১২.
পরের দিনই সজলের শেষ চিঠিটা এসেছিল। দিয়ে গিয়েছিল ওরই এক বোন। এই সেই চিঠি, আমার সামনে খোলা পড়ে রয়েছে। অনেক বার পড়েছি, সারা জীবন ধরেই পড়ব। ও লিখেছে–
বিন্দু,
তুমি যে-ভাবে তখন আমাদের মাঝখান থেকে উঠে এলে, তার মধ্যে তোমার মনের কথা আমি বুঝতে পেরেছি। তোমার মনের কাছে আমার জোর খাটাবার কোনও প্রশ্নই নেই। প্রথমত জোর খাটানো ব্যাপারটার ওপরেই আমরা কখনও তেমন প্রত্যয় নেই, তার ওপরে মনের ওপর জোর খাটানো তো অনেকটা জল দিয়ে প্রতিমা গড়ার মতো। পৃথিবীকে এ রকম জোর খাটানোর ইতিহাসও বিরল না। কিন্তু প্রতিমা গড়া যায়নি। তথাপি, বিন্দু, দেখ, আমি খুব আবেগের সঙ্গেই বলছি, তুমি আমার প্রতিমা, নারীর সেই চিরন্তন প্রতিমা, সাধারণ পুরুষ যার সঙ্গে সুখেদুঃখে ঘরকন্না করে, সন্তান উৎপাদন করে, লালনপালন করে, সেইরকম প্রতিমা। অবিশ্যি বাস্তবে আজও তা ঘটেনি, এ রকম একটা আকাঙ্ক্ষা বা প্রত্যাশা ছিল মনে, যা কার্যকরী হয়ে উঠতে পারেনি। অসাধারণত্বে বিশ্বাস নষ্ট হয়েছে, তবু বলি, যাকে নিয়ে ঘরকন্না করার চিন্তা করা যায়, তার থেকে তোমার মধ্যে কিছু বেশি শক্তির লক্ষণ অনেক বার দেখেছি। যাকে ইংরেজিতে বলে common, তার সঠিক অনুশীলনের মধ্যেই uncommonকে অনুভব করা যায়। কিন্তু আমার মনে হয়, আমাদের ট্র্যাজেডি, আমাদের চারপাশে কেবল uncommon হওয়ার অনুশীলন : যা একান্ত হাস্যকর।
যাই হোক, আজকের চিঠিটা লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে, কোথায় একটা পর্বের ইতি পড়তে চলেছে। পর্বটা যে ঠিক কীসের, আমি প্রকৃত বলতে পারব না। অনেক সময় এ রকম হয়, মনের ভিতর আপনা মনের মধ্যে কতগুলো ধারণার উদ্ভব হয়। সেইভাবেই আমি যেন শুনতে পাচ্ছি, ঘণ্টা বাজছে, একটা পর্বের ইতির ঘণ্টা। তুমি কি আগেই তা শুনতে পেয়েছ? পাওনি বোধ হয়।
এখন থেকে আমার পরিচয় বোধ হয় দলত্যাগী’ হবে। স্বাভাবিক। আসলে আমি বোধ হয় দলচলের মানুষ না। স্বীকার করতেই হবে, সেই হিসাবে আমি সাম্প্রতিককালের একটি নষ্ট অস্তিত্ব নষ্ট অর্থে বিনাশ না, নষ্ট। যেমন ধরো, আন্তর্জাতিকতা’ শব্দটিকে কিছুকাল ধরেই আমি কেমন সন্দেহের চোখে দেখছিলাম। আন্তর্জাতিকতা যখন ভ্রাতৃত্বের চেহারায় ফোটে, তখন খারাপ লাগে না, এবং আন্তর্জাতিক অগ্রজকে সম্মান জানানো, এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ, নিজেরই গুণ। কিন্তু আমার কেমন সন্দেহ হচ্ছে, আমরা ভারতীয়রা, রাজনৈতিক সংগ্রামে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দেউলিয়া দাসের। ভূমিকা গ্রহণ করেছি। তার জন্যে আমরা কোনও দেশকে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ বলে গালাগালিও দিতে পারব না, কেননা, বিপ্লব করতে গিয়েও আমরা আত্মপরিচয়হীন দাস মাত্র। জাতীয়তাবাদীদের সর্বগ্রাসী ভূমিকা তো দেখছি, কিন্তু আন্তর্জাতিকতাবাদীদের দুর্দশা আরও অনেক বেশি, কারণ গোড়া থেকেই দেশের মাটি থেকে তারা বিচ্ছিন্ন। আমি খুব বেশি দূরের ভবিষ্যৎ দেখতে পাই না, কিন্তু আজ আমাদের জন্য যে বিদেশি রেডিও চিৎকার করে চলেছে, সন্দেহ হচ্ছে, সে স্বর খুব শীঘ্রই নীরব হয়ে যাবে। রাজনীতির গতিবিধি এইরকম। প্রত্যেকটি দেশ তার নিজের গরজেই সবকিছু করে। সেই হিসাবে। রাজনীতিকে গালাগাল দিয়ে কোনও লাভ হয় না। প্রত্যেক দেশকেই তার নিজস্ব নীতি অবলম্বন করে চলতে হয়। আমার বিশ্বাস হয় না, স্ট্যালিনকে কখনও চিনচিনের জেনারেলিসিমো বলে কল্পনাও করতে পারত।
রাজনীতি এক দিকে যেমন আশ্বাসের কারণ, আর এক দিকে তা নিরন্তর বিশ্বাসভঙ্গের কারণ হয়ে ওঠে। পশ্চাদপট, নিশ্চয়ই ক্ষমতা, নিরঙ্কুশ ক্ষমতা। এ বিষয়ে আমার সঙ্গে অনেকেই একমত হবে না। এখানে আমি একলা চলো রে’ হলেও, জানি, বিশ্বের ক্ষেত্রে আমি মোটেই একলা না।
যে নামটি এখন সর্বাধিক উচ্চারিত, সেই মার্কসের কথা না বলে, আমেরিকান নৃতত্ত্ববিদ মরগ্যান-এর কথা বলা যায়, প্রায় একই সময়ে তিনি আধুনিক সাম্যবাদের অনিবার্যতার কথা বলেছিলেন। উৎপাদনের হাতিয়ারের অভাবে একদা আদিম সাম্যবাদের উদ্ভব হয়েছিল। আধুনিককালে উৎপাদনের হাতিয়ার এখন সবল, এবং উৎপাদকেরা তা নিজেদের মধ্যে সমান অংশে ভাগ করে নেবে। কিন্তু উৎপাদক বলতে আমরা গোটিকে বুঝি, কোটিকে না। আসলে কোটির উৎপাদিত সম্পত্তিকে ভোগ করছে গোটি, অতএব যুদ্ধ অনিবার্য, এবং সে যুদ্ধ এই শতাব্দীর শুরুতেই শুরু হয়ে গিয়েছে।
দোহাই বিন্দু, মনে কোরো না, তোমাকে শিক্ষা দিতে বসেছি। আসলে নিজেকেই পরিষ্কার করতে চাইছি। আমার বক্তব্য, সেই যুদ্ধকে রাজনীতি তার চক্রের দ্বারা, বারে বারেই ছিন্নভিন্ন করছে। সংগ্রামী মানুষরা সরল। তারা কেউ প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী বা চেয়ারম্যানদের মতো জীবনযাপন করার কথা ভাবে না। সরল মানুষ, অতএব অতি বিচিত্র, common uncommon-এর মতোই, বৈচিত্র্যকে এক্ষেত্রে জটিল বলতে পারো।
যদুবংশ ধ্বংস মানেই, পৃথিবী ধ্বংস নয়, মানুষ চিরচলমান প্রবাহে চলবে। তথাপি কোটিকে গোটিরা চিরদিনই নিজেদের প্রয়োজনে অনেক লোভ দেখিয়েছে। অসহায় মানুষ তার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। যদুবংশ যেমন শেষ সত্য না, যদুবংশের মহামানবের কথাই যেমন শেষ কথা না, বর্তমানের কোনও মহামানবের কথাই সব সত্য না। এমনকী তার বিজ্ঞানভিত্তিক বিচারও না। আগেও কোটিকে স্বর্গের লোভ দেখানো হয়েছে, আজও আর-এক রূপে সেই স্বর্গেরই লোভ দেখানো হচ্ছে, যে সত্যের স্বরূপও সদা পরিবর্তনশীল। মনে রেখো, উনিশশো সত্তর খ্রিস্টাব্দের বিশেষ কোনও অবস্থায় দাঁড়িয়ে, আমি এ সব কথা বলছি। অন্য যে কোনও অস্ত্রের কথা বাদ দিচ্ছি, এমন শ্লোগানও তো কোনও না কোনও ভাবে শুনতে হচ্ছে, দূর পাল্লার আণবিক ক্ষেপণাস্ত্রই শক্তির উৎস। কিন্তু শ্লোগান যারা দিচ্ছে, তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখ, দম্ভের মুখোশের আড়ালে, বাঁচবার কী করুণ অভিব্যক্তি। অথচ, মানুষের বসতি এই পৃথিবী ধ্বংসের অস্ত্র মানুষই তৈরি করেছে। এবং নিজেরাই সেই অস্ত্রের ভয়ে কাঁপছে। তথাপি, এই নয় যে, কোটি গোটির স্বেচ্ছাচারকে মেনে নেবে। সে অচলায়তন ভাঙবার জন্য, আমরা ভারতীয়রা, আমাদের পথ খুঁজে নেব, নিচ্ছি। কিন্তু নীচের ঈর্ষা এবং যোদ্ধার ঘৃণাকে যেমন এক করে ফেলা যায় না, তেমনি গোটির ধ্বংসের জন্য আন্তর্জাতিকতার নীতির নলে গুলির আশা করব না, আমরা নিজেরাই নীতি সৃষ্টি করব।
মানুষই সব কিছুর স্রষ্টা, সব কিছুর থেকে মানুষই বড়। ইতিহাসের বহু স্তম্ভ আর সিংহাসন সে ভেঙেছে, আরও অনেক গড়বে এবং ভাঙবে। কিন্তু তথাপি, তার সেই স্বর্গলাভ কখনও হবে না, যে স্বর্গের লোভ তাকে দেখানো হয়। সেই হিসাবে, মানুষ চিরকালই বড় অসহায়।
মানুষ যে সবথেকে বড় শক্তির উৎস, তার প্রমাণ, সে যুগে যুগেই তার অসহায়তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, করবে।
চিঠির শেষে নামটা লিখেছিল, কবে কখন দেখা হবে, সে কথা লেখেনি। অপেক্ষায় ছিলাম। ওর চিঠির সব কথা যে বুঝেছিলাম, তাও না। কথা বলব, আলোচনা করব, সেই অপেক্ষায় ছিলাম। তার আগেই সংবাদ এল, ও নিহত। আততায়ীর গুলিতে ও নিহত, ওর বাড়ির কাছেই। খবর পেয়ে দেখতে ছুটেছিলাম। হাসপাতালে গিয়ে দেখেছিলাম, রক্তে ভেজা শরীর শোয়ানো। কিন্তু ওর মুখ তেমনি শান্ত, বড় বড় চোখ দুটো বোজা।
না, কাঁদিনি। ওর শেষ চিঠির কথাগুলো মনে পড়ছিল, অথচ রাগে ঘৃণায় আমার মস্তিষ্ক চিন্তাশূন্য হয়ে গিয়েছিল। অস্ত্রের জন্য আমার হাত নিশপিশ করে উঠেছিল, রক্তের জন্য আমি লালায়িত হয়ে উঠেছিলাম। রমুদার কথাগুলো মনে পড়ছিল, আর নিজের গলাটা টিপে ধরতে ইচ্ছা করছিল।
একটা পর্ব শেষ হবার ঘণ্টা সজল শুনতে পেয়েছিল। অব্যর্থ শুনেছিল। ওর বেঁচে থাকার পর্ব। কিন্তু আমি–উহ্! এই আমি! আমি ভেবেছিলাম, ওর সঙ্গে আমার সম্পর্ক শেষের পর্বের কথা ও লিখেছে। যদিও এক দিক থেকে সেটাও সত্যি। তার মধ্যে আরও কি কোনও সত্যি নেই? ওদের একটা যুদ্ধের পর্বও কি শেষ না?
না, শেষ না, আর একটা পর্বের শুরু। সুবীরের ভিতরের কাঠখড় সব আমি দেখতে পাচ্ছি। ওর রং লাগানো মাটি সব সজলের রক্তে ধুয়ে গিয়েছে। ও ভয় পেয়ে, রাত্রে আমার কাছ থেকে অস্ত্র দুটো নিয়ে গিয়েছে। ভোর হয়ে আসছে। অস্ত্রে আমার দরকার নেই। নিরস্ত্র অবস্থাতেই আমি ওর কাঠামো টুকরো টুকরো করব। ওর শক্তির উৎস আমি বুঝে নিয়েছি। ওর শক্তির উৎস-হত্যা হত্যা হত্যা। নিশ্চিহ্ন করা, যে কোনও প্রতিবন্ধক, যে কোনও বিরোধিতা।
বেঁচে থাকবারও একটা মিনিমাম অধিকার থাকা চাই। সুবীরের তাও নেই।
আমি আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। পোশাক বদলাবার কোনও প্রশ্ন নেই। খুনির থেকে আমার চোখমুখ কোনও অংশে সুস্থ দেখাচ্ছে না। না দেখাক, এই আমার আসল মূর্তি, সংহারিণী। নিঃশব্দে দরজা খুলে, সিঁড়ি দিয়ে নীচে গেলাম। সাবধানে বাইরের দরজা খুলে, রাস্তায় নামলাম। এখনও রাস্তায় আলো জ্বলছে। কিন্তু কর্পোরেশনের শ্রমিকরা কাজে বেরিয়ে পড়েছে। দু-চারজন লোক চোখে পড়ে। আমি হাঁটতে শুরু করলাম। হেঁটে কোনও দিনই যাইনি, কিন্তু চিনতে আমার কোনও অসুবিধা হবে না।
বড় রাস্তায় ট্রাম চলতে আরম্ভ করেছে। প্রাইভেট বা অন্য দু-একটা গাড়ি চলাচল করছে। আমার দিকে যে কেউ লক্ষ করতে পারে, সে কথা আমি এক বারও ভাবিনি। ভাবিনি, আমার মতো একটি মেয়ের পক্ষে, ও রকম সময়ে একলা বেরোনো ঠিক হয়নি। অবিশ্যি, কোনও ভয়ই এখন আর আমার কাছে ভয় না। আমিই সকলের বিভীষিকা।
সেই খালি বাড়িটার সামনে এসে যখন দাঁড়ালাম, দেখলাম, দরজাটা খোলা। যা কখনও থাকে না। ভিতরের উঠোন অন্ধকার। আমি ভিতরে ঢুকলাম, বারান্দায় উঠে দেখলাম, ঘরের ভিতরে যাবার দরজাটাও ভোলা। সামনের ঘরে ঢুকে দেখলাম, বাঁ দিকের ঘরে সামান্য আলোর রেশ। এ রকম দরজা খোলা অবস্থায় কেউ থাকতে পারে না বলেই মনে হয়। তবু আমার হাত-পা শক্ত হয়ে উঠল। দু চোখে আগুনের জ্বালা। আমি আস্তে আস্তে বাঁ দিকের ঘরে ঢুকলাম। মেঝের ওপরে কেউ শুয়ে আছে। ভাল করে উঁকি দিয়ে দেখলাম, হিরণ। মনটা শক্ত হয়ে উঠল। পরমুহূর্তেই চোখে পড়ল, ওর বুকের কাছে রক্ত, গড়িয়ে পড়েছে মেঝেয়।
আমি ঝুঁকে পড়বার আগেই, একটি স্বর শুনতে পেলাম, হিরণ সজলকে মেরেছিল, তাই ওরা সিদ্ধান্ত নিয়ে, হিরণকে মেরেছে!
আমি চমকে, পাশ ফিরেই দেখলাম, ভিতরে যাবার দরজার পাশে হরিশদা দাঁড়িয়ে। হিরণ হরিশদার ছেলে! আমার মুখ দিয়ে স্খলিত স্বরে উচ্চারিত হল, হরিশদা!
হরিশদা এগিয়ে এলেন। হরিশদার চোখ শুষ্ক, চোখের কোল বসা, সমস্ত চেহারাটা যেন ধসে পড়া। আমি হরিশদার কাছে এগিয়ে গিয়ে একটি হাত চেপে ধরতে গেলাম, পারলাম না। আমার গলায় কোনও স্বর নেই, কথা বলতে পারছি না। হরিশদার চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হল, তাঁর চোখের তারা দুটো নেই, ভিতরে গভীর অন্ধকার, কিন্তু ভেঙেপড়া আবেগের কোনও অভিব্যক্তিই নেই। নিচু গম্ভীর পরিষ্কার স্বরে বললেন, আমি এ হত্যার অংশীদার। কিন্তু যমুনা, এ হত্যার দায় নিতে বড় ভার লাগছে। কারণ এ হত্যা, একটা উপলব্ধি এনে দিয়েছে, যা কঠিন। অথচ অনেক হত্যাই, সামনের পথ খুলে দেয়নি, পথ রুদ্ধ করেছে।
আমি আবার হিরণের দিকে তাকালাম। সামান্য আলোর রেশে, ওকে দেখে, সজলের মতোই মৃত্যুর কোলে শান্ত দেখছি। ওর প্রতি আমি কখনও প্রীতি বোধ করিনি। সে রকম কোনও সুযোগও ও আমাকে দেয়নি। ওকে আমার বরাবরই একটি নিঃশব্দ ভয়ংকর শার্দুলের মতো মনে হয়েছে, এবং সামান্য দু-একবার যেটুকু গর্জন শুনেছি, তা আমার কাছে কখনও শুভ মনে হয়নি। কেঁপে উঠেছিলাম, মনে মনে, এক বার ওর সংকেতময় কথা শুনে, শ্রেণীশত্রুর অস্তিত্ব নাশ, যা সজলকে উদ্দেশ করেই বলেছিল। ওকে আমি ঘৃণা করতে পারছি না, ওর প্রতি আমার রাগ হচ্ছে না, আমি ওর ভিতরের আন্তরিক আর আগুন-ভরা প্রেরণার কথা ভাবছি। বিশ্বাসের সঙ্গে ওর হৃদয়াবেগের যতটা গাঢ়তা ছিল, বিচারবুদ্ধি তার সঙ্গে একটুও ছিল না। ওর নিজের মৃত্যুভয় ছিল না, সজলকে হত্যা, ওর কাছে পুণ্যের রূপ নিয়েছিল। আর কী দেখছি? সুবীরের অনিবার্য পরাজয় মেঝেয় গড়াচ্ছে।
আমি হরিশদার দিকে তাকালাম, কথা ফুটতে চাইছে না, তবু জিজ্ঞেস করলাম, এখন কী করবেন?
হরিশদা বললেন, সে কাজ তো অন্তহীন, অনেক কাজ, এক কথায় বলা যায় না।
আমি তাড়াতাড়ি বললাম, সে কথা জিজ্ঞেস করিনি, আমি হিরণের কথা জিজ্ঞেস করছি। ওকে নিয়ে এখন কী করবেন?
হরিশদা বললেন, ওকে নিয়ে যা করবার, তা করা হয়ে গেছে। আমার আর এখন কিছুই করার নেই। ওকে এখানেই রেখে যেতে হবে, আমি নিরুপায়।
আমি হরিশদার মুখের দিক থেকে চোখ সরাতে পারছি না, মনে প্রশ্ন জাগছে, ছেলের জন্য কি তাঁর কোনও কষ্টই হচ্ছে না? কিন্তু সে কথা আমি জিজ্ঞেস করতে পারব না। হরিশদা হঠাৎ বলে উঠলেন, সঠিক রক্তপাতের সংজ্ঞাটা কী, এ প্রশ্নের জবাব খুবই দরকার। খোকন নিজেও দু-একবার আমাকে কথাটা জিজ্ঞেস করেছে।
খোকন কে? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
হরিশদা ঘাড়টা একটু দুলিয়ে, হিরণের দিকে দেখালেন। হরিশদা হিরণকে খোকন বলে ডাকতেন! এই প্রথম জানলাম। আমার মনে হল, হরিশদার দু চোখের শূন্য গভীর অন্ধকারে, অস্পষ্ট একটি আলোর ইশারা যেন দেখা যাচ্ছে। বললেন, ওর মা ওর খুব ছেলেমানুষ বয়সে মারা গেছে। কিন্তু সে সব কথা আজ ভাবব না। সন্দেহ নেই, ওকে আমি হারালাম। হারিয়েছি বলেই, পাওয়ানার বিষয় ভাবতে হবে। খোকনরা দেশ ছেয়ে আছে।
তারপরেই আমার দিকে ফিরে বললেন, যমুনা, চলো আমরা যাই, এখানে আর থাকা ঠিক না।
আমার চোখে আর আগুনের জ্বালা বোধ করছি না। মানুষের শক্তির কথা ভাবছি। যে শক্তি তার নিরন্তর অসহায়তার বিরুদ্ধে সংগ্রামশীল।