শনিবার বিকেলে দপ্তরে বসে একটি সদ্য পাওয়া পাণ্ডুলিপির পাতার উপর মুগ্ধদৃষ্টি রেখে ঘাড় গুঁজে বসে আছি। আড্ডাধারী বন্ধুরা একে-একে হাজির হয়েছেন, সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। আমার তন্ময়তা ভঙ্গ করবার জন্য আড্ডার সব্যসাচী লেখক বললেন–
রাবীন্দ্রিক ধাঁচের হাতের লেখার পাণ্ডুলিপি কি না, তাই এত মনোযোগ। আমাদের দিকে আর চোখ তুলে তাকাবার ফুরসত হচ্ছে না।
আড্ডার গাল্পিক লেখক বললেন—রাবীন্দ্রিক হাতের লেখার প্রতি আশ্রমিকদের কেমন যেন একটা দুর্বলতা আছে। কোন পাণ্ডুলিপি যদি রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখার ধাঁচে হয়, তাহলে আর তা পড়ে দেখারও প্রয়োজন হয় না। সে-লেখা সরাসরি প্রেস-এ চলে যায়। রবীন্দ্রনাথের মত হাতের লেখা যখন, তখন লেখার হাত থাকতেই হবে।
আমাকে একটু কটাক্ষ করেই সব্যসাচী লেখক বললেন–ওঁর ভাবটা হচ্ছে প্রহলাদের মত। হাতে খড়ির সময় ক লিখতে গিয়ে কৃষ্ণ বলে কেঁদে আকুল।
তরুণ কবি বললেন–আপনারা কী বলতে চান। এই পত্রিকায় মাঝে মাঝে আমার কবিতা প্রকাশিত হয়, সেটা কি শুধুই আমার রাবীন্দ্রিক হাতের লেখার জন্যে? রচনার গুণে নয়?
সব্যসাচী লেখক সুযোগ পেলেই তরুণ কবিকে একটু বেকায়দায় না ফেলে ছাড়েন না। বললেন, সত্যি কথা বলতে কি, ফিফটি-ফিফটি।
ফিফটি-ফিফটি! তার মানে? কবির কণ্ঠে একটু উষ্মর আভাস।
হাতের লেখা পঞ্চাশ আর দুর্বোধ্যতা পঞ্চাশ।
এই বাক-বিতণ্ডা থেকে তরুণ কবিকে উদ্ধার করা প্রয়োজন, আর প্রয়োজন এই অভিযোগ থেকে আত্মপক্ষ সমর্থনের। পাণ্ডুলিপি একপাশে সরিয়ে রেখে বললাম-পরীক্ষার্থী ছাত্র আর যশঃপ্রার্থী লেখকদের হাতের লেখা পরীক্ষক ও পত্রিকা সম্পাদকের উপর কিছুটা প্রভাব বিস্তার করে বই কি! তা বলে ভাল রচনা হাতের লেখার দোষে পরীক্ষায় কম নম্বর পেলেও পত্রিকার সম্পাদক বাতিল করে দেবেন, এমনটা কদাচিৎ ঘটে।
সব্যসাচী লেখক বাধা দিয়ে বলে উঠলেন—হাতের লেখার দোষে যে ভাল লেখা সম্পাদকের দপ্তর থেকে বাতিল হয়ে যায় তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমার আছে।
আমরা সবাই উৎসুক হয়ে উঠলাম নতুন কিছু খবর শোনার লোভে।
সব্যসাচী লেখক বললেন–১৯৩৬ সালের কথা। নবশক্তি পত্রিকা। তখন পার্ক সার্কাস থেকে বেরোয়। প্রেমেন্দ্র মিত্র নামে সম্পাদক, পত্রিকা। প্রকাশের দায়িত্ব একা অদ্বৈত মল্লবর্মণের ঘাড়ে। আমি মাঝে-মাঝে লেখা নিয়ে যাই। মিষ্টভাষী এই ক্ষীণকায় মানুষটির বিনয়নম্র স্বভাব আমাকে খুবই আকর্ষণ করত। কিন্তু যখনই গিয়েছি, দেখেছি কাজের চাপে অত্যন্ত বিব্রত। এক হাতে তাকে সব কিছুই করতে হয়। জমিয়ে বসে গল্প করার ইচ্ছে উভয়ের থাকা সত্ত্বেও দু-চার কথার পর বিদায় নিয়ে চলে আসতাম। কিছুদিন বাদে অফিসের পর বিকেলে নবশক্তির কার্যালয়ে গিয়ে দেখি অদ্বৈত বাবু নেই। তার জায়গায় বসে আছেন একটি নব্য ছোকরা। পরনে মিহি খদ্দরের ধুতি-পাঞ্জাবি, কাধের উপর পরিপাটি ভঁজে ইস্ত্রি করা একটি কালোপাড়ের মাদ্রাজী সাদা চাদর। ঘরে ঢুকতেই নব্য ছোকরা গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করলেন—কি চাই?
—অদ্বৈতবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম।
তিনি এক মাসের ছুটি নিয়ে দেশে গেছেন। কিছু প্রয়োজন আছে?
আপনারাই বলুন। এরকম কাঠখোট্টা মেজাজের লোকের কাছে এয়োজনের কথা বলবার প্রবৃত্তি হয়? খামটা পকেটেই ছিল পকেটেই থেকে গেল। তবু একটু অন্তরঙ্গতা দেখবার জন্য বললুম—একটু জল খাওয়াতে পারেন?
অপেক্ষা করতে হবে। বেয়ারাটা কাগজ নিয়ে ডাকঘরে গেছে, এই এল বলে।
মনে মনে ভাবলুম, ভদ্রতার খাতিরে অন্তত দু-চারটা কথা বলবেন।
কিন্তু ছোকরা সাজ-পোশাকে খদ্দর-মার্কা হলে হবে কি, আমার দিকে দ্বিতীয়বার ফিরেও তাকাল না। টেবিলের উপর ডান হাতের কাছে এক বাণ্ডিল খালি খাম, বাঁ দিকে একতাড়া খাম ভর্তি ডাকে-আসা গল্প-প্রবন্ধ। বাঁ দিক থেকে একটা খাম তুলে আলোর দিকে মেলে ধরে খালি অংশটুকু ফড়াৎ করে একটানে ছিড়ে ফেললেন। বেরিয়ে এল একটি কবিতা। কবিতার নাম ও লেখকের নামের উপর একবার চোখ বুলিয়েই বলে উঠলেন—আহা, কী কবিতার নাম। সুমিতাকে। সুমিতাকে নিয়েই যদি কবিতা লিখবি সেটা সুমিতার হাতেই দিয়ে এলে পারতিস। আমাদের জ্বালানো কেন।
বলার সঙ্গে সঙ্গে ডানদিকের খালি খামের বাণ্ডিল থেকে আরেকটা খাম তুলে তার মধ্যে কবিতাটা ভরে খস্ খস্ করে লেখকের নাম-ঠিকানা লিখে ফেললেন।
আবার বাঁ দিকের খামে হাত। আবার ফড়াৎ শব্দে হেঁড়া। এবার বেরিয়ে এল একটি গল্প। সঙ্গে সঙ্গে স্বগতোক্তি হল-যেমন হাতের লেখা, তেমনি গল্পের আকার, তেমনি লেখকের নাম।
ডান হাতের খাম উঠে এল। গল্পটি তার মধ্যে কবরস্থ হতেই আমি উঠে পড়লাম। চোখের সামনে লেখার উপর এমন কসাইগিরি আর কতক্ষণ সহ করা যায়! ভদ্রলোকের তখন ক্ৰক্ষেপ নেই যে একজন আগন্তুক জল খেতে চেয়ে না খেয়েই বেরিয়ে যাচ্ছেন। দরজার চৌকাঠ পার হয়ে রাস্তার সিঁড়িতে পা দেবার আগে আমার এই নিঃশব্দে চলে যাওয়াটা ওঁর নজরে পড়েছে কি না জানবার জন্যে পিছন ফিরে তাকালাম। তিনি তখনও আপন মনে ছিড়ছেন আর তরছেন, ছিড়ছেন আর ভরছেন। যেমন আসা তেমনি যাওয়া।
এ পর্যন্ত বলেই সাব্যসাচী লেখক আমার দিকে তাকিয়ে থেকে মুচকি হাসতে লাগলেন। ভাবখানা, বুক সাধু যে-জান সন্ধান।
সন্ধান জানবার আগেই কথার মোড় ফেরাবার উদ্দেশ্যে আমি বললামআপনার অভিজ্ঞতাকে স্বীকার করে নিয়ে এর বিপরীত নজীরও আমি দেখাতে পারি। সুবোধ ঘোষের উদাহরণ দিয়েই বলি। সুবোধবাবুর হাতের লেখা। যারা দেখেছেন তারাই জানেন যে, তার হাতের লেখার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় না থাকলে পাঠোদ্ধার সহজসাধ্য নয়। সুবোধবাবুর প্রথম উপন্যাস তিলাঞ্জলি দেশ পত্রিকায় প্রকাশের জন্য পাণ্ডুলিপি প্রেসে পাঠানো হল। কম্পোজ করতে গিয়ে লাইনে অপারেটার হিমসিম। কাজের স্পীড গেল কমে, এক ঘন্টার কাজ দুঘণ্টা সময় লাগে। প্রুফ যখন এল তা সংশোধন করতে গিয়ে ক্ষতবিক্ষত, করেকশন করা মানে নতুন কম্পোজের সামিল।
একদিন দুপুরে দপ্তরে বসে আছি। তখন আনন্দবাজার রবিবাসরীয় বিভাগ আর দেশ-এর দপ্তর ছিল একই ঘরে, পাশাপাশি টেবিলে। সুবোধবাবু তখন রবিবাসরীয় বিভাগে কাজ করেন, তিনিও বসে আছেন। এমন সময় প্রেস থেকে লাইনো বিভাগের ইন-চার্জ একটা পাণ্ডুলিপি হাতে ঘরে এসে উপস্থিত।
ঘরে ঢুকেই তিনি বোমার মত ফেটে পড়লেন—এই লেখকের লেখা এত দুর্বোধ্য যে, কোন অপারেটর কম্পোজ করতে চায় না। এই লেখককে কেন আপনারা বলেন না, আরেকটু ধরে ধরে সুস্পষ্ট করে লিখতে–এই বলে সুবোধবাবুর উপন্যাসের কপি শূন্যে তুলে ধরলেন।
আমি তো হতবাক। আরক্তিম মুখে সুবোধবাবু আমার দিকে তাকিয়ে। সুবোধবাবুর লেখক-খ্যাতি তখন ব্যাপক ছিল না এবং লাইনো বিভাগের লোকেদের তখন জানবার কথাও নয় কে সুবোধ ঘোষ।
এই অস্বস্তিকর অবস্থার যবনিকা টানবার জন্য আমি তাড়াতাড়ি সুবোধবাবুর দিকে দেখিয়ে বললাম-এই যে, এই ইনিই লেখক, এরিই নাম সুবোধ ঘোষ।
সঙ্গে সঙ্গে অপারেটর ভদ্রলোক লজ্জায় কাচুমাচু। এক গাল হেসে কিন্তু কিন্তু করে বললেন—এই বুঝেছেন কি না, আমি ঠিক বুঝতে পারি নি
অপারেটরকে সঙ্কোচ থেকে উদ্ধারকল্পে বললাম-আমাদের কাগজের সম্পাদক বঙ্কিমবাবুর হাতের লেখা যদি কম্পোজ করতে পারেন তাহলে সুবোধবাবুর হাতের লেখা কেন পারবেন না?
-বঙ্কিমবাবু বহু বছর ধরে লিখছেন, পুরনো অপারেটাররা ওর লেখার ধচি এতদিনে বুঝে ফেলেছে।
অমি বললাম-সুবোধবাবুও বহু বহু বছর ধরেই লিখবেন। ততদিনে ওঁর। হাতের লেখার ধাঁচও আপনার অপারেটাররা বুঝে ফেলবে।
এই ঘটনার বেশ কিছুকাল পরে সুবোধবাবু যখন আনন্দবাজার পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক, নিয়মিত সম্পাদকীয় লেখেন তখন প্রেস-এর একজন লইনো অপারেটার কী কারণে খবর না দিয়েই ডিউটি থেকে ডুব মারে। পরদিন ডিউটিতে আসামাত্র সেই লাইনো-ইনচার্জ ভদ্রলোক খুব খানিকটা বকাবকি করে বললেন–ফের যদি এরকম হয় তাহলে তোমার চাকরি থাকবে
বলে দিচ্ছি।
উত্তরে সে লোকটি গম্ভীর হয়ে বললে-সুবোধবাবুর যতদিন এখানে চাকরি আছে ততদিন আমার চাকরি মারে কে।
বহু বছর পরে এই লাইনে ইনচার্জ পুজা সংখ্যায় সুবোধবাবুর একটি গল্প শেষ মুহূর্তে পেয়ে অলৌকিক কার্যক্ষমতার পরিচয় দিয়েছিলেন, সে-গল্প বারান্তরে আপনাদের বলব।
বৈঠকের গাল্পিক সাহিত্যিক গল্প শুনতে এবং গল্প বলতে খুবই ভালবাসেন। কিন্তু তার একটা অভ্যাস হচ্ছে টু দি পয়েন্ট থাকা। অর্থাৎ যে-প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনার শুরু সে-প্রসঙ্গ যদি গল্পের তোড়ে ডালপালা বিস্তার করতে করতে প্রসঙ্গান্তরে চলে যাবার চেষ্টা করে তাকে আবার মূল কাণ্ডে ফিরিয়ে আনা। তাই বিরক্তির ভাব প্রকাশ করে বললেন–যে কথা শুরুতে হচ্ছিল সেই কথাই হোক। রাবীন্দ্রিক হাতের লেখার যে বিরাট পাণ্ডুলিপিটার উপর আপনি এতক্ষণ হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন সে-বস্তুটি কী জানতে পারি?
ভ্রমণ-কাহিনী।
আমার কথা শুনে সব্যসাচী সাহিত্যিক গাল্পিক-সাহিত্যিককে একটু ভরসা দেবার সুরে বললেন–
যাক, বেঁচে গেলেন। উপন্যাস তো নয়। উপন্যাস হলেই ভয়—আবার একজন প্রতিদ্বন্দ্বী দেখা দিল।
আমি বললাম-না-ই বা হল উপন্যাস। এ-লেখার জাতি-পাঁতি স্বতন্ত্র। উপন্যাস এর ধারে কাছে লাগে না।
দশ জোড়া বড় বড় চোখে একরাশ বিস্ময়ভরা প্রশ্ন জেগে উঠল–লেখকটি কে?
—আপনারা চিনবেন না। সৈয়দ দা।
আবার প্রশ্ন—সৈয়দ দা, তিনি আবার কে?
আমি বললুম—ডক্টর সৈয়দ মুজতবা আলী। শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্র। সেই সুবাদে আমার সৈয়দ দা।
সব্যসাচী লেখক বললেন–তাহলে তো আর কিছু বলা যাবে না। একে রাবীন্দ্রিক হস্তাক্ষর তদুপরি শান্তিনিকেতনিক। এ-লেখা তো অবশ্য প্রকাশিতব্য।
আমি বললাম—আগামী সপ্তাহ থেকেই লেখাঁটি প্রকাশিত হবে। আপনারাই তখন বিচার করবেন লেখাঁটি প্রকাশিতব্য কিনা। তবে এটুকু আপনাদের বলে রাখছি, এই এক বই লিখেই ইনি বাংলা সাহিত্যে পাঠকচিত্ত জয় করবেন।
গাল্পিক বন্ধু বললেন—আচ্ছা, বেশ কিছুকাল আগে পরিচয় পত্রিকায় ভাষাতত্ত্ব নিয়ে এর একটি প্রবন্ধ পড়েছিলাম মনে পড়ছে। তিনি কি ইনি?
আমি বললাম-আপনি ঠিকই ধরেছেন তিনিই ইনি। সেখানে তিনি পণ্ডিত। কিন্তু এ লেখায় পাণ্ডিত্যের সঙ্গে সাহিত্যরসের অপূর্ব যোগাযোগ দেখতে পাবেন।
এই এক লেখাতেই বাংলা সাহিত্যজগতে সৈয়দ মুজতবা আলীর আসন পাকা হয়ে গেল। আজ তিনি সর্বশ্রেণীর পাঠকদের প্রিয় লেখক। তাঁর নিজের লেখা সম্বন্ধে তাকে প্রশ্ন করলে তিনি আনাতোল ফ্রাসের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে বলতেন, If you wish to travel more, travel light.—তোমার লেখাকে তুমি যদি সর্বত্রগামী করতে চাও, হালকা হয়ে লেখ, পণ্ডিতী ফলিও না।
আলোচনা প্রসঙ্গে বৈঠকে সেদিন কথা উঠল সাম্প্রতিক কালে প্রথম প্রকাশিত লেখায় কোন্ কোন্ লেখক স্বনামধন্য হয়েছেন।
বৈঠকের গাল্পিক বন্ধু আলোচনার বিষয় একটু গুরুগম্ভীর হয়ে পড়লে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন—এই বুঝি তর্কবিতর্ক শুরু হল, সেই সঙ্গে গলার শিরা ফুলিয়ে চিৎকার। তিনি হঠাৎ বলে উঠলেন-যে-যাই বলুন বাংলা সাহিত্যে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাস পথের পাঁচালী নিয়ে আর্বিভাব একটি চিরস্মরণীয় ঘটনা। সেই সঙ্গে যিনি কে আবিষ্কার করেছিলেন, বিচিত্রা-সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে আমরা চিরকৃতজ্ঞ।
ভবিষ্যতে বাংলা দেশে সাহিত্যিক উপেন্দ্রনাথের কোন রচনাই যদি স্মরণীয় হয়ে না থাকে তবু তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন দুটি লেখকের আবিষ্কর্তারূপে।
একজন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, অপরজন বিভূতিভূষণ। আর এই বিভূতিভূষণের সঙ্গে উপেন্দ্রনাথের প্রথম পরিচয়ের ঘটনাটা খুবই কৌতুককর।
এইটুকু বলেই গাল্পিক বন্ধু থামলেন। এটা তাঁর বরাবরের স্বভাব। শ্রোতাদের একটা উৎকণ্ঠার মধ্যে এনেই বিরতি! আমাদের প্রতিক্রিয়াটা উপভোগ করবার জন্যই বোধ হয় একটা কর্ণরোচক গল্পের সূত্রপাত করেই থেমে গেলেন।
আমরা সবাই হাঁ হাঁ করে উঠলাম—থামলেন কেন, ঘটনাটা বলুন!
কোন উত্তর নেই। নির্বিকার চিত্তে পকেট থেকে আস্তে আস্তে নস্যির কৌটা বার করলেন। কৌটার ঢাকনিটার উপর পাকা তবলচীর মত তর্জনী দিয়ে দুবার টোকা মারলেন। সন্তর্পণে ঢাকনা খোলা হল, দু-আঙ্গুলে নস্যির টিপটি বাগিয়ে নিয়ে ঢাকনাটা বন্ধ করতে করতে বললেন—চা কোথায়?
আমি বললাম—সে আর আপনাকে বলতে হবে না। পকেট থেকে নস্থির কৌটো বার করতে দেখেই আমার বেয়ারা অমর কেটলি নিয়ে ছুটে বেরিয়ে গিয়েছে। এতদিন বৈঠকে আড্ডা দিচ্ছেন, ওর কি আর আপনাদের চিনতে বাকি আছে?
ইত্যবসরে চা এসে গেল। টেবিলের উপর রাখা কাপটার উপর উপুড় হয়ে সশব্দে চুমুক মেরেই একটা তৃপ্তির ধ্বনি ছাড়লেন।
কলকাতা বেতারে রবিবারের শিশুমহলের প্রারম্ভে পরিচালিকা তার শ্রোতাদের উদ্দেশে যখন বলেন-তোমরা সব ভাল আছ তো? তখন পাখিপড়ার মত শেখানো একদল কচিকণ্ঠের আওয়াজ ভেসে আসে—হ্যাঁ-
চায়ের কাপে দ্বিতীয়বার চুমুক মেরেই আমাদের গাল্পিক বন্ধু যখন বললেন–তা হলে গল্পটা শুরু করি। আমরা সমস্বরে বলে উঠলাম-হ্যাঁ-
গল্প শুরু হল।
বাঙালীটোলা জানেন তো? ভাগলপুরের বাঙালীটোলা? সেই বাঙালী টোলার গাঙ্গুলীরা হচ্ছে সেখানকার বিখ্যাত বনেদী পরিবার, শরৎচন্দ্রের মামাবাড়ি। শরৎচন্দ্রের শৈশব ও কৈশোর কেটেছিল ওই মামাবাড়িতে। আমাদের উপেনদা ওই গাঙ্গুলী পরিবারের ছেলে। কলকাতা থেকে আইন পাস করে উপেনদা এলেন ভাগলপুরে ওকালতি ব্যবসার উদ্দেশ্যে। কিন্তু কলকাতা অধ্যয়নকালেই সাহিত্যের নেশায় তিনি মশগুল; ভারতবর্ষ, সাহিত্য ইত্যাদি পত্রিকায় তার লেখা বেরিয়েছে, কিছু সাহিত্যিক খ্যাতিও তিনি অর্জন করেছেন।
কাবুলীওয়ালা যেমন হিংয়ের ঝুলি বাড়িতে রেখে এলেও তার গা দিয়ে হিং-এর গন্ধ বেয়োয়, উপেনদা সাহিত্যের পাট কলকাতায় চুকিয়ে দিয়ে অর্থ উপার্জনের আশায় ভাগলপুরে ওকালতি করতে এসেও একটি সাহিত্যের আড্ডা জমিয়ে তুললেন। মানুষটি একে সাহিত্য-পাগল, তায় মজলিসী। রোজ সন্ধ্যায় তার বাড়ির বৈঠকখানায় একটা জমাটি আড্ডা বসত। গান-বাজনার সঙ্গে মজলিসী গল্প, সেই সঙ্গে চলত সাহিত্য আলোচনা।
ভাগলপুরে বহুকাল থেকেই সাহিত্যের আবহাওয়া আপনা থেকেই গড়ে উঠেছিল। উপেনদার আড্ডায় সাহিত্যেৎসাহী অনেক বাঙালীই রবাহূত আসতেন-যেতেন, কেউ কিছু মনে করতেন না।
সেই সময় একটি অপরিচিত বাঙালী যুবকের উপেনদার আড্ডায় ছিল নিত্য যাওয়া-আসা! পরনে গোড়ালি ছুঁই-ছুঁই খাটো ধুতি, গায়ে ইন্ত্রি-বিহীন নিজহাতে কাচা মার্কিন কাপড়ের পাঞ্জাবি। এক হাতে লণ্ঠন, অপর হাতে লাঠি। প্রতিদিন সন্ধ্যায় আর এক কোণে সবার পিছনে সবার অগোচরে চুপচাপ বসে থাকেন, আডড়া শেষ হলে যেমন নিঃশব্দে আসেন, তেমনি নিঃশব্দে চলে যান। মানুষটি যে কে, সে পরিচয় নেবার প্রয়োজন কখনও ঘটে নি। আড্ডায় আসেন যান এইটিই তো একমাত্র পরিচয়। পূর্বপরিচয়ের প্রয়োজন কি।
শরতের পর শীত পার হয়ে বসন্তকালও চলে গেল, এল গ্রীষ্ম। ভাগলপুরের গ্রীষ্ম তো জানেন, যতক্ষণ বোদ ততক্ষণ বাইরে বেরনো যায় না, সন্ধ্যের পর লোকে একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। কোর্ট বন্ধ। উপেনদা সারাদিন ঘরে বসে নতুন উপন্যাস লিখছেন, সন্ধ্যে হলেই আড্ডার জন্য উন্মুখ হয়ে বৈঠকখানায় বসে অপেক্ষা করছেন। এমন সময় দেখা দিল ধুলো উড়িয়ে প্রচণ্ড কালবৈশাখীর ঝড়। উপেনদার মন খারাপ। এই ঝড়ের মধ্যে আজ আর কি কেউ আসবে? বু প্রতিদিনের অভ্যাসমত বৈঠকখানাঘরে বসে আছেন, ঝড়ের জন্য সেদিন দরজা জানলা বন্ধ। বাইরে অন্ধকার নেমে এসেছে, ঝড়ের দাপট কিছু কম, দু-চার ফোঁটা বৃষ্টিও পড়ছে যেন। দরজাটা খুলে বাইরের রাস্তার দিকে তাকাতেই দেখতে পেলেন দূর থেকে একটি লণ্ঠনের আলো তাঁরই বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে, সঙ্গে একটা ছায়ামূর্তি। যাক একজনকে অন্তত পাওয়া গেল, দুদণ্ড রসালাপ করে সন্ধ্যেটা তাহলে ভালই কাটবে।
ছায়ামূর্তি যখন কায়া নিয়ে তার ঘরের বারান্দায় হাজির হল, উপেনদা যেন একটু দমে গেলেন। মানুষটিকে পাঁচ ছয় মাস ধরে নোজই তাঁর বৈঠকখানায় দেখছেন বটে কিন্তু যেমন গম্ভীর তেমনি লাজুক। কথা খুবই কম বলেন, যেটুকু বলেন একেবারে রসকষহীন। এর সঙ্গে সাহিত্য নিয়ে আলোচনাই বা কী হবে, রঙ্গরসের কথা তো ছেড়েই দিলাম।
উপেনদার স্বভাব হচ্ছে সব মানুষের মধ্যেই গল্প বা উপন্যাসের চরিত্র খুঁজে বেড়ানো। মনে মনে ভেবে নিলেন এই নির্বাক মানুষটির জীবনে এমন কিছু উপাদান আছে যা তাঁর উপন্যাসের চরিত্রসৃষ্টির প্রয়োজনে লাগবে। সেই উদ্দেশ্যেই আগন্তুক নিকটবর্তী হতেই তাকে সাদর অভ্যর্থনায় ঘরে ডেকে তুললেন।
ঘরে ঢুকেই মানুষটি হাতের ছাতা লাঠি ও লণ্ঠন দেয়ালের ধারে রেখে ঘরের কোণার সেই নির্দিষ্ট বেঞ্চিতে গিয়ে বসলেন, যেখানে তিনি রোজই এসে বসেন।
প্রবল আপত্তি জানিয়ে উপেনদা বললেন—আপনি অত দূরে গিয়ে বসলেন কেন, সামনের চেয়ারটায় বসুন।
আগন্তুক সলজ্জ কণ্ঠে বললেন–আজ্ঞে আরও অনেকেই তো আসবেন, ওদের জায়গায় আমার বসাটা কি ঠিক হবে?
অভয় দিয়ে উপেনদা বললেন—আপনার সঙ্কোচের কোন কারণ নেই, ঝড় বৃষ্টি মাথায় করে আজ আর কেউ আসবে না। আপনি এগিয়ে এসে বসুন।
অত্যন্ত সংকোচের সঙ্গে উপেনদার সামনের টেবিলটার বিপরীত দিকের চেয়ারে এসে বসতেই উপেনদা বললেন–আমাদের আড্ডায় আপনার নিত্য যাওয়া আসা অথচ আপনার পরিচয়টাই নেওয়া হয় নি। এই আড্ডায় পরিচয়ের তো প্রয়োজন হয় না, মুখচেনা হলেই চিরচেনা। আপনার নামটা জানতে পারি?
—আজ্ঞে আমার নাম বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
–এখানে কী করা হয়?
–কলকাতা থেকেই এখানে এসেছি চাকরি নিয়ে।
–কলকাতা থেকে ভাগলপুরে এসেছেন চাকরি নিয়ে? কলকাতায় কি কিছু জুটল না?
প্রশ্নটার মধ্যে হয়তো উপেনদার নিজেরও কলকাতা ছেড়ে ভাগলপুরে ওকালতি করতে আসার জন্য একটা প্রচ্ছন্ন ক্ষোভ মিশে ছিল। কলকাতার সাহিত্যজীবন ছেড়ে নিছক অর্থের অন্বেষণে ভাগলপুরে এসে, মক্কেল নিয়ে পড়ে থাকাটায় ওঁর অন্তরের সায় ছিল না। সান্ত্বনার সুরে তাই আবার বললেন—
কলকাতায় একটু চেষ্টা করলেই তো একটা-না-একটা কাজ জুটে যেত।
–আজ্ঞে, মাস্টারি একটা জুটেছিল কিন্তু পোষালো না। অগত্যা এখানে খেলাত ঘোষেদের জমিদারী সেরেস্তায় নায়েবের কাজ নিয়ে চলে এসেছি।
–খেলাত ঘোষের জমিদারি? সে তো অনেক দূর। এখান থেকে চার পাঁচ মাইল তো হবেই। তাছাড়া গভীর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে যেতে হয় না?
-হ্যাঁ, মাইল দু-তিন পথ জঙ্গল পার হতে হয়।
একথা শুনে উপেনদা একেবারে থ হয়ে গেলেন। বিস্ময়ের ঘোরটা কেটে যেতে বললেন–
এই জঙ্গলে রাস্তা পার হয়ে রোজ আপনি এখানে আসেন! আপনার ভয় করে না? শুনেছি ওই জঙ্গলটায় হিংস্র জন্তুজানোয়ার থাকে, সাপখোপেরও অভাব নেই।
বিভূতিবাবু একটু সলজ্জ হাসি হেসে বললেন—ভয় পাবার কী আছে? জন্তু জানোয়ার থাকলেই বা কি? ওদের আক্রমণ না করলে ওরাও আমাকে কিছু করবে না। তাছাড়া জঙ্গলের একটা মোহ আছে, মায়া আছে যা আমাকে সবচেয়ে বেশী আকর্ষণ করে। আর সাপখোপের কথা বলছেন? ওই যে দেখছেন লাঠি, ওঠা যতক্ষণ হাতে থাকে ততক্ষণ আর কোন কিছুর ভয় আমার থাকে না।
উপেনদা মনে মনে খুশী হয়ে উঠলেন একটি অদ্ভুত চরিত্রের মানুষকে পেয়ে। বললেন—
আচ্ছা, প্রতিদিন আপনি এই দীর্ঘপথ হেঁটে আসেন, আড্ডায় এসে চুপচাপ বসে থাকেন তাও লক্ষ্য করেছি। কিন্তু কেন? কিসের টানে?
-কিসের টানে? আপনাকে কী করে বোঝাব বলুন। ভাগলপুরে আসবার আগেই বাঙ্গালীটোলায় আপনাদের বাড়ির কথা অনেক শুনেছি। শুনেছি শরৎচন্দ্র এই বাড়িতেই মানুষ হয়েছিলেন, এইখানেই তাঁর সাহিত্যসাধনার উৎস। তাছাড়া অনুরূপা দেবী, কেদার বন্দ্যোপাধ্যায় আরও অনেক নামকরা সাহিত্যিকই এই বাড়িতে সাহিত্যের আসর জমিয়েছেন। এ-বাড়ি তো আমার কাছে তীর্থক্ষেত্র। তার উপর রয়েছেন আপনি। আপনার বাড়ির সাহিত্যিক আড্ডার খবর আমি কলকাতা থেকে শুনে এসেছিলাম।
যা আশা করে উপেনদা এই মানুষটির সঙ্গে আলাপ জমিয়েছিলেন এখন দেখলেন এ-অন্য ধাতুতে গড়া। এর কথাবার্তার মধ্যে একটি শিল্পীমন লুকিয়ে আছে তার খানিকটা আভাস যেন উপেনদার কাছে ফুটে উঠল। আগ্রহের সঙ্গে উপেনদা বললেন–
আপনার গোপনে সাহিত্যচর্চার বাতিক আছে নাকি?
না এমন কিছু নয়, এই একটু আধটু—
লাজুক মানুষ তাই বলতে সঙ্কোচ। উপেনদা তাই সাহস দিয়ে বললেন–
আহা লজ্জার কি আছে। কবিতা-টবিতা নিশ্চয়ই দু-একটা লিখেছেন। আর যখন অরণ্যের নির্জনতায় আপনি দিনের পর দিন কাটাচ্ছেন তখন আলবত কবিতা আপনি লিখেছেন। যদি এখনও না লিখে থাকেন, লিখতে হবে এবং আমাকে দেখাতেই হবে।
এ-কথার পর বিভূতিবাবু বুকে বল সঞ্চয় করে বললেন—অভয় যদি দেন, উৎসাহ যদি পাই, তাহলে আপনাকে একটা কথা নিবেদন করি।
–তাহলে অনুমান ঠিকই করেছি। নিশ্চয় কবিতা আপনি লিখেছেন এবং পকেটে করে নিয়েও এসেছেন দেখে শুনে দেবার জন্যে। লজ্জার কিছু নেই, এ-রকম অনেকেই আমার কাছে এসে তাদের লেখা কয়েক্ট করিয়ে নিয়ে যায়। চটপট বার করুন, আমি পড়ে দেখতে চাই।
–আজ্ঞে কবিতা নয়। আমি একটা উপন্যাস লিখেছি।
–উপন্যাস? আ-আ-আপনি? লিখে ফেলেছেন? বিস্ময়ে বিমূঢ় উপেনদা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন বিভূতিবাবুর দিকে।
রাত হয়ে গিয়েছে। বাইরের জমাট অন্ধকার বৃষ্টিভেজা ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে মিশে ঘরের জানলা-দরজা দিয়ে এলোমেলো প্রবেশ করতে লাগল। ঘরের ভিতরে একটা থমথম আবহাওয়া। বিভূতিবাবু মাথা নিচু করে বলে আছেন—যেন মস্ত একটা অপরাধ করে ধরা পড়ে গিয়েছেন। ওদিকে উপেনদার চোখে মুখে তখনও বিস্ময়ের স্তব্ধতা, যেন এ-মানুষ কখনই অপরাধ করতে পারে না।
এই অস্বস্তিকর নিস্তব্ধ দুজনকেই পীড়া দিচ্ছিল। অগত্যা উপেনদাই কথা বললেন—খানিকটা স্বগোতোক্তির মত।
–হাতে খড়ি হল না, একেবারে উপন্যাস!
এবার বিভূতিবাবুর অবাক হবার পালা। তিনি বললেন—হাতে খড়ি। সে আবার কি।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, হাতে খড়ি। এর আগে কোন পত্রিকায় আপনার কোন লেখা-টেখা কিছু বেরিয়েছে? যেমন, কোন কবিতা বা গল্প? নিদেন পক্ষে কোন প্রবন্ধ?
আজ্ঞে না।
তবে? হাতে খড়ি হল না, আপনি কি-না উপন্যাস লিখে ফেললেন? এই আমার কথা ধরুন না। সাহিত্য জীবন শুরু করেছিলাম কবিতা লিখে। পরে গল্প-উপন্যাসে চলে গিয়েছি। আমি কেন। কে নয়। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম রচনা কবিতা। প্রকাশ করেছিলেন ঈশ্বর গুপ্ত তার সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায়। সেই তার প্রথম হাতে খড়ি। রবীন্দ্রনাথের কথা আর নাই বললাম। এমন কি আমার ভাগ্নে শরৎচন্দ্র সেও প্রথম জীবনে কবিতা লিখেই সাহিত্য চর্চা শুরু করেছিল।
বিস্মিত হয়ে বিভূতিবাবু বললেন–শরৎবাবু কবিতা লিখেছেন? কই এ কথা তো আগে কখনও শুনিনি।
-কোত্থেকে শুনবেন। এ-কথা আমি ছাড়া আর জানবেই বা কে। আজও শরতের লেখা একটা কবিতার প্রথম লাইন মনে আছে—ফুলবনে লেগেছে আগুন। ভাগলপুরের এই বাড়ি থেকেই আমাদের কৈলোর জীবনে একটা হাতে লেখা পত্রিকা বার করতাম। সেই পত্রিকায় এই কবিতাটি ও লিখেছিল। তাই বলছিলাম দু-একটা ছোট খাটো লেখা এ-দিক ও-দিকে ছেপে নামটা একটু চালু করে নিয়ে উপন্যাসে নামা উচিত ছিল না কি?
কৈফিয়ত দেবার সুরে বিভূতিবাবু বললেন–অনেকদিন ধরেই ভিতরে ভিতরে একটা তাগিদ অনুভব করছিলাম আমার দেশের কথা, আমার গ্রামের কথা উপন্যাস আকারে লিখে যাব। গ্রামের ইস্কুলে মাস্টারি করতাম, অবসর ছিল, তাই লিখে ফেলেছি।
তা বেশ করেছেন। একা একা পড়ে আছেন, সময় তো কাটাতে হবে। তবে উপন্যাস লিখলেই তো হল না, কতগুলো নিয়ম-কানুন আছে। সেগুলো বজায় রেখেছেন কি? কত বড় উপন্যাস লিখেছেন?
বিভূতিবাবু বললেন–তা একটু বড়ই হবে, আমার হাতের লেখা বেশ ছোটই। তারই চারশ পাতা হয়েছে।
তা তো হবেই। একা-একা যখন আছেন তখন পাতার পর পাতা, দিস্তার পর দিস্তা, রিমের পর রিম লিখে যাওয়া ছাড়া আর কাজটা কি। আপনার উপন্যাসে পরিচ্ছেদ আছে তো?
তা আছে।
অঙ্ক মিলিয়েছেন?
অঙ্ক? উপন্যাস লেখার সঙ্গে অঙ্কের কি সম্পর্ক ঠিক বুঝতে পারলাম না।
অঙ্ক, মানে মথমেটিক। প্রথম পরিচ্ছেদে ঠিক যতগুলি শব্দ আছে, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে ঠিক ততগুলিই শব্দ থাকবে। এইভাবে তৃতীয়, চতুর্থ পঞ্চম। গুনে দেখেছেন?
আজ্ঞে না, গুনে তো দেখি নি।
আমি এখানে আছি, আপনি আমার এখানে আজ ছ-মাসের উপর আসা-যাওয়া করছেন। একবার মুখ ফুটে জানালেন না? এখন সবই পণ্ডশ্রম। কবিতার যেমন একটা ছন্দ আছে, যতি আছে, মাত্রা আছে, উপন্যাসেরও তাই। একটা পরিচ্ছেদের সঙ্গে আর একটা পরিচ্ছেদের মাত্রা ঠিক রাখা চাই। তা না রাখলে উপন্যাস বেমানান হয়ে পড়ে। বেসামাল হয়ে যায়।
হতাশ হয়ে বিভূতিবাবু বললেন—তাহলে উপায়?
–উপায় একটা আছে। তার আগে আজকেই বাড়ি গিয়ে কোন পরিচ্ছেদে কত শব্দ আছে গুনে ফেলুন। তারপর ছাঁটকাট করেই হোক অথবা বাড়িয়েই থোক এক পরিচ্ছেদের সঙ্গে আরেক পরিচ্ছেদের সামঞ্জস্য রাখতে হবে। একেবারে নিক্তির ওজনের ব্যাপার কিনা।
এ-কথার পর বিভূতিবাবু বেশ দমে গেলেন। এতদিন ধরে এত পরিশ্রম করে অন্তরের সমস্ত বেদনা ঢেলে যে-উপন্যাস লিখলেন—শুধু অঙ্কের ভুলে তা ব্যর্থ হয়ে যাবে?
উপেনদা ঝানু ঔপন্যাসিক। মানবচরিত্র নিয়ে তাঁর কারবার। বিভূতিবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি বুঝে ফেললেন ওর মানসিক অবস্থা। উৎসাহ দিয়ে বললেন–
এতে মুষড়ে পড়বার কিছু নেই। যতক্ষণ আমি আছি ভাই, তোমার লেখার লাগি কোন ভয় নাই। আপনি শুধু পরিচ্ছেদগুলির শব্দ আজ গুনে ফেলুন, আগামী কাল একটু বেলা-বেলি চলে আসবেন আর অন্যান্য বন্ধুরা হাজির হবার আগেই। তবে হ্যাঁ, উপন্যাসের পাণ্ডুলিপিটা সঙ্গে আনা চাই। আমার একবার দেখা দরকার।
এই আশ্বাসবাণীর পর বিভূতিবাবু যেন ভরাডুবির মুখে তক্তা খুজে পেলেন। এদিকে কথায় কথায় রাত্রি ঘনিয়ে এসেছে। মেঘান্ধকার রাত্রে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যেতেও হবে বহুদুর। উপেনদার কাছে বিদায় চেয়ে পকেট থেকে দেশলাই বার করে লণ্ঠনটা জ্বালালেন, তারপর ছাতা ও লাঠি বগলদাবা করে ঘর থেকে বারান্দা, বারান্দা থেকে পথে নেমে পড়লেন। রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দেবার সময় উপেনদা বললেন–
কাল আসা চাই কিন্তু, লেখাটাও আনতে ভুলবেন না।
ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বিভূতিবাবু বিদায় নিলেন। বিভূতিবাবুর ছায়ামূর্তি আস্তে আস্তে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল-লণ্ঠনের আলোটার দিকে স্থির দৃষ্টি মেলে উপেনদা তখনও তাকিয়ে।
যে-আকাশে সূর্য-চন্দ্র বিরাজমান, সেই আকাশেই একদিন লণ্ঠনের এই ক্ষীণ আলো পথের পাঁচালী নিয়ে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্করূপে দেখা দেবে–এ–কথা কি দুরে অপহৃয়মাণ আলোকরশ্মির দিকে চোখ মেলে রেখে উপেনদা সেদিন ভাবতে পেরেছিলেন?
সে-রাত্রে বিভূতিবাবুর চোখে ঘুম নেই। শুধু উপন্যাসের পরিচ্ছেদের শব্দ-রাজি গুনেই চলেছেন। প্রথম পরিচ্ছেদে ১৬শ শব্দ, দ্বিতীয়তে হাজার। তৃতীয় আর চতুর্থ প্রায় সমান, পঞ্চম খুব ছোট আর ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ বিরাট বড়। শব্দ সংখ্যার আঙ্কিক হিসাব করতে করতে শেষ রাত্রে পরিশ্রান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন।
পরদিন তাড়াতাড়ি জমিদারী সেরেস্তার কাজকর্ম চুকিয়ে প্রচণ্ড গ্রীষ্মের তপ্ত রোদ আর হাওয়ার মধ্যেই বেরিয়ে পড়লেন বাঙালীটোলার পথে। হাতে সেই লণ্ঠন আর লাঠি, শুধু ছাতার বদলে কাগজে মোড়া কয়েকটি খাতা।
বৈঠকখানায় উপস্থিত হয়েই দেখেন উপেনদা ওঁরই প্রত্যাশায় প্রস্তুত হয়ে বসে আছেন। ঘরে প্রবেশ করতেই বললেন—কই, খাতা এনেছেন।
খবরের কাগজে-মোড়া বাণ্ডিলটা উপেনদার সামনে টেবিলের উপর রেখে লণ্ঠন আর লাঠি নিয়ে অন্যান্য দিনের মত ঘরের শেষ প্রান্তের বেঞ্চিতে গিয়ে বসলেন। পাণ্ডুলিপির পাতাগুলি উল্টে-পাল্টে দেখতে দেখতে উপেনদা বললেন–
যা আশংকা করেছিলাম তাই। পরিচ্ছেদের মধ্যে তো শব্দসংখ্যার মিল নেই মনে হচ্ছে। ভাল করে গুনে দেখেছেন?
কাল সারারাত ধরে গুনেছি, আগাগোড়া গরমিল।
গালে হাত দিয়ে উপেনদা স্তব্ধ হয়ে কী যেন চিন্তা করতে লাগলেন। কী একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। এমন সময় আড্ডার দু-তিনজন ঘরে প্রবেশ করতেই খাতাগুলি খবরের কাগজে মুড়ে টেবিলের ড্রয়ারে ভরে ফেলে বিভূতিবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন–আমার কাছে রইল। অবসর মত আমি একবার পড়ে দেখতে চাই।
যথারীতি আড্ডা জমে উঠল। বিভূতিবাবু নীরব শ্রোতা হয়ে যেমন বসে থাকেন তেমনি বসে রইলেন। বৈঠক শেষে লণ্ঠন জ্বালিয়ে ধীর পদক্ষেপে ফিরে গেলেন ওঁর ডেরায়।
দিন আসে দিন যায়। উপেনদা সেই পাণ্ডুলিপির কথা কিছুই বলেন না, বিভূতিবাবুও আর জিজ্ঞাসা করেন না। এইভাবে মাস দুই কেটে যাবার পর বৈঠক ভাঙবার মুখে উপেনদা বিভূতিবাবুকে বললেন–আপনি চলে যাবেন না, কথা আছে।
বিভূতিবাবুর মন সংশয় দোলায় দুলে উঠল। কী জানি কি বলবেন! আসরের সবাই একে একে প্রস্থান করলে উপেনদা বিভূতিবাবুকে তাঁর টেবিলের উল্টোদিকের চেয়ারে এসে বসতে বললেন। কাছে এসে বসতেই ড্রয়ার থেকে খাতাগুলি বার করে বললেন–আমি আগাগোড়া পড়েছি। আপনার হবে। হবে কেন? হয়েছে।
আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল বিভূতিবাবুর মুখ। সু দ্বিধাভরে জিজ্ঞাসা করলেন-কিন্তু অঙ্ক?
-অঙ্কে বেশ কিছু গরমিল অবশ্য আছে। তবে তাতে কিছু যায়আসে না। ওটা আমি একটু কাটছাট করে ঠিক করে দেব। তাছাড়া সব লেখা কি অঙ্ক দিয়ে বিচার করলে চলে? না বিচার করা উচিত? ব্যতিক্রমও তো ঘটতে পারে। আচ্ছা, উপন্যাসটা আপনি কোথাও প্রকাশের কথা চিন্তা করেছেন কি?
বিভূতিবাবু কিছুক্ষণ মাটির দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে রইলেন। সেই ভাবেই একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন–কলকাতায় থাকতেই প্রবাসী পত্রিকায় দিয়েছিলাম। এখানে চাকরি নিয়ে চলে আসবার সময় খোঁজ নিতে গিয়ে ফেরত পেলাম।
গুম্ হয়ে গেলেন উপেনদা। মজলিশী মেজাজের হাসিখুশী মানুষটা এক মুহূর্তে পাথরের মত স্তব্ধ হয়ে গেলেন। ঘরের আবহাওয়াও যেন ভারী হয়ে উঠল। কিছুক্ষণ নীরবতার পর উপেনদা গভীর গলায় বললেন–আপনি ভাববেন না। এই উপন্যাস প্রকাশের ব্যবস্থা আমিই করব। ধরে নিন, আপনি আপনার একমাত্র সন্তানকে আমার হাতে সমর্পণ করে গেলেন। এর ভার আজ থেকে আমিই নিলাম। আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়ি যান।
কৃতজ্ঞতায় বিভূতিবাবুর মন ভরে গেল। বিদায় নেবার সময় ধুলোততি কেঁাচার খুট দিয়ে চোখের কোণ মুছে আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন–আমার এই লেখা প্রকাশ হোক আর নাই থোক, মনে আর কোন খেদ নেই।
আরও মাস দুই পার হবার পর উপেনদা একদিন বিভূতিবাবুকে নিভৃতে ডেকে বললেন–আমি ভাগলপুর ছেড়ে আবার কলকাতায় চলে যাচ্ছি। একথা আজ্ঞার আর কাউকে বলবেন না, বাগড়া দেবে। বিভূতিবাবু অবাক হয়ে উপেনদার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
উপেনদা হেসে বললেন–অবাক হচ্ছেন তো? তবে শুনুন। কলকাতায় গিয়ে আমি একটা মাসিক পত্রিকা বার করছি।
আপনি? সে তো শুনেছি অনেক টাকার ব্যাপার।
টাকার ভাবনা আমার জামাইয়ের। বুঝেছেন, আমার জামাইয়ের কোলিয়ারী-টোলিয়ারী আছে। অনেক টাকা। ভজিয়ে-ভাজিয়ে তো এ-লাইনে নামতে রাজি করিয়েছি। এখন রবীন্দ্রনাথ আর শরৎচন্দ্রকে একসঙ্গে নামাতে পারলেই কেল্লা ফতে। আমি কথা দিয়ে যাচ্ছি, আপনার উপন্যাস আমিই ছাপব।
সত্যি সত্যিই উপেনদা ভাগলপুরের পাট গুটিয়ে চলে গেলেন কলকাতায়। তার কয়েক মাস পরেই মহা সমারোহে প্রকাশিত হল বিচিত্রা। প্রকাশ বললে ভুল হবে, বলা উচিত আবির্ভাব। প্রথম সংখ্যা যেদিন বেরলল, তার আগের রাত্রে টালা-টু-টালিগঞ্জ-কলকাতার দেয়াল বিচিত্রার পোস্টারে ছেয়ে গেল। পত্রিকার কর্মকর্তারা ট্যাক্সি করে অধিক রাত পর্যন্ত সারা কলকাতা ঘুরে দেখলেন পোস্টার কেমন দেখতে লাগছে। সুতরাং খরচের বহরটা এই থেকেই অনুমান করে নিন। যাকে বলে এলাহি কারবার, ঢালোয়া ব্যাপার। সে ইতিহাস কারও অজানা নয়।
ওদিকে ভাগলপুরের নির্জনে বসে বিভূতিবাবু আশা নিয়ে মাস গুনছেন, উপন্যাস আর বেয়োয় না। চিঠি লেখেন না, পাছে উপেনদা বিরক্ত হন। কিন্তু ধৈর্যেরও তো একটা সীমা আছে।
কী একটা উপলক্ষ্যে বেশ কিছুদিনের ছুটি থাকায় বিভূতিবাবু কলকাতা যাওয়া স্থির করলেন।
ফড়িয়াপুকুর লেন-এর দোতালার একটি ঘরে জোর আড্ডা বসেছে। সোফাসেট-টিপয় সজ্জিত প্রকোষ্ঠে জন পাঁচেক সুটেড-বুটেড, ভদ্রলোক চায়ের পেয়ালায় ঝড় তুলে তর্ক করে চলেছেন সাহিত্যে শ্লীলতা আর অশ্লীলতা নিয়ে। সকলের মুখেই সিগারেট জ্বলছে, ধোঁয়ায় ঘর অন্ধকার। সেন্টার টেবিলে দামী ব্র্যাণ্ডের সিগারেটের টিন, চায়ের কাপ ইতস্তত ছড়ানো। ঘরের এক কোণে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা একটি যুবক টেবিলের উপর একরাশ প্রুফ নিয়ে নিবিষ্ট চিত্তে কাজ করে চলেছেন, বিতর্কে বিগতস্পৃহ। ইনিই বেদের লেখক অচিন্ত্যকুমার।
এমন সময় দরজার সামনে এক ভদ্রলোক উঁকি মারতেই পাচ-জোড়া চোখ তার উপর পড়ল। এত বাঙালী সাহেব-সুবো দেখে আগন্তুক খানিকটা ঘাবড়ে গিয়ে দরজার ওপারেই দাঁড়িয়ে রইলেন, ঘরে আর ঢুকলেন না। আধময়লা ধুতি, তাও প্রায় হাঁটুর কাছাকাছি। জুতোর চামড়া ব্ল্যাক না ব্রাউন কলকাতার পথের ধুলোয় চেনবার উপায় নেই। গায়ে পাঞ্জাবি, তার দু-চার জায়গায় রিপুকর্মের চিহ্ন প্রকট। হাতে রয়েছে চটের থলি।
ঘর থেকে কে-একজন তাচ্ছিল্যের ভাব দেখিয়ে বললেন–
কী চান এখানে? আপনি কি এজেন্ট? কোথাকার এজেন্ট? আপনাকে কিন্তু দশ কপির বেশি পত্রিকা দিতে পারব না। ভয়ানক ডিমাণ্ড। যান্ ওই কোণের ভদ্রলোকের কাছে টাকা জমা দিন।
আমি এজেন্ট নই।।
তবে কি লেখক? কবিতা লিখেছেন? নাম ঠিকানা সমেত ওই কোণার ভদ্রলোকের কাছে জমা দিয়ে যান।
আমি লেখকও নই, কবিতা দিতেও আসি নি। আমি এসেছি পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করতে।
উপেন গাঙ্গুলীর সঙ্গে। তিনি এখনও আসেন নি। আপনার যা দরকার কোণের ভদ্রলোকটিকে বলে গেলেই চলবে। এক নিশ্বাসে কথাগুলি আগন্তুকের উপর ছুড়ে মেরে বক্তা আবার পূর্ব আলোচনার সূত্রে ফিরে গিয়ে বললেন–যাই বলুন অমলবাবু, ডি. এইচ. লরেন্সকে নিয়ে একদল ছোকরা-লেখক যে-রকম মাতামাতি করছে
এমন সময় উপেনদা এসে হাজির। দরজার কাছে যে-লোকটি এতক্ষণ ফিরে যাব-কি-যাব না ইতস্তত করছিল তাকে প্রায় জড়িয়ে ধরে ঘরে টেনে এনে বললেন—
কী খবর বিভূতিবাবু। কবে কলকাতায় এলেন? ভাগলপুরের সব খবর ভাল তো? বসুন, বসুন।
সোফায় সমাসীন যে-ভদ্রলোক তাকে এজেন্ট ঠাউরেছিলেন তার পাশেই জায়গা ছিল বসবার। বিভূতিবাবু বসলেন না। দাঁড়িয়ে থেকেই বললেন–আজই সকালে কলকাতায় এসে পৌঁছেছি, রাত্রেই গ্রামে চলে যাব। হাতে একটু সময় ছিল, তাই আপনার সঙ্গে দেখা করে গেলাম।
তা এসে ভালই করেছেন। আপনাকে সুখবরটা দিই, আগামী সংখ্যা থেকেই আপনার উপন্যাস বেরোচ্ছ।
এতক্ষণ যারা তর্কে ঘর সরগরম করে রেখেছিলেন তারা এবার একেবারে চুপ। বার বার তারা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছেন বিভূতিবাবুর পা থেকে মাথা, মাথা থেকে পা।
বিভূতিবাবু আর মুহূর্তমাত্র না বাড়িয়ে প্রায় ছুটে বেরিয়ে এলেন রাস্তায়। সেদিনের কলকাতা শহরের সন্ধ্যার আনন্দ তিনি কোনদিন ভোলেন নি। পরবর্তী জীবনে প্রায়ই আমাদের বলতেন—দ্যাখ, কলকাতা শহর আমার কোনদিনই ভাল লাগে না। গ্রামে আর অরণ্যেই আমি শান্তি পাই। তবে হ্যাঁ, সেদিন সন্ধ্যায় বিচিত্রা অফিস থেকে রাস্তায় বেরিয়ে কলকাতা শহরটাকেও আমি ভালবেসেছিলাম।
একটানা গল্প বলে আমাদের বৈঠকের গাল্পিক বন্ধু থামলেন। পথের পাঁচালীর প্রকাশের কাহিনী তন্ময় হয়ে আমরা শুনছিলাম আর ভাবছিলাম বাংলা দেশের দুর্ভাগ্য বিচিত্রা-র মত পত্রিকাও উঠে গেল, উপেনদার মত সম্পাদকও আমরা আর পেলাম না। আর বিভূতি বন্দ্যোপাধ্যায়? বাংলাসাহিত্যে বিভূতিভূষণের মত মানবদরদী ও প্রকৃতিপ্রেমী কথাসাহিত্যিক কি আর দেখা দেবে?
গাল্পিক সাহিত্যিক ইত্যবসরে দম ভরে আরেক টিপ নস্যি নিয়ে বললেন–পরের মাস থেকেই বিচিত্রায় পথের পাঁচালী বের হতে লাগল। সাহিত্যরসিক মহলে সাড়া পড়ে গেল—কে এই লেখক?
হঠাৎ একদিন শনিবারের চিঠির সম্পাদক সজনীকান্ত দাস খোঁজখবর নিয়ে বিভূতিবাবুর কাছে এসে হাজির। নব্বই-টা টাকা তার হাতে গুতে দিয়ে বললেন–পথের পাঁচালী বই আকারে আমি ছাপব।
অবাক হয়ে গেলেন বিভূতিবাবু। ন-ব্ব-ই-টা-কা!! এ-যে কল্পনাতীত।
এইটুকু বলেই গাল্পিক বন্ধু চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন। আমরা অধৈর্য হয়ে বললাম—সে কী! উঠে পড়লেন যে? পথের পাঁচালীর কাহিনী তো শুনলাম। কিন্তু মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘটনাটা তো বললেন না?
দরজার দিকে চলতে চলতে গাল্পিক বন্ধু বললেন–রাত কত হল খেয়াল আছে? অতসী মামী গল্প প্রকাশের ঘটনাটা আরেক দিন হবে।
এতক্ষণে আমাদের হুঁশ হল। রাত সাড়ে নটা কখন বেজে গেছে টেরও পাই নি।