সংযোজন ২; ছন্দের সহজপাঠ
মজাটা নেহাত মন্দ নয়। কবিতা কেমন লেখা হচ্ছে, তা নিয়ে কোনও প্রশ্ন উঠছে। না, তার বদলে প্রশ্ন উঠছে কবিরা ছন্দ জানেন কি জানেন না, তাই নিয়ে। অর্থাৎ একেবারে শিকড় ধরে টান মারা হচ্ছে। কেউ-কেউ তো দেখছি প্রশ্ন তোলারও ধারা ধারছেন না, অম্লানবদনে বলে দিচ্ছেন যে, একালে যারা কবিতা লিখছেন, ছন্দের একেবারে প্রাথমিক পাঠও তারা নেননি। সাদা বাংলায়, ছন্দ নামক ব্যাপারটার ‘হ-ক্ষ’ তো দূরের কথা, ‘অ-আ-ক-খও তাদের জানা নেই। তবু যদি তারা ওইসব ছাইপাশ লিখতে চান তো লিখুন, কিন্তু সম্পাদকমশাইরা সাবধান, ‘কবিতা’ নাম দিয়ে ওই ব্যভিচারগুলিকে আর ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করবেন না।
শুনে কার কী মনে হয় জানি না, এই লেখকের কিন্তু পাগলা মেহের আলির কথাটাই বারবার মনে পড়ে যায়। “তফাত যাও, তফাত যাও। সব ঝুট্ হ্যায়, সব ঝুঁট্ হ্যায়।”
তবে কিনা বাংলা কবিতা সম্পর্কে (এবং, বলা বাহুল্য, কবিদের সম্পর্কেও) এমন মন্তব্য যে এই প্রথম শোনা গেল, তা-ও নয়। মোটামুটি এই একই ধরনের কথা শুনছি। অনেক বছর ধরেই। অনেক বছর মানে কত বছর? তা পঞিাশ বছর তো হবেই, কিছু বেশিও হতে পারে। কাদের সম্পর্কে এবং কোন কবিতা সম্পর্কে এমন মন্তব্য? দয়া করে তাহলে শুনুন।
যখন ইস্কুলে পড়ি, তখন রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা- যাতে অন্ত্যমিল ছিল না। বটে, কিন্তু মিশ্রকলাবৃত্ত ছন্দের বাঁধুনি ছিল একেবারে টানটান, উপরন্তু আঠারোমাত্রার পঙক্তিগুলি ছিল একেবারে সমান মাপে টানা- সম্পর্কে এক প্রবীণ পাঠককে বলতে শুনেছিলুম, “দূর দূর, এ আবার কী কবিতা! ছন্দ নেই!” এবারে বলি, প্রাস্তিক-এর এটি প্রথম কবিতা, সেই যার প্রথম পঙক্তিটি হল : “বিশ্বের আলোকলুপ্ত তিমিরের অন্তরালে এল।..”। বলা বাহুল্য, প্রথম কবিতার পরে আর সেই পাঠক এক পা-ও এগোননি। ভালোই করেছিলেন। কেন-না, নিজেরই অর্ধশিক্ষার (যা কিনা অশিক্ষার চেয়েও ভয়ংকর ব্যাপার) কারণে তিনি যাকে ছন্দ বলে চিনেছিলেন, ও-বইয়ের বেশির ভাগ কবিতাতেই তার কোনও সন্ধান তিনি পেতেন না।
যখন কলেজে পড়ি, তখন আবার এই একই অভিযোগ শোনা গেল জীবনানন্দের বিরুদ্ধে। কি না তাঁর ছন্দজ্ঞান বড়ো কম! অভিযোগের সমর্থনে তাঁর যে কবিতাটির সেদিন উল্লেখ করা হয়েছিল, সেটিতেও ছিল না পৌনঃপুনিক অন্ত্যমিলের আয়োজন; তবে প্রতিটি পঙক্তি সমান দৈর্ঘ্যের না হলেও এবং পঙক্তিশেষের ভাঙা-পর্বটি মাঝে-মাঝে বর্জিত হলেও (যা কিনা। রবীন্দ্রনাথও মাঝে-মাঝে অনাবশ্যক বিবেচনায় বর্জন করতেন) ছন্দ ছিল। অবশ্যই। সে-ও পরিপটি মিশ্রকলাবৃত্ত ছন্দ, বিষগ্নতা আর দীর্ঘনিশ্বাস-বিজড়িত বেদনার ভার যা বড়ো সহজে বহন করে। এবারে তবে কবিতাটির নাম বলা যাক। বিখ্যাত কবিতা। ধূসর পাণ্ডুলিপি-র ‘ক্যাম্পে’।
অভিযোগ কি বুদ্ধদেব বসুর বিরুদ্ধেই উঠত না? তা-ও উঠত বইকি। শুধুই যে তাঁর কবিতার বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণিত হত কিছু শুচিবায়ুগ্রস্ত মানুষের আপত্তির কোলাহল, তা নয়, বিস্তর পণ্ডিতস্মান্য ব্যক্তির মুখে তখন নিন্দামন্দ শোনা যেত তার ছন্দোজ্ঞানহীনতা’ সম্পর্কেও। এবং নিন্দামন্দ যে অকারণ নয়, তার প্রমাণ হিসেবে তাঁরা উল্লেখ করতেন বন্দীর বন্দনা-র অন্তর্ভুত এমন-সব কবিতার, যাতে ছন্দ ছিল আদ্যন্ত অতি পরিপটি ও সুশৃঙ্খল; না থাকবার মধ্যে শুধ ওই অন্তামিলটাই ছিল না।
চল্লিশের দশকে যাঁরা হরেক পত্রিকায় কবিতা লিখতে শুরু করেন, এক-আধ জনের কথা বাদ দিলে দেখা যাবে যে, আক্রমণের লক্ষ্য এক-কালে তারাও কিছু কম হননি। পরে গালাগাল খেয়েছেন তারাও, যাঁরা কিনা। “পঞ্চাশের কবি” হিসেবে আখ্যাত। এখন আবার গালমন্দ শুনতে হচ্ছে তাদের পরবর্তী কালের কবিদেরও। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সেই একই একঘেয়ে অভিযোগ : ছন্দের ছাঁও এরা জানে না। সুতরাং কবিতা লেখার চেষ্টায় ক্ষান্তি দিয়ে এবারে “তফাত যাও…তফাত যাও”! এই যে অভিযোগ, এর উত্তরে আত্মপক্ষ সমর্থনের মতো হাস্যকর ব্যাপার। আর কিছুই হয় না। চল্লিশের সমর্থনে তাই অন্তত এই লেখকের পক্ষে একেবারে নীরব থাকাই ভালো। তবে পঞ্চাশের কবিরা যে ছন্দ-টন্দের ব্যাপারে একেবারে আকাট রকমের অজ্ঞ ছিলেন, এবং- সেই অজ্ঞতাকে কথার কম্বলে ঢেকেঢুকে রেখেস্রেফ নতুন রকমের উচ্চারণের জোরেই আবার মোড় ঘুরিয়েছিলেন বাংলা কবিতার, এইটে মেনে নেওয়া ভারী শক্ত। যদি বলি যে, তাদের পরে যাঁরা কবিতা লিখেছেন এবং এখনও লিখছেন, ছন্দজ্ঞান তাদেরও মোটামুটি টনটনে, তো মোটেই বাড়িয়ে বলা হবে না।
এরা ছন্দ জানেন না, এমন অভিযোগ তাহলে উঠছে কেন? উঠছে- যদ্দুর বুঝতে পারি— এই জন্য যে, অভিযোস্তাদের নিজেদেরই নেই ছন্দ বিষয়ে কোনও স্পষ্ট ধারণা। ছন্দ বলতে যে ঠিক কী বোঝায়, তা তাঁরা নিজেরাই জানেন না, যদিও তার জন্যে যে সমালোচকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে র্তাদের কিছু আটকেছে, তা নয়। আটকায়নি। আসলে কোনও কালেই!
বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে আর-একটু খুলে বলি।
প্রান্তিক-এর প্রথম কবিতা পড়ে যিনি বলেছিলেন যে, ওতে ছন্দই নেই’, অনেক বছর পরে তাকে একদিন জিজ্ঞেস করি যে, ছন্দ তো ছিল, তাহলে কেন আমন কথা মনে হল তার। উত্তরে তিনি যে-যুক্তি দিলেন, তাতে তো আমি হতবাক। বন্দীর বন্দনা-র একাধিক কবিতার সূত্রে যাঁরা বলতেন যে, লেখকের ছন্দ-জ্ঞান বড়োই অল্প, তা একরকম “নেই বললেই চলে, একদা হতবাক হয়েছি তাদের কথা শূনেও। মনে-মনে ভেবেছি, ‘ও হরি, এই তাহলে ব্যাপার!”
এখন বিস্ময়বোধ অনেক কমে গিয়েছে। উদ্ভটসাগরদেরই তো এখন আধিপত্য, তাই এসব ব্যাপারে যিনি যতই উদ্ভট কথা বলুন, তাতে আর বিশেষ অবাক হই না। আর তা ছাড়া এই সহজ সত্যটা তো তখনই আমি জেনে গিয়েছি যে, অন্তমিলকেই অনেকে ছন্দ বলে মনে করেন। হালে আবার জানা গেল যে, তাদের সংখ্যাই দিনে দিনে বাড়ছে। পঙক্তি-শেষে চালাক-চালাক মিল থাকলে তবেই সেটা ছন্দ, নইলে নয়। ফলে, যে-কবিতায় অন্ত্যমিলের সাড়ম্বর আয়োজন নেই, তাতেও যে ছন্দ থাকতে পারে, থাকে, এই কথাটা তাদের কিছুতেই বোঝানো যাবে না। ”
তা-ও হয়তো যেত, যদি তারা ছন্দের ব্যাপারে একেবারে কিছুই না জানতেন। সেক্ষেত্রে তারা যে আর-একরকম জেনে বসে আছেন, এবং তারই জোরে জারি করছেন হরেকরকম ফতোয়া, সে-ই হয়েছে মস্ত বিপদ। এখন এই উলটো অ-আ-ক-খ’ তাদের কে ভোলাবে?
ভোলাবার দরকারটাই-বা কী। কিছু না-বুঝে কিংবা বেবাক ভুল বুঝে ছন্দ নিয়ে যাঁর যা খুশি বলুন না, তাতে কান না-দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়।
এই পর্যন্ত পড়বার পরে অনেকের সন্দেহ হতে পারে যে, এই নিবন্ধের লেখক বোধ হয় অন্ত্যমিল নামক ব্যাপারটারই ঘোর বিরোধী। তা কিন্তু নয়। আসলে, রাইম বা অন্তমিল যে রিদম বা ছন্দের একটা জরুরি শর্ত, এই হাস্যকর কথাটাই সে বিশ্বাস করে না। কেন-না, তা যদি সে বিশ্বাস করত, তাহলে একইসঙ্গে তাকে এটাও বিশ্বাস করতে হত যে, গোটা সংস্কৃত কাব্যসাহিত্যের কোথাও কোনও ছন্দ নেই। না, ছন্দ আর মিল একেবারেই আলাদা দুটো ব্যাপার, পরস্পরের সঙ্গে কোনও অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কসূত্রে তারা আবদ্ধ নয়। যা ছন্দোবদ্ধ, তাতে অন্তমিলের ব্যবস্থা অবশ্য থাকতেই পারে, কিন্তু সেটা যে থাকতেই হবে, এমন কোনও কথা নেই। ছন্দ আসলে অনেক বড়ো মাপের ব্যাপার। এতই বড়ো যে, দলবৃত্ত কলাবৃত্ত আর মিশ্রকলাবৃত্ত নামে যে-তিনটি বাংলা ছন্দের পরিচয় আমরা সকলেই রাখি, এবং মোটামুটি যার মধ্যেই দীর্ঘকাল যাবৎ আটকে ছিল বাংলা কবিতা, তার বলয়েও ছন্দ নামক ব্যাপারটাকে সর্বাংশে আঁটানো যাচ্ছে না। তার শরীরের অনেকটাই থেকে যাচ্ছে সেই বলয়ের বাইরে। ফলে, দলবৃত্ত কলাবৃত্ত আর মিশ্রকলাবৃত্ত ছন্দের (এবং তাদের ত্ৰিবিধ নিয়মেরই অন্তর্গত অসংখ্যরকম প্যাটার্ন বা বন্ধের) ধারও ধারছেন না যেসব কবি, এবং সেটা ধারবেন না বলেই এই তিন ছন্দের বলয়ের বাইরে দাঁড়িয়ে লিখছেন তাদের কবিতা (যেমন ধরা যাক, সমর সেন তার সংক্ষিপ্ত কবি-জীবনের আদ্যন্ত লিখেছেন বা অরুণ মিত্র আজও লিখে যাচ্ছেন), তাঁদেরই বা আমরা কোন কানুনে ছন্দোজ্ঞানহীন বলব? কিংবা তাঁদের রচনাকে বলব ছন্দছুট?
যে-কানুনেই বলি না কেন, সেই একই কানুনে তবে তো (শুধু ‘আফ্রিকা’ কি ‘পৃথিবী’ বলে কথা নেই)। রবীন্দ্রনাথের তাবৎ গদ্যকবিতাকেই ছন্দছুট বলতে হয়। রক্ষা এই যে, ‘ছন্দ-টন্দ বোঝে না’ বলে নবীন কবিদের উপরে যাঁরা এখন ছড়ি ঘোরাচ্ছেন, অতটা সাহস তাদের হবে না।
গদ্যকবিতার কথা যখন উঠলই, তখন এই নিয়ে যে-রাসের কথাটা এককালে খুব শোনা যেত, সেটাও বলি। অনেককেই তখন বলতে শুনেছি যে, টানা এক পাতা গদ্য লিখে তারপর ইরেজার দিয়ে তার দু-পাশটা একটু এলোমেলোভাবে মুছে দিলেই সেটা আমনি গদ্যকবিতা হয়ে যায়। খুবই যে মোটাদাগের রসিকতা, তাতে সন্দেহ নেই। যাঁরা বলতেন, তাঁদের সঙ্গে তর্ক করতেও বুচিতে বাধত বলেই আমার এক বন্ধু এই মন্তব্য শুনে একটুও না হেসে খুব অবাক হবার ভান করে। বলতেন, “মুছতে যে হবেই, এমন কথা কে বলল। আপনি দেখছি কিছুই জানেন না। না-মুছলেও কবিতা হয়।” বাজে রসিকতার এটাই ছিল মোক্ষম জবাব।
তখন অন্তত তা-ই ভাবতুম। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে ততই দেখছি, গদ্যের দুপাশ না-মুছলেও যে কবিতা হয়, এর চেয়ে সত্য উক্তি আর কিছুই হতে পারে না। কথাটা হয়তো আগেও কখনও বলেছি, তবু আবার বললেও ক্ষতি নেই যে, কবিতা তো আর-কিছুই নয়, শব্দকে ব্যবহার করবার এক রকমের গুণাপনা, ভাষার মধ্যে যা কিনা অন্যবিধ একটি দ্যোতনা এনে দেয়। সেই দ্যোতনা কি নেহাতই চলতি-অর্থে ছন্দোবদ্ধ রচনার মধ্যে লভ্য? তা ছাড়া, কি তার বাইরে, কোথাও নয়?
এই যে প্রশ্ন, এর কোনও উত্তর আমরা দেব না। শুধু নীচের কয়েকটি লাইন, যা নিশ্চয় সকলেই একাধিকবার পড়েছেন, আরও একবার পড়তে বলব।
“তখন প্ৰলয়কাল, তখন আকাশ্নে তারার আলো ছিল না এবং পৃথিবীর সমস্ত প্ৰদীপ নিবিয়া গেছে- তখন একটা কথা বলিলেও ক্ষতি ছিল। না— কিন্তু একটা কথাও বলা গেল না। কেহ কহাকেও একটা কুশলপ্রশ্নও করিল না।
“কেবল দুইজনে অন্ধরের দিকে চাহিয়া রহিলাম। পদতলে গাঢ়কৃষ্ণ উন্মত্ত মৃত্যুম্রোত গর্জন করিয়া ছুটিতে লাগিল।”
এবং আরও কয়েকটি লাইন :
“কৃষ্ণপক্ষের পঞ্চমী। অন্ধকার রাত্রি। পাখি ডাকিতেছে না। পুষ্করিণীর ধারের নিচ্গাছটি কালো চিত্রপটের উপরে গাঢ়তর কালির প্রলেপের মতো লেপিয়া গেছে। কেবল দক্ষিণের বাতাস এই অন্ধকারে অন্ধভাবে ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, যেন তাহাকে নিশ্চিতে পাইয়াছে।”
বলা বাহুল্য, প্রচলিত অর্থে ছন্দোবদ্ধ (উপরন্তু সমিল) যে-রচনারীতিকে দীর্ঘদিনের সংস্কারের কারণে অনেকেই একেবারে একমেবাদ্বিতীয়ম কাব্যরীতি বলে ভাবতে অভ্যস্ত, উদ্ধৃত পঙক্তিগুলিকে সেই রীতির সঙ্গে কোনও সম্পর্কসূত্ৰে গাঁথা যাবে না। এমনকি কোনও গদ্যকবিতা থেকেও তুলে আনা হয়নি এই পঙক্তিগুলিকে! তোলা হয়েছে রবীন্দ্রনাথের দুটি গল্প থেকে, যার একটির নাম ‘একরাত্রি’, অন্যটির নাম ‘ত্যাগ’।
অথচ ওই যে দ্যোতনার কথা বলেছি আমরা, ভাষার মধ্যে একমাত্ৰ কবিতাই যার উন্মেষ ঘটায়, এই গদ্যরচনার মধ্যেও তা দেখছি অলভ্য নয়। আর ছন্দ? প্রচলিত তিন বাংলা ছন্দের কথা তাহলে অন্তত কিছুক্ষণের জন্যে ভুলতে হবে আমাদের, সরিয়ে রাখতে হবে ছন্দের ব্যাকরণ থেকে লব্ধ নানা শুকনো সংস্কার, এবং একেবারে গোড়ায় গিয়ে ভাবতে হবে যে, শব্দাবলির যে-পারস্পরিক সংগতি আর সর্বাঙ্গীণ ভারসাম্যের উপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে আমাদের ছন্দ-বিষয়ক ধারণা, তারই কি কোনও অনটন এখানে আমাদের চোখে পড়ছে? কই, তা-ও তো পড়ছে कों!
সঞ্চয়িতা থেকে গল্পগুচ্ছ-এ সরে এসেছি। এবারে তবে আরও অনেকটা সরে আসা যাক। ঢুকে পড়া যাক সহজপাঠ প্ৰথম ভাগের মধ্যে।
স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের সঙ্গে শিশুদের প্রথম পরিচয়ের পালা সাঙ্গ হবার ঠিক পরে-পরেই তাদের জন্য ছ-টি বাক্য সেখানে রচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। বাক্যগুলি এখানে তুলে দিচ্ছি :
বনে থাকে বাঘ।
গাছে থাকে পাখি।
জলে থাকে মাছ।
ডালে আছে। ফল।
পাখি ফল খায়।
পাখা মেলে ওড়ে।
কল্পনাপ্রবণ যে-কোনও শিশুর আগ্রহকে তার ঘরের কোণ থেকে বাইরের পৃথিবীর দিকে- অরণ্য জলাশয় আর আকাশের দিকে- ঘুরিয়ে দিচ্ছে এই ছোটো-ছোটো কয়েকটি বাক্য, যার অনুরণন আমাদের মতো বয়স্ক পাঠকের চিত্তেও চট করে ফুরিয়ে যায় না। একটু ভাবলেই আমরা বুঝতে পারব যে, বক্তব্যের ধারাবাহিক শৃঙ্খলা, শব্দগত সংগতি আর সর্বাঙ্গীণ ভারসাম্য এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের সূত্রে এই বাক্য-কটিকে বেঁধে রেখেছে, আর একই সঙ্গে জাগিয়ে তুলছে সেই আভ্যন্তর আন্দোলন, যাকে খুব সহজেই আমরা ছন্দ বলে শনাক্ত করতে পারি। ধীরে-ধীরে যখন পড়ি, তখন হয়তো সেই ছন্দ ততটা স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে না। কিন্তু তা না-ই পড়ুক, এবং কবিতা হিসাবে না-ই উপস্থাপিত হয়ে থাকুক। এই বাক্যসমষ্টি, মাত্ৰই আঠারোটি শব্দের— এবং খুবই সহজ সরল শব্দের— এই সমাহারও যে বস্তৃত কবিতা-ই, তা-ও তো কারও না বুঝবার কথা নয়।
অনেকই অবশ্য বোঝে না! জানে না যে, গদ্যভাষার মধ্যেও অনেক সময়ে প্রচ্ছন্ন থাকে ছন্দ, যা সেই ভাষার মধ্যে এনে দেয় এক অন্যতর অর্থের দ্যোতনা, এবং সেই দ্যোতনাই তখন গদ্যকে তুলে আনে কবিতার পর্যায়ে।
এখন যাঁরা কবিতা লিখছেন, তাঁদের অনেকেই মনে হয় প্রচলিত তিন ছন্দের কাঠামোর মধ্যে আর আটকে রাখতে চাইছেন না নিজেদের, কবিতার মুক্তি চাইছেন তার বলয়ের বাইরে, সেখানে খুঁজে নিতে চাইছেন অন্যতর ছন্দ। এই যে অন্বেষণ, এর কি কোনও তাৎপর্য নেই? আছে নিশ্চয়। চলতি ছন্দেই যদি সমস্ত কাজ চলত, তবে তো আর কথাই ছিল না। রবীন্দ্রনাথকে তবে আর অত কষ্ট করে মেলে ধরতে হত না কলাবৃত্তের তাবৎ সম্ভাবনার পাপড়িগুলিকে, এবং তারও পরে গিয়ে ঘা দিতে হত না গদ্যকবিতার দরজায়।
অন্বেষণের দরকার অতএব আছেই। কিন্তু কেউ-কেউ সেটা স্বীকার করতে চাইছেন না। এই বলে চেচিয়ে মরছেন যে, ছন্দের একেবারে প্রাথমিক শিক্ষাই এদের হয়নি।
কিছুদিন আগে প্রশ্ন উঠেছিল; এত কবি কেন? পালটা প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়: তাতে এত গাত্রদাহাঁই-বা কেন? বলতে ইচ্ছে হয় : গোল কোরো না বাবার, যাঁরা লিখছেন, তাদের লিখতে দাও। তবু যদি ঝামেলা করো, তো তোমাদের হাতে এবারে একখানা করে সহজ পাঠ ধরিয়ে দেব।