১২. যখন ইদরিস মিয়ার কাছ থেকে সবাই যুদ্ধের গল্প শুনেছে।
ইদরিস মিয়ার চালাঘরের সামনে ছোট একটা আগুন জ্বলছে। সবাই আগুনটাকে ঘিরে বসেছে। আগুনের শিখা লকলক করছে, তার লালাভ আলোতে সবাইকে কেমন জানি অবাস্তব দেখায়। মিঠুন একটা কাঠি দিয়ে একটু পর পর জ্বলন্ত কাঠকুটোতে খোঁচা দিচ্ছে এবং তখন আগুনের ফুলকি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে।
ইদরিস মিয়া একটু উবু হয়ে বসেছে, আগুনের জ্বলন্ত শিখায় তার এলোমেলো চুল, খোঁচা খোঁচা দাড়ি গোঁফ আর মুখে। বয়সের ছাপ যেন আরো অনেক বছর বেড়ে গেছে। দূর থেকে ভেসে আসা নদীর ঢেউয়ের শব্দ, এলোমেলো বাতাস আর আগুনের শিখার শব্দের মাঝে ইদরিস মিয়া আসাদ রহমানের জীবনের শেষ কয়টা দিনের কথা বলছে। সবাই নিশ্বাস বন্ধ করে সেই অবিশ্বাস্য দিনগুলোর কথা শুনছে।
ইদরিস মিয়া বলছে, এই এলাকায় তখন পাকিস্তানি মিলিটারির খুব উৎপাত। ওরা বাংকারে থাকে। বাংকারগুলো অনেক শক্ত। প্রথম আস্তরে মাটি আর টিনের দেওয়াল। তারপর ছয় ইঞ্চি পরপর লোহার বিম, সেইখানে কংক্রিটের আস্তর। বাংকারের কাছে কেউ যেন যেতে না পারে সেইজন্য সামনে মাইন, বুট্র্যিাপ আর বাঁশের কঞ্চি।
পাকিস্তানিরা দিনের বেলা অনেক এলাকা মিলিয়ে ডিফেন্স নিয়ে থাকতো। রাতের বেলা দূরের বাংকারগুলো ছেড়ে সেকেন্ড লাইন অফ ডিফেন্সে চলে যেত। সেকেন্ড লাইন অফ ডিফেন্স ঘন, অনেক কাছাকাছি। সেখানে অনেকগুলো ভারী মেশিন গান সবসময় রেডি থাকে।
আমাদের কুড়ি জনের একটা দল তৈরি হয়েছে। এইটা একটা স্পেশাল প্লাটুন। আমাদের কাজ হচ্ছে সবসময় পাকিস্তানিদের আশেপাশে থাকা আর সুযোগ পেলেই তাদের ওপর একটা হামলা করা। সারাক্ষণ ওদের ওপর হামলা করার জন্য ওরা ব্যস্ত থাকে, মনের দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন যখন রেগুলার বাহিনী সামনাসামনি আক্রমণ করে ওরা সহজে ঘায়েল হয়ে যায়।
আসাদ ভাই আমাদের দলটার কমান্ডার। অসম্ভব সাহসী মানুষ। একেবারে সিংহের মতো সাহস।
টিয়া বলল, আসাদ মানে সিংহ। সিংহের মতো সাহস তো হবেই।
ইদরিস মিয়া মাথা নাড়লেন, বললেন, ঠিকই বলেছ বোন। যার নাম সিংহ তার কাম তো সিংহের মতন হবেই। যাই হোক একদিন আমাদের কাছে জরুরি অর্ডার এসেছে এই পাকিস্তানিদের ঘাঁটিতে একটু হামলা করার। আজকে রাতেই হামলা করতে হবে। মাঝ রাতের আগে। হামলা করে কমপক্ষে তিন ঘন্টা যুদ্ধ করতে হবে। কারণটা কী আমরা তখনও জানি না। কিন্তু অর্ডার যখন হয়েছে আমরা হামলা করার জন্য রেডি হয়ে গেলাম।
যাই হোক আমরা সন্ধ্যাবেলা রওনা দিয়েছি। পরনে লুঙ্গি আর শার্ট। খালি পা। পিঠে চাইনিজ লাইট মেশিন গান আর দুইটা ম্যাগাজিন। ম্যাগাজিন দুইটা খুব ভারী। কোমরে চারটা গ্রেনেড। ঘুটঘুটে অন্ধকার, বৃষ্টি হয়েছে। পথে ঘাটে কাদা। আমরা শব্দ না করে হাঁটার চেষ্টা করছি। তবু দেখি প্যাঁচপ্যাঁচে শব্দ হয়। আমরা পাকিস্তানিদের কাছাকাছি আসার পর আসাদ ভাই যার যার পজিশনে বসিয়ে দিলেন। তারপর নিজে বাংকারগুলো রেকি করতে গেলেন। সামনের বাংকারগুলো খালি দেখে আসাদ ভাই আরেকটু এগিয়ে গেলেন। ঠিক তখন দুইজন পাকিস্তানি মিলিটারি মনে হয় পেট্রোলিং করে ফিরে আসছে, একেবারে আসাদ ভাইয়ের মুখোমুখি।
অন্ধকারে পাকিস্তানি মিলিটারি বুঝে নাই আসাদ ভাইকে, মনে করেছে তার দলের কেউ। জিজ্ঞেস করে, কৌন হো?
আসাদ ভাই তার রাইফেলের বাট দিয়ে ব্যাটার মুখে মেরে বলল, তোমহারা বাপ হো।
তারপর ঝটকা মেরে পাকিস্তানি মিলিটারিটার রাইফেলটা কেড়ে নিয়ে চিৎকার করে বলল, ফায়ার! আর আমরা সাথে সাথে গুলি করতে শুরু করলাম। মিলিটারি লাফিয়ে একটা বাংকারে ঢুকে গেল আর আসাদ ভাই একটা বাড়তি জি থ্রি রাইফেল নিয়ে ক্রলিং করে ফিরে এলেন।
ঘুটঘুটে অন্ধকার, ঝম ঝম করে বৃষ্টি হচ্ছে। তার মাঝে আমি আন্দাজের উপর গুলি করছি। পাকিস্তানিদের মাঝে হৈ চই শুরু হয়ে গেল। তারা অবশ্য খুব এক্সপার্ট। জন্ম থেকে খালি যুদ্ধই করে আসছে তাই আমাদের এটাক সামলে নিয়ে পাল্টা এটাক শুরু করল। হঠাৎ দেখি সামনের বাংকার থেকে প্রচণ্ড শব্দ করে ভারী মেশিনগান থেকে গুলি হতে শুরু করেছে। একেবারে মাথার কাছ দিয়ে গুলি ছুটতে লাগল। এর মাঝে দেখলাম আসাদ ভাই ক্রলিং করে আমার কাছে এসেছেন। গুলির শব্দে কিছু শোনা যায় না, তার মাঝে চিৎকার করে বললেন, মেশিনগানটা থামাতে হবে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কীভাবে?
আসাদ ভাই বললেন, কভার দাও। আমি যাচ্ছি।
আমি বললাম, যাবেন না। এই ভাবে যাবেন না।
আসাদ ভাই বললেন, আমার গায়ে লাগাতে পারে সেই গুলি ইয়াহিয়া খানের বাপের কাছেও নাই!
আমি কভার দিলাম। আর সত্যি সত্যি আসাদ ভাই কাছে গিয়ে একটা গ্রেনেড চার্জ করলেন আর সাথে সাথে মেশিনগান থেমে গেল।
কতক্ষণ গুলি চলেছে খেয়াল নাই। একসময় আসাদ ভাই আমাদের ফিরে যাওয়ার সংকেত দিয়েছেন। বৃষ্টিও কমে আসছে। আমরা ক্রলিং করে পিছিয়ে এসেছি। একদিনের জন্য যথেষ্ট হয়েছে।
ফিরে এসে খবর পেলাম যে জন্যে এটাক করতে অর্ডার দিয়েছিল সেটা ঠিক ঠিক হয়েছে। আশপাশের গ্রাম থেকে অনেক মেয়েদের ধরে এনেছিল। আমরা যখন এটাক করেছি তখন মেয়েগুলো পেছন দিয়ে পালিয়ে গেছে। আগেই খবর দেওয়া ছিল, তাই তারা রেডি হয়ে ছিল। আমাদের মিশন কমপ্লিট।
পরের দিন আমরা দেখলাম মিলিটারি আর রাজাকার মিলে সকাল থেকেই অত্যাচার শুরু করে দিয়েছে। গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে, লুটতরাজ করছে, মানুষের চিৎকার কান্নাকাটি। একেবারে ভয়ংকর অবস্থা। তারপর দুইটা নৌকা বোঝাই করে লুট করা মালামাল নিয়ে এই নদী দিয়ে রওনা দিয়েছে। খবর পেলাম বিশ পঁচিশ জন নৌকার ছইয়ের ওপর অস্ত্র নিয়ে বসেছে। আসাদ ভাই বলল, বদমাইশদের অ্যামবুশ করতে হবে। আমরা নদীর তীরে পজিশন নিয়ে অপেক্ষা করছি। নৌকার জন্য অপেক্ষা করছি হঠাৎ শুনি বুটের ধুপ ধাপ শব্দ।
পাকিস্তান মিলিটারির একটা দল নৌকা করে রওনা দিয়েছে, অন্য আরেকটা দল নদীর তীরে ধরে হেঁটে আসছে। আমাদের মাথায় বাজ পড়ল, আমরা এই জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। তা ছাড়া আমাদের পজিশনটা খুবই খারাপ।
আসাদ ভাই একটুও ঘাবড়ালো না। আমাকে ডেকে বলল, আমি এদের আটকে রাখব, তুমি সবাইরে নিয়ে সরে যাবে!
আমি বললাম, এইটা হয় না। মরলে সবাই মরব।
আসাদ ভাই বলল, কেউ মরবে না। আগে নৌকার মিলিটারিগুলারে শেষ করি।
আমরা গুলি শুরু করতে লাগলাম, মুহূর্তের মাঝে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। নৌকার ওপরে যেগুলো ছিল সেগুলো পাখির মতো পানিতে পড়ে মারবেলের মতো ডুবে যেতে লাগল। যে মিলিটারিগুলো আসছিল তারা আমাদের জন্য রেডি ছিল না, তারপরেও নদীর পাড়ে পজিশন নিয়ে ফায়ার শুরু করতে লাগল।
আসাদ ভাই একটা মাটির ঢিবির পিছনে কভার নিয়ে তার এল এম জিটা দিয়ে গুলি করতে করতে আমাদের বলতে লাগলেন, তোমরা যাও। যাও।
আমরা যখন পিছিয়ে যাচ্ছি তখন আসাদ ভাই গুলি খেলেন। আমরা দেখলাম তার মুখ থেকে রক্ত পড়তে লাগল তখনও তিনি থামলেন না। গুলি করতেই থাকলেন, গুলি করতেই থাকলেন।
পাকিস্তানি মিলিটারি হঠাৎ পিছিয়ে যেতে শুরু করল। কিছুক্ষণের মাঝেই তারা পিছনে সরে গেল, গোলাগুলি বন্ধ হয়ে গেল। আমরা তখন আসাদ ভাইকে উদ্ধার করার জন্য ছুটে এসেছি। তখনো তার জ্ঞান আছে। বুকের ডান পাশে কাঁধ দিয়ে গুলি ঢুকে পেটের ভিতর দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। রক্তে শরীর ভেসে যাচ্ছে। শীতে থর থর করে কাঁপছেন। আমরা আমাদের নিজেদের কাপড় খুলে তাকে ঢেকে শরীরটা গরম করার চেষ্টা করলাম।
আসাদ ভাই আমার হাতটা ধরে বললেন, ইদরিস আমি আর বাঁচবো না।
আমি বললাম, এইভাবে বলবেন না আসাদ ভাই।
আসাদ ভাই বললেন, আমি স্বাধীন দেশটা দেখতে পারলাম না। তুমি দেখবা। আমার ছেলেমেয়ে দেখব। নাতি-নাতনি দেখব। দেখব না?
আমি বললাম, দেখবে আসাদ ভাই। অবশ্যই দেখবে।
আমার পকেটে একটা চিঠি আছে। আমি আমার বউকে লিখেছি। তুমি তার কাছে পৌঁছায়া দিও।
আমি বললাম, দিব আসাদ ভাই।
তারপর আসাদ ভাই চোখ বন্ধ করে আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে গেলেন। আমি আসাদ ভাইয়ের হাত ধরে রাখলাম কিন্তু আসাদ ভাই আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন।
ইদরিস মিয়া তার কাহিনী শেষ করে কিছুক্ষণ চুপ কওে বসে রইল। তারপর তার পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে ওদের দিকে এগিয়ে ধরলেন। বললেন, এই যে চিঠিটা। চৌত্রিশ বছর থেকে আমি বাঁচায়ে রাখছি। চিঠির সাথে কোনো ঠিকানা ছিল না তাই আসাদ ভাইয়ের পরিবারের কাছে পৌঁছাতে পারি নাই। অনেক চেষ্টা করেছিলাম কাউরে খুঁজে পাই নাই। তোমরা তোমাদের নানির কাছে কিংবা দাদির হাতে দিও।
রিতু চিঠিটা হাতে নিল, বলল, দিব।
ইদরিস মিয়া বলল, আমার দায়িত্ব আজকে শেষ হলো।