১২
লিফ্টবাহিত হয়ে কী মসৃণ এই সাততলায় উঠে আসা। তারপর ডোরবেল বাজিয়ে দাও। কয়েদখানার দরজা খুলে যাবে। যখনই সে ফেরে তখনই তার মনে হয়, পাখি কি কখনও খাঁচায় ফেরে? গাঁয়ের বাড়িতে সে যখন কবুতর পুষেছিল, বারান্দায় ওপরে লটকানো কাঠের বাক্সের ঘরে রোজ ফিরে আসত পোষা কবুতরেরা। গৃহী পাখি। মানুষকে পুষল কে? মানুষ নিজেই কি? সে ঘর বানাল, কপাট বানাল, নিজেকে পুরল তার মধ্যে! কিন্তু গৃহের মধ্যে কী আশা করে মানুষ? নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা, স্বস্তি, নির্ভরতা, স্নেহ? আবার এই তার নিজস্ব ঘর তাকে পৃথিবী থেকে খানিকটা আলাদাও করে দেয় না? মানুষ কি ভাবতে শেখে না, এই ঘর আমার, এই বাড়ি আমার, অন্য ঘর-বাড়িগুলো আমার নয়? অন্য ঘরবাড়ি উড়ুক পুড়ুক, আমারটা থাকলেই হল। মানুষ এইভাবেই কি ক্রমে উদাসীন হয়ে যায় ঘরের বাইরের পৃথিবীর প্রতি? অন্য সকলের প্রতি?
অনেকের সঙ্গেই তার মতের অমিল হচ্ছে আজকাল—মন্ত্রী, আমলা, কতিপয় শিল্পপতি। কৃষ্ণজীবন তাদের কিছুই বুঝিয়ে উঠতে পারে না। সে বরাবর নন-কমিউনিকেটিভ। কিন্তু লিখিত প্রতিবেদনে সে তুখোড়। সে জানে, তার যুক্তি অকাট্য। তার মত আজ বা কাল পৃথিবীকে গ্রহণ করতেই হবে। আজ হলেই ভাল হয়। কাল বড় দেরি হয়ে যাবে না কি?
ইদানীং তাকে একগাদা কমিটির সদস্য করা হয়েছে। তাকে ডাকা হচ্ছে বিভিন্ন কনফারেন্সে। বিশেষজ্ঞরা তার কথা শুনছেন। এখনও মানতে পারছেন না। সেইসব লিখিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে দেশ ও বিদেশের নানা পত্র-পত্রিকায়। লোকে তার কথার সারবত্তা বুঝতে পারছে। মানতে পারছে না।
আজ দিল্লিতে সমবেদনাসম্পন্ন, বন্ধুভাবাপন্ন এক মন্ত্রী একটু ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, এটা কী করে হয় কৃষ্ণজীবনবাবু, আপনি ইন্ডাস্ট্রির গ্রোথকেই বন্ধ করে দিতে চাইছেন! ইন্ডাস্ট্রি কমে গেলে প্রোডাকশন কমে যাবে, সরকারের আয় কমবে, আন্এমপ্লয়মেন্ট দেখা দেবে।
কৃষ্ণজীবন খুব মৃদুস্বরে বলল, মানুষ অনর্থক কিছু বাহুল্য জিনিস তৈরি করে যাচ্ছে। আমি বিচার করে দেখেছি, অনেক কিছু না হলেও মানুষের চলে যায়।
আপনি অনেকগুলো ইন্ডাস্ট্রিকে ব্ল্যাকলিস্টে ফেলতে চাইছেন। একটা চালু ইন্ডাষ্ট্রি কি হুট করে বন্ধ করে দেওয়া যায়? বরং ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়েস্ট রিসাইক্লিং-এর জন্য আপনি যে নানারকম প্ল্যান্টের কথা বলেছেন সেটা ভেবে দেখার মতো। কিন্তু তাতেও অনেক টাকার দরকার। এটা তো নতুন কনসেপশন! কিন্তু, কারখানার ধোঁয়াকে মাটির তলার চেম্বারে ঢুকিয়ে তা থেকে বাই প্রোডাক্ট করার যে প্রস্তাব দিয়েছেন সেটা বোঝা যাচ্ছে না।
আমিও জানি না কি করা যায়। সায়েন্টিস্টরা ব্যাপারটা ভাবলে এবং হাতে-কলমে চেষ্টা করলে কিছু একটা হতে পারে।
মন্ত্রী মাথা নেড়ে বললেন, আমাদের পক্ষে এসব ব্যাপার বড় বেশী নাগালের বাইরে। এটা গরিব দেশ। আমাদের ইন্ডাস্ট্রি তেমন গ্রো করেনি, এ তো আপনি জানেন। ভারতবর্ষের কলকারখানার দূষণ পৃথিবীর খুব বেশী ক্ষতি করছে না।
ঘরে কয়েকজন উচ্চপদস্থ আমলাও ছিলেন। তাঁরা বললেন, কোথায় আমরা নতুন ইন্ডাস্ট্রির কথা ভাবছি, আর এদিকে আপনি বলছেন ইন্ডাষ্ট্রি কমাতে হবে।
কৃষ্ণজীবন যে অর্থনীতি বোঝে না, তা নয়। পরিবেশ, অর্থনীতি, বিজ্ঞান সবকিছুই পরস্পরের সঙ্গে অন্বিত। সে এও জানে ইন্ডাস্ট্রি কমলে ভারতের ওপর প্রথম ধাক্কাটা হবে মারাত্মক। তবে তার প্রস্তাব যে এঁরা গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনাও করছেন না এবং সে চলে গেলেই যে তার বক্তৃতার কপি বাজে কাগজের ঝুড়িতে চালান হয়ে যাবে, এও সে জানে। সে বুঝতে পারছে এরা তাকে একটু বাজিয়ে দেখছে মাত্র, গুরুত্ব দিচ্ছে না। তবু যে সেমিনারের পর তাকে আলাদা ডেকে মন্ত্রী স্বয়ং কথা বলেছেন, এটাই ঢের। কৃষ্ণজীবন ক্লান্ত বোধ করছিল।
এরা কি তাকে পাগল ভাবে! তার প্রস্তাব কি এতই অবাস্তব? কিংবা খুব হাস্যকর? অনেক জ্ঞানীগুণী তাকে বলেছেন, দূষণরোধ খুব ভাল কথা, কিন্তু আপনি ইন্ডাস্ট্রি কমাতে বলছেন, সেটা তো ঘড়িকে উল্টোদিকে চালানো!
ঠিক কথা। কৃষ্ণজীবন গোটা দুনিয়াকেই হুঁশিয়ারি দিয়ে বলতে চাইছে, ভোগ কমাও, ভোগ্যপণ্য সংযত করো, অল্প নিয়ে থাকো, যদি শেষ অবধি বাঁচতে চাও, যদি সন্তানসন্ততির বেঁচে থাকা চাও। মন্ত্রী মানছেন না, আমলারা মানছেন না, অর্থনীতিবিদরা মানতে রাজি নন, তবু দূষণমুক্ত পৃথিবীর নানা দিকে যে শঙ্কিত পরিবেশ-চেতনার উন্মেষ ঘটছে তাতে ক্রমে ক্রমে কৃষ্ণজীবনের কণ্ঠস্বরটিই কি প্রবল হয়ে উঠবে না একদিন? কিছু লোক কৃষ্ণজীবনের কথা শুনছে, অনুধাবন করছে, সমর্থন করছে। তাকে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না বলেই কি মন্ত্রী তাকে নিজের ঘরে আমন্ত্রণ করে আনেননি?
একজন আমলা বললেন, যথেষ্ট গাছপালা লাগানো হচ্ছে, নতুন নতুন বনসৃজন হচ্ছে, পলিউশন তাতেই কন্ট্রোলে থাকবে।
কৃষ্ণজীবন মূক ও বধিরের মতো বসে রইল। তার কথা আসতে চাইছে না। তার পেপারে ভারতবর্ষে বনসৃজনের নামে যে ধাষ্টামো হচ্ছে তার স্পষ্ট উল্লেখ আছে। জলদি জাতের গাছ লাগিয়ে দায় সারা হচ্ছে বটে, কিন্তু সেইসব গাছ তাড়াতাড়ি বাড়তে গিয়ে মাটির রসকষ টেনে ছিবড়ে করে ফেলছে। অন্য দিকে বন দফতরের পরোয়ানায় কাটা হচ্ছে সেইসব গাছ যা বহুদিন ধরে বাড়ে, বহুদিন বাঁচে এবং মাটিকে ধরে রাখে।
বলে লাভ কি? এরা কি জানে না? এরা কি জানে না আজকাল হিমালয় পর্বতমালায় অবধি বৃষ্টি অনিয়মিত এবং পশু-খাদ্যেরও অভাব? পাহাড়ী মানুষেরা জ্বালানী ও অন্য প্রয়োজনে নেড়া করে ফেলছে বৃক্ষ সংবলিত পাহাড়গুলিকে! এরা কি জানে না, পৃথিবী ছাড়া গোটা সৌরমণ্ডলে আর একটিও গ্রহ নেই, যাতে প্রাণের বিন্দুমাত্র লক্ষণ আছে? জীবজন্তু, গাছপালা দূরে থাক, কোনও গ্রহে একটি জীবাণুও নেই? এই মহার্ঘ, অনন্য গ্রহটিকে শুধু অবিমৃশ্যকারিতায় একটি মৃত গ্রহে পরিণত করার অধিকার কার আছে?
নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট, ডিজেল ইঞ্জিন, কম্প্রেসর, রাসায়নিক ধোঁয়াশা, ক্ষতিকারক গ্যাস— সবকিছুর বিরুদ্ধেই সোচ্চার কৃষ্ণজীবন। শুধু ভারতবর্ষ তো নয়, গোটা দুনিয়ায় প্রগতির নামে এক বিপুল যন্ত্র সভ্যতার বিস্তারের বিরুদ্ধেই তার জেহাদ। পৃথিবীর মায়াময় বাতাবরণ ছিদ্রময় হয়ে এল। সকল প্রাণের উৎস মহান সূর্য অবিরল ছুঁড়ে দিচ্ছে তার মারক নানা বল্লম। পৃথিবীর মায়াময় আবরণ তা আটকাতে পারছে না আর। উষ্ণ হচ্ছে তার মরু অঞ্চল। বাড়ছে ক্যানসার, চর্মরোগ। অচিরে মেরু প্রদেশের বরফ গলে মহাপ্লাবনের জলের ঢল নেমে আসবে সমুদ্রে।
এত কথা কি বলা যায়?
মন্ত্রী তার দিকে চেয়ে ছিলেন। হয়তো ভাবছিলেন, লোকটা কি একটু বেহেড? একটু ডাম্ব?
মন্ত্রী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ইউ আর অ্যান এক্সপার্ট। আপনি ভেবে দেখবেন।
দুপুরের ফ্লাইটে ফিরে এসেছে কৃষ্ণজীবন।
আনমনে সে কিছুক্ষণ ডোরবেল বাজাল। বিরক্তিকর এক পাখির ডাকের মতো শব্দ হচ্ছে ভিতরে। কে যে এরকম বিরক্তিকর ডোরবেল পছন্দ করেছিল কে জানে! একবার বোতাম টিপলে অনেকক্ষণ ধরে বেজে যায়। অথচ ডোরবেলের জন্য একটি সংক্ষিপ্ত জোরালো আওয়াজই যথেষ্ট। খামোকা এই শব্দময় শহরে আরও নতুন নতুন বিচিত্র শব্দের সৃষ্টি করা! কে জানে, এ আমলের লোকেরা বোধ হয় শব্দ ভালবাসে! কেবল শব্দ আর শব্দ। সেইজন্যই কি স্টিরিও, রক মিউজিক, চেঁচিয়ে কথা বলা?
দরজা খুলল না। একটা স্পেয়ার চাবি কৃষ্ণজীবনের কাছে থাকে। সে দরজা খুলে খাঁচায় ঢুকল।
বাড়িতে কেউ নেই। রিয়া তার ছেলেমেয়ে সহ কোথায় গেছে। এ বাড়িতে চব্বিশ ঘণ্টার কাজের একটি মেয়েও আছে। তাকেও হয় সঙ্গে নিয়ে গেছে, নয় ছাড়িয়ে দিয়েছে। রিয়া ঘন ঘন কাজের লোক পাল্টায়।
ফাঁকা বাড়িতেই অধিকতর স্বস্তি বোধ করে কৃষ্ণজীবন। লোক থাকলে সে অস্বস্তি বোধ করে। শুধু দোলন ছাড়া। অন্য সব জায়গা থেকে ধাক্কা খেয়ে প্রত্যাহৃত হয়েছে তার মন। তারপর জড়ো হয়েছে দোলনের ওপর। দোলনকে সে সবটুকু দিয়ে ভালবাসে। সে ভাবে, আমি দোলনকে একটা সবুজ পৃথিবী দিয়ে যাবো।
কৃষ্ণজীবনের কোনও নেশা নেই। চা অবধি খায় না। সে এক গ্লাস জল খেল। বাড়ির পোশাক পরে নিজের ঘরে গিয়ে বইপত্র নিয়ে বসল।
বইতে ডুব দিলে কৃষ্ণজীবনের কোনও বাহ্যজ্ঞান থাকে না। সে সম্পূর্ণ সম্মোহিত হয়ে থাকে। ডোরবেলটা তবু শুনতে পেল সে। অনেকক্ষণ ধরে বাজছে। মেকানিক্যাল পাখির ডাক।
কৃষ্ণজীবন গিয়ে দরজা খুলল। মুখটা চেনা, কিন্তু নামটা মনে করতে পারল না সে। তার মগজ অধিকার করে আছে বই।
তারপর হাসল কৃষ্ণজীবন। বলল, ওরা তো কেউ বাড়ি নেই।
মেয়েটা তার দিকে একটু বিস্ফারিত চোখে চেয়েছিল। বলল, আমি একটু ভিতরে আসব?
কেন আসবে তা বুঝতে পারল না কৃষ্ণজীবন। মেয়েটা তার মেয়ে মোহিনীর বান্ধবী। প্রায়ই আসে। নামটা মনে পড়ল না।
দরজা ছেড়ে কৃষ্ণজীবন বলল, আসতে পারে। কিছু দরকার আছে?
আমাদের বাড়ির ফোনে ডায়ালটোন নেই। আমি আপনাদেরটা একটু ব্যবহার করতে পারি?
বিরক্ত কৃষ্ণজীবনের মনেই পড়ল না, তাদের টেলিফোনটা কোথায় আছে। সে টেলিফোন যন্ত্রটাকে সুনজরে দেখে না। উপকারী যন্ত্র বটে, কিন্তু বড্ড জ্বালায়। টেলিফোনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতে ভালবাসে তার বউ রিয়া আর মেয়ে মোহিনী। কী করে বলে কে জানে!
কৃষ্ণজীবন বলল, করতে পারো। হয়ে গেলে যাওয়ার সময় দরজাটা টেনে দিয়ে যেও। আমি আমার ঘরে যাচ্ছি।
কৃষ্ণজীবন তার ঘরে এসে ফের বই খুলে বসল। জগৎ-সংসার ভুলে গেল।
কতক্ষণ কেটেছে কে জানে! হঠাৎ কে যেন ঘরের আলোটা জ্বেলে দিল।
এই অন্ধকারে কি করে পড়ছিলেন?
কৃষ্ণজীবন তার ঘোর-লাগা চোখ তুলে তাকাল। সেই মেয়েটি।
কৃষ্ণজীবন কী বলবে ভেবে পেল না। খুব অস্বস্তির সঙ্গে বলল, সন্ধে হয়ে গেছে, না?
হ্যাঁ। আপনার চোখ খুব ভাল, তাই এই অন্ধকারেও পড়ে যাচ্ছিলেন।
আলো জ্বালতাম। একটু বাদেই জ্বালতাম।
আমার ফোন করা হয়ে গেছে।
দরজাটা টেনে দিয়ে যেও।
আচ্ছা, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?
কি কথা?
আপনি কখনও লাঙ্গল চালিয়েছেন?
কেন চালাব না? অনেক চালিয়েছি।
সত্যি? দারুণ ব্যাপার, না!
কৃষ্ণজীবন মেয়েটির দিকে অবাক চোখে চেয়ে বলে, এমন কিছু দারুণ ব্যাপার নয়। সবই অভ্যাস।
আচ্ছা, আপনি তো হাইলি এরুডাইট। আপনি কেন চাষ করতেন?
করতাম। আমরা খুব গরিব ছিলাম।
আমি একটু বসতে পারি?
বোসো।
আপনাকে ডিস্টার্ব করছি না তো?
কৃষ্ণজীবন বিরক্ত হচ্ছে। তবু বলল, কিছু বলবে?
আমি প্রায়ই আসি, জানেন তো?
জানি। তোমার নামটা মনে নেই।
অনু। আপনার সঙ্গে ভীষণ কথা বলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আপনি সবসময়ে এত ব্যস্ত থাকেন! আসলে আপনি তো থাকেনই না কলকাতায়।
হ্যাঁ।
আর আপনি ভীষণ গম্ভীর বলে একটু ভয় পাই।
কৃষ্ণজীবন খুব অবাক হয়ে বলে, ভয় পাও? কেন?
মনে হয় আপনি ভীষণ রাগী।
কৃষ্ণজীবন দুঃখের সঙ্গে মাথা নেড়ে বলে, আমার রাগ নেই। রাগতে পারিই না। রাগতে পারলে হয়তো ভালই হত।
রাগ কি ভাল? আপনি রাগবেন কেন? কখনও রাগবেন না।
কৃষ্ণজীবন ঠিক এ ধরনের কথাবার্তা কখনও শোনে না। মেয়েটি কি খুব সরল? বা মাথায় ছিট আছে? বুঝতে না পেরে সে চুপ করে থাকে।
অনু বলল, আপনার ভয়েসটা দারুণ ভাল। রিয়েল বাস। আর আপনি ভীষণ হ্যান্ডসাম।
মেয়ের বয়সী একটি মেয়ের মুখে একথা শুনে আর একটু বিস্ময় বাড়ল কৃষ্ণজীবনের। যৌবনকালে সে শুনেছে বটে যে, তার চেহারাখানা ভাল। কিন্তু ভাল চেহারার কোনও উপযোগ বা প্রয়োজনীয়তা সে তো অনুভব করে না! তার চিন্তার রাজ্যে চেহারার মূল্যই বা কী?
অনু খিলখিল করে হেসে ফেলল। তারপর বলল, কিন্তু আপনি একটু শ্যাবি। আজ শেভ করেননি কেন?
কৃষ্ণজীবন নিজের গালে হাত বুলিয়ে নিল নিজের অজান্তেই, বলল, শেভ! করিনি বলছো?
করেননি। সেটাই মনে নেই?
কৃষ্ণজীবন খুব ভাবিত হয়ে বলে, সকালে খুব তাড়া ছিল। কি জানি ভুলেও যেতে পারি! মিনিস্টারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল। শেভ তো করার কথা।
ফের খিলখিল করে হাসল অনু। বলল, মোটেই করেননি। আপনার গালে স্টাবস রয়েছে।
হতে পারে। তুমি খুব হাসো বুঝি?
অনু একটু গম্ভীর হয়ে বলে, হাসিই তো আমার রোগ। কিন্তু ফর লাস্ট টু উইকস হাসছি না। এই প্রথম আপনার কাছে এসে হাসলাম। আমার বাবা সিরিয়াসলি ইল। হার্ট অ্যাটাক।
ওঃ! বলে কৃষ্ণজীবন খুব অস্বস্তির সঙ্গে চুপ করে থাকে।
এই বয়সের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তার দেখাসাক্ষাৎ বা কথাবার্তা হয়ই না। জানেই না এরা কেমন।
আজ বাবা একটু বেটার। পেইন নেই, সেডেটিভ কম দেওয়া হচ্ছে। আজ আমার মনটা খুব ভাল লাগছে।
এসব ক্ষেত্রে কী বলতে হবে তা কৃষ্ণজীবন ভেবে পায় না। একজন প্রম্পটার থাকলে ভাল হত। সে শুধু বলল, বাঃ, বেশ!
আচ্ছা, আপনি বাড়িতে বুঝি লুঙ্গি পরেন? আমার বাবা পরে পাজামা আর পাঞ্জাবি। সব সময়ে ফিটফাট।
কৃষ্ণজীবন প্রচণ্ড অস্বস্তি বোধ করছে। এ মেয়েটা কি ফাজিল? ফচকে? অসভ্য? ছিটিয়াল? এভাবে কৃষ্ণজীবনের সঙ্গে কেউ কথা বলে না। এ বাড়িতে তাকে ভাল করে লক্ষই বা করে কে? কৃষ্ণজীবন তার লুঙ্গিটার দিকে চেয়ে বুঝতে পারল না, কৃতকর্মের জন্য তার অনুশোচনা হওয়া উচিত কিনা! ভদ্রলোকদের কি বাড়িতে পাজামা-পাঞ্জাবি পরেই থাকা উচিত? সে পাজামা তো পরেইনি, এমনকি তার গা আদুর।
আপনি কি একসারসাইজ করেন?
একসারসাইজ! মানে ব্যায়াম?
হ্যাঁ। আমার বাবা একটুও করে না। ডাক্তার বলেছে, এখন থেকে রেগুলার হাঁটতে হবে। অনেকটা করে। অবশ্য এখনই নয়। টোটাল রিকভারির পর। আপনি কিন্তু খুব মাসকুলার। হি-ম্যান। আচ্ছা, গ্রামের বাড়িতে আপনার কে আছে?
কৃষ্ণজীবন এতক্ষণে কূল খুঁজে পেল। গাঁ নিয়ে কেউ প্রশ্ন করলে সে আজও কথা খুঁজে পায়। কৃষ্ণজীবন একটু হেসে বলল, সবাই আছে। মা-বাবা, ভাইরা, ভাইদের ছেলেপুলে। আমাদের বেশ বড় সংসার।
সবাই প্লাউম্যান?
প্লাউম্যান? না না, চাষের জমি এখন ভাগচাষীদের হাতে। বেশী নেইও। অভাবে বিক্রি করে দিতে হয়েছে। আমার ভাইরা সামান্য চাকরি বা ব্যবসা করে।
আপনার গ্রাম বেশী ভাল লাগে, না শহর?
কৃষ্ণজীবন স্বপ্নাতুর চোখে মেয়েটির দিকে চেয়ে বলে, গ্রাম। আমি একদিন সেখানেই ফিরে যাবো। চাষ করব। গাছের পর গাছ লাগাব। সবুজে সবুজ করে দেবো চারধার।
আপনি তো পলিউশন এক্সপার্ট। গাঁয়ে কোনও পলিউশন নেই, না?
আছে, আছে। পলিউশন সর্বত্র আছে। যেখানে কল-কারখানা নেই, ডিজেলের ধোঁয়া নেই, কেমিক্যাল ফিউম নেই, সেখানে কী আছে জানো? মানুষকে মানুষের গালাগাল, অশ্রাব্য কথা, করাপশন। এগুলোও পলিউশন। ভিতরকার পলিউশন। কলকাতার বস্তি বা ঝুপড়ি দেখনি?
দেখব না কেন! আমাদের বাড়ির পিছনেই একটা আছে।
ঝগড়া শুনতে পাও?
হ্যাঁ। কী অসভ্য অসভ্য গালাগাল দেয়।
সে কথাই বলছি। মানুষ এখনও এইসব পলিউশন নিয়ে চিন্তা করতে শুরু করেনি বোধ হয়। মাতাল, অশিক্ষিত বাপ দূষিত কথা বলে, গাল দেয়, মারধর করে। ছেলেমেয়েরা সেইসব শিখে নেয়। এইভাবেই এত পলিউটেড হয়ে যায় এরা, যখন আর পৃথিবীর সৌন্দর্য বুঝতে পারে না, জীবনের সৌন্দর্য বুঝতে পারে না। গোটা দুনিয়াকে ঘেন্না করতে থাকে।
ইউ টক নাইস। মুগ্ধ চোখে চেয়ে অনু বলে।
কৃষ্ণজীবন মৃদু হেসে বলে, গ্রামেও সেরকম পলিউশন আছে।
রুরাল লাইফ আমি কখনও দেখিনি। আমার খুব ইচ্ছে করে।
গাঢ় স্বরে কৃষ্ণজীবন বলে, সব মানুষেরই করে। প্রত্যেক মানুষের রক্তেই একটা ফিরে যাওয়ার টান আছে। কিন্তু যেতে পারে না। শহর বেঁধে রাখে।
আমরা মাঝে মাঝে বেড়াতে যাই। কখনও পাহাড়ে, কখনও সমুদ্রের ধারে, কখনও জঙ্গলে, কী যে ভাল লাগে! কিন্তু তিন চারদিন পর ইট বিকামস্ বোরিং। ভেরি বোরিং। রোজ পাহাড় দেখছি তো পাহাড়ই দেখছি। নাথিং চেঞ্জেস।
শুধু দেখতে গেলে এবং ইনভলভমেন্ট না থাকলে ওরকম হয়। যে জায়গায় যাচ্ছো সেই জায়গার সঙ্গে তোমার তো আত্মীয়তা নেই! থাকলে বোরডম টের পেতে না। আমি যখন গাঁয়ে ফিরে যাবো, ঠিক চাষী হয়ে যাবো, গেঁয়ো হয়ে যাবো, সব বিদ্যে ভুলে যাবো।
ইউ আর প্যাশনেটলি ইন লাভ উইথ ইওর ভিলেজ। আচ্ছা, আপনি কি চান শহর থেকে মোটরগাড়ি, বাস সব তুলে দিয়ে রিকশা, সাইকেল, ঘোড়ার গাড়ি আর ট্রাম চালু করতে? হাউ ফানি! মোহিনী বলছিল।
কৃষ্ণজীবন স্নান একটু হাসল। বলল, একদিন হয়তো তাই হবে। আমার মতে কী যায় আসে? আমি যা ভাল বুঝি, বলি। আমাদের চেয়ে তোমরা আরও বেশী দিন পৃথিবীতে থাকবে। তোমাদের সন্ততিরা থাকবে আরও বেশী দিন। পৃথিবীকে আমরা যদি তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে ফেলি তাহলে তাদের জন্য কী থাকবে? আমি তো ভাবী পৃথিবীর চেহারা দেখতে পাই, ঘোড়ার গাড়ি ফিরে এসেছে, সাইকেল চলছে। পালকি, গোরুর গাড়ি, নৌকো…
ইউ আর ফানি।
পাশাপাশি সোলার এনার্জি, ব্যাটারি আর উইন্ডমিল। পৃথিবী বসে থাকবে না। বাঁচবার পথ করে নেবেই। কিন্তু বোকারা কিছু বুঝতে পারছে না।
কারা বলুন তো!
মানুষেরা। ক্ষমতাবানরা। যারা পৃথিবীকে চালাচ্ছে তারা।
অনু মুগ্ধতার সঙ্গে চেয়েছিল। হঠাৎ বলল, ইউ আর নাইস। আই অ্যাডোর ইউ।
কৃষ্ণজীবনের আবার মনে হল, তার একজন প্রম্পটার দরকার। এই পরবর্তী প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের সংলাপ সে বুঝতেই পারে না। কত কী বলে দেয় এরা মুখের ওপর! এরা কি এরকমই নাকি! কিন্তু খারাপ লাগছে না। মোটেই খারাপ লাগছে না তার।
অনু চেয়ারটা আর একটু কাছে টেনে বসল। তারপর বলল, আমি শুনেছি, আপনার কোনও ফ্রেন্ড নেই। সত্যি?
কৃষ্ণজীবন অপ্রত্যাশিত এই প্রশ্নে আবার চকিত হল। তারপর মৃদু হেসে বলল, না। আমার কোনওদিনই তেমন কোনও বন্ধু ছিল না। কেন বলো তো!
আমি আপনার ফ্রেন্ড হতে চাই।
তুমি!
আমি খুব ভাল ফ্রেন্ড হবো। আই অ্যাডোর ইউ। ইউ আর এ নাইস ম্যান। মাঝে মাঝে চলে আসবো, গল্প করব। আবোল তাবোল গল্প কিন্তু! রাগ করবেন না তো! ফ্রেন্ডের ওপর রাগ করতে নেই।
মাই গড! তুমি তো মোহিনীর বন্ধু!
তাতে কি? আপনি কি ওল্ড কনসেপশনের লোক?
না, মানে…
কথা হারিয়ে গেল। কিন্তু হঠাৎ অনেকদিন পর একটা নির্মল হাসিতে তার মন উদ্ভাসিত হয়ে গেল। কেন যে ভীষণ ভাল লাগল তার এই অবাস্তব, অসম্ভব প্রস্তাবকে!
কি, রাজী?
কৃষ্ণজীবন সকৌতুকে অনুর দিকে চেয়ে বলে, রাজী। কিন্তু আমার তো অভ্যাস নেই বন্ধুত্বের। কি করতে হয় বলো তো!
আই উইল টিচ ইউ।
শেখাবে?
আপনি তো ভীষণ ভাল আর ছেলেমানুষ, তাই না? আমি আপনাকে সব শিখিয়ে দেবো। আজ যাই, নার্সিং হোম-এ যেতে হবে। বাই।
অনু চলে যাওয়ার পর আর কিছুতেই বইয়ে মন দিতে পারল না সে। তার আংশিক বোবা মন হঠাৎ যেন অনেক কথা বলে উঠতে চাইছে। মজা লাগছে, হাসি পাচ্ছে। মেয়েটা পাগল বোধহয়। কিন্তু এ গুড কম্পানি। তার জীবনে এরকম ঘটনা কখনও ঘটেনি। কত বয়স হবে মেয়েটার, হার্ডলি পনেরো বা ষোলো? পোশাকটা কী ছিল যেন? না শাড়ি নয়। কী যেন? বেশ স্মার্ট দেখাচ্ছিল তো! বোধহয় সালোয়ার কামিজ! হ্যাঁ, তাই হবে। বেশ ধারালো, বুদ্ধির ছাপওয়ালা মুখ।
একটু রাতে নিজস্ব ছোট টেলিস্কোপ আর দোলনকে নিয়ে যখন ছাদে বসে মেঘের ফাঁকে ফাঁকে তারা দেখার চেষ্টা করছিল কৃষ্ণজীবন তখনও আনন্দের রেশটা রয়েছে।
বাবা, তুমি হাসছো কেন? আমাকে তারা দেখাবে না?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। আজ বড় মেঘলা, ভাল দেখা যাচ্ছে না।
তুমি হাসছিলে কেন বাবা?
এমনিই।
তুমি তো কখনও হাসো না! সবসময়ে গম্ভীর থাকো।
হাসলে কি আমাকে তোমার ভাল লাগে না!
খুব ভাল লাগে।
আজ আমার খুব মজা লাগছে।
কেন বাবা?
এমনিই।
কথাটা খাওয়ার টেবিলে রিয়াও তুলল, কী গো, আজ তোমাকে একদম অন্যরকম দেখাচ্ছে কেন?
কিরকম?
সেই চেনা মানুষটা তো নয় দেখছি! সেই গোমড়ামুখো, ভ্রূকুটি-কুটিল মুখখানা তো দেখছি না। কী হল হঠাৎ?
কৃষ্ণজীবন ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে গেল।
দোলন নিরীহ গলায় বলে, বাবার আজ খুব মজা লাগছে।
রিয়া ভ্রূ কূচকে বলে, কিসের মজা?
মোহিনী আর সত্রাজিৎ তাদের প্লেট থেকে মুখ তুলে কৃষ্ণজীবনের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইল। তাদের বাবার মজা লাগছে, এরকম অদ্ভুত ঘটনার কথা তারা কখনও শোনেনি।
রিয়া বলল, সবই তো চেপে থাকো। সত্যি বলো তো, তুমি কোনও অ্যাওয়ার্ড বা রিকগনিশন পাওনি তো!
না, না, বলে কৃষ্ণজীবন নিজেকে ঢাকবার ব্যর্থ চেষ্টা করল। বন্ধুত্বও কি অ্যাওয়ার্ড নয়? রিকগনিশন নয়?
রিয়া একটু বিরক্ত মুখে বলল, বিষ্ণুপুর থেকে একটা চিঠি এসেছে। পোস্টকার্ড!
একটু চমকে উঠল কৃষ্ণজীবন, কার চিঠি! খারাপ খবর নাকি?
ইট ডিপেন্ডস্। তোমার বাবা তোমাকে একবার যেতে লিখেছেন।
কেন?
কি সব গোলমাল হচ্ছে। বাড়ি ভাগাভাগি হবে। তোমার নাকি যাওয়া দরকার।
ওঃ। বলে চুপ করে থাকে কৃষ্ণজীবন।
আমি একটা কথা বলব?
কি কথা?
তুমি কিন্তু নিজের ভাগটা ছেড়ো না। আজকাল কেউ কিছু সহজে ছাড়ে না। তুমিও বোকার মতো ছেড়ে দিও না।
‘হুঁ।’ বলে চুপ করে থাকে কৃষ্ণজীবন। চোখে ভেসে ওঠে, কুলগাছ ছেয়ে সোনালতার বিস্তার। কী সবুজ মাঠ! মাটির মদির গন্ধ নাকে ভেসে এল বুঝি!
অনবদ্য গল্প । পড়তে পড়তে কোথায় হারিয়ে গেছলাম নিজেই জানিনে !