১২. শিখাদের বাড়িতে অনবরত লোকজন আসে

শিখাদের বাড়িতে অনবরত লোকজন আসে। তার বাবার কাছে আসে মক্কেলরা, কাকার কাছে অফিসের লোক, এ ছাড়া আছে দাদার বন্ধুরা। বসবার ঘরটা খালিই পাওয়া যায় না প্রায়।

দুপুরের দিকে বাবা-কাকা-দাদারা কেউই বাড়িতে থাকে না বলে শিখা সেই সময়টায় শুধু বসবার ঘরটা ব্যবহার করতে পারে। বিশেষত কলেজ বন্ধের সময়।

দেবযানী আর পলার সঙ্গে বসে গল্প করছিল শিখা, এই সময় অনিন্দ্য আর ধূতিকান্ত এসে উপস্থিত হল। রাস্তায় জল জমে আছে, সেই জল ঠেলে এসেছে। ভিজে জুতো বাইরে খুলে রেখে ওরা ঘরে ঢুকল খালি পায়ে। অনিন্দ্য ঢুকেই বলল, আমরাও শাড়ি আর গয়না বিষয়ে অনেক কিছু জানি।

শিখা হেসে বলল, আহা, আমরা বুঝি শুধু শাড়ি আর গয়না নিয়ে আলোচনা করি?

তা হলে কী নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল?

নানান বিষয়ে।

অর্থাৎ ছেলেদের সম্পর্কে তো?

যা যা! ছেলেদের সম্পর্কে আবার আলোচনা করার কী আছে রে?

নেই বুঝি? আমরা কিন্তু ভাই ছেলেরা একসঙ্গে মিললেই কোনো-না-কোনো সময়ে মেয়েদের নিয়ে আলোচনা করবই। ফ্র্যাঙ্কলি বলছি! কী রে ধৃতি, বল না।

ধূতিকান্ত তখন পায়ের কাছে গোটানো প্যান্টটা খুলছে। দেবযানী আর পলা গম্ভীর হয়ে বসে আছে, তারমধ্যে দেবানী একটু বেশি গম্ভীর। কারণ সে অনিন্দ্যর সঙ্গে কথা বলে না।

রুমাল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে অনিন্দ্য বলল, একটু চা-ফা হবে না? কী রে শিখা, একটু চায়ের কথা বল।

শিখা বলল, এখন সবাই ঘুমোচ্ছে। আর একটু পরে, বিকেল হোক!

তার মানে বিকেল পর্যন্ত এখানে থাকতে হবে আমাদের? বেশ তো, আমার আপত্তি নেই।

তোরা হঠাৎ এখানে এলি যে?

কী করব, ধৃতিটা যে সারাসকাল থেকে বলছে তোর সঙ্গে দেখা করতে আসবে, তোর জন্য মন কেমন করছে…

ধূতিকান্ত আপত্তি করতেই অনিন্দ্য জোরে হেসে উঠল। তারপর পলার দিকে তাকিয়ে বলল, কী রে ভালো আছিস? তোর স্বাস্থ্যটা আরও ভালো হয়েছে মনে হচ্ছে? সেই পাইলটদাদার সঙ্গে পরশু দিন আমার দেখা হয়েছিল রাস্তায়।

অকারণেই লজ্জা পেল পলা। অনিন্দ্যর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয়, আজ আর সে অন্য কারুকে কথা বলতে দেবে না।

দেবযানীর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে অনিন্দ্য বলল, আমি এক-এক সময় কী ভাবি জানিস? মেয়েদের সম্পর্কে আড়ালে আমরা যা-যা বলি, সেগুলো তাদের সামনে এসে বললে কী ক্ষতি হয়? তেমনি মেয়েরাও বলতে পারে যা খুশি—শুধু শুধু গম্ভীরভাবে অন্য কথাবার্তা বলার কোনো মানে হয়? কী রে শিখা, তোর কোনো আপত্তি আছে?

শিখাদের বসবার ঘরটা বেশ বড়ো। এলোমেলোভাবে সাজানো। একপাশে সোফা সেট, অন্য দিকে আবার একটা ভারী কাঠের টেবিল, তার চারপাশে কয়েকটা কাঠের চেয়ার। টেবিলের ওপর কাচ পাতা, তার নীচে শিখার বাবার প্রায় দু-তিন-শো মক্কেলের কার্ড।

মেয়েরা বসেছিল সোফায়। অনিন্দ্য গিয়ে বসল, শিখার বাবার রিভলভিং চেয়ারে, তারপর টেবিলের ওপর পা তুলে দিল। তার সদ্য জলে ধোয়া ফর্সা পা। সিগারেট ধরিয়ে বলল, যেমন ধর, পাঁচটা ছেলে যদি এক জায়গায় হয়, তাদের কথাবার্তা শুনে তোদের মনে হবে পৃথিবীতে প্রেম-ভালোবাসা বলে কোনো জিনিস নেই। ওসব শিল্পী-সাহিত্যিকদের তৈরি করা গাঁজা।

ধৃতি অকারণে হেসে উঠল। শিখা তার শাড়ির আঁচল প্লেন করছে। অনিন্দ্যর সবসময় ঠোঁটে একটু হাসি লাগিয়ে রাখা কথাগুলো শুনতে মন্দ লাগে না। তবে কখন যে কোন দিকে ওর কথার মোড় ঘুরবে তা বোঝার উপায় নেই।

অনিন্দ্য বলল, ছেলেরা তখন শুধু মেয়েদের শরীর নিয়ে আলোচনা করে। কার বুক কীরকম, কার কোমরে খাঁজ আছে, কার পাছা হেভি-ঠিক যেন খাবার জিনিস, কীরকমভাবে সেটা পাওয়া যায়।

দেবযানী উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি চলি!

অনিন্দ্য বলল, যার শুনতে ইচ্ছে হবে না, সে কানে আঙুল দিয়ে বসে থাকতে পারে। আমি কিন্তু যা ফ্যাক্ট তাই বলছি।

শিখা দেবযানীকে খানিকটা হুকুমের সুরে বলল, বোস। এখন যাবি না।

তারপর অনিন্দ্যর দিকে ফিরে বলল, তুই বুঝি ভাবছিস, তুই খুব রসিকতা করছিস? আমাদের কিন্তু শুনতে ভালো লাগছে না।

অনিন্দ্য বলল, ভালো লাগার কথা তো নয়ই। ক্রুড কথাবার্তা। কিন্তু ছেলেরা তোদের সম্পর্কে আড়ালে কী ভাবে, সেটা জেনে রাখতে ক্ষতি কী?

ধৃতি বলল, কিন্তু অনিন্দ্য, তুই সব ছেলেকে এই দলে ফেলতে পারিস না। অনেক ছেলে আছে খুব সিরিয়াস ধরনের।

যেমন তুই? তুই তো একটা মেনিমুখো।

তাহলে তুই বলতে চাস, কোনো ছেলেই ভালোবাসতে জানে না?

একা একা। একা বসে অনেক ছেলেই মেয়েদের দেবী হিসেবে পুজো করে, কিন্তু দলে ভিড়লেই এক-একটি নররাক্ষস।

এটাও সবার সম্পর্কে খাটে না।

অনিন্দ্য দারুণ কায়দায় কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, আমি কখনো অন্যরকম দেখিনি। এটা কেন হয়, তাও বলে দিচ্ছি। পিউবার্টি আসার পরেই যৌনখিদে দারুণভাবে জেগে ওঠে। মানুষের জীবনের যেটা শ্রেষ্ঠ সময়, অর্থাৎ যৌবন, সেই সময়েই, আমাদের দেশে বা সমাজে—ছেলে মেয়েরা দূরে দূরে থাকে, কেউ কারুকে পায় না। কী অসহ্য যন্ত্রণা বল তো? এটা একটা বিরাট ট্র্যাজেডি নয়?

ধৃতি গম্ভীরভাবে বলল, সংযমেরও একটা মূল্য আছে। সংযমের জন্যই পৃথিবীতে অনেক বড়ো বড়ো কাজ হয়।

অনিন্দ্য বিশ্রী শব্দ করে ব্যঙ্গের হাসি হাসল। তারপর ধৃতিকে কীটপতঙ্গের মতন জ্ঞান করে বলল, মেয়েদের সামনে সাধু সাজছিস? ন্যাকা! মেয়েরা তোর মতন ন্যাকাদের পছন্দ করে না।

শিখা তীব্র গলায় বলল, আমরা একটা দরকারি বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলাম। তোরা কেন বিরক্ত করতে এসেছিস?

আমি যা বলছি, তাও কম দরকারি নয়।

দয়া করে তোমাদের এই দরকারি কথা অন্য জায়গায় গিয়ে বলো। আমরা অন্য ব্যাপারে ব্যস্ত আছি।

শিখার পাশ থেকে পলা বলল, এইসব কথা বলার জন্য তোরা বৃষ্টি ভিজতে ভিজতে এসেছিস? তোদের লজ্জা করে না?

অনিন্দ্য পলাকে বলল, লজ্জার কী আছে রে? এসব কথা মেয়েদের কাছেই তো বলার। তাদের নিয়েই যখন সব কিছু। সবাই জানে, আমি পুরোপুরি হোমো নয়। আজ ভেবেছি তোদের কিছু জ্ঞান দেব।

আমাদের জ্ঞানের দরকার নেই। তুই এক কাজ কর, তুই এখন একটা বিয়ে করে ফেল, তাহলেই তোর সমস্যা মিটে যাবে।

অনিন্দ্য কথাটা প্রায় লুফে নিয়ে বলল, ঠিক বলেছিস। আমি বিয়ে করবই ভাবছি। কিন্তু কাকে বিয়ে করা যায়? পলা, তোকে তো পাওয়া যাবে না। তোর তো ক্যাণ্ডিডেট আছে। পাইলটদাদা তোর জন্য আগেই লাইন দিয়েছে না? শিখাও বড্ড রাগি। তুই দেবযানীকে জিজ্ঞেস কর তো, আমাকে বিয়ে করবে কিনা? জিজ্ঞেস কর না?

তুই জিজ্ঞেস করতে পারছিস না?

ও যে আমার সঙ্গে কথা বলে না। তুই জিজ্ঞেস করে দেখ। ও রাজি হলেই আমি রাজি আছি। বিয়েটা কিন্তু হিন্দুমতে হবে না। ইরানে এখনও যেরকম চালু আছে—এক রাত্তিরের জন্য কনট্র্যাক্ট ম্যারেজ।

শিখা বলল, অনিন্দ্য, তুই এবার মার খাবি কিন্তু–

দেবযানী জ্বলন্ত চোখে শিখার দিকে তাকিয়ে বলল, এইজন্যই আমি চলে যেতে চেয়েছিলাম! তবু তুই আমাকে বসিয়ে রাখলি, এইসব অপমানের কথা শোনবার জন্য?

শিখা বলল, চলে যাবি কেন? ওরা যা ইচ্ছে করলেই কী আমরা মেনে নেব? আমরা উত্তর দিতে পারি না?

এইসব ইতরের মতন কথাবার্তার উত্তর দিতেও আমার ঘেন্না করে।

পলা বলল, সত্যি, অনিন্দ্যটা দেবযানীকে দেখলেই পেছনে লাগে। এমন অপমানজনক কথা, আমাকে বললে তো আমি মার লাগাতাম।

অনিন্দ্য মুচকি হেসে বলল, কেন রে, এক রাত্রের বিয়েটা কি খারাপ?

দেবযানী আর দেরি করল না। তক্ষুনি উঠে এসে অনিন্দ্যকে এক চড় মারতে গেল। অনিন্দ্য হাত দিয়ে মুখখানা ঢেকে ফেলতেই দেবযানী তার চুলের মুঠি ধরে টানল। পলা আর শিখাও উঠে এসে দেবযানীকে সাহায্য করতে লেগে গেল, দুমদাম করে মারতে লাগল অনিন্দ্যকে। কোমল হাতের আদর নয়। রীতিমতন শক্ত হাতের শাস্তি। দেবানী অনিন্দ্যর মাথাটা দু-তিনবার জোরে ঠুকে দিল টেবিলে। ধূতিকান্ত হাঁ করে চেয়ে রইল।

কিছুক্ষণ বাদে মেয়ে তিনটি নিবৃত্ত হওয়ার পর অনিন্দ্য আস্তে আস্তে মাথা তুলল। তার ফর্সা মুখে একটা লালচে ভাব ছড়িয়ে গেছে। চুলগুলো সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। কপালের ডান দিকে বাতাসার সাইজে ফুলে উঠেছে।

সে প্রথমেই ধৃতির দিকে ফিরে দাঁত খিচিয়ে বলল, শালা, তুই চুপ করে বসেছিলি কেন? কিছু করতে পারিসনি?

ধৃতি হাতের তালু উলটে বলল, যা বাবাঃ! আমি কী করব?

দেবযানী তখনও রাগে ফুসছে। ঘন ঘন নিশ্বাসে দুলে উঠছে তার বুক। সে বলল, আবার একটাও খারাপ কথা বললে আবার মারব।

অনিন্দ্য বলল, আমার বড় লেগেছে।

লাগুক! তাও তোমার উচিত শিক্ষা হয়নি।

এখন একটু সেবা করবে না? মেয়েরা তো দয়াময়ী হয়।

তোমার দিকে তাকাতেও আমার ঘেন্না হয়।

একটা জিনিস লক্ষ করেছ। আমি কিন্তু একবারও বাধা দিইনি। দিতে কী পারতাম না? শিভালরি জিনিসটা আমার মধ্যে এখনও আছে! আজ আমি এখানে ডিক্লেয়ার করে যাচ্ছি, মেয়েরা আমাকে যতই মারুক, আমি কোনোদিন বাধা দেব না।

তারপরই সে হো-হো করে হেসে উঠল। যেন নিজের ভেতরে সে একটা দারুণ মজায় মশগুল হয়ে আছে। কপালের ফুলো জায়গায় এমন সাবধানে হাত বুলোতে লাগল যেন কোনো ফুলকে আদর করছে। তারপর বলল, একটা সত্যি কথা বলব? মার খেতে আমার খুব ভালো লাগছিল। ব্যথা লাগছিল, সেইসঙ্গে আরামও পাচ্ছিলাম। মেসসাকিজম কাকে বলে জানিস? আমি বোধ হয় মেসসাকি। আমি আবার এইরকম আরাম পেতে চাই। সুতরাং আমি এইসব কথা আবার বলব।

সদর্পে উঠে দাঁড়িয়ে সে বলল, ধৃতি, তুই সত্যি করে বল তো, দেবযানীর ঠোঁট দুটো দেখলেই চুমু খেতে ইচ্ছে করে কি না!

দেবযানী সঙ্গে সঙ্গে মুখ নীচু করল।

অনিন্দ্য হাসতে হাসতে বলল, অত লজ্জা পাওয়ার কী আছে? কারুর ঠোঁট যদি সুন্দর হয়–

শিখা বলল, বেরিয়ে যা!

যাব না!

ধৃতি, তোমার বন্ধুকে নিয়ে যাও এখান থেকে, নইলে ভালো হবে না কিন্তু।

ধৃতি ব্যস্ত হয়ে বলল, আমি ভাই ফ্র্যাঙ্কলি বলছি, অনিন্দ্য যেরকম ব্যবহার করছে সেটা আমারও খারাপ লাগছে। এই অনিন্দ্য, কী হচ্ছে কী?

শাট আপ!

কেন ওদের শুধু শুধু রাগাচ্ছিস?

কারুকে যদি বলি তার ঠোঁট দেখলেই চুমু খেতে ইচ্ছে করে–সেটা শুনে তার রাগ করা উচিত নয়। আমি বাজি ফেলে বলতে পারি, দেবযানী রাগ করেনি। বড়োজোর লজ্জা পেয়েছে একটু।

দেবযানীর মাথার চুল উঁচু করে বাঁধা। সে এবার রাজেন্দ্রাণীর মতন ঘুরে দাঁড়ালো। স্ফুরিতাধরে বলল, আমি রাগও করিনি, লজ্জাও পাইনি। আমার ঘেন্না হচ্ছে তোমার কথা শুনে। শিখা, আমরা কতক্ষণ এ-রকম বাঁদরামি সহ্য করব?

ধৃতি বলল, অনিন্দ্য চল।

তোর ইচ্ছে হয়, তুই যা।

শিখা বলল, অনিন্দ্য, তুই এখন না গেলে তোকে জোর করে বার করে দেব।

কে জোর করছে? আমি জানি, তোর বাবা-কাকা-দাদারা কেউ এখন বাড়িতে নেই।

চাকররা আছে।

চাকর-বাকরদের দিয়ে কি অনিন্দ্য মজুমদারকে তাড়ানো যায়? লোকে কী বলবে? লোকে তো আমাকে ভালোছেলে বলেই জানে।

পড়াশুনোয় ভালো হলেই কেউ ভালো হয় না। তোর ভেতরে একটা শয়তান আছে।

অনিন্দ্য আবার হাসল অবজ্ঞা ও ব্যঙ্গ মিশিয়ে। তারপরই পাশ ফিরে খুবই সহজভাবে বলল, হোয়াট অ্যাবাউট আ কিস, দেবযানী? চমৎকার বৃষ্টির দুপুর!

দেবযানী আবার মারতে আসছিল, তাড়াতাড়ি ধৃতি মাঝখানে এসে বাধা দিয়ে বলল, আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি। আমি ওর হয়ে ক্ষমা চাইছি। সব কিছু নিয়েই ওর ঠাট্টা! অনিন্দ্য, যথেষ্ট হয়েছে আর না। শুধু এ-রকম অসভ্যতা ছাড়াও ছেলে-মেয়েরা একসঙ্গে মিলেমিশে অনেক কাজ করতে পারে। আমি বলছিলাম কি, এখন তো ছুটি আছে, এখন সবাই মিলে কিছু একটা কাজ করতে পারি না? আমি ভাবছিলাম, শিখার বাড়িতে কিংবা আমার বাড়িতে যদি সিটিজেনস কমিটির একটা ব্রাঞ্চ খুলি, তাহলে এই শহরের উন্নতির জন্য..!

অনিন্দ্য বলল, অর্থাৎ সেক্স রিপ্রেশানস চাপা দেওয়ার জন্য ছেলে-মেয়েদের গা ঘেঁসাঘেঁসি করে কাজ-কাজ খেলা।

ছিঃ অনিন্দ্য!

আমি ভন্ডামি একদম সহ্য করতে পারি না।

ধৃতি এবার মেজাজ গরম করে বলল, কীসের ভন্ডামি? তুই নিজেই তো একটা ভন্ড। বাড়িতে ভালো সেজে থেকে বাইরে লোককে জ্বালাতন করিস। তোর কি কোনো ভালো জিনিস সহ্য হয় না? যদি খেলার মতন করেও কিছু ভালো কাজ হয়, যদি একটা বস্তির অন্তত কুড়িটা ছেলেকেও রোজ দুধ দেওয়া যায়—

অনিন্দ্যকে অগ্রাহ্য করে পলা বলল, আমরা সেইরকমই একটা জিনিস ভাবছিলাম। আমরা ঠিক করেছি, একটা পত্রিকা বার করব। সবাই মিলে খাটব। পত্রিকা থেকে যা লাভ হবে, সেটা দিয়ে আসব মাদার টেরেসাকে।

ধৃতি উৎসাহিত হয়ে বলল, খুব ভালো কথা! যদি একটা নন-পলিটিক্যাল কাগজ বার করা যায়।

অনিন্দ্য বলল, সাহিত্য? বেকার বাঙালির একমাত্র পেশা! তার ওপর আবার মহিলা সাহিত্যিক। ওরে বাবা!

আবার অনিন্দ্যকে অগ্রাহ্য করে পলা বলল, বস্তির ছেলেদের জন্য একটা ছোটোখাটো স্কুল করার প্ল্যান দিয়েছে শিখার দাদা।

অনিন্দ্য বলল, অর্থাৎ পলা যখন অফিসারের স্ত্রী হবে, তখন যাতে বস্তি থেকে মোটামুটি ভালো চাকর পাওয়া যায়।

ধৃতি বলল, আঃ! তুই কি আমাদের কোনো কথা বলতে দিবি না।

তোরা আমার কথা শুনছিস না কেন? আমি অনেক ভালো সাবজেক্টের কথা বলছিলাম। আমি বলছিলাম চুমু খাওয়ার কথা। দেবযানী যদি রাজি থাকে।

ধৃতি অনিন্দ্যর কাঁধে হাত দিয়ে বলল, চল, এক্ষুনি বাইরে চল।

অনিন্দ্য এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ধৃতিকে এমন একটা ধাক্কা মারল যে সে আর একটু হলেই ছিটকে পড়ে যাচ্ছিল। বন্ধু হয়েও সে যে এত জোরে ধাক্কা দেবে ধৃতি সেটা অনুমানই করতে পারেনি।

ধৃতি আর কিছু বলার আগেই শিখা এগিয়ে এল অনিন্দ্যর কাছে। খুব নরমভাবে বলল, অনিন্দ্য শোন—

কী?

আমরা তোর বন্ধু হতে চাই।

আমিও-তো তাই-ই চাইছি। তবে মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব বিছানাতেই ভালো হয়!

দু-জনে দু-জনের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল কয়েক পলক। তারপর শান্ত গলাতেই বলল, তুই আমার বাড়িতে এসে সকলের সামনে দেবযানীকে এ-রকম কথা বলছিস কেন? কেন ওকে অপমান করছিস?

অপমান করতে চাইনি তো? দেবযানীকে কি কখনো কেউ চুমু খায়নি?

তুই জানিস না, কোনো মেয়েকে এসব কথা বলার আগে বলতে হয় তাকে ভালোবাসিস কি না?

কী করে ভালোবাসার কথা বলব? তোর বাড়িতে যদি এত ভিড় না থাকত, যদি তুই একলা থাকতিস, তাহলে নিশ্চয়ই তোকে খুব ভালো ভালো ভালোবাসার কথা শোনাতাম। দেবযানীর বাড়ি ভীষণ কনজারভেটিভ, ওদের বাড়িতে যাওয়া যায় না, কোথায় ভালোবাসার কথা শোনাব? পলা তো আউট অব বাউণ্ডস হয়ে গেছে।

যেকোনো মেয়েকে তুই ভালোবাসার কথা জানাতে পারিস?

পাচ্ছি না তো সেরকম কারুকে। তোকে কজন প্রেম জানিয়েছে? যারা তোর ওসব চান্স নিয়েছে।

আচমকা শিখা খুব জোরে একটা চড় মারল অনিন্দ্যর ডান চোখের ওপর। অনিন্দ্য দু হাতে চোখ ঢেকে ফেলল। সেই অবস্থাতেই হাসতে হাসতে বলল, এত পটপট করে তোরা গায়ে হাত তুলতে পারিস, আর ঠোটটা ছোঁয়াতেই যত আপত্তি? এবার কিন্তু জোর করে তোদের তিনজনকেই একসঙ্গেই–

শিখা আর একটা চড় মারল। পলা ধরল ওর কান। দেবযানী পেছন থেকে সবটা শক্তিতে একটা ধাক্কা দিয়ে ওকে ফেলে দিল মাটিতে।

ধৃতি তিক্তভাবে বলল, ঠিক হয়েছে।

তারপর স্পার্টার্ন রমণীদের মতন ওরা তিনজন আক্রমণ চালালো অনিন্দ্যর ওপরে। দুম দুম করে ঠুকে দিতে লাগল ওর মাথা। অনিন্দ্য একটুও প্রতিরোধ করল না। নিঃশব্দে মার খেতে লাগল। শিখা ওর পিঠের ওপর বসে পড়ে হাত দুটো মুচড়ে ধরে থেকে পলাকে বলল, আলমারির মধ্যে একটা কাঁচি আছে, দে তো? ওর চুলগুলো সব কেটে দিই!

অনিন্দ্যর সৌভাগ্যবশত আলমারির মধ্যে কাঁচিটা খুঁজে পাওয়া গেল না। তার বদলে একটা পুরোনো ব্লেড পড়েছিল। পলা বলল, এইটা দিয়ে ওর একটা ভুরু কামিয়ে দিবি!

একটু দূরে দাঁড়িয়ে ধৃতি হাতের ইশারায় বলল, আর থাক!

দেবযানী দুটো কান ধরে অনিন্দ্যর মুখটা ঘুরিয়ে দিল। তারপর চটিসুদ্ধ একটা পা তার চোখের সামনে ধরে বলল, দিই, ঘসে দিই?

অনিন্দ্য নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল।

দেবযানী সত্যিই চটিটা ঘসে দিল অনিন্দ্যর ঠোঁটে। খুব জোরের সঙ্গে। এত বেশিক্ষণ সে ঘসতে চাইছিল যে পলাই তার হাত ধরে টেনে সরিয়ে আনল।

ওরা ছেড়ে দেওয়ার পর অনিন্দ্য আস্তে আস্তে উঠে বসল। একেবারে বিধ্বস্ত অবস্থা। থুথু করে মুখের ধুলো বার করতে লাগল হাতের রুমালে। তারপর শিখার দিকে তাকিয়ে বলল, একটা ভিজে তোয়ালে পাওয়া যাবে?

শিখার শরীরে তখন অনেক রাগ, তাই কথার কোনো উত্তর দিল না।

অনিন্দ্য হাতটা উঁচু করে ধৃতিকে বলল, ধর।

ধৃতি হাত ধরে তাকে টেনে তুলে বলল, আমি তোকে বারন করেছিলাম। অনিন্দ্য বলল, ছেলেরা আমার গায়ে হাত তুলতে চট করে সাহস পায় না। কিন্তু আমার এই ধরনের কিছু শাস্তি পাওনা ছিল, তাই না?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *