সংবাদপত্রে সেকালের কলকাতা
সেকালের সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপনে সমাজের চিত্র কীভাবে প্রতিফলিত হয়েছে, তার কিছুটা পরিচয় দিয়েছি। বিজ্ঞাপন ছাড়াও নানা রকমের সংবাদের মধ্যে সামাজিক জীবনের যে ছবি ফুটে ওঠে, তার গুরুত্বও কম নয়। আমাদের দেশের সামাজিক ইতিহাস এখনও লেখা আরম্ভ হয়নি বললেও ভুল হয় না। সংবাদপত্রের আবির্ভাবের পর, সামাজিক জীবনের বিভিন্ন দিকের বহু মূল্যবান উপাদান তার পৃষ্ঠায় স্থান পেয়েছে। বিজ্ঞানীর দৃষ্টি দিয়ে সেগুলি বিচার—বিশ্লেষণ করলে, কেবল তা—ই দিয়েই অতীত জীবনের চমৎকার বাস্তব ইতিবৃত্ত রচনা করা যায়। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর কলকাতার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের অনেক ‘সংবাদ’ সেকালের ইংরেজি—বাংলা সংবাদপত্রের স্তম্ভে সমাধিস্থ হয়ে আছে। এইসব অতীব দুষ্প্রাপ্য জরাজীর্ণ পত্রিকাস্তূপের ভিতর থেকে এখনও সেগুলি পুনরুদ্ধার করে ইতিহাস রচনার কাজে লাগানো যায়। কিন্তু অধিকাংশ পত্রিকার দুরবস্থা দেখে মনে হয়, অদূর ভবিষ্যতে সেগুলি আর ব্যবহারযোগ্য থাকবে না। কেবল একখানি পত্রিকা থেকে (‘সমাচার দর্পণ’) কত মূল্যবান উপকরণ আহরণ করা যেতে পারে, স্বর্গীয় ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘সংবাদপত্রে সেকালের কথা’ গ্রন্থে তার প্রমাণ দিয়েছেন। এরকম আরও অনেক মূল্যবান পত্রিকা আছে, বাংলা ও ইংরেজি দুইই। তা থেকে সংবাদ সংগ্রহ করে কোনো সঙ্কলন গ্রন্থ প্রকাশ করা হয়নি। ভবিষ্যতে পত্রিকগুলির বিলুপ্তির সঙ্গে আমাদের দেশের ইতিহাসের অনেক মূল্যবান উপকরণ চিরদিনের মতন লুপ্ত হয়ে যাবে।
জীর্ণ পত্রিকার স্তূপ ঘেঁটে এরকম অনেক সংবাদ আমি আহরণ করেছি। তা—ই দিয়ে সেকালের কলকাতার তথা বাংলার সামাজিক জীবন সম্বন্ধে স্বতন্ত্র একটি বই লেখা যায়। এখানে ছোট একটি অধ্যায়ের মধ্যে কয়েকটি মাত্র টুকরো সংবাদের ভিতর দিয়ে সেকালের কলকাতার প্রাত্যহিক ও সামাজিক জীবনের যংসামান্য আভাস দেবার চেষ্টা করেছি।
বেঙ্গল হরকরা, ১২ মে, ১৮২৯ : সম্পাদকীয় প্রবন্ধ : ‘শহরের পুলিশের উদাসীনতা ও অকর্মণ্যতার একটি লজ্জাকর দৃষ্টান্ত আমরা কর্তৃপক্ষের নজরে আনতে চাই। দৃষ্টান্তটি বিরল নয় বলে এবং অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও অমানুষিক বলে, কর্তৃপক্ষের নজরে আনা দরকার বোধ করছি। আমাদের ধারণা, ব্রিটিশ আইনশাসিত আর কোনো দেশে এরকম ঘটনা ঘটে না।
‘আমাদের এই প্রবন্ধ লেখার সময় পর্যন্ত আমরা জানি, ওয়েলিংটন স্কোয়্যারের দক্ষিণ—পশ্চিম কোণে একটি লোকের মৃতদেহ প্রকাশ্যে পথের উপর পড়ে রয়েছে। ঘটনাস্থলে অনুসন্ধান করে আমরা জেনেছি, লোকটি গত রবিবার (আজ মঙ্গলবার) বেলা দুটোর সময় চলতে চলতে হঠাৎ ক্লান্তিতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় এবং বেলা পাঁচটার সময় মারা যায়। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো তদন্ত করা হয়নি এবং ভাবগতিক দেখে মনে হয়, হবার কোনো সম্ভাবনাও নেই। এমনকি মৃতদেহটি যে শহরের প্রকাশ্য জনপথ থেকে সরিয়ে ফেলা বাঞ্ছনীয়, সে চেতনাও যেন পুলিশের লোপ পেয়েছে। এর মধ্যে মৃতদেহটি নিশ্চয় পচতে আরম্ভ করেছে, তার পাশ দিয়ে লোকজন চলাচল করছে এবং তারা এই বীভৎস দৃশ্য দেখছে। প্রতিবেশীদের অসুখবিসুখও হতে পারে। সুতরাং পুলিশের উদাসীনতা অমার্জনীয় ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।
‘প্রথমত, পুলিশের কর্তব্য ছিল, লোকটি যখন অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল, তখন তাকে হাসপাতালে (কাছে ধর্মতলায় ছিল) পাঠানো। তা করলে, হয়তো লোকটি বেঁচে যেত। তা যখন করা হয়নি, তখন সে প্রশ্ন না—তোলাই ভাল। কিন্তু লোকটি যে কী কারণে ওইভাবে পড়ে মারা গেল, সে সম্বন্ধে অন্তত পুলিশের তদন্ত করা কর্তব্য ছিল। এমনও হতে পারে যে লোকটিকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। আরও অন্যান্য কৌশলে হত্যা করাও সম্ভব। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে, খোঁজ করলে, ব্যাপারটা জানা সম্ভব হত। তা—ও করা হয়নি।
‘কলকাতার পুলিশের এরকম মর্মান্তিক উদাসীনতার দৃষ্টান্ত এর আগেও আমরা অনেক লক্ষ করেছি। কলকাতার সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি কিছুদিন আগে একটি মামলার রায়—প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছিলেন যে কলকাতা শহরের ক্রমে যে অবস্থা হচ্ছে তাতে মানুষের জীবন একেবারেই নিরাপদ নয় দেখা যাচ্ছে। প্রধান বিচারপতির এই সুচিন্তিত মন্তব্যের পর, আমরা ভেবেছিলাম, শহরের কর্তা ও প্রহরীদের দৃষ্টি আরও সজাগ হবে এবং তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব সম্বন্ধে আরও সচেতন হবেন। কিন্তু এইসব দৃষ্টান্ত দেখে মনে হয়, তাঁরা তা হননি। যাঁরা এ ব্যাপারে দোষী নন, তাঁদের সম্বন্ধে আমরা কিছু বলছি না। কিন্তু শহরের অবস্থার উন্নতির জন্য আরও বেশি অবহিত হওয়া প্রয়োজন।’ (অনুবাদ)
১৮২৯—৩০ সালেও কলকাতা শহরের অবস্থা কীরকম ছিল, ‘হরকরা’র এই সম্পাদকীয় প্রবন্ধ থেকে তা পরিষ্কার বোঝা যায়। নাগরিক শাসন—শৃঙ্খলা, দৈনন্দিন জীবনের শোভনতা বা নিরাপত্তা বসে এখনও কলকাতায় বিশেষ কিছু ছিল না। সাধারণ লোকসমাজের নাগরিক চেতনার তখনও বিকাশ হয়নি। নগরকর্তারাও অত্যন্ত উদাসীন ছিলেন। অথচ ‘হিন্দু কলেজ’ ও অন্যান্য শিক্ষায়তনের প্রতিষ্ঠার ফলে কলকাতায় তখন একশ্রেণির শিক্ষিত মধ্যবিত্তের বিকাশ হয়েছে। বোঝা যায়, সংখ্যায় তাঁরা নগণ্য ছিলেন এবং সমাজে তাঁদের প্রভাবও খুব সঙ্কীর্ণ ছিল।
আধুনিক যুগে শহরের সমস্ত কদর্যতার মধ্যে কলকাতার মহানগরের ক্রমবিকাশ হয়েছে। মধ্যযুগের নগরের অন্যতম ভূষণ ছিল বারাঙ্গনাপল্লি। রাজার পারিষদ ও আমলা—অমাত্যরা প্রকাশ্যে বারাঙ্গনা—গৃহে যাতায়াত করতেন, সকলে মিলেমিশে আমোদ—আহ্লাদ করতেন। তার মধ্যে একটা মধ্যযুগীয় পৌরুষ ও আভিজাত্যও ছিল। পতিতাসঙ্গদোষে সামাজিক মর্যাদার হানি হত না। বড়বাবুরা যাঁরা বিদেশে চাকরি করতে যেতেন, সাধারণত কোনো নগরে, তাঁরা প্রথম থেকেই পরিবার—পরিজন সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন না। সেইজন্য চাকুরিস্থলে তাঁদের উপপত্নীর প্রয়োজন হত এবং তাঁদের বসতির কাছাকাছি অঞ্চলে বারাঙ্গনাপল্লি গড়ে উঠত। দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায় তাঁর ”আত্মজীবনচরিত”—এ এ সম্বন্ধে গোয়াড়ি কৃষ্ণনগরের কথা উল্লেখ করে যা লিখেছেন, তা প্রণিধানযোগ্য। পূর্বে কৃষ্ণনগরের কেবল আমিনবাজারে পতিতালয় ছিল। গোয়াড়িতে গোপ, মালো প্রভৃতি জাতির বাস ছিল। পরে ইংরেজরা যখন এখানে বিচারালয় ইত্যাদি স্থাপন করেন, তখন গোয়াড়ির পরিবর্তন হতে থাকে। কীভাবে এই পরিবর্তন হয়, সে সম্বন্ধে কার্তিকেয়চন্দ্র লিখেছেন :
‘পরে যখন ইংরাজ গবর্ণমেন্ট এই স্থান প্রশস্ত ও নদীতীরস্থ দেখিয়া ইহাতে বিচারালয় সকল স্থাপন করিলেন, সেই সময় সাহেবেরা গোয়াড়ীতে পশ্চিম দিকে, ও তাঁহাদের আমলা উকীল ও মোক্তারেরা ইহার পূর্ব দিকে, আপন আপন বাসস্থান নির্মাণ করিতে লাগিলেন। তৎকালে বিদেশে পরিবার সঙ্গে লইয়া যাইবার প্রথা অপ্রচলিত থাকাতে, প্রায় সকল আমলা উকিল বা মোক্তারের এক একটি উপপত্নী আবশ্যক হইত। সুতরাং তাঁহাদের বাসস্থানের সন্নিহিত স্থানে স্থানে গণিকালয় সংস্থাপিত হইতে লাগিল। পূর্বে গ্রিস দেশে যেমন পণ্ডিত সকলও বেশ্যালয়ে একত্রিত হইয়া সদালাপ করিতেন সেইরূপ প্রথা এখানেও প্রচলিত হইয়া উঠিল। যাঁহারা ইন্দ্রিয়াসক্ত নহেন, তাঁহারাও আমোদের ও পরস্পরের সাক্ষাতের নিমিত্ত এই সকল গরিকালয়ে যাইতেন।’
গোয়াড়ির মতন কলকাতা শহরেও গণিকালয়ের প্রতিষ্ঠা হয় ইংরেজ আমলে। উত্তর কলকাতায় প্রাচীন ও সম্ভ্রান্ত শহরবাসীদের বসতিকেন্দ্রের আশপাশেই সেইজন্য শহরের ‘বিখ্যাত’ গণিকাপল্লিগুলি প্রতিষ্ঠিত দেখা যায়। এইসব পল্লির নৈতিক পরিবেশ কীরকম কলুষিত ছিল, তার পরিচয় পাওয়া যায়, সেকালের সংবাদপত্রের নানারকম বিবরণ থেকে। একটি বিবরণ এখানে উদ্ধৃত করছি, ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ পত্রিকা থেকে। ১৮৪৩ সালের ১ জুন তারিখের পত্রে, জনৈক পত্রলেখক লেখেন :
‘…শুনিয়াছিলাম এতন্নগরীয় কোন কোন স্থানস্থ প্রজারা পোলীসে আবেদন করেন যে বারাঙ্গনারা প্রত্যহ সন্ধ্যা সময়াবধি ১০/১১ ঘণ্টা পর্যন্ত রাজপথে শ্রেণীবদ্ধ হইয়া যে সকল কুভাষা কদর্যালাপ করিয়া থাকে তাহা আর করিতে না পারে যেহেতু তাহারা ক্রমে ক্রমে এমত আরম্ভ করিয়াছে যে, সেই পথ দিয়া কোনো ভদ্রলোক গমনাগমন করিলেও তাহাদিগের প্রতি লক্ষ্য হইতে লাগিল তাহাতে শ্রুত আছি এই আবেদনে অনুমোদিত হইয়া তাহার নিবারণানুমতি হইয়াছিল ইহাতে অন্য অন্য পল্লীস্থ অনেকেই বিবেচনা করিয়াছিলেন যে তাঁহারাও আবেদন করিয়া যে যে পল্লীতে ঐ উৎপাত আছে তাহার শান্তির চেষ্টা করিবেন, কিন্তু এক্ষণে প্রায় তদবধি দেখা যাইতেছে যে ঐ কুৎসিত কাণ্ডের কোন অংশই শোধন হয় নাই যথা পূর্বং তথা পরং বরঞ্চ এক্ষণে তাহারা রাস্তার মধ্যে নৃত্য পর্যন্ত করিয়া থাকে…’
কলকাতা শহরের বনেদি পরিবারের বসতিকেন্দ্রে গণিকাদের উৎপাত যে কী পরিমাণে ছিল, তা এই পত্রখানি থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়। উন্মুক্ত রাজপথে দল বেঁধে দাঁড়িয়ে গণিকারা যে ভাষায় কদর্য আলাপ—আলোচনা করত, পথচারী ভদ্রলোকদের লক্ষ করে যেসব মন্তব্যাদি করত, তা কতকটা অনুমান করা যায়। পুলিশের কাছে আবেদন করা সত্ত্বেও তার কোনো প্রতিকার করা হয়নি। তার প্রধান কারণ গণিকারা কলকাতা শহরের বনেদি রাজা—মহারাজা, জমিদার ও ধনিক বড়বাবুদের পক্ষপুটে পরম নিশ্চিন্তে বসবাস করত। কলকাতার পুলিশ তাঁদের আশ্রিত এলাকায় হস্তক্ষেপ করতে সাহস পেতেন না। স্থানীয় বর্ধিষ্ণু সাধারণ মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকদের নীতিবোধ ও রুচিবোধ গণিকাদের এই প্রকাশ্য ইতরামিতে ক্ষুণ্ণ হত এবং তাঁরা কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন—নিবেদন করতেন। কিন্তু তাতে কোনো ফল হত না। বিত্তবানদের আশ্রিত বারাঙ্গনারা শহরের প্রকাশ্য রাজপথে নৃত্য করতেও ভয় পেত না। কলকাতার সম্ভ্রান্ত পল্লির নৈতিক পরিবেশ যে কত কদর্য ছিল, তা আজ কল্পনাও করা যায় না।
শহর আর গ্রামের সামাজিক পরিবেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য হল, গ্রামের মানুষ পরস্পর—পরিচিত, শহরের মানুষের কোনো পরিচয় নেই। গ্রাম্য সমাজের মানুষের একাধিক পরিচয় আছে, নামগোত্র জাতিবর্ণ সব দিক দিয়ে সে পরিচিত। কেবল জাতিবর্ণ নয়, সামাজিক পেশার দিক দিয়েও প্রত্যেকে পরিচিত। আত্মপরিচয় গোপন করার কোনো সুযোগ নেই গ্রাম্য সমাজে। তাই অসামাজিক কোনো কাজ করে সেখানে গা—ঢাকা দেওয়া সম্ভব নয়। গ্রামের চোরদেরও সকলে চেনে—জানে। গ্রামে চুরি হলে প্রথমে চেনা চোর যারা, তারা রাত্রে বাড়ি ছিল কি না, খোঁজ করা হয়। শহরে কেউ কারও সঙ্গে পরিচিত নয়। পরিচয়ের একমাত্র মানদণ্ড ধনদৌলত বা বিদ্যাবুদ্ধি—প্রতিপত্তি। তা—ও যাঁদের আছে, তাঁরা নামেমাত্র পরিচিত, মুখ—চেনা নন। বাকি সকলে জনসমুদ্রের বুদবুদের মতন। নামগোত্রহীন জাতিবর্ণহীন মানুষ নিয়েই শহরে সমাজ। বিজ্ঞানীরা তাই শহুরে সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য ‘অ্যানোনিমিটি’ বলে উল্লেখ করেছেন। এরকম নামগোত্রহীন সর্বপরিচয়হীন নাগরিক সমাজে চোর—ডাকাত খুনি—অপরাধীদের পক্ষে আত্মগোপন করে থাকা খুবই সহজ। তাই ইংরেজরা যখন তাঁদের নতুন শাসনব্যবস্থা ও ভূমিব্যবস্থা প্রবর্তন করে এ দেশের গ্রাম্য সমাজকে ভেঙে দিলেন, বংশানুক্রমিক পেশা ও বৃত্তি থেকে সাধারণ লোককে উৎখাত করে ভ্রাম্যমাণ চোর—ডাকাতের দল সৃষ্টি করলেন, তখন কলকাতা শহরের নতুন নামগোত্রহীন সমাজ এইসব চোর—ডাকাত খুনি—ক্রিমিনালদের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠল। শহরই হল তাদের প্রধান ঘাঁটি। প্রধানত শহরে বাস করেই তারা গ্রামে—গ্রামান্তরে চুরি—ডাকাতি করে বেড়াত এবং আবার শহরে ফিরে এসে আত্মপরিচয়হীন অবস্থায় বসবাস করত। কলকাতা শহরের এই সামাজিক অবস্থা সম্বন্ধে, ১৮৪৩ সালের ৩ জুলাই তারিখে ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ পত্রিকায় জনৈক পত্রলেখক লিখেছেন :
‘…বিজ্ঞ লোকেরা অনুমান করেন যে এই কলিকাতা নগরে এক্ষণে বহুতর মন্দ লোক বাস করিতেছে তাহারাই নানা গ্রামে দস্যুতার মূল তজ্জন্য এই মূলোৎপাটন না হইলে বাহিরের উক্ত আপদ কখনই নিবারণ হইবেক না সেই সকল লোকেরাই সরদার তাহারা দিবাভাগে একটা একটা অবিদ্যার বাটীতে কালযাপন করে রাত্রি হইলে বাহিরে যায় ইহাদিগের অধীনে সুলুক সন্ধান করিবার নিমিত্ত চর আছে তাহাদের বসতি পল্লীগ্রামে, তাহারা নানা অনুসন্ধান করিয়া সমাচার আনয়ন করে পরে সেই অনুসারে লোক সঙ্গে লইয়া ডাকাইতী করিতে যায় পুনশ্চ এই নগরে আইসে এক্ষণে কলিকাতা যে প্রকার আইনে মুক্ত আছে তাহাতে নষ্টদুষ্ট লোকের কোনো আপদুপদ্রব নাই কেহ কাহাকে জিজ্ঞাসাও করে না যে তুমি এই নগরে কি নিমিত্ত বাস কর তোমার জীবিকা কি সুতরাং তাহারা পরমসুখে বায়ুসেবন করিয়া বেড়ায় রাত্রি হইলে শিষ্ট প্রজার সর্বনাশ যজ্ঞে ব্রতী হয় তাহাতে যে দক্ষিণা পাইয়া থাকে তাহাতেই নগরে বাস করিয়া নবাবী করে…।’
পত্রলেখকের শেষের কয়েকটি কথা গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন যে কলকাতা শহরে যেরকম স্বাধীন পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে, তাতে নষ্টদুষ্ট লোকের কোনো আপদ—উপদ্রব নেই। কেউ কাউকে জিজ্ঞাসাও করে না যে এই নগরে কেন তুমি বাস করছ, তোমার জীবিকা কী? সুতরাং দুষ্ট লোকেরা পরম নিশ্চিন্তে শহরে বাস করে, দিনের আলোয় শহরের বায়ু সেবন করে বেড়ায় এবং রাতে চুরি—ডাকাতি—রাহাজানি ইত্যাদি যাবতীয় কুকর্ম করে। নাগরিক সমাজের অ্যানোনিমিটির কুফলের এটি একটি দৃষ্টান্তমাত্র।
কলকাতা শহরে প্রথমে যে সাহেবরা এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন অস্তগামী মধ্যযুগের উচ্ছিষ্টতুল্য প্রতিনিধি। নতুন শিক্ষা বা নতুন সভ্যতার অগ্রদূত তাঁরা ছিলেন না। তাঁরা ডুয়েল লড়তেন, হিন্দুদের পূজাপার্বণে যোগদান করতেন, হিন্দুদের মতো নিজেরাও তুকতাকে বিশ্বাস করতেন। তাঁদের সঙ্গে হেয়ারড্রেসার এসেছিলেন, বাজিকর সাহেবরাও এসেছিলেন। উৎসবে বাঙালি ধনিক বাবুদের এবং ইংরেজ প্রভুদের অন্যতম অনুষ্ঠান ছিল বাজি পোড়ানো ও নানারকম খেলা দেখারনো। অনেক সাহেব এইসব খেলা দেখিয়ে জীবিকা অর্জন করতেন। তার কয়েকটি দৃষ্টান্ত সেকালের ‘সংবাদপূর্ণচন্দ্রোদয়’ পত্রিকা থেকে উদ্ধৃত করে দিচ্ছি :
.
।। ছায়াবাজীর বিজ্ঞাপন ।।
মনঃ অতি আকষণীয় সৌন্দর্য্য নব্যপ্রকার দর্শন বিদ্যা সম্বন্ধীয় নানাপ্রকার দ্রব্যদর্শন। চিৎপুর রোডের সিন্দুরিয়াপটি নামক স্থাননিবাসী শ্রীযুক্ত বাবু লালমোহন মল্লিক মহাশয়ের পূজার বাটীতে আগামী ১৭ এপ্রিল বুধবার সায়াহ্নে ঠিক নবম ঘটিকার পর আকসি হাইড্রোজেন যন্ত্র দ্বারা হিরকের ন্যায় অতি প্রবল আলোক সন্দর্শিত হইবেক, তাহার প্রত্যেক টিকিটের মূল্য ১ টাকা, স্পেনস হোটেলের ৬ নং লৌডন বিলডিং নামক স্থানে মেং জে ডবলিউ নিউলেণ্ড সাহেবের নিকট এবং বাটীর দ্বারে টিকিট পাইবেন। নিউলেণ্ড সাহেব সমাদর পূর্বক এতদ্দেশীয় মান্যমান মহাশয়দিগকে জ্ঞাপন করিতেছেন যে তন্মহাশয়দিগের আনন্দ জন্মাওনার্থ এই সকল অতি মনোরম দ্রব্য প্রস্তুত করিয়াছেন এবং পূর্বে সহস্র সহস্র ব্যক্তি তদ্দৃষ্টে অতিশয় সন্তুষ্টও হইয়াছেন, ইহা সমুদয় দর্শনবিদ্যা বিষয়ক এবং সাধারণের সাহায্য যোগ্যও বটে, বিশেষতঃ হিরকের ন্যায় জ্যোতিমান যে আলোক সন্দর্শিত হইবেক তন্নিমিত্ত এক টাকা ব্যয় অধিক বোধ হইবেক না, তদ্ব্যতীত নানাপ্রকার মূল্যবান আশ্চর্য মনাকর্ষণীয় ব্যাপার সকল সন্দর্শিত হইবেক যে কোন ব্যক্তি পূর্বে ইহা দৃষ্টি করেন নাই এমত কি বিদ্বান কি সাধারণ। ব্যক্তি সকলেরই মনোরঞ্জনীয় বোধ হইবেক।’ (সংবাদপূর্ণচন্দ্রোদয়, ১৬ এপ্রিল, ১৮৫০)।
আমরা মানুষের নৃত্যশালার কথা জানি, কলকাতা শহরে অনেকেই তা দেখেছেন। কিন্তু একসময় কলকাতা শহরে অশ্বের নৃত্যশালা ছিল এবং সাহেবরা ছিলেন তার মালিক। অশ্বের নৃত্য দেখিয়ে তাঁরা বেশ দু’পয়সা রোজগার করতেন। এ বিষয়ে সংবাদপত্রের একটি বিজ্ঞাপন উদ্ধৃত করছি।
.
।। ব্যবসায়ের বিজ্ঞাপন।।
(অক্টরলোনি মনুমেন্টের নিকটস্থ অশ্ব নৃতশালা)
শ্রীযুত হিলর ও জর্ডন সাহেবরা সর্বসাধারণকে সমাদরপূর্বক জ্ঞাপন করিতেছেন যে তাঁরা অল্পদিনের মধ্যে আপনাদের দলসহযোগে (১২) বারো দফা অশ্বের নাট্যক্রিয়া করিবেন, তাহা প্রত্যেকবারে ভিন্ন হইবেক। তাঁহারা আগামী জানুআরি মাসে মাদ্রাজে গমন করিবেন প্রযুক্ত অল্পদিন এখানে থাকিবেন মাত্র।
এখানে অল্পদিন বাসের কালে কলিকাতাস্থ সর্বসাধারণ লোকের সাহায্যে সমাদরপূর্বক প্রার্থনা করেন।
.
Hillier & Jourdan
কলিকাতা, ২১ অক্টোবর, ১৮৫০। (সংবাদপূর্ণচন্দ্রোদয়, ২৪ অক্টোবর, ১৮৫০)
অশ্বের বারো দফা নাট্যক্রিয়া কি, একালের শহরবাসীর কল্পনা করার ক্ষমতা নেই। সেকালের শহরবাসীর কাছে ব্যাপারটি খুবই আকর্ষণীয় ছিল নিশ্চয়। তা না হলে সাহেবরা এইভাবে বিজ্ঞাপন দিয়ে তাঁদের নাট্যাভিনয়ের (অশ্বের) ব্যবসা জমাবার চেষ্টা করতেন না।
সেকালের কলকাতায় সাহেবরা বেলুনে উড়তেন এবং পত্রিকার সাহায্যে বিজ্ঞাপন দিয়ে সকলকে তা জানাতেন। যেমন,
”আমরা জনশ্রুতি দ্বারা শ্রবণ করিয়া বেলুনযোগে মানুষ উড়ার কল্পনার বিষয় যাহা প্রকাশ করিয়াছিলাম এক্ষণে ফলে তাহাই হইবার সঠিক প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে। পুনর্বার বেলুনে উড়িবার সাহেব স্থিরতাপূর্বক প্রচার করিয়াছেন যে আগামী মঙ্গলবার প্রাতঃকালীন আট ঘটিকার সময় উড়িবেন।
”এবারকার বেলুনের সাহেব ঐ বিষয়ে আপনার সাধারণ লোকের বিদিত নিমিত্ত আদৌ প্রচার করিয়াছেন যে প্রকৃত গ্যাস বা বাষ্প দ্বারা বেলুন পূর্ণ করিবেন এবং পূর্বকার মেগ্রি সাহেব যে যে সময় বেলুন উঠাইবার জন্য ধার্য করেন তাহারও পরিবর্তন করিয়াছে অর্থাৎ ইহার বেলুনের সময় অপরাহ্ন না হইয়া পূর্বাহ্ন হইয়াছেন ইহাতে অনুমান হয় কৌতুকার্থি ভুরি তদ্দর্শনাভিলাষী হইয়া তাঁহার মানসপূর্ণ করিতে পারেন…এদেশের লোকেরা অদ্ভূত কৌতুকের নাম শ্রবণেও মহা কৌতুকী হয়েন বর্তমান বেলুনি সাহেব যে মানসে আসিয়াছেন তাহার মানসসিদ্ধি হইবেক তাহাতে সন্দেহ নাই।” (সংবাদপূর্ণচন্দ্রোদয়, ২ নভেম্বর, ১৮৫০)
‘বেলুনি সাহেবের’ মতন অনেক বাজিকর সাহেব ও সার্কাসের খেলা দেখিয়ে কৌতুকপ্রিয় এ দেশি জনসাধারণের কাছে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। সাহেবরা কীরকম খেলা দেখাতেন, তার একটি বিবরণ এখানে সেকালের সংবাদপত্র থেকে উদ্ধৃত করে দিচ্ছি :
”গত পরশু রাত্রিযোগে টৌনহালে প্রোফেসার লিস ও তাঁহার পুত্রদিগের আশ্চর্য্য বাজী দৃষ্টে আমরা মহা হর্ষুযুক্ত, চমৎকৃত ও কৌতুকী হইয়াছি। উক্ত স্থানে বহুতর সাহেব বিবি ও এতদ্দেশীয় মান্যলোকেরা উপস্থিত হইয়াছিলেন, তাঁহারা বাজীকরদিগের কার্য্য দৃষ্টে ঘন ঘন কলরবে যে প্রকার সাধুবাদ প্রদান করেন তাহাতেই প্রমাণ হইয়াছে উক্ত—ক্রীড়া কি প্রকার আনন্দোৎপাদক হইয়াছিল। প্রোফেসরের বালকেরা এক ২ বার যে প্রকার কঠিনতর বাজীতে শরীর সংপৃক্ত করিয়াছিল তাহাতে লোকে ত্রাসে প্রায় নিঃশ্বাসহীন হইয়া শঙ্কা করিতেছিলেন যে বালকদের শরীর যে সূক্ষ্ম ওজনে স্থিত তাহার একচুল পরিমাণে দিগ্বিদিগ হইয়া দুর্ঘটনা না ঘটে। বাজীকরেরা যত প্রকার বাজী যে মত সুন্দররূপে করিয়াছেন ও তাহাতে দর্শকদিগের যত সুখ জন্মে তাহা বর্ণনা করা অসাধ্য, চক্ষে যিনি যখন তাহা দেখিবেন তখনই তাহা স্বয়ং অনুভব ও সম্ভোগ করিবেন। অতএব আমরা বিবেচনা করি যে এদেশীয় মহাশয়দের নিদানে একবার এ ক্রীড়া দর্শন করা আবশ্যক। কারণ ইউরোপীয় বিদ্যা ও দর্শনশাস্ত্রের গুণ প্রদর্শক এমত কার্য্য দৃষ্টি করিয়া বহুদর্শি হওয়া সকলের কর্তব্য।
”উক্ত বীর্য্যমান প্রোফেসারের একটি মাত্র ক্রীড়ার বিবরণ পাঠকবর্গ অবধান করুন। তিনি একপদে দণ্ডায়মান হইয়া কেবল একহস্ত দ্বারা শায়িত একটি পুত্রের পদ ধারণপূর্বক শূন্যে উত্তোলনপূর্বক কতক্ষণ আপন মস্তকোপরি রাখিলেন।…” (সংবাদপূর্ণচন্দ্রোদয়, ২৪ জানুয়ারি, ১৮৫২)
.
সাহেব বাজিকরেরাও আমাদের সামাজিক জীবনে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন, কেবল বিজ্ঞানী ও শিক্ষাব্রতীরা করেননি।
একালের কলকাতায় রাজপথের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা এবং পথচারীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা এক কঠিন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নানা রকমের বিধিব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও কলকাতার পথে দুর্ঘটনার অন্ত নেই। আজকাল দুর্ঘটনা বলতে আমরা বুঝি মোটর বা ট্রামের দুর্ঘটনা। কিন্তু সেকালের কলকাতায় মোটর বা বৈদ্যুতিক ট্রাম, কোনাটাই যখন ছিল না, তখনও রাস্তায় যানবাহনের উপদ্রব পথচারীদের সহ্য করতে হত। ঘোড়ার গাড়িই ছিল তখন একমাত্র যান, অবশ্য গোগাড়ি ও পাল্কি ছাড়া। নানা রকমের ঘোড়ার গাড়ি ছিল এবং আজকালকার মোটরের মতন তার নামের ও আকারের বৈচিত্র্যও ছিল। গাড়ি চাপা পড়ে তখনও কলকাতার নিরীহ লোকজনের মৃত্যু হত। ঘোড়ার গাড়ির উৎপাতে পাল্কি—বেয়ারা ও আরোহীরাও বিপন্ন হত। এখন যেমন সংবাদপত্রে মোটর ও ট্রাম দুর্ঘটনার কথা প্রায়ই প্রকাশিত হয়, একশো বছর আগেও তেমনি পথের এইসব দুর্ঘটনার দুঃসংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হত। এরকম কয়েকটি সংবাদ এখানে পরিবেশন করছি :
.
।। গাড়ি চাপায় মৃত্যু।।
গত ১১ জ্যৈষ্ঠ বুধবার রাত্রে নতুন চীনাবাজারের সম্মুখে একজন জবন মদিরা পানে মত্ত হইয়া রাস্তায় ভ্রমণ করিতেছিল এমতকালে একখানি চেরেট অতি দ্রুত আসিয়া উপস্থিত হইয়া তাহার কালান্তক হইল অর্থাৎ উক্ত জবন তাহার চক্রে পড়িয়া দেহত্যাগ করিয়াছে।—(সমাচার চন্দ্রিকা, ২৯ মে, ১৮৪৩)
ঘোড়ার গাড়িরও নানা রকমের নাম ছিল, আজকালকার মোটরের মতন, তার মধ্যে ‘চেরেট’ একটি।
।। গাড়ি চাপায় মৃত্যু।।
আমরা অবগত হইয়া দুঃখীত হইলাম যে গত ১৭ শ্রাবণ কলিঙ্গায় একটি জবন কন্যা রাত্রিকালে গ্রীষ্মপ্রযুক্ত তাহার মাতার সহিত রাস্তার ধারে শয়ন করিয়া নিদ্রা যাইতেছিল হঠাৎ তাহার উপর দিয়া গাড়ি যাওয়াতে প্রাণত্যাগ হয় কিন্তু তৎকালে তাহার মাতা এমত নিদ্রিতা ছিল যে তার কোন বৃত্তান্ত জ্ঞাত হইতে পারে নাই… (সমাচার চন্দ্রিকা, ৩ আগষ্ট, ১৮৪৩)
দুর্ঘটনাটি ভয়াবহ।
.
।। সৌভাগ্যক্রমে রক্ষা পাওয়া।।
৯ আগষ্ট তারিখের রাত্রে একজন বিবি একটি বালক লইয়া পাল্কী আরোহণপূর্বক চৌরঙ্গী হইতে কসাইটোলার দিগে আসিতেছিলেন ইতিমধ্যে কসাইটোলার চৌরাস্তার উপর এক চেরিয়াট গাড়ি দুই অশ্ব সমেত অতি বেগে আসিয়া ঐ পাল্কীর উপরি পতিত হওয়াতে বেহারা পাল্কী হইতে বাহির হইয়া প্রাণরক্ষা করিয়াছেন পরে বেহারা ঐ পাল্কীতে বিবিকে লইয়া গৃহে গমন করে। (সমাচার চন্দ্রিকা, ৩১ আগস্ট, ১৮৪৩)
আজকালকার মোটরের তুলনায় ‘চেরেট’ গাড়ির উপদ্রব সেকালে কম ভয়াবহ ছিল না। রিকশা বা সাইকেলের দুর্দশার মতন পাল্কিরও সেকালে যথেষ্ট দুর্ভোগ ভুগতে হত। পাল্কি—বেহারা ঘোড়ার উপদ্রবে পাল্কি ছেড়ে দিয়ে পলায়ন করত বলে যাত্রীরা বিপদে পড়ত।
.
।। গাড়ি চাপায় আঘাত।।
গত ১৩ ভাদ্র সোমবার বেলা ৮/৯ ঘণ্টার সময়ে শোভাবাজারের বটতলার নিকট পাল্কিগাড়ি গমন করিতেছিল হঠাৎ একজন বৃদ্ধা স্ত্রীলোক তাহার চক্রে পতিত হইয়া আঘাত প্রাপ্তা হইয়াছে কিন্তু বোধ হয় যে ঐ আঘাতে তাহার প্রাণাঘাত হইবেক না।
পাল্কিগাড়িও চেরেটের মতন এক রকমের ঘোড়ার গাড়ি। এমনি পাল্কির সামনে ঘোড়া জুতে দিলে যেরকম চেহারা হয়, সেইরকম দেখতে বলে পাল্কি গাড়ি বলা হত। কলকাতার রাস্তায় তখন লোকের বা গাড়ির ভিড় খুব বেশি ছিল না। তা সত্ত্বেও লোকে গাড়ির তলায় চাপা পড়ত। কাঁধের পাল্কি ও গোরুর গাড়ির যুগ থেকে হঠাৎ অশ্বযানের যুগেও সাধারণ লোককে খাপ খাইয়ে নিতে বেশ কষ্ট পেতে হয়েছিল। সাধারণ লোক তখনও যারা কলকাতার রাজপথে চলাচল করত, তারা মৃদুগতি গ্রাম্য জীবনধারায় অভ্যস্ত। অশ্বযানের বেগের সঙ্গেও সে জীবন পরিচিত নয়। তাই কলকাতা শহরে পদে পদে তাদের নতুন বেগবান অশ্বযানের আঘাতে বিপন্ন হতে হয়েছে।
.
।। গাড়ি চাপায় আঘাতী।।
২১ সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার অতি প্রত্যুষে চিৎপুর হইতে কৃষক লোকেরা তরিতরকারি ও ফলাদি লইয়া কলিকাতায় বিক্রয়ার্থে আসিতেছিল পথিমধ্যে মৃত রাজা রামচাঁদের বাটীর সমীপে এক সাহেবের পাল্কিগাড়ির চক্রে একজন কৃষক পতিত হওয়াতে তাহার পদে সাংঘাতিক আঘাত লাগিয়াছে সাহেব তাহা দৃষ্ট করিয়া আপন কৌচমেনকে অতি বেগে গাড়ি চালাইতে আজ্ঞা প্রদান করিলেন গরীব কৃষক আঘাতী হইয়া ভূমে পতিত থাকিয়া ক্রন্দন করিতে লাগিলেন। (সমাচার চন্দ্রিকা, ২১ সেপ্টেম্বর, ১৮৪৩)
নতুন নাগরিক সভ্যতায় বেগের সঞ্চার করেছে প্রথমে অশ্বযান, তারপর মোটর, ট্রাম ইত্যাদি। গোযানের গতি থেকে অশ্বযানের গতির সঙ্গে প্রথম থেকেই সাধারণ অনভ্যস্ত মানুষের পক্ষে তাল রেখে চলা সম্ভব হয়নি।
এই ধরনের বিচিত্র সব সংবাদের ভিতর থেকে সেকালের কলকাতা শহরের সামাজিক জীবনের যে পরিচয় পাওয়া যায় তার মূল্য অল্প নয়। টুকরো টুকরো চিত্র হলেও, সবগুলি জোড়া দিলে সমাজের একটি সমগ্র—চিত্রও পাওয়া সম্ভবপর। সামাজিক ইতিহাস রচনার এরকম আকর্ষণীয় উপকরণ অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। প্রাচীন পত্রপত্রিকার জীর্ণ পৃষ্ঠার মধ্যে এইসব উপকরণ উপেক্ষিত অবস্থায় সমাধিস্থ হয়ে রয়েছে। লক্ষ না থাকলে, দৃষ্টি না থাকলে, এইসব উপকরণ আহরণ করাও সম্ভব নয়, এবং কোন উপকরণের কী গুরুত্ব তা—ও বোঝা যায় না। কলকাতা শহরের কোনো ইতিহাসই এখনও লেখা হয়নি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস তো নয়ই। যদি কোনোদিন লেখা হয়, তাহলে সেকালের সংবাদপত্রের ও সাময়িকপত্রের এইসব উপেক্ষিত উপকরণ যে কত মূল্যবান, তা যে—কেউ উপলব্ধি করতে পারবেন।*
.
* বর্তমান লেখক কর্তৃক সঙ্কলিত ও সম্পাদিত ‘সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র’ (চার খণ্ড) এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য।