১২. শীতের সোনালি রোদে

শীতের সোনালি রোদে গা এলিয়ে কাটানো হচ্ছে একটা অলস দুপুর। কেউ শুয়ে আছে ঘাসের ওপর, কেউ বসে আছে পড়ে থাকা গাছের গুঁড়িতে।

একপাশে কয়েকজন বেঁটে বাঁটকুল গনাই শেখকে ধরে শুনছে লালনের কয়েকটি গান। লালনও উৎফুল্লভাবে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। মজার কথা এই, লালন নিজেই তার ভুলে-যাওয়া গান নতুন করে শিখে নেয় গনাইয়ের কণ্ঠে শুনে। এখন কোথাও গেলে কেউ কেউ লালনের কাছে গান শুনতে চায়। লালন তো যখন তখন গান সৃষ্টি করতে পারে না। বুক ঠেলে যখন নিজে নিজে আসার, তখন আসে। সেইজন্যই দু-চারখানা গান শিখে রাখা দরকার।

এমনও হয়, গনাইয়ের গাওয়া কোনও গান শুনে লালন সবিস্ময়ে বলে ওঠে, এই গান আমি গাইছি নাকি?

অন্য সবাই হো হো করে হেসে ওঠে।

যে নিজে গান বানিয়েছে, তার মনে নেই। কিন্তু শ্রোতাদের মনে আছে।

এখন লালন কোনও এক ভ্রাম্যমাণ বাউলের কাছ থেকে গুপিযন্ত্র বাজাতে শিখে নিয়েছে। এখন সে প্রায়ই পিড়িং পিড়িং করে বেশ মজা পায়। গানের সঙ্গেও বাজাতে পারে।

লালন বাইরের কোনও জায়গা থেকে ঘুরে এলে এখানকার বাসিন্দারা সেই অভিজ্ঞতার কথা শুনতে চায়। এদের মধ্যে অনেকেই কাছাকাছি দু চার খানা গ্রামের বাইরে অন্য কোথাও যায়নি। এদের বাপ-ঠাকুরদাও একটা ক্ষুদ্ৰগণ্ডির মধ্যেই জীবন কাটিয়ে গেছে।

এবারে পাবনায় গিয়ে লালনের অনেক গভীর অভিজ্ঞতা হয়েছে। সিরাজ সাঁইয়ের চরণ ধরে সে তিন দিন পড়ে ছিল। আসতে ইচ্ছেই করছিল না। লালনের এমনই হয়। বাইরে কোথাও গিয়ে খুব ভালো লেগে গেলে সেখানেই আরও থেকে যেতে ইচ্ছে করে, আবার জঙ্গলের মধ্যে তার কুটির, এখানকার মানুষজনও তার মন টানে।

কত তত্ত্ব, ইসলামি শাস্ত্র, এমনকী হিন্দুশাস্ত্র সম্পর্কেও সিরাজের অগাধ জ্ঞান, কিন্তু তিনি মুখে বড় বড় কথা বলেন না, হাসি-মশকরা, গল্প-কাহিনি, গান এই সবের মধ্যেই সেই সব ফুটে বেরোয়।

এবারে লালনের বেশি লাভ হয়েছে, সে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছে।

হিন্দু ও মুসলমান কত শত বছর ধরে পাশাপাশি বাস করছে এ-দেশে, অথচ তারা পরস্পরের ধর্ম ও সামাজিক নীতি সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানে না। এই অজ্ঞতা থেকেই তো বিদ্বেষ ও সংঘর্ষ হয়।

যেমন হিন্দুদের মূর্তিপূজক ভেবে মুসলমানরা কেমন যেন অবজ্ঞা করে। কিন্তু এই মূর্তিগুলো তো সব বিভিন্ন রূপ ও গুণের প্রতীক। প্রতিমা কথাটার মানেই যে তাই, তা লালনও সদ্য জেনেছে। হিন্দু ধর্মের যে পরমেশ্বর কিংবা পরম ব্রহ্ম তার তো কোনও মূর্তি কিংবা রূপ নেই। ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরও সেই পরম ব্রহ্মেরই বন্দনা করেন। আবার ইসলাম ধর্মে যে বিশ্বভ্রাতৃত্বের উদার আহ্বান, তা হিন্দুরা বোঝে না। ইসলাম সব মানুষকে সমান করে, আর হিন্দুরা নিজেদের মধ্যেই নানান জাতিভেদ করে নানান ছুতোয় অনেক মানুষকে বিতাড়িত করে দেয়।

তবু মুসলমানেরা হিন্দুদের সম্পর্কে যতটুকু জানে, হিন্দুরা মুসলমানদের সম্পর্কে জানে তারও অনেক কম। জানতেও চায় না। অন্যদের দূরে সরিয়ে রাখাই যে তাদের ভ্রান্ত নীতি।

এখানে সঙ্গীসাথীদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে লালন বুঝেছে, এখানকার মুসলমানরাও নিজেদের ধর্ম সম্পর্কে জানে খুব কম। আসলে দু-এক পুরুষ আগে হিন্দু সমাজে অত্যাচারিত হয়ে এদের বাপ-দাদারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। তাতে অনেকেরই দারিদ্র ঘোচেনি, শিক্ষার সুযোগ পায়নি, শুধুমাত্র বেঁচে থাকার লড়াইতেই এত ব্যস্ত যে, নতুন ধর্মের মূলতত্ত্ব বোঝারও অবকাশ হয়নি, শুধু মৌলবিরা মাথার মধ্যে কিছু সংস্কার ঢুকিয়ে দিয়েছে। আর একটা কথাও সত্যি যে, ইসলামে সব মানুষ সমান বলা হলেও তার চাক্ষুষ প্রমাণ পাওয়া যায় না সবসময়। ধনী আর অতি দরিদ্র মুসলমান তো পাশাপাশি খেতে বসে না কখনও। শিয়া আর সুন্নিদের তফাত নিয়ে মারামারিও হয়। হিন্দু জমিদার যেমন হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে চাষিদের ওপর অত্যাচার করে, তেমনই মুসলমান জমিদারও তো অসহায় মুসলমান চাষিদের রেয়াত করে না।

লালনের আফশোস হয়, যদি সে কিছুটা লেখাপড়াও জানত, তা হলে সে রামায়ণ-মহাভারত আর কোরান-হাদিস নিজে পাঠ করে বুঝে নিতে পারত। কিন্তু বাল্যকালে কেউ তার হাতে একটা খাগের কলমও ধরিয়ে দেয়নি। কী আর করা যাবে, এখন জ্ঞানী মানুষদের কাছ থেকে শুনে শুনে যতটুকু শেখা যায়।

পাবনার গল্প করতে করতে কালুয়ার কথা এসে পড়ে। শিমুল গাছতলার এই যে নতুন গ্রাম দিন দিন বেড়ে উঠছে, কালুয়াই তার প্রথম স্থপতি। লালন তাকে পরম সুহৃদ হিসেবে পেয়েছিল। এবারে কালুয়ার দেখা পেয়ে সে তাকে। এখানে একবার ফিরিয়ে আনার খুব চেষ্টা করেছিল। কালুয়া তাকে মেরেছে ধরেছে, তবু সব সহ্য করেও কাকুতি-মিনতি করেছে লালন। কালুয়ার এখন চরম উন্মাদনার দশা।

কালুয়ার কথা বলতে বলতে লালন আড়চোখে কমলির দিকে তাকায়। কালুয়া কেন ফিরতে চায় না, তা আর কেউ না বুঝুক, কমলি অবশ্যই বোঝে।

কমলির দিক থেকে কোনওই সাড়া পাওয়া যায় না। নিরেট মুখ করে সে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে।

মদিনা শহরে এক স্বামী-বিরহিনী যুবতির গান শুনে হজরত রা-এর মন গলে যাওয়ার কাহিনিটি শুনে সকলেই বাহবা দিয়ে ওঠে।

একজন বলল, আহা-হা। বিরহের গান শুনে মন গলে না এমন পাথরও কি কেউ আছে?

লালন গুপিযন্ত্রটা বাজাতে বাজাতে বলল, এক হিসাবে সব মানুষের গানই তো বিরহের গান।

মনসুর বলল, এডা তুমি কী কইলা লালন? সবই বিরহের প্যানপ্যানাইয়া গান? আরও কত গান আছে। মারফতি গান। বাউল-ফকিররা যে নবি আর রসুলের নামে গান করে, তাও কি?

লালন বলল, ভালো কইরা ভাইব্যা দেখো। আল্লা রসুলই বলো কিংবা হিন্দুগো যে ঠাকুর-দেবতার গান। সবই তো জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার মিলন আকাঙ্ক্ষা। যতদিন মিলন না-হয়, তারেই তো বিরহ কয়।

মনসুর বলল, আর একটু বুঝাইয়া কও!

লালন আর কিছু বলার আগেই দূর থেকে একজন চেঁচিয়ে জানাল, লালন, একটা খুব মন্দ সংবাদ আছে।

লালন বলল, কাছে আইস্যা কও!

লোকটির নাম মিজান। সে বাইরের গ্রামে কোনও কাজে গিয়েছিল। দৌড়ে দৌড়ে আসছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, খাড়াও, আসি।

সে একটা গাছের আড়ালে হিসি করতে বসে গেল, অন্যদের উৎকণ্ঠায় রেখে।

একটু বাদে মিজান বলল, জমিদারের অত্যাচার শুরু হইছে। আমি শুইন্যা আসলাম, হরিনাথ মজুমদারের বাড়িতে লেঠেল পাঠাইছে ঠাকুরবাবুরা। এতক্ষণে মনে হয়, সব শ্যাষ!

লালন উদবিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল, সব শ্যাষ মানে? তুমি নিজের চক্ষে কী দ্যাখছো আর কী শুনছ, তাই কও।

মিজান বলল, আমি দেখি নাই কিছু। হাটে শুনছি। জমিদারের লেঠেল। বাহিনী আইস্যা হরিনাথের বাড়ি ঘেরছে। হরিনাথরে ধইরা নিয়া যাবে, তার বাড়িতে আগুন দিবে।

শীতল বলল, ক্যান, ক্যান? হরিনাথের তো জমি-জিরেত কিছু নাই। জমিদার তারে ধরবে ক্যান?

মিজান বলল, তা আমি ক্যামনে জানমু? হাটের মানুষজন খুব চিল্লাচিল্লি করছে, কিন্তু ওই বাড়ির কাছে যাইবার সাহস কাউর নাই।

লালন জিজ্ঞেস করল, বাড়িতে আগুন ধরাইছে? হরিনাথরে নিয়া গেছে?

মিজান বলল, অতদূর শুনি নাই। হরিনাথ নাকি বাড়িতে নাই, কোন গেরামে গেছে, ফিরা আসলেই ধরবে। তয় এতক্ষণে বাড়িতে আগুন লাগাইছে বোধহয়।

লালন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তাইলে তো আমাগো যাইতে হয়। আমরা হরিনাথের পাশে দাঁড়াব।

মনসুর বলল, জমিদার পাইক-বরকন্দাজ পাঠাইছে… আমরা গিয়া কী করতে পারব?

লালন বলল, বন্ধুর বিপদের সময় আমরা তার পাশে যাব না?

মনসুর বলল, সে কথা ঠিক। কিন্তু জমিদারের শক্তির সঙ্গে পাল্লা দেওয়া।

লালন বলল, আমরাও তো লাঠি খেলা শিখছি। আমরা যথাসাধ্য আটকাব। আর যদি না-পারি তো পারব না। তবু যেতে হবেই। আর দেরি করা ঠিক হবে না।

শীতল বলল, মাথা ঠান্ডা কইরা একটু ভাবো লালন। আমরা এইখানে বাড়ি ঘর করছি, আমাগো কাউরই জমির পাট্টা নাই। জমিদার এতদিন তা নিয়ে মাথাও ঘামায় নাই। এখন আমরা যদি এইসব ব্যাপারে জড়াইয়া পড়ি, তাইলে আমাগো উপর জমিদারের নজর পড়বে। তারপর আমাগো কী হবে? এখন জমিদারের পাঁচ-ছয়জন লাঠিয়াল আসছে, এরপর যদি পঞ্চাশজন আসে?

লালন হেসে বলল, ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এখন আমি আমার বিবেককে ঘুম পাড়াতে রাজি না। পরে যা হয় হবে। আমি যাবই, তোমরা কে কে যেতে চাও সঙ্গে বললা। আর যদি কেউ না-চাও, তবু আমি…

মনসুর বলল, আরে না, না, সে কথা না। তুমি গ্যালে আমরা সবাই যাব। কী, ঠিক না?

এবার সকলে সমস্বরে বলল, নিশ্চয় যাব। সক্কলডি যাব।

শীতল বলল, আমি তো যাবই। লালন, আমরা মরতে ভয় পাই না। আমাগো এই গেরাম যদি জমিদার ভাঙতে আসে, আমি আগে প্রাণ দেব।

লালন বেছে নিল ছজনকে। তারপরে রণ-পা-এ রওনা দিল দ্রুত।

হরিনাথের গ্রামে এই দলটি পৌঁছে গেল সন্ধের একটু আগে।

মিজানের খবর মিথ্যে নয়। তবে হরিনাথের বাড়িতে এখনও আগুন লাগানো হয়নি। বাড়ি ঘিরে বসে আছে ছজন লাঠিয়াল। উঠোনে একটা টিনের চেয়ারে বসে তামাক টানছে একজন নায়েব-শ্রেণির মানুষ। ফরসা, টুকটুকে চেহারা, মাথায় একটাও চুল নেই কিন্তু গোঁফের বেশ বাহার আছে। মাথায় চুল নেই বটে, কিন্তু ভুরু দুটি বেশ মোটা।

লালনের দলটিকে দেখে সে ভুরু নাচিয়ে অবজ্ঞার সঙ্গে বলল, তোরা আবার কারা?

লালন বিনীতভাবে বলল, হুজুর, আমরা হরিনাথের বন্ধু।

নায়েব বলল, বটে! সে তোমাকে পাঠাইছে? সে নিজে লুকাইয়া আছে কোথায়?

লালন বলল, সে আমাদের পাঠায় নাই। সে কোথায় আছে, তাও আমরা জানি না।

নায়েব বলল, সে তোদর পাঠায়নি? তবে তোরা এখানে মাথা গলাতে এসেছিস কেন? যা যা, নিজের কাজে যা।

লালন বলল, হরিনাথের কি খাজনা বাকি পড়েছে? তার তো নিজের জমি নাই। আমরা যতটুকু জানি, তার যেটুক ছিল, তাও সে ইস্কুল গড়ার জন্য দিয়ে দিয়েছে। তবু তারে ধরতে এসেছেন কেন?

কেন এসেছি, সেজন্য কি তোকে কৈফিয়ত দিতে হবে নাকি? তুই কে?

কৈফিয়ত না হুজুর। বন্ধুর বিপদ হলে অন্য বন্ধুরা পাশে এসে দাঁড়ায় না? বন্ধু কোনও দোষ করেছে নাকি, তাও জানতে চায়। আপনার বন্ধুর বিপদে আপনি তার পাশে যান না?

আমার কোনও বন্ধু নাই। জমিদারের কাজে বন্ধু-টন্ধু থাকলে চলে না। শোন, এই হরিনাথের একটা ছাতা-মাথা কাগজ আছে। তাতে জ্ঞানের কথা কিছু থাকে না। শুধু চুটকি খবর লেখে। তাতে লিখেছে যে, ঠাকুর জমিদাররা নাকি প্রজাদের ওপর অত্যাচার করে, দুটো গ্রামের নাম দিয়ে লিখেছে, সেখানে প্রজাদের ঘরে আগুন দেওয়া হয়েছে, একজনকে মারতে মারতে হাত-পা ভেঙে দিয়েছে। সব মিথ্যা কথা। লোকটার এত বড় আস্পর্ধা!

হরিনাথের গ্রামবার্তা প্রকাশিক নামে পত্রিকার কথা লালন জানে। কিন্তু পড়তে তো পারে না। তাতে কী লেখা হয় সে জানে না। তবে বিনা কারণে হরিনাথ মিথ্যা কথা লিখবে, তাও বিশ্বাস হয় না। একবার হরিনাথ তাকে বলেছিল বটে, ঠাকুররা তাকে অপছন্দ করে।

নায়েব আবার বলল, ঠাকুর জমিদারদের সব লোক ধন্য ধন্য করে। অন্য জমিদারদের সঙ্গে তাঁদের তুলনাই হয় না। পূজ্যপাদ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের জমিদার। সারা দেশে তাঁর সুনাম। আর তাঁর নামেই বদনাম দেয়, এই লোকটা এমন নিমকহারাম। এবার ওকে উচিত শিক্ষা দিতে হবে।

লালন নানান জেলায় ঘুরে, বহু মানুষের সঙ্গে কথা বলে এথন অনেক বিষয়ে অভিজ্ঞ হয়েছে।

সে বলল, নায়েবমশাই, দেশে এখন ইংরেজ-রাজত্ব। আমরা সকলে মহারানি ইংলন্ডেশ্বরীর প্রজা। দেশে এখন আইন-আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শুনেছি, এমনকী অত্যাচারী সাহেবদের নামেও আদালতে নালিশ করা যায়। আগেকার দিনের মতন জমিদারের তো শাস্তি দেওয়ার অধিকার নাই। হরিনাথ যদি মিথ্যা কথা লিখে থাকে, তা হলে আদালতেই তার বিচার হতে পারে।

নায়েব ফুঁসে উঠে বলল, ওরে বাপ রে বাপ, এ যে দেখি ছোট মুখে। বড় কথা! ছোটলোকরাও এই ইংরাজ রাজত্বে মাথায় চড়ে বসতে চায়। তুই আমাকে আইন শেখাতে এসেছিস, এই কটা তালপাতার সেপাই নিয়ে? ভালো চাস তো এখনই দূর হয়ে যা, নইলে তোদের সবকটার লাশ ফেলে দেব এখানে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লালন বলল, আমরা তো পিছু হঠতে আসি নাই। আমরা সব যদি লাশ হয়ে যাই, হইতেও পারি, কিন্তু তার আগে আপনাদেরও কয়েকজনের নির্ঘাত মাথা ফাটবে। দু-একটা লাশও পড়তে পারে। কেন শুধু শুধু এই রক্তারক্তি? তা বন্ধ করা যায় না? আদালতেই হরিনাথের বিচার হউক না!

নায়েব বলল, রক্তারক্তি হয় হোক। হরিনাথকে না-নিয়ে যাব না।

তারপর সে হাঁক দিল, গুরমিত সিং।

এর মধ্যে জমিদারের লাঠিয়ালরা নায়েবের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। এদের সকলেরই ঘি-খাওয়া মোটাসোটা চেহারা। একজন আছে পঞ্জাব দেশীয়, মাথায় পাগড়ি, এক হাতে লোহার বালা, কোমরে একটা ছুরি গোঁজা, দশাসই শরীর, মুখ-ভরতি দাড়ি গোঁফ। তার হাতের লম্বা লাঠিটায় পিতলের আংটা লাগানো, পায়ে নাগরা।

সে ডাক শুনে সেলাম দিয়ে বলল, হুজৌর!

নায়েব হুকুম দিল, ই লোগোকে হঠা দেও!

জমিদারের লাঠিয়ালরা সবাই লাঠি আঁকড়ে ধরতেই লালন হাত তুলে বলল, দাঁড়াও, একটা কথা আছে। নায়েবমশাই, আমার একটা প্রস্তাব শুনবেন? শুনেছি, কোনও কোনও দেশে এই প্রথা আছে। সকলে মিলে মারামারি করে নিধন হওয়ার বদলে, দুই দলের একজন একজনের সঙ্গে লড়াই থোক। যে হারবে, তার দল বিদায় নেবে। ধরেন, আপনার দলের যে-কোনও এক জনের সাথে আমার দলের একজনের লড়াই হবে। আমার লোকটি যদি হারে, এমনকী মরেও যায়, তা হলে অন্যরা বিনাবাক্যে চলে যাবে। আপনারাও তাই মানবেন?

নায়েবের চক্ষু বিস্ময়ে প্রায় ছানাবড়া। সে বলল, তাই নাকি? এই প্রথা? বেশ কথা।

পঞ্জাবি লাঠিয়ালটির পিঠে হাত দিয়ে সে বলল, আমার দলের এর সঙ্গে তোমার দলের কে লড়বে?

বিন্দুমাত্র দ্বিধা না-করে লালন বলল, আমি।

জমিদারের লাঠিয়ালরা সকলে একসঙ্গে হেসে উঠল।

লালনও হেসে বলল, ওর তুলনায় আমি চুনোপুঁটি। যদি আমার প্রাণ যায়, বন্ধুর জন্য প্রাণ দিলে সোজা স্বর্গে চলে যাব, তাই না? আপনাকে কিন্তু কথা রাখতে হবে।

লালন লাঠি নিয়ে তৈরি হতেই শীতল তার সামনে এসে বলল, সাঁই, তুমি স্বর্গে যেতে চাও, আমাদের বুঝি স্বর্গে লোভ নাই? তোমারে মোটেই আগে যেতে দেব না। তোমার থিকা আমি দুই বছরের বড়। বড় ভাই থাকতে ছোট ভাই আগে যায় না।

লালন আরও কিছু বলতে গেলেও শীতল তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আর কোনও কথা না। আমিই আগে।

লালন বলল, বেশ!

তারপর নিচু গলায় বলল, শোন, শীতল, তুই যদি জিতে যাস, লোকটারে বাগে পেলেও একেবারে মেরে ফেলিস না। হার স্বীকার করাতে পারলেই হবে।

শীতল বলল, ঠিক আছে, তোমার কথা মতন, ওরে প্রাণে মারব না, আমি মরি তো মরব। তাই সই।

লালন বলল, তুই মরবি না। আমি তোর জন্য দোয়া করব।

শীতল বলল, সাঁই, অন্য এক জমিদার আমার বাড়ি পুড়ায়ে দিয়েছিল। পেয়াদারা আমার ভগিনীরে টেনে নিয়ে গিয়েছিল, ঋণ শোধ করতে পারি নাই তাই জমিদার জুতা মেরেছিল আমার দুই গালে। তখন রুখে দাঁড়াতে পারি নাই, পালায়ে এসেছি গ্রাম ছেড়ে। আজ এক জমিদারের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে প্রাণ দিলে আমি ধন্য হব। পূর্বপুরুষ আশীর্বাদ করবে।

লালন আবার বলল, তুই মরবি না, শীতল। আমার আয়ুর ভাগ তোরে। দিলাম।

বাড়ির সামনের চাতালটা খালি করে দেওয়া হল। হরিনাথের বাড়ির লোক ভয়ার্ত চোখে দেখছে গবাক্ষ দিয়ে। আরও কিছু লোকের ভিড় জমেছে।

লুঙ্গিটা খুলে ফেলেছে শীতল, শুধু একটা নেংটি পরা। একেবারে মেদহীন, কালো চকচকে শরীর। সরু কোমর, চওড়া বুক, জ্বলজ্বল করছে চক্ষু যেন একটা কালো রঙের বাঘ।

গুরমিত সিং-এর কোনও প্রস্তুতির দরকার হল না। সে তো ধরেই নিয়েছে, এ লড়াই একটুক্ষণের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। প্রায় সব দর্শকদেরও তাই ধারণা।

গুরমিত সিং প্রথম থেকেই লাঠি উঁচিয়ে সবলে শীতলের মাথাটা গুঁড়িয়ে দেবার চেষ্টা করতে লাগল। তার শরীরে যতই শক্তি থাক, লাঠি চালানোতে সে তেমন দক্ষ নয়। শীতল একটা উচ্চিংড়ের মতন তিড়িং তিড়িং করে লাফিয়ে দৌড়োত লাগল ঘুরে ঘুরে। অপর পক্ষের লাঠি একবারও তাকে স্পর্শ করতে পারল না।

অত সহজে যুদ্ধ শেষ হল না, বেশ কিছুক্ষণ ধরে চলতে লাগল একই ভাবে। গুরুমিত মারতে তাড়া করে আর শীতল পালায়। দুজনের লাঠিতে ঠোকাঠুকিও হল না একবারও।

ক্রমশ ভারী শরীর নিয়ে দৌড়োত দৌড়োতে গুরমিত ক্লান্ত হয়ে পড়ছে বোঝা যায়। রাগে, বিরক্তিতে সে গর্জন করতে লাগল, শীতল একেবারে নিঃশব্দ। সে অতিরিক্ত একটুও শ্বাস নষ্ট করছে না।

তারপর একবার গুরুমিত শীতলের কাছে এসে পড়ল। এইবার বুঝি শেষ হল খেলা। সকলে দমবন্ধ হয়ে চেয়ে রইল।

শীতলের মাথা লক্ষ্য করে প্রচণ্ড জোরে লাঠি চালাল গুরুমিত। একেবারে শেষ মুহূর্তে টুক করে সরে গেল শীতল। অত জোরে মাটিতে আঘাত করার ফলে গুরমিত আর লাঠি ধরে রাখতে পারল না, খসে গেল হাত থেকে। শীতল সঙ্গে সঙ্গে সেই লাঠিটায় এক লাথি মেরে পাঠিয়ে দিল অনেক দূরে।

তারপর নিজের লাঠি তুলে মারতে গেল গুরমিতের মাথায়।

লালনের অনুরোধ মনে পড়ায় সে থেমে গেল ওই অবস্থায়। গুরুমিত মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে চোখ বুজেছে, আর তার সামনে যমদূতের মতন লাঠি তুলে আছে শীতল।

রক্তচক্ষে শীতল তাকাল লালনের দিকে। লালন খুব আস্তে আস্তে নিষেধের মাথা নাড়ল দুদিকে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে লাঠি নামিয়ে ফেলল শীতল চোখ রাখল পরাজিতের দিকে।

লালন এবার দৌড়ে মাঝখানে এসে বলল, শাবাশ শীতল, শাবাশ।

তারপর সবার দিকে ফিরে চেঁচিয়ে বলল, আপনারাই বলুন, কে জিতেছে?

সবাই চিৎকার করে একবাক্যে সায় দিল শীতলের নামে।

জমিদারের অন্য লাঠিয়ালরা এবার তেড়ে যেতে চাইল লালনদের দিকে। নায়েব তাদের থামিয়ে দিয়ে বলল, না, থাক থাক। আমরা ভদ্রলোক, আমরা কথার খেলাপ করি না। আর লড়াই হবে না। চল, সবাই ফিরে চল।

লালনের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুতভাবে হেসে বলল, আজকের মতন শেষ হলেও এ-খেলা এখানেই শেষ নয়। তোর সঙ্গে আবার দেখা হবে।

এবারে হরিনাথের বাড়ির লোকজন হুড়মুড় করে বেরিয়ে এল। প্রশংসা, কৃতজ্ঞতা কিংবা স্তুতিবাক্যে কান নেই লালনের। সে ফেরার জন্য ব্যস্ত। এইসব মারামারির সম্পর্কে সে আলোচনা করতেও চায় না। বেশিক্ষণ।

হরিনাথ লুকিয়ে নেই, সে সত্যিই অনেক দূরের এক গ্রামে গেছে নৌকোয়, ফিরতে অধিক রাত হবার কথা। লালন আর অপেক্ষা করল না।

নায়েবের কথাই ঠিক। ঠিক সাতদিন পর সে ফিরে এল, এবারে একেবারে শিমুলতলার নয়া বসতিতে। সে এসেছে ঘোড়ায় চেপে, সঙ্গে দুজন মাত্র রক্ষী, একজনের হাতে বন্দুক, অন্যজনের হাতে একটা বল্লম।

আজও শীতের দুপুর, একই রকম ভাবে শুয়ে-শুয়ে লালন অনেকের সঙ্গে আলাপচারী আর হাস্য পরিহাসে মেতে ছিল।

বড় গাছটার তলায় ঘোড়া থেকে নেমে সে লালনের দিকে তাকিয়ে বলল, সেদিন তুমি আইন-আদালত দেখাচ্ছিলে। হরিনাথ আমাদের প্রজা নয় ঠিকই। কিন্তু এই জঙ্গল ঠাকুর-জমিদারদের সম্পত্তি। তোমরা এখানে বিনা অনুমতিতে ঘরবাড়ি তুলেছ। এর নিষ্পত্তি তো জমিদারই করবেন, তাই না? আমি কিছু বলব না। জমিদারবাবু তোমায় ডেকে পাঠিয়েছেন, যা বলবার তিনিই বলবেন।

সবাই প্রথমে হতবুদ্ধির মতন এ-ওর মুখের দিকে চাইতে লাগল। এখন কী করা যাবে? নায়েবমশাই বিরাট বাহিনী নিয়ে জোরজুলুম করতে আসেননি, শুধু লালনকে নিয়ে যেতে চাইছেন, এখনই কোনও সংঘর্ষের প্রশ্ন নেই।

কিন্তু লালনকে একা নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য কী? ওকে কয়েদ করে রাখবে? ওর ওপর অত্যাচার চালাবে? কোনও দলিলে জোর করে টিপ সই দেওয়াবে?

মনসুর নায়েবকে জিজ্ঞেস করল, লালনভাই যদি না-যেতে চায়, আপনে কি তারে জোর কইরা ধইরা নিয়া যাবেন?

নায়েব বলল, না, সেরকম কোনও হুকুম নাই। আমি শুধু জমিদারের হুকুম জানাতে এসেছি। যাওয়া-না-যাওয়া তার ইচ্ছা। সে যদি না যেতে চায়, জমিদারকে জানাব। তারপর যা ব্যবস্থা গ্রহণ করার তা তিনি বুঝবেন।

লালন শান্তভাবে বলল, ঠিক আছে, আমি যাব।

তৎক্ষণাৎ শীতল চিৎকার করে বলে উঠল, আমিও সঙ্গে যাব। লালনকে আমরা একা ছাড়ব না।

আরও তিন-চারজন চেঁচিয়ে উঠল। আমরাও যাব। সবাই মিলে যাব।

একটা কোলাহল শুরু হয়ে গেল।

নায়েব হাত তুলে বলল, চুপ চুপ। আর কারুর যাওয়ার হুকুম নাই। শুধু লালনকে নিয়ে যাওয়ার কথা হয়েছে।

শীতল দর্পের সঙ্গে বলল, কেন, আমরা যেতে পারব না কেন?

নায়েব বলল, আবার লড়াই করতে যেতে চাস নাকি? একেবারে মুখ, জানিস না, জমিদারের সামনে যখন-তখন যাওয়া যায় না। ভাণ্ডারার সময় নজরানা নিয়ে গেলে তাঁর দর্শন পাওয়া যায়।

মনসুর জিজ্ঞেস করল, লালনভাই কী নজরানা নিয়ে যাবে?

নায়েব বলল, লালনকে কিছু দিতে হবে না। ওকে তো জমিদার নিজে দেখা করতে বলেছেন।

লালন বলল, আপনে একটু অপেক্ষা করেন, আমি একবার ঘর থেকে আসি। পানি খাবেন? কমলি মুড়ির মোয়া বানাইছে না? মোয়া খাবেন?

নায়েব বলল, না, কিছু খাব না। তোমাদের এদিকে হরিণ-টরিণ আসে নাকি? একটা হরিণ পেলে নিয়ে যেতাম।

মনসুর বলল, না, এদিকে হরিণ আসে না। মাঝে মাঝে খরগোশ দেখি। আর ময়ূর। আগে জানলে, আপনের জইন্য একটা ময়ূর ধইরে রাখতাম।

পেছন দিক থেকে একজন বলে উঠল, আপনেদের ওইদিকে যদি শিয়াল কম থাকে দুই-পাঁচটা নিয়া যেতে পারেন।

অনেকে হেসে উঠল।

এর পরেও একজন যোগ করল, আরে না, কর্তারা থাকেন শিলাইদহে, সেহানে শিয়াল কম পড়বে ক্যান!

লালনের তো বিশেষ সাজগোজের বালাই নেই। সে ঘরে এল গুপিযন্ত্রটা নেবার জন্য। অনেকটা পথ যেতে হবে। যদি মনে গান আসে, তা হলে এটা বাজানো যাবে।

ঘরের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে ভানুমতী। চোখ দুটি দেখলে যেন মনে হয় ফেটে বেরিয়ে আসবে।

একেবারে শরীরের অনেক গভীর থেকে স্বর বের করে সে বলল, আবার কি আমার কপাল পুড়ল? তুমি চললা?

লালন তার থুতনি ধরে বলল, হ যাচ্ছি, অত ভয়ের কী আছে? আমি আবার ফিরে আসব।

ভান্‌তি বলল, দিদিরা যে কইলো, তুমি আর আসবা না? আমার কপাল দোষেই কি তোমারে ধইরে নিয়ে যায়?

লালন তার গালে একটা টুসকি মেরে বলল, না রে পাগলি, তোর কপালের দোষ নাই। দোষ যদি কিছু থাকে, তা আমারই কপালের। তুই অপেক্ষা কইরা থাকিস, আমি ঠিকই ফিরা আসব।

গুপিযন্ত্রটা নিয়ে সে বেরিয়ে গেল।

কাছেই একটা আমলকি গাছতলায় দাঁড়িয়ে থাকে কমলি। তার হাতে একটা চাদর। সেটা যে লালনের গায়ে পরিয়ে দিয়ে বলল, এটা জড়াইয়া রাইখ্যা। অনেক দূরের পথ, শীত লাগবে।

লালন পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল কমলির দিকে।

কমলি মুখ নিচু করে বলল, সাঁই, আর কি দেখা হবে না?

লালন বলল, কেন দেখা হবে না? আমি তো একেবারে চলে যাচ্ছি না।

কমলি বলল, আমি তো আর কিছু পাব না। শুধু তোমারে দূর থেকে দেখি, তা থিকা আমারে বঞ্চিত কোরো না–

আর কিছু না-বলে সে দৌড়ে চলে গেল।

নায়েবরা ঘোড়ায় এসেছে, লালনও তার ঘোড়ায় যাবে। হেঁটে যেতে গেলে সময় লেগে যাবে অনেক।

লালনের ঘোড়াটাও আনা হয়েছে। লালন চেপে বসবার পর শীতল বলল, সাবধানে যাইয়ো ওস্তাদ।

লালন বলল, তোরা সাবধানে থাকিস। আমার পানের বরজ দেখিস।

মনসুর নায়েবকে জিজ্ঞেস করল, কতা আমাগো সাঁই কবে নাগাদ ফিরতে পারবে?

নায়েব রহস্য করে বলল, সেই জমিদার যা মনে করবেন। কিংবা–

আকাশের দিকে একটা আঙুল তুলে বলল, কিংবা উপরওয়ালার ইচ্ছা।

মানুষ তো সবসময় যুক্তি মেনে চলে না! এক-এক সময় যুক্তিকে ছাড়িয়ে যায় আবেগ। লালনের ঘোড়াটা চলতে শুরু করতেই কয়েকজন বলল, আমরা যাব, আমরা যাবই যাব আমাগো লালনের সাথে—দেহরক্ষী দুজন এতক্ষণ প্রায় নীরব ও স্থির ছিল, এবার তারা ঘুরে দাঁড়িয়ে হাতের অস্ত্র তুলে বলল, আর কেউ যাবে না, আর কেউ যাবে না।

লালনও তাদের ধমক দিয়ে বলল, কেন এমন করোস তোরা? যা, ফিরা যা। মাইয়া মানুষরা কেউ কান্দে নাই, তোরা কান্দোস, তোগো লজ্জা করে না? আমি কি চিরকালের মতন যাইতেছি নাকি!

ঘোড়াটা খানিকটা এগোবার পর নায়েব রসিকতা করে বলল, তুমি লাঠিও ধরো, আবার গুপিযন্ত্রও বাজাতে পারো? আজ লাঠির বদলে ওই বাজনাটা আনলে কেন?

নায়েবের রসিকতার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতন মন-মেজাজ লালনের নয় এখন। উত্তর দিল না সে, বাকি পথও ওদের সঙ্গে কথা বলল না।

তার মনের মধ্যে একটাই কথা ঘুরছে। জমিদার কি জঙ্গলের মধ্যে তাদের। এই নতুন বসতি ভেঙে দিতে বলবেন? এতগুলি ছন্নছাড়া মানুষের নিবিড় সুখের সংসার আবার শেষ হয়ে যাবে? জমিদার যদি অনেক টাকা চান, তা হলেও তা দেওয়া যাবে কীভাবে? জমির মূল্য দেওয়ার ক্ষমতাও তো তাদের নেই।

এই চিন্তার জন্য লালনের মনে কোনও গান এল না। গুপিযন্ত্রটা বাজাতে লাগল আস্তে আস্তে।

শিলাইদহ আসলে খুব দূরে নয়। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে কোনাকুনি গেলে একটামাত্র ছোট নদী পার হতে হয়, সে নদীতে হাঁটুও ভোবে না এই শীতকালে। ওরা পৌঁছে গেল সন্ধের কাছাকাছি।

লালনের বুকের মধ্যে নানারকম আশঙ্কা গুড়গুড় করছিল ঠিকই। কিন্তু শিলাইদহের কুঠিবাড়ির একেবারে সামনে পৌঁছে হঠাৎ কী করে যেন সব কেটে গেল। এখন তার মনে হল, এত ভয়ের কী আছে? জমিদারও মানুষ, সেও মানুষ। জমিদারের ক্ষমতা অনেক বেশি হতে পারে। কিন্তু সেও তো সব কিছু এক নিমেষে ছেড়ে চলে যেতে পারে। তা হলে জমিদার কী নেবে? সে ও তার সঙ্গীসাথীরা এই জঙ্গল ছেড়ে চলে যাবে অন্য জঙ্গলে। দুনিয়ায় কি জঙ্গলের অভাব আছে?

এই কথাটা ভাবার পরেই তার মনে বেশ বল এল।

কুঠিবাড়ির সদর দেউড়ি দিয়ে ভেতরে ঢোকার পর তাকে ঘোড়া থেকে নামতে বলা হল। অন্য একজন লোক এসে এক কোণের একটি জায়গা দেখিয়ে বলল, তুমি ওইখানে বসে থাকো। নায়েবমশাইয়ের যখন সময় হবে, তখন তোমার সঙ্গে এসে কথা বলবেন।

অর্থাৎ যে টাকমাথা লোকটিকে নায়েব মনে করা হয়েছিল, সে নায়েব নয়। একজন নিম্নপদস্থ কর্মচারী। আসল নায়েব থাকেন এখানে। এত সামান্য ব্যাপারে তিনি বাইরে যান না।

লালন বলল, আমি শুধু জমিদারবাবুর সাথে কথা কব, আর কারুর সাথে কথা কইতে চাই না।

কাছাকাছি দু-তিনজন লোক দাঁড়িয়ে আছে, তারা হেসে উঠল।

একজন বলল, ওরে বাবা, এ কোন লাটসাহেব এল? জমিদারের সঙ্গে দেখা করতে চায়। ওরে, নায়েবই যদি তোর সঙ্গে কথা বলেন তো বর্তে যাবি! নকুলবাবু তো কুমারখালির দিকটায় খাজনার ব্যাপার দেখেন। এখন ওই চাটায়ে বসে বিশ্রাম কর।

লালন তবু টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে জানাল যে, সে অন্য কোথাও যাবে না, বসবেও না। সে শুধু জমিদারের সঙ্গে কথা বলবে। যেন সে রাজার প্রতি রাজার ব্যবহার প্রত্যাশা করে।

এই নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কথা কাটাকাটি হল, তারপর এক ব্যক্তি তাকে নিয়ে গেল ভেতরে।

সেটা ঠিক অন্দরমহল নয়। একটুখানি ভেতরে ঢুকে আবার বাইরের দিকে এক প্রশস্ত বারান্দা। অদূরে নদী। ওপারে সূর্যাস্ত হচ্ছে।

 সেই সূর্যাস্তের দিকে তাকিয়ে একটা আরাম কেদারায় বসে আছেন জমিদার। তাঁর সামনে একটা ইজেল, তাতে একটা অর্ধসমাপ্ত ছবি। ইজেলের নীচেও কয়েকটি ছবি পড়ে আছে মেঝেতে।

লালন অবশ্য ইজেল বস্তুটি কী তা বুঝল না।

অস্ত সূর্যকে প্রণাম করে জমিদার মুখ ফিরিয়ে তাকালেন তার দিকে।

লালন এমন অবাক বহুদিন হয়নি। সে মনে মনে ভেবে এসেছে, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দেখবে। তিনি এক রাশভারী চেহারার প্রবীণ হবেন নিশ্চয়ই। কিন্তু এ যে এক নবীন যুবা। দীর্ঘকায়, অত্যন্ত রূপবান। দেবেন্দ্রনাথের পরিবর্তে তাঁর পুত্রদের কেউ যে এখন জমিদারি পরিদর্শনের ভার নিয়েছে, তা এ অঞ্চলে এখনও বিদিত নয়।

যুবকটি লালনকে সঙ্গে নিয়ে আসা কর্মচারীটিকে জিজ্ঞেস করলেন, ইনি কে?

কর্মচারীটি বললেন, আজ্ঞে কর্তামশাই, এর নাম লালন ফকির। আপনি বলেছিলেন–

যুবকটি অত্যুৎসাহী হয়ে উঠে বলল, আপনিই লালন ফকির? বসুন, বসুন। ওরে, কেউ একটা কুরশি এনে দে। আপনাকে কেন ডেকে এনেছি জানেন? আপনার দুটি-একটি গান শুনব বলে।

লালন বলল, আপনি শুধু আমার গান শোনার জন্য আমাকে ডেকে এনেছেন?

যুবকটি বলল, হ্যাঁ, নানারকম গান সম্পর্কে আমার খুব আগ্রহ। তবে, এভাবে আপনাকে ডেকে আনা নিশ্চয়ই আমার বেয়াদপি হয়েছে। আমারই উচিত ছিল আপনার আখড়ায় গিয়ে গান শোনা। কিন্তু জানেন তো, জমিদাররা খাঁচায় বদ্ধ জীব। তারা ইচ্ছেমতন যেখানে সেখানে যেতে পারে না। আমি যদি আপনার আখড়ায় যেতে চাইতাম, সাতগন্ডা নায়েব গোমস্তা আর পাইক-পেয়াদা আমার পেছনে দৌড়োত। সেইজন্যই আপনাকে কষ্ট দিয়েছি।

লালন এবার হো হো করে হেসে উঠল।

সেই হাসি শুনে থতমত খেয়ে যুবক জমিদারটি জিজ্ঞেস করল, আপনি হাসছেন কেন?

লালন বলল, আপনি আমার গান শোনার জন্য ডেকেছেন। আর আমি ভাবতে ভাবতে এসেছি, আপনি আমায় শাস্তি দেবেন, কয়েদ করবেন, আমাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করবেন।

খাঁটি বিস্ময়ের সঙ্গে সেই জমিদার জিজ্ঞেস করল, আপনাকে শাস্তি দেব… কেন?

লালন বলল, কয়েকদিন আগেই আপনার লাঠিয়ালদের সঙ্গে আমাদের সংঘর্ষ হয়েছে। আমরা জঙ্গলে যে জমিতে–

যুবকটি বলল, দাঁড়ান, দাঁড়ান। লাঠিয়ালদের সঙ্গে সংঘর্ষ মানে… আপনারও লাঠিয়াল আছে নাকি?

সে গলা তুলে বলল, শচীনবাবু, শচীনবাবু। এই কে আছ, একবার শচীনবাবুকে ডাকো তো!

ভৃত্যরা এর মধ্যে দুটি হ্যাজাক বাতি এনে রেখে গেল দুদিকে। আর একটি সেজ বাতি। এত উজ্জ্বল আলোর বিলাতি হ্যাজাক বাতি লালন আগে দেখেনি।

যুবকটি একটা সাদা রঙের লম্বা ও গোল লাঠির মতন বস্তু ঠোঁটে লাগিয়ে গন্ধক কাঠি জ্বেলে সেটি ধরাল। ধোঁয়া বেরুতে লাগল তার থেকে। সিগারেট নামে এই শহুরে বস্তুটি এদিককার গ্রামাঞ্চলের তামাক-ধূমপায়ীদের কাছে। এখনও অপরিচিত, অভিনব। যুবকটি এই সিগারেট সেবন শিখেছে মাইকেল মধুসূদন নামে এক ফিরিঙ্গি কবির কাছ থেকে।

ধোঁয়া উদ্‌গীরণ করতে করতে যুবকটি বলল, শচীনবাবু আসুক, তার আগে আপনি বলুন তো, লাঠালাঠির বৃত্তান্তটা কী?

লালন বলল, আপনি কিছুই জানেন না?

যুবকটি বলল, এই তো প্রথম শুনছি।

লালন সংক্ষেপে ঘটনাটি জানাল। ততক্ষণে শচীনবাবু নামে এক ব্যক্তি এসে গেছেন। জমিদার-তনয় তার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, শচীনবাবু, এসব কী শুনছি? এই হরিনাথ মজুমদার কে?

শচীন বলল, আজ্ঞে হরিনাথ মজুমদার একটা অতি নগণ্য পত্রিকার এডিটর। নিজেকে সে মাঝে মাঝে কাঙাল হরিনাথ বলে পরিচয় দিয়ে থাকে। সে আমাদের এই জমিদারির নামে নানারকম মিথ্যা কুৎসা রটনা করে চলেছে। তাই তাকে একটু শিক্ষা দেওয়ার জন্য…

লাঠিয়াল পাঠিয়ে ছিলেন?

ভবদেব গোমস্তা কয়েকজন লাঠিয়াল নিয়ে গিয়েছিল ঠিকই। তবে বিশেষ কিছু হয়নি। শুধু একটু ভয় দেখিয়ে–

বিশেষ কিছু হয়নি, তার কারণ প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিলেন। ছি ছি ছি ছি! আপনারা কোন যুগে পড়ে আছেন? পত্রপত্রিকায় কিছু লিখলে কি সেইজন্য লাঠিয়াল পাঠানো যায়? এসব তো বর্বর যুগে হত। আপনাদের এখানে কেউ লেখাপড়া জানে না? লেখার জবাব লেখাতেই দিতে হয়। লাঠি দিয়ে নয়। আর যদি মিথ্যে কথা লিখেই থাকে, তাতে গুরুত্ব দেওয়ার কী আছে?

লালন বলল, পুরাটা মিথ্যা না তাতে কিছু সত্যও আছে, তাও তো যাচাই করা দরকার।

জমিদার জিজ্ঞেস করল, কী লেখা হয়েছে সেই রিপোর্টে?

লালন তাকাল শচীনের দিকে।

শচীন বলল, ওসব কথা আমি মুখে আনতেও চাই না।

জমিদার তাকাল লালনের দিকে।

লালন আস্তে আস্তে বলল, আমার অক্ষরজ্ঞান নাই, নিজে কিছু পড়তে পারি না। লোকমুখে শুনেছি, গ্রামের গরিব প্রজাদের ওপর লাঠিয়ালরা গিয়া অত্যাচার করে, খাজনা দিতে না-পারলে চাষিদের বাড়িতে আগুন ধরায়ে দেয়, আর কুকর্মের বিবরণ… বাবুমশাই, ওই হরিনাথ মজুমদার আমার বন্ধু মানুষ, আমি তারে বিশ্বাস করি, সে গরিব মানুষের পক্ষে।

জমিদার বলল, হুঁ, এর মধ্যে কিছু কিছু সত্য থাকতেই পারে। নইলে। শচীনবাবুরাই বা এত উত্তেজিত হবেন কেন? জমিদাররা থাকেন সব কলকাতায়, দূরের জমিদারিতে নায়েব-কর্মচারীরা যে কী করছে, তার খবরও রাখেন না। তাঁরা টাকা পেলেই খুশি। কীভাবে যে সেই টাকা আদায় হচ্ছে… নাঃ, এরকম আর বেশিদিন চলতে পারে না। জমিদারি ব্যবস্থায় ঘুণ ধরে গেছে। লর্ড কর্নওয়ালিশের এই ব্যবস্থা আর বেশিদিন টিকবে না মনে হয়। এখন আমাদের ব্যাবসা ছাড়া গতি নেই। আপনাদের ভিটেমাটির কী সমস্যা হয়েছে বলছিলেন?

লালন বলল, আমরা গুটিকতক মানুষ, আমারই মতন দরিদ্র, সমাজ থিকা বিতাড়িত, জঙ্গলের মধ্যে ছোট ছোট কুটির বানিয়ে একটা বসতি গড়েছে। সেই জঙ্গল যে আপনাদের জমিদারির মধ্যে পড়ে তা জানতাম না। আমরা ভেবেছিলাম, বন-জঙ্গল, নদী, বিল-হাওর এই সবই সৃষ্টিকর্তার সম্পত্তি….

জমিদার হেসে বলল, সেটাই তো স্বাভাবিক। আমরা জমিদাররা জোর করে এসব ভাগাভাগি করে নিয়েছি। পৃথিবীর আর কোথাও বোধহয় এক ফোঁটাও জমি সৃষ্টিকর্তার অধীনে নেই।

লালনদের নতুন বসতির খুঁটিনাটি সে মন দিয়ে শুনল।

তারপর বলল, শচীনবাবু, এই ফকিরের যে-গ্রাম, তা সব নিষ্কর হিসেবে পাট্টা করে দিন। আমি থাকতে থাকতেই যেন সই-সাবুদ হয়ে যায়। দেখবেন যেন গাফিলতি না-হয়।

উঠে দাঁড়িয়ে সামনের ইজেলের অর্ধসমাপ্ত ছবিটা সরিয়ে দিতে দিতে সে বলল, আমার ঠাকুরদাদা ঈশ্বর দ্বারকানাথ ঠাকুর এই এদিককার জমিদারির পত্তন করেছিলেন। তিনি ছিলেন কড়া ধাতের মানুষ। তখন আমাদের সম্পত্তি অনেক বিস্তৃত হয়েছিল। তারপর, আপনারা জানেন কি না জানি না, বিলাতে গিয়ে আমার ঠাকুরদাদা মশাই প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন। তাঁর অকস্মাৎ মৃত্যুর পর দেখা যায় আমাদের প্রচুর ঋণ। আমার বাবামশাইকে তখন দেউলিয়া ঘোষণা করতে হয়েছিল। তারপর বাবামশাই ধীরে ধীরে সব পুনরুদ্ধার করেন, সব পাওনাদারদের ঋণ মিটিয়ে দেন। সেই সময় বাবামশাই নিয়মিত জমিদারি পরিদর্শনে আসতেন। কিন্তু তিনি তো নিছক জমিদার হয়ে থাকার জন্য জন্মাননি। তিনি এখন ঈশ্বর সাধনায় মগ্ন। জমিদারির কিছু দেখেন না, কলকাতাতেও বিশেষ থাকেন না। মাঝে মাঝেই চলে যান সিমলে পাহাড়ে কিংবা গঙ্গায় বোটে থাকেন। জমিদারির ভার দিয়েছেন ছেলেদের ওপর। মুশকিল হচ্ছে, আমার বড় দাদা দার্শনিক ও কবি মানুষ, বিষয়কর্মে একেবারেই মন নেই। পরের দাদা খুবই উচ্চশিক্ষিত, কিন্তু তিনি জমিদারিতে আগ্রহ দেখাননি, সরকারি চাকরি করেন, এখন আছেন বোম্বাই নগরীতে। তারপর এই অধম… আপনি আমার নাম জানেন।

লালন বলল, আজ্ঞে না।

আমার নাম জ্যোতিরিন্দ্র। জমিদারি সামলাবার ব্যাপারে আমি একেবারেই অযোগ্য। সত্যি কথা বলতে কী, আমার ভালো লাগে গান-বাজনা, ছবি আঁকা, থিয়েটার। আমি শহুরে মানুষ। তা ছাড়া জমিদারির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সন্দিহান বলে মন লাগাতেও পারি না। বরং সাহেবদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমি জাহাজের ব্যাবসা করব ভাবছি। দেখা যাক।

আপনি কি নিজে গান করেন?

কেন, এ-কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?

আপনার মতন এমন সুরেলা কণ্ঠ কোনও পুরুষের আগে শুনিনি।

জ্যোতিরিন্দ্র একটু লজ্জা পেয়ে বলল, আমাদের বাড়িতে গানবাজনার খুব চর্চা হয়। ভাইবোনরা অনেকেই গান গায়। আমার এক বন্ধু সম্প্রতি এই অঞ্চল ঘুরে গেছেন, তিনি কোথাও আপনার গান শুনেছেন, আপনার আর গগনের। ফিরে গিয়ে আমায় বললেন, গ্রামবাংলায় কত রত্ন যে ছড়িয়ে আছে, আমরা তার কিছুই সন্ধান রাখি না। বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষের মধ্যে বাংলা সংস্কৃতিকে তো আপনারাই বাঁচিয়ে রেখেছেন। এবার আমি এসেছি প্রধানত আপনাদের গান শোনার জন্যই। অনেক কথা হয়েছে, এবার গান ধরুন।

লালন গুপিযন্ত্রটায় সুর তুলতেই জ্যোতিরিন্দ্র আবার বলল, যদি কিছু মনে  করেন, এদিকে এই দুটি বাতির মাঝখানে বসবেন?

ইজেলে একটা নতুন কাগজ পরিয়ে সে হাতে নিল স্কেচ পেন। তারপর মুখ ঘুরিয়ে একবার পেছন দিকে তাকাল।

জ্যোতিরিন্দ্রের সঙ্গে তার এক ছোট ভাই এসেছে। সে কিশোরবয়স্ক, তার নাম রবি।

জ্যোতিরিন্দ্র দুবার রবি, রবি বলে ডেকে জিজ্ঞেস করল, রবি কোথায় গেল?

একজন কর্মচারী জানাল, রবি নদীর চড়ায় বালিহাঁস দেখতে গিয়েছিল এখনও ফেরেনি।

জ্যোতিরিন্দ্র বলল, থাক। ফকির সাহেব, আপনার গান শুরু করুন।

এবার লালন গান ধরল, এ তার স্বতঃস্ফুর্ত গান নয়, পুরনো রচনা, গনাই শেখের কাছে নতুন করে শোনা। 

কে কথা কয় রে দেখা দেয় না
নড়ে চড়ে হাতের কাছে খুঁজলে জনম-ভর মেলে না।

খুঁজি তারে আসমান-জমি
আমারে চিনিনে আমি
এ কী বিষম ভুলে ভ্রমি
আমি কোন জন সে কোন জনা।

রাম কি রহিম সে কোন জন
ক্ষিতি জল কি বায়ু-হুতাশন
শুধাইলে তার অন্বেষণ
মূর্খ দেখে কেউ বলে না।

হাতের কাছে হয় না খবর
কী দেখতে যাও দিল্লি-লাহোর
সিরাজ সাঁই কয় লালন রে তোর
সদায় মনের ঘোর গেল না

খুব দ্রুত লালনের প্রতিকৃতি আঁকতে আঁকতে জ্যোতিরিন্দ্র বলল, অপূর্ব। আর একখানা—লালন আবার ধরল:

আমি একদিনও না দেখিলাম তারে
বাড়ির কাছে আরশিনগর
সেথা এক পড়শি বসত করে…

পরপর পাঁচখানি গান শুনিয়ে লালন থামল। পাশে সরিয়ে রাখল গুপিযন্ত্র।

জ্যোতিরিন্দ্র বলল, জঙ্গলের মধ্যে আপনাদের যে-গ্রাম, সেখানে আমার জন্য একটুখানি জায়গা রাখবেন। হয়তো একদিন একটা ছোট্ট কুঁড়েঘর বেঁধে আমিও সেখানে বাস করব। কী গান শোনালেন ফকির! এর সব মর্ম বোেঝ সহজ নয়। আরশিনগর, এমন কখনও শুনিনি!

দ্রুত হাতে কয়েকটা টান দিয়ে রেখাচিত্রটি সম্পূর্ণ করে জ্যোতিরিন্দ্র বলল, এই দিকে এসে দেখুন তো, আপনার মুখখানি ঠিক হয়েছে কি না।

লালন উঠে এসে জ্যোতিরিন্দ্রর পাশে দাঁড়াল। ছবিটি দেখার পর হাসি ছড়িয়ে গেল তার সারা মুখে।

সে বলল, বাবুমশাই, আমার মুখখানি কেমন দেখতে, তা তো আমি জানি না। কখনও দেখি নাই।

জ্যোতিরিন্দ্র বলল, সে কী? নিজের মুখ কখনও দেখেননি? এই যে গাইলেন আরশিনগরের কথা?

লালন বলল, সে আরশিনগরে নিজেকেও দেখা যায় না, পড়শিকেও দেখা যায় না।

জ্যোতিরিন্দ্র বলল, নার্সিসাস নামে একজন স্বচ্ছ ঝরনার জলে প্রথম নিজের মুখ দেখেছিল। আপনি তাও দেখেননি?

লালন বলল, এদিকে তেমন ঝরনা কিংবা নদী কোথায়? সবই তো ঘোলা জল।

 জ্যোতিরিন্দ্র গভীর বিস্ময়ে বলল, এমন মানুষও আছে, যে জীবনে কখনও নিজের মুখও দেখেনি।

লালন বলল, গ্রামে-গঞ্জে এমন অনেক মানুষ আছে!

জ্যোতিরিন্দ্র একটুক্ষণ চুপ করে থেকে তারপর বলল, কোনও মেয়ের চোখের মণির দিকে খুব মন দিয়ে দেখলে সেখানে নিজের প্রতিবিম্ব দেখা যায়। তেমন দেখার চেষ্টা করেছেন?

লালন আরও হেসে বলল, এবার দেখার চেষ্টা করব। কিন্তু বাবুমশাই, মুখখানা বেশি বুড়া বুড়া মনে হয়। আমি কি অত বুড়া হয়েছি?

জ্যোতিরিন্দ্র বলল, হ্যাঁ, ঠিক হয়নি। আলো কম লেগেছে। দিনের বেলা আরও ভালো করে আঁকতে হবে। আপনি অনুগ্রহ করে আর একবার আসবেন?

আর কিছু কথার পর লালনের বিদায় নেবার পালা। অন্তরালে একজন ভৃত্য একটি বোতল ও গেলাস নিয়ে অপেক্ষা করছে। এখন বাবুমশাইয়ের কারণবারি পান করার সময়।

জ্যোতিরিন্দ্র লালনকে অতিথিশালায় থেকে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করল, লালন রাজি হল না। সে জানে শিমুলতলায় তার সঙ্গীসাথীরা অধীরভাবে অপেক্ষা করছে। তাদের সুসংবাদ জানাবার জন্য এই রাতেই যতখানি সম্ভব সে এগিয়ে যেতে চায়।

কুঠিবাড়ির গেটের বাইরে আসতেই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে একজন ব্যক্তি লালনের পা ছুঁয়ে প্রণাম করে বলল, সাঁই, আপনি আমারে চেনেন  না। আমি আপনার একজন ভক্ত-শিষ্য। আমি আপনার জন্যই অপেক্ষা করছি। আমার নাম গগন।

লালন বলল, তুমিই গগন! তোমার কথা একটু আগে শুনলাম। তুমি গান করো?

গগন বলল, আমি গ্রামে গ্রামে চিঠি বিলি করি। লোকে আমায় বলে গগন হরকরা। মাঝে মাঝে গান মনে আসে, আপন মনে গাই। নিকটেই আমার কুটির, একবার পদধুলি দিলে ধন্য হই।

গগনের বাড়ির কাছে গিয়ে দেখা গেল, সেখানে দাঁড়িয়ে আছে এক রমণী। সাধারণ নারীদের তুলনায় বেশ লম্বা ও চওড়া, মাথার চুল চুড়ো করে বাঁধা, কপালে একটা মস্ত বড় লাল টিপ। হাতে একটা একতারা।

গগন জিজ্ঞেস করল, কী রে, তুই কী করছিস এখানে?

স্ত্রীলোকটি বলল, আমিও তো এই ফকিরকে দেখব বলে অপেক্ষা করছি।

গগন বলল, সাঁই, এর নাম সর্বখেপি। সকলে এই নামে ওরে ডাকে। খেপিই বটে, শ্মশানে-মশানে ঘুরে বেড়ায়, কোনও ভয়-ডর নাই। এও নিজের গান গায়।

সর্বখেপি বলল, ভয়-ডর আবার কীসের? জগৎ জুড়ে রয়েছে প্রেম। যারা সেই প্রেমের ঝরনা ধারায় একবার স্নান করে, তাদের দিব্য জনম হয়, তারা আর কোনও কিছুই গ্রাহ্য করে না।

গগন বলল, খেপি, তোর মতন প্রেমের অমন মর্ম আমরা বুঝি না।

লালন হেসে বলল, প্রেমের মর্ম বোঝার জন্য শ্মশান মশানে যেতে হবে কেন?

গগন তার কুঁড়েঘরে একলাই থাকে। অতিথিদের জন্য সে একটা মাদুর পেতে দিল।

লালন একটা বিড়ি ধরিয়ে বলল, দাঁড়াও, আগে ভিতরের প্রাণীটাকে শান্ত করি। জমিদারের সামনে বিড়ি ধরাবার সাহস হয় নাই। উনি একটা লম্বা, সাদা রঙের বিড়ি টানছিলেন।

এক গেলাস জল এক চুমুকে শেষ করে লালন বলল, বেশি সময় নাই, যেতে হবে। গগন, তোমার একখান গান শোনাও।

গগন গান ধরল:

আমি কোথায় পাবো তারে। আমার মনের মানুষ যে রে
হারায়ে সেই মানুষে, তার উদ্দিশে, দেশ-বিদেশে বেড়াই ঘুরে
লাগি সেই হৃদয় শশী, সদা প্রাণ হয় উদাসী…

দীর্ঘ গানটি শুনে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল লালন।

গগন আবার একটি ধরল:

হরি নাম দিয়ে জগৎ মাতালে দেখো
এগলা নিতাই
এগলা নিতাই, এগলা নিতাই, এগলা নিতাই…

এ গানেরও সুর অপূর্ব।

গগন বলল, সাঁই, আপনারে আমার সামান্য গান শুনায়ে ধইন্য হইলাম। এবার আপনি যদি-–

 গগনকে তার কথা শেষ করতে হল না আর অনুরোধও করতে হল না।

লালন সিধে হয়ে বসল। তার চক্ষু দুটি স্থির। সে শুরু করল গান:

আমার ঘরের চাবি পরের হাতে
কেমনে খুলিয়ে সে ধন দেখব চক্ষেতে…

এ গান পূর্বে রচিত নয়। স্বতঃস্ফূর্ত। জমিদার তনয়টি বেশ ভালোই ব্যবহার করেছেন ঠিকই, তবু কেমন যেন বাধোবাধো লাগছিল। মনে হচ্ছিল উনি দূরের ভাষায় কথা বলেন। তাই মনে কোনও নতুন গান আসেনি।

এ-গানটি শেষ হতেই লালন অন্য একটি গান শুরু করল। এও নতুন। এখন তার মনের মধ্যে পোনামাছের বাচ্চার ঝাঁক এসে গেছে।

খ্যাপা তুই না-জেনে তোর আপন খবর যাবি কোথায়
আপন ঘর না বুঝে বাইরে খুঁজে পড়বি ধাঁধায়…

লালন থামতেই সর্বখেপি বলল, এখন আমি একটা গান শুনাই?

অত বড় চেহারার রমণীটি গান গায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, নেচে নেচে, মাথার ওপর দুহাত তুলে তালি দেয়। তার বিশাল স্তনদুটি দোলে।

সে গাইল:

দেখে যা ও ময়ূরী, ও কোকিলা
আমার এই শূন্য ঘরে ভালোবাসার কেমন লীলা…

লালন সে-গান শুনে বলল, লীলা? লীলা শুনলেই মনটা কেমন যেন ঝিমঝিম করে। যেন ছোট্ট এই একটা শব্দের মধ্যে ভরা আছে ব্রহ্মাণ্ড।

সর্বখেপি লালনের দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলল, এই লালনখ্যাপা, তুই বেশি বেশি সাঁই হয়েছিস, তাই না? বইস্যে বইস্যে গান করিস! বিড়ি ফেলে দে, ওঠ! দাঁড়া!

লালন বাধ্য ছেলের মতন উঠে দাঁড়াল।

সর্বখেপি বলল, এবার গান কর। কোমর দুলাবি।

গগন বলল,এই খেপি, কারে কী কইতে হয় জানো না।

লালন গান ধরল:

মিলন হবে কত দিনে
আমার মনের মানুষের সনে।

একটু গাইতে না-গাইতেই সর্বখেপি তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, এর উত্তর আমি জানি। এইটা শোন:

মন রে সুধাও মন-মানুষের ঘর-ঠিকানা
কর্দমে ফুটেছে পদ্ম, কর্দমেরও কি তা আছে জানা
বনের বাইরে আছে দাঁড়ায়ে চন্দনবৃক্ষ
নিজের সুবাস সে জানে না, পায় শুধু অন্তরীক্ষ….

লালন ভেবেছিল, সে বেশিক্ষণ বসবে না, তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়বে। কোথায় কী? খাওয়াদাওয়ার নাম নেই, ধন-সম্পদের চিন্তা নেই, ভবিষ্যতে কী হবে তার ঠিক নেই, শুধু গান নিয়ে মেতে রইল এই তিনজন। অবিরাম গান, অবিরাম সুর, তারই কী তীব্র নেশা।

একসময় বাইরে থেকে ভেসে এল আজানের সুর। তখন ওদের ঘোর ভাঙল। রাত্রি শেষ, ভোর হয়ে গেছে। ফুটে উঠছে আলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *