দ্বাদশ অধ্যায় — যৌন শিক্ষা
যৌন সম্পর্কিত বিষয় এত কুসংস্কার এবং নিষেধের বেড়াজালে ঘেরা যে, অত্যন্ত শঙ্কার সঙ্গে এই সম্পর্কে আলোচনা করিতে অগ্রসর হইতেছি। ভয় হয়, পাছে যে সমস্ত পাঠক এই পর্যন্ত আমার শিক্ষানীতি গ্রহণ করিয়াছেন তাহারাও এই ক্ষেত্রে প্রয়োগের সময় তাহাতে সন্দেহ প্রকাশ করেন। তাঁহারা হয়তো বিনা দ্বিধায় স্বীকার করিয়াছেন যে, নির্ভীকতা এবং স্বাধীনতা শিশুর পক্ষে মঙ্গলজনক; তথাপি যৌন ব্যাপারে তাহারাই হয়তো এ নীতির বিরোধিতা করিয়া শিশুদের উপর অকারণ ভীতি ও দাসত্ব প্রয়োগ করার পক্ষপাতী হইতে পারেন। যে-নীতি দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত বলিয়া আমি বিশ্বাস করি, তাহা আমি কোনোক্রমেই সংকুচিত করিতে রাজি হইব না; মানব চরিত্রের অন্যান্য আবেগ, যেমন খেলা, নূতন কিছু গঠন করা, ভয়, স্নেহ প্রভৃতির বিকাশ বা নিয়ন্ত্রণ সম্বন্ধে যেরূপ অবলম্বন করিয়াছি, যৌন ব্যাপারেও আমি ঠিক সেইরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করার পক্ষপাতী।
যৌনভাব ও ফ্রয়েডির মতবাদ : নানারূপ বাধানিষেধ আরোপ ও ঢাকঢাক-গুড়গুড় ছাড়াও যৌনভাবের একটি বিশেষত্ব এই যে, এই প্রবৃত্তি দেরিতে পরিপক্ক হয়। মনঃসমীক্ষকগণ সত্যই দেখাইয়াছেন যে, শৈশবেও যৌনপ্রবৃত্তি বিদ্যমান থাকে; তবে ইহাদের অভিমতের মধ্যে অনেকখানি অতিরঞ্জন আছে।
যৌন প্রবৃত্তির শিশুসুলভ প্রকাশ বয়স্ক ব্যক্তিদের আচরণ হইতে পৃথক, ইহার বেগও যথেষ্ট কম। বয়স্ক ব্যক্তির মতো যৌন ব্যাপারে লিপ্ত হওয়া শিশুর পক্ষে দৈহিক দিক দিয়াই অসম্ভব। প্রথম যৌবনাগম কিশোর-কিশোরীর মনে এক প্রক্ষোভময় বিষয় আলোড়ন সৃষ্টি করে; পাঠ্য-জীবনের মাঝখানে বয়ঃসন্ধিক্ষণের রঙিন উন্মাদনা স্বাভাবিক শিক্ষা গ্রহণের পথে বিঘ্ন উপস্থিত করে; এইগুলি অপসারণ করিয়া সুস্থ স্বাভাবিক জীবন বিকাশের পথে কিশোরকে পরিচালিত করা শিক্ষাব্রতীর বড় সমস্যা হইয়া দাঁড়ায়; এইরূপ সমস্যার অধিকাংশ সম্বন্ধেই কোনো আলোচনার চেষ্টা করিব না; কেবল যৌবনাগমের পূর্বে কি করা কর্তব্য তাহাই হইবে আমার আলোচ্য বিষয়। এই সম্পর্কে শিক্ষা সংস্কারের আবশ্যকতা অত্যন্ত বেশি, বিশেষত বাল্যকালের শিক্ষায়। যদিও ফ্রয়েডীয় মনোবিজ্ঞানীদের সঙ্গে অনেক বিষয়ে আমার মতের অনৈক্য ঘটিয়াছে তবু আমার মনে হয় একটি বিষয়ে তাঁহারা বিশেষ উপকার সাধন করিয়াছে। তাহারা দেখাইয়াছেন যে, বাল্যে যৌন-সংক্রান্ত ব্যাপারে শিশুদের প্রতি যথাযথ আচরণ না হওয়ার ফলে পরিবর্তীকালে স্নায়বিক বিকলতার উদ্ভব হইয়া থাকে। এই ক্ষেত্রে তাঁহাদের কাজে যথেষ্ট সুফল প্রদান করিয়াছে কিন্তু এখনও বহু পুঞ্জিভূত কুসংস্কার দূর করা প্রয়োজন। শিশুর যৌনভাব সংক্রান্ত কুসংস্কারগুলি দূর করার একটি প্রধান অন্তরায় হইল তাহার জীবনের প্রথম কয়েক বৎসর তাহার লালন-পালনের ভার সম্পূর্ণ অশিক্ষিত স্ত্রীলোকদের উপর ন্যস্ত করা। ইহার ফলে অনেক ক্ষেত্রে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় যাহা সোজাসুজি বর্ণনা করিলে অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হইতে হইবে বলিয়া বিশেষত পর্যবেক্ষক পণ্ডিতগণ ঘুরাইয়া ফিরাইয়া তাহার বিবরণ দিয়া থাকেন। মূর্খ পরিচারিকাগণ এই সম্বন্ধে কিছুই জানে না, তাহাদের পক্ষে বিশেষজ্ঞগণের সিদ্ধান্ত বিশ্বাস করার কোনো প্রশ্নই উঠে না।
করমৈথুনঃ শিশুর যৌন সমস্যাগুলির ক্রম অনুসারে আলোচনা করিতে গেলে জননী ও পরিচারিকাকে বিব্রত করে যে সমস্যা তাহা হইল শিশুর করমৈথুন। এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞগণ বলেন যে, দুই হইতে তিন বৎসর বয়সের সকল বালক-বালিকাই এইরূপ করিয়া থাকে এবং কিছুদিন পরে আপনা হইতেই ইহা বন্ধ হইয়া যায়। কখনও কখনও দৈহিক কয়নের ফলে এই বিব্রতকর কাজটি বেশি হয় কিন্তু ঔষধ প্রয়োগ করিয়া ইহার কারণ দূর করা যায়। (কি ঔষধ প্রয়োগ করা উচিত তাহা আমার বিবেচ্য বিষয় নহে)। কিন্তু এইরূপ কারণ ব্যতিরেকেই সাধারণত শিশুরা করমৈথুন করিয়া থাকে। এই ব্যাপারে অভিভাবকগণ শঙ্কাৰিত হইয়া উঠেন এবং ইহা বন্ধ করিবার জন্য ভীতি প্রদর্শন করিতে থাকেন। কার্যত ভীতি প্রদর্শনে কোনো উপকার হয় না কিন্তু ফল হয় এই যে, ভয় শিশুর মানস স্তরে প্রবেশ করে এবং দমিত হইয়া তাহাই পরে শিশুর জীবনে দুঃস্বপ্ন, স্নায়বিক দুর্বলতা, ভ্রান্ত এবং অহেতুক ভীতিরূপে আত্মপ্রকাশ করে। শিশুর করমৈথুন দূর করার চেষ্টা না করিলেও কোনও ক্ষতি নাই; তাহার স্বাস্থ্য এবং চরিত্রের উপর ইহার কোনও কুফল দেখা যায় না। খুব কম ক্ষেত্রে ইহা সামান্য অনিষ্ট করে কিন্তু ইহা সহজেই নিরাময় করা সম্ভব; এই অভ্যাসটি আঙ্গুল চোষা অপেক্ষা বেশি গুরুতর বা অপকারী নয়। স্বাস্থ্য ও চরিত্রের উপর করমৈথুনের যে কুফল লক্ষ্য করা গিয়াছে এই অভ্যাস বন্ধ করার চেষ্টা হইতেই তাহার উদ্ভব। করমৈথুন শিশুর পক্ষে ক্ষতিকর হইলেও ভয় দেখাইয়া এই কুৎসিত অভ্যাস ত্যাগ করানো না গেলে শুধু নিষেধ করা বিজ্ঞোচিত কাজ হইবে না। কেননা নিষেধ করিলেই যে শিশু এই অভ্যাস হইতে বিরত হইবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নাই। আপনি যদি বন্ধ করার কোনো চেষ্টা না করেন তবে সম্ভবত ইহা আপনা আপনি বন্ধ হইয়া যাইবে কিন্তু এ বিষয়ে চেষ্টা করিলেই বরং নানা মানসিক জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা। কাজেই প্রতিক্রিয়ার ফলাফল বিবেচনা করিয়া শিশুকে এ সম্বন্ধে স্বাধীনতা দেওয়াই ভালো। অবশ্য আমি এইকথা বলিতেছি না যে, নিষেধ করা ব্যতীত অন্য কোনো সম্ভাব্য উপায় গ্রহণ করা হইতেও বিরত থাকিতে হইবে। যাহাতে শিশু বেশিক্ষণ বিছানায় জাগিয়া না থাকে সেই জন্য ঘুম ধরিলে তাহাকে শুইতে দিবেন। যাহাতে তাহার মন অন্য কোনও দিকে আকৃষ্ট হয় সেইজন্য তাহার প্রিয় কতকগুলি খেলনা বিছানায় রাখিতে দিবেন; এইরূপ প্রক্রিয়ায় কোনো অপকার হয় না। ইহাতে যদি কোনো উপকার না হয় তবে শিশুকে বাধা দিবেন না, বা একটি খারাপ অভ্যাস করিতেছে বলিয়া সেইদিকে তাহার দৃষ্টি আকর্ষণ করিবেন না, স্বাভাবিকভাবে শিশুকে অন্য বিষয়ে মনোযোগী করিতে পারিলে আপনা হইতেই সে ইহাতে ক্ষান্ত হইবে। এই চেষ্টা হইলেও দুশ্চিন্তার কারণ নাই; শিশুর করমৈথুন অভ্যাস বেশিদিন থাকে না।
সাধারণ শিশুর তৃতীয় বৎসরে যৌন কৌতূহল শুরু হয়। পুরুষের সঙ্গে স্ত্রীলোকের, বয়স্ক ব্যক্তির সঙ্গে শিশুর দৈহিক পার্থক্য প্রথমে তাহার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। শৈশবে এই কৌতূহলের আর কোনো বিশেষত্ব নাই, ইহা তাহার সাধারণ কৌতূহলের অন্তর্গত। শুধু যেখানে ব্যাপারটিকে রহস্যাবৃত করিয়া রাখিবার রীতি, সেখানেই শিশুদের মধ্যে ভেঁপোমির ভাব দেখা যায়। যেখানে কোনো রহস্য নাই সেখানে কৌতূহল তৃপ্ত হইলেই আগ্ৰহ কমিয়া যায়। প্রথম হইতেই শিশুকে তাহার মাতা-পিতা-ভ্রাতা-ভগিনীকে মাঝে মাঝে বিবস্ত্র অবস্থায় দেখিতে দিতে হইবে। বস্ত্র পরিবর্তনের সময় বা অন্য কখনো স্বাভাবিক অবস্থায় শিশুর সম্মুখে ক্ষণিকের জন্য নগ্নদেহ হইলেও আচরণে কোনোরূপ ভাবান্তর দেখানো উচিত নহে; বয়স্ক ব্যক্তি বা শিশু কাহারই ইহাতে কিছু মনে করিবার নাই; নগ্নতা সম্বন্ধে বয়স্ক ব্যক্তিদের যে বিশেষ কোনো মনোভাব আছে তাহা শিশু না জানিলেই হইল। (পরে অবশ্য তাহাকে জানিতে হইবে।) দেখা যাইবে শিশু অতি সহজেই তাহার পিতা ও মাতার দৈহিক পার্থক্য লক্ষ্য করিবে এবং তাহার মাতা ও ভগিনীর দৈহিক পার্থক্যও যে অনুরূপ ধরনের তাহা বুঝিতে পারিবে। এতটুকু পর্যন্ত বুঝিতে পারিলে দৈহিক পার্থক্য সম্বন্ধে আগ্রহ যথেষ্ট পরিমাণে কমিয়া যাইবে আলমারি বা টেবিলের দেরাজ মাঝে মাঝে ভোলা থাকিলে তাহার সম্বন্ধে শিশুর কৌতূহল যেমন বিশেষ থাকে না তেমনই এই সময়ে শিশু যৌন বিষয় সংক্রান্ত কোনো প্রশ্ন করিলে অন্যান্য বিষয়ের প্রশ্নের মতোই তাহারও উত্তর দিতে হইবে।
যৌন বিষয় সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর : প্রশ্নের উত্তরদান যৌন শিক্ষার একটি প্রধান অংশ। এই প্রসঙ্গে দুইটি নিয়ম মানিয়া চলিতে হইবে। প্রথমে সর্বদা সত্য উত্তর দিন; দ্বিতীয় যৌনজ্ঞানকে অন্য যে-কোনও জ্ঞানের মতো বিবেচনা করুন। যদি কোনও মিশু আপনাকে চন্দ্র, সূর্য, মেঘ, মোটরগাড়ি বা ইঞ্জিন সম্বন্ধে বুদ্ধির পরিচায়ক কোনও প্রশ্ন করে তবে আপনি খুশি হন এবং সে যতটুকু বুঝিতে পারে সেই অনুপাতে প্রশ্নের উত্তর দিয়া থাকেন। কিন্তু সে যদি যৌনবিষয় সংক্রান্ত কোনো প্রশ্ন করে আপনি হয়তো বলিবেন, চুপ চুপ। আপনি যদি জানেন যে, এরূপ বলা উচিত নহে তবু হয়তো সংক্ষেপে এবং শুষ্কভাবে ইহার উত্তর দিবেন; আপনার আচরণে বিব্রত হওয়ার ভাব প্রকাশ পাইতে পারে, শিশু তৎক্ষণাৎ আপনার আচরণের সূক্ষ্ম পার্থক্য লক্ষ করিবে এবং বুঝিবে সে প্রশ্নের উত্তরের সঙ্গে কোনো কিছু গুপ্ত রহস্য জড়িত আছে। রহস্যাবৃত বিষয়ের প্রতিই শিশুর কৌতূহল বেশি জাগ্রত হয়। যৌন বাসনা ও যৌন-জীবন সম্পর্কেও এইভাবে শিশু আকৃষ্ট হইতে পারে। কখনও যেন মনে করিবেন না যে, যৌন আচরণে ভীতিকর অন্যায় এবং অপবিত্র কোনো ভাব আছে। আপনি যদি এইরূপ মনে করেন শিশু ইহা বুঝিতে পারিবে, সে তবে স্বভাবতই ভাবিবে যে, তাহার পিতামাতার সম্পর্কের মধ্যে গোপনীয়, নোংরা কোনো রকম আচরণ আছে। পরে সে সিদ্বান্ত করিবে যে, জনক-জননী তাহার জন্মদান ক্রিয়াকে অশোভন ও কুৎসিত বলিয়া মনে করেন। ইহার ফলে সে নিজেকে সর্বদা অপবিত্র এবং পাপকর্মের ফল বলিয়া বোধ করিতে থাকিবে। এইরূপ ভাব বিদ্যমান থাকিলে কিশোর-কিশোরীর, এমনকি যুবক-যুবতির পর্যন্ত প্রবৃত্তি এবং মানসিক আবেগগুলি সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশ প্রায় অসম্ভব হইয়া উঠে।
শিশুর যখন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার মতো বয়স হইয়াছে যেমন ধরুন তিন বৎসর বয়সের পর–তখন যদি তাহার ভাই বা বোন জন্মগ্রহণ করে তবে তাহাকে বলুন যে, শিশুটি তাহার মায়ের দেহের মধ্যে ধীরে ধীরে বাড়িয়া উঠিয়াছে, ঠিক এইভাবে সে নিজেও যে বাড়িয়া উঠিয়াছিল তাহাও বলুন। বালককে ছোট্ট শিশুর মাতৃস্তন্য পান করা দেখিতে দিন; তাহাকে বলুন সে নিজেও এমনইভাবে স্তন্যপান করিয়াছিল। যৌনজীবন সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়ের মতো এ বিষয়ও শিশুকে সহজ সরলভাবে বুঝাইয়া দিবেন। ইহার মধ্যে গুরুগাম্ভীর্য আনিবার কোনো প্রয়োজন নাই। মাতৃত্বের পবিত্র এবং রহস্যঘন কর্তব্য সম্বন্ধে বড় বড় কথা বলিবার আবশ্যকতা নাই। সমস্ত বিষয়টি হওয়া উচিত সহজ এবং বস্তুনিষ্ঠ।
যে বয়সে শিশুর প্রথম যৌন কৌতূহল জাগ্রত হয় তখন যদি পরিবারে কোনো সন্তানের জন্ম না হয় তাহা হইলেও এ প্রশ্নের অবতারণা করা যায়। তখন বলিতে হয়–তোমার জন্মের পূর্বে এ ঘটনাটি ঘটিয়াছিল। ইহা হইতেই প্রশ্নোত্তর শুরু হইতে পারে। আমার ছেলের বেলায় দেখি সে যে এক সময় বর্তমান ছিল না তাহা বোঝাই তাহার পক্ষে অত্যন্ত কঠিন। কখন পিরামিড তৈয়ার করা হইয়াছিল বা এই জাতীয় প্রাচীন কোনও কাহিনী বলিতে গেলেই সে জিজ্ঞাসা করে তখন সে কি করিত। যদি বলি–তখন সে জন্মায় নাই, তাহার অস্তিত্ব ছিল না তবে সে বড়ই হতবুদ্ধি হইয়া পড়ে। দুইদিন আগে হউক আর পিছে হউক জন্মানো মানে কি তাহা সে জানিতে চাহিবে; তখন আমরা তাহাকে বলিব।
শিশু যদি পশুপালন ক্ষেত্রে বাস করে তবে সন্তানের জন্মদানের ব্যাপারে পিতার অংশ কি স্বাভাবিক অবস্থায় সে প্রশ্ন তাহার মনে উঠিবে না। কিন্তু শিশু যাহাতে এই জ্ঞান পিতামাতা বা শিক্ষকের নিকট হইতে পায় সে বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করিতে হইবে। তাহা না হইলে কুশিক্ষাপ্রাপ্ত কুৎসিত স্বভাবের ছেলেদের নিকট হইতেই সে ইহা শিখিবে। আমার বয়স যখন বারো বৎসর তখন অন্য একটি ছেলে আমাকে কি বুঝাইয়াছিল তাহা আমার স্পষ্ট মনে আছে; সমস্ত বিষয়টি অশ্লীলতাপূর্ণ এবং গোপন হাসিঠাট্টার উপকরণ বলিয়া মনে করা হইত। আমাদের সে যুগের ছেলেদের ইহাই ছিল স্বাভাবিক অভিজ্ঞতা। ইহার ফল হইত যে, অধিকাংশ লোক সারাজীবন ধরিয়া যৌন ব্যাপারটিকে নোংরা হাসিঠাট্টার বিষয় মনে করিত এবং যে স্ত্রীলোক যৌন সংস্পর্শে আসিত তাহারা তাহাদের সন্তানের জননী হইলেও তাহাদিগকে শ্রদ্ধার চক্ষে দেখিত না। সন্তানের যৌন শিক্ষার ব্যাপারে পিতামাতা অদৃষ্টের উপর নির্ভর করিত, যদিও পুরুষগণ জানিত কিভাবে নিজেরা যৌন সম্পর্কিত প্রথম জ্ঞান লাভ করিয়াছিল! কুসঙ্গ হইতে বালকদের যৌনশিক্ষা লাভ করার ব্যবস্থা কিরূপে যে সুস্থ নীতিবোধ গঠনে সহায়তা করিত তাহা আমি কল্পনা করিতে পারি না। যৌনজীবন স্বাভাবিক, শোভন এবং প্রীতিপদ প্রথম হইতেই শিশুর মনে এই বোধ জন্মাইতে হইবে। ইহার অন্যথা করিলে স্ত্রী এবং পুরুষের সম্পর্ক, পিতামাতা ও সন্তানের সম্পর্ক বিষময় করিয়া তোলা হইবে। পিতামাতা যখন পরস্পরকে ভালোবাসেন এবং সন্তানদিগকে ভালোবাসেন তখন তাঁহাদের মধ্যে যৌনজীবনের মধুর প্রকাশ। পিতামাতার পরস্পরের মধ্যে সম্পর্কের বিষয় বালককে অশ্লীল কিশোরদের নোংরা হাবভাব ও কুৎসিত ইঙ্গিত হইতে শিক্ষা করিতে না দিয়া পিতামাতার নিজেদেরই এ ভার গ্রহণ করা উচিত। ছেলেমেয়ের মনে যদি এই ধারণা জন্মে যে, তাহাদের পিতামাতার যৌনজীবনের সম্পর্ক দূষণীয় গোপন ব্যাপার তবে তাহার ফলও ভাল হয় না।
যদি কোনো পরিবারের শিশুর অন্য বালকদের খারাপ সঙ্গ হইতে যৌনজ্ঞান শিক্ষার কোনো আশঙ্কা না থাকে তবে যতদিন সে স্বাভাবিক কৌতূহলের বশে এই সম্বন্ধে প্রশ্ন না করে ততদিন অপেক্ষা করা চলে। কিন্তু যৌবনাগমের পূর্বেই তাহাকে এ বিষয়ে যথাযথ জ্ঞান দিতে হইবে। ইহা অবশ্য করণীয়। যৌবনারম্ভে যে দৈহিক ও মানসিক পরিবর্তন আসে যে সম্বন্ধে বালক-বালিকাকে সম্পূর্ণ অজ্ঞ করিয়া রাখিলে তাহাদের উপর এক রকম নিষ্ঠুরতা দেখানো হয়। যৌবন-সূচনায় কিশোরী অকস্মাৎ যে দৈহিক পরিবর্তনের সম্মুখিন হয় সে সম্পর্কে আগে হইতে তাহাকে অবহিত না করিলে কোনো কঠিন রোগে আক্রান্ত হইয়াছে বলিয়া সে অত্যন্ত ভীত হইয়া পড়িতে পারে। ইহা ছাড়া যৌনবিষয়টি কিশোরদের কাছে এমন উন্মাদনাকর যে, শৈশবে এ বিষয়ে আলোচনা তাহারা যেরূপ বিজ্ঞানসম্মত মনোভাবের সহিত গ্রহণ করিত, যৌবনের রঙিন আবেশ দেহমনে ছড়াইয়া পড়িলে আর তেমনভাবে পারে না। কাজেই যৌনজীবন সম্বন্ধে কুৎসিত আলোচনা করার সম্ভাবনা বাদ দিলেও বালক বা বালিকাকে যৌবনারম্ভের পূর্বেই যৌন কাজের প্রকৃতি সম্বন্ধে শিক্ষা দেওয়া উচিত।
কখন শিক্ষা দিতে হইবে : যৌবনাগমের কতদিন পূর্বে এই শিক্ষা দেওয়া তাহা কতকগুলি বিষয়ের উপর নির্ভর করিবে। অনুসন্ধিৎসু এবং সক্রিয় বুদ্ধিসম্পন্ন শিশুকে জড়-প্রকৃতির শিশু অপেক্ষা পূর্বে এই শিক্ষা দিতে হইবে। কারণ সহজেই অনুমান করা যায়। অনুসন্ধিৎসু বালকের কৌতূহলের অন্ত নাই; কৌতূহলের বশবর্তী হইয়াই সে এইদিকে অল্পবুদ্ধি বালকের তুলনায় আগে আকৃষ্ট হইবে। কখনও কোনো অবস্থাতেই শিশুর কৌতূহল অপরিতৃপ্ত রাখা উচিত হইবে না। শিশু বয়সে যত ছোটই হউক, সে যদি জানিতে চায় তাহার কৌতূহল মিটাইতেই হইবে। কিন্তু সে যদি স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া কোনো প্রশ্ন না করে তবু পাছে সে কুসংসর্গ হইতে খারাপভাবে কিছু জানিয়া ফেলে, সে দোষ নিবারণের জন্য দশ বৎসর বয়সের পূর্বেই তাহাকে যৌনজীবন সম্বন্ধে শিক্ষা দিতে হইবে। এইরূপ ক্ষেত্রে গাছপালার বংশ বৃদ্ধি ও প্রাণীর প্রজনন সম্বন্ধে আলোচনার ভিতর দিয়া স্বাভাবিকভাবে তাহার কৌতূহল উদ্দীপ্ত করা বাঞ্ছনীয়। এইজন্য কোনোরূপ আড়ষ্টভাব বা গুরুগম্ভীর ভূমিকার প্রয়োজন নাই, খানিক কাশিয়া গলা পরিষ্কার করিয়া লইয়া শোন খোকন, এ বয়সে তোমার যে বিষয়টি জানা বিশেষ প্রয়োজন তাই এখন বলছি এই ধরনের মুখবন্ধসহ প্রসঙ্গ উত্থাপনের আবশ্যকতা নাই। অতি সাধারণভাবে দৈনন্দিন ব্যাপারের প্রসঙ্গ তুলিতে হইবে। এই জন্যই প্রশ্নের উত্তর হিসাবে ইহার আলোচনা হইলেই ভালো হয়।
বালক ও বালিকাদের প্রতি যে একইরূপ আচরণ করা দরকার এবং তাহাদিগকে যে সমভাবে শিক্ষা দেওা উচিত সে সম্বন্ধে বর্তমান যুগে কোনো যুক্তি প্রদর্শনের প্রয়োজন আছে বলিয়া মনে করি না। আমাদের বাল্যকালে ভালোভাবে লালিত-পালিত মেয়ের পক্ষে বিবাহ সম্বন্ধে কোনো কিছু না জানিয়াও বিবাহ দেওয়া রেওয়াজ ছিল; স্বামীর নিকট হইতে সে যৌন-জীবন সম্বন্ধে শিক্ষা লাভ করিত। কিন্তু অধুনাকালে এইরূপ ঘটিতে শুনি নাই। আমার মনে হয়, এখন অধিকাংশ লোকই মনে করে অজ্ঞতার উপর যে গুণের ভিত্তি, তাহার কোনো মূল্য নাই এবং বালিকাদেরও বালকের মতো জ্ঞানলাভের অধিকার আছে। যাহারা ইহা মানেন না তাহারা হয়তো এ পুস্তক পাঠ করিবেন না; কাজেই তাহাদের সঙ্গে কোনো যুক্তি-তর্কের অবতারণার প্রশ্ন উঠে না।
যৌননীতিজ্ঞানের শিক্ষা আমি সংকীর্ণ অর্থে আলোচনা করিতে চাহি না। এই সম্বন্ধে বিভিন্ন অভিমত আছে। খ্রিস্টানদের সঙ্গে মুসলমানদের পার্থক্য, মধ্যযুগীয়দের সঙ্গে স্বাধীন চিন্তাবাদীদের পার্থক্য রহিয়াছে। পিতামাতা যে যৌননীতিবিজ্ঞানে বিশ্বাস করেন, নিজেদের সন্তানদিগকেও তাঁহারা সেইমতো শিক্ষা দিতে চান; এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ করা আমি পছন্দ করি না। কিন্তু এ সব জটিল বিতর্কসংকুল প্রশ্ন বাদ দিলেও সকলের পক্ষেই প্রযোজ্য এমন বিষয় আছে।
যৌনবিজ্ঞান ও স্বাস্থ্যনীতি : প্রথমেই বলা যাইতে পারে স্বাস্থ্যনীতির কথা। যৌনব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনার সম্মুখিন হওয়ার পূর্বেই যুবকদের এ সম্বন্ধে জানা উচিত। তাহাদিগকে এ সম্বন্ধে যথাযথ শিক্ষা দিতে হইবে; কতক লোক নীতি-উপদেশ দানের উদ্দেশ্যে যৌনব্যাধির কথা অতিরঞ্জিত করিয়া প্রচার করিয়া থাকে; এইরূপ করা অনাবশ্যক। কেমন করিয়া যৌনরোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব এবং কেমন করিয়াই বা ইহা হইতে আরোগ্য লাভ করা যায় তাহাও শিখাইতে হইবে। কেবল সপ্রকৃতির সংযত ব্যক্তিদের প্রয়োজন অনুযায়ী শিক্ষাদান করিয়া অন্য সকলের দুর্ভোগকে পাপের উপযুক্ত শাস্তি মনে করা ভুল। তাহা হইলে মোটর চালনায় যে ব্যক্তি আহত হইয়াছে তাহাকেও কোনো প্রকার সাহায্য না করিতে পারি এই বলিয়া যে, অসতর্ক অবস্থায় মোটর চালানো অন্যায়, অতএব পাপ। ইহা ছাড়া যৌনব্যাধির ক্ষেত্রে যেমন, মোটর চালানোর ক্ষেত্রেও তেমনি নিরপরাধ ব্যক্তির উপর শাস্তি পড়িতে পারে; একজন অসতর্ক মোটর চালক যদি কোনো লোককে চাপা দেয় তাহাতে যেমন আহত ব্যক্তির কোনও অপরাধ নাই, তেমনই কোনো শিশু যদি সিফিলিস রোগ লইয়াই জন্মগ্রহণ করে তবে তাহাকেও দোষী বা পাপী মনে করা উচিত নহে।
যুবক-যুবতিদিগকে বুঝানো দরকার যে, শিশুর জন্মদান একটি গুরুতর ব্যাপার এবং সন্তানের স্বাস্থ্য ও সুখস্বাচ্ছন্দ্য বিধানের সম্ভাবনা আছে কিনা তাহা বিবেচনা করিয়া সন্তানোৎপাদন সর্বদাই সমর্থনযোগ্য; এমনকি ঘন ঘন বেশিসংখ্যক সন্তান হওয়ার ফলে প্রসূতির স্বাস্থ্য যদি নষ্ট হইয়া যায়, সন্তানগণ যদি রুগ্ন এবং বিকৃত মস্তিষ্ক হয়, সকলের যদি যথেষ্ট পরিমাণে খাদ্যের সংস্থান না-ও হয় তবু ইহাতে দোষ নাই। হৃদয়হীন অদৃষ্টবাদীরাই কেবল এই অভিমত পোষণ করে; তাহাদের ধারণা মানুষের দুঃখদৈন্য অসম্মান ভগবানের মহিমার পরিচালক। শিশুদের প্রতি যাহাদের প্রীতি আছে, অসহায়ের উপর দুঃখের বোঝা যাহারা চাপাইয়া দিতে চান না তাঁহারাই এই নিষ্ঠুর নীতির বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হন। ন্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধা এবং শিশুদের জীবনের প্রতি মমত্ববোধ নৈতিক মিক্ষার একটি অপরিহার্য অংশ বলিয়া বিবেচিত হওয়া উচিত।
মেয়েদিগকে একদিন সন্তানের জননী হইতে হইবে; এইজন্য তাহাদের পক্ষে তকালে প্রয়োজন লাগিতে পারে এমন কতক জ্ঞান মোটামুটি অর্জন করা উচিত। অবশ্য বালক ও বালিকা উভয়কেই শারীরবিদ্রা ও স্বাস্থ্যনীতি কিছু কিছু শিখিতে হইবে। কিশোর-কিশোরীকে ইহা স্পষ্টভাবে বুঝাইতে হইবে যে অপত্যস্নেহ ব্যতীত কেহ ভালো পিতামাতা হইতে পারে না; শুধু তাহাই নহে, অপত্যস্নেহের সঙ্গে অনেকখানি জ্ঞানের প্রয়োজন। শিশুর সহিত আচরণের প্রবৃত্তি ব্যতীত জ্ঞান এবং জ্ঞান ব্যতীত প্রবৃত্তি উভয়ই সমান অকেজো। জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা যতই অনুভূত হইবে ততই বেশিসংখ্যক বুদ্ধিমতী স্ত্রীলোক মাতৃত্বের প্রতি আকৃষ্ট হইবে। বর্তমানে অনেক উচ্চশিক্ষিত মহিলা ইহাকে অবজ্ঞা করেন; তাঁহাদের ধারণা বুদ্ধি প্রয়োগের সুযোগ ইহার ভিতর নাই। বুদ্ধিমতী উচ্চশিক্ষিতা মহিলাদের পক্ষে মাতৃত্ব লাভ হইতে বিরত থাকা সমাজের পক্ষে বড়ই দুর্ভাগ্যের বিষয়। কারণ এ দিকে তাঁহাদের চিন্তা নিয়োজিত হইলে তাহারা উৎকৃষ্ট জননী হইতে পারেন। যৌনপ্রেম ও হিংসা : যৌন ভালোবাসা সম্বন্ধে শিক্ষা-প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয়ে বিশেষ অবহিত হওয়া প্রয়োজন। প্রেমের ব্যাপারে জোর জবরদস্তি বা হিংসা সুখবহ হয় না; বরং দুঃখ ও অশান্তি সৃষ্টি করে। স্থূলপ্রেম যখন মূর্ত হইয়া ওঠে অর্থাৎ প্রেমের বস্তুর উপর যখন অধিকার বিস্তারের বাসনা জাগে তখনই প্রেমের স্বাধীনতা লোপ পায়, ব্যক্তিত্বের অবসান ঘটে; যেখানে এইরূপ কড়াকাড়ি নাই, সেইখানে আছে নিবিড় আনন্দের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। পূর্ববর্তী যুগে পিতামাতা সন্তানদের নিকট হইতে কর্তব্য হিসাবে ভালোবাসা আদায় করিতে চেষ্টা করিয়া সন্তান-সন্ততির সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক তিক্ত করিয়া তুলিয়াছিলেন। এখনও অনেক স্বামী-স্ত্রী এই একই প্রকার ভুল পন্থা অবলম্বন করিয়া পরস্পরের মধ্যেকার প্রীতির সম্পর্ক ধ্বংস করিয়া ফেলেন। ভালোবাসাকে কর্তব্য বলিয়া গণ্য করা যায় না, কেননা ইহা ইচ্ছার বশ নহে। ইহা একটি শ্রেষ্ঠ স্বর্গীয় দান। ইহা মুক্ত ও স্বতঃস্ফূর্ত হইলে সৌন্দর্য ও আনন্দের শতদল বিকশিত করিয়া তোলে কিন্তু খাঁচায় ভরিয়া রাখিলে প্রেমের অপমৃত্যু ঘটে। এখানেও ভয় শত্রু। জীবনে আনন্দের উপাদান হারাইবার ভয়ে যে ব্যক্তি ভীত হয় এবং ইহাকে আষ্টেপৃষ্টে আঁকড়াইয়া ধরিতে চেষ্টা করে তাহার ভাগ্যে কখনও সুখ প্রাপ্তি ঘটে না। অন্যান্য ব্যাপারে যেমন, যৌনপ্রেমের ব্যাপারেও তেমনই নির্ভীকতাই বুদ্ধি ও বিজ্ঞতার মূল।