দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
রোমক স্বর্গের পথ
বিনোদিনী যখন বৈদ্য লইয়া গৃহে ফিরিয়া আসিল, তখন হুগ্লীর দুর্গ মধ্যে অন্ধকারময় কক্ষে জনৈক খৃষ্টীয় ধর্ম্মযাজক দুই জন পাপীকে প্রেমময় ত্রাতার কাহিনী শুনাইতেছিলেন। পাপীদ্বয়ের মধ্যে একজন স্থূলাকার মশীকৃষ্ণবর্ণ, সে কোন কথা শুনিতেছিল না; দ্বিতীয় পাপী দীর্ঘাকার, শ্যামবর্ণ, কৃশকায়, সে নিবিষ্ট মনে পাদ্রীর সকল কথা শুনিয়া যাইতেছিল। স্থূলকায় পাপী কোন কথা শুনিতেছে না দেখিয়া পাদ্রী রাগিল। আরও দুই একবার চেষ্টা করিয়া সে কছিল, “চৈতন্যদাস, তুমি আমার পবিত্র কথা শুনিতেছ না, তোমার অদৃষ্টে অনেক দুঃখ আছে।” চৈতন্যদাস হাসিমুখে কহিল “সাহেব, যখন জন্মিয়াছি তখন হইতে দুঃখ পাইতেছি, বৈরাগী হইয়া যখন অর্থলোভ ত্যাগ করিতে পারি নাই, তখন দুঃখ পাইব না কেন? মারিতে হয় মার, যাহা ইচ্ছা কর, আমি অখাদ্য খাইতে পারিব না।” পাদ্রী কহিল, “তুমি অখাদ্য খাইও না, কিন্তু ত্রাণকর্ত্তার নির্দ্দিষ্ট পথ অবলম্বন কর।”
“সাহেব, যে পথ অবলম্বন করিয়াছি, তাহার কর্ত্তব্যই শেষ করিয়া উঠিতে পারিলাম না, নূতন পথ অবলম্বন করিয়া কি হইবে? সাহেব, তোমার খৃষ্টও দেবতা, আমার কৃষ্ণও দেবতা; তবে কেন আমাকে পীড়ন করিতেছ?”
“তোমার কৃষ্ণ দেবতা নহে, মানুষ, মিথ্যাবাদী লম্পট-”
চৈতন্যদাস কর্ণে অঙ্গুলী দিয়া কহিল, “কৃষ্ণনিন্দা শুনিতে নাই। পাদ্রী, তোমার যাহা ইচ্ছা কর, আমার যে কৃষ্ণ আছে তাহাই থাক।”
পাদ্রী ক্রুদ্ধ হইয়া যমদূতসদৃশ কৃষ্ণবর্ণ দুই জন ফিরিঙ্গিকে ডাকিল। তাহারা আসিয়া একখানি বৃহদাকার চক্রে চৈতন্য দাসকে বাঁধিল, তাহা দেখিয়া দ্বিতীয় পাপী চক্ষু মুদিল। চক্রে আবদ্ধ হইয়া চৈতন্যদাস মুদ্রিত নেত্রে বলিতেছিল, “হরিবোল, হরিবোল, জয় রাধে কৃষ্ণ।” পাদ্রী বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল “তুমি কি বলিতেছ?” কিন্তু তাহার কণ্ঠস্বর চৈতন্যদাসের কর্ণে প্রবেশ করিল না। পাদ্রী ক্রুদ্ধ হইয়া অনুচরদিগকে চক্র ঘুরাইতে আদেশ করিল। চক্র ঘূর্ণিত হইল; সঙ্গে সঙ্গে চৈতন্য দাসের হস্তের ও পদের অস্থি চূর্ণ হইল। ভীষণ যন্ত্রণায় বৈষ্ণবের নয়নকোণ হইতে অশ্রুধারা প্রবাহিত হইল; কিন্তু সে অধীরতা প্রকাশ করিল না, তাহার মুখ হইতে যন্ত্রণাব্যঞ্জক একটি শব্দও নির্গত হইল না। কিয়ৎক্ষণ পরে চৈতন্যদাস গদগদ কণ্ঠে বলিল, “আর একবার দাঁড়াও, যন্ত্রণা নাই, ক্লেশ নাই, প্রভু, ঐরূপ আর, একবার দেখাও।” তাহার কথা শুনিয়া ব্রাহ্মণের ভয় দূর হইল, তিনি চক্রের নিকটে গিয়া চৈতন্যদাসের অঙ্গ স্পর্শ করিলেন। চৈতন্যদাস বলিয়া উঠিল, “এ ত তোমার স্পর্শ নয় প্রভু! এ কাহার কঠোর করস্পর্শ। রাধাবিনোদ তোমার নবনীত কোমল করকমল আর একবার আমার অঙ্গে বুলাইয়া দাও। মধুসূদন, মধু, মধু।” ব্রাহ্মণ জিজ্ঞাসা করিলেন, “চৈতন্যদাস কি দেখিতেছ?” বৈরাগী নয়ন মুদিত রাখিয়াই কহিল, “ঠাকুর, বড় সুন্দর বড় সুন্দর, আর ভয় নাই। রাধাবিনোদ আসিয়াছেন, আমার শিয়রে দাঁড়াইয়া আছেন, তাঁহার করস্পর্শ্বে আমার সকল যাতনা দূর হইয়াছে।” সহসা ব্রাহ্মণের দেহ রোমাঞ্চিত হইল, তাঁহার মনে হইল যেন কাহার ছায়া চক্রে আবদ্ধ বৈষ্ণব-দেহের চারিপার্শ্বে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, ব্রাহ্মণের সমস্ত দেহ কম্পিত হইল। তিনি ভূমিতে লুটাইয়া সেই অশরীরী ছায়াকে দূর হইতে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করিলেন। চৈতন্যদাস বলিতে লাগিল, “রাধাবিনোদ, সমস্ত জীবনের সঞ্চিত কলুষরাশি মার্জ্জনা করিয়া যদি দেখা দিলে তাহা হইলে আর একবার দাঁড়াও, শেষ মুহূর্ত্ত পর্য্যন্ত থাকিও।” গৃহতলে শয়ান ব্রাহ্মণের মনে হইল যে সুগন্ধি ধূপধূমে কক্ষ আমোদিত হইয়াছে! ব্রাহ্মণ বৈষ্ণবের উন্মাদনায় উন্মত্ত হইয়া উঠিল, চৈতন্যদাসের রক্তসিক্ত চরণযুগল ধারণ করিয়া কহিল, “বৈরাগী, তুমি কি দেখিলে? সারা জীবনের ধ্যানেও যাহা নয়নপথে আসে নাই, সে দর্শনদুর্লভ রূপ তুমি মুহূর্ত্তের আহ্বানে কেমন করিয়া দেখিতে পাইলে? বৈষ্ণব, আমি ব্রাহ্মণ নহি, আমি চণ্ডাল, যেখানে চলিয়াছি সেখানে জাতিভেদ নাই, কুলমর্য্যাদা নাই। যাহা দেখিতেছ আমাকে একবার দেখাও।” বৈরাগী আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে কহিল, “দেখ, তুমিও দেখ।”
তখন ব্রাহ্মণের নয়নপথে ছায়ারূপ যেন সহসা শরীরী হইয়া উঠিল, অন্ধকারময় কক্ষের এক কোণ উজ্জ্বল শুভ্র আলোকে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল, সেই ছায়ারূপ ক্রমে ক্রমে সুন্দর সুগঠিত শ্যামরূপ ধারণ করিল; রাধাবিনোদ বলিতে বৈষ্ণবে যাহা বুঝে ছায়া সেই শরীর ধারণ করিয়া ব্রাহ্মণ ও বৈষ্ণবের মানসচক্ষুর সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। ব্রাহ্মণের মুদ্রিত নয়নের কোণে অশ্রুধারা প্রবাহিত হইল; তাহা দেখিয়া পাদ্রী ও তাহার অনুচরদ্বয় বিস্মিত ও স্তম্ভিত হইয়া রহিল।
সেই সময়ে আর একজন ফিরিঙ্গি যুবা সেই অন্ধকারময় কক্ষে প্রবেশ করিয়া ডাকিল, “আলভারেজ্!” পাদ্রী ব্যস্ত হইয়া কক্ষের দুয়ারে গিয়া দাঁড়াইল। যুবা তাহাকে কহিল, “তোমার রক্তপিপাসা কি এখনও মিটে নাই? তুমি আমার আদেশ না লইয়া বন্দীদিগকে কেন কারাগার হইতে লইয়া আসিয়াছ?” পাদ্রী লজ্জিত হইয়া কহিল, “পৌত্তলিক-দলনে পুরোহিতের আদেশই গ্রাহ্য, তাহার জন্য যে শাসনকর্ত্তার আদেশ লইতে হয় তাহা জানিতাম না।”
“তুমি কি বন্দীদিগকে যন্ত্রণা দিতে আরম্ভ করিয়াছ?”
“এই দুইজন বন্দী শয়তানের অনুচর, ইহাদিগের জন্য ভারতবর্ষের লোকে প্রকৃত ধর্ম্ম গ্রহণ করিতেছে না।”
যুবা অগ্রসর হইয়া চক্রে আবদ্ধ বৈষ্ণব ও তাহার পার্শ্বে ধূলায় ললুণ্ঠিত ব্রাহ্মণকে দেখিয়া অঙ্গুলী হেলন করিল। পাদ্রীর অনুচরদ্বয় তৎক্ষণাৎ চৈতন্যদাসের বন্ধন মোচন করিল, কিন্তু চৈতন্যদাস দাঁড়াইতে পারিল না, তাহার দেহ ধূলায় লুণ্ঠিত হইল। তাহা দেখিয়া যুবা পাদ্রীকে জিজ্ঞাসা করিল, “ইহাকে কি হত্যা করিয়াছ?” পাদ্রী কহিল, আপনি শাসনকর্ত্তা সেই জন্য সম্মান করিতেছি, আমি আমার কর্ত্তব্য সম্পাদন করিতেছি, কোনও শাসনকর্ত্তার নিকটে আমি কৃত কার্য্যের জন্য দায়ী নহি, স্বয়ং রাজাও আমার কার্য্যের হস্তক্ষেপ করিতে পারেন না। ঈশ্বরের প্রতিনিধি আমার একমাত্র প্রভু।”
“পাদ্রী, তুমি জান, ইহা স্পেন্ নহে, ইহা ভারতবর্ষ? জান যে এই দুইজন পৌত্তলিক আমাদের প্রজা নহে?” “জানি।” “তুমি জান এই হুগলী বন্দর সমর বিভাগের কর্ত্তৃত্বাধীন? তুমি জান যে এখানে তোমাদিগের আইন প্রচলিত নহে?” “জানি।” “তোমার স্মরণ আছে যে তুমি সত্য ধর্ম্ম প্রচার করিতে আসিয়াছ, নরহত্যা করিতে বা দেশ শাসন করিতে আস নাই?” “জানি।” “তবে তুমি নরহত্যা করিয়াছ কেন?” “সত্য ধর্ম্ম প্রচারের জন্য যাহা আবশ্যক তাহা করিয়াছি। ডিসুজা, এখন তুমি আমীরাল, স্মরণ রাখিও যে একদিন স্পেনে প্রত্যাবর্ত্তন করিতে হইবে।”
“পাদ্রী, আমি সৈনিক, সর্ব্বদা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করিতে প্রস্তুত। ভরসা করি, তোমার রাজত্বে প্রত্যাবর্ত্তন করিবার পূর্ব্বে আমার মৃত্যু হইবে। আলভারেজ্, তুমি নরঘাতী পিশাচ, ঈশার পবিত্র ধর্ম্ম তোমার ন্যায় চণ্ডালের জন্য ভারতবর্ষে নিন্দিত ও ঘৃণিত হইয়াছে, একদিন তোমাদিগের জন্য পর্ত্তুগীজ্ সাম্রাজ্য বিনষ্ট হইবে। যাহা করিয়াছ তাহা আমার অধিকারে দ্বিতীয় বার হইবে না।” “কেন হইবে না?” “আমার আদেশ।” “কোনও খৃষ্টান্ আমার আদেশ অবহেলা করিতে ভরসা করিবে না।” “পাত্রী, আমার আদেশের বিরুদ্ধে হুগলীর কোন পর্ত্তুগীজ্ তোমার আজ্ঞা পালন করিবে না।” “যাহারা পালন না করিবে তাহারা সমুচিত দণ্ড পাইবে।”
এই সময়ে আর একজন ফিরিঙ্গি যুবা দ্বারে দাঁড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আমীরাল্ কি এখানে আছেন?” ডিসুজা কহিলেন, “আছি, কি হইয়াছে?” যুবা কক্ষে প্রবেশ করিয়া কহিল, “আমীরাল্, কল্য ডাকুন্হা যে বজরা মারিয়াছিল তাহা নবাব সাহ নওয়াজ খাঁর বজরা, আমি কারাগারে গিয়া তাঁহাকে দেখিয়া আসিয়াছি।” “সাহ নওয়াজ খাঁ কে?” “শাহজাদা শাহজহানের একজন প্রধান অনুচর। এখনই তাঁহাকে মুক্ত করুন, নতুবা মুহূর্ত্ত মধ্যে ভারতবর্ষে পর্ত্তুগীজ অধিকার বিলুপ্ত হইবে।”
ডিসুজা পাদ্রীর অনুচরদ্বয়কে কহিলেন, “এই দুইজন বন্দীকে বিনোদিনী বৈষ্ণবীর গৃহে লইয়া যাও। পাদ্রী আলভারেজ্ এখন হইতে বন্দী, তাঁহার অঙ্গে হস্তক্ষেপ করিও না, কিন্তু তাঁহাকে নজরবন্দী রাখিও।”
ডিসুজা আগন্তুকের সহিত কক্ষ পরিত্যাগ করিল। একজন ফিরিঙ্গি চৈতন্যদাসকে ক্রোড়ে উঠাইয়া লইল, দ্বিতীয় ব্যক্তি ব্রাহ্মণের দেহ স্পর্শ করিল। ব্রাহ্মণ জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোথায় যাইতে ইইবে?” ফিরিঙ্গি অঙ্গুলী দিয়া দ্বার দেখাইল, ব্রাহ্মণ ফিরিঙ্গিগণের সহিত কক্ষ ত্যাগ করিল।