দ্বাদশ অধ্যায় – মুঘল সাম্রাজ্যের ক্রান্তিকাল এবং সংকট
মারাঠা শক্তির অভ্যুত্থান
রাজপুতদের মতোই মারাঠা শক্তিরও অভ্যুত্থান ঘটে মধ্যযুগেই, অর্থাৎ অষ্টাদশ শতাব্দীর পরবর্তী সময়কালে। উভয় শক্তিই একটি মিশ্র বর্ণের সমন্বয় থেকে উদ্ভূত–এ বিষয়টি নিয়ে ইতিপুর্বেই দীর্ঘভাবে আলোচনা হয়েছে। মধ্যযুগীয় ভারতে ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং ক্ষাত্র সমাজধারা উভয়েই যে প্রভাব বিস্তার করেছিল তা নিঃসন্দেহ। সুতরাং যারা বিভিন্ন চাকুরিতে, বিশেষ করে সেনাবাহিনীর কাজে নিযুক্ত ছিল তারা ভূমিস্বত্ব ভোগীদের সঙ্গে একত্রিত হয় ক্রমশ নিজেদের একটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠী গড়ে তোলে। বিবাহের পাত্রপাত্রীরা উভয়েই এই সম্প্রদায় থেকেই নির্বাচিত হত, এবং এরা কতকগুলি আচরণবিধিও মেনে চলতেন। যথা, বিধবাদের পুনর্বিবাহ প্রথার বিলোপ সাধন এবং কিছু কিছু খাদ্যাভ্যাস পরিত্যাগ ইত্যাদি। সামাজিকতার নিরিখে এরা নিজেদের উচ্চবর্গের মানুষ বলে মনে করতেন। তবে রাজপুতদের মতো মারাঠারা কিন্তু স্বতন্ত্র স্বশাসিত রাজ্য গঠন করে উঠতে পারেনি। তারা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর প্রভাবশালী নেতা হয়ে উঠতে পেরেছিলেন এইমাত্র। প্রয়োজনে অন্য কোনো শক্তি উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এদের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করতেন। এই বিচ্ছিন্ন শক্তিগুলিকে বারগির বলা হত।
বাহমনি রাজত্ব কাল এবং তার পরবর্তী শাসকদের সাহায্যে মারাঠা গোষ্ঠী-প্রধান, বা সর্দারদের রাষ্ট্রের শাসন কার্যে নিয়োগ করা হত এবং তাদের মধ্যে মোরে, ঘাটগে, নিম্বলকার ইত্যাদিরা বহু বৎসর ধরেই আঞ্চলিক শাসকের কর্তৃত্ব ভোগ করে এসেছেন। পরবর্তীকালে প্রথমে মালিক অম্বর এবং পরে মুঘলেরা যখন তাদের সমর্থন আদায় করতে প্রতিযোগিতায় নামলেন তখন নিঃসন্দেহে এই মারাঠা সর্দারদের অবস্থার আরও উন্নতি হল।
সপ্তদশ শতকে মারাঠাদের উত্থান এবং পরবর্তীকালে স্বাধীন মারাঠা রাজ্য স্থাপনের সঙ্গে শিবাজির পরিবারের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিল। শিবাজির পূর্বপুরুষ বাবাজী, পুনা জেলার হিঙ্গানী বারাদি এবং দেবলগাঁও গ্রামের প্যাটেল বা গ্রামপ্রধান ছিলেন। তাঁর দুই পুত্র মালোজী এবং ভিঠোজী দৌলতাবাদ জেলায় বসতি স্থাপন করেন এবং সিন্ধখেড়ের যাদবদের অধীনে সাধারণ অশ্বারোহীর কাজে নিযুক্ত হন। এই বংশের শাখা ঘোড়পাড়েরা বিজাপুর রাজ্যের প্রতিষ্ঠিত নাগরিক হয়ে ওঠেন। পরবর্তী সময়ে মালিক অম্বরের অধীনে মালোজী যথেষ্ট প্রতিপত্তি লাভ করেন। এই পরিবারের সামাজিক উন্নয়নের এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল মালোজীর পুত্র শাহজীকে মালিক অম্বর কর্তৃক ১৬২২ সালে শোলাপুর এবং পুনার অধিকার প্রদান। এই পরগনাগুলি তখন মুরারী পণ্ডিত নামে এক সর্দার বিজাপুরের তরফে অধিকার করে। রেখেছিলেন। এবং এই মুরারী পণ্ডিতকে এই অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করে শাহজী প্রচুর সুনাম অর্জন করেন। ১৬৩০ সালে শাহজীর শ্বশুর লুখাজি যাদবকে আহমদনগর রাজসভায় চক্রান্ত করে হত্যা করার ফলে শাহজী প্রতিবাদে দলত্যাগ করে মুঘলদের পক্ষে যোগ দেন, এবং সম্রাট শাহজাহান তাকে ৫০০০ জাট, ৫০০০ সাওয়ার-এর মনসব, এবং পুনা নগরীটি উপহারস্বরূপ প্রদান করেন। তাঁর ভ্রাতা মিনাজি এবং জ্যেষ্ঠপুত্র সাম্বাদীকেও মসনদ দেওয়া হয়। ঘটনাক্রমে শাহজীর সঙ্গে মুঘলদের এই সম্পর্ক অবশ্য স্বল্পস্থায়ী হয়। মালিক আম্বারের পুত্র ফেখ খান ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে দৌলতাবাদ দুর্গ সমর্পণ করে মুঘলদের অধীনে কার্য গ্রহণ করেন এবং তাকে পুনা নগরীটিও জায়গির হিসাবে দেওয়া হয়। সেই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে শাহজী দলত্যাগ। করে বিজাপুরের পক্ষে যোগদান করেন। ২ ফেথ খানের সঙ্গে চুক্তি হওয়ার পরেই নিজাম শাহকে গোয়ালিয়র দুর্গে বন্দি করে রাখা হয়। ফলত, বিজাপুরের পৃষ্ঠপোষকতায় শাহজী নিজামশাহী রাজবংশের রক্ষক হয়ে উঠেন। মালিক আম্বসার-এর পথ অনুসরণ করে শাহজী একজনকে নিজামশাহী যুবরাজ হিসেবে নির্বাচিত করেন এবং তাকে শাহগড়ের শাসন কর্তা হিসেবে গড়েও তোলেন। আদিল শাহ ও শাহজীর সাহায্যার্থে সাত থেকে আট হাজারের এক অশ্বারোহী দল প্রেরণ করেন। তিনি আবার নিজস্ব কেল্লা ও নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের অধিকারী নিজামশাহীর বহু অভিজাত ব্যক্তিকে ও শাহজীর পক্ষ অবলম্বন করতে সম্মত করান। নিজামশাহীর বহু কর্মচ্যুত সৈন্যও শাহজীর সঙ্গে যোগদান করেন এবং এর ফলে শাহজীর অশ্বারোহী সৈনিকের সংখ্যা হয়ে দাঁড়ায় বিশ হাজার। পর্যাপ্ত শক্তির অধিকারী শাহজীও মুঘলদের উত্ত্যক্ত করে তুলতে থাকেন এবং আহমদ নগর রাজ্যের বৃহদংশ তার অধিকারে আসে। শোনা যায় যে মোট ৮৪ লক্ষ হান উৎপাদনের মধ্যে শাহজীর অধিকৃত অঞ্চলের পরিমাপ ছিল তত লক্ষ হান, বিজাপুরের তত লক্ষ হান এবং মোগলদের কর্তৃত্ব ছিল ২১ লক্ষ।
ভবিষ্যতে শিবাজির উত্থান এবং কীভাবে তার অধীনে ভোঁসলেরা অন্য কাউকে রাজারূপে (রাজা বানানোর বদলে) প্রতিষ্ঠা করার কার্য ছেড়ে নিজেরাই রাজা হয়ে ওঠেন–ইত্যকার ঘটনাবলি বুঝে ওঠার জন্য এতক্ষণ যে পশ্চাদপটটি তুলে ধরা হল, তা অত্যন্ত জরুরি।
শিবাজির প্রথম জীবন
মুঘলদের সঙ্গে ১৬৩৬ সালে সন্ধি স্থাপনের পর শাহজীকে আহমদনগরে তার শাসনাধীন বহু অঞ্চল ছেড়ে দিতে হয়। তিনি বিজাপুরের সুলতানের অধীনে চাকুরি গ্রহণ করেন এবং চুক্তি অনুযায়ী তাকে মুঘল সাম্রাজ্যসীমা থেকে বহুদূরে কর্ণাটক রাজ্যের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই অসংবদ্ধ অবস্থার সুযোগ নিয়ে বুদ্ধিমান শাহজী। ব্যাঙ্গালোরে এক অর্ধস্বাধীন রাজ্যখণ্ড প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা শুরু করেন। গোলকুণ্ডার অগ্রণী অভিজাত মির জুমলা ঠিক এইভাবেই করমণ্ডল উপকূলের এক অংশে রাজ্যখণ্ড প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছিলেন। অন্যান্য অনেক প্রধানই একই পথে চলেছিলেন। সাদি বা পশ্চিম উপকূলের অবিসিয়াগণ অধিকারীদের নাম এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়।
পুনার জায়গিরটি শাহজি তার অবহেলিত প্রথমা স্ত্রী জিজাবাই এবং নাবালক পুত্র শিবাজিকে ছেড়ে দিয়ে আসেন। মাত্র ১৮ বৎসর বয়সে ১৬৪৫-৪৭ সালে রাজগড়, কোণ্ডানা এবং তোরনা নামে পুনার নিকটবর্তী কয়েকটি পার্বত্য দুর্গ জয় করে শিবাজি তার সামর্থ্যের পরিচয় দেন। ১৬৪৭ সালে তার অভিভাবক এবং শিক্ষক দাদাজী কোণ্ডাদেবের জীবনাবসানের পর শিবাজি আর কারও কর্তৃত্বাধীন রইলেন না, ফলত তার পিতার জায়গিরের সর্বময় কর্তাও হয়ে উঠলেন এই তরুণ যুবক।
শিবাজি যে তার পিতার ইচ্ছার বিরুদ্ধাচারণ করেছিলেন এ কথা ভাববার কোনো কারণ নেই। প্রকৃতপক্ষে শাহজী ব্যাঙ্গালোরে যা করেছিলেন, শিবাজি পুনায় সেই ভাবেই শাসন করতে থাকেন, এবং এর কারণগুলিও মোটামুটি একই রকম ছিল। কর্ণাটক ছিল সীমান্তবর্তী একটি এলাকা এবং বিজাপুরের শাসকেরা এই অঞ্চলকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেন না। ১৬৩৬ সালে শাহজাহানের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের পর বিজাপুর দক্ষিণ ভারতের দিকে মনোনিবেশ করেন এবং শাহজাহান। মধ্য এশিয়া এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, ফলত পুনাও হয়ে ওঠে অপেক্ষাকৃত অবহেলিত অঞ্চল।
বিজাপুরের প্রশাসন অবশ্য পিতা ও পুত্রকে পৃথক ভাবে যে চিন্তা করেননি, ১৬৪৪ সালে রচিত একটি আদেশনামায় তার প্রতিফলন ঘটে। এই ফরমানে কামোজি জেঢেকে নির্দেশ দেওয়া হয় যে, তাঁর প্রতিনিধি দাদাজী কোণ্ডদেব কোনদামাতে রাজদ্রোহীতা প্রদর্শন করার জন্য। শাহজীকে দরবার থেকে বিতাড়িত এবং তার সম্মান হরণ করা হল। যদিও প্রকৃতপক্ষে দাদাজী কোণ্ডদেব ছিলেন শিবাজির সঙ্গে, শাহজীর সঙ্গে নয়। এর পরে খান্দোজী এবং বাজী ঘোরপাড়েকে নিয়ে একটি পরিষদ গঠন করা হয়, যাদের দায়িত্ব ছিল শাহজীর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এই তদন্ত কার্য ১৬৪৯ সাল অবধি অসমাপ্ত অবস্থায় চলতে থাকে। যখন তার প্রধান পৃষ্ঠপোষক রনদউলা খানের মৃত্যুর পর শাহজীকে কারারুদ্ধ করা হয়। এর পরেই শিবাজি তার পিতার মুক্তিসাধনের উদ্দেশ্যে মুঘলদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন এবং আলোচনা শুরু করেন।
তার মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে শাহজী ১৬৫৬ সালে পুনায় গিয়ে শিবাজির অধিকৃত সমগ্র অঞ্চল পরিদর্শন করেন এবং সম্ভবত তাকে প্রশাসনিক বিষয়ে কিছু পরামর্শও দান করেন।
শিবাজির বিজয় অভিযান প্রকৃতপক্ষে ১৬৫৬ সালেই আরম্ভ হয় যখন তিনি মারাঠা দলপতি চন্দ্ররাও মোরের নিকট থেকে জাভলি অধিকার করে নেন। মোরেদের বহুদিনের সঞ্চিত ধনরত্ন সমেত জাভেলি একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য ছিল মোরেদের। এবং এটি অধিকার করতে শিবাজি ছলনার আশ্রয় নেন। জাভেলি জয় করার পর শিবাজি মহারাষ্ট্রের উচ্চভূমির জাভেলি অঞ্চলের অবিসংবাদী অধিকর্তা হয়ে ওঠেন; ফলত সাতারা এবং উপকূলবর্তী কোঙ্কন অঞ্চল অভিযানের পথ তাঁর কাছে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত হয়ে যায়। জাভলির পদাতিক সেনারাও শিবাজির সেনানীর এক শক্তিশালী অঙ্গ বলে প্রমাণিত হয় এবং তাদের সাহায্যে শিবাজি পুনার নিকটবর্তী আরও কয়েকটি দুর্গ অধিকার করে নিজের অবস্থান আরও শক্তিশালী করে তোলেন।
মোগলরা ১৬৫৭ সালে বিজাপুর আক্রমণ করায় শিবাজি বিজাপুরের প্রত্যাঘাত থেকে রক্ষা পান। শিবাজি প্রথমে ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে আলোচনা শুরু করলেও পরে তিনি তার অবস্থান পরিবর্তন করে মুঘল অঞ্চলের গভীরে আক্রমণ চালিয়ে বহু ধনসম্পদও অধিকার করে নেন। গৃহযুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রস্তুতির সময় ঔরঙ্গজেব যখন বিজাপুরের সঙ্গে সমঝোতায় আসেন তখন তিনি শিবাজিকেও ক্ষমা করেছেন। কিন্তু তিনি শিবাজিকে বিশ্বাস করতেন না। এবং সেইজন্য বিজাপুরকে শিবাজিকে বিজাপুরী অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করতে বলেন। যদিও তাকে আবার কর্মে নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়াই হয়, তাহলে বিজাপুর যেন তাকে সুদুর কর্ণাটকে, মুঘল সাম্রাজ্য সীমা থেকে বহুদূরে প্রেরণ করেন, এই ছিল ঔরঙ্গজেবের পরামর্শ।
শিবাজির উচ্চাশার সম্বন্ধে ধারণা করতে হলে মুঘলদের সঙ্গে শিবাজির পারস্পরিক আদানপ্রদানের ধরন বা চরিত্রকে বুঝে ওঠা বিশেষ সহায়ক হতে পারে। ১৬৪৮ সালে তার পিতার মুক্তির বিষয়ে সহায়তা করবার জন্য শিবাজি দাক্ষিণাত্যের মুঘল রাজ্যপাল শাহজাদা মুরাদ বক্স-এর নিকটে যান এবং মুঘলদের কর্মে যোগ দেবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তখন শাহজাদা তাকে পাঁচ হাজারের মনসব দেবার এবং শাহজীর পূর্বতন ৫০০০ মনসব তাকে ফিরিয়ে দেবার প্রস্তাব দেন। শিবাজি জুন্নার এবং আহমেদনগরের পরগনার দেশমুখের পদও উপরন্তু দাবি করলে শাহজাদা, বাদশাহের উপস্থিতিতে তার এই ইচ্ছাপূরণেরও কথা দেন। কিন্তু মুঘলদের মধ্যস্থতা ছাড়াই শাহজী ইতিমধ্যে মুক্তি পান।
১৬৫৭ সালে মুঘলদের বিজাপুর আক্রমণের সময় শিবাজি দাবি করেন যে বিজাপুরের অধিকারভুক্ত যতগুলি কেল্লা ও মহল শিবাজির দখলে ছিল, সেইগুলির স্বত্ব তাকে দান করা হোক এবং দাতোল বন্দর এবং তার অধীনস্থ সমস্ত রাজ্যও তার অধিকারভুক্ত করা হোক। ঔরঙ্গজেব এতে সম্মতও হন। কিন্তু আদিল শাহের অধীনস্থ কোঙ্কনের সমস্ত কেল্লা এবং অঞ্চলসমুহের অধিকার শিবাজি দাবি করলে, ঔরঙ্গজেব তাতে পিছিয়ে আসেন। যদিও বাদশাহ আদিল শাহের অধিকারভুক্ত সমগ্র রাজত্ব। অধিকার করে ফেরার পরেই শিবাজি তার দাবি পূরণের অনুরোধ করেছিলেন। মোঘলদের অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ-বিগ্রহের সুযোগ নিয়ে শিবাজি পুরন্দর জয় করে নিয়েছিলেন এবং কল্যাণ ও ভিওয়ান্দি সহ কোঙ্কনের উত্তর অংশও তার অধিকারভুক্ত করতে পেরেছিলেন।
এ কথা পরিষ্কার যে তাদের রাজ্যের সীমান্ত অঞ্চলে এক স্বাধীন ও শক্তিশালী মারাঠা রাজ্য গড়ে উঠুক, মুঘলরা এটি চাননি। কোঙ্কনের উত্তরে শিবাজির প্রবেশ এবং তার কল্যাণ ও ভিওয়ান্দি অধিকারের ব্যাপারে বিজাপুরী প্রশাসন বিশেষ চিন্তিত। হয়ে পড়েন। কোঙ্কন শুধু বিজাপুরে-জাত দ্রব্যাদি রপ্তানির জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ছিল না, কল্যাণ ও ভিওয়ান্দি যুদ্ধের অশ্বসকল আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় বন্দর বলে বিবেচিত হত। এই যুদ্ধের ঘোড়া আমদানির ব্যবসাটি পর্তুগিজরা তাদের একচেটিয়া করে নেবার চেষ্টা চালাচ্ছিল। এইসব কারণেই বিজাপুরের এক অগ্রণী অভিজাত আফজল খাঁকে, দশ হাজার সৈন্য সহ শিবাজির বিরুদ্ধে অভিযানে পাঠানো হয়। তার উপর নির্দেশ ছিল যে-কোনো প্রকারে বা যেভাবেই হোক শিবাজিকে বন্দি করা। তখন বিশ্বাসভঙ্গ ও ছল-চাতুরীকে যুদ্ধ জয়ের অঙ্গ হিসাবে মনে করা হত, এবং আফজল খাঁ ও শিবাজি উভয়েই বেশ কয়েকবার এই ছল-চাতুরীর আশ্রয় নিয়েছেন। শিবাজির সৈন্যেরা খোলাখুলি লড়াইয়ে অভ্যস্ত ছিল না এবং সেই জন্যই তারা এই শক্তিশালী সেনাপতির সঙ্গে সম্মুখ সমরে লিপ্ত হতে চায়নি। বিজাপুরের শাসকদের থেকে তিনি শিবাজির মার্জনা আদায় করবেন এই অঙ্গীকার করে আফজল খান শিবাজিকে তাঁর সঙ্গে আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ পাঠালেন। শিবাজি নিশ্চিত জানতেন যে এটি একটি ফঁদ মাত্র, তাই তিনি প্রস্তুত হয়েই এই বৈঠকের জন্য গেলেন এবং দুঃসাহসিক ধূর্ততার সঙ্গে আফজল খানের প্রাণ নাশ করলেন (১৬৫৯)। শিবাজি আফজল খাঁর নেতাহীন বিশৃঙ্খল সৈন্যদলকে ধ্বংস করে গোলাবারুদ সহ তাদের সমস্ত সাজ-সরঞ্জাম লুট করে নিলেন। এই বিজয় গর্বে উৎসাহিত মারাঠা সৈন্যদল পানহালার দুর্গ জয় করে কোলাপুর জেলা এবং দক্ষিণ কোঙ্কন উপকূলে জলস্রোতের মতো প্রবেশ করে। এ ছিল এক ব্যাপক বিজয়াভিযান।
এই সব কর্মকাণ্ডের পরে শিবাজি প্রায় এক প্রবাদপুরুষ হয়ে ওঠেন। ঘরে ঘরে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে এবং তাকে অপরাজেয় ঐন্দ্রজালিক (জাদু) শক্তির অধিকারী বলেও লোকমুখে প্রচার করা হতে থাকে। মারাঠা অঞ্চলের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ দলে দলে তার কাছে এসে তার সৈন্যদলে যোগদান করতে থাকে, এমনকি পুর্বর্তন বিজাপুর কর্মে প্রশাসনের সৈন্যদল-ভুক্ত অনেক পেশাদারি আফগান সৈন্যও তাঁর
সৈন্যদলে যোগ দেয়।– ইতিমধ্যে ঔরঙ্গজেব তার সীমান্তের এত নিকটে একটি মারাঠা শক্তির উত্থান। দেখে বিশেষ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তখন তিনি তার আত্মীয় এবং দাক্ষিণাত্যের নবনিযুক্ত শাসক শায়েস্তা খানকে শিবাজির শাসিত অঞ্চলগুলির উপর আক্রমণ চালাতে বলেন। প্রথম পর্বে এই যুদ্ধের ফলাফল শিবাজির পক্ষে হতাশাজনক ছিল। শায়েস্তা খান ১৬৬০ খ্রি. পুনা অধিকার করে এখানেই তাঁর প্রধান কর্মকেন্দ্র গড়ে তোলেন। এরপর শিবাজির থেকে কোঙ্কন পুনরুদ্ধারের জন্য তিনি সেখানে সৈন্য পাঠান। শিবাজির অতর্কিত আক্রমণ, এবং মারাঠা রক্ষীবাহিনীর অসীম সাহস সত্ত্বেও মুঘলেরা উত্তর কোঙ্কন অধিকারে নিয়ে আসে।
কিন্তু শিবাজি চুপ করে বসে থাকার পাত্র ছিলেন না। আফজল খানের হত্যার পর বিজাপুর সিদি সালাবাট-এর নেতৃত্বে আরেকটি অভিযান চালিয়ে শিবাজির নিকট থেকে পানহালা অধিকার করে নেয়। এর পরে অবশ্য বিজাপুরের আক্রমণের তীব্রতা কমে আসে। এবং এই সুযোগে শিবাজি ১৬৬২ সালে মন্ত্রী (উজির) আবুল মহম্মদের মাধ্যমে বিজাপুরের সঙ্গে একটি চুক্তি সম্পাদন করেন। এর ফলে রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে শিবাজির শাসিত অঞ্চলগুলি স্বীকৃতি পায়। এবং শিবাজিও তাঁর তরফ থেকে বিজাপুরের অঞ্চলসমূহ আক্রমণ না করার প্রতিশ্রুতি দেন। এইভাবে নিজের পৃষ্ঠ রক্ষা করে শিবাজি আবার মুঘলদের দিকে মনোনিবেশ করেন। শায়েস্তা খানের ছাউনিতে রাত্রিকালীন আক্রমণ শিবাজির সবথেকে আশ্চর্য অভিযান বলে ধরা যেতে পারে। তিনি পুনায় শায়েস্তা খানের শিবিরে গোপনে অনুপ্রবেশ করেন এবং রাতে শায়েস্তা খান হারেমে (মহিলা মহল) থাকাকালীন তাকে আক্রমণ করেন। (১৬৬৩)। এই আক্রমণে খানের পুত্র ও একজন সেনানায়ক নিহত হন এবং শায়েস্তা খান নিজেও আহত হয়ে পড়েন। এই দুঃসাহসিক আক্রমণে যেমন শিবাজির খ্যাতির। পুনরুদ্ধার হয়, তেমন শায়েস্তা খানও সম্মান হারিয়ে অপদস্থ হয়ে পড়েন। ক্রুব্ধ ঔরঙ্গজেব শায়েস্তা খানকে বাংলায় বদলি করেন এবং এমনকি প্রস্থানের পূর্বাহ্নে সম্রাট যে তার পদস্থ আধিকারিকদের সঙ্গে প্রতিবারই সাক্ষাৎ করেন, সেই সম্মানটুকুও শায়েস্তা খানকে দেওয়া হয়নি। ইতিমধ্যে শিবাজি আর-একটি সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে ফেলেন। তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মুঘল বন্দর সুরাট আক্রমণ করে সেখানে যথেচ্ছ লুণ্ঠন কার্য চালান এবং এক কোটি টাকার মূল্যের সম্পদ সংগ্রহ করেন। অবশেষে শিবাজী দেশের দিকে রওনা হন।
পুরন্দর-এর চুক্তি এবং শিবাজির আগ্রা সফর
শায়েস্তা খানের অপমানজনক পরাজয় এবং শিবাজির সফল সুরাট আক্রমণ ঔরঙ্গজেবের বিশেষ অস্বতির কারণ হয়। তিনি তখন তার সম্পূর্ণ আস্থাভাজন অভিজাত পারিষদদের একজন মির্জা রাজা জয় সিংহকে শিবাজির বিরুদ্ধে অভিযানের নেতৃত্বে মনোনীত করেন। তাকে ১২,০০০ অশ্বারোহী সৈনিক দেওয়া হয় এবং ঔরঙ্গজেব তার আরেক জন বিশ্বস্ত মানুষ দিলের খানকে জয় সিংহের অধীনে স্থাপন করেন। জয় সিংহকে কেবল সর্বপ্রকার সামরিক কর্তৃত্বই দেওয়া হয়নি, তাকে জায়গির প্রদান, পদোন্নতি বা অবনতি সাধন ইত্যাদি প্রশাসনিক ক্ষমতাও দেওয়া হয়। যা সাধারণত সমগ্ৰ দাক্ষিণাত্যের মুখ্য প্রশাসকের উপরই ন্যস্ত থাকে। অল্প দিন পরে অবশ্য শাহজাদা মুয়াজ্জাম-এর স্থলে তাকে দাক্ষিণাত্যে দিল্লির সম্রাটের প্রতিনিধির। ক্ষমতাও দেওয়া হয়, অর্থাৎ তিনিই মুখ্য প্রশাসক পদে উন্নীত হন।
তার পূর্বতন সেনাপতিদের মতো জয় সিংহ কখনো মারাঠাদের ছোটো করে দেখেননি, বরঞ্চ তিনি কূটনৈতিক এবং সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে যথেষ্ট যত্ন করেই প্রস্তুতি নিতে থাকেন। শিবাজিকে সঙ্গীহীন করে তোলার জন্য তার বিরোধী এবং প্রতিপক্ষদের কাছে তিনি আবেদন জানান এবং তার উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা কমিয়ে আনার লোভ দেখিয়ে বিজাপুরের শাসককেও নিজের দলে টানার চেষ্টা শুরু করেন। এমনকি তিনি শিবাজির প্রতি শত্রুভাবাপন্ন কয়েকজন মারাঠি দেশমুখকেও প্রভাবিত করে তার দিকে নিয়ে আসতে সক্ষম হন। সৈন্যসামন্ত নিয়ে পুনায় পৌঁছে জয় সিংহ শিবাজির রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু পুরন্দর দুর্গে সরাসরি আঘাত হানার সিদ্ধান্ত নেন। শিবাজির পরিবারবর্গ এবং তার যত সম্পদ সবই এই পুরন্দর দুর্গে গচ্ছিত ছিল। ১৬৬৫ সালে জয় সিংহ মারাঠাদের সমস্ত প্রচেষ্টাকে পরাস্ত করে এই পুরন্দর দুর্গটি সম্পূর্ণ ভাবে অবরুদ্ধ করে তোলেন। দুর্গের পতন আসন্ন অথচ কোনোদিক থেকে কোনো সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে শিবাজি জয় সিংহের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন। বহু দরকষাকষির পর পরবর্তী শর্তগুলির ভিত্তিতে উভয় পক্ষের মধ্যে চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল।
১. শিবাজির অধিকৃত ৩৫টি কেল্লার মধ্যে ২৩টি তার সন্নিহিত ভুখণ্ড সমেত মুঘলদের অর্পণ করা হয়। এই কেল্লাগুলির বাৎসরিক রাজস্বের পরিমাণ ছিল চার লক্ষ হান। বাৎসরিক এক লক্ষ হান-এর রাজস্ব সহ বাকি ১২টি দুর্গ শিবাজি, মসনদের প্রতি আনুগত্য ও সেবার বিনিময়ে নিজের দখলে রাখতে পারবেন।
২. বিজাপুরী কোঙ্কনের বাৎসরিক চার লক্ষ হান-এর আয়বিশিষ্ট যে অঞ্চলগুলি শিবাজির অধিকারে ছিল, তার স্বত্ব তাকেই প্রদান করা হল। এছাড়া উচ্চভূমি (বালাঘাট) অঞ্চলের বছরে চার লক্ষ হান আয়-বিশিষ্ট যে ভূখণ্ড শিবাজি অধিকারে ইচ্ছুক ছিলেন তাও তাকে দিয়ে দেওয়া হল। এই সমস্ত সুবিধার বিনিময়ে শিবাজি কিস্তিবদ্ধভাবে মুঘলদের চল্লিশ লক্ষ হান জমা দেবেন এই সিদ্ধান্ত হয়।
ব্যক্তিগত ভাবে মুঘলদের কাজকর্মে নিযুক্ত হওয়ার থেকে শিবাজি অব্যাহতি চান। সেইজন্য তার পরিবর্তে তার নাবালক পুত্র শম্ভাজীকে একটি পাঁচ হাজারের মনসবের অধিকার দেওয়া হয়। তবে শিবাজি অঙ্গীকার করেন যে ভবিষ্যতে দাক্ষিণাত্যের কোনো মুঘল অভিযানে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করবে না।
জয় সিংহ চাতুর্যের সঙ্গে শিবাজি এবং বিজাপুরী শাসকদের মধ্যে একটি বিবাদের সূত্র রচনা করেন। কিন্তু যে রাজস্ব তিনি মুঘলদের প্রদান করেন, বিজাপুর অঞ্চল থেকে তা উদ্ধার করার জন্য মুঘলদের থেকে তিনি কতটা সাহায্য পাবেন জয় সিংহ-এর সমগ্র পরিকল্পনার সাফল্য ছিল এরই উপর নির্ভরশীল, এইখানেই ছিল একটি মারাত্মক ভুল। শিবাজির সম্বন্ধে ঔরঙ্গজেবের সন্দেহ তখনও দূর হয়নি। এবং বিজাপুরের বিরুদ্ধে সংযুক্ত মুঘল ও মারাঠা আক্রমণের যৌক্তিকতা সম্বন্ধে তিনি ছিলেন সন্দিহান। তাই ঔরঙ্গজেব জয় সিংহকে লিখলেন–তাল কোঙ্কদের স্বত্ব শিবাকে দেওয়া হল, কিন্তু তাকে বিজাপুরী বালাঘাট কোনো অংশ দেবার জন্য কোনো আদেশ দেওয়া হবে না। পারলে সে আদিল শাহের থেকে এই ভূখণ্ড ছিনিয়ে নিক। (হাত অঞ্জুমান)।
বিকানেরের রাজ্য সংগ্রহশালায় রক্ষিত জয় সিংহ এবং তার পুত্র কুমার রাম সিংহ-র মধ্যে লিখিত পত্রগুলি থেকে জানা যায় যে যে বিজাপুরের বিরুদ্ধে মুঘল মারাঠা জোট যে শুধু ঔরঙ্গজেব বিরোধী ছিলেন তাই নয়–দিলের খান, যাকে ঔরঙ্গজেব জয় সিংহ-এর সঙ্গে থাকার জন্য এবং তার প্রতি নজর রাখার জন্য নিয়োগ করেছিলেন, তিনি জয় সিংহকে বলেন ‘মহারাজা, বিজাপুর আক্রমণ করবেন না। আপনি শিবাকে জয় করেছেন, তাকেই দাক্ষিণাত্যে রাজ্য শাসনের ভার দিন এবং সেখানে আমাদের বিষয়-আশয়ের তিনিই দেখাশোনা করুন। জয় সিংহ-এর কিছু সর্দার ও দিলের খান-এর মতো একই মত পোষণ করতেন।– কিন্তু জয় সিংহ-এর চিন্তা ছিল অন্যরকম। তার মূল নীতি ছিল দাক্ষিণাত্য বিষয়ে যে সামাজিক নীতি নির্ধারিত হবে, তারই পরিপ্রেক্ষিতে মারাঠা সমস্যার সমাধান করা। শিবাজিকে যদি একাই বিজাপুরকে প্রতিহত করার গুরুদায়িত্ব দেওয়া হয়, তাহলে মনে রাখতে হবে যে, মুঘল ও বিজাপুর অঞ্চলের নয় লক্ষ হান-এর যে। অঞ্চল তার দখলে, তার থেকে চার লক্ষ হান মুঘলদের রাজস্ব দেওয়ার পর, মুঘলদের সাহায্য করার বিষয়ে তার কোনো উৎসাহ থাকবে বলে মনে হয় না। শিবাজি ও বিজাপুরের মধ্যে নতুন সমঝোতা হওয়া কিছু অসম্ভব নয়। জয় সিংহ ঔরঙ্গজেবকে বোঝালেন যে, শিবাজি যদি তার ভাইকে বিজাপুর শাসকের অধীনে কার্যে নিযুক্ত করতে সম্মত হন, তাহলে বিজাপুরের সুলতান তাঁকে বিজাপুর বালাঘাট অঞ্চলের পাঁচ লক্ষ হান-এর ভূসম্পত্তির অধিকার ছেড়ে দিতে সম্মত হবেন।
জয় সিংহ ঔরঙ্গজেবকে লেখেন ‘বিজাপুরকে অধিকার করা সমগ্র দাক্ষিণাত্য ও কর্ণাটক বিজয়ের মুখবন্ধ মাত্র। শিবার সাহায্যে যদি প্রথমেই আমরা বিজাপুরকে পরাজিত করতে পারি, তার থেকে ভালো আর কি হতে পারে? তবে শিবাজির সম্বন্ধে ঔরঙ্গজেবের বিতৃষ্ণার কথা মনে রখে জয় সিংহ লিখলেন ‘আমরা এখন শিবাজিকে বৃত্তাকারে চারিদিক থেকে ঘিরে তাকে কেন্দ্রবিন্দুতে আটকে রেখেছি। তার। চারিদিকের সমস্ত অঞ্চলেই আমাদের অধিকারে। এখন যদি শিবা আনুগত্যের পথ থেকে একচুলও সরে যায়, তাহলে অনায়াসেই আমরা তাকে পিষে মারতে পারব।
কিছুটা অতিরঞ্জন করে জয় সিংহ লিখলেন ‘বিজাপুর জয় করতে পারলেই মুঘলরা শিবাজিকে একটি বৃত্তের কেন্দ্রেই সম্পূর্ণ ভাবে আটকে রাখতে পারবে। ঔরঙ্গজেব অগত্যা বিজাপুরের বিরুদ্ধে অভিযানে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সম্মতি দেন, তবে জয় সিংহকে তিনি পর্যাপ্ত সেনানী দেননি। শিবাজিকে ঔরঙ্গজেব এটুকু দিতেই সম্মত হয়েছিলেন যে তিনি বিজাপুরী বালাঘাটের পাঁচ লক্ষ হান মূল্যের অঞ্চলের স্বত্ব পাবেন, যদি শিবাজি পরিকল্পনা মাফিক বিজাপুর অভিযানের পূর্বেই সেই ভূখণ্ডটি নিজেই অধিকার করে নিতে পারেন।
মারাঠাদের সহায়তা সত্ত্বেও বিজাপুর জয় একটি কঠিন ব্যাপার ছিল। বিজাপুরকে চকিতে আক্রমণ করে তাদের অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলতে পারেন, জয় সিংহ-এর এই ধারণাটি সত্য হয়নি, কেননা এই অভিযানের প্রস্তুতির বিষয়টি আর গোপন ছিল না। পক্ষান্তরে বিজাপুর এই আক্রমণের বিরুদ্ধে পোড়ামাটি নীতি অবলম্বন করে। বিজাপুরে পৌঁছে জয় সিংহ দেখলেন যে নগরীটিকে অবরোধ করার উপযোগী ভারী বন্দুক তার কাছে নেই, আবার তার অবরোধকারী সেনাদলের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য সংগ্রহ করার এবং তাদের অন্যান্য ভাবে তাদের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করার কোনো উপায় তার ছিল না। আবার গোলকুণ্ডার শাসক বিজাপুরের সাহায্যার্থে ১২,০০০ ঘোড়সওয়ার ও ৪০,০০০ পদাতিকের এক সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে তাকে আরও অসুবিধায় ফেলে দিল। জয় সিংহের অভিযান এইভাবে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দিলের খান এবং শিবাজির বিরুদ্ধপন্থী অংশের ব্যক্তিবর্গ অভিমত দিলেন যে শিবাজির গড়িমসি এমনকি বিশ্বাসঘাতকতার জন্যই এই পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। তারা দাবি করলেন শিবাজিকে তখনই কারারুদ্ধ করা হোক। শিবাজিকে এই সম্ভাব্য বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য জয় সিংহ তাকে পানশালা অধিকার করার অভিযানে প্রেরণ করেন। কিন্তু শিবাজি এতে ব্যর্থ হন। তাঁর ব্যাপক পরিকল্পনার এই ব্যর্থতা দেখে জয় সিংহ শিবাজিকে আগ্রায় গিয়ে বাদশাহের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে রাজি করালেন। জয় সিংহ ভেবেছিলেন যে শিবাজি ও ঔরঙ্গজেবের মধ্যে সমঝোতা হলে পরে ঔরঙ্গজেব হয়তো নতুন করে বিজাপুর জয়ের জন্য পর্যাপ্ত সাহায্য পাঠাবেন। কিন্তু তার এই আগ্রা যাত্রা সম্পূর্ণ বিফল হল। শিবাজিকে পাঁচ-হাজারি মনসবদারদের শ্রেণিভুক্ত করায় তিনি বিশেষ অপমানিত বোধ করেন। কেননা ইতিপূর্বে তার নাবালক পুত্রকে এই পদ দেওয়া হয়েছিল। তখন বাদশাহের জন্মতিথির উৎসব চলা সত্ত্বেও তিনি প্রথার বাইরে গিয়ে একবারও শিবাজির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি। অপমানিত শিবাজি তখন ক্রুব্ধ হয়ে সভাস্থল ত্যাগ করেন এবং রাজকীয় সেবা প্রত্যাখ্যান করেন। এ ধরনের ঘটনা পূর্বে ঘটেনি এবং জাহানারা ও যশবন্ত সিংহ-সহ একটি বড়ো গোষ্ঠী অভিমত দেন যে রাজকীয় সম্মান ও মহত্ত্ব বজায় রাখার জন্য শিবাজিকে এখনই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক। শিবাজি জয় সিংহ-এর পরামর্শেই আগ্রা এসেছিলেন, তাই ঔরঙ্গজেব জয় সিংহকে তার পরামর্শের জন্য লিখে পাঠান। শিবাজির প্রতি সহৃদয় ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে জয় সিংহ দ্ব্যর্থহীন ভাবে বাদশাহকে উত্তর দেন। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেবার পূর্বেই শিবাজি বন্দিকক্ষ থেকে পলায়ন করেন। (১৬৬৬)। তাঁর পলায়নের বৃত্তান্ত সর্বজনবিদিত হওয়ায় এখানে তার আর পুনরাবৃত্তি করা হল না।
শিবাজিকে পলায়নের সুবিধা করে দিতে পেরেছিলেন এ বিষয়ে ঔরঙ্গজেব তার অসাবধানতার জন্য নিজেকেই বারবার দায়ী করতে থাকেন। শিবাজির এই আগ্রা গমনের ফলে মুঘল-মারাঠা পারস্পরিক সম্পর্ক যে এক নতুন মোড় নেয় তাতে কোনো সন্দেহ নেই, যদিও দেশে ফিরে এসে শিবাজি দুই বৎসরকাল চুপচাপ ছিলেন। জয় সিংহ শিবাজি সম্বন্ধে যাই ধারণা করে থাকুন না কেন ঔরঙ্গজেব যে তার সঙ্গে সমঝোতাকে কোনোই গুরুত্ব দেননি, শিবাজির এই আগ্রা সফর সে কথাই প্রমাণ করে দিল। শিবাজি তার কাছে এক নগণ্য ভূস্বামী (ভূঁইয়া) ছাড়া আর কিছুই ছিলেন না। শিবাজি সম্বন্ধে ঔরঙ্গজেবের এই গোঁড়া বিরুদ্ধাচরণ, তাঁর গুরুত্বকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা এবং তার সঙ্গে মুঘলদের বন্ধুত্বকে সম্পূর্ণ মূল্যহীন এবং অপ্রয়োজনীয় ভাবা, এইগুলি ঔরঙ্গজেবের জীবনের বৃহত্তম রাজনৈতিক ভূল বলে আজ গণ্য করা হয়; পরবর্তী ঘটনাবলীই এর প্রমাণ বহন করে।
তর্কের খাতিরে অবশ্য বলা যায় পাঁচ হাজারের মনসব যেটা শিবাজিকে দেওয়া হয়েছিল। কিছু ছোটো সম্মান নয়। তিনি যখন মুঘলদের অধীনে কার্যভার গ্রহণে অসম্মত হন, তখন তার ছেলেকে এই সম্মানই দেওয়া হয়েছিল। আবার ১৬২৯ সালে শাহজী তার কর্মজীবন শুরু করার সময় শাহজাহান তাঁকে এই পদই দিয়েছিলেন। এবং শিবাজিকেও প্রাথমিক পর্যায়ে এই পাঁচ হাজারের মনসবই দেওয়া হয়। এই সব যুক্তি-তর্ক অবশ্য গুরুত্বহীন। ঔরঙ্গজেবের সমসাময়িক ব্যক্তিত্ব মামুরী বলেছেন–যেহেতু তার নাবালক পুত্রকে তার অনুপস্থিতিতে ৫০০০-এর মনসব দেওয়া হয়েছিল এবং তার আত্মীয় নেতাজীও এই একই মনসবের অধিকারী ছিলেন, তাই শিবাজি স্বভাবতই আশা করেছিলেন যে তাকে অন্তত ৭০০০১-এর মনসব দেওয়া হবে। তাহলে প্রশ্ন উঠছে যে ঔরঙ্গজেব শিবাজির বন্ধুত্বকে কতটা গুরুত্ব দিতেন? যদি জয় সিংহ-এর মতো তিনিও ভাবতেন যে দাক্ষিণাত্যের বৃহত্তর স্বার্থের জন্য এই বন্ধুত্ব বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, তাহলে প্রথাবহির্ভূত ভাবেও তিনি শিবাজির মৈত্রী অর্জনের চেষ্টা করতেন। যেমন ১৬১৫ খ্রি. জাহাঙ্গির মেবারের রানা অমর সিংহ-এর। ক্ষেত্রে করেছিলেন।
শিবাজির সঙ্গে শেষ সম্পর্ক ছেদ : শিবাজির শাসন ব্যবস্থা ও কিছু কীর্তি
ঔরঙ্গজেব পুরন্দর-এর চুক্তিটি সম্পূর্ণ ভাবে উপলব্ধি করতে পারেননি। তাই তিনি এর যে সংকীর্ণ অর্থ অনুধাবন করেছিলেন তার ফলশ্রুতি হিসাবে শিবাজি আবার তার বিজয় অভিযান শুরু করতে বাধ্য হন। অবশ্য বিজাপুরের বিরুদ্ধে অভিযানের ব্যর্থতার পর এই চুক্তিটি কার্যত অর্থহীন হয়ে পড়ে। প্রকৃতপক্ষে শিবাজি চার লক্ষ হান-এর মূল্যবিশিষ্ট ২৩টি কেল্লা এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলের ক্ষতি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না, বিশেষ করে বিজাপুর থেকে এই ক্ষতিপূরণের সম্ভাবনা কার্যকরী না হওয়ায়।
আগ্রা থেকে ফিরে আসার পর নিজের অবস্থান পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে শিবাজি বাদশাহের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং তার সঙ্গে একটি সন্ধিপত্র রচনা করেন। এই সন্ধিপত্র অনুসারে শম্ভাজীকে তার পাঁচ হাজারের মনসব ফিরিয়ে দেওয়া হয়, বেরারে জায়গির দেওয়া হয়, এবং শিবাজি ঔরঙ্গাবাদের প্রশাসনের সৈন্যদলে কাজ করার জন্য একদল সেনানীকেও প্রেরণ করেন। কিন্তু এর অল্পদিন পরেই আগ্রা যাত্রার সময় শিবাজিকে যে এক লক্ষ টাকা অগ্রিম দেওয়া হয়েছিল, তা উদ্ধারের জন্য বেরার অঞ্চলটি অধিকার করে নেন। শিবাজি ঠিক এই ধরনেরই একটি সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। ১৬৭০ সালে এক জোরালো আক্রমণ চালিয়ে পুরান্দরের চুক্তিতে যে কোনদানা মুঘলদের সমর্পণ করা হয়েছিল সেটি সমেত বেশ কয়েকটি পার্বত্য দুর্গ অধিকার করে নেন। ১৬৬৫ সালের পুরন্দরের সন্ধি অনুযায়ী কোনদানা মুঘলদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। তিনি সুরাটকেও দ্বিতীয়বার আক্রমণ করেন। তিনি শুধু পুরন্দারের শক্তিশালী দুর্গটিও অধিকার করে নেন তাই শুধু নয়, এছাড়া বিশেষ করে বেরার আর খান্দেশ সহ মুঘল অঞ্চলের গভীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারেন। উত্তর-পশ্চিমে আফগান বিদ্রোহের বিষয়ে মুঘলরা ব্যস্ত থাকায় শিবাজির আরও সুবিধা হয়। বিজাপুরের সঙ্গেও শিবাজি নতুন করে সংঘর্ষ শুরু করেন–উৎকোচের সাহায্যে পানহালা এবং সাতারা অধিকার করে নেবার পর তিনি এই কানারা দেশটিতে অনায়াসেই হানা দিতে থাকেন।
১৬৭৪ সালে রাজগড়ে শিবাজি প্রথাগত ভাবে রাজমুকুট পরিধান করেন। পুনার এক ছোটো জায়গিরদার থেকে শিবাজি বহুদূর অগ্রসর হয়েছেন। এখন তিনি মারাঠি প্রধানদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী বলে গণ্য হলেন এবং তার রাজ্যের পরিসীমা সৈন্যবাহিনীর আয়তনের হিসাবে তিনি এখন দাক্ষিণাত্যের পরে পরিশ্রান্ত সুলতানদের সমমর্যাদা দাবি করতে পারতেন। এই রীতিসিদ্ধ রাজ্যাভিষেকেরও কয়েকটি মূল উদ্দেশ্য ছিল। যে সমস্ত মারাঠা কুলপতিরা তাকে এতদিন আভিজাত্যহীন ভূঁইফোড় বলে অবজ্ঞা করতেন, শিবাজি এখন মর্যাদায় তাদের সমকক্ষ হয়ে উঠলেন। তাঁর সামাজিক অবস্থান আরও সুদৃঢ় করতে শিবাজি কয়েকটি প্রাচীন অভিজাত মারাঠা পরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেন–যথা মোহিত, শিরকে ইত্যাদি। গাগা বাট্টা-নামক এই অনুষ্ঠানের মুখ্য পুরোহিত মহাশয় এখন সরকারিভাবে ঘোষণা করলেন যে শিবাজি একজন উচ্চ শ্রেণির ক্ষত্রিয়। সবশেষে একজন স্বাধীন প্রশাসক হিসেবে এখন দাক্ষিণাত্যের সুলতানদের সঙ্গে সমপর্যায়ের অধিকার নিয়ে শিবাজি চুক্তি ও সমঝোতা সম্পাদন করতে সক্ষম হলেন, আগেকার মতো এক বিদ্রোহী হিসেবে নয়। মারাঠা জাতীয়তাবোধের জাগরণের ক্ষেত্রেও এ এক মহান পদক্ষেপ।
রাজ্যাভিষেকের সময় শিবাজি উপাধি নিয়েছিলেন ‘হৈাভা ধর্মোদ্দারকা’ বা ‘হিন্দু ধর্মের উদ্ধারকর্তা এবং ক্ষত্রিয় কুলবতংস’ বা ‘ক্ষত্রিয় রত্ন। কিন্তু ঔরঙ্গজেবের। সংকীর্ণ ধর্মীয় নীতির প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে তিনি যে নিজেকে হিন্দুধর্মের বীরপুরুষ। বলে তুলে ধরতে চাইছিলেন, তা নয়। ধর্ম রক্ষা তৎকালে এক হিন্দু নৃপতির স্বাভাবিক কর্তব্য বলে সচরাচর মনে করা হত। এবং এখানে ধর্ম অর্থে চাতুর্বর্ণ এবং ব্রাহ্মণ ও ভূমির রক্ষাই (গো-ব্রাহ্মণ প্রতিপালক) সাধারণত মনে করা হত। রামদাস, যাকে শিবাজির গুরু বলে মানা হয়, তিনি শিবাজিকে হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবনের ব্রত দিয়েছিলেন কিনা সেই বিষয়ে বহু মতভেদ আছে। আর. আর. রানাডের মতে, তার রাজ্যভিষেকের পরবর্তীকালে শিবাজির সঙ্গে রামদাসের যোগাযোগ স্থাপিত হয়, অভিষেকের পূর্বে নয়। যাই হোক, সেই সময়ে যখন সব সংগ্রামকেই একটি ধর্মীয় প্রতাঁকে চিহ্নিত করা হত, সেখানে শিবাজির সাফল্যকে মুসলিম আগ্রাসনের বিরুদ্ধে হিন্দু শক্তির জাগরণ বলে যে আখ্যা দেওয়া হবে, তাতে কিছু অবাক হবার নেই।
১৬৭৬ খ্রিস্টাব্দে শিবাজি এক নূতন সাহসিকতাপূর্ণ পদক্ষেপ নেন, যখন তিনি কর্ণাটক, যাকে তখন সোনার দেশ বলে মনে করা হত, আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। শিবাজি এবার কর্ণাটকের পূর্ব-কূলবর্তী তাঞ্জোরে তার পৈতৃক ভূসম্পত্তি উদ্ধারের। জন্য উৎসাহী হয়ে ওঠেন। এই অংশটি তখন তার সত্তাই ভিয়ানকোজির অধিকারে। ছিল। এই অভিযান শুরু করার আগে, শিবাজি তার পশ্চাদবর্তী অংশ রক্ষা করার জন্য বিজাপুরের প্রতিনিধি খাওয়াস খানকে উৎকোচ প্রদান করে তার সঙ্গে যথাযথভাবে শান্তি স্থাপন করেন। তবে শিবাজির দুই ভাই, মান্না এবং আকান্না, যাঁদের তখন হায়দরাবাদের উপর সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব ছিল, তাদের কাছ থেকেও প্রচুর সাহায্য পেয়েছিলেন। তাঁর রাজধানীতে কুতব খান শিবাজিকে সবিশেষ সংবর্ধনা জ্ঞাপন। করেন, এবং দু’জনের মধ্যে একটি যথাযথ চুক্তিও রচিত হয়। শিবাজিকে কুতব শাহ এক লক্ষ হান, বা পাঁচ লক্ষ টাকার ভরতুকি দিকে
দরবারে একজন মারাঠা রাষ্ট্রদূত রাখারও সিন্ধান্ত নেওয়া হয়। কর্ণাটকে বিজিত ভুখণ্ড ও ধনরত্ন দুই পক্ষ ভাগ করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কুতব শাহ শিবাজির সাহায্যার্থে ৫০০০ সৈন্য ও গোলাবারুদ প্রেরণ করা ছাড়াও এই সৈন্যদলের খরচ বাবদ মাসে ১ লক্ষ হান অর্থ প্রদান করেন। এই চুক্তি শিবাজির পক্ষে খুবই লাভজনক প্রতিপন্ন। হয় এবং এর সুবিধা নিয়ে তিনি বিজাপুর কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে জিনজি এবং ভেলোর জয় করা ছাড়াও তার সত্তাই ভিয়ানকোজির অধিকৃত বেশিরভাগ রাজ্যই নিজ অধিকারে নিয়ে আসেন। এছাড়া তিনি দক্ষিণ কর্ণাটক থেকে শের খান লোদিকেও বিতাড়িত করেন। শিবাজির ‘হিন্দাভা ধর্মোদ্ধার কলা’ বা হিন্দুধর্মের রক্ষাকর্তার উপাধি ধারণ করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু এ সত্ত্বেও এই অঞ্চলের হিন্দুদের ধনসম্পদ নির্দয়ভাবে লুণ্ঠন করতে তাঁর দ্বিধা হয়নি। সভাসদ-এর বিবরণ অনুযায়ী শিবাজি বৎসরে ২০ লক্ষ হান রাজস্বের ভূসম্পত্তি অধিকার করেন এবং যে পরিমাণ সম্পদ লুণ্ঠন করেন, তার মূল্য অপরিসীম। তিনি শাহজীর পুত্র শাম্ভাজীকে এই সমস্ত অঞ্চলের ভার দেন, তবে তার সঙ্গে তিনি একজন অভিজ্ঞ প্রশাসককেও রেখেছিলেন, যার নাম রঘুনাথ নারায়ণ হনুমন্তে। এই বিপুল সম্পদ সঙ্গে নিয়ে দেশে ফেরার সময় শিবাজি কিন্তু কুতব শাহকে এর কোনো ভাগ দেননি, এবং যার ফলে উভয়ের সম্পর্ক ক্ষুণ্ণ হয়।
কর্ণাটক অভিযানই শিবাজির শেষ বৃহৎ অভিযান বলা যেতে পারে। আওরঙ্গজেব যখন মারাঠাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করেন, তখন এই জিনজিরই তার পুত্র রাজারামের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল।
‘কর্ণাটক অভিযান থেকে ফিরে আসবার অল্পদিন পরেই ১৬৮০ খ্রি. শিবাজির জীবনাবসান হয়। তবে ইতিমধ্যে তিনি একটি সুগঠিত শাসনব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করে গিয়েছিলেন। শিবাজির শাসনব্যবস্থা ছিল মুখ্যত দাক্ষিণাত্যে প্রচলিত শাসন ব্যবস্থারই অনুকরণে রচিত। তিনি আটজন মন্ত্রীকে মনোনীত করেছিলেন, যাদের অষ্টপ্রধান বলা হত। এরা কিন্তু একটি মন্ত্রী-পরিষদের মতো কাজ করতেন না, পক্ষান্তরে প্রতিজনই সরাসরি শাসকের অধীনের কাজ করতেন এবং তাঁর নিকটেই দায়ি ছিলেন। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের বলা হত যথাক্রমে পেশাওয়া, যাঁরা আর্থিক ব্যবস্থাপনা এবং সাধারণ শাসনব্যবস্থার দায়িত্বে ছিলেন শর-ই-নউবত বা সেনাপতি। শর–ই নউবত ছিল একটি সম্মানজনক পদ এবং কোনো একজন অগ্রণী মারাঠা দলপতিকেই এই দায়িত্বে রাখা হত। হিসাব রক্ষার দায়িত্বে ছিলেন মজুমদার এবং আভ্যন্তরীণ গুপ্ত। সংবাদ, ডাক ব্যবস্থা ও গার্হস্থ্য বিষয়ের দায়িত্বসম্পন্ন মন্ত্রীকে বলা হত ওয়াকে নভিশ। সম্রাটকে চিঠিপত্রাদি বিষয়ে সাহায্যকারীদের বলা হত সুরুনভিশ অথবা চিউনিস। আচার-অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব ছিলেন দবির, যিনি আবার বিদেশি শক্তির সঙ্গে যোগাযোগের কাজও করতেন। ন্যায়াধীশ এবং পণ্ডিতরাও ছিলেন যথাক্রমে আইনকানুন এবং দানখয়রাত বিষয়ের ভারপ্রাপ্ত।
তবে এই অমাত্যদের নিয়োগ করা থেকেও আরও উল্লেখযোগ্য ছিল শিবাজির সৈন্য-সংগঠন এবং রাজস্ব সংগ্রহ ব্যবস্থা। নিয়মিত সৈন্যদের শিবাজি নগদ মাহিনা দিতেন, যদিও প্রধানরা মধ্যে মধ্যে রাজস্ব বরাদ্দও লাভ করতেন, যাকে বলা হত সরঞ্জাম। সৈন্যদলে কঠোর অনুশাসন মানা হত এবং কোনো স্ত্রীলোক বা নৃত্যাঙ্গনাদের সৈন্যদলের সঙ্গে যাওয়ার অনুমতি ছিল না। অভিযানের সময় সৈন্যরা যা কিছু লুণ্ঠন করতেন তার সঠিক হিসাব রাখা হত। নিয়মিত সৈন্যদলে (পাগা) ৩০,০০০ থেকে ৪০,০০০ জন অশ্বারোহী ছিল এবং তাদের পরিচালনা করতেন হাওয়ালদাররা, যাঁরা নির্দিষ্ট বেতনভুক্ত ছিলেন।
এই সব নিয়মিত সৈন্যদল ছাড়া কিছু কিছু সহায়ক বা খুচরো সৈন্যও শিবাজির সেনাদলে মাঝে মাঝে যোগ দিত। যাদের বলা হত সিলাহদার। দলের প্রয়োজানুসারে বা তাদের লুটপাটের আকাঙ্ক্ষার তীব্রতা অনুসারে এদের সংখ্যা বছরে বছরে কম-বেশি হত। এছাড়া স্থানীয় সর্দাররাও তাদের দলবলসহ লুটপাটের লোভে মাঝে। মাঝে সৈন্যদলে ঢুকে পড়ত। শিবাজির এক বিশাল অশ্বারোহী সৈন্যদল ছিল, যাদের সংখ্যা ছিল এক লাখের মতো। তবে তাদের মধ্যে কতজন লড়াই করত তা অবশ্য সঠিক জানা যায় না। তার দুর্গে কামান লাগানো থাকত, তবে পুনা অঞ্চল ধাতব শিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল না–তাই এই কামানের সংখ্যাও ঠিক জানা নেই।
এই দুর্গগুলি শিবাজির শক্তির এক প্রধান উৎস ছিল এবং এগুলিকে বিশেষ ত্ত্বাবধানে রাখা হত। মাওয়াঙ্গী পদাতিক সৈন্য এবং গোলন্দাজদের সেইসব কেল্লার পাহারায় রাখা হত। শোনা যায় যে কোনোরকম বিশ্বাসঘাতকতা প্রতিরোধের মতো সমান মর্যাদার অধিকারী তিনজন পৃথক ব্যক্তিকে প্রতিটি দুর্গের দায়িত্বে রাখা হত।
শিবাজি ভারতের স্বল্পসংখ্যক রাজাদের মধ্যে একজন, যিনি নৌবহর সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছিলেন। উত্তর কোঙ্কন প্রদেশের কল্যাণ, ভিওয়ান্দি এবং পানভেল বিজয়ের ফলে তিনি গোঁয়ার পর্তুগিজ অধিকৃত অঞ্চল সংলগ্ন ভূখণ্ডে পৌঁছে যান। তিনি শীঘ্রই উপলব্ধি করেন যে এক শক্তিশালী নৌবাহিনী ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যের যে-সকল কেন্দ্র উপকূলবর্তী খড়িগুলির নিকট অবস্থিত তাদের রক্ষা করা সম্ভব নয়। এবং আফ্রিকার অধিবাসী সিডি উপজাতির যে জনগোষ্ঠী জনজিরায় বসতি স্থাপন করে জনজিরা এবং তার সংলগ্ন অঞ্চলটি অধিকার করে রেখেছিল, তাদের থেকে উপকূল অঞ্চল রক্ষা করার জন্য এক নৌবহর অতি প্রয়োজনীয়।
কল্যাণ ও ভিওয়ান্দি অঞ্চলে প্রচুর কাঠ পাওয়া যেত এবং সেইগুলি ব্যবহার করে শিবাজি ৬০ থেকে ১৬০টি কামানবাহী জলযান (ঘুরাব) নির্মাণ করলেন। এছাড়াও তিনি শিবার, শিব্রার্স মানছোওয়া ইত্যাদি অনেক জাহাজও নির্মাণ করেন, যেগুলি বাণিজ্যের কাজে ব্যবহার করা হত। শিবাজির বেশিরভাগ জাহাজই সিডিদের হাত থেকে জনজিরা ও সংলগ্ন অঞ্চল রক্ষা করার কাজে ব্যবহার করা হত। বিশেষ করে এই সিডিরা মাঝে মাঝেই উপকূলবর্তী অঞ্চলে গোলযোগ সৃষ্টির জন্য, মুঘলদের সঙ্গেও হাত মেলাত। তবে শিবাজির পোতগুলি জলবক্ষে লুণ্ঠনের কাজেও ব্যবহৃত হত। সুরাট থেকে মক্কা তীর্থযাত্রীদের জাহাজও এর ব্যতিক্রম ছিল না। মোচার সঙ্গে বাণিজ্যের জন্যও শিবাজি তার জলযানগুলি ব্যবহার করতেন। নাবিকের কাজের জন্য তিনি কোলি এবং ভাণ্ডারীদের মতো স্থানীয় বংশগত সাগর মাঝিদের মুখ্যত নিয়োগ করতেন। তবে কুখ্যাত মালাবার জলদস্যু সম্প্রদায়সহ মুসলিমদের তিনি তার। নৌবহরে কাজ দিতেন।
সংক্ষেপে সভাসদের আলংকারিক ভাষার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা যায় যে, রাজা সমুদ্রের উপরেও জোয়াল চাপালেন’, অর্থাৎ সমুদ্রকে বশীভূত করলেন।
শিবাজির রাজস্ব নীতি মূলত মালিক অম্বরের পদ্ধতির অনুসরণেই প্রস্তুত। হয়েছিল। এই পদ্ধতিতে জমির মাপজোক করার চেষ্টা করা হত এবং এর জন্যই শিবাজি গ্রামের মোড়ল বা প্রধানদের সঙ্গে যোগাযোগ সৃষ্টি করার চেষ্টা করেন। তবে একথা ভাবা ঠিক নয় যে শিবাজি গ্রামের জমিদার বা দেশমুখদের বিলুপ্তি চেয়েছিলেন। তবে শিবাজি এমন একটি অঞ্চলের মালিক ছিলেন যেখানে বিজাপুরী প্রশাসকের দুর্বলতা এবং অবহেলার জন্য বৃহৎ দেশমুখরা অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে। উঠেছিলেন। অষ্টাদশ শতকের ঐতিহাসিক সভাসদ লেখেন–”মিরাসদারেরা গ্রামগুলিতে তাদের বুরুজ, প্রাসাদ (ভেট) এবং ঘাঁটি নির্মাণ করে, এবং প্রচুর কর্মী ও বন্দুকবাজ নিযুক্ত করে বিশেষ শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। তারা সরকারের রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তাদের কোনোরকম সৌজন্য দেখাত না, এবং বেশি কিছু দাবি করলেই প্রচণ্ড ঝগড়াঝাঁটি শুরু করে দিত। এই শ্রেণিটি সম্পূর্ণ উচ্ছল হয়ে উঠেছিল এবং সম্পূর্ণ দেশটিই তারা অধিকার করে নিয়েছিল বলা যায়।
শিবাজি প্রথমেই এই শ্রেণির ভূস্বামীদের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা শুরু করেন। বিশেষত এদের অনেকেই বিজাপুর প্রশাসকের খুব নিকটবর্তী ছিলেন এবং শিবাজির বিরুদ্ধে অভিযানেও অংশ নিতেন। সভাসদ লিখছেন, ‘শিবাজি এদের বুরুজ, ওয়াদে এবং অন্যান্য ঘাঁটিগুলি ধ্বংস করে দেন এবং কোথাও এরা শক্তপোক্ত দুর্গ নির্মাণ করে থাকলে সেখানে তার নিজস্ব লোকেদের মোতায়েন করেন। মিরাসদারেরা জোর করে যে খাজনা আদায় করত তিনি তা বন্ধ করেছেন। ইজারা এবং অন্যান্য রাজস্ব আদায়ের পথ বন্ধ করে দেন, এবং প্রতিটি গ্রাম থেকে জমিদারদের পাওনার পরিমাণ তিনি অর্থ বা শস্যের মাধ্যমে নির্দিষ্ট করে দেন। জেলা এবং পরগনা স্তরে বংশানুক্রমে যাঁরা শাসন চালাতেন সেইসব দেশমুখ এবং দেশ-কুলকার্নিদের এবং পাতিল এবং কুলকার্নিদের অধিকার এবং সুবিধা ভোগের সীমাও নির্দিষ্ট করে দেন।
এর থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে শিবাজি প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থারই পরিবর্তন করতে। চেয়েছিলেন। কোনো নতুন ব্যবস্থা সৃষ্টি করতে চাননি। এইসব শক্তিশালী দেশমুখদের নিজের নিয়ন্ত্রণে আনার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হবার পরেই ১৬৭৯ সালে শিবাজির দেওয়ান মাপজোক ও জরিপের ওপর ভিত্তি করে জমির মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি সম্পন্ন করেন। দেশমুখদের সহযোগিতা তো চাওয়াই হয়েছিল। তবে গ্রামের প্রধানদের সহযোগিতা। না পেলে জমির পরিমাপ নির্ধারণ করা সম্ভব হত না।
বলা হয় যে, শিবাজি জমিদারি প্রথার বিলোপ সাধন চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি জায়গিরদারি ব্যবস্থারই অবসান করেছিলেন বলে ধরে নেওয়া হয়। এর প্রমাণস্বরূপ সভাসদের একটি বক্তব্যকেই উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে। কাউকে মোকাসা বা জাগির মঞ্জুর করলে পরে রায়তদের (কৃষক বা জমির মালিক) মধ্যে অস্থিরতা ও অব্যবস্থা দেখা দিতে পারে, সুতরাং কাউকে আর মোকাসা দেওয়া হবে না। আবার। সভাসদ কিন্তু নিজেই বলেছেন যে আফজল খানের পরাজয়ের পর অনেককেই মোকাসা হিসাবে গ্রামের স্বত্ব দান করা হয়। আবার শিবাজির অধিষ্ঠাত্রী দেবী তুলজা ভবানীর সম্মানে কয়েকটি মোকাসা অঞ্চল পৃথক করে রাখা হয়। এই ধরনের আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, যথা কর্ণাটক বিজয়ের পর আত্মজপুত্র শম্ভাজীকে কিছু মোকাসা মহল বা অঞ্চল প্রদান করা হয়।
প্রকৃতপক্ষে শিবাজি কোনো মোকাসা মহলকে দারোবস্ত অর্থাৎ সম্পূর্ণভাবে বা ইনাম অর্থাৎ পুরস্কার হিসাবে কোনো ব্যক্তিকে দেওয়ার বিরুদ্ধে ছিলেন। সভাসদও অস্পষ্টভাবে এর উল্লেখও করেছেন। এটি মুঘল ব্যবস্থার একটি অঙ্গ ছিল। শিবাজির সংস্কারমূলক নীতির ফলে মারওয়াড়ের রাজা যশবন্ত সিংহ ও ওয়াতান জায়গির হিসাবে যোধপুর পরগনার ক’টি গ্রামের অধিকার পাননি।
শিবাজির সময়কার প্রকৃত ভূমি-রাজস্বের উপর প্রশাসনের দাবির সম্বন্ধে একটি সুস্পষ্ট ধারণা করা বিশেষ কঠিন বলে মনে হয়। সভাসদের মতে সমগ্র উৎপন্ন খাদ্যশস্যের পাঁচ ভাগের দুই ভাগ অংশ প্রশাসন দাবি করতেন। এছাড়া এর সঙ্গে পেশাওয়াদের সময়কার অনেক করকে যুক্ত করতে হয়। রাজার দাবির পরিমাণ তাহলে বেশ গুরুভারই ছিল। তবে একজন বিদেশি পর্যটক ফ্রাইয়ার রাজস্বের পরিমাণ পূর্বের থেকে দ্বিগুণ হয়েছিল বলে যে মন্তব্য করেছেন, তারও কোনো ভিত্তি নেই। পক্ষান্তরে শিবাজির স্বরাজ্যে আভ্যন্তরীণ আইন-শৃঙ্খলার প্রবর্তন, মিরাসদারদের ক্ষমতা হ্রাস, এবং কৃষি কর্মের পুনর্জীবন এবং পরিবর্জনের ব্যবস্থাগুলি অবশ্যই কৃষিজীবীরা সানন্দেই গ্রহণ করেছিলেন বলে অবশ্যই মনে করা হয়।
তাঁর রাজ্য-সংলগ্ন মুঘল অঞ্চলগুলির উপর একটি রাজস্বের দাবি করেও শিবাজি তার আয়ের পরিমাণ বর্ধিত করেছিলেন। এর পরিমাণ ছিল জমির খাজনার এক চতুর্থাংশ, এবং একে বলা হত চৌহাই বা চৌথ। চৌথ কিন্তু আসলে কোনো নতুন ব্যবস্থা নয়। গুজরাটের জমিদাররা যে বন্থ আদায় করতেন তারও মাপ ছিল চৌহাই বা তাদের অধীনস্থ জমি, রাজস্বের এক চতুর্থাংশ, অর্থাৎ বন্থ বা চৌথাই দুটিই ছিল জমিদারদের প্রাপ্য করের আর-একটি প্রকারভেদ। এইভাবেই দিউ-এর পর্তুগিজ রামনগরের রাজাকে এই শর্তে চৌথ দিতেন যাতে তিনি পর্তুগিজদের অঞ্চল আক্রমণ না করেন। মুঘলেরাও কাথিওয়াড়ের উপকূলবর্তী পোরবন্দরের রাজস্বের এক চতুর্থাংশ সেখানকার জমিদারদের দিয়ে থাকতেন। কোঙ্কনের জমিদারেরাও এই ধরনের রাজস্ব আদায় করে থাকতে পারেন। এই প্রথার সাহায্যে শিবাজি সমগ্র দাক্ষিণাত্যের উপরই তার জমিদারির অধিকার স্থাপন করেন। বস্তুত, মারাঠা আক্রমণের থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য এগুলিকে একটি সুরক্ষা মূল্য বলা যেতে পারে।
আবার এই জমিদারি অধিকারের উপর নির্ভর করেই শিবাজি সরদেশমুখী দাবি করেন। রাজস্বের দশ শতাংশের সমপরিমাণ এই দাবির অর্থ ছিল শিবাজিকে এই অঞ্চলের সমস্ত দেশমুখদের প্রধান হিসাবে মেনে নেওয়া। এখানে লক্ষণীয় হল যে বিজাপুরের শাসকও নিজেকে সরদেশমুখ বলে দাবি করেন। বিজাপুর শাসকেরা কোনো কোনো অভিজাত পরিবারের উপর এইভাবে সরদেশমুখী বা সরপ্যাটেলি (সমগ্র প্যাটেলদের প্রধান) দাবি করেছিলেন বলেও আমরা জানি। শিবাজির সরদেশমুখীর অর্থ এ অঞ্চলের সমগ্র দেশমুখদের উপর তার কর্তৃত্ব মেনে নেওয়ার দাবির সঙ্গেই জড়িত। এখানে লক্ষণীয় যে শিবাজি তার গদিতে বসার সময় সকল দেশমুখদের উপর সিংহাসন পট্টি জারি করেন।
বিজাপুর, এমনকি মহাপরাক্রান্ত মুঘলদের বিরুদ্ধতা সত্ত্বেও শিবাজি যে একটি স্বাধীন মহারাষ্ট্র রাজ্য গড়ে তুলতে পেরেছিলেন এ কম কথা নয়। এর মুখ্য কারণ হল যে মহারাষ্ট্রের অধিবাসীদের ক্রমবর্ধমান এবং বিপুল জনসমর্থন যার জন্য তিনি অনেক শক্তিশালী দেশমুখ পরিবারকে তাঁর দিকে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন অথবা তাদের বিরোধিতাকে বিনষ্ট করে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
শিবাজি নিজেকে যে শুধু একজন সুযোগ্য সেনাপতি, নিপুণ কৌশলবিদ এবং সুচতুর কূটনীতিক বলেই প্রমাণ করেননি, দেশমুখদের ক্ষমতা খর্ব করে তিনি এক শক্তিশালী রাষ্ট্রেরও গোড়াপত্তন করেছিলেন। তার নীতি রূপায়ণের ক্ষেত্রে সৈন্যদলের এক বিশেষ ভূমিকা ছিল, বিশেষত যখন দ্রুত বেগশীলতা একটি মুখ্য প্রয়োজন বলে অনুভূত হত সৈন্যদল তাদের বেতন ছাড়াও সন্নিহিত রাজ্যগুলিতে লুণ্ঠন কার্যের উপরেও নির্ভরশীল ছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও শিবাজির রাজ্যকে এক যুদ্ধবিদ বা যুদ্ধভিত্তিক রাজ্য বলা যায় না। প্রাক-আধুনিক যুগে প্রায় সকল রাজ্যই লুটপাট করে তাদের আয়ের সীমা বাড়াত, যদিও এই অনুপাত বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন রূপ হত।
শিবাজির এই আন্দোলন ছিল কিন্তু বিশেষভাবে আঞ্চলিক প্রকৃতির। শিবাজি তার সৈন্যদলে আফগান ও মুসলিমদের স্থান দিয়েছিলেন এবং তাঁর দক্ষ নৌবহরের অধ্যক্ষের মধ্যে একজন বা বোধ হয় দু’জনই ছিলেন মুসলিম। সম্ভবত আবিসিনীয় মুসলিম। কিন্তু তার সেনাপতি এবং আধিকারিকদের প্রায় সকলেই ছিলেন মহারাষ্ট্রবাসী। তার শাসনব্যবস্থার কোনো সুস্পষ্ট হিন্দু চরিত্র বা হিন্দু ভাবাদর্শ ছিল না, কিন্তু সবকিছুই ছিল এক বিশাল জনসমর্থনের উপর প্রতিষ্ঠিত। সেভাবে বলতে গেলে শিবাজি ছিলেন এক জনতার রাজা, যিনি মুঘল শক্তি ও কেন্দ্রমুখীনতার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ইচ্ছাকে সুনিশ্চিত করেছিলেন।
আওরঙ্গজেব এবং দাক্ষিণাত্যের রাজ্যসমূহ (১৬৫৮-১৬৮৭)
সিংহাসনে আরোহণের পরেই ঔরঙ্গজেব তার পিতা শাহজাহানের দাক্ষিণাত্য নীতি অবলম্বন করে সরাসরি বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা এই দুটি দক্ষিণী রাজ্য অধিকার করে নেবেন, এইটিই হয়তো আশা করা গিয়েছিল। বাস্তবে কিন্তু তিন দশক অতিক্রান্ত হবার পরেই ঔরঙ্গজেব এই রাজ্যগুলি অধিকারের বিষয়ে অগ্রণী হন।
১৬৫৮ থেকে ১৬৮৭ অবধি সময়-কালকে তিনভাগে ভাগ করে নেওয়া যায়। প্রথম পর্বে, অর্থাৎ ১৬৬৮ সাল পর্যন্ত, ১৬৩৬ সালে সন্ধিচুক্তি অনুযায়ী আহমদনগরের যেসব অংশ বিজাপুরকে সমর্পণ করা হয়, তিনি প্রধানত সেই ভূখণ্ডই বিজাপুরের নিকট থেকে অধিকার করে নেওয়ার চেষ্টা করেন। দ্বিতীয় পর্বে, অর্থাৎ ১৬৮৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়-কালে, মারাঠাদেরই দাক্ষিণাত্যের প্রধান বিপদ বলে চিন্তা করা হয় এবং শিবাজি ও তার পুত্র ও উত্তরাধিকারী শম্ভাজীর বিরুদ্ধে মুঘলদের সঙ্গে একযোগে অভিযান চালানোর জন্য ঔরঙ্গজেব বিজাপুর গোলকুণ্ডার উপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন। এর সঙ্গে সঙ্গেই যেসব রাজ্যকে মুঘলরা সম্পূর্ণভাবে অধিকার। করতে চেয়েছিলেন, সেখানে ছোটোখাটো হামলাও চলতে থাকে। শেষ পর্ব শুরু হয় ১৬৮৪ সালে। শিবাজির বিরুদ্ধে বিজাপুর ও গোলকুণ্ডার সমর্থন পাওয়ার চেষ্টায় হতাশ হয়ে ঔরঙ্গজেব সিদ্ধান্ত নেন যে মারাঠাদের ধ্বংস করতে গেলে প্রথমেই বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা জয় করা দরকার।
এখানে মনে করা যায় যে, ১৬৩৬ সালে মারাঠাদের সর্বপ্রকার সাহায্য প্রত্যাহার করার অঙ্গীকারে শাহজাহান আহমেদনগরের এক তৃতীয়াংশ উৎকোচ হিসাবে প্রদান করে বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা কখনোই জয় না করার যে অঙ্গীকার করেছিলেন, সেই চুক্তি তিনি নিজেই ভঙ্গ করেন। দাক্ষিণাত্যের অভিমুখে সীমাবদ্ধ আক্রমণ চালাবার সুদূরপ্রসারী যে ফল হতে পারে শাহজাহান বা ঔরঙ্গজেব কেউই তা বুঝে উঠতে পারেননি। এতে মুঘলদের করা চুক্তি বা অঙ্গীকারের উপর সকলের বিশ্বাসই চিরদিনের জন্য ভঙ্গ হয় যার ফলে মারাঠাদের বিরুদ্ধে হৃদয়ের মিলনের যে নীতি প্রায় ২৫ বছর ধরে ঔরঙ্গজেব এত ধৈর্যের সঙ্গে সকলকে বোঝাবার চেষ্টা করে এসেছেন, তার সাফল্য ছিল অকিঞ্চিৎকর।
প্রথম পর্ব (১৬৫৮-৬৮)
সিংহাসনে আরোহণ করার সময় ঔরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যের জাঠ সমস্যার মুখোমুখি হন। একটি ছিল শিবাজির অভ্যুত্থান আর অপরটি ১৬৩৬ সালের চুক্তিতে যে রাজ্যখণ্ড বিজাপুরকে দেওয়া হয়েছিল, তা ছেড়ে দিতে তাকে বুঝিয়ে ওঠা। কল্যাণ এবং বিদার ১৬৫৭ সালে আয়ত্তে আনা হয়, ঘুস দিয়ে ১৬৬০ সালে পারোন্দা অধিকার করা হয়। তবে শোলাপুর আয়ত্তে আনা যায়নি। ঔরঙ্গজেব শিবাজি ও আদিল শাহ উভয়কেই উচিত শিক্ষার দেবার জন্য জয় সিংহকে আদেশ করেন। এ থেকেই বোঝা যায় যে ঔরঙ্গজেব মুঘলদের শক্তির প্রতি কতটা আস্থাশীল ছিলেন, এবং বিরোধীদের কতটা তাচ্ছিল্য করতেন।
জয় সিংহ ‘বিভাজন ও শাসন’ নীতি অবলম্বন করতে সিদ্ধান্ত নেন। তার যুক্তি ছিল তার বিজয়দৃপ্ত সেনানীর পক্ষে এই দুটি নগণ্য শক্তিকে পরাজিত করা কঠিন নয়,
কিন্তু যদি বুদ্ধি করে কোনো জিনিস লাভ করা যায় তাহলে দেরি করে (অর্থাৎ জোর খাঁটিয়ে) লাভ কি? তার ধারণায় মুঘলদের উদ্দেশ্য ছিল মারাঠাদের বিরুদ্ধে সাহায্যের বিনিময়ে কোনো পুরস্কার না দিয়েই কি করে দাক্ষিণাত্যে বিভক্তি রাখা যায়। তার এই উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য জয় সিংহ একটি সম্ভাব্য নীতি প্রস্তুত করেছিলেন। জয় সিংহ বুঝেছিলেন যে সমগ্র দাক্ষিণাত্যের বিষয়ে একটি ভবিষ্যৎ নীতি বা কৌশল স্থির না করলে মারাঠাদের সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়। ঔরঙ্গজেবও এই সত্য উপলব্ধি করেছিলেন কুড়ি বছর পরে।
বিজাপুর আক্রমণের পরিকল্পনা করার সময় জয় সিংহ ঔরঙ্গজেবকে লেখেন যে ‘বিজাপুর জয় প্রকৃতপক্ষে সমগ্র দাক্ষিণাত্য ও কর্ণাটক জয়ের একটি মুখবন্ধ মাত্র।’ ঔরঙ্গজেব কিন্তু এই সাহসী পদক্ষেপ থেকে পিছিয়ে আসেন। এই কারণ সম্বন্ধে চিন্তা করতে গিয়ে আমাদের মনে হয়—’ইরানের শাসক তখন দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল নিয়ে ভীতিব্যঞ্জক অবস্থান নিয়েছে।’ এছাড়া কর্ণাটক অভিযান হবে দীর্ঘস্থায়ী এবং কঠিন শ্রমসাধ্য। এবং যেহেতু বিশাল সুদক্ষ সৈন্যদলকে কয়েকজন অভিজাত বা একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী শাহজাদার পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়, সেইজন্য স্বয়ং বাদশাহকে সেই অভিযানে নেতৃত্ব দিতে হবে, যা দুর্ভাগ্যবশত শাহজাহানকে করতে হয়েছিল। এছাড়া যতদিন শাহজাহান জীবিত আছেন ততদিন ঔরঙ্গজেব কি করে এত দূরবর্তী অভিযানে যেতে পারবেন।
তাঁর যৎসামান্য শক্তি দিয়ে জয় সিংহ-এর বিজাপুর আক্রমণ (১৬৬৫) ব্যর্থ হওয়া অবশ্যম্ভাবী ছিল। এই অভিযানের সময় দাক্ষিণাত্যের শক্তিগুলি মুঘলদের বিরুদ্ধে। ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়, কেননা কুতব শাহ বিজাপুরের সাহায্যে এক বিশাল সৈন্যদল পাঠান। দক্ষিণীরা গেরিলা যুদ্ধ নীতিঅবলম্বন করে জয় সিংহকে দাক্ষিণাত্যের দিকে নিয়ে আসে। সেই সঙ্গে পথপার্শ্বস্থ সমস্ত গ্রামগুলি ধ্বংস করে দেয় যাতে তার সেনারা কোনোপ্রকার খাদ্য সংগ্রহ না করতে পারেন। জয় সিংহ দেখলেন যে তার পক্ষে এই নগর আক্রমণ করা সম্ভব নয়। কেননা তিনি উপযোগী কামান, বন্দুক আনেননি, আবার অবরোধ করে বসে থাকাও অসম্ভব। তাই ফিরে যেতে হল। এই পশ্চাদপসারণও ব্যয়বহুল প্রতিপন্ন হয়, এবং এই অভিযানে জয় সিংহ অর্থ সংগ্রহ করতে পারেননি বা নতুন ভূখণ্ডও অধিকার করতে পারেননি। এই হতাশায় এবং ঔরঙ্গজেবের তিরস্কারে ভগ্নহৃদয় জয় সিংহ-এর মৃত্যু হয় ১৬৬৭ সালে। পরবর্তী বৎসরে উৎকোচের বিনিময়ে মুঘলরা শশালাপুর জয় করে নেয়, এবং এইভাবেই প্রথম পর্ব শেষ হয়।
দ্বিতীয় পর্ব (১৬৬৮-৮৪)
১৬৭২ খ্রিস্টাব্দে আদিল শাহের মৃত্যুর পর বিজাপুরের দ্রুত অবক্ষয়ের ফলে এক নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ঔরঙ্গজেব নিশ্চিত ছিলেন যে শিবাজি বিশ্বাসযোগ্য নন এবং তিনি এক উচ্চাশী পুরুষ। সেহেতু তার সঙ্গে কোনো স্থায়ী সমঝোতা হওয়া সম্ভব নয়। এই নীতি মাথায় নিয়ে ঔরঙ্গজেব তিনটি উপায় চিন্তা করেছিলেন–
(১) দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলির প্রতি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতার সিদ্ধান্ত নেওয়া। এমনকি শিবাজি এককভাবে বা গোলকুপ্তার সঙ্গে মিলিতভাবেই হোক–যদি বিজাপুর জয় বা ক্ষমতাহীন করে ফেলেন, তাতেও এই নিরপেক্ষতা বিঘ্নিত হবে না।
(২) মারাঠা আক্রমণের প্রতিরোধে বিজাপুরকে উপযুক্ত শক্তিশালী করে তোলা। যদি বিজাপুর এর বিরোধী হয় তাহলে বিজাপুর দরবারের কোনো শক্তিশালী গোষ্ঠীকে মুঘল নীতির সমর্থনে সম্মত করানো।
(৩) দক্ষিণের দুটি রাজ্যকেই অথবা প্রথম ধাপে কেবল বিজাপুরকে সরাসরি অধিকার করে নেওয়া।
প্রথম নীতিটি ছিল চিন্তারও অতীত এবং কখনোই এটিকে গুরুত্ব দিয়ে চিন্তা করা হয়নি। যদিও সবদিক বিবেচনা করে অন্যগুলির তুলনায় এই নীতি হয়তো ততটা ক্ষতিকর ছিল না। দাক্ষিণাত্যের স্থায়ী এবং সমৃদ্ধ কোনো রাজ্য মুঘলদের জন্য অতটা চিন্তার কারণ হত না, এমনকি সে রাজ্য যদি শিবাজির দ্বারা অধিকৃত হয় তাহলেও। ১৬৫৬ সালে এবং তার পরবর্তী ঘটনাবলী ও অবস্থান, যথা মুঘল সাম্রাজ্যের তৎকালীন অবস্থা, এবং অন্য রাজ্য অধিকার সহ ঔরঙ্গজেবের কঠোর নীতি অনুসরণ। করার সিদ্ধান্ত, এগুলিই এক বিশাল সম্ভাব্য অকর্মণ্যতাকে কোনোমতে প্রতিরোধ করে। রেখেছিল। সুতরাং এরপর ঔরঙ্গজেব তাঁর দ্বিতীয় পছন্দের নীতির দিকে কিছুটা অগ্রসর হলেন এবং শেষ পর্যন্ত যখন অবশেষে নিজস্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তার বিশ্বাস হল যে দাক্ষিণাত্যের শক্তিগুলি কিছুতেই শিবাজিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করার জন্য তার সাথে হাত মেলাবে না, তখন তিনি তার দ্বিতীয় নীতিটিকেও পরিত্যাগ করে শেষ পর্যন্ত তৃতীয় নীতিটিকেই গ্রহণ করলেন ১৬৮৪ সালে।
স্যার যদুনাথ সরকার ঠিকই ভেবেছিলেন যে দুটি ঘটনা, অর্থাৎ ১৬৭২ খ্রিস্টাব্দে বালক রাজা সিকান্দারের সিংহাসনে আরোহণ করার পরবর্তী সময়ে বিজাপুরের ক্রমবর্ধমান দুর্বলতা এবং বিজাপুরের দরবারে ঘটমান গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, মূলত এই দুটির পরিপ্রেক্ষিতেই দাক্ষিণাত্যে নতুন মুঘল নীতির প্রবর্তন হয়। এটা লক্ষণীয় শাহ আলমের পরিবর্তে চন্মনে ও সাফল্যময়’ আমলা হিসাবে বাহাদুর খানকে দাক্ষিনাত্যের সুবাদার করা হয় (১৬৭৩)। এই ঘটনার পর থেকে ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিনাত্য নীতির ২য় পর্ব শুরু হয়। তবে এই সময়কালে ঔরঙ্গজেবের উদ্দেশ্যও বিশেষ সীমিত ছিল। বাহাদুর খানকে কোনোদিন নতুন অতিরিক্ত সেনানী দেওয়া হয়নি। এবং স্যার যদুনাথ সরকারের মতে একজন সাধারণ প্রাদেশিক শাসকের সীমিত ক্ষমতা নিয়ে। দোর্দণ্ডপ্রতাপ শিবাজিকে দমন করা এবং তার সঙ্গে বিজাপুর জয় করা এক অসম্ভব ব্যাপার ছিল। ইতিপূর্বে এর থেকে অনেক বৃহত্তর সৈন্যদল নিয়ে এবং শিবাজির সহযোগিতা পাওয়া সত্ত্বেও জয় সিংহ এই কার্যে অসফল হন।
এই সময়কার একটি নতুন ঘটনা হল গোলকুণ্ডায় মান্না এবং আখান্নার ক্ষমতারোহণ। এক তেলেগু ব্রাহ্মণ পণ্ডিত মান্না ছিলেন গোলকুণ্ডার উজির সৈয়দ মুজাফফরের মুনশি এবং ব্যক্তিগত সহকারী।১৬৭২ সালে সিংহাসন অধিকার করার পর আবুল হাসান তাকে উজির এবং পেশোয়ার পদ প্রদান করেন। এই সুযোগ্য দুই ভাই ১৬৭২ সাল থেকে ১৬৮৭ সালে গোলকুণ্ডা রাজ্যের অবসানের সময় পর্যন্ত এই রাজ্যটির প্রায় সর্বময় কর্তা হয়েছিলেন বলা যায়। এই ভাইয়েরা গোলকুণ্ডা, বিজাপুর এবং শিবাজির মধ্যে একটি ত্রিপাক্ষিক জোট গঠনের চেষ্টা করেন। বিজাপুর দরবারের। গোষ্ঠী সংঘর্ষ এবং শিবাজির সর্বব্যাপী উচ্চাশার জন্য এই নীতি মাঝে মাঝে ব্যাহত হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে বিজাপুরের উপদল গঠন যে একটি নীতি মেনে চলবেন, এ আশা করা যেত না। তারা নিজেদের স্বার্থ অনুসারে মোগলের স্বপক্ষে আবার কখনো-বা বিপক্ষে অবস্থান নিত। শিবাজি কখনও বিজাপুরে লুণ্ঠন চালাতেন আবার। কখনও তাদের মোগলদের বিরুদ্ধে সাহায্য করতেন। এদিকে ক্রমবর্ধমান মারাঠা শক্তির জন্য চিহ্নিত হয়ে পড়লেও ঔরঙ্গজেব মনে হয় দাক্ষিণাত্যে মুঘল সাম্রাজ্য বিস্তার করতে উৎসাহী ছিলেন না। মুঘলদের পক্ষে এবং শিবাজির বিপক্ষে যাবে এমন এক শক্তিকে বীজাপুরে স্থাপন করার জন্য বারবার চেষ্টা করা হচ্ছিল। এও দেখা হচ্ছিল এর নেতৃত্ব যেন গোলকুণ্ডার হাতে না চলে যায়।
দাক্ষিণাত্যে কাজে বহাল হওয়ার পর বাহাদুর খান একটি সতর্ক ও মীমাংসামুখীন নীতি গ্রহণ করেছিলেন। তিনি দাক্ষিণাত্যের নেতা খাওয়াস খানের সঙ্গে পরামর্শ শুরু করে তাকে শিবাজির বিরুদ্ধে মুঘলদের সঙ্গে যোগদান করতে প্রভাবিত করার চেষ্টা করতে থাকেন। ১৬৭৫ সালের অক্টোবর মাসে বাহাদুর খান পান্ধারপুরে খাওয়াস খানের সঙ্গে মিলিত হন। সেই আলোচনার সময় খাওয়াস খান, সিকান্দার আদিল শাহের বোনকে ঔরঙ্গজেবের এক ছেলের সঙ্গে বিবাহ দেবার প্রতিশ্রুতি দেন। এবং বাহাদুর খানের পুত্রের সঙ্গে তার নিজের কন্যার বিয়েরও সম্মতি দেন। খাওয়াস। নিজেও শিবাজির বিরুদ্ধে অভিযানে যোগ দিতে সম্মত হন। এবং তার বিনিময়ে মুঘলেরা খাওয়াস খানকে তার বিদ্রোহী আফগান সৈন্যদের বেতন মেটাবার জন্য তিন লক্ষ টাকা দেবার প্রতিশ্রুতি দেন। বাহাদুর খান আফগান সেনাদের সংগঠন ভেঙে দেওয়ার জন্য এবং আফগান সেনাদের প্রধান বহনলাল খানকে সর–ই–লসকর-এর। সম্মান থেকে বিচ্যুত করতে খাওয়াস খানকে সাহায্যের জন্য ভিমা নদী পর্যন্ত অগ্রসর হন। কিন্তু বহলোল খান খাওয়াস খানকে পদচ্যুত এবং বন্দি করে নেওয়ার ফলে তার এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ১৬৭৬ সালে বাহাদুর খান-কর্তৃক বিজাপুর আক্রমণের এই ছিল পশ্চাৎপট। বাহাদুর খান বিজাপুরের থেকে গুলবর্গা এবং নলদুর্গ ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হন (১৬৭৭)। নলদুর্গ এবং গুলবর্গা জয় করার ফলে ভীমা এবং পশ্চিমে মঞ্জিরা নদী দ্বারা বেষ্টিত ভূখণ্ড মুঘলদের দখলে আসে। এ ছাড়া এর ফলে বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা শহরগুলির উপর আক্রমণ হানার মতো নিকট দূরত্বে মুঘলরা অগ্রসর হতে সক্ষম হন।
এত স্বল্প সাফল্যে অসন্তুষ্ট হয়ে ঔরঙ্গজেব বাহাদুর খানকে অপসারিত করে তার স্থলে তারই সহকারী দিলির খানকে নিয়োগ করেন। বাহাদুর শাহ বিজাপুরের দক্ষিণী দলগুলিকে একত্র করে আফগানদের বিরুদ্ধে যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন দিলের খান সম্পূর্ণ তার বিপরীতমুখী নীতি প্রণয়ন করেন। বহলাৈল খান যে গোলকুণ্ডার বিপক্ষে মিলিত আক্রমণ এবং সম্মিলিত ভাবে শিবাজিকে ধ্বংস করার যে বাহ্যাড়ম্বরপূর্ণ ঘোষণা করেছিলেন, দিলের খান সেই ভাষণের দ্বারা প্রভাবিত হন। কিন্তু গোলকুণ্ডার বিরুদ্ধে মিলিত আক্রমণ (১৬৭৭) নির্লজ্জভাবে ব্যর্থ হয় এবং এর ফলে মান্না ও আখান্নার মুঘলদের বিরুদ্ধে দাক্ষিণাত্যে এক সম্মীলিত জোট সৃষ্টি করার নীতি আরও জোরদার হয়ে ওঠে। মান্না ইতিমধ্যেই শিবাজির সঙ্গে একটি চুক্তি সম্পাদন করছিলেন যাতে করে সাম্রাজ্যের সুরক্ষার জন্য তাকে বাৎসরিক এক লক্ষ হান দেবার ব্যবস্থা করেন। প্রহ্লাদ নিরজ নামে একজন মারাঠা অভিজাত শিবাজির প্রতিনিধি রূপে হায়দরাবাদে কর্মভার গ্রহণ করেন। এর সঙ্গে সঙ্গেই আখান্নার উৎসাহেই ১৬৭৬ সালে শিবাজি ও বহনলাল খানের মধ্যে এক চুক্তি সম্পন্ন হয়। বহলাল খান সম্প্রতি খাওয়াস খানের স্থলাভিষিক্ত হয়ে এসেছিলেন। এই চুক্তির শর্তাবলী ছিল নিম্নরূপ। মুঘলদের থেকে সুরক্ষা মূল্য বাবদ বিজাপুর সরকার শিবাজিকে এককালীন তিন লক্ষ টাকা এবং প্রতিবছর এক লক্ষ টাকার ভরতুকি দেবেন। বিনিময়ে মুঘল আক্রমণ থেকে শিবাজি তাদের রক্ষা করবেন। তাছাড়া বিজাপুর পূর্বদিকে কৃষ্ণা নদী দ্বারা বেষ্টিত সমগ্র অঞ্চলের উপর কোলাপুর জেলা সহ শিবাজির কর্তৃত্ব স্বীকার করে নেয়। এর পরেই ১৬৭৭-৭৮ সালে কর্ণাটক অভিযানের সময় গোলকুণ্ডা শিবাজিকে সমর্থন দেয়। বোধ হয় মান্না এবং আখান্না ভ্রাতৃদ্বয় আশা করেছিলেন যে শিবাজিকে যদি দক্ষিণের দিকে রাজ্য বিস্তার করার সহযোগিতা দেওয়া হয়, তাহলে হয়তো তিনি বিজাপুরে প্রতি তার উচ্চাশাকে সীমিত রাখবেন। কিন্তু শিবাজির গগনচুম্বী উচ্চাশা এবং বিজাপুরের দরবারে আফগান এবং দক্ষিণীদের মধ্যেকার অন্তর্কলহের জন্য দুই ভাইয়ের এই আশা পূরণের ক্ষেত্রে এক বিশেষ অসুবিধে সৃষ্টি হল। এই জন্য বাহনলাল খানের উত্তরাধিকারী মাহমুদ খান শিবাজির কাছে আবেদন করেন ‘আমরা পরস্পরের প্রতিবেশী, আমরা একই নিমক খাই, এই রাজ্যের মঙ্গলের জন্য আমি যতটা গভীর ভাবে চিন্তা করি, আপনিও ততটাই করেন। শত্রুপক্ষ (মুঘলেরা) একে ধ্বংস করার জন্য অহোরাত্রি চেষ্টা করে চলেছে। আসুন আমরা একত্রিত হয়ে এই বিদেশিদের বিতাড়ন করি।’ কিন্তু এই আবেদনের কোনো ফল হয়নি। এর ফলে বিজাপুরী শক্তিগুলি শিবাজির হানাদারিকে প্রতিরোধ করার জন্য ক্রমশই মুঘলদের সমঝোতার দিকে ঝুঁকে পড়তে থাকেন। তবে এ ধরনের সমঝোতাও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি, কেননা বিজাপুরের কোনো গোষ্ঠীই শিবাজিকে ধ্বংস করতে উৎসাহী ছিলেন না। কেননা তাদের চোখে শিবাজি ছিলেন মুঘলদের বিরুদ্ধে প্রধান অস্ত্রধারী। এই কূটনৈতিক টানাপোড়েন, বিশেষ করে মুঘল আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মান্না ও আখান্নার ভূমিকা নিয়ে অদ্যাবধি যথেষ্ট গবেষণা হয়নি।
১৬৭৮ সালকে দাক্ষিণাত্যের রাজনীতির ক্ষেত্রে মান্না এবং আখান্নার অবদানের একটি সীমাফলক ধরা যেতে পারে। গোলকুণ্ডার উপর মুঘল ও বিজাপুরের। সম্মিলিত অভিযান (১৬৭৭) ব্যর্থ হলে, এবং তার অব্যবহিত পরেই বহলোল খানের মৃত্যুর পর নিম্নলিখিত নীতি নির্ধারিত হয়। প্রথমত দক্ষিণী দলের নেতা সিদি মাসুদ হবেন উজির, দাঙ্গাপ্রবণ আফগান সেনাদের পয়সা মিটিয়ে দেওয়া হবে, এবং একজন। গোলকুণ্ডার প্রতিনিধি বিজাপুরে বাস করে ওয়াজিরকে শাসন ব্যবস্থা সম্বন্ধে পরামর্শ দেবেন। এবং স্থির করা হয় যে শিবাজিকে কোঙ্কন অঞ্চলেই আটকে রাখা হবে। এই চুক্তি অনুসারে আখান্নাকে রাজপ্রতিনিধি হিসাবে বিজাপুরে রাখা হয়।
সুতরাং অন্তত এই পর্যন্ত গোলকুন্ডা এবং মুঘল রাজনীতি ও বিজাপুর এক সমান্তরাল নীতি অবলম্বন করে চলেছিল, অর্থাৎ শিবাজিকে আটকে রাখা। ঔরঙ্গজেব যদি মান্না এবং আখান্নার সঙ্গে একজোট হয়ে বিজাপুরকে আরও শক্তিশালী করে তুলে শিবাজির অগ্রগতিকে প্রতিরোধ করতে পারতেন, তাহলে কি দাক্ষিণাত্যের রাজনীতি এক স্থিতাবস্থা ধারণ করতে পারত? তবে এরকম সম্ভাবনার কথা চিন্তা করা গেলেও বাস্তবে তাকে সৃষ্টি করা কঠিন বা অসম্ভবই ছিল। মুঘলরা প্রথমে সিদি মাসুদকে দলে টানার চেষ্টা করেন। কিন্তু ১৬৭৯ খ্রিস্টাব্দে মাসুদ এবং শিবাজির মধ্যে। গোপন শলাপরামর্শ হবার পর, দিলের খান বিজাপুর দখল করার এক আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তখন বিজাপুর দুর্গে মাত্র ৫০০০ সেনা ছিল। কিন্তু ঠিক সময়ে এবং কার্যকরী ভাবে মারাঠাদের হস্তক্ষেপের ফলে দিলের খান শোচনীয় ভাবে পরাজিত হন।
মুঘলদের এই সব কূটনৈতিক এবং সামাজিক কৌশল অবলম্বনের ফলে কেবল তিনটি দক্ষিণী শক্তির জোট আবার নূতন করে মুঘলদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হল। এই পরিস্থিতিতে নবতম সংযোজন আবার কর্ণাটকের পদাতিক বাহিনী। বেরারের শাসক প্রেম নায়েকের তিরিশ হাজার পদাতিক বাহিনী পাঠানোর ঘটনাটি মুঘলদের বিজাপুরের অবরোধ প্রত্যাহারের একটি প্রধান কারণ বলে ধরা যায়। শিবাজিও, বিজাপুরের সাহায্যে এক বড়ো সৈন্যদল পাঠানো ছাড়াও চতুর্দিকে মুঘলদের উপর আক্রমণ হানতে থাকেন। দিলের খাঁর কিছুই লাভ হল না, কেবল মুঘল-অধিকৃত অঞ্চলগুলি মারাঠাদের আক্রমণের সহজ লক্ষ্য হয়ে উঠল। এবং এর ফলে ঔরঙ্গজেব তাকে ডেকে পাঠালেন।
তাহলে দেখা যাচ্ছে ১৬৬৬ সালে বিজাপুর থেকে জয় সিংহের পশ্চাদপসরণ এবং ১৬৮০ সালে দাক্ষিণাত্যে শাহজাদা আকবরের খোঁজে ঔরঙ্গজেবের পদার্পণ এই সময়কালে মুঘলদের ফলাফল ছিল একেবারে হতাশাজনক। ১৬৭৬ সালে শিবাজির সঙ্গে সম্পর্কছেদের পর ঔরঙ্গজেব চেষ্টা করেছিলেন জয় সিংহ-এর অতীত সাফল্যের পুনরাবৃত্তি করতে। কিন্তু তিনি সম্পূর্ণ নিষ্ফল হন। তিনি মারাঠাদের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করেননি আবার মারাঠাদের বিরুদ্ধে অন্যান্য দক্ষিণী রাজ্যগুলিকে একত্রিত করতেও পারেননি। তিনি মঝেমধ্যে বিজাপুরকে উত্ত্যক্ত করার জন্য সেই রাজ্যের স্থানে স্থানে হামলা চালাবার সিদ্ধান্ত নেন, যা অবশ্য নিষ্ফল হয়। প্রকৃতপক্ষে এই সময়ে একক ভাবেই হোক বা মারাঠাদের সঙ্গে যৌথ ভাবেই হোক, তিনি দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলি অধিকারের কোনো চেষ্টা করেননি, যদিও জয় সিংহ তাকে পূর্বেই এই নীতি অবলম্বন করার কথা বলেছিলেন। আফগানদের বিদ্রোহ বা পারসিক আক্রমণের সম্ভাবনা কোনোদিক থেকেই এর সম্পূর্ণ কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি যে প্রকৃতপক্ষে ঔরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যের এই রাজ্য দুটির আক্রমণের ব্যাপারে ভীতিগ্রস্ত ছিলেন। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে এই অভিযান হবে দীর্ঘস্থায়ী। বহু সৈন্য এবং সম্পদ নিয়োগ হয়ে উঠবে অবশ্যম্ভাবী। এ ছাড়া মুঘল সেনাধ্যক্ষদের চিরস্থায়ী বিবাদ-বিসংবাদের নিষ্পত্তি করার জন্য এক উদ্যমী রাজপুত্র বা শাহজাদাকে এই সম্পূর্ণ অভিযানের নেতৃত্বে অগ্রসর হতে হবে। ঔরঙ্গজেব এই বিপজ্জনক পরিস্থিতিটিকে সর্বান্তকরণে এড়াতে চেয়েছিলেন। আবার তিনি স্বয়ং দাক্ষিণাত্য অভিযানে যেতে ইচ্ছুক ছিলেন না। সুতরাং এই সময়েই সর্বত্রই এক অনিশ্চিত নীতি ও পরিস্থিতির বাতাবরণ পরিলক্ষিত হয়।
শাহজাদা আকবরের সন্ধানে ঔরঙ্গজেব ১৬৮০ সালে দাক্ষিণাত্যে পদার্পণ। করলেও এই নীতির কোনো তাৎক্ষণিক পরিবর্তন দেখা যায়নি। প্রথমেই ঔরঙ্গজেব মারাঠাদের উপর তার দৃষ্টি নিবন্ধ করে অন্যান্য দক্ষিণী রাজ্যগুলিকে মারাঠাদের বিরুদ্ধে মুঘলদের সহায়তা করে জোটবদ্ধ হওয়ার জন্য তাদের বোঝাতে এবং চাপ দিতে থাকেন।
তৃতীয় পর্ব (১৬৮৪-৮৭)
১৬৮৪ সালে ঔরঙ্গজেব উপলব্ধি করলেন যে কোনো একটি বা উভয় দাক্ষিণাত্যের রাজ্য অধিকার না করতে পারলে তার উদ্দেশ্য সাধিত হবে না। এইটিকেই ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতির তৃতীয় পর্ব বলে ধরা যায়।
ঔরঙ্গজেব আদিল শাহকে রাজকীয় বাহিনীর যাবতীয় খাদ্য ও প্রয়োজনীয় বস্তু সরবরাহ করার ও তার রাজ্যের মধ্য দিয়ে মুঘল সৈন্যদের অবাধ চলাচলের অধিকার। দেওয়ায় এবং মারাঠাদের বিরুদ্ধে ৫০০০ থেকে ৬০০০ অশ্বারোহী সৈন্য মোতায়েন করার আদেশ পালন করতে বলেন। তিনি আরও হুকুম করেন ঔরঙ্গজেবের প্রধান। বিরোধী বিজাপুরী অভিজাত শারজা খানকে যেন বিতাড়ন করা হয়। এর পর খোলাখুলি ভাঙন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠল। আদিল শাহ গোলকুণ্ডা ও শম্ভাজী উভয়ের নিকটই, সাহায্যের আবেদন করলেন এবং তারাও সত্বর সাহায্যের হাত বাড়িয়ে। দিলেন। কিন্তু এই সম্মিলিত দক্ষিণী ফৌজও পুর্ণশক্তির মুঘল সৈন্যদলের সামনে দাঁড়াতে পারল না, বিশেষ করে মুঘল বাদশাহ যখন স্বয়ং এই সৈন্যদলের পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। এসত্ত্বেও ১৮মাস ব্যাপী অবরোধের পরে বিজাপুরের পতন হয়। (১৬৮৬) এবং ঔরঙ্গজেব স্বয়ং অবরোধের শেষ পর্বে মোঘল সৈন্যদের নেতৃত্বে ছিলেন। এই ঘটনা অতীতে জয় সিংহ (১৬৬৫) এবং দিলের খানের (১৬৭৯-৮০) অসফলতার যথেষ্ট কারণ হিসাবে গণ্য হয়।
বিজাপুরের পতনের পর গোলকুণ্ডার বিরুদ্ধে মুঘল অভিযান অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। কুতব শাহ এতই অপরাধ করেছিলেন, যে তা ক্ষমার অযোগ্য বলে বিবেচিত হল। তিনি দু’জন বিধর্মী অবিশ্বাসীকে (কাফের) অর্থাৎ মান্না এবং আখান্নাকে সর্বোচ্চ ক্ষমতা দিয়েছিলেন এবং শিবাজিকে বহুবার সাহায্য করেছিলেন। তাঁর বিশ্বাসঘাতকতার শেষতম সংযোজন ছিল ঔরঙ্গজেবের নিষেধ সত্ত্বেও বিজাপুরের সাহায্যার্যে ৪০,০০০ জন সৈনিক প্রেরণ। ১৬৮৫ সালে কঠোর প্রতিরোধ সত্ত্বেও শেষ। পর্যন্ত মুঘলরা গোলকুণ্ডা অধিকার করে। সম্রাট তখন এক বিশাল ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে কুতব শাহকে মার্জনা করার সিদ্ধান্ত নেন। এছাড়া তার রাজ্যের কিছু অঞ্চল। মুঘলদের প্রদান করার এবং মান্না ও আখান্নাকে বিতাড়ন করার দাবিও করা হল। কুতব শাহ অবশ্যই সম্মত হন। মান্না এবং আখান্নাকে টেনেহিঁচড়ে পথে বার করে। নিয়ে এসে হত্যা করা হয় (১৬৮৬)। কিন্তু এতবড়ো অপরাধও কুতুবশাহী রাজত্বকে রক্ষা করতে পারেনি। বিজাপুরের পতনের পর ঔরঙ্গজেব কুতব শাহের হিসাব মেটাতে উদ্যত হলেন। ১৬৮৭ সালে গোড়াতেই এই অবরোধ শুরু হয়। এবং প্রায়। ছ’মাস পরে উৎকোচ এবং বেইমানির বিনিময়ে দুর্গের পতন হয়।
মনে হয় গোলকুণ্ডা এবং বিজাপুর উভয় ক্ষেত্রেই সমগ্র রাজ্যটি অধিকার করে নিতে শাহ আলম চাননি। কিন্তু তিনি আবুল হাসানকে ক্ষুদ্র স্বার্থের সঙ্গে জড়িত করে রাখছেন। এই অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করে বন্দি করে রাখা হয়। ১৬৮৩ সালে শাহজাদা আকবরের ইরানের দিকে রওনা দেওয়া এবং তার থেকে আক্রমণের ভয় হ্রাস পাওয়ার পর ১৬৮৩ সালে আম্বার ওয়াকিল-এর একটি পত্র থেকে বোঝা যায় রাজপুত্ররা এবং মুখ্য অভিজাতরা আর দাক্ষিণাত্যের এই অভিযান চালিয়ে যেতে অনিচ্ছুক ছিলেন। এই পত্রানুসারে বর্ষা শেষ হবার পর ঔরঙ্গজেব উত্তর ভারতে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। অবশ্য খান-ই-জাহান বাহাদুরকে দক্ষিণ ভারতের মুখ্য প্রশাসক হিসাবে নিয়োগ করে রেখে। কিন্তু খান-ই-জাহান বাহাদুর এ প্রস্তাবটি সম্বন্ধে অনুসন্ধান করে জানলেন যে দাক্ষিণাত্যের প্রকৃত অবস্থা অন্য তথ্যের পরিচয় দেয়। প্রকৃতপক্ষে বাদশাহ স্বয়ং রাজপুত্রগণ এবং অন্যান্য অভিজাতবৃন্দের সঙ্গে যখন মুঘল শিবিরে অবস্থান করছেন, তখনও মারাঠারা ৫-৬ ক্রোশের মধ্যে উপস্থিত হয়ে নানা ঔদ্ধত্য এবং অবাধ্যতা প্রদর্শন করতে থাকেন। আবার তিনি যখন প্রস্তাব দেন যে বাদশাহ একজন রাজকীয় ব্যক্তিত্বকে দায়িত্বে রেখে যান, তিনি যাঁর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করবেন, তখন ঔরঙ্গজেব শাহ আলমকে এই দায়িত্ব নিতে বললে তিনি সরাসরি তা প্রত্যাখ্যান করে বলেন যে তিনি কখনোই বাদশাহর পার্শ্বচ্যুত হবেন না কেননা পূর্বে যখন তিনি দাক্ষিণাত্যে নিযুক্ত ছিলেন তখন দিলের খাঁ এবং অন্যান্যরা নানাভাবে তার বদনাম করার চেষ্টা করেছিলেন।
যাই হোক, একথা আমরা অস্বীকার করতে পারি না, যে অভিজাতদের জায়গির-এরজন্য ক্রমবর্ধমান দাবি ঔরঙ্গজেবের সরাসরি বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা জয়ের একটি মুখ্য কারণ, কেননা ইতিপূর্বে এই দাবিটি তিনি বহুদিন ধরেই আগ্রাহ্য করে আসছেন।
মারাঠা এবং দাক্ষিণাত্য : শেষ পর্ব (১৬৮৭-১৭০৭)
ঔরঙ্গজেবের জয় হল বটে, কিন্তু শীঘ্রই বুঝতে পারলেন যে বিজাপুর এবং গোলকুণ্ডার ধ্বংসের পর থেকেই তার যাবতীয় অসুবিধার শুরু। এখন ঔরঙ্গজেবের । জীবনের সর্বশেষ এবং সর্বকঠিন পর্যায়ের সূত্রপাত হল।
বিজাপুর ও গোলকুণ্ডার পতনের পর ঔরঙ্গজেব তার সমস্ত শক্তি মারাঠাদের বিরুদ্ধে নিয়োগ করতে সক্ষম হন। ইতিপূর্বে কয়েকটি নিপুণভাবে পরিকল্পিত কৌশল এবং পছন্দসই সৈন্য নিয়োগের ফলে ঔরঙ্গজেব মারাঠাদের এক রক্ষণাত্মক পরিস্থিতিতে ঠেলে দিতে পেরেছিলেন এবং মারাঠাদের বিজাপুর এবং গোলকুণ্ডার সাহায্যে অগ্রসর হবার মতো সমস্ত পথই বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এছাড়া শম্ভাজী তখন আভ্যন্তরীণ শত্রুদের নিয়ে সিদি ও পর্তুগিজ সহ প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির বৈরী ভাবনার শক্তিদের প্রতিরোধে বিশেষ ব্যস্ত থাকায় ঔরঙ্গজেবের পক্ষে দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলিকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার কৌশল কার্যকরী করা সম্ভব হয়, যার ফলে তিনি নিজের সুবিধামতো তাদের যে-কোনো একদিকে আক্রমণ করতে পারতেন।
১৬৮৯ সালে এক মুঘল সৈন্যদল অতর্কিতে তার গোপন আশ্রয়স্থল সোমেশ্বরে। হানা দিয়ে শম্ভাজীকে বন্দি করে। তাকে ঔরঙ্গজেবের সামনে হাজির করে একজন বিদ্রোহী ও অবিশ্বাসী (কাফের) বলে হত্যা করা হয়। নিঃসন্দেহে এটি ছিল ঔরঙ্গজেবের আরও এক বিশাল রাজনৈতিক ভুল। মারাঠাদের সঙ্গে মীমাংসা করে নিয়ে তিনি তাঁর বিজাপুর এবং গোলকুণ্ডা বিজয়কে স্থির নিশ্চিত করে নিতে পারতেন। প্রকৃতপক্ষে বেশ কয়েকজন অভিজাত বাদশাহকে অনুরোধ করেছিলেন যে শম্ভাজীকে বন্দি করে রেখে তাকে তার সমস্ত দুর্গ মুঘলদের হাতে অর্পণ করার। আদেশ দেওয়া যেত। শম্ভাজীকে হত্যা করে ঔরঙ্গজেব সমঝোতার সমস্ত রাস্তা তো বন্ধ করে দিলেন-ই–উপরন্তু লড়াই করার একটি আদর্শও মারাঠাদের সামনে তুলে দিলেন। কোনো একজন নেতার অবর্তমানে মারাঠা সর্দাররা মুঘলদের অধিকৃত অঞ্চলগুলিতে যেমনখুশি লুঠপাট চালাতে লাগল, কেবল মুঘল সৈন্যদের অগ্রসর হতে দেখলেই তারা গা ঢাকা দিত। মারাঠাদের ধ্বংস করার পরিবর্তে ঔরঙ্গজেবের নীতির জন্য মারাঠারা সমগ্র দাক্ষিণাত্যে ছড়িয়ে গেল। শম্ভাজীর ছোটোভাই রাজারামকে রাজপদে বসানো হল, কিন্তু মুঘলরা তার রাজধানী আক্রমণ করতেই তিনি পালিয়ে গেলেন। রামচন্দ্র অমাত্যকে সহকারী রাজপ্রতিনিধি (হুকুমত পানাহ)। হিসাবে ছেড়ে এসে রাজারাম পূর্ব উপকূলের জিনজিতে আশ্রয় নিয়ে সেখান থেকেই তার সৎ জ্ঞাতিভ্রাতা তাঞ্জোরের শাহজিকে সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধ চালাতে লাগলেন। এই ভাবে মারাঠা প্রতিরোধ ক্রমশ পশ্চিম থেকে পূর্ব উপকূল ছড়িয়ে পড়ল।
কিন্তু তাহলেও ঔরঙ্গজেব তখন তার সমস্ত শত্রুদের জয় করে ক্ষমতার শীর্ষে অধিষ্ঠান করছিলেন। অভিজাত সভাসদদের অনেকেরই মত এই ছিল যে অন্যদের হাতে মারাঠাদের শেষ নিষ্পত্তি করার দায়িত্ব দিয়ে ঔরঙ্গজেবের এখনই উত্তর ভারতে ফিরে যাওয়া উচিত ছিল। ঔরঙ্গজেব কিন্তু এই সমস্ত প্রস্তাবই খারিজ করে দেন। তাঁর ধারণা ছিল যে মারাঠাদের তো শেষ করে দেওয়া গেছে, এখন ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ঔরঙ্গজেব সমৃদ্ধশালী এবং বিস্তীর্ণ কর্ণাটক রাজ্য জয় করতে এবং বিজিত দুটি রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা স্থাপন করতে উদ্যোগী হলেন।
সাম্প্রতিক গবেষণাতে দেখা যায় যে পুরোনো ও সুস্থির গোলকুণ্ডা ও বিজাপুরে ঔরঙ্গজেব যে শাসন ধারা পুনর্গঠন করেন, তা মোটামুটি যথাযথই ছিল। ঔরঙ্গজেব কিছু পুরোনো অভিজ্ঞ মুঘল রাজকর্মচারীকে এখানে নিয়ে আসেন। পুরোনো গোলকুণ্ডার নয়টি সরকার বা শাসিত অংশে ভাগ করা হয় এবং এর শাসন-কেন্দ্রে একজন ফৌজদার দায়িত্বে থাকেন। হায়দরাবাদী কর্ণাটক এবং বিজাপুরী কর্ণাটককে দুটি স্বতন্ত্র অঞ্চল হিসাবে গঠন করা হয়। পুরোনো রাজস্ব ব্যবস্থাকে নূতন করে রূপ দেওয়া হয়। কোনো সর্বাত্মক জরিপ বা জমির কর পরিমাণ নির্ধারণ অবশ্য করা হয়নি। তথাপি স্থানীয় দেশমুখদের সাহায্যে গোলকুণ্ডার নতুনভাবে যে কর নির্ধারণ করা হয় তা দীর্ঘস্থায়ী প্রতিপন্ন হয়, এবং নিজাম-উল-মুলক, ও পরবর্তীকালে ইংরেজেরা এই ধারাই অনুসরণ করেন। ইজারা প্রথার বিলোপ সাধন করা হয়, যদিও আরও নিম্নস্তরে এ ব্যবস্থা সম্ভবত চালু ছিল। শক্তিশালী রেড্ডী, ভালেমা এবং ব্রাহ্মণ দেশমুখদের চুড়ান্ত শোষণ করা হলেও, তাদের অবস্থান অক্ষুণ্ণ রাখা হয়। জমির খাজনার দাবি শতকরা ১৩ ভাগ বর্ধিত হয়, যার ভিতর চার শতাংশ ছিল জিজিয়া কর।
গোলকুণ্ডা এবং বিজাপুর উভয় রাজ্যেই ইরানি, আফগান এবং দক্ষিণী অভিজাতদের (রইস) উচ্চবর্গীয় মুঘলদের সঙ্গে সংযুক্তিকরণের চেষ্টা করা হচ্ছিল, অবশ্য তাদের পূর্বতন খেতাব অক্ষুণ্ণ রেখেই। উদাহরণস্বরূপ গোলকুণ্ডার ২৪ জন কুতুবশাহী রইসকে ১০০০ জাট বা ততোধিক মূল্যের মনসব দেওয়া হয়। কিছুকাল পরে অবশ্য এই সব সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গকে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ মহব্বত খানকে ৭০০০/৭০০০ মনসব দিয়ে হায়দরাবাদের রাজ্যপাল এবং হায়দরাবাদী কর্ণাটকের ফৌজদার ও দেওয়ান অথবা সেনাপতি এবং প্রশাসকের দায়িত্ব দেওয়া হলেও কিছুকাল পরেই তাকে লাহোরের প্রশাসক নিযুক্ত করা হয়। গোলকুণ্ডার আর-এক অভিজাত আলি আসকার খানকে অওয়া (অযোধ্যার)-এর রাজ্যপাল নিয়োগ করা হয়। তবে আরও গভীরতর সমীক্ষায় দেখা যায় যে যে-সমস্ত স্থানীয় প্রশাসক সংস্কৃতি ও কৃষ্টির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, এবং সকল প্রকার ক্ষমতা, আইন-কানুন ও অধিকারের উৎস ছিলেন তাদের স্থলে মুঘল প্রশাসকদের নিয়োগ করা হতে থাকল। এই মুঘল শাসকরা ছিলেন কঠোরতর এবং ব্যক্তিগত সম্পর্ক-বিচ্যুত রাজকীয় শাসন ব্যবস্থার প্রতীক। (জে. এফ. রিচার্ডস)। সেইজন্য জনসাধারণের মনোভাব কিন্তু পুরাতন গদিচ্যুত রাজাদের স্বপক্ষেই অক্ষুণ্ণ ছিল। এছাড়া গোলকুণ্ডাতে সকল ব্রাহ্মণকেই গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। দেশমুখদের পুরোনো অবস্থান অক্ষুণ্ণ থাকলেও তাদের কখনোই দরবারে আসতে বলা হত না। এছাড়া তাদের কোনো সরকারি পদ দেওয়া বন্ধ হল, এমনকি তাদের সৈন্যদেরও বারগির শ্রেণিভুক্ত করে রাজকীয় সৈন্যদলের অন্তর্ভুক্ত করে দেওয়া হল। এছাড়া বিভিন্ন রেড্ডী, ভালেমা ও ব্রাহ্মণ দেশমুখদের, দেশপাণ্ডে এবং মুনিয়ারদের ব্যবস্থা করা প্রয়াস শুরু হল। এই সব শ্রেণির হিন্দু অভিজাতগণ এবং তাদের। সেনাপতি বা নায়কেরা কিন্তু সচরাচর মারাঠাদের স্বপক্ষে যোগদান করেননি। নির্মমভাবে তাদের অর্থ ও সম্পদ শোষণ করা হতে লাগল, সে অর্থ কখনও গেল বাদশাহের রাজকোষে, আবার প্রায়শই স্থানীয় রাজকর্মচারীদের ব্যক্তিগত তহবিলে। এই শোষণ কার্য সম্পন্ন করার পরেই পুরোনো অবস্থানে তাদের আবার ফিরিয়ে দেওয়া হল। একমাত্র বেরাদের প্রধান পিদ্যা নায়ক ছাড়া অন্য কাউকেই না দেওয়া হয়েছিল মনসব, এমনকি চিরকালীন পরম্পরাকে অগ্রাহ্য করে তাদের রাজসভায় আমন্ত্রণ করাও বন্ধ করা হল।
বিজাপুর এবং কর্ণটক ব্যবস্থা করা অপেক্ষাকৃত অনেক কঠিন ছিল। শাহজীর সময় থেকে শুরু করে পরবর্তীকালে শিবাজির অভিযানের ফলে মারাঠারা ব্যাঙ্গালোর এবং তাঞ্জোরে নিজেদের ঘাঁটি গড়ে তুলে কোনো-কোনো শক্তিশালী স্থানীয় নায়কদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছিল।
রাজারাম জিনজিতে পদার্পণ করার পরে চারিদিক থেকেই প্রচুর সমর্থন ও সাহায্য পেতে থাকেন। তখন ঔরঙ্গজেব বাধ্য হয়েই ওয়াজির আসাদ-খানের পুত্র এবং শক্তিশালী অভিজাত জুলফিকার খানকে এই অবস্থার মুকাবিলা করার জন্য নিযুক্ত করলেন। ১০,০০০ অশ্ব এবং ১৫,০০০ রাজপুত সৈন্যের সহায়তায় জুলফিকার খান। কর্ণাটকের বিদ্রোহকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হলেন। কিন্তু জিনজিকে যথাযথভাবে অবরুদ্ধ করতে ব্যর্থকাম হলেন। ইতিমধ্যে মারাঠাদের প্রতিরোধ দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকল। ১৬৯২ সালে মারাঠারা রাজগড় এবং পানহুলা সমেত অনেকগুলো দুর্গই শুধু উদ্ধার করল না–তাদের দু’জন অগ্রণী সেনাধ্যক্ষ সান্তা ঘোরপাড়ে এবং ধানাজী যাদবের নেতৃত্বে কর্ণাটকের ৩০,০০০ অশ্বারোহী সেনা জিনজির উদ্ধার কল্পে প্রেরণ করল। এই দুই অকুতোভয় সেনাধ্যক্ষ কর্ণাটক এবং মহারাষ্ট্র অঞ্চলে মুঘলদের কপালের কাটা হয়ে দাঁড়ালেন। তারা বেশ কয়েকজন মুঘল সেনাপতিকে পরাস্ত করে পণবন্দি করে রাখলেন এবং বেশ কিছুকাল জুলফিকার আলি খান ও মুঘল দরবারের মধ্যকার যোগাযোগ বন্ধ করে দিলেন।
ঔরঙ্গজেবের সরাসরি বিজাপুর এবং গোলকুণ্ডা অধিকার করে নেওয়ার সিদ্ধান্তে চিন্তাশীল পরিদর্শক ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের মনে শাসক হিসাবে ঔরঙ্গজেবের বিচক্ষণতা এবং জ্ঞানের বিষয়ে যে সন্দেহ দেখা দেয় তার যথেষ্ট প্রমাণ আছে। তাই জিনজি এবং তৎপার্শ্বস্থ অঞ্চলগুলি দ্রুত অধিকার করে নেওয়ার বিষয়ে জুলফিকার আলির ব্যর্থতা দেখে গুজব ছড়াল যে জুলফিকার মারাঠাদের সঙ্গে এক গোপন চুক্তি করেছেন, তিনি শীঘ্রই দাক্ষিণাত্যে স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন এবং মারাঠারা অনতিবিলম্বে বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা জয় করে নেবে। এও জনরব শোনা গেল যে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর এইসব অঞ্চল পুনরায় আদিল শাহ ও কুতব শাহের হাতে তুলে দেওয়া হবে। প্রকৃতপক্ষে চারিপার্শ্বে যুদ্ধের থেকে ক্লান্তি এবং এইসব অঞ্চল–বিশেষ করে কর্ণাটক যে ঔরঙ্গজেবের নিকট বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নয় এই উপলব্ধি থেকেই লোকের মধ্যে এই গুজবগুলিই আত্মপ্রকাশ করে। এই কথাও মানুষের মনে ছাপ ফেলেছিল যে সমস্ত কিছু জয় করে নেবার উচ্চাশার পেছনে ছুটে ঔরঙ্গজেব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হন, তিনি মনসবদারের তাদের প্রাপ্য মিটিয়ে দিতে পারেননি এবং এমনকি কৃষক সম্প্রদায়কেও ভালোবাসতে ও রক্ষা করতে তিনি ব্যর্থ হন। এর ফলে দাক্ষিণাত্য-বিষয়ক সকল বিষয়েই অভিজাতদের মধ্যে দীর্ঘসূত্রিতা ও আগ্রহহীন ভাবে। কাজ করার প্রবণতা দেখা যায়।
১৬৯৮ সালে অপেক্ষা করার পর জুলফিকার আলি খান শেষ পর্যন্ত জিনজি জয় করতে সক্ষম হলেন। তবে তার প্রধান হাতিয়ার রাজারাম পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেন। তিনি সাতরায় ফিরে আসার পরেই কর্ণাটক সহ সমগ্র দাক্ষিণাত্যে মারাঠা সক্রিয়তা লক্ষণীয় ভাবে বৃদ্ধি পায়।
বিজাপুরেও অভিজাতদের মধ্যে দলাদলি এবং মারাঠাদের ধ্বংসলীলার জন্য শাসনব্যবস্থার বিশেষ অবনতি হয়। মারাঠারা এত সাহসী হয়ে উঠেছিল যে কোনো রইসই (অভিজাত) তাদের মুখোমুখি হবার সাহস দেখাতে পারেননি। এইভাবে সান্তা ঘোড়পাড়ে ইসমাইল খানকে পরাজিত ও বন্দি করেন। যাকে দাক্ষিণাত্যের সর্বাপেক্ষা সাহসী যুদ্ধবিদ বলে গণ্য করা হত। বিজাপুর আত্মসমর্পণের পর রুস্তম খান। উপাধিকারী শারজা খান বন্দি হলেন, তারপর আলি মর্দান খান, রুহুল্লা খান ইত্যাদিরা বন্দি হলেন। তারা প্রত্যেককেই অবশ্য প্রচুর মুক্তিপণ দিয়ে মুক্তি পান। রাজারাম সাতারায় প্রত্যাবর্তন করার সময়কালের মধ্যে মারাঠারা প্রাচীন বিজাপুর রাজ্যে বস্তুত একটি সমান্তরাল সরকার গড়ে তুলেছিল। সমসাময়িক নিরীক্ষক কাফি খানের বক্তব্যানুসারে মারাঠারা প্রতিটি জেলায় চৌথ আদায়ের জন্য একজন করে। কামাইশ-দার, বা সংগ্রহকারী নিয়োগ করেছিল। কোথাও জমিদার বা ফৌজদারের প্রতিরোধের জন্য কামাইশদারেরা চৌথ সংগ্রহ করতে না পারলে সুবাদার বা মারাঠা সেনানায়কেরা তাদের সাহায্যে ছুটে এসে অবাধ্য শহরটিকে অবরোধ ও ধ্বংস করত। এইভাবে সমস্ত বণিকদের থেকেই রাহদারী কর আদায় করা হত। প্রতি অঞ্চলেই মারাঠারা তাদের শক্তির কেন্দ্র হিসাবে কেল্লা গড়ে তুলত। মুকাদ্দাম বা গ্রামের প্রধানরা প্রায়ই মারাঠা সুবাদারদের সঙ্গে বন্দোবস্ত করে রাজার আধিকারিকদের সঙ্গে দরাদরি করে খাজনার অঙ্ক স্থির করত।
মারাঠাদের লুঠতরাজ কেবল দাক্ষিণাত্যেই বিস্তৃত হয়নি। ১৬৯৯ সালে তারা নর্মদা অতিক্রম করে উজ্জয়িনীকে তছনছ করে দেয়। অনতি বিলম্বেই তারা গুজরাটে প্রবেশ করে সুরাটের নিকট ঘোরাঘুরি করে ব্রোচ বা ভারুচকে লুণ্ঠন করে।
কিন্তু এতে দমে না গিয়ে ঔরঙ্গজেব মারাঠাদের চূর্ণ করার প্রতীক্ষায় অনড় রইলেন। তিনি গোলন্দাজ সেনাসহ দুটি চলমান বাহিনীর সৃষ্টি করেন। যাদের নেতা ছিলেন যথাক্রমে জুলফিকার আলি খান, গাজিউদ্দিন খান এবং ফিরজ জং। এরা মারাঠা অভিযানকে সীমিত রাখতে সক্ষম হন এবং ফিরজ জং-এর সঙ্গে এক চলমান। সংঘর্ষে সান্তা ঘোড়পাড়ে নিহত হন। এতে কিন্তু মূল অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয় না।
এর অল্পদিন পরেই ঔরঙ্গজেব সব ক’টি মারাঠা দুর্গই পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। ১৭০০ থেকে ১৭০৫ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ সাড়ে পাঁচ বছর ধরে ঔরঙ্গজেব তার পরিশ্রান্ত ও রোগাক্রান্ত দেহ নিয়ে এক দুর্গ থেকে আরেক দুর্গে আক্রমণ হানতে লাগলেন। মুঘল সৈন্যদল বন্যা, রোগব্যাধি এবং ঘুরে বেড়ানো বা বেদুইন মারাঠাদলের হাতে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হল। ক্রমে অভিজাত শ্রেণি ও মুঘল সৈন্যদলের মধ্যে অসন্তোষ ও ক্লান্তি বিপুল ক্রমাগতই বেড়ে চলল। নীতিভ্রংশতা ও হতাশাময় পরিবেশে বহু জায়গিরদার মারাঠাদের সঙ্গে চুক্তি করে তাদের জায়গির লুঠ না করার আশ্বাসের বিনিময়ে মারাঠাদের চৌথ দিতে রাজি হন।
এই দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে মুঘলদের প্রচুর ক্ষতি স্বীকার তো করতে হলই এমনকি শিবাজি প্রতিষ্ঠিত নবীন মারাঠা শক্তি ক্লান্ত হয়ে পড়ল। সেইজন্যই ১৬৯৫ ও ১৬৯৮ খ্রিস্টাব্দে দু’বার রাজারাম মুঘলদের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করার চেষ্টা করেন। ঔরঙ্গজেব অবশ্য এই আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। ১৭০০ সালে রাজারামের মৃত্যুর পর তার জ্যেষ্ঠা বিধবা তারাবাই ঔরঙ্গজেবকে এক শান্তি-প্রস্তাব দেন। তিনি রাজকীয় সেনাদলে ৫০০০ অশ্ব দিতে এবং সাতটি কেল্লা সমর্পণ করতে প্রস্তাব দেন। বিনিময়ে তিনি তার পুত্র দ্বিতীয় শিবাজিকে মারাঠা রাজার খেতাব, ৭০০০ মনসবের অধিকার এবং দাক্ষিণাত্যে সরদেশমুখী আদায় করার অধিকার দাবি করেন। এর পরেই তারাবাই স্বাধীনতা এবং চৌথের দাবিও প্রত্যাহার করেন।
ঔরঙ্গজেব তখনও মনে করতেন যে মারাঠাদের ধ্বংস করার তার সামর্থ্য আছে। কাফি খান বলছেন যে দুটি কিশোর বালক এবং এক অসহায় মহিলাকে পরাজিত করা কিছু কঠিন হবে না। এছাড়া তিনি শম্ভাজীর পুত্র শাহুর অধিকারও নস্যাৎ করতে চাননি। প্রকৃতপক্ষে ১৬৮৯ সাল থেকে শাহুকে রাজদরবারেই মানুষ করা হয়। তাই তিনি এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দাবি করেন যে সব ক’টি দুর্গই তাঁকে অর্পণ করা হোক।
১৭০৩ সালে ঔরঙ্গজেব মারাঠাদের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করেন। শম্ভাজীর পুত্র শাহুকে এখন তিনি মুক্তি দিতে সম্মত হলেন। শাহুর সঙ্গে বরাবরই ভালো ব্যবহার করা হয়েছিল। তাকে রাজা খেতাব দিয়ে ৭০০০/৭০০০ মনসব দেওয়া হয়। সাবালক হলে পরে সন্ত্রান্ত পরিবারে দুটি মারাঠা কন্যার সঙ্গে শাহুজীর বিবাহ সম্পন্ন হয়। ঔরঙ্গজেব শাহুজীর বিশেষ অবস্থানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে শিবাজির স্বরাজ্য প্রদান করতে এবং দাক্ষিণাত্যের উপর সরদেশমুখীর অধিকার দিতে প্রস্তুত হন। সত্তর-এর অধিক মারাঠা সর্দার শাহুজীকে আহ্বান করার জন্য একত্র হন। কিন্তু একেবারে শেষ মুহূর্তে ঔরঙ্গজেব এই ঘোষণা বাতিল করেন, কারণ মারাঠাদের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে তিনি সন্দিহান হয়ে উঠেছিলেন।
পরবর্তীকালে পারসিক সূত্র থেকে জানা যায় যে ঔরঙ্গজেব শাহজীকে শিবাজির স্বরাজ্য ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন এবং ছয়টি সুবার উপর সরদেশমুখীও মঞ্জুর করেছিলেন। তবে তিনি তাকে চৌথের অধিকার দিয়েছিলেন কিনা সে বিষয়ে কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। কিন্তু শাহুকে মারাঠারা নিয়ে চলে যেতে পারে এই সন্দেহে তিনি শেষ মুহূর্তে তার আদেশ প্রত্যাহার করেন।
১৭০৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই ঔরঙ্গজেব সব ক’টি মারাঠা দুর্গ অধিকারের চেষ্টার নিষ্ফলতার কথা উপলব্ধি করেন। তিনি ধীরে ধীরে ঔরঙ্গাবাদের অভিমুখে পশ্চাদপসরণ করেন। এবং খুশিতে উচ্ছল এক মারাঠা বাহিনী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মোগল সৈন্যদের উপর হামলা চালাতে থাকে।
১৭০৭ সালে ঔরঙ্গজেব ঔরঙ্গাবাদে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি ফেলে রেখে যান একটি বিক্ষিপ্ত সাম্রাজ্য–যেখানে বিভিন্ন সমস্যাগুলি তাদের চরমসীমার দিকে নিশ্চিতভাবে অগ্রসর হচ্ছিল।
ঔরঙ্গজেবের মূল্যায়ন এবং জায়গিরদারির সমস্যা
ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মুঘল সাম্রাজ্য ধ্বংসের দিকে অগ্রসর হয় এবং তার মৃত্যুর দুই দশকের মধ্যেই খণ্ড বিখণ্ড হয়ে যেতে থাকে। এ বিষয়ে ঔরঙ্গজেব কতটা দায়ী তা নিয়ে বহু তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। কারও মতে হিন্দুদের হাতে মুঘল সাম্রাজ্যের এই ধ্বংসলীলা প্রতিহত করতে ঔরঙ্গজেব বহু প্রয়াস করেছিলেন। এবং সাম্রাজ্যকে রক্ষা করার জন্য মুসলিমদের জোটবদ্ধ করার প্রয়াস পেয়েছিলেন। কিন্তু হিন্দু ও শিয়াদের অর্থাৎ মারাঠা এবং দক্ষিণী রাজ্যগুলির অধিপতিদের যৌথ প্রচেষ্টার সামনে তার সকল চেষ্টা ব্যর্থ হয়। অপরদিকে স্যার যদুনাথ সরকার ঔরঙ্গজেবকে একরোখা মহানাগের সঙ্গে তুলনা করেন, ‘যে নাগ সবকিছু গিলে খেতে খেতে শেষপর্যন্ত নিজের ওজনের চাপেই নিজেও ভেঙে যায়।’
তবে ঔরঙ্গজেবের গোঁড়ামি ও কঠোর ধর্মাচরণ যথা মুসলিমদের শরিয়ত আদিষ্ট জীবনধারাকে কঠোর ভাবে অনুশীলন করার বাধ্যবাধকতা, অ-মুসলমানেদের বিরুদ্ধে। নানা বিভেদমূলক নীতি অবলম্বন, এবং বহু সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পর উলেমাদের তার শক্তির স্তম্ভ গড়ে তোলার চেষ্টা ইত্যাদি যে ব্যর্থ হবে তাতে কোনো সন্দেহই ছিল না। ভারতের মতো এক বৃহৎ দেশকে কোনো সংকীর্ণ ধর্মীয় অনুশাসন দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। বিশেষত তা যদি দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠিত অভ্যাস এবং আচরণবিধির। বিরুদ্ধমুখী হয়। তাই ঔরঙ্গজেবের অনেক সংস্কারমূলক ব্যবস্থা, যথা মদ ও মাদক দ্রব্যগুলির নিষিদ্ধকরণ, এবং ভাঙ চাষের উপর নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি যতটা মানা হয়েছিল, তার থেকে ভঙ্গ করা হয় অনেক বেশি পরিমাণে। উদাহরণস্বরূপ বলতে গেলে ঔরঙ্গজেবের পছন্দের মানুষ কাজি আবদুল ওয়াহাবও গোপনে মদ্যপান করতেন। এছাড়া শাহজাদা ও রইস বা অভিজাত বর্গ ও ঔরঙ্গজেবের প্রবর্তিত কঠোর, কর্তব্য পরায়ণ, এবং আনন্দশূন্য জীবনধারাকে গ্রহণ করতে চাননি। ওয়াজির। এবং সর্বোচ্চ বেতনভোগী রাজকর্মচারী আসাদ খান এত আড়ম্বর বিলাসিতাপূর্ণ জীবনযাপন করতেন যে অষ্টাদশ শতকের মসির-উল-উমরা অজ্ঞাতদের এক বিশ্বস্ত। জীবনীকারের উদ্ধৃতি অনুসারে তার হারেমের অর্থাৎ বেগম মহলের ও গীতিবাদ্যকারেদের দরুন এত বিপুল পরিমাণ অর্থব্যয় হত যে তার সমগ্র রাজস্ব। দিয়েও তা মেটানো যেত না।
বাবর, আকবর, জাহাঙ্গির ইত্যাদি ঔরঙ্গজেবের পূর্বসূরিরা মঝেমধ্যে সামাজিক অনুষ্ঠানের বা মজলিশের আয়োজন করতেন। সেইসব আসরে থাকত সুরা, থাকত সংগীত। অভিজাতরা নিমন্ত্রিত হতেন এবং তাদের সঙ্গে মন্ত্রণা ও আলোচনাও হত সেইসব আসরে। এর বিপরীতে ঔরঙ্গজেব ছিলেন বন্ধু বিবর্জিত একাকী, শুদ্ধাচারী, এবং অনেক দূরের একজন মানুষ। কোনো সাধু বা ফকিরের পক্ষে হয়তো এই জীবনধারা যথাযথ হতে পারে। কিন্তু যাকে সর্বদা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যার জন্য আলোচনা এবং সকলের অংশগ্রহণ উভয়ই অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, তার জন্য এই কঠোর, নির্লিপ্ত জীবনপ্রণালী কখনোই সঠিক হতে পারে না। যথা, মাড়োয়ারের সমস্যা যখন তুঙ্গে উঠেছে, তখনও স্বয়ং রাজকীয় বকশি খান-ই-জাহানকে জোর করে গোসলখানা বা খাস কামরায় প্রবেশ করে তার প্রয়োজনীয় অভিমত জানাতে হয়। এবং এই ঔদ্ধত্যের জন্যও তাকে শাস্তিও দেওয়া হয়। সেইভাবেই তৎকালীন ঔরঙ্গজেবের প্রিয়তম পুত্র শাহজাদা শাহ আলম বিজাপুর ও গোলকুণ্ডার বিষয়ে তার মতামত বাদশাহকে জানাতে পারেননি, এবং সম্রাটের থেকে ভিন্ন মত পোষণের জন্য তাকে কারাবরণও করতে হয়।
ঔরঙ্গজেব উলেমা অর্থাৎ ধর্মগুরুদের ব্যবহার করে এবং তাদের সাহায্যে সব মুসলমানকে নিজের সমর্থনে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা আরও অসফল হয়। বস্তুত দেখা গেল যে উলেমারা দুনীর্তিগ্রস্ত ও লোভী, ঠিক যেমন জিজিয়ার আমিল পদে নিযুক্ত অনেক কাজির ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছিল। এমনকি শ্রদ্ধেয় কাজি আবদুল ওয়াহাবও তার মৃত্যুকালে নগদ দু’লক্ষ আশরাফি (স্বর্ণমুদ্রা) এবং পাঁচ লক্ষ টাকা ছাড়াও আরও অনেক মূল্যবান বস্তু রেখে গিয়েছিলেন।
কাফি খানের মতে ‘ঔরঙ্গজেব কাজিদের শাসননীতি এবং শাসনকার্যের খুঁটিনাটি সকল বিষয়ে এমন সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে গিয়েছিলেন, অর্থাৎ শাসনব্যবস্থার সব কর্তৃত্বই তাদের হাতে দিয়ে দিয়েছিলেন যে সাম্রাজ্যের অগ্রণী এবং দায়িত্বশীল আধিকারিকরা তাদের ঈর্ষা ও দ্বেষের দৃষ্টিতে দেখতেন।’ এইভাবে কাজি আবদুল ওয়াহাব গুজরাটি (কাজি–উল–কুজ্জত) এবং ক্ষমতাবান ও শক্তিশালী হয়ে ওঠেন যে সমস্ত নামকরা আমিররাই তাকে ভয় করে চলতেন। এই পরিপ্রেক্ষিতেই উল্লেখ করা যায় যে সত্তরের দশকে ঔরঙ্গজেব যখন মহব্বত খানকে এক সৈন্যবাহিনী দিয়ে শিবাজিকে ধ্বংস করতে পাঠাচ্ছিলেন তখন মহব্বত তাকে ব্যঙ্গ করে বলেন যে শিবাজির বিরুদ্ধে এত সৈন্যদল পাঠানোর কি দরকার যখন কাজির এক ফতোয়াতেই সব কাজ হয়ে যাবে। পরে ১৬৭৬ সালে মহব্বত খান তার দুঃখ ও বিস্ময় ব্যক্ত করে এক পত্রে ঔরঙ্গজেবকে লেখেন ‘বাদশাহের দক্ষ ও অভিজ্ঞ আধিকারিকদের সকল বিশ্বাস ও আস্থা থেকে বঞ্চিত করে রেখে ভণ্ড মায়াবাদী উলেমারদের ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করা হচ্ছে, যে উলেমারদের মগজে কিছুই নেই। মহব্বত খান আরও লেখেন যে এই ব্যক্তিরা আসলে রাজকর্তৃপক্ষকে জ্ঞান এবং আচার সহবত বিক্রি করছেন, যেহেতু তাদের উপর নির্ভর করা শরিয়া সঙ্গত নয়, এবং বাস্তব পরিস্থিতির পক্ষে কোনোভাবে উপযুক্তও নয়।
তবে একথা ভেবে বিস্ময় লাগে যে ঔরঙ্গজেব আকবরের সুলহ–ই–কুল পদ্ধতি বর্জন করলেও, আবার আকবরেই মতাদর্শে জাগতিক শক্তির সঙ্গে আধ্যাত্মিক শক্তিকে একত্রিত করতে চেয়েছিলেন। যে সতনামী সম্প্রদায় দাবি করত যে তারা অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার অধিকারী এবং কোনো অস্ত্রই তাদের ধ্বংস করতে পারবে না, তাদের পরাস্ত করার জন্য ঔরঙ্গজেব নিজ হাতে ইসলামি প্রার্থনার সূত্রগুলি লিখে এবং ইসলাম-ধর্মীয় প্রতীক চিহ্ন এঁকে সেগুলিকে তাদের বিরুদ্ধে যাত্রার সময় সকল রাজকীয় পতাকা ও চিহ্নের উপর সেলাই করে লাগিয়ে দেওয়ার আদেশ দেন। আবার ১৬৯৫-৯৬ সালে যখন ভীমা নদীতে সহসা জলোচ্ছাসে রাজকীয় শিবিরের সমূহ ক্ষতি হয়, তখন ঔরঙ্গজেব কাগজের উপর প্রার্থনাবাণী লিখে সেগুলিকে জলের ভিতর নিক্ষেপ করার আদেশ দেন। ভীম সেন বলছেন, ‘সঙ্গে সঙ্গেই জল নামতে শুরু করল। ঈশ্বর ভক্ত বাদশাহের প্রার্থনা ঈশ্বর গ্রহণ করেছেন এবং পৃথিবী আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠল।’ দিল্লির খ্যাতনামা সুফি সাধু শেখ কলিমুল্লাহ অভিযোগ করেন। যে, ‘সুলতানাত অর্থাৎ পার্থিব রাজকার্য এবং ফকিরি বা সাধুসন্তের আদর্শকে একসঙ্গে মিশ্রিত করার প্রচেষ্টা ঔরঙ্গজেবের এক বিশাল ভণ্ডামি এবং আত্মাভিমানের নিদর্শন।’
আকবর ও তৎকালীন অন্যান্য শাসকদের মতো ঔরঙ্গজেবও প্রয়োজনে শরিয়ার বিধিকে অগ্রাহ্য করে অন্য নীতি বা জাওয়াবিত প্রয়োগ করার অধিকার রাখতেন, যা ধর্মের উপর ভিত্তিশীল নয়। আবার শরিয়ার বিভিন্ন মতের মধ্যে কোনটি সঠিকভাবে প্রযোজ্য, তা স্থির করার অধিকারও তিনি গ্রহণ করেছিলেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ সাতারা অবরোধ-কালে দুর্গ থেকে আক্রমণকারী চারজন মুসলিম ও নয়জন মুসলমান সৈন্যকে গ্রেফতার করা হয়। শিবিরের কাজি প্রস্তাব দেন যে যদি হিন্দু সৈন্যরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে তাহলে তাদের মুক্তি দেওয়া হোক এবং মুসলিম সৈন্যদের তিন বৎসরকাল কারারুদ্ধ করা হোক। ঔরঙ্গজেব এই প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে কাজির দরখাস্তের উপর লিখে দেন যে, কাজি জানাফি মতবাদ ছাড়া অন্য আইনানুগ ব্যবস্থার প্রতিও যেন দৃষ্টি দেন যাতে করে সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ যেন খর্ব না হয়। বাদশাহের এই নির্দেশ মেনে কাজি রায় দেন যে হিন্দু ও মুসলিম উভয় ধর্মের যুদ্ধবন্দিদেরই প্রাণদণ্ড দেওয়া হোক যাতে করে এই ব্যবস্থা একটি দৃষ্টান্তস্বরূপ হয়ে ওঠে।
শরিয়াকে ধরে থাকলেও ঔরঙ্গজেব কিন্তু তাঁর তৈমুর বংশপরম্পরাকে কখনো অস্বীকার করেননি। তাই জীবনের শেষদিকে তিনি তাঁর পুত্রদের পত্রের মাধ্যমে তার পূর্বপুরুষ আকবর ও শাহজাহানের অনেক কাজকেই সমর্থন করে উল্লেখ করেন। এবং প্রায় আবুল ফজলের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করেই বলেন তোমার প্রজাদের সুরক্ষা প্রদান কিন্তু তোমাদের এই ভুবনে ও পরবর্তী ভুবনে আনন্দের ও সুখের প্রধান উৎস, তোমাদের একথা বোঝা উচিত। এই উপদেশের কোনো ছত্রেই কিন্তু তাদের ধর্ম রক্ষা করার কথা বলা হয়নি। অধার্মিকদের শাস্তিবিধানের কথা বলা হয়নি, অবিশ্বাসী বা কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার কথা বলা হয়নি। কিন্তু বলা হয়েছে কিছু প্রকৃতই প্রয়োজনীয় ও বাস্তবমুখী কর্তব্য সম্পাদন করে তবেই প্রকৃত ধর্মসাধন বলে তুলে ধরা।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে ঔরঙ্গজেব অতি জটিল চরিত্রের মানুষ ছিলেন। একদিকে তার গোঁড়া শরিয়ত-ভিত্তিক মনোভাব, অপরদিকে এক বহুধর্মভিত্তিক দেশে শাসকের কর্তব্য প্রতিপালনের সমভাবে কঠিন দায়িত্ববোধ।
ঔরঙ্গজেবকে একজন অক্লান্ত ও কঠোর প্রশাসক বলা হয়ে থাকে এমনকি তিনি স্বয়ং নিজেকে এবং তার কাজের লোকেদেরও রেহাই দিতেন না। কিন্তু ইউরোপের দ্বিতীয় ফিলিপের মতোই তার এই অধ্যবসায়ী ও পরিশ্রমী ব্যক্তিত্বের পশ্চাতে ছিল একজন কেরানি বা অধস্তন কর্মচারীর মানসিকতা। অন্তদৃষ্টি এবং বৃহৎ শক্তিসমূহ ও পারিপার্শ্বিককে উপলব্ধি করার মতো একজন সফল রাজনীতিকের মননশীলতা তার ছিল না। উদাহরণস্বরূপ মাড়োয়াড় সমস্যাটি সমাধানের প্রচেষ্টায় তিনি কোনো কৌশল বা দক্ষতা দেখাতে পারেননি। এবং তিনি স্বয়ং বা তার প্রশাসন এই ঘটনা থেকে কোনো সুবিধাই অর্জন করেননি। মারাঠা আন্দোলনের প্রকৃতিই তিনি বুঝতে পারেননি এবং বহু সুযোগ থাকলেও শিবাজি বা তার উত্তরাধিকারীদের সঙ্গে কোনো বোঝাপড়ায় আসতে পারেননি। অবিশ্বাসী কাফের শিবাজির বিরুদ্ধে দাক্ষিণাত্যের মুসলিম রাজ্যগুলিকে ব্যবহার করার তাঁর চিন্তা এক আলেয়ার মতো অলীক প্রতিপন্ন। হয়। আবার অবশেষে মোহভঙ্গ হলে তিনি দুই দক্ষিণী রাজত্বকে সরাসরি অধিকার করে নেবার সিদ্ধান্ত নেন। এর বিরুদ্ধে বহু অভিজাত পারিষদ এমনকি শাহ আলমের পরামর্শ ও ইচ্ছাও তিনি অগ্রাহ্য করেন। দক্ষিণ ভারতের এই অন্তহীন যুদ্ধের ফলে মুঘল প্রশাসনের সকল প্রকার অভ্যন্তরীণ দুর্বলতাই প্রকাশ হয়ে পড়ে।
জায়গিরদারি সংকট
জায়গিরদারি সমস্যার একটি প্রশাসনিক এবং একটি সামাজিক কারণ ছিল। এই প্রথার সফলতার মূল কথা ছিল জায়গিরদারের পর্যাপ্ত অর্থের সংকুলান। যাতে করে তিনি যে মানের জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত, বা যে জীবনধারা তার মেনে চলা উচিত তা তিনি। বজায় রাখতে বা যে জীবনধারা তার মেনে চলা উচিত তা তিনি বজায় রাখতে পারেন। এবং দ্বিতীয়ত তার রাজ্যের সহায়তার জন্য যথেষ্ট সংখ্যায় সৈন্য নিয়োগ করতে পারেন। জায়গিরদারি প্রথার মূলকথা ছিল জায়গির বা অভিজাতদের তাদের জায়গিরের মধ্যে যে সব জমিদারি ছিল তার ভূমি রাজস্ব সংগ্রহের কায়েমি স্বার্থ। তাহলে জমা (নিরূপিত রাজস্ব) এবং হাসিল (আয়)-এর সামঞ্জস্য কেবল ওই রাজস্ব সংগ্রহের ব্যবস্থাপনা এবং রাজস্ব আয় করার পদ্ধতির প্রকৃতির উপর নির্ভর করে না। প্রয়োজনে ফৌজদারের সাহায্য নিয়ে জমিদারদের এই রাজস্ব দিতে বাধ্য করতেও হয়। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন যে ওই জমিদারেরা সাধারণত সশস্ত্র হত এবং জমির কৃষিজীবী মালিকদের সঙ্গে জমিদারদের প্রায়ই বর্ণভিত্তিক সম্পর্ক বা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল।
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে জায়গির প্রথা দেশে তৎকালীন সমাজ-ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল ছিল। মুঘলেরা মোটামুটি ভাবে, এবং বিভিন্ন কারণবশত উত্তর ভারতের বেশিরভাগ জমিদারদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিরূপিত রাজস্ব আদায় করতে পারত, অবশ্য বহু দূর এবং অগম্যস্থানের ভূস্বামী ব্যতিরেকে। প্রকৃতপক্ষে ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় তারা। পেশকাশ (পেশকাশ দর্শনবৃত্তি। মানে জমিদার এলে তাকে অর্পণ করা হয়) গ্রহীতা জমিদার থেকে খারাজ অর্থাৎ খাজনা আদায়কারী কর্মচারীতে পরিণত হতে থাকে, যখন তারা নানকার হিসাবে উৎপন্ন দ্রব্যের এক ভাগেরও অধিকারী হয়। এ ছাড়াও মনসবদারদের সংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে মাঝে মাঝে মনসবদার এবং তাদের সঙ্গীসাথীদের বেতনের প্রয়োজন এবং সংগৃহীত অর্থ সম্পদের মধ্যে ব্যবধান থাকত। এই অবস্থায় কখনো বেতন কমিয়ে এবং এবং কখনো মনসবদারের প্রয়োজনে সৈন্য এবং ঘোড়ার সংখ্যা হ্রাস করে এই অবস্থার সামাল দেওয়া এত। এর থেকে এও প্রতিপন্ন হয় যে স্থানীয় জমিদারের প্রয়োজনে ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের জন্য মনসবদারদের ফৌজদারের উপর আরও বেশি নির্ভর করতে হত।
দাক্ষিণাত্যে এই পদ্ধতি আরোপ করার অসুবিধা ছিল, দক্ষিণদেশে অবস্থা ছিল একেবারে ভিন্ন। সেখানে অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই থাকত এবং জমিদারেরা এই অবস্থাটি নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে প্রস্তুত ছিল; জায়গিরদারি ব্যবস্থার এইখানে এটিই ছিল প্রধান বাধা। ভীম সেন যিনি তখন দাক্ষিণাত্যে ছিলেন, তিনি এইরকম বলছেন–মনসবদারদের তনখাওয়া বা বেতনের পরিবর্তে যেসব অঞ্চলের অধিকার দেওয়া হয়েছিল সেগুলি তাদের শাসন করার ক্ষমতা ছিল না। কেননা তাদের সৈন্যবল ছিল অত্যন্ত কম। জমিদাররাও ক্রমশ শক্তিসঞ্চয় করে। সশস্ত্র বাহিনী মারাঠাদের সঙ্গে সন্ধি করে এবং সশস্ত্র বাহিনী বা জামিয়াত নিয়োগ করে দেশে অত্যাচার চালাচ্ছিল। সবশেষে তিনি বলছেন ‘জমিদারদের এত প্রতিপত্তির জন্য জায়গিরদারদের হাতে একটি দাম বা দিরহামও, অর্থাৎ কোনো টাকা-পয়সা বা রাজস্ব পৌঁছোনো সম্ভব ছিল না।
জায়গিরদার ও ফৌজদারদের সৈন্যবলের স্বল্পতা সম্বন্ধে ভীম সেন বলছেন যে ঔরঙ্গজেবের রাজত্বের শেষ দিকে একমাত্র মির্জা রাজা জয় সিংহ-এর পৌত্র জয় সিংহ কাছছায়া এবং রাম সিংহ হাদা ও দলপত বুন্দেলার নিজস্ব ওয়াতন বা সৈন্যদল ছিল। বাকি কোনো মনসবদারেরই ১০০০-এর অধিক অশ্বারোহীর ব্যবস্থা করতে পারতেন না। ভীমসেন আরও বলছেন যে প্রত্যেক জেলায় দুষ্কৃতীকারীরা ছোটোখাটো। ফৌজদারদের পরোয়া না করেই নিজেরা শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। আবার ফৌজদারেরাও চতুর্দিকে ঘুরে ঘুরে কাজ করার শারীরিক ক্রেশ ও অর্থব্যয়ের জন্য হতোদ্যম হয়ে সিদ্ধান্ত নিলে যে এর থেকে এক জায়গায় আরামে বসে শত্রুদের অর্থাৎ মারাঠাদের সঙ্গে চুক্তি করে নেওয়াই সুবিধাজনক।আসবার ওয়াকিল লিখছেন যে এমনকি সাতহাজারি মনসবদারগণও কোনোক্রমে মাত্র ৭০০ জনের ফৌজ বজায় রাখতে পারত। আবার ফৌজদারেরা এই প্রকার অকর্মণ্য হয়ে পড়ায় রাজপুত্র বা শাহজাদারাই ফৌজদারদের মতো দেশের সর্বত্র ঘুরে ঘুরে বেড়াতে থাকত।
দেশের প্রচলিত শাসনব্যবস্থার জন্য অবস্থার আরও অবনতি হয়। যে জায়গিরগুলি থেকে সর্বাধিক রাজস্ব আদায় হত (সায়র হাসিল) সেগুলিকে যুদ্ধের খরচ বহন করার জন্য পৃথক করে রাখা হত। এর ফলে জায়গিরদারদের জোর তালাব অঞ্চলে, অর্থাৎ যেখানে জমিদারদের এবং ভূমির অধিকারীদের ক্ষমতার জন্য রাজস্ব আদায় করা খুবই । কঠিন জায়গির দেওয়া হত সেখানেই। এগুলি সাধারণত গোলকুণ্ডা ও বিজাপুরের রাজ্যসীমার বাইরেই হত। জায়গিরদাররা যথোপযুক্ত সংখ্যায় ও উপযুক্ত গুণমানের অশ্বারোহী ও অশ্ব পরিদর্শনের সময় দেখাতে না পারলে তাদের জায়গির বাজেয়াপ্ত করে পাই বাকী, বা পুনর্নিয়োগের জন্য আলাদা করে রাখা হত।
মনসবদারের জন্য তাহলে সাইর হাসিল জায়গির-এর লড়াইটি এক জীবনমরণ সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। এর ফলে রাজকীয় মুৎসুদ্দিরা বোরকমের ভ্রষ্টাচারের ও অসাধুতার সুযোগ পেল, যথা ঘন-ঘন বদল। ছোটো ছোটো মনসবদারেরাই এরজন্য সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বে-জায়গিরি বা পর্যাপ্ত পরিমাণ নিরূপণের যোগ্য জায়গির না থাকায় জায়গিরদারি পদ্ধতির অব্যবস্থা আরও অনেক বেড়ে গেল। কাফি খান লিখছেন যে একদিকে যেমন পাই বাকী অর্থাৎ জায়গিরের জন্য দেবার জমির স্বল্পতা, আবার। অপরদিকে বহুসংখ্যক প্রধানত দক্ষিণী ও মারাঠি সম্প্রদায়ভুক্ত মনসবদারদের নিয়োগ। এর ফলে বহু অভিজাতদের পুত্র বা খানজাদারা চার থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করেও জায়গির হাতে পাননি। এই ঘটনাকাল ১৬৯১-৯২। অবস্থা কিন্তু এই সময় আরও খারাপ দিকে যায়। কেননা গোলকুণ্ডা ও বিজাপুর জয়ের পর সম্পদের স্বল্পতার জন্য ঔরঙ্গজেব নির্দেশ দেন মনসবদারেদের সংখ্যা যেন কখনোই উপলব্ধ সম্পদের থেকে বেশি না হয়। প্রকৃতপক্ষে নতুন করে কোনো অভিজাতকে নিয়োগ করায় ঔরঙ্গজেব নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। বাদশাহ বারবার ঘোষণা করেন যে তার আর কোনো নতুন ভৃত্যের প্রয়োজন নেই। এবং তার কাছে কোনো নিয়োগপত্র না এলেই তিনি খুশি হবেন। কিছুদিন ধরেই রাজকীয় বকশি বা সচিব রুহুল্লা খান অন্যান্য অভিজাত খানদের চাপে পড়ে বাদশাহের সামনে নতুন নাম পাঠাতেন। তার যুক্তি ছিল যে বাদশাহের অধীনে সাতটি সুলতানাত আছে, অর্থাৎ দাক্ষিণাত্যের পাঁচজন সুলতান এবং মালওয়া ও গুজরাটের সুলতানদের ধরে। এই বিশাল সাম্রাজ্যের বহু-সংখ্যক দুঃস্থ খানেদের (খানাজাদ) কথা বিবেচনা করা হবে, সে সিদ্ধান্ত একমাত্র স্বয়ং বাদশাহই নিতে পারেন। ১৬৯২ সাল রুহুল্লা খানের মৃত্যুর পর ঔরঙ্গজেব নূতন বকশি (সচিব) মুখলিস খান-এর পাঠানো সবক’টি আবেদনই ক্রুদ্ধ হয়ে ফেরত দেন। কাফি খান বলেন এরজন্য শিবিরে প্রচণ্ড অসন্তোষ দেখা দিল। বিশেষ করে তাদের মধ্যে, যারা বাদশাহের দর্শনের জন্য বহু বৎসর অপেক্ষা করে ছিলেন। তাই জায়গির মঞ্জুর করে বাদশাহের একটি দস্তখত পাওয়া একশত অসুস্থ লোকের মধ্যে একটি মাত্র ডালিম দেওয়ার মতো।
এ বিষয়ে আর অধিক তথ্য পরিবেশন অপ্রয়োজনীয়। এই জায়গিরদারি প্রণালীতে অনেক ভুল ভ্রান্তি ছিল। বিশেষ করে ছোটো ছোটো মনসবদারদের ঘন-ঘন বদলি, নতুন জায়গিরদার বা প্রতিনিধির থেকে জায়গিরটি অর্পণ করার আগে থোক টাকা দাবি করা (কবজ)। আবার জায়গির হাতে পাওয়ার আগেই বাদশাহের পশুগুলির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অর্থ দাবি করা ইত্যাদি। আবার যারা পুরুষানুক্রমে বাদশাহের। সেবা করে এসেছে, এবং যাদের বিশ্বস্ততা এবং সমর্থন রাজ্যের পক্ষে অতি প্রয়োজনীয় ছিল সেই খানাজাদাদের আশা পূরণ করতে না পারলে কিন্তু অন্য ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করত। পুরাতন বিশ্বস্ত অভিজাতদের রাজানুগত্যকে এভাবে ছোটো করা হত এবং এর ফলে তারা অন্যত্র নিজেদের প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করত। ওয়াজির, আসাদ খান ও তার পুত্র জুলফিকার আলি খান এবং অগ্রণী অভিজাত গাজিউদ্দিন ফিরূজ জঙ্গ এই ধরনের উচ্চাশা পোষণ করতেন বলে সন্দেহ করা হয়।
তবে এই যুক্তিও অনেকে দেন যে জায়গিরদারি ব্যবস্থার আসলে কোনো সমস্যা ছিল না। কেননা দাক্ষিণাত্যের দুই সুলতানের রাজত্ব অধিকার করে নেওয়ার ফলে সাম্রাজ্যের জমা’ শতকরা ২৩ ভাগ বা বার্ষিক ৫.৩ কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়েছিল অথচ মনসবদের সংখ্যা সীমার মধ্যেই রেখে দেওয়া হয়েছিল। আবার ১৬৮৯ সালের মুঘল রাজস্বের খতিয়ান দেখে অনেকে বলেন যা পাই বাকীরা (বা পত্তনীযোগ্য জমির) কোনো অভাব ছিল না তবে এবিষয়ে দুটি কথা স্মরণে রাখা প্রয়োজন। প্রথমত আকবরের সময় থেকেই দাক্ষিণাত্যের জমার পরিমাণকে বহুগুণ বর্ধিত করে দেখানো হত। খানেরা তাই তাদের দাবির বিনিময়ে যা পেতেন তা কিন্তু প্রকৃত রাজস্ব বা হাসিলের এক-ভগ্নাংশ মাত্র। এর ফলে আরও লাভসম্পন্ন সাইর হাসিল জায়গির পাওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। পরবর্তীকালের কাগজপত্র থেকে এও দেখা যায় পাই বাকী হিসাবে বৃহৎ ভূমিখণ্ডকে ভবিষ্যৎ লগ্নির জন্য রেখে দেওয়া হয়। তবে বেশিরভাগ পাই বাকী ভূমিই ছিল কর্ণাটকে যা তখনও নিয়ন্ত্রণে আনা হয়নি। এই জায়গাগুলিকে বলা হত মুলক-ই জাদিদ অথবা সদ্য জয়করা অঞ্চল, এই অভিজাত খানরা এই অঞ্চলে জায়গির স্বীকার করতে চাননি। সুতরাং এই অঞ্চলে প্রচুর পাই বাকী জমি থাকলেও তা দিয়ে অন্যত্র জায়গির-এর যে ঘাটতি–তা কোনোভাবে পূরণ করা সম্ভব হয়নি।
ঔরঙ্গজেবের অধীনে মনসবদারদের সংখ্যা কতটা বৃদ্ধি হয়েছিল সে নিয়ে কিন্তু প্রচুর ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। লাহোরির দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায় যে শাহজাহানের শাসনকালে বিংশতি বছরে (বা বিশতম বছরে) ৮০০০ মনসবদার এবং ৭০০০ আহাদী এবং অশ্বারোহী গোলন্দাজ ছিলেন। সম্ভবত বিজাপুর ও গোলকুণ্ডার অধিকারে পূর্বে প্রস্তুত একটি দলিল থেকে ১৪,৪৮৯ জনের হিসাবে পাওয়া যায় যাদের মধ্যে ৭৪৫৭ জন নগদ বেতন পেতেন এবং ৬৯৯২ জন ছিলেন জায়গিরদার। এই সংখ্যাগুলি থেকে বোঝা যায় যে এই সময়ে জায়গিরদারদের সংখ্যার কোনো বৃদ্ধি হয়নি।
যদিও শাহজাহানের রাজত্বকালের ইতিহাস আমরা পাই, ঔরঙ্গজেবের শাসন কালের ১০ বৎসরের পর আর তার কোনো ইতিহাস সরকারিভাবে পাওয়া যায়নি। এবং সেই জন্য তার সময় ঠিক কতজন মনসবদার ছিলেন তা বলা কঠিন। যাই হোক, বেশ খুঁটিনাটি বিচার করে আথার আলি দেখিয়েছেন যে ১০০০ জাঠ বা তদুর্ধ্ব। সম্পদের অধিকারী মনসবদারদের সংখ্যা নিম্নলিখিতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
শাহজাহান – ১৬২৮-৫৮ – ৪৩৭জন
ঔরঙ্গজেব – ১৬৫৮-৭৮ – ৪৮৬ জন
১৬৭৯-১৭০৭ – ৫৭৫ জন
সুতরাং ঔরঙ্গজেবের সমগ্র শাসনকালে মসনবদারদের সংখ্যার মাত্র ৩১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। আথার আলি আরও দেখিয়েছেন ‘পদমর্যাদা বা মনসবদারি বৃদ্ধির সংখ্যা ১৫৯৫ এবং ১৬৫৬ ও ৫৭ সময়কালে যা হয়েছিল সেই অনুপাতে কিছুই নয়। সেই সময় ৫০০ জাঠ বা ততোধিক মনসবদারের সংখ্যা ৪.২ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল, যা সেই সময়কার রাজ্য বিস্তারের অনুপাত থেকে বহুগুণ বেশি।’ তিনি এই কথা বলে শেষ করছেন যে এই কথাটাই বলা যায় যে তার পূর্বসূরিদের থেকে অনেক বেশি শক্তি দিয়ে ঔরঙ্গজেব উচ্চতর মনসব দেওয়ার চাপকে প্রতিহত করতে পেরেছিলেন। যে শাসনব্যবস্থা তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন, সেটিকে ঔরঙ্গজেব যথাসম্ভব দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করেছিলেন। কিন্তু তার ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মতবাদ ও নীতি সমগ্র শাসনব্যবস্থার উপরেই এক তুমুল চাপ সৃষ্টি করেছিল। এ ছাড়া শাসনব্যবস্থা ও সামরিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যে নতুন নতুন সমস্যাগুলির সৃষ্টি হচ্ছিল, তিনি সেগুলোর সমাধানের কোনো চেষ্টা করেননি।
জাহাঙ্গির ও শাহজাহানের শাসন কালের পর্যালোচনা করার সময় আমরা দেখি যে চৌথ এবং মাসিক রাজস্বনীতির সূত্রপাতের সঙ্গে সঙ্গে মুঘল মনসবদারি ব্যবস্থা আর আগের মতো সুদক্ষ ও সুনিয়ন্ত্রিত ছিল না। অন্যত্র সামরিক ব্যবস্থার উন্নতিকরণের সঙ্গে সঙ্গে আরও শক্তিশালী ও সুদক্ষ ময়দানি গোলন্দাজ বাহিনীর প্রয়োজন অনুভূত হল। আরও বোঝা গেল যে পদাতিকদের চকমকি দিয়ে জ্বালানো। বন্দুকের ব্যবহার করা অত্যন্ত প্রয়োজন। এরজন্য আবার আরও বৃহত্তর ও কেন্দ্রশাসিত স্থায়ী সৈন্যদলের প্রয়োজন ছিল। বহুসংখ্যক মারাঠি দুর্গ দখল করার পরিচালনা রূপায়ণের জন্য প্রচুর পদাতিক সৈন্যের দরকার ছিল। কিন্তু অভিজাত বা খানেদের ছিল প্রধানত গোলন্দাজ বাহিনী। সমসাময়িক ঐতিহাসিক ভীম সেনের লেখায় সৈন্যদলের ক্লেশকর জীবনযাত্রা এবং অভিজাতদের ক্রমবর্ধমান অসন্তোষের অনুপুঙ্খ বর্ণনা আছে।
তাহলে এই জায়গিরদারির সমস্যা কিন্তু তৎকালীন ক্রমবর্ধমান সামাজিক ও প্রশাসনিক সংকটের এক অংশবিশেষ যে সংকটের মূলে ছিল দাক্ষিণাত্যের দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ যার থেকে বাদশাহের কোনোপ্রকার লাভই হয়নি। ঔরঙ্গজেবের চরিত্রের অনমনীয়তা, তার উদ্ধত এবং সন্দেহাকুল স্বভাব, এবং অতি কঠিন রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের জন্যও একমাত্র সামরিক বাহিনীর উপর আস্থা স্থাপন, প্রভৃতি দাক্ষিণাত্যের এই নিষ্ফল, ব্যয়সাধ্য এবং ক্ষতিকর যুদ্ধপ্রক্রিয়ার এই ছিল মূল কারণ।
কৃষিক্ষেত্র সম্বন্ধীয় সমস্যা
কেউ কেউ বলেছেন যে প্রশাসন অর্থনৈতিক চাপ বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে কৃষি-সম্পর্কিত সমস্যাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফরাসি পর্যটক বারনিয়ের শাজাহানের। রাজত্বর শেষকালে ভারতে অবস্থান করছিলেন এবং তাঁর মতে তখন কৃষকদের উপর শোষণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে তাদের অনেকেই পার্শ্ববর্তী রাজাদের ভূখণ্ডে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। সমগ্র জমির অধিকারী মোঘলদের মাত্রাতিরিক্ত খাজনার নন্সির জন্য এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল এবং পুরুষানুক্রমে স্বত্বভোগী এমন কোনো খানদানি অভিজাত পরিবার ছিলেন না যাঁরা এই রাজকীয় স্বৈরাচারকে প্রতিরোধ করতে পারেন।
অনেক আধুনিক ঐতিহাসিক বানিয়েরের সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করেই তাদের মতবাদ রচনা করেছিলেন। কিন্তু একথাও বলা হয়েছে যে ভারতের গ্রামীণ পরিস্থিতি সম্বন্ধে বানিয়েরের কোনো বাস্তব ধারণা ছিল না এবং তার প্রতিবেদনগুলি মূলত ফ্রান্সে সাড়া জাগানোর উদ্দেশ্যেই রচিত। রাজস্থানে বংশানুক্রমিক (খানদানি) অভিজাত বংশের কিছু মানুষ অবশ্যই ছিলেন কিন্তু তারা কৃষিজ উন্নয়ন নিয়ে আদৌ চিন্তিত ছিলেন বলে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এই বিষয়টি বরঞ্চ জায়গিরদারদেরই আওতায় ছিল এবং স্থানান্তরে বদলি হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকলেও কিছুটা রাজার চাপে এবং কিছুটা নিজেদের সুবিধার জন্য তারাই কৃষিকার্যের বিস্তার এবং উন্নয়নের জন্য চেষ্টা করতেন।
আবার মোগলরাই সমগ্ৰ জমির অধিকারী বলে বানিয়েরের ধারণাও ভুল ছিল। আসলে তখন জমি কেনা-বেচার অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে। আবুল ফজল পরিষ্কার বলেছেন যে স্বকর্ষিত ভূমির মালিককেই বলা হত মালিক-ই-জমিন বা তার নিজ-কর্ষিত জমির অধিকারী এবং তিনি ইচ্ছে করলে ভবিষ্যৎ বংশধরদের এই জমি উত্তরাধিকার সূত্রেও দিয়ে যেতে পারতেন, বা কুটুম্বিতার মাধ্যমেও জমির হস্তান্তর করতে পারতেন। তবে কুটুম্বিতা বা সামাজিক সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে অন্যকে জমি প্রদান করতে গেলে গ্রামের প্রধানদের অনুমতির প্রয়োজন ছিল। শহরাঞ্চলে গৃহ নির্মাণের জন্যও জমি ক্রয় করা যেত।
দুর্ভিক্ষ ও স্থানীয় প্রশাসনের অত্যাচারের জন্য অনেকে গৃহত্যাগ করতে বাধ্য হত। এছাড়া কৃষিজীবী মানুষ অনবরতই উন্নততর অবস্থার আশায় এক জমিদারি থেকে অন্য জমিদারিতে যাতায়াত করত। এই ধরনের কৃষিজীবীদের পাহি বলা হত। তবে সতেরোশো শতকে এই পাহিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল কিনা তা সঠিক বলা যায় না। রাজস্থান এবং মহারাষ্ট্রের যে সকল অংশ স্বায়ত্তশাসনভোগী রাজাদের অধিকারে ছিল সেখানকার জমির খাজনা বা রাজস্বের চাহিদা মুঘলদের রাজস্বের দাবির সমপরিমাণই ছিল।
তবে ব্যক্তিগত ভাবে কোনো কোনো জায়গিরদার বা রাজকর্মচারী অতিরিক্ত রাজস্বের লোভে কৃষকদের উপর যে অত্যাচার করত না তা কিন্তু নয়। যদিও এই ধরনের ঘটনা নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারি ব্যবস্থা ও বলবৎ ছিল। তাই আমরা লক্ষ করেছি আগ্রা-মথুরা অঞ্চলের জাঠেদের মধ্যে এবং নাগোরের সতনাম শ্রেণির কৃষকদের মধ্যে কিছু কৃষিজনিত অত্যাচারের অভিযোগ পাওয়া যায়। তবে একে দেশব্যাপী এমন কোনো কৃষি-সম্পর্কিত সমস্যা বলা যায় না। যার জন্য সর্বতোভাবে কৃষিকর্মের অবনতি হয়েছিল। সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে সতেরোশো। শতাব্দীতে উত্তর ভারতে মোট কৃষিজমির পরিমাণ ০.২৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। কর্ষিত জমির আয়তনের এই বৃদ্ধি কিন্তু ১৬০১-১৮৭১ পর্যন্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের ২১% থেকে বেশি। এই তথ্যটিও কৃষিজ সংকটের অভিযোগটিকে সম্পূর্ণ খারিজ করে দেয়। তবে কৃষিক্ষেত্রে নূতন প্রযুক্তি উদ্ভাবন না হওয়ার জন্যই সম্ভবত কৃষিজ উৎপাদনের হারের স্বল্পতা পরিলক্ষিত হয়।
সাম্রাজ্যের ঘনায়মান সংকটের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণসমূহ
আগেই বলা হয়েছে সতেরো এবং আঠারো শতাব্দীতে তিনটি প্রসিদ্ধ এশীয় সাম্রাজ্য, যথা সাফাভিদ, মুঘল এবং অটোমান প্রায় একই সঙ্গে পতনের সম্মুখীন হয়। যদিও প্রত্যেক ক্ষেত্রেই এই অবক্ষয়ের কিছু কিছু নির্দিষ্ট কারণ বর্তমান, কিন্তু সাধারণ ভাবে কয়েকটি মাত্র কারণই সকলের পক্ষেই সমভাবে প্রযোজ্য। যথা মাথাভারী’ শাসন ব্যবস্থা, গভীর ভাবে যাজক বা ধর্মগুরু নিয়ন্ত্রিত সমাজ ব্যবস্থা এবং অত্যন্ত সংকীর্ণ সামাজিক ভিত্তি-সম্পন্ন শাসকশ্রেণি যারা ছিলেন পৃথিবীর অন্যত্র বিকাশহীন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঙ্গে একেবারেই সম্পর্কহীন। এছাড়া অভিজাতদের বিলাসবহুল জীবন-যাত্রার সঙ্গে এক বৃহৎ জনসংখ্যার শোচনীয় দুরবস্থার মধ্যে জীবনযাপনের কঠোর পার্থক্যের কথা ইউরোপীয় পর্যটকেরা সকলেই উল্লেখ করেছেন। ভারতবর্ষ সম্বন্ধে বলা হয়েছে যে ১৫৯৫ সালে ৫০০ জাট এবং তদুর্ধ সম্পদের অধিকারী ১২২ জন মনসবদারের বেতনের মোট পরিমাণ সমগ্র সাম্রাজ্যের রাজস্বের অর্ধেকেরও বেশি ছিল।
এছাড়া আরও কিছু কিছু বিশেষ বৈষম্যের জন্য অভিজাত শাসকশ্রেণি ও সাধারণ মানুষের মধ্যেকার পার্থক্য আরও বেড়ে গিয়েছিল। হিন্দু ও মুসলিম উভয় শ্রেণির চিন্তাশীলদের মধ্যে এক গভীর বিশ্বাস ছিল যে নিম্নবর্গে জাত কোনো কোনো শ্রেণির মানুষদের তাদের জন্মগত সীমারেখার মধ্যেই আবদ্ধ থাকা উচিত, নয়তো সামাজিক স্থিতি বিঘ্নিত হতে পারে। এই মনোভাবের জন্য অবশ্য সামাজিক অভিজাত শ্রেণির দরজা সকলের জন্য বন্ধ হয়ে যায়নি, তবে প্রবেশ হয়ে উঠেছিল নিয়ন্ত্রিত। মুঘলরা তাদের কর্মক্ষেত্রে হিন্দুদেরও নিয়োগ করতেন। যেমন ক্ষত্রিয়, কায়স্থ এবং কয়েকজন ব্রাহ্মণকেও রাজকর্মচারী হিসাবে নিযুক্ত করে তাদের কারোকে উচ্চ পদমর্যাদায় উন্নীত করা হয়। কিন্তু নিম্নবর্গের কাউকে তারা কর্মচারী হিসাবে গ্রহণ করেননি। মুঘলরা কেবল ব্যবসায়ী বা বানিয়াদেরই যে, অপছন্দ করতেন তা নয় এছাড়া তারা কারিগর সম্প্রদায় ও কৃষিজীবী শ্রেণির মানুষদেরও পছন্দের মধ্যে আনতেন না। তবে এর মধ্যে ব্যতিক্রম বলতে রাজপুত শেখজাদা ও আফগানদের কথা উল্লেখ করা যায়। শিবাজিকে এক সাধারণ ভূঁইয়া বলে যে অপমান করা হয়েছিল, তাও এই মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। পরে অনেক মারাঠা সরদারদের উচ্চমনসব দেওয়া হলেও তাদের কখনই সামাজিক ভাবে সমকক্ষ ভাবা হয়নি এবং বিশ্বাসভাজন ও ক্ষমতাসম্পন্ন কোনো কাজে তাদের নিয়োগও করা হয়নি।
মুঘলদের এই সংকীর্ণ সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্যই তারা পাশ্চাত্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতির দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে রেখেছিলেন। এর একটি অন্যতম কারণ এই ছিল মুঘলেরা ইউরোপীয়দের সমুদ্র পথে আধিপত্য থেকে কোনোপ্রকার। চিন্তারই কারণ খুঁজে পায়নি। তারা ভেবেছিলেন যে বিভিন্ন ইউরোপীয় সংস্থার পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে কাজে লাগিয়ে এবং স্থলপথে স্বীয় কর্তৃত্ব বজায় রেখে তারা নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে এবং বণিকদের স্বার্থ রক্ষা করতে সক্ষম হবে। এর জন্য তাদের নতুন করে নৌবহর সৃষ্টি করার ব্যয় নির্বাহ করতে হবে না। অটোমানরা এক শক্তিশালী নৌবহর সৃষ্টি করে আঠারোশো সাল পর্যন্ত ভূমধ্য সাগরে প্রভাব বিস্তার করে রেখেছিল। কিন্তু যখন উচ্চতর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাহায্যে পাশ্চাত্যবাসীরা উন্নততর কামান ও দ্রুততর জাহাজ নির্মাণ করতে সক্ষম হয় তখন তারা সেই বিজ্ঞানকেই অবহেলা করে আসার জন্য পিছয়ে পড়তে বাধ্য হয়।
তৎকালীন ধর্মীয় নেতারা বুদ্ধি ও চিন্তনের যে ঋণাত্মক আবহ সৃষ্টি করেছিলেন মুঘল শাসকগোষ্ঠীর উপর তা প্রভাব বিস্তার করেছিল। এই ধর্মযাজকরা যুক্তিবাদকে নিন্দা করতেন। সেই জন্যই আবুল ফজল দুঃখ করে বলছেন যে কীভাবে তারা কেবল পরম্পরা বা ঐতিহ্যের উপরেই (তালি) জোর দিয়ে কী করে এবং কেন’অর্থাৎ কোনোরকম প্রশ্নের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সমাজের প্রচলিত এই মানসিকতা দেখেই আকবর অঙ্ক, ভূগোল, সমাজবিজ্ঞান ইত্যাদি ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়ের উপর জোর দেওয়ার চেষ্টা করেন এবং ব্যর্থ হন এবং ফলত প্রযুক্তিগত কোনো উন্নতি তখন কোথাও দেখা যায়নি বললেই চলে।
এই পরিস্থিতিতে নূতন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বেড়ে ওঠার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। বার্নিয়েরের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা যায় যে নূতন চিন্তার সৃষ্টি ও সুরক্ষা প্রক্রিয়ার যোগ্য কোনো শিক্ষাবিদ তখন ভারতে ছিলেন না, যেমন ফরাসী দেশে ছিল।
বাণিজ্য এবং হস্তশিল্পের ক্ষেত্রে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি পরিলক্ষিত হয়, যেখানে কৃষির ক্ষেত্রে এই উন্নতি হয় ধীরগতিতে। সাম্রাজ্যের বাইরের চাকচিক্য অনেক ইউরোপীয় বণিক ও পর্যটকের চোখ ধাঁধিয়ে যায় বটে কিন্তু মুঘল সাম্রাজ্য উন্নতির উচ্চতর স্তরে দেশকে নিয়ে যাবার যোগ্য ছিলেন না। আগে বা পরে দ্রুত শ্রীবৃদ্ধির পথ করে দেবার জন্য সাম্রাজ্যের স্থবির পরিকাঠামোকে ভাঙতেই হত।
তাহলেও আমাদের একথা ভাবা ঠিক হবে না যে ঔরঙ্গজেবের সময় শাসন ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছিল। মুঘল সাম্রাজ্য কিন্তু তখনও এক শক্তিশালী এবং প্রাণবন্ত সামরিক এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থার অধিকারী ছিল। মুঘল সৈন্যদল হয়ত দাক্ষিণাত্যের পাহাড়ের ঢালে, বিশেষ করে পশ্চিম দিকে অত্যন্ত চলমান আক্রমণ করে চকিতে মিলিয়ে যাবার ক্ষমতাসম্পন্ন মারাঠা শক্তির কাছে পরাজিত হয়েছিল। মারাঠাদের দুর্গগুলি অধিকার করা কঠিন ছিল এবং ধরে রাখা ছিল কঠিনতরো একথা সত্যি। কিন্তু উত্তর-ভারতের বিশাল সমতলভূমি ও কর্ণাটকের বিস্তীর্ণ মালভূমিতে মুঘল গোলন্দাজ ও অশ্বারোহী সৈন্যদল তখনও ছিল সবার সেরা। ঔরঙ্গজেবের। মৃত্যুর ত্রিশ-চল্লিশ বছর পরে মোগল গোলন্দাজ বাহিনীর শক্তি বহুলাংশে হ্রাসপ্রাপ্ত হওয়া সত্ত্বেও মারাঠারা যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের সামনে দাঁড়াতে পারত না। অবিরাম নৈরাজ্য, যুদ্ধ এবং মারাঠাদের উপদ্রবে দাক্ষিণাত্যের নাগরিকদের নিঃশেষ করে দিয়েছিল। এর ফলে বহু জায়াগায় শিল্প ও চাষ প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধই হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সাম্রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র উত্তর ভারতে, সমগ্র সাম্রাজ্যেই যার অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক গুরুত্বের এক নির্ণায়ক ভূমিকা ছিল সেখানে তখনও মুঘল প্রশাসনের। পূর্বেকার উদ্যম ছিল অব্যাহত এবং প্রচুর পরিমাণ ভূমি রাজস্ব তখনও সেখান থেকে সংগৃহীত হত। ব্যবসা বাণিজ্য শুধু সমৃদ্ধিময় ছিল তাই নয়, বিস্তার লাভও করছিল। জেলাস্তরে প্রশাসন বিস্ময়কর দৃঢ়তা প্রদর্শন করতে সক্ষম হয় এবং এই প্রশাসনের এক বড়ো অংশ এই সংকট অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত পরোক্ষভাবে ইংরেজ প্রশাসনের অংশ হয়ে ওঠে। “ যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজয় এবং ঔরঙ্গজেবের নানা ভুল-ভ্রান্তি সত্ত্বেও মুঘল সাম্রাজ্য তখনও মানুষের মনে এবং কল্পনায় এক শক্তিশালী প্রভাব অক্ষুণ্ণ রাখতে পেরেছিল।
রাজপুতদের বিষয়ে বলতে গেলে দেখতে পাই যে মাড়োয়াড়ের সঙ্গে সম্পর্কছেদের বিষয়টি কিন্তু এই জন্য হয় যে ঔরঙ্গজেব হিন্দুদের দুর্বল করে দেবার জন্য চাননি, যে তাদের কোনো স্বীকৃত নেতা উঠে আসুক। বরঞ্চ এটি তার এক ভুল হিসাবের ফল বলা যেতে পারে। তিনি চেয়েছিলেন যে মাডোয়াড় রাজ্য দুটি প্রধান দাবিদারের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যাক। কিন্তু এই নীতি বাস্তবায়িত করতে গিয়ে তিনি দুইজন নেতাকেই শত্রুভাবাপন্ন করে তুললেন এবং সেই সঙ্গে দূরে ঠেলে দিলেন। মেওয়ার রাজকেও। যিনি ভাবতেন এই সমস্ত বিষয়ে মুঘলদের হস্তক্ষেপ করতে হলে তা এক বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। মাড়ওয়ারের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ এবং এর ফলশ্রুতি স্বরূপ দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ মোগল সাম্রাজ্যের নৈতিক অবস্থানকে ক্ষুণ্ণ করে তোলে। অবশ্য ১৬৮১ সালের পর এই যুদ্ধের সামরিক গুরুত্ব আর বিশেষ রইল না। ১৬৮১ সাল থেকে ১৭০৬ সাল পর্যন্ত সময়কালে দাক্ষিণাত্যে বহু রাঠোর রাজপুত উপস্থিত থাকার জন্য মারাঠাদের সঙ্গে সংঘর্ষের ফলাফলের উপর কোনো প্রভাব ফেলতে পেরেছিল কিনা, তা অবশ্য সন্দেহজনক। রাজপুতদের দাবি ছিল আগের মতোই। উঁচুদরের মনসব মনজুর এবং তাদের মাতৃভূমি ফিরে পাওয়া। ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর ছয় বৎসরের মধ্যে এই দাবিগুলি পূরণ হয়ে যাওয়ায় রাজপুতদের দিক থেকে মুঘলদের আর কোনো সমস্যা হয়নি। পরবর্তীকালে মুঘল সাম্রাজ্যের খণ্ড বিখণ্ড হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে না ছিল তাদের কোনো হাত, না তারা সাম্রাজ্যের পতনকে রোধ করায় কোনো বিশেষ সাহায্য দিতে পেরেছিল।
ঔরঙ্গজেবের ধর্মীয় নীতিকে আরও বৃহত্তর পারিপার্শ্বিকে বিচার করা উচিত। ঔরঙ্গজেব গোঁড়া দৃষ্টিভঙ্গি-সম্পন্ন ছিলেন। এবং সর্বদা ইসলামিক আইনের গণ্ডির ভিতরে থাকতে চাইতেন। কিন্তু এই আইন ভারতের বাইরে সম্পূর্ণ পৃথক পারিপার্শ্বিকে প্রণীত হয়েছিল। এবং ভারতে একে কঠোর ভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। বহুক্ষেত্রে তিনি তার অমুসলমান প্রজাদের অনুভূতিগুলি বুঝতে চাননি। যদিও শরাই নীতিকে স্বীকার করে নেওয়ার জন্য জিম্মি (অর্থাৎ যার বাদশাহের জিম্মায় আছে) তাদের পুরাতন মন্দিরগুলিকে সম্মান জানানো তার কর্তব্য ছিল, তথাপি ১৬৮৭ সালে বিজাপুর ও গোলকুণ্ডার পতনের সময় পর্যন্ত তিনি বহু হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেছিলেন। তিনি অমুসলমানদের উপর জিজিয়া করও নুতন করে জারি করেছিলেন। কিন্তু এতদসত্ত্বেও তিনি সমস্ত মুসলমানকে তার সাহায্যে একত্রিত করতে পারেননি অথবা সম্পূর্ণ ইসলামিক আইন দ্বারা শাসিত তার বাদশাহীর দিকে তাদের অখণ্ড আনুগত্য অর্জন করতে পারেননি। অপরপক্ষে এর ফলে তার হিন্দু প্রজাদের একাংশ তার শত্রুভাবাপন্ন হয়ে পড়ল এবং যারা রাজনৈতিক অন্য কারণে। মোঘল সাম্রাজ্যের প্রতি বিরূপ ছিল তাদের হাত আরও শক্ত হয়ে উঠল। তাহলেও মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য ধর্মকেই দায়ী করা সমীচীন হবে না। ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর ছয় বৎসরের মধ্যেই জিজিয়া কর বাতিল করে দেওয়া হয় এবং নতুন মন্দির নির্মাণের নিষেধাজ্ঞাও শিথিল করা হয়। কিন্তু ১৮শ শতকে মুঘল সাম্রাজ্যের দ্রুত পতন ও খণ্ড খণ্ড হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ার উপর এর কোনো প্রভাব ছিল না।
শেষ পর্যন্ত বিচার করে দেখলে মনে হয় যে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কারণেই মুঘল সাম্রাজ্যের ক্ষয় ও পতন হয়েছিল।
—
১. মামুরির কাজকে প্রায় পুরোপুরি নিজের নামে করে কাফি খান ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর তার লেখা গ্রন্থে চালিয়ে দিয়েছিলেন। যেখানে মামুরি ছিলেন ঔরঙ্গজেবের সমসাময়িক, সেখানে কাফি খান কিন্তু জন্মেছিলেন ১৬৬৩-৬৪ সালে।
২. শোনা যায় ঔরঙ্গজেব নাকি শাহুকে মুসলিম হয়ে যাওয়ার শর্তে রাজ্যভার তুলে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তবে সমকালীন সূত্র থেকে এর সপক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। যদি ঔরঙ্গজেব সত্যই শাহকে ইসলামে রূপান্তরিত করতে চাইতেন তাহলে তিনি তা অনেক আগেই করতে পারতেন কারণ শাহু তার কাছে দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে বন্দি ছিলেন।
৩. জি. টি. কুলকার্নি তার The Mughal Maratha Relation : Twenty-Five Fateful Year (1682-1707), পুনে, 1983, গ্রন্থে দাবি করেছেন যে ঔরঙ্গজেব শাহুকে চৌথ দান করতে প্রস্তুত ছিলেন, যদিও তিনি তার এই দাবির সপক্ষে কোন তথ্য প্রমাণ হাজির করতে পারেননি। আর জি. টি. কুলকার্নিকেই শরণ করেছেন জে. এফ. রিচার্ড তার “The Mughal Empire (The New Cambridge History of India) (0.V.9.1993) গ্রন্থে।