সংবাদটা আরও বিশদভাবে পাওয়া গেল তারাচরণ নাপিতের কাছে। পাঁচখানা গ্রামেই তাহার যজমান আছে। নিয়মিত যায় আসে। সে বিবৃতির শেষে মাথা চুলকাইয়া বলিল—কি আর বলব বলুন, পণ্ডিত!
দেবু চুপ করিয়া ভাবিতেছিল মানুষের ভ্রান্ত বিশ্বাসের কথা।
তারাচরণ আবার বলিল—কলিকালে কারুর ভাল করতে নাই! তারাচরণ এ সব বিষয়ে নির্বিকার ব্যক্তি, পরনিন্দা শুনিয়া শুনিয়া তাহার মনে প্রায় ঘটা পড়িয়া গিয়াছে। কিন্তু তবু দেবনাথের প্রসঙ্গে এই ধারার ঘটনায় সে ব্যথা অনুভব না করিয়া পারে নাই।
দেবু বলিল—এর মধ্যে ন্যায়রত্ন মহাশয়ের বাড়ি গিয়েছিলে?
–গিয়েছিলাম; ঠাকুর মশাইও শুনেছেন।
–শুনেছেন?
–হ্যাঁ। ঘোষ একদিন ঠাকুর মশায়ের কাছেও গিয়েছিল কিনা।
–কে? শ্ৰীহরি?
–হ্যাঁ। ঘোষ খুব উঠে পড়ে লেগেছে। কাল দেখবেন একবার কাণ্ডখানা।
–কাণ্ড?
–পাঁচখানা গায়ের মধ্যে কঙ্কণা-কুসুমপুরের কথা বাদ দেন। বাদবাকি গায়ের মাতব্বর মোড়লদের কাণ্ডকারখানা দেখবেন। ঘোষ কাল ধানের মরাই খুলবে!
—শ্ৰীহরি ধান দেবে তা হলে?
–হ্যাঁ। যারা এই পঞ্চগেরামী মজলিসের কথায়, ঘোষের কথায় যায় দিয়েছে, তাগিদে ঘোষ ধান দেবে। অবিশ্যি অনেক লোক রাজি হয় নাই, তবে মাতব্বরেরা সবাই চলেছে। মোড়লদের মধ্যে কেবল দেখুড়ের তিনকড়ি পাল বলেছে—৩ মি ওসবের মধ্যে নেই।
দেবু আবার কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। আজ তাহার মাথায় যেন আগুন জ্বলিয়া উঠিয়াছে। নানা উন্মত্ত ইচ্ছা তাহার মনে জাগিয়া উঠিতেছে। মনে হয় দেখুড়িয়ার ওই দুর্দান্ত ভল্লাদের নেতা হইয়া এ অঞ্চলের মাতব্বরগুলোকে ধ্বংস করিয়া দেয়। সর্বাগ্রে ওই শ্ৰীহরিকে। তাহার। সর্বস্ব লুঠতরাজ করিয়া তাহাকে অন্ধ করিয়া, তাহার ঘরে আগুন জ্বালাইয়া দেয়।
তারাচরণ বুলিলচাষের সময় এই ধানের অভাব না হলে কিন্তু ব্যাপারটা এমন হত না, ধর্মঘট করে মাতব্বরেরাই ক্ষেপেছিল। আপনাকে ওরাই টেনে নামালে। কিন্তু ধান বন্ধ হতেই মনে মনে সব হায়-হায় করছিল। এখন ঘোষ নিজে থেকে যেই মজলিশ করে আপনাকে পতিত করবার কথা নিয়ে মোড়লদের বাড়ি গেল, মোড়লরা দেখলে—এই ফঁক; সব একেবারে ঢলে পড়ল। তা ছাড়া–
—তা ছাড়া? স্থিরদৃষ্টিতে চাহিয়া দেবু প্রশ্ন করিল।
–তা ছাড়া—তারাচরণ আবার একটু থামিয়া বলিল—একালের লোকজনকে তো জানেন গো; স্বভাব-চরিত্র কটা লোকের ভাল বলুনঃ কামার-বউয়ের, দুর্গার কথা শুনে লোকে সব রসস্থ হয়ে উঠেছে।
…হুঁ। এ সম্বন্ধে ন্যায়রত্ন মশায় কি বলেছেন জান? শ্ৰীহরি গিয়েছিল বললে যে?
হাত দুইটি যুক্ত করিয়া তারাচরণ প্রণাম জানাইয়া বলিল—ঠাকুর মশায়? সে হাসিল, হাসিয়া বলিল—ঠাকুর মশায় বলেছেন,আহা—বেশ কথাটা বলেছেন গো! পণ্ডিত লোকের কথা তো! আমি মুখস্ত করেছিলাম, দাঁড়ান মনে করি।
একটু ভাবিয়া সে হতাশভাবে বলিলনা, আর মনে নাই। হ্যাঁ, তবে বলেছেন—আমাকে ছাড়ান দাও। তুমি পাল থেকে ঘোষ হয়েছ, তুমিই তো মস্ত পণ্ডিত হে! যা হয় কঙ্কণার বাবুদের নিয়ে করগে।
ন্যায়রত্ব শ্রীহরিকে বলিয়াছিলেন—আমার কাল গত হয়েছে ঘোষ। আমি তোমাদের বাতিল বিধাতা। আমার বিধি তোমাদের চলবে না। আর বিধি বিধানও আমি দিই না। তারপরও হাসিয়া বলিয়াছেন-কঙ্কণার বাবুদের কাছে যাও তারাই তোমাদের মহামহোপাধ্যায়; তুমি পাল থেকে ঘোষ হয়েছ—নিজেই তো একজন উপাধ্যায় হে!
দেবু সান্ত্বনায় জুড়াইয়া গেল। অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া নিজের উন্মত্ততাকে সে শাসন করিল। ছি ছি! সে এ কি কল্পনা করিতেছে?
তারাচরণ বলিল—কঙ্কণার বাবুদের কথা উঠল তাই বলছি; কুসুমপুরের শেখদের ব্যাপারে আপনাকে নিয়ে কথাটা কে রটিয়েছে জানেন? ওই বাবুরাই!
–বাবুরা? কি রটিয়েছে?
–হ্যাঁ। বাবুদের নায়েব নিজে বলেছে ইরসাদকে। বলেছে, দেবু ঘোষ কাছারিতে উঠেই বাবুকে চোখ টিপে ইশেরা করেছিল যে, হাঙ্গামা বেশি বাড়বে না আমি ঠিক করে দিচ্ছি। তা নইলে বাবু রহমকে ছেড়ে দিতেন না। বাবুও বুঝে দেবুকে ইশেরা করে এক হাত দেখিয়ে দিয়েছেন–আচ্ছা, মিটিয়ে দাও; তা হলে পাঁচশো টাকা দেব।
দেবু বিস্ময়ে নির্বাক হইয়া গেল। বাবুদের নায়েব এই কথা বলিয়াছে!
দেবু অবাক হইয়া গেলেও কথাটা সত্য। মুখুয্যেবাবুর মত তীক্ষ্ণধী ব্যক্তি সত্যই বিরল। মুসলমানেরা যখন দল বাঁধিয়া আসিয়াছিল তখন তিনি বিচলিত হইয়াছিলেন, একটা দাঙ্গা হাঙ্গামা আশঙ্কা করিয়াছিলেন। কিন্তু তাহাতে তিনি ভয় পান নাই। বরং তিনি এমন ক্ষেত্রে তাহাই চাহিয়াছিলেন; তাহা হইলে মরিলে মরিত কয়েকজন দারোয়ান চাপরাসী এবং জনকয়েক মুসলমান চাষী; তিনি সর্বপশ্চাতে আগ্নেয়াস্ত্রের আড়ালে অক্ষত থাকিতেন। তারপর মামলাপর্বে তাঁহার বাড়ি চড়াও করিয়া লুঠতরাজ এবং দাঙ্গার অভিযোগে এই চাষীকুলকে তিনি নিষ্পেষিত করিয়া দিতে ন। কিন্তু দেবু আসিয়া ব্যাপারটা অন্য রকম করিয়া দিল। দেবুর জীবনের কাহিনীও তিনি শুনিয়াছেন; সে কাহিনী দেবুকে এমন একটা মর্যাদা এবং ব্যক্তিত্ব দিয়াছে, যাহার সম্মুখে তাহার মত ব্যক্তিকেও সঙ্কুচিত হইতে হয়। কারণ দেবু জীবনে যাহা পারিয়াছে, তিনি পারেন নাই। দেবু তাহাকে মন্ত্রমুগ্ধ করিয়া জনতাকে শান্ত রাখিয়া নিমেষে রহমকে উঠাইয়া লইয়া গেল। তিনি অত্যন্ত চিন্তিত হইয়া পড়িলেন। সমস্ত অপরাধ এখন তাহার ঘাড়ে।
ঠিক এই সময় তাঁহার কানে আসিল—কঙ্কণার অপর কোনো বাবুর নায়েব যে পরামর্শ দিয়াছে সেই কথা; আরও শুনিলে দেবু মিথ্যা ডায়রি করিতে এবং তার পাঠাইতে চায় না বলিয়া থানায় যায় নাই। সঙ্গে সঙ্গে তাহার মস্তিষ্কে বিদুৎ-ঝলকের মত ইশারায় একটা কথা খেলিয়া গেল। মনুষ্য-প্রকৃতি তিনি ভাল করিয়াই জানেন। দেবুর কথা তিনি নিশ্চয় করিয়া বলিতে পারেন না; কিন্তু পাঁচশো টাকার লোভ ইহাদের অন্য কেহ সংবরণ করতে পারেন না, ইহা তাহার ধ্রুব বিশ্বাস। তখন অপবাদটা রটাইয়া তাহার জনপ্রিয়তাকে আঘাত করিবার চেষ্টা করিলে কেমন হয়? তিনি তাহার নায়েবকেও তৎক্ষণাৎ পাল্টা একটা ডায়রি করিতে থানায় পাঠাইলেন এবং মিথ্যা কথাটা ইরসাদ-রহমের কানে তুলিতে বলিয়া দিলেন। উত্তেজনায় অধীর জনতা সঙ্গে সঙ্গে কথাটা বিশ্বাস করিয়া লইল। রহম-ইরসাদের প্রথমটা দ্বিধা হইলেও কথাটা তাহারা একেবারে উড়াইয়া দিতে পারিল না।
হাফ হাতা পাঞ্জাবিটা গায়ে দিয়া দেবু সেই আসন্ন দ্বিপ্রহর মাথায় করিয়াই বাহির হইয়া পড়িল। তারাচরণ অনুমান করিল পণ্ডিত কোথায় যাইবে, তবুও সে জিজ্ঞাসা করিল—এই দুপুরে কোথায় যাবেন গো?
—ঠাকুর মশাইকে একবার প্রণাম করে আসি তারু-ভাই। নইলে মনের আগুন আমার নিভবে না। দেবু রাস্তায় নামিয়া পড়িল।
তারাচরণ আপনার ছাতাটা তাহার হাতে দিয়া বুলিলছাতা নিয়ে যান। বেজায় কড়া রোদ।
কথা না বলিয়া দেবু ছাতাটা লইয়া চলিতে আরম্ভ করিল। পঞ্চগ্রামের বিস্তীর্ণ মাঠের মধ্য দিয়া পথ। শ্ৰাবণ সদ্য শেষ হইয়াছে। ভদ্রের প্রথম। চাষের ধান পোঁতার কাজ প্রায় শেষ হইয়া আসিল। বিশেষ করিয়া যাহারা সচ্ছল অবস্থার লোক, তাহাদের রোয়ার কাজ কয়দিন আগেই শেষ হইয়াছে। ধান ধান করিয়া তাহাদের কাজ বন্ধ হয় নাই, তাহার উপর প্রয়োজন অনুযায়ী নগদ মজুর লাগাইয়াছে। যাহাদের জমির ধান ইহারই মধ্যে উঠিয়াছে, তাহাদের ক্ষেতে চলিতেছে নিড়ানের কাজ। বিস্তীর্ণ মাঠের ধানের সবুজ রঙে গাঢ়তার আমেজ আসিয়াছে। দেবু কোনোদিকে লক্ষ্য না করিয়া আজ চলিল।
একটা অতি বিস্ময়কর ঘটনাও আজ তাহার অন্তরকে স্পর্শ করিল না। এত বড় মাঠে চাষ এখনও অনেক লোকে করিতেছে; পূর্বে মাঠের প্রতিটি জন তাহার সহিত দু-একটা কথা বলিয়া তবে তাহাকে যাইতে দিত। দূরের ক্ষেতের লোক ডাকিয়া তাহার গতি রুদ্ধ করিয়া কাছে। আসিয়া সম্ভাষণ করিত। আজ কিন্তু অতি অল্প লোকই তাহাকে ডাকিয়া কথা বলিল। আজ কথা বলিল—সতীশ বাউরি, দেখুড়িয়ার জনকয়েক ভল্লা আর দুই-একজন মাত্র। তাহাদের জ্ঞাতিগোত্রীয়দের সকলে দেবুর অন্যমনস্কতার সুযোগ লইয়া নিবিষ্টমনে চাষেই ব্যস্ত হইয়া রহিল। তিনকড়ি আজ এ মাঠে নাই।
দেবুর সেদিকে খেয়ালই হইল না। প্রথমটা দুরন্ত ক্ৰোধে মনের প্রতিহিংসা-প্রবৃত্তি আদিমযুগের ভয়াবহতা লইয়া জাগিয়া উঠিয়াছিল। কিন্তু ন্যায়রত্ন মহাশয়ের সান্ত্বনা-বাণীর আভাস পাইয়া তাহার অন্তরের পুঞ্জীভূত অভিযোগ শীতলবায়ুপ্রবাহ-সৃষ্ট কালবৈশাখীর মেঘের মত ঝরঝর ধারায় গলিয়া গিয়াছে। সে-মুহূর্তে তাহার চোখ ফাটিয়া জল আসিয়াছিল, তারাচরণের সম্মুখে সে বহু কষ্টে চোখের জল সংবরণ করিয়াছে। পথেও সে আজ চলিয়াছিল এক নিবিষ্ট চিত্তে—আত্মহারার মত। হাতের ছাতাটাও খুলিয়া মাথায় দিতে ভুলিয়া গিয়াছে।…
ন্যায়রত্ন মহাশয় পূজার্চনা সবে শেষ করিয়া গৃহদেবতার ঘর হইতে বাহির হইতেছিলেন। দেবুকে দেখিয়া স্মিতমুখে তাহাকে আহ্বান করিলেন—এস, পণ্ডিত এস!
দেবুর ঠোঁট দুইটি থরথর করিয়া কাঁপিয়া উঠিল। পৃথিবীর হৃদয়হীন অবিচারের সকল বেদনা এই মানুষটিকে দেখিবামাত্র যেন ফেনিল আবেগে উথলিয়া উঠিল—শিশুর অভিমানের মত।
ন্যায়রত্ন সাগ্রহে বলিলেন—বস। মুখচোখ লাল হয়ে উঠেছে রৌদ্ৰে, ঘেমে নেয়ে গেছ যেন! দেবুর হাতেই বন্ধ ছাতাটার দিকে চাহিয়া বলিলেন ছাতাটা এখনও ভিজে রয়েছে দেখছি। বেশ বৃষ্টি হয়েছিল সকালে। তারপর প্রহরখানেক তো সূর্যদেব ভাস্কররূপ ধারণ করেছেন। মনে হচ্ছে তুমি ছাতাটা মাথায় দাও নি পণ্ডিত! একটু ঠাণ্ডায় ঠাণ্ডায় এলে পারতে।
দেবু এতক্ষণ আত্মসংবরণ করিয়াছিল, ঠাকুর মহাশয়ের যুক্তি ও মীমাংসা শুনিয়া এবার একটু বিনম্ৰ হাসি তাহার মুখে ফুটিয়া উঠিল। সে নতজানু হইয়া বলিল-পায়ের ধুলো নে কি?
–অর্থাৎ আমায় হেবে কিনা জিজ্ঞাসা করছ? সম্মুখে আমাকে দেখছ, আমার পূজার্চনা শেষ হয়ে গিয়েছে। তুমি পণ্ডিত মানুষ, সিদ্ধান্ত তুমি করে নাও।
দেবু কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে পারিল না। সে ঠাকুর মহাশয়ের মুখের দিকেই চাহিয়া রহিল। ন্যায়রত্ন মহাশয় দেবতার নির্মাল্য সমেত হাতখানি দেবুর মাথার উপর রাশিয়া বলিলেন—আমার পায়ের ধুলোর আগে ভগবানের আশীর্বাদ নাও। পণ্ডিত, তার সেবা করি বলেই সংসারের ছোঁয়াছুঁয়ির বিচার করি। যে বস্তু যত নিৰ্মল, তাতে স্পর্শদুষ্টি তত শীঘ্র সংক্রামিত হয় কিনা। তাই সাবধানে থাকি। নইলে আমি তোমাকে স্পর্শ করব না এমন স্পৰ্ধা আমার হবে কেন?
দেবু ন্যায়রত্নের পায়ের উপর মাথা রাখিল।
ন্যায়রত্ন সস্নেহে বলিলেন—ওঠ, পণ্ডিত ওঠ। … বলিয়া বাড়ির ভিতরের দিকে মুখ ফিরাইয়া ডাকিলেন-ভো ভো রাজ! দাদু হে–
দেবু ব্যথভাবে বলিল—বিশু-ভাই এসেছে নাকি?
–হ্যাঁ। ন্যায়রত্ব হাসিলেন।
—কি দাদু? বাড়ি হইতে বাহির হইয়া আসিল বিশ্বনাথ। এবং দেবুকে দেখিয়া সঙ্গে সঙ্গে বলিয়া উঠিল—এ কি, দেবু-ভাই। এই রৌদ্রে?
ন্যায়রত্ব হাসিয়া বলিলেনদেখছ পণ্ডিত? রাজ্ঞীর সঙ্গে বিশ্বম্ভালাপমগ্ন রাজচিত্ত অসময়ে আহ্বানের জন্য কেমন বিক্ষুব্ধ হয়েছে দেখছ?
বিশ্বনাথ লজ্জিত হইল না, বলিল—আপনার ঠাকুর মাতবে ঝুলনে, রাজ্ঞী সেই নিয়ে ব্যস্ত। এ বেচারার দিকে চাইবার তার অবকাশ নাই মুনিবর!
—আমার দেবতার প্রসাদে এই পূর্ণিমারাত্রে তুমিও হিন্দোলায় দুলবে রাজন্। তুমি ঘরে ঝুলনার দড়ি টাঙিয়েছ—আমি উঁকি মেরে দেখেছি। আমার ঠাকুরের ঝুলনের অজুহাতেই তুমি কলকাতা থেকে আসবার সুযোগ পেয়েছ, সেটা ভুলে যেয়ো না। আমি অবশ্য তুমি সাতদিন পরে এলেও কিছু বলি না। কিন্তু তুমি তো প্রতিবারেই আমার ঠাকুরের প্রতি ভক্তির ছলনা করে কৈফিয়ত দিতে ভোল না রাজন্।
বিশ্বনাথ এবার হাসিতে লাগিল। দেবু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল, বিলুকে তাহার মনে পড়িয়া গেল। ঝুলনে তাহারাও একবার দোল খাইয়াছিল।
ন্যায়রত্ন বলিলেন–জয়া যদি ব্যস্ত থাকে, তবে তুমিই পণ্ডিতের জন্য এক গ্লাস শরবত প্রস্তুত করে আন দেখি।
দেবু ব্যস্ত হইয়া বলিল–না না না।
ন্যায়রত্ন বলিলেন—গৃহস্থকে আতিথ্য-ধর্ম পালনে ব্যাঘাত দিতে নাই। তারপর বিশ্বনাথকে বলিলেন—যাও ভাই, পণ্ডিতের বড় তৃষ্ণা পেয়েছে। বড় শ্ৰান্ত-ক্লান্ত ও…
কিছুক্ষণ পরে ন্যায়রত্ন বলিলেন আমি সব শুনেছি পণ্ডিত।
দেবু তাহার পায়ে হাত দিয়াই বসিয়াছিল; সে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিল-আমি কি করব বলুন।
ন্যায়রত্ন স্তব্ধ হইয়া রহিলেন। বিশ্বনাথ পাশেই চুপ করিয়া বসিয়া ছিল—জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাহার মুখের দিকে চাহিল।
দেবু আবার প্রশ্ন করিল—বলুন আমি কি করব?
ন্যায়রত্ব বলিলেন—বলবার অধিকার নিজ থেকেই অনেকদিন ত্যাগ করেছি। শশীর মৃত্যুর দিন উপলব্ধি করেছিলাম কাল পরিবর্তিত হয়েছে, পাত্রেরাও পূর্বকাল থেকে স্বতন্ত্র হয়েছে; দৈবক্রমে আমি ভূতকালের মন এবং কায়া সত্ত্বেও ছায়ার মত বর্তমানে পড়ে রয়েছি। সেদিন থেকে আমি শুধু দেখে যাই। বিশ্বনাথকে পর্যন্ত কোনো কথা বলি না।
তিনি একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া নীরব হইলেন। দেবু চুপ করিয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া যেমন বসিয়া ছিল—তেমনি বসিয়া রহিল। ন্যায়রত্ন আবার বলিলেনদেখ, বলবার অধিকার আমার আর সত্যিই নাই। শশীর কালেও যাদের দেখেছি, একালের মানুষ তাদের চেয়েও স্বতন্ত্র হয়ে পড়েছে। মানুষের নৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে গিয়েছে।
বিশ্বনাথ এবার বলিল—তাদের যে সত্যিই দেহের মেরুদণ্ড ভেঙে গিয়েছে দাদু, নৈতিক মেরুদণ্ড সোজা থাকবে কি করে! অভাব যে অনিয়ম; নিয়ম না থাকলে নীতি থাকবে কোন অবলম্বনে বলুন? চুরিতে লুটতরাজে যার সব যায়, সে বড়জোর নীতি মেনে চুরি না করতে পারে, কিন্তু ভিক্ষে না করে তার উপায় কি বলুনঃ ভিক্ষার সঙ্গে হীনতার বড় নিকট সম্বন্ধ, আর হীনতার সঙ্গে নীতির বিরোধকে চিরন্তন বলা চলে।
ন্যায়রত্ন হাসিলেন, বলিলেন—তাই-ই কালক্রমে সত্য হয়ে দাঁড়াল বটে। হয়ত মহাকালের তাই অভিপ্রায়। নইলে দীনতা—সে হোক না কেন নিষ্ঠুরতম দীনতা–তার মধ্যে। থেকেও হীনতার স্পর্শ বাঁচিয়ে চলার সাধনাই তো ছিল মহদ্ধর্ম। কৃচ্ছ্বসাধনায়, সর্বস্ব ত্যাগে ভগবানকে পাওয়া যা না-যাক পার্থিব দৈন্য এবং অভাবকে মালিন্যমুক্ত করে মনুষ্যত্ব একদিন জয়যুক্ত হয়েছিল।
বিশ্বনাথ বলিল—যে শিক্ষায় আপনার পূর্ববর্তীরা এটা সম্ভবপর করেছিলেন—সে শিক্ষা যে তারাই সর্বজনীন হতে দেয় নি দাদু। এ তারই প্রতিফল। মণি পেয়ে মণি ফেলে দেওয়া যায়, কিন্তু মণি যে পায় নি—সে মণি ফেলে দেবে কি করে? লোভই বা সংবরণ করবে কি করে?
ন্যায়রত্ন পৌত্রের মুখের দিকে চাহিলেন, বলিলেনকথা তুমি বেশ চিন্তা করে বলে থাক দাদু। অসংযত বা অর্থহীনভাবে কথা তো বল না তুমি!
বিশ্বনাথ দেখিল—পিতামহের দৃষ্টিকোণে প্রখরতা অতি ক্ষীণ আভায় চমকিয়া উঠিতেছে। দেবুও লক্ষ্য করিয়াছিল, সে শঙ্কিত হইয়া উঠিল; কিন্তু বিশ্বনাথের কোন কথায় ন্যায়রত্ন এমন হইয়া উঠিয়াছেন—অনুমান করিতে পারিল না।
বিশ্বনাথ হাসিয়া বলিল—আমার পূর্ববর্তী সম্মুখে বর্তমান; আমি এখন রঙ্গমঞ্চে নেপথ্যে অবস্থান করছি। সেইজন্যই বললাম—আপনার পূর্বগামী।
ন্যায়রত্বও হাসিলেন নিঃশব্দ বাঁকা হাসি; বলিলেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কর্ণের দিব্যাস্ত্রের সম্মুখে পার্থসারথি রথের ঘোড়া দুটোকে নতজানু করে রথীর মান বাঁচিয়েছিলেন। অর্জুনকে পেছন। ফিরতেও হয় নি, কর্ণের মহাস্ত্রও ব্যর্থ হয়েছিল। বাগযুদ্ধে তুমি কৌশলী বিশ্বনাথ।
বিশ্বনাথ এবার খানিকটা শঙ্কিত হইয়া উঠিল; ইহার পর ন্যায়রত্ন যাহা বলিবেন, সে হয়ত বজ্রের মত নিষ্ঠুর অথবা ইচ্ছামৃত্যুশীল শরশয্যাশায়ী ভীষ্মের অন্তিম মৃত্যু-ইচ্ছার মত সকরুণ মর্মান্তিক কিছু। ন্যায়রত্ব কিন্তু তেমন কোনো কিছুই বলিলেন না, ঘাড় নিচু করিয়া তবু আপনার ইষ্টদেবতাকে ডাকিলেন নারায়ণ! নারায়ণ!
পরমুহূর্তে তিনি সোজা হইয়া বসিলেন—যেন আপনার সুপ্ত শক্তিকে টানিয়া সোজা করিয়া জাগ্রত করিয়া তুলিলেন। তারপর দেবুর দিকে ফিরিয়া বলিলেন বিবেচনা করে দেখ পণ্ডিত। আমার উপদেশ নেবে অথবা তোমাদের এই নবীন ঠাকুরমশায়ের উপদেশ নেবে?
বিশ্বনাথও সোজা হইয়া বসিল, বলিল—আমি যে সমাজের ঠাকুরমশায় হব দাদু, সে সমাজে আপনার দেবু পণ্ডিত হবে আপনাদেরই মত পূর্বগামী। সে সমাজের পতনের সঙ্গে সঙ্গেই হয় দেবু কাশীবাস করবে অথবা আপনার মত দ্রষ্টা হয়ে বসে থাকবে।
ন্যায়রত্ন হাসিয়া বলিলেন—তা হলে আমার পাজি-পুঁথি এবং শাস্ত্রগ্রন্থ ফেলে দিয়ে ঘরদোর পরিষ্কার করে ফেলি, বল? আমার ঠাকুরের তা হলে মহাভাগ্য! পাকা নাটমন্দির হবে। তুমিই সেদিন বলেছিলে-যুগটা বণিকের এবং ধনিকের যুগ; কথাটা মহাসত্য। এ অঞ্চলের নব সমাজপতি—মুখুয্যেদের প্রতিষ্ঠা তার জ্বলন্ত প্ৰমাণ।
বিশ্বনাথ হাসিয়া বাধা দিয়া বলিল-আপনি রেখে গেছেন দাদু কথাগুলো আপনার যুক্তিহীন হয়ে যাচ্ছে; সেদিন আরও কথা বলেছিলাম সেগুলো আপনি ভুলে গেছেন।
ন্যায়রত্ন চমকিয়া উঠিয়া বলিলেন ভুলি নাই। তোমার সেই ধর্মহীন ইহলোকসর্বস্ব সাম্যবাদ।
–ধর্মহীন নয়। তবে আপনারা যাকে ধর্ম বলে মেনে এসেছেন সে ধর্ম নয়। সে আচারসর্বস্ব ধর্ম নয়, ন্যায়নিষ্ঠ সত্যময় জীবনধারা। আপনাদের বাহ্যানুষ্ঠান ও ধ্যানযোগের পরিবর্তে বিজ্ঞানযোগে পরম রহস্যের অনুসন্ধান করব আমরা। তাকে শ্রদ্ধা করব কিন্তু পূজা করব। না।
ন্যায়রত্ন গম্ভীরস্বরে ডাকিলেন–বিশ্বনাথ!
–দাদু!
–তা হলে আমার অন্তে তুমি আমার ভগবানকে অৰ্চনা করবে না।
বিশ্বনাথ বলিল–আগে আপনি দেবু পণ্ডিতের সঙ্গে কথা শেষ করুন।
ন্যায়রত্ন দেবুর দিকে ফিরিয়া চাহিলেন। দেবুর মুখ বিবর্ণ হইয়া গিয়াছে। তাহাকে উপলক্ষ করিয়া ন্যায়রত্নের জীবনে আবার এ কি আগুন জ্বলিয়া উঠিল? কুড়ি-বাইশ বৎসর পূর্বে নীতির বিতর্কে এক বিরোধবহ্নি জ্বলিয়া উঠিয়াছিল, তাহাতে সংসারটা ঝলসিয়া গিয়াছে; ন্যায়রত্নের একমাত্র পুত্র বিশ্বনাথের পিতা ক্ষোভে অভিমানে আত্মহত্যা করিয়াছে।
দেবুকে নীরব দেখিয়া ন্যায়রত্ন বলিলেন—পণ্ডিত।
দেবু বলিল—আমি আজ যাই ঠাকুর মশায়!
—যাবে? কেন?
–অন্যদিন আসব।
—আমার এবং বিশ্বনাথের কথা শুনে শঙ্কিত হয়েছ? ন্যায়রত্ব হাসিলেন। না না, ওর জন্যে তুমি চিন্তিত হয়ো না। বল, তুমি কি জানতে চাও! বল?
দেবু বলিল—আমি কি করব? শ্ৰীহরি পঞ্চায়েত ডেকে আমাকে পতিত করতে চায়। অন্যায় অপবাদ দিয়ে
–হ্যাঁ, এইবার মনে হয়েছে। ভাল, পঞ্চায়েত তোমাকে ডাকলে তুমি যাবে, সবিনয়ে বলবে আমি অন্যায় কিছু করি নি। তবু যদি শাস্তি দেন নেব; কিন্তু নিরাশ্রয়া বন্ধুপত্নীকে। পরিত্যাগ করতে পারব না। তাতে যা পারে পঞ্চায়েত করবে। ন্যায়ের জন্য দুঃখ-কষ্ট ভোগ করবে।
বিশ্বনাথ হাসিয়া উঠিল।
ন্যায়রত্ন প্ৰশ্ন করিলেন-হাসলে যে বিশ্বনাথ? তোমাদের ন্যায় অনুসারে কি মেয়েটাকে ত্যাগ করা উচিত?
–আমাদের উপর অবিচার করছেন আপনি। আমাদের ন্যায়কে আপনাদের ন্যায়ের উল্টো অর্থাৎ অন্যায় বলেই ধরে নিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে আপনি যা বলছেন—আমাদের ন্যায়ও তাই বলে। তবে আমি হাসলাম পঞ্চায়েত পতিত করবে এবং তাতে দুঃখ-কষ্টের কথা শুনে।
—তার মানে তুমি বলছ পঞ্চায়েত পতিত করবে না বা পতিত করলেও দুঃখ-কষ্ট নাই!
—পঞ্চায়েত পতিত করবেই। কারণ তার পিছনে রয়েছে ওদের সমাজের ধনী সমাজপতি শ্ৰীহরি ঘোষ এবং তার প্রচুর ধন ধান্য। তবে দুঃখ যতখানি অনুমান করেছেন ততখানি নাই।
ন্যায়রত্ব হাসিয়া বলিলেন—তুমি এখনও ছেলেমানুষ বিশ্বনাথ।
–বৃদ্ধত্বের দাবি করি না দাদু, তাতে আমার রুচিও নাই। তবে ভেবে দেখুন না পঞ্চায়েত কি করতে পারে? আপনি সে যুগের কথা ভেবে বলছেন। সে যুগে সমাজ পতিত করলে তার পুরোহিত, নাপিত, ধোপা, কামার, কুমোর বন্ধ হত। কর্মজীবন, ধৰ্মজীবন দুই-ই পঙ্গু হয়ে যেত। সমাজের বিধান লঙ্ঘন করে তাকে কেউ সাহায্য করলে তারও শাস্তি হত। গ্রামান্তর থেকেও কোনো সাহায্য পাওয়া যেত না। এখন ধোপা-নাপিত-কামার-পুরুতই সমাজের নিয়ম মেনে চলে না। পয়সা দিলেই ওগুলো এখন মিলবে। সে যুগে ধোপা-নাপিত সমাজের হুকুম অমান্য করলে রাজদ্বারে দণ্ডনীয় হত। এখন ঠিক উল্টো। ধোপা-নাপিত-চুততার-কামাররা যদি বলে যে তোমাদের কাজ আমি করব না—তা হলে আমরাই জব্দ হয়ে যাব। আর বেশি পেড়াপীড়ি করলে হয় তারা অন্যত্র উঠে যাবে, নতুবা জাত-ব্যবসা ছেড়ে দেবে। ভয় কি দেবু, জংশন থেকে ক্ষুর কিনে নিয়ে একখানা, আর কিছু সাবান। তা যদি না পার তো জংশন শহরেই বাসা নিও; তোমাকে দাড়িও রাখতে হবে না ময়লা কাপড়ও পরতে হবে না। জংশন পঞ্চায়েতের এলাকার বাইরে।
দেবু অবাক হইয়া বিশ্বনাথের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। ন্যায়রত্নও তাহার মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত চাহিয়া থাকিয়া শেষে হাসিলেন; বলিলেন—তুমি আর রঙ্গমঞ্চের নেপথ্যে নেই দাদু, তুমি আবির্ভূত হয়েছ। আমিই বরং প্রস্থান করতে ভুলে গিয়ে তন্দ্ৰাচ্ছন্ন হয়ে অযথা মঞ্চে অবস্থান করছি।
বিশ্বনাথ বলিল—অন্তত মহাগ্রামের মহামান্য সমাজপতি হিসেবে আপনার কাছে লোকে এলে তখন কথাটা অতি সত্য বলে মনে হয়। দেশে নতুন পঞ্চায়েত সৃষ্টি হল ইউনিয়ন-বোর্ড, ইউনিয়ন-কোর্ট, বেঞ্চ; তারা ট্যাক্স নিয়ে বিচার করছে, সাজা দিচ্ছে। তবু লোকে যখন সমাজপতির বংশ বলে আমাদের, তখন যাত্রার দলের রাজার কথা মনে পড়ে।
ন্যায়রত্ন বলিলেনওরে বিদুষক! না, যাত্রার দলের রাজা নই, সত্যকারের রাজ্যভ্রষ্ট রাজা আমি। আমার রাজ্যভ্রষ্টতা সম্বন্ধে আমি সচেতন। এখানে রয়েছি ভ্ৰষ্ট রাজ্যের মমতায় নয়, সে আর ফিরবে না সে কথাও জানি। তবু রয়েছি, আমার কাছে যে গচ্ছিত আছে গুপ্তসম্পদ। কুলমন্ত্ৰ, কুলপরিচয়, কুলকীর্তির প্রাচীন ইতিহাস। তোরা যদি নি হাসি মুখে মরব। না নিস্, তাও দুঃখ করব না। সব তাকে সমর্পণ করে চলে যাব।
ঠিক এই সময়েই ভিতর-বাড়ির দরজার মুখে আসিয়া দাঁড়াইল জয়া। সে বলিল দাদু, একবার এসে দেখেশুনে নিন, তখন যদি কোনোটা না পাওয়া যায়, তবে কি হবে বলুন তো? তা ছাড়া, আপনার-আমার না হয় উপোস, কিন্তু অন্য সবার খাওয়াদাওয়া আছে তো! টোলের। ছোট ছাত্রটি এরই মধ্যে ছুতোনাতা করে দু-তিনবার রান্নাঘর ঘুরে গেল। মুখখানা বেচারার শুকিয়ে গেছে।
–চল যাই।
–কি এত কথা হচ্ছে আপনাদের?
–শিবকালীপুরের পণ্ডিত এসেছেন, তারই সঙ্গে কথা বলছিলাম।
ন্যায়রত্নের আড়ালে তাহার পায়ের তলায় দেবু বসিয়া ছিল; জয়া তাহাকে দেখতে পায় নাই। দাদাশ্বশুরের কথায় দেবুর অস্তিত্ব সম্বন্ধে সচেতন হইয়া জয়া মাথার কাপড়টা অল্প টানিয়া বাড়াইয়া দিল। তারপর বলিলপণ্ডিতকে বলুন, এইখানেই দুটি প্রসাদ পেয়ে যাবেন। বেলা অনেক হয়েছে।
দেবু মৃদুকণ্ঠে বলিল-আমার আজ পূর্ণিমার উপবাস।
—বেশ, তবে এখন বিশ্রাম কর। ও বেলায় রাত্রে ঝুলন দেখে ঠাকুরের প্রসাদ পাবে। রাত্রে বরং এইখানেই থাকবে।
দেবুর মন অস্বস্তিতে ভরিয়া উঠিয়াছিল। পিতামহ-পৌত্রের কথার জটিলতার মধ্যে সে হাঁপাইয়া উঠিয়াছে; তা ছাড়া বাড়িতে কাজও আছে, রাখাল কৃষণেরা তাহার জন্য অপেক্ষা করিয়া থাকিবে। সে হাতজোড় করিয়া বলিল—আমি ওবেলায় আবার আসব। রাখালটার ঘরে খাবার নাই; কৃষাণদেরও তাই। ধান দিই-দিই করে দেওয়া হয় নাই। আজ আবার পূর্ণিমা, ধার-ধোরও পাবে না বেচারারা। বলেছি খাবার মত চাল দোব। তারা আমার পথ চেয়ে বসে থাকবে।
পথে নামিয়া দেবু বিভ্রান্ত হইয়া গেল। আপনার কথা ভাবিয়া নয়, ন্যায়রত্নের এবং বিশ্বনাথের কথা ভাবিয়া। বারবার সে আপনাকে ধিক্কার দিল, কেন সে আবেগের বশবর্তী হইয়া ঠাকুর মহাশয়ের কাছে ছুটিয়া আসিয়াছিল? তাহার ইচ্ছা হইল সে এই পথে-পথেই দেশ ছাড়িয়া চলিয়া যায়। এমন সোনার সংসার ঠাকুর মশায়ের, বিশ্বনাথের মত পৌত্র, জয়ার মত পৌত্রবধু, অজয়-মণির মত প্রপৌত্র, কত সুখ সব হয়ত অশান্তির আগুনে পুড়িয়া ছাই হইয়া। যাইবে। নতুবা ঠাকুর মহাশয় হয়ত ঘর-দুয়ার ছাড়িয়া কাশী চলিয়া যাইবেন, অথবা বিশ্বনাথ স্ত্রী-পুত্রকে লইয়া বাড়ি ছাড়িয়া চলিয়া যাইবে। কিংবা হয়ত একাই সে ঘর ছাড়িবে। সঠিক না জানিলেও সে তো আভাসে-ইঙ্গিতে বুঝিয়াছে বিশু-ভাই কোন পথে ছুটিয়াছে। তাহার পরিণাম যে কি, তাহাও অনুমান করা কঠিন নয়। এই দ্বন্দ্বের আঘাতে বিশু-ভাই আরও সেই পথে ছুটিবে দ্বিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্যের মত। তারপর হয়ত আন্দামান নয়ত কারাবাস! আহা, এমন সোনার প্রতিমার মত স্ত্ৰী-এমন চাঁদের মত ছেলে …!
—ওই! পণ্ডিত মশায় যে গো! এই ভর্তি দুপুরে ই-দিক পানে—কোথায় যাবেন গো?
দেবু সচকিত হইয়া লোকটির দিকে চাহিয়া দেখিল, বক্তা দেখুড়িয়ার রাম ভল্লা। দেবু হাসিয়া বলিলরামচরণ?
–আজ্ঞে হ্যাঁ। এত বেলায় যাবেন কোথা গো?
–গিয়েছিলাম মহাগ্রামে ঠাকুর মশায়ের বাড়ি। বাড়ি ফিরছি।
–তা ই-ধার পানে কোথা যাবেন?
দেবু এবার ভাল করিয়া চারিদিকে চাহিয়া দেখিল। তাই তো! অন্যমনস্কভাবে সে ভুল পথেই আসিয়া পড়িয়াছে। সম্মুখেই ময়ূরাক্ষীর বন্যারোধী বাঁধ। মাঠে বা দিকের পথে না ঘুরিয়া সে বরাবর সোজা চলিয়া আসিয়াছে। বাঁধের ওপরেই শোন। শিবকালীপুর, মহাগ্রাম এবং দেখুড়িয়া-তিনখানা গ্রামের শবদাহ হয় এখানে। তাহার বিলু, তাহার খোকা—বিশ্বনাথের জয়া, অজয়-মণির চেয়ে তাহারা দেখিতে বেশি খারাপ ছিল না, গুণেও খাটো ছিল না—বিলু-খোকা তাহার ওই শ্মশানে মিশিয়া আছে। কোনো চিহ্ন আর নাই, ছাইগুলাও কবে ধুইয়া গিয়াছে, তবু স্থানটা আছে। সে ওইখানে একবার বসিবে। অনেক দিন সে তাহাদের জন্য কাঁদে নাই। পাঁচখানা গ্রামের হাজারো লোকের কাজের বোঝা ঘাড়ে লইয়া মাতিয়া ছিল। মানসম্মানের প্রলোভনে–হ্যাঁ, মান-সম্মানের প্রলোভনেই বৈকি! সে সব ভুলিয়া-মস্ত বড় কাজ করিতেছি ভাবিয়া প্ৰমত্ত মানুষের মত ফিরিতেছিল। আজ সম্মান প্রতিষ্ঠার বদলে লোকে সর্বাঙ্গে অপমান কলঙ্কের কালি লেপিয়া দিতে উদ্যত হইয়াছে। তাই আজ বিলু-খোকাই তাহাকে পথ ভুলাইয়া আনিয়াছে। তাহার চোখের উপর বিলু ও খোকার মূর্তি জ্বলজ্বল করিয়া ভাসিয়া উঠিল।
রাম আবার জিজ্ঞাসা করিল-কোথায় যাবেন আজ্ঞা?—দিবা-দ্বিপ্রহরে পণ্ডিত মানুষ গ্রামের পথ ভুল করিয়াছে, এ কথা সে ভাবিতেই পারিল না।
দেবু বলিল—একটু শ্মশানের দিকে যাব।
–শ্মশানে?
–হ্যাঁ। দরকার আছে।
রাম অবাক হইয়া গেল।
দেবু বলিল–তুমি আমার একটু কাজ করবে?
–বলুন আজ্ঞা?
পকেট হইতে দড়িতে বাধ্য কয়েকটা চাবি বাহির করিয়া বলিল—এই চাবি নিয়ে তুমিতাই তো, কাকে দেবে ও? ক্ষণিক চিন্তা করিয়া লইয়া বলিল চাবিটা তুমি কামার-বউ—অনিরুদ্ধ কামারের বউকে দিয়ে বলবে যে, ভাড়ার থেকে আট সের চাল নিয়ে আমার রাখাল ছোঁড়াকে দুসের আর কৃষাণ দুজনকে তিন সের করে ছসের দিয়ে দেয় যেন। আমার ফিরতে দেরি হবে। এখনি যেতে হবে না, চাষের কাজ শেষ করে যেয়ো।
রাম বলিল-আজকের কাজ হয়ে গিয়েছে। আজ পুনিমে, হাল বন্ধ, আগাম্ পোঁতাজমিগুলোতে নিড়েন দিচ্ছিলাম। তা যে রোদ, আর পারলাম না। আমি এখুনি না হয় যাচ্ছি। কিন্তু আপনি শ্মশানে গে কি করবেন গো?
—একটু কাজ আছে। দেবু বধের দিকে অগ্রসর হইল।
রাম তবু সন্তুষ্ট হইল না। দেবুর গতিবিধি তাহার কাছে বড় রহস্যময় বলিয়া মনে হইল। দেবুকে লইয়া যে সমস্ত কথা উঠিয়াছে সে সবই জানে। পদ্ম-সংক্রান্ত কথাও জানে, রহম ও কঙ্কণার বাবুদের মধ্যে বিবাদ-প্রসঙ্গে যে কথা উঠিয়াছে তাহাও জানে। পদ্মের কথা সে অপরাধের মধ্যে গণ্য করে না। বিপত্নীক জোয়ান লেখাপড়া-জানা ভাল ছেলে, তার যদি ওই স্বামী-পরিত্যক্তা মেয়েটিকে ভালই লাগিয়া থাকে—সে যদি ভালই বাসিয়া থাকে তাহাকে, তাহাতে দোষ কোথায়? কঙ্কণার বাবুদের দেওয়া অপবাদ সে বিশ্বাস করে না। এ সম্বন্ধে তিনকড়ি হলফ করিয়া বলিয়াছে। তিনকড়ি অবশ্য পদ্মের কথাও বিশ্বাস করে না।
তাই সমস্ত জানিয়া-শুনিয়াও দেবুকে আরও খানিকটা আটকাইয়া কথাপ্রসঙ্গে ভিতরের কথাটা জানিবার জন্যই বলিল—কুসুমপুরের মিটিঙে যান নাই আপনি?
–কুসুমপুরের মিটিং! কিসের মিটিং?
—মস্ত মিটিং আজ কুসুমপুরে গো। তিনু-দাদা গিয়েছে। বাবুদের সঙ্গে রহমের হাঙ্গামার কথা—ধর্মঘটের কথা–
মৃদু হাসিয়া দেবু বলিল-আমি আর ওসবের মধ্যে নাই, রাম-ভাই।
রাম চুপ করিয়া রহিল, তারপর বলিল—শ্মশানে কি করবেন আপনি? এই দুপুর বেলা খান্ নাই দান্ নাই। চলুন, ঘর চলুন।
ঠিক এই সময়েই একটা হাঁক ভাসিয়া আসিল। চাষীর হাক, চড়া গলায় লম্বা টানা ডাক। রাম ঘুরিয়া দাঁড়াইল। ডাকটার শেষ অ-আ ধ্বনিটা স্পষ্ট। রাম কানের পিছনে হাতের আড়াল দিয়া শুনিয়া বলিল—তিনু-দাদা আমাকেই ডাকছে। সঙ্গে সঙ্গে সে মুখের দুই পাশে হাতের তালুর আড়াল দিয়া সাড়া দিল—এ-এঃ!
তিনু হনহন করিয়া আগাইয়া আসিতেছে। দেবুও যাইতে যাইতে থমকিয়া দাঁড়াইল। ব্যাপারটা কি।
তিনু অত্যন্ত উত্তেজিত। কাছে আসিয়া এমন জায়গায় রামের সঙ্গে দেবুকে দেখিয়া সে কোনো বিস্ময় প্রকাশ করিল না। বিস্ময়-প্রকাশের মত মনের অবস্থাই নয় তাহার। সে বলিল–ভালই হয়েছে, দেবু বাবাও রয়েছে। তোমার বাড়ি হয়েই আসছি আমি। পেলাম না তোমাকে। কুসুমপুরের শেখেরা বড় গোল পাকিয়ে তুললে বাবা। রামা, তোরা সব লাঠি-সড়কি বার কর।
দেবু সবিস্ময়ে বলিল—কেন? আবার কি হল?
—আর বোলো না বাবা। আজ মিটিং ডেকেছিল। তোমাকে বাদ দিয়ে ডেকেছিল—আমি যেতাম না, কিন্তু ভাবলাম—যাই, কড়া-কড়া কটা কথা শুনিয়ে দিয়ে আসি। গিয়ে দেখি সে মহা হাঙ্গামা! শুনলাম কঙ্কণার বাবুরা নাকি বলেছে, কুসুমপুর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দেবে; আগে কুসুমপুর ছিল হিদুর গাঁ—আবার হিন্দু বসাবে বাবুরা। এইসব শুনে শেখেরা ক্ষেপে উঠেছে, তারা বলছে—আমাদের গা ছারখার করলে আমরাও হিদুর গা ছারখার করে দেব
–বলেন কি? তারপর?
—তারপর সে অনেক কথা। তা আমার বাড়িতে এস কেনে, সব বলব। তেষ্টায় বুক আমার শুকিয়ে গিয়েছে।
কথাটা বলিতে বলিতে সে অগ্রসর হইল। সঙ্গে সঙ্গে দেবু এবং রামও আগাইয়া চলিল।
তিনকড়ি বলিল-গাঁয়ের জগন-টগন সব ধর্মঘটের মাতব্বরেরা মিটিঙে গিয়েছিল। যায় নাই কেবল পঞ্চায়েতের মোড়লরা। শুনেছ তো তোমাকে পতিত করা নিয়ে ছিরে বেটার সঙ্গে খুব এখন পীরিত। ছিরে ধান দেবে কিনা!
—শুনেছি। কিন্তু কুসুমপুরে কি হল?
—আমরা বললাম বাবুরা তোমাদের ঘর জ্বালিয়ে দেয়, তোমরা বাবুদের সঙ্গে বোঝ, অন্য হিদুরা তার কি করবে? তারা বললে বাবুরা বলেছে হিন্দু বসাবে, তখন সব হিদুই একজোট হবে।-আসবার সময় আবার শুনলাম। … সুন্ন মা রে!
তিনকড়ির বাড়ির দরজায় তাহারা আসিয়া পড়িয়ছিল।
দেবু প্রশ্ন করিল—আর কি শুনলেন?
—বলি। দাঁড়াও বাবা, আগে জল খাই এক ঘটি।
দরজা খুলিয়া বাহির হইয়া আসিল স্বর্ণ, তিনকড়ির বিধবা মেয়েটি। সুন্দর স্বাস্থ্যবতী মেয়ে, চমৎকার মুখশ্ৰী, গৌরবর্ণ দেহ। পনের-ষোল বছরের মেয়েটিকে দেখিয়া কে বলিবে সে বিধবা। কিশোরী কুমারীর মত স্বপ্নবিতোর দৃষ্টি তাহার চোখে; মুখের কোথাও কোনো একটি রেখার মধ্যে এতটুকু বেদনা বা উদাসীনতা লুকাইয়া নাই। সে বাহির হইয়া আসিল—তাহার হাতে একখানি বই। দেবুকে দেখিয়া লজ্জিতভাবে চকিতে সে বইখানি পিছনের দিকে লুকাইল।
জটিল চিন্তা এবং উৎকণ্ঠা সত্ত্বেও দেবু হাসিয়া বলিলবই লুকোচ্ছ কেন? কি বই পড়ছিলে?
তিনকড়ি ঘরের ভিতর যাইতে যাইতে বলিলমা সুন্ন, দেবু-বাবাকে একটুকু শরবত করে দে তো।
–না, না। আমার আজ পূর্ণিমার উপবাস। একবার শরবত আমি খেয়েছি।
–তবে একটুকু হওয়া কর। যে গরম! গগ করে ঘামছে।
স্বর্ণ তাড়াতাড়ি একখানা পাখা লইয়া আসিল। দেবু বলিল-পাখাটা আমাকে দাও।
–না, আমি হাওয়া করছি।
–না, না। দাও, আমাকে দাও। তুমি বরং বইখানা নিয়ে এস। কি পড়ছিলে দেখি? যাও নিয়ে এস।
কুণ্ঠিতভাবেই স্বর্ণ বইখানা আনিয়া দেবুর হাতে দিল।
বইখানি একখানি স্কুলপাঠ্য সাহিত্য-সঞ্চয়ন। বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত লেখক লেখিকাদের ছাত্রোপযোগী লেখা চয়ন করিয়া সাজানো হইয়াছে। প্রবন্ধ, গল্প, জীবনী, কবিতা।
দেবু বলিল—কোটা পড়ছিলে বল?
স্বর্ণ নতমুখে বলিল–ও একটা পদ্য পড়ছিলাম।
দেবু হাসিয়া বলিল-পদ্য বলে না, কবিতা বলতে হয়। কোন্ কবিতা পড়ছিলে?
স্বর্ণ একটু চুপ করিয়া রহিল। তারপর বলিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা কবিতা।
দেবু বইখানার কবিতার দিকটা খুলিতেই একটা কবিতা যেন আপনিই বাহির হইয়া পড়িল; অনেকক্ষণ ধরিয়া একটা পাতা খোলা থাকিলে বই খুলিতে গেলে আপনাআপনিই সেই পাতাটি প্রকাশিত হইয়া পড়ে। দেবু দেখিল কবিতাটির শেষে লেখকের নাম লেখা রহিয়াছে শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবিতাটির নামের দিকে চাহিয়া দেখিল—স্বামীলাভ। তাহার নিচে ব্রাকেটের ভিতর ছোট অক্ষরে লেখা ভক্তমাল। সে প্রশ্ন করিল—এইটে পড়ছিলে বুঝি?
স্বৰ্ণ ঘাড় নাড়িয়া জানাইল–হ্যাঁ, ওইটাই সে পড়িতেছিল।
দেবু স্নিগ্ধস্বরে বলিল-পড় তো, আমি শুনি। বইখানা সে তাহার দিকে আগাইয়া দিল।
রাম ভল্লা বলিল—সুন্ন মা যা সুন্দর রামায়ণ পড়ে পণ্ডিত মশায়! আহা-হ্যাঁ, পরান জুড়িয়ে যায়।
দেবু হাসিয়া বলিল—পড় পড়, শুনি।
স্বর্ণ মৃদুস্বরে বলিলবাবাকে খেতে দিতে হবে, আমি যাই। বলিয়া সে ঘরের মধ্যে চলিয়া গেল লজ্জিতা মেয়েটির দিকে চাহিয়া দেবু সস্নেহে হাসিল। তারপর সে কবিতাটি পড়িল–
একদা তুলসীদাস জাহ্নবীর তীরে নির্জন শ্মশানে
… … …
হেরিলেন, মৃত পতি-চরণের তলে বসিয়াছে সতী,
তারি সনে একসাথে এক চিনলে মরিবারে মতি।
… … …
তুলসী কহিল, মাত যাবে কোন্খানে এত আয়োজন?
… … …
কহে কড়জোড় করি, স্বামী যদি পাই স্বৰ্গ দূরে যাক।
তুলসী কহিল হাসি, ফিরে চল ঘরে কহিতেছি আমি,
ফিরে পাবে আজ হতে মাসেকের পরে আপনার স্বামী!
রমণী আশার বশে গৃহে ফিরে যায় শ্মশান তেয়াগি;
তুলসী জাহ্নবীতীরে নিস্তব্ধ নিশায় রহিলেন জাগি।
… … …
এক মাস পরে প্রতিবেশীরা আসিয়া তাহাকে প্রশ্ন করিল-তুলসীর মন্ত্রে কি ফল হইয়াছে? মেয়েটি হাসিয়া বলিলপাইয়াছে, সে তার স্বামীকে পাইয়াছে।
শুনি ব্যগ্ৰ কহে তারা, কহ তবে কহ, আছে কোন্ ঘরে?
নারী কহে, রয়েছেন প্রভু অহরহ আমারি অন্তরে।
কবিতাটি শেষ করিয়া দেবু স্তব্ধ নির্বাক হইয়া বসিয়া রহিল। স্বর্ণকে দেখিয়া যে কথা তাহার মনে হয় নাই, সেই কথা তাহার মনে পড়িয়া গেল, স্বর্ণ বিধবা, সাত বৎসর বয়সে সে বিধবা হইয়াছে। নীরবে নতমুখে সে চলিয়া গেল, তখন তাহার ওই নতমুখের ভঙ্গির মধ্যে শান্ত পদক্ষেপের মধ্যে যাহা সে উপলব্ধি করিতে পারে নাই, তাই সে এখন স্পষ্ট অনুভব করিল। তাহার গোপন-পোষিত সুগভীর বিরহ-বেদনা। সে একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল। তুলসীদাসের মন্ত্রের মত কোনো মন্ত্র যদি তাহার জানা থাকিত, তবে স্বর্ণকে সেই মন্ত্র সে দিত। তিনকড়ি-কাকা আক্ষেপ করিয়া বলে—স্বৰ্ণ আমার প্রতিমাসে কথা মিথ্যা নয়। চোখ তাহার জলে ভরিয়া উঠিল।
তিনকড়ি এই মুহূর্তে ঘরে প্রবেশ করিল; বাহির হইতেই সে কথা আরম্ভ করিয়াছিল—এই পাটি, বুঝলে বাবাজী, বেশি করে লাগালে তোমার গে দৌলত শেখ। দৌলত গিয়েছিল মুখুয্যেবাবুদের বাড়ি, বাবুরা নাকি তাকেই কথাটা বলেছে।…