৃত্যু কামনা করা বৈধ। মারয়ামও এরূপ মহা-বিপদকালে মৃত্যু কামনা করেছিলেন। কেননা তিনি নিশ্চিত রূপেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, আমার ইবাদত-বন্দেগী, পবিত্রতা, সার্বক্ষণিক মসজিদে অবস্থান ও ইতিকাফ করা, নবী পরিবারের লোক হওয়া ও দীনদারী সম্পর্কে লোকজন যতই অবগত থাকুক না কেন, যখনই আমি সন্তান কোলে নিয়ে তাদের মাঝে আসব তখনই তারা আমার বিরুদ্ধে অপবাদ দিবে। আমি যতই সত্য কথা বলি না কেন, তারা আমাকে মিথ্যাবাদী প্ৰতিপন্ন করবে।
এসব চিন্তা করেই তিনি উপরোক্ত কামনা করেন যে, এ অবস্থার সম্মুখীন হওয়ার আগেই যদি আমার মৃত্যু হয়ে যেত! কিংবা মানুষের স্মৃতি থেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যেতম! অর্থাৎ যদি আমার জন্মই না হত!
আল্লাহর বাণী, অতঃপর নিন্ন দিক থেকে তাকে আহবান করল কে এই আহবানকারী? আত্তকী (র) ইব্ন আব্বাস (রা) থেকে বর্ননা করেন যে, তিনি ছিলেন জিবরীল ফিরিশতা। শিশু ঈসা আহবানকারী নন; কেননা জনসম্মুখে যাওয়ার পূর্বে ঈসা (আঃ)-এর মুখ থেকে কোন কথা বের হয়নি। সাঈদ ইব্ন জুবায়র, আমর ইব্ন মায়মুন, যাহহাক, সুদী ও কাতাদা এরূপই বলেছেন। কিন্তু মুজাহিদ, হাসান, ইব্ন যায়ীদ এবং সাঈদ ইব্ন জুবায়রের এক বর্ণনা মতে এই আহবানকারী ছিলেন, শিশু ঈসা (আ)। ইব্ন জারীর এই মতের সমর্থক।
আল্লাহর বাণীঃ তুমি দুঃখ করো না। তোমার পালনকর্তা তোমার পাদদেশে একটি নহর সৃষ্টি করেছেন। (… এর অর্থ অধিকাংশ তাফসীরবিদদের মতে ছােট নহর। তাবারানী এ প্রসংগে একটি হাদীছ বর্ণনা করেছেন; কিন্তু সে হাদীছের সনদ দুর্বল। ইব্ন জারীর এ মত সমর্থন করেন এবং এটি বিশুদ্ধ মত। পক্ষান্তরে, হাসান, রাবী ইব্ন আনাস, ইব্ন আসলাম প্রমুখ মনীষীদের মতে … দ্বারা এখানে শিশু পুত্র ঈসাকে বুঝানো হয়েছে। কিন্তু পরবর্তী আয়াতের প্রতি লক্ষ্য করলে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, প্রথম মতই সঠিক। আল্লাহ বলেন, তুমি নিজের দিকে খেজুর গাছের কাণ্ডে নাড়া দাও, তা থেকে তোমার উপর সুপক্ক তাজা খেজুর পতিত হবে। আল্লাহ এ দু। আয়াতে প্ৰথমে পানি ও পরে খাদ্যের ব্যবস্থার কথা জানিয়ে দিয়েছেন। তাই পরবর্তী আয়াতে বলেন, এখুন। আহার কর, পান কর ও চক্ষু শীতল কর। কেউ বলেছন, খেজুর গাছটির কাণ্ডটি শুষ্ক ছিল। কেউ বলেছেন, শুষ্ক নয়। ফলেবান ছিল। এ রকম হওয়াও সম্ভব যে, খেজুর গাছটি তাজা ছিল, কিন্তু ঐ সময় তাতে ফল ছিল না। কেননা ঈসা। (আ)-এর জন্ম হয়েছিল শীতকালে। আর শীতকাল খেজুর ফলের মওসুম নয়। মারিয়ামের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ সূচক বাণী তোমার উপর সুপক্ক তাজা ফল পতিত হবে থেকে এই শেষোক্ত মতের সমর্থন বুঝা যায়। আমর ইব্ন মায়মুন বলেন, প্রসূতিদের জন্য খুরমা ও সুপক্ক তাজা খেজুরের চেয়ে অধিক উৎকৃষ্ট খাদ্য আর নেই। এ কথা বলার পর তিনি উপরোক্ত আয়াত তিলাওয়াত করেন। ইব্ন আবি হাতিম……. আলী ইব্ন আবি তালিব (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ খেজুর গাছকে তোমরা ভালবাস, সে তোমাদের ফুফু। কেননা তোমাদের পিতা আদমকে যে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছিল সেই মাটি থেকেই খেজুর গাছের সৃষ্টি আর খেজুর গাছ ব্যতীত অন্য কোন গাছের নর-মাদার প্রজনন করা হয় না। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ তোমাদের স্ত্রীগণ যেন শিশু সন্তানকে তাজা খেজুর খাওয়ায়। যদি তাজা খেজুর পাওয়া না যায় তা হলে অন্তত খুরমা যেন খেতে দেয়। জেনে রেখো, আল্লাহর নিকট সেই বৃক্ষের চেয়ে উত্তম কোন বৃক্ষ নেই, যে বৃক্ষের নীচে মারয়াম বিনত ইমরান অবতরণ করেছিলেন। এ হাদীসটি আবু ইয়ালাও তার মুসনাদ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন।
আল্লাহর বাণী : যদি মানুষের মধ্যে কাউকে তুমি দেখ, তবে বলে দিওঃ আমি আল্লাহর উদ্দেশ্যে সওম মানত করেছি। সুতরাং আজ আমি কিছুতেই কোন মানুষের সাথে কথা বলব না। মারিয়ামকে তার নীচের দিক থেকে যিনি আহবান করেছিলেন সেই আহবানকারীর কথা এই পর্যন্ত শেষ হল। তুমি যদি কোন লোককে দেখ, তবে তাকে বলে দিও এখানে মুখ দিয়ে কথা বলা নয়। বরং ইশারা করে ও আপনি অবস্থার প্রতি ইংগিত করার কথা বুঝানো হয়েছে। আমি আল্লাহর উদ্দেশ্যে সওম মানত করেছি। এখানে সওম অর্থ চুপ থাকা ও মৌনতা অবলম্বন করা। সে যুগের শরীআতে পানাহার ও বাক্যালাপ থেকে বিরত থাকাকে সওম বলা হত। কাতাদা, সুদী ও ইব্ন আসলাম এ কথা বলেছেন। পরবর্তী আয়াতের দ্বারা তা বুঝা যায়। আজ আমি কিছুতেই কোন মানুষের সাথে কথা বলব না। কিন্তু আমাদের শরীআতে কোন রোযাদার ব্যক্তি যদি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চুপচাপ থাকে ও মীেনতা অবলম্বন করে কাটায়। তবে তার রোযা, মাকরূহ হয়ে যায়।
আল্লাহর বাণী : অতঃপর মারিয়াম সন্তানকে নিয়ে তার সম্প্রদায়ের কাছে উপস্থিত হল। তারা বলল : হে মারুয়াম, তুমি তো একটি অদ্ভুত কাণ্ড করে বসেছি। হে হারূন-ভগিনী, তোমার পিতা তো অসৎ লোক ছিল না এবং তোমার মা-ও ছিল না ব্যভিচারিণী। আহলি-কিতাবদের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রাথমিক যুগের বহু সংখ্যক আলিম বলেন যে, মারয়ামের সম্প্রদায়ের লোকেরা যখন দেখল, মারুয়াম তাদের মাঝে নেই, তখন তারা তাঁর সন্ধানে বের হয়। অবশেষে তারা মারিয়ামের নিকট পৌঁছে সে স্থানটিকে জ্যোতির্ময় দেখতে পেল এবং তার সাথে নবজাত সন্তান দেখে বলল, হে মারিয়াম, তুমি তো এক বড় ধরনের অপরাধ করে বসেছি; কিন্তু তাদের এই বক্তব্য সংশয়মুক্ত নয়। এর প্রথম অংশ শেষ অংশের সাথে সাংঘর্ষিক। কেননা, কুরআনের ভাষ্য থেকে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, মারিয়াম তার নবজাত শিশুকে নিজে কোলে নিয়ে সম্প্রদায়ের নিকট উপস্থিত হয়েছিলেন। ইব্ন আব্বাস (রা) বলেছেন, সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার চল্লিশ দিন পর ও নিফাসের ইদ্দত থেকে পবিত্র হওয়ার পর মারিয়াম সম্প্রদায়ের নিকট এসেছিলেন।
মোটকথা, মারিয়ামের সম্প্রদায়ের লোকেরা যখন তাঁর কোলে নবজাত শিশু সন্তানকে দেখল তখন বললঃ হে মারয়াম! তুমি তো এক বিরাট অন্যায় কাজ করে ফেলেছি। L__৯, ৭ ৮ ৯ হচ্ছে যে কোন গুরুতর অপকর্ম বা জঘন্য উক্তি। অতঃপর তারা মারিয়ামকে উদ্দেশ্য করে বলল, হে হারূনের বোন! এই হারূন কে, সে সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। এক মতানুযায়ী ঐ যুগে হারূন নামে একজন সুপ্ৰসিদ্ধ ইবাদতকারী লোক ছিলেন। মারিয়াম বেশী পরিমাণ ইবাদত করে তাঁর সমপর্যায়ে উন্নীত হয়েছিলেন। এই সাদৃশ্যের জন্যই মারয়ামকে হারূনের বোন বলা হয়েছে। সাঈদ ইব্ন জুবোয়র বলেন, ঐ যুগে হারূন নামে এক জঘন্য লোক ছিল। তার সাথে তুলনা করে হারূনের বোন বলা হয়েছে। তৃতীয় মতানুযায়ী ইনি মূসা (আঃ)-এর ভাই হারূন। তাঁর ইবাদতের সাথে মারয়ামের ইবাদতের সাদৃশ্য থাকায় এখানে হারূনের বোন বলা হয়েছে। চতুর্থ মত মুহাম্মদ ইব্ন কাব আল-কুরাজীর, যাতে বলা হয়েছে, এই মারিয়াম মূসা ও হারূন (আ)-এর সহোদর বোন। সে কারণে হারূনের বোন বলা হয়েছে। কিন্তু এ মতটি যে সম্পূর্ণ ভ্ৰান্ত তা সামান্য শিক্ষিত লোকের কাছেও স্পষ্ট। কেননা ঈসার মা মারিয়াম ও হারূন-মূসার মধ্যে দীর্ঘ সময়ের ব্যবধান রয়েছে। তবে মুহাম্মদ কুরাজী সম্ভবত তাওরাতের একটি বর্ণনা থেকে বিভ্রান্ত হয়েছেন। ঐ বর্ণনায় আছে, যে তারিখে আল্লাহ মূসা (আ)-কে মুক্তি দিয়েছিলেন এবং ফিরআওন ও তার দলবলকে ডুবিয়ে মেরেছিলেন, প্রতি বছর সেই তারিখে মূসা ও হারূনের বোন মারিয়াম আনন্দে ঢোল পিটাতেন। কুরাজী মনে করেছেন এই মারিয়াম ও ঐ মারিয়াম অভিন্ন। কিন্তু তাঁর এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। তা ছাড়া এটা সহীহ হাদীস ও কুরআনী বর্ণনার পরিপন্থী। তাফসীর গ্রন্থে এ বিষয়ে আমরা বিশদ আলোচনা করেছি। পঞ্চম মতে, হারূন মারিয়ামেরই সহোদর ভাই। সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, ঈসার মা মারিয়ামের হারূন নামে এক ভাই ছিলেন। মারিয়ামের জন্ম ও তাঁর মা কর্তৃক মানত করার ঘটনায় কোথাও এ কথা বলা হয়নি যে, মারিয়াম তাঁর বাপ মায়ের একমাত্র কন্যা ছিলেন, তার কোন ভাই ছিল না।
ইমাম আহমদ . মুগীরা ইব্ন শুবা থেকে বর্ণিত। মুগীরা বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) আমাকে নাজরানে প্রেরণ করেন। নাজরানবাসীরা আমাকে বলল, আপনারা কুরআনে পড়েন। ৩,৩১LA. এ.২। হে হারূনের বোন! কিন্তু এর অর্থের দিকে কি লক্ষ্য করেছেন? কেননা হারূনের ভাই মূসা ও মারয়াম-তনয় ঈসার মাঝে তো সময়ের বিরাট ব্যবধান। মুগীরা বলেন, আমি মদীনায় ফিরে এসে রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বিষয়টি জানাই। তিনি বললেন, তুমি তাদেরকে এ কথা কেন বললে না যে, মানুষ তখন পূর্ববতী নবী ও সত্যনিষ্ঠ লোকের নামের সাথে মিলিয়ে নাম রাখত। ইমাম মুসলিম, নাসাঈ ও তিরমিয়ী এ হাদীসটি আবদুল্লাহ ইব্ন ইদরীস থেকে বর্ণনা করেছেন। তিরমিয়ী একে হাসান, সহীহ ও গরীব আখ্যায়িত করে বলেছেন, ইব্ন ইদরীস ব্যতীত অন্য কারও থেকে আমরা এ হাদীস পাইনি। অন্য বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছিলেন : তাদেরকে তুমি কেন এ উত্তর দিলে না যে, তারা তাদের পূর্ববতী সৎলোক ও নবীদের নামের অনুসরণে নাম রাখত। কাতাদা প্রমুখ আলিমগণ উল্লেখ করেছেন যে, সে সময়ে প্রচুর লোকের নাম রাখা হত হারূন বলে। কথিত আছে, একবার তাদের এক জানাযায় বহু লোক উপস্থিত হয়। তন্মধ্যে হারূন নামধারী লোকের সংখ্যাই ছিল চল্লিশ হাজার।
মোটকথা, তারা বলেছিল, হে হারূনের বোন এবং হাদীস থেকেও প্রমাণ পাওয়া যায় যে, হারুন নামে মারিয়ামের এক জ্ঞাতি ভাই ছিলেন এবং দীনদারী ও পরহেযগারীতে তার সুখ্যাতি ছিল। তখন তারা বলল : তোমার পিতা অসৎ লোক ছিলেন না এবং তোমার মা-ও ছিলেন না ব্যভিচারিণী। অৰ্থাৎ তুমি তো এমন পরিবারের মেয়ে নও, যাদের চরিত্র এত নীচু পর্যায়ের। তোমার পরিবারের কেউই তো মন্দ কাজে জড়িত ছিল না। তোমার ভাই, পিতা ও মাতা কেউ তো এরূপ ছিলেন না। এভাবে তারা মারিয়ামের চরিত্রে কলংক লেপে দিল এবং মহা অপবাদ আরোপ করল। ইব্ন জারীর (র) তার ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন, তারা হযরত যাকারিয়া (আ) এর উপর অসৎ কর্মের অপবাদ দেয় এবং তাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করে। যাকারিয়া (আ) সেখান থেকে পলায়ন করলে তারাও তাঁর পিছু ধাওয়া করে। সম্মুখে একটি গাছে তাকে আশ্রয় দেয়ার জন্যে দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। তিনি তার মধ্যে প্রবেশ করেন। কিন্তু ইবলীস তার চাদরের আচল টেনে ধরে। তখন তারা গাছটি সহ তাকে দ্বিখণ্ডিত করে দেয়।
কতিপয় মুনাফিক মারয়ামকে তার খালাত ভাই ইউসুফ ইব্ন ইয়াকুব আল-নাজ্জারকে জড়িয়ে অপবাদ দেয়। সম্প্রদায়ের লোকদের এ সব অপবাদের মুখে মারিয়ামের অবস্থা যখন সঙ্গীন হয়ে পড়ল, বাকশক্তি রুদ্ধ হয়ে গেল এবং নিজেকে অপবাদ থেকে মুক্ত করার কোন উপায়ই রইলো না, তখন তিনি মহান আল্লাহর উপর ভরসা রেখে হাত দ্বারা সন্তানের দিকে ইংগিত করলেন। অর্থাৎ সন্তানের দিকে ইংগিত করে তাদেরকে বুঝিয়ে দিলেন যে, তোমরা ওর কাছে জিজ্ঞেস কর এবং তার সাথে কথা বল। কেননা, তোমাদের প্রশ্নের জওয়াব তার কাছে পাওয়া যাবে এবং তোমরা যা শুনতে চোচ্ছ, তা তার কাছেই আছে। তখন উপস্থিত জনতার মধ্য থেকে দুষ্ট-দুর্দান্ত প্রকৃতির লোকেরা বললঃ যে কোলের শিশু, তার সাথে আমরা কেমন করে কথা বলব? অর্থাৎ তুমি আমাদের প্রশ্নের উত্তর অবুঝ শিশু বাচ্চার উপর কি করে ছেড়ে দিলে? সে তো সবেমাত্র কোলের শিশু। যে মাখন ও ঘোলের মধ্যে পার্থক্য করতে জানে না। তুমি আমাদের সাথে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করছ এবং মুখ দ্বারা কথা না বলে, অবুঝ শিশুর দিকে ইংগিত করে আমাদের সাথে উপহাস করছি। ঠিক এমন সময় শিশু ঈসা বলে উঠলেন : আমি তো আল্লাহর বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন এবং আমাকে নবী করেছেন। আমি যেখানেই থাকি, তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন। তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, যতদিন জীবিত থাকি, ততদিন সালাত ও যাকাত আদায় করতে এবং মায়ের অনুগত থাকতে এবং আমাকে তিনি উদ্ধত ও হতভাগ্য করেন নি। আমার প্রতি সালাম যেদিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি। যে দিন মৃত্যুবরণ করব এবং যে দিন পুনরুজ্জীবিত হয়ে উত্থিত হব। (১৯ মারায়াম )
এই হল ঈসা (আ) মুখ থেকে প্রকাশিত প্রথম কথা।
সর্বপ্রথম তিনি বললেন : আমি আল্লাহর বান্দা, এ কথার দ্বারা তিনি আল্লাহর দাসত্বকে স্বীকার করে নেন এবং আল্লাহ যে তার প্রতিপালক এ কথার ঘোষণা দেন। ফলে জালিম লোকেরা দাবি করে যে, ঈসা (আ) আল্লাহর পুত্র, এ থেকে আল্লাহ যে পবিত্র তা তিনি ঘোষণা করেন। ঈসা আল্লাহর পুত্র নন। বরং তিনি যে, তাঁর বান্দা ও রাসূল এবং তাঁর এক দাসীর পুত্ৰ একথাও ঘোষণা করেন। এরপর জাহিল লোকেরা তার মায়ের উপর যে অপবাদ দিয়েছিল। সে অপবাদ থেকে তার মা যে পবিত্র ছিলেন সে সম্পর্কে বলেন, আল্লাহ আমাকে কিতাব দিয়েছেন। ও নবী করেছেন। কেননা আল্লাহ এমন ব্যক্তিকে নবুওত দান করেন না, যার জন্ম হয় ব্যভিচারের মাধ্যমে। অথচ ঐসব অভিশপ্ত লোকগুলো ঈসা (আ)-এর প্রতি সেরূপ কুৎসিৎ ধারণাই পোষণ করেছিল। সূরা নিসায় আল্লাহ বলেন, তারা লানতগ্রস্ত হয়েছিল তাদের কুফরীর জন্যে এবং মারিয়ামের প্রতি গুরুতর অপবাদ দেওয়ার জন্যে (৪ নিসা : ১৫৬)!
সেই যুগের কতিপয় ইহুদী এই অপবাদ রটিয়ে দিয়েছিল যে, মারিয়াম ঋতুবতী অবস্থায় ব্যভিচারে লিপ্ত হন। এতে তিনি অন্তঃসত্ত্বা হন (আল্লাহর লানত তাদের প্রতি)। আল্লাহ এ অপবাদ থেকে তাঁকে মুক্ত বলে ঘোষণা করেন এবং জানান যে, তিনি মহাসত্যবাদী তাঁর পুত্ৰকে আল্লাহ নবী ও রাসূল বানিয়েছেন। শুধু নবী-রাসূলই বানাননি, সমস্ত নবীদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় পাঁচজনের অন্যতম করেছেন। এ দিকেই ইংগিত করে শিশু ঈসা (আঃ) বললেন : যেখানেই আমি থাকি না কেন, তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন। কেননা, তিনি যেখানেই থাকতেন। সেখানেই মানুষকে এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহবান জানাতেন। একই সাথে আল্লাহকে স্ত্রী-পুত্র গ্রহণসহ যাবতীয় দোষ-ত্রুটি মুক্ত হওয়ার ঘোষণা করতেন। তিনি আমাকে সালাত ও যাকাতের নির্দেশ দিয়েছেন যতদিন আমি জীবিত থাকি। এখানে বান্দার জন্যে দটি স্থায়ী কর্মসূচীর উল্লেখ করা হয়েছে, যথা : সালাতে আল্লাহর সম্মুখে দণ্ডায়মান হওয়া ও যাকাত প্রদানের মাধ্যমে সৃষ্টির সেবা করা। সালাতের দ্বারা দাসত্বের গুণাবলী বিকশিত হয়। আর যাকাত আদায়সহ অভাবী লোকদের সাহায্য, অতিথি সেবা, পরিবারবর্গের ভরণ-পোষণ, দাস-মুক্তি ও অন্যান্য সৎকাজে অর্থ ব্যয়ের দ্বারা যেমন উত্তম চরিত্র গড়ে ওঠে, তেমনি অর্থ-সম্পদও পবিত্র হয়। অতঃপর বলেন : এবং নির্দেশ দিয়েছেন আমার মায়ের অনুগত থাকতে এবং আমাকে তিনি উদ্ধত ও হতভাগ্য করেন নি। অর্থাৎ আল্লাহ আমাকে মায়ের অনুগত করে সৃষ্টি
- করেছেন। শুধুমাত্র মায়ের আনুগত্যের কথা এ জন্যে বলেছেন যে, তিনি পিতা বিহীনই জন্মগ্রহণ করেন। মহান সেই সত্তা যিনি সমগ্র জগতের স্রষ্টা এবং যিনি তাঁর সৃষ্টিকে পবিত্র রেখেছেন এবং প্ৰত্যেককে সঠিক দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। এবং আমাকে তিনি উদ্ধত ও হতভাগ্য করেন নি। অর্থাৎ আল্লাহ আমাকে পাষাণ-হৃদয় ও কর্কশভাষী করেন নি এবং আল্লাহর নির্দেশ ও আনুগত্যের পরিপন্থী কোন কথা বা কাজ আমার দ্বারা হবার নয়। আমার প্রতি শান্তি যেদিন আমি জন্মলাভ করেছি, যেদিন আমার মৃত্যু হবে এবং যেদিন জীবিত অবস্থায় আমি পুনরুথিত হব। উল্লেখিত তিনটি অবস্থায় শান্তির গুরুত্ব সম্পর্কে ইতিপূর্বে হযরত ইয়াহয়া ইব্ন যাকারিয়ার বর্ণনা প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে।
এ পর্যন্ত হযরত ঈসা ইব্ন মারিয়াম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার পর আল্লাহ বলেছেন : এই মারিয়াম-তনয় ঈসা, আমি সত্য কথা বলে দিলাম, যে বিষয়ে লোকেরা বিতর্ক করছে। সন্তান গ্ৰহণ করা আল্লাহর কাজ নয়, তিনি পবিত্ৰ মহিমময় সত্তা। তিনি যখন কিছু করার সিদ্ধান্ত করেন তখন বলেন, হও এবং তা হয়ে যায়। (১৯ মারায়াম : ৩৪, ৩৫)
এখানে যেমন বলা হয়েছে তেমনি সূরা আলে-ইমরানেও ঈসা (আ)-এর ঘটনা বিস্তারিত আলোচনা করার পর বলা হয়েছে :
—যা আমি তোমার নিকট বিবৃত করছি তার নিদর্শন ও সারগর্ভ বাণী হতে। আল্লাহর নিকট ঈসার দৃষ্টান্ত আদমের দৃষ্টান্ত সদৃশ। তৃাকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছিলেন, অতঃপর তাকে বলেছিলেন, হও ফলে সে হয়ে গেল। এ সত্য তোমার প্রতিপালকের নিকট হতে, সুতরাং তুমি সংশয়কারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে না। তোমার নিকট জ্ঞান আসার পর যে কেউ এ বিষয়ে তোমার সাথে তর্ক করে তাকে বল, এস, আমরা আহবান করি আমাদের পুত্ৰগণকে ও তোমাদের পুত্রগণকে, আমাদের নারীগণকে ও তোমাদের নারীগণকে, আমাদের নিজদেরকে ও তোমাদের নিজদেরকে; অতঃপর আমরা বিনীত আবেদন করি এবং মিথ্যাবাদীদের উপর দেই। আল্লাহর লানত। নিশ্চয়ই এটা সত্য বৃত্তান্ত। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই। নিশ্চয় আল্লাহ পরম প্রতাপশালী, প্রজ্ঞাময়। যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে নিশ্চয় আল্লাহ ফাসাদকারীদের সম্বন্ধে সম্যক অবহিত। (আল-ইমরান : ৫৮-৬৩)
এ কারণে নাজরান থেকে আগত প্রতিনিধি দলের সাথে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে মুবাহালার আয়াত নাযিল হয়। নাজরানের এই খৃষ্টান প্রতিনিধি দলের সদস্য ছিল ষািটজন। তন্মধ্যে চৌদ্দজন ছিল নেতৃস্থানীয় এবং তিনজন ছিল সকলের শীর্ষস্থানীয়। তাদের সিদ্ধান্তই ছিল সবার জন্যে পালনীয়। তারা হল- আকিব, সায়্যিদ ও আবু হারিছা ইব্ন আলকামা। তারা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাথে হযরত ঈসা (আ) সম্বন্ধে বিতর্কে লিপ্ত হয়। তখন এ প্রসংগে আল্লাহ সূরা আলে ইমরানের প্রথমাংশে অবতীর্ণ করেন। এতে ঈসা মাসীহ সম্পর্কে, তাঁর জন্ম ও তাঁর মায়ের জন্ম প্রসংগে আলোচনা করা হয় এবং রাসূলুল্লাহ (সা)-কে নির্দেশ দেওয়া হয় যে, তারা যদি কথা না মানে ও তোমার আনুগত্য না করে তবে তাদের সাথে মুবাহালা (বিনীত প্রার্থনা) করবে। কিন্তু দেখা গেল, তারা মুবাহালা করা থেকে সরে দাড়াল এবং রাসূলুল্লাহর সাথে সন্ধি করার জন্যে অগ্রসর হল। প্রতিনিধি দলের অন্যতম নেতা আকিব সংগী খৃষ্টানদের সম্বোধন করে বলল, তোমরা তো নিশ্চিত জান যে, মুহাম্মদ অবশ্যই আল্লাহর প্রেরিত নবী, তোমাদের নবী ঈসার সংবাদ অনুযায়ী সময়ের নির্দিষ্ট ব্যবধানে তিনি এসেছেন। তোমরা অবশ্যই অবগত আছ যে, কোন সম্প্রদায় আল্লাহর নবীর সাথে মুবাহালা করলে গোটা সম্প্রদায়ই ধ্বংস হয়ে যায়। তোমরাও যদি তাঁর সাথে মুবাহাল কর, তবে সমুলে ধ্বংস হয়ে যাবে। আর যদি মুবাহালা না কর তাহলে তোমাদের ধর্ম সুসংহত হবে এবং ঈসা (আ) সম্বন্ধে তোমাদের যে দাবি, তাও প্রতিষ্ঠিত থাকবে। সুতরাং তাঁর সাথে সন্ধি চুক্তি করে দেশে ফিরে शN3।
অতঃপর তারা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট সন্ধির প্রস্তাব দিল এবং জিযিয়া কর ধার্যের আবেদন জানাল এবং সেই সাথে রাসূলের পক্ষ থেকে একজন নির্ভরযোগ্য লোক তাদের সংগে পাঠাবার অনুরোধ করে। রাসূলুল্লাহ (সা) তাদের প্রস্তাবে সম্মত হয়ে আবু উবায়দা ইব্ন জারুরাহ (রা)-কে তাদের সাথে পাঠিয়ে দিলেন। সূরা আলে-ইমরানের তাফসীরে আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। সীরাতুন-নবী অধ্যায়ে এ প্রসংগে বিশদ আলোচনা করা হবে।
মোটকথা, আল্লাহ হযরত ঈসা-মাসীহর ঘটনা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি আপন রাসূলকে বলেছেন : এ-ই-মারয়ামের পুত্র ঈসা, সত্য কথা, যে সম্পর্কে লোকেরা বিতর্ক করে।অর্থাৎ ঈসা (আঃ) আল্লাহর এক সৃষ্ট দাস। তাঁর এক দাসীর গর্ভ থেকে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এ কারণে আল্লাহ বলেন : আল্লাহ এমন নন যে, সন্তান গ্ৰহণ করবেন, তিনি পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা। তিনি যখন কোন কাজ করার সিদ্ধান্ত করেন, তখন এ কথাই বলেন : হও এবং তা হয়ে যায়। অর্থাৎ কোন কিছুই তার সিদ্ধান্তকে অচল করতে পারে না। কোন কিছুর তিনি পরোয়া করেন না এবং কোন কাজে তিনি ক্লান্ত হন না। বরং তিনি সব কিছুই করতে সক্ষম, যা ইচ্ছা করেন তা-ই করে থাকেন। তাঁর বিষয়টা হল এমন যে, যখন কোন কিছু ইচ্ছা! করেন, তখন বলেন, হও। অতঃপর তা হয়ে যায়। এরপর তিনি বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ আমার পালনকর্তা ও তোমাদের পালনকর্তা। অতএব, তোমরা তার ইবাদত কর। এটা সরল পথ।
মায়ের কোলে থাকা অবস্থায় হযরত ঈসার কথা এই পর্যন্ত শেষ। তিনি তাদেরকে জানিয়ে দিলেন, আল্লাহ তার প্রতিপালক এবং তাদেরও প্রতিপালক; তার প্রভু এবং তাদেরও প্ৰভু। আর এটাই সরল পথ। আল্লাহ বলেন : অতঃপর দলগুলো নিজেদের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি করল। সুতরাং দুর্ভোগ কাফিরদের মহাদিবস আগমন কালে। অৰ্থাৎ সেই যুগের ও পরবর্তী যুগের লোক হযরত ঈসা (আ) সম্পর্কে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ইয়াহুদীদের এক দল বলল, ঈসার ব্যভিচার জাত সন্তান এবং এ কথার উপরই তারা অটল হয়ে থাকল। আর এক দল আরও অগ্রসর হয়ে বলল, ঈসাই আল্লাহ। অন্য দল বলল, সে আল্লাহর পুত্র। কিন্তু সৃষ্টিজ্ঞান সম্পন্ন লোকেরা বললেন, তিনি আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। আল্লাহর এক বাদীর সন্তান এবং আল্লাহর কলেমা যা মারিয়ামের প্রতি প্ৰদান করেছিলেন এবং তিনি আল্লাহর প্রেরিত রূহ। এই শেষোক্ত দলই মুক্তিপ্রাপ্ত। সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং আল্লাহর সাহায্যপুষ্ট। যে ব্যক্তিই হযরত ঈসা (আ) সম্পর্কে উপরোক্ত বিষয়গুলোর কোন একটি ব্যাপারেও বিরোধিতা করবে, সেই হবে। কাফির পথভ্ৰষ্ট ও জাহিল। এ জাতীয় লোকদেরকেই সাবধান করে আল্লাহ বলেছেন : সুতরাং মহা দিবস আগমন কালে কাফিরদের জন্যে ধ্বংস।
ইমাম বুখারী (র) সাদাকা ইবনুল ফ্যলের সূত্রে উবাদা ইবনুস সামিত (রা) থেকে বর্ণনা করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন : যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দেবে যে, আল্লাহ ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই, তিনি একক, তার কোন অংশীদার নেই, মুহাম্মদ (সা) তাঁর বান্দা ও রাসূল, ঈসা আল্লাহর বান্দা রাসূল ও কলেমা, যা মারয়ামের প্রতি অর্পণ করেছেন এবং আল্লাহর পক্ষ হতে প্রেরিত রূহ। জান্নাত জাহান্নাম সত্য। আল্লাহ তাকে জান্নাত দান করবেন। তার আমল যে রকম হউক না কেন। ওয়ালীদ বলেন. রাবী জুনাদা আরও কিছু বেশী বর্ণনা করেছেন যে, জান্নাতের আটটি দরজার মধ্যে যেটি দ্বারা ইচ্ছা সে প্রবেশ করতে পারবে। ইমাম মুসলিম দাউদ ইব্ন রশীদের সূত্রে … জাবির (রা) থেকে এবং অন্য সূত্রে আওযাঈ থেকে অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেছেন।