১২. মাল্টিভার্স ছাড়িয়ে

১২. মাল্টিভার্স পেরিয়ে

বাইবেল আমাদের শিক্ষা দেয়, স্বর্গে কীভাবে যেতে হয়। স্বর্গ কীভাবে চলে তা শেখায় না।

—কার্ডিনাল কারোনিয়াস
নিজের বিচারের সময় কথাটা পুনরাবৃত্তি করেছিলেন গ্যালিলিও

কিছুই না থাকার বদলে অনেক কিছুর অস্তিত্ব আছে কেন? যে অস্থিরতা অধিবিদ্যার অবিরাম ঘড়িটিকে সচল করে রাখে, সেই চিন্তাটি হলো বিশ্বের অনস্তিত্বও ঠিক অস্তিত্বের মতোই সম্ভব।

—উইলিয়াম জেমস

আমরা সবচেয়ে সুন্দর যে অভিজ্ঞতাটি পাই, তা রহস্যময়। এটা মৌলিক আবেগ, যা বিশুদ্ধ শিল্প ও বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের দোলনায় টিকে থাকে। এ সম্পর্কে যে জন জানে না এবং অবাক বা বিস্মিত হতে পারে না, সে আসলে মৃতের মতো। তার চোখ ঘোলাটে হয়ে গেছে।

—আলবার্ট আইনস্টাইন

.

টমাস এইচ হাক্সলি ১৮৬৩ সালে লেখেন, ‘মানবতার জন্য সব প্রশ্নের মধ্যে সেরা প্রশ্নটি হলো প্রকৃতিতে মানুষের অবস্থান ও মহাজগতের সঙ্গে তার সম্পর্ক নির্ধারণ। সমস্যাটি অন্য সব সমস্যার আড়ালে লুকিয়ে আছে। অন্য সব কটির চেয়ে এটি বেশি আকর্ষণীয়।’

‘ডারউইনের বুলডগ’ হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন হাক্সলি। ভিক্টোরিয়ান যুগের গভীরভাবে রক্ষণশীল ইংল্যান্ডে বিবর্তনবাদকে দুর্দান্তভাবে রক্ষা করেন এই মানুষটি। সৃষ্টির একেবারে কেন্দ্রস্থলে মানবতা অবস্থিত ভেবে গর্বিত ছিল ইংরেজ সমাজ। তাদের চোখে শুধু সৌরজগৎই ছিল মহাবিশ্বের কেন্দ্র। শুধু তাই নয়, মানবজাতিও ছিল ঈশ্বরের সৃষ্টির সবচেয়ে সেরা কিছু। ঈশ্বরের স্বর্গীয় হাতের চূড়ামণি। ঈশ্বর স্বয়ং তাঁর নিজের মতো করে আমাদের সৃষ্টি করেছেন।

এই ধর্মীয় গোঁড়ামিকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ডারউইনবাদ রক্ষা করতে হতো হাক্সলিকে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে চালিত আক্রমণের বিরুদ্ধে এ মতবাদ রক্ষা করতেন তিনি। এভাবে ট্রি অব লাইফে আমাদের ভূমিকা নিয়ে আরও বৈজ্ঞানিক উপলব্ধিকে প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করেছিল। এখন আমরা বুঝতে পারি, মহাজগতে আমাদের সঠিক অবস্থানটি সংজ্ঞায়িত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন নিউটন, আইনস্টাইন ও ডারউইনের মতো বিজ্ঞানের জায়ান্টরা।

নিজ নিজ কাজের ধর্মতাত্ত্বিক ও দার্শনিক নিহিতার্থ আঁকড়ে ধরেছিলেন তাঁদের প্রত্যেকেই। প্রিন্সিপিয়ার উপসংহারে নিউটন ঘোষণা করেছেন, ‘সূর্য, গ্রহ ও ধূমকেতুর সবচেয়ে সুন্দর সিস্টেম কেবল একটা বুদ্ধিমান আর শক্তিশালী সত্তার নির্দেশনা ও কর্তৃত্বের মাধ্যমে শুরু হতে পারে।’ নিউটন যদি গতির সূত্র আবিষ্কার করে থাকেন, তাহলে অবশ্যই স্বর্গীয় সূত্রদাতাও আছেন একজন।

আইনস্টাইনও এমন কিছুর অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিলেন, যা তাঁর ভাষায় ‘ওল্ড ওয়ান’। কিন্তু তিনি এমন কেউ, যিনি মানুষের বিষয়গুলোতে হস্তক্ষেপ করেন না। ঈশ্বরকে প্রশংসা করার পরিবর্তে তাঁর লক্ষ্য ছিল ‘ঈশ্বরের মন পড়া’। তিনি বলতেন, ‘আমি জানতে চাই, ঈশ্বর এই বিশ্ব কীভাবে গড়লেন। আমি অন্য কিছু নিয়ে আগ্রহী নই। শুধু ঈশ্বরের ভাবনা জানতে চাই।’ আইনস্টাইন তাঁর এই ধর্মতাত্ত্বিক বিষয়গুলোতে তার তীব্র কৌতূহলের ন্যায্যতা প্রতিপাদন করেছেন এই বলে যে ‘ধর্ম ছাড়া বিজ্ঞান পঙ্গু। আর বিজ্ঞান ছাড়া ধর্ম অন্ধ।’

অন্যদিকে মহাবিশ্বে মানুষের ভূমিকা নিয়ে হতাশাজনকভাবে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন ডারউইন। অবশ্য তাঁকে জীবজগতের কেন্দ্র থেকে মানবজাতিকে ছুড়ে ফেলার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। নিজের আত্মজীবনীতে তিনি স্বীকার করেছেন, ‘নিছক ঘটনাক্রমে বা প্রয়োজনের কারণে এই বিশাল ও বিস্ময়কর মহাবিশ্বকে কল্পনা করা বা এই মহাবিশ্বের মানুষ তার নিজের সামর্থ্য দিয়ে বহু দূরের অতীত বা ভবিষ্যৎকে দেখবে সেটা কল্পনা করা চরম কঠিন ও কিছুটা হলেও অসম্ভব।’ এক বন্ধুকে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার ধর্মতত্ত্ব জট পাকানো।

দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো, ‘প্রকৃতিতে মানুষের অবস্থান ও মহাবিশ্বের সঙ্গে তার সম্পর্ক নির্ধারণ’—এ বিপদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছে অনেককে। বিশেষত যারা কর্তৃত্বকারী গোঁড়ামির কঠোর অনুশাসন চ্যালেঞ্জ জানানোর দুঃসাহস করেছেন, তাঁদের এটি করতে হয়েছে। ১৫৪৩ সালে মৃত্যুশয্যায় নিকোলাস কোপার্নিকাস তাঁর বৈপ্লবিক বই ডি রেভুলিউশনিবাস অরবিয়াম কোলেসটিয়াম (অন রেভুলিউশসন অব দ্য সেলেশটিয়াল অরবস) লিখেছেন। এটা নিছক দুর্ঘটনা নয়। ইনকুইজিশন থেকে বাঁচতে কাজটি করতে বাধ্য হন তিনি। অন্যদিকে গ্যালিলিও দীর্ঘদিন সেকালের প্রভাবশালী মেডিচি পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতার কারণে সুরক্ষিত ছিলেন। কিন্তু একসময় ভ্যাটিকানের ক্রোধের শিকার হওয়াটা অবধারিত ছিল তাঁর জন্য। এর পেছনের কারণ এক যন্ত্ৰ জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন তিনি। সে যন্ত্র দিয়ে মহাবিশ্বের এমন সব রহস্য উদ্‌ঘাটিত হয়েছিল, যা গির্জার মতবাদের তীব্র বিরোধিতা করেছিল। সেই যন্ত্রটি হলো টেলিস্কোপ বা দুরবিন।

বিজ্ঞান ধর্ম ও দর্শন সংমিশ্রণ আসলে বেশ শক্তিশালী। এটি এতই পরিবর্তনশীল যে রোমের রাস্তায় পুড়িয়ে মারা হয়েছিল ১৬ শতকের অন্যতম সেরা দার্শনিক জিয়োর্দানো ব্রুনোকে। তাঁর অপরাধ মহাকাশে যে অসীমসংখ্যক গ্রহ আছে আর সেগুলোতে যে অসীমসংখ্যক জীবসত্তা আছে, তা বিশ্বাস করতেন তিনি। শাস্তির ভয়েও এই বিশ্বাস থেকে সরে আসতে অস্বীকৃতি জানান ব্রুনো। ব্রুনো লিখেছেন, ‘এভাবেই ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠত্ব আর তাঁর জগতের মহত্ত্ব প্রকাশিত হয়। তিনি একমাত্র সূর্যে নন, বরং অগণিত সূর্যে মহিমান্বিত হন। এক পৃথিবীতে বা এক বিশ্বে নয়, বরং হাজার হাজার, আমি বলি অসীম বিশ্বে তার মহিমা প্রকাশ পায়।

গ্যালিলিও এবং ব্রুনোর পাপটা এমন নয় যে তাঁরা মহাকাশের স্বর্গীয় আইন নিয়ে কোনো দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন। তাঁদের আসল পাপ হলো, মানবজাতিকে মহাবিশ্বের কেন্দ্র থেকে বিচ্যুত করেছিলেন তাঁরা। দীর্ঘ ৩৫০ বছর পর, অনেক দেরিতে ১৯৯২ সালে গ্যালিলিওর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে ভ্যাটিকান। তবে ব্রুনোর প্রতি এখনো কোনো ক্ষমা চাওয়া হয়নি।

ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ

গ্যালিলিওর পর থেকে একের পর এক বৈপ্লবিক ঘটনা ঘটতে থাকে। মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ধারণা এবং এতে আমাদের ভূমিকাও পাল্টে যায় সে কারণে। মধ্যযুগে ইউরোপে মহাবিশ্বকে দেখা হতো একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন আর নিষিদ্ধ জায়গা হিসেবে। পৃথিবীকে মনে করা হতো একটা ছোট্ট, সমতল মঞ্চের মতো, যেখানে দুর্নীতি আর পাপে পরিপূর্ণ। সেটি ছিল রহস্যময় এক স্বর্গীয় গোলক দিয়ে ঘেরা। ওই গোলকে ধূমকেতুর মতো অশুভ বস্তুগুলো রাজা ও তার জনগণকে আতঙ্কিত করে তুলত। আবার ঈশ্বর ও গির্জার প্রশংসায় তাদের ঘাটতি দেখা দিলে তারা রোষের শিকার হতো ওই নাট্যমঞ্চের সমালোচকদের। তখন তাদের ইনকুইজিশন বা ধর্মবিচারসভার স্বঘোষিত নীতিমান সদস্যদের মুখোমুখি বীভৎসভাবে বিচার করা হতো।

অতীতের কুসংস্কার ও অতীন্দ্রিয়তাবাদ থেকে আমাদের মুক্তি দেন নিউটন এবং আইনস্টাইন। আকাশের সমস্ত বস্তুসহ আমাদের নিজেদের গতিপথ পরিচালনা করার নিখুঁত ও যান্ত্রিক সূত্রগুলো আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন নিউটন। আসলে এই সূত্রগুলো এতই নির্ভুল যে মানুষ সেগুলো নিছক তোতা পাখির মতো মুখস্থ করে ফেলেছে। অন্যদিকে আইনস্টাইন বিপ্লব ঘটিয়েছেন জীবনের রঙ্গমঞ্চের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে। কাল ও স্থানের সুষম পরিমাপ সংজ্ঞায়িত করা কেবল অসম্ভব নয়, সেই সঙ্গে খোদ রঙ্গমঞ্চটিও নিজেও বক্রও হয়ে গেল এবার। এটি প্রসারিত রাবারের চাদর দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হলো। একই সঙ্গে হয়ে গেল প্রসারণশীল।

এরপর বিশ্ব সম্পর্কে আরও উদ্ভট চিত্র আমাদের সামনে হাজির করল কোয়ান্টাম বিপ্লব। একদিকে নিয়তিবাদের পতনের অর্থ দাঁড়াল পুতুলগুলো নিজেরাই নিজেদের সুতো কেটে দিতে পারবে এবং তাদের নিজেদের সুতোগুলোর পাঠোদ্ধারও করতে পারবে। স্বাধীন ইচ্ছা আবারও পুনরুদ্ধার হলো। কিন্তু তার জন্য দাম হিসেবে দিতে হলো বহুবিধ ও অনিশ্চিত পরিণতি। এর মানে দাঁড়াল, অভিনেতারা একই সময়ে একই সঙ্গে দুই জায়গায় থাকতে পারে এবং অদৃশ্য হয়ে আবারও সেখানে উদয় হতে পারে। তাই অভিনেতা মঞ্চে আছে কি না কিংবা তখন কোনো সময় তা বলা হয়ে উঠল অসম্ভব।

এ অবস্থায় আরেকটি আমূল পরিবর্তন ঘটাল মাল্টিভার্সের ধারণা। এখন ‘ইউনিভার্স’ বা ‘মহাবিশ্ব’ শব্দটি নিজেই সেকেলে হয়ে গেছে। মাল্টিভার্সে সমান্তরাল মঞ্চ রয়েছে, যেখানে তাদের মধ্যে সংযুক্ত করা ট্র্যাপডোর ও লুকানো টানেলসহ একটা মঞ্চ আরেকটার ওপর সাজানো। মঞ্চগুলো আসলে অন্য মঞ্চগুলোর জন্ম দেয় একটা অশেষ সৃষ্টি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। প্রতিটি মঞ্চে পদার্থবিজ্ঞানের নতুন আইন উদ্ভূত হয়। সম্ভবত এসব মঞ্চের শুধু গুটি কয়েকই আমাদের চেনা জীবন আর চেতনার শর্ত পূরণ করে।

বর্তমানে আমরা নাটকের অঙ্কের প্রথম ভাগে বসবাস করছি অভিনেতা হিসেবে। আবার এই মঞ্চের মহাজাগতিক বিস্ময়গুলোর অনুসন্ধানের একেবারে সূচনা পর্যায়ে রয়েছি। নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কে যদি যুদ্ধ বা দূষণের কারণে নিজেরাই নিজেদের গ্রহ ধ্বংস না করে ফেলি, তাহলে হয়তো একদিন আমরা এই পৃথিবী ছেড়ে যেতে পারব। অনুসন্ধান চালাতে পারব নক্ষত্রগুলো ও মহাকাশের অন্যান্য বস্তুতেও। কিন্তু আমরা এখন জেনে গেছি যে এখানে নাটকের তৃতীয় অঙ্কও রয়েছে। সেই অঙ্কটি অভিনীত হয়ে গেলে সব অভিনেতা ধ্বংস হয়ে যাবে। তৃতীয় অঙ্কে মঞ্চটি এতই শীতল হয়ে উঠবে যে সেখানে জীবনধারণ হয়ে উঠবে অসম্ভব। এ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হলো ট্রাপডোরের মাধ্যমে গোটা মঞ্চ ছেড়ে চলে যাওয়া। তারপর নতুন কোনো মঞ্চে আবারও নতুন কোনো নাটক শুরু করা।

কোপার্নিকান প্রিন্সিপল বনাম অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপল

একটা বিষয় স্পষ্ট যে মধ্যযুগে অতিন্দ্রিয়বাদ থেকে বর্তমানের কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের ক্রান্তিকালে প্রতিটি বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ভূমিকা এবং মহাবিশ্বে আমাদের অবস্থান বদলে গেছে নাটকীয়ভাবে। সূচকীয় হারে প্রসারিত হচ্ছে আমাদের মহাবিশ্ব। আমাদের নিজেদের ধারণা বদলাতেও বাধ্য করেছে। আকাশের সীমাহীন নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে কিংবা পৃথিবীতে অগণিত সংখ্যক জীবসত্তার কথা ভেবে আমার এই ঐতিহাসিক অগ্রগতির কথা মনে পড়ে। তখন মাঝেমধ্যে দুটি পরস্পরবিরোধী আবেগে অভিভূত হই আমি। একদিকে মহাবিশ্বের বিশালতা দেখে নিজেকে অতি ক্ষুদ্ৰ বলে মনে হয়। মহাবিশ্বের এই বিশালতা, শূন্যতায় বিস্তৃতির কথা ভেবে ব্লেইজ প্যাসক্যাল একবার লিখেছেন, ‘এই অসীম স্থানগুলোর শাশ্বত নীরবতা আমাকে আতঙ্কিত করে।’ অন্যদিকে প্রাণের জমকালো বৈচিত্র্য ও আমাদের জৈবিক অস্তিত্বের সূক্ষ্ম জটিলতায় মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই।

বর্তমানে মহাবিশ্বে বৈজ্ঞানিকভাবে আমাদের ভূমিকা নির্ধারণের প্রশ্নে, পদার্থবিজ্ঞান সম্প্রদায়ে এক অর্থে দুটি চরমপন্থী দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। এর একটি কোপার্নিকান প্রিন্সিপল এবং আরেকটি অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপল।

কোপার্নিকান মতবাদে বলা হয়, মহাবিশ্বের আমাদের অবস্থান সম্পর্কে বিশেষ কোনো তাৎপর্য নেই। (অনেকে একে মিডিওক্রিটি মতবাদ হিসেবে আখ্যায়িত করেন)। এখন পর্যন্ত প্রতিটি জ্যোতির্বিদ্যার আবিষ্কার এই দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করে বলে মনে হয়। শুধু কোপার্নিকাসই পৃথিবীকে মহাবিশ্বের কেন্দ্র থেকে বিচ্যুত করেননি, মহাবিশ্বের কেন্দ্র থেকে গোটা মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিকে বিচ্যুত করেছেন হাবলও। তার বদলে আমরা পেয়েছি কোটি কোটি গ্যালাক্সিসমৃদ্ধ একটা প্রসারণশীল মহাবিশ্ব। ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জির সাম্প্রতিক আবিষ্কার আরেকটি বিষয় জোরালো করে তুলেছে। সেটি হলো আমাদের দেহ গঠিত হয়েছে মহাবিশ্বের সর্বমোট বস্তু বা শক্তি উপাদানের মাত্র ০.০৩ শতাংশ উচ্চতর রাসায়নিক উপাদান দিয়ে। স্ফীতি তত্ত্ব অনুযায়ী, মনে রাখতে হবে, দৃশ্যমান মহাবিশ্ব একটা বালুকণার মতো, যা অনেক বড় ও সমতল মহাবিশ্বের অংশ হিসেবে গাঁথা। আর এই মহাবিশ্ব হয়তো নিজেই অনবরত নতুন মহাবিশ্ব অঙ্কুরিত করছে। পরিশেষে এম- থিওরি যদি সফলভাবে প্রমাণিত হয়, তাহলে এই সম্ভাবনার মুখোমুখি হতে পারব যে স্থান ও কালের পরিচিত মাত্রিকতাকে বাড়িয়ে অবশ্যই ১১ মাত্রায় আনতে হবে। আমরা যে শুধু মহাবিশ্বের কেন্দ্র থেকেই খসে পড়েছি তা-ই নয়, এমনও হতে পারে, ভবিষ্যতে দেখা যাবে অনেক বড় একটা মাল্টিভার্সের অতিক্ষুদ্র একটা অংশ হলো আমাদের এই দৃশ্যমান মহাবিশ্ব

এমন উপলব্ধির বিশালতার মুখোমুখি হয়ে, স্টিফেন ক্রেনের একটা কবিতার কথা মনে পড়ে। তিনি লিখেছেন :

A man said to the universe :
‘Sir, I exist!’
‘However,’ replied the universe,
‘The fact has not created in me
A sense of obligation.’

(আবার ডগলাস অ্যাডামসের স্যাটায়ার বিজ্ঞান কল্পকাহিনি হিচহাইকার্স গাইড টু দ্য গ্যালাক্সির কথাও মনে পড়ে। এ বইয়ে টোটাল পারসপেকটিভ ভর্টেক্স নামের একটা যন্ত্রের কথা বলা আছে। যন্ত্রটি দিয়ে যেকোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষকে খ্যাপা উন্মাদে পরিণত করা সম্ভব। চেম্বারের ভেতরে গোটা মহাবিশ্বের এক মানচিত্র থাকে। সেখানে ছোট্ট এক তিরচিহ্ন দিয়ে লেখা থাকে, ‘আপনি এখন এখানে’। )

তবে আরেক চরমপন্থা হিসেবে আমাদের কাছে রয়েছে অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপল। এই মতবাদ আমাদের বোঝায়, একগুচ্ছ অলৌকিক ‘দুর্ঘটনা’র কারণে আমাদের ত্রিমাত্রিক মহাবিশ্বে চেতনা সম্ভব হয়ে উঠেছে। এতে উদ্ভট রকম সংকীর্ণ পরিসরের কিছু প্যারামিটার রয়েছে. যা বুদ্ধিমান প্রাণকে বাস্তবে পরিণত করে। আবার এ কারণেই এই পরিসরের ভেতরে আমরা সমৃদ্ধি অর্জন করি। প্রোটনের স্থিতিশীলতা, নক্ষত্রদের আকার, উচ্চতর পদার্থের অস্তিত্ব ইত্যাদি সবকিছুই জটিল জীবসত্তা ও চেতনা গড়ে ওঠার জন্যই সূক্ষ্মভাবে সমন্বয় করা হয়েছে বলে মনে করা হয়। এই আকস্মিক পরিস্থিতি কোনো ডিজাইন, নাকি দুর্ঘটনা তা নিয়ে তর্ক উঠতে পারে। কিন্তু আমাদের অস্তিত্ব সম্ভব হয়ে ওঠার জন্য সূক্ষ্ম ও জটিল সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই।

এ ব্যাপারে স্টিফেন হকিং একবার মন্তব্য করেন, ‘মহাবিস্ফোরণের এক সেকেন্ড পর প্রসারণের হার যদি এক লাখ মিলিয়ন ভাগের এক ভাগও কম হতো, তাহলে (মহাবিশ্ব) বর্তমানের আকারে আসার অনেক আগেই আবারও ধসে পড়ত।…মহাবিস্ফোরণের মতো কোনো কিছু থেকে এ রকম একটা মহাবিশ্বের উদয় হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। আমার ধারণা, এটি স্পষ্টতই ধর্মীয় মত প্রকাশ করে।

আমাদের জীবন ও চেতনা কতটা মূল্যবান, তা উপলব্ধি করতে আমরা প্রায়ই ব্যর্থ হই। আমরা ভুলে যাই, তরল পানির মতো কিছু একটা মহাবিশ্বের অন্যতম মূল্যবান পদার্থ। এটাও ভুলে যাই, গোটা সৌরজগতে শুধু পৃথিবীতে (এবং হয়তো বৃহস্পতির চাঁদ ইউরোপায়) তরল পানি আছে। কথাটা হয়তো আমাদের ছায়াপথের এই অঞ্চলের জন্যও সত্য। আবার সম্ভবত সৌরজগতে মানুষের মস্তিষ্ক প্রকৃতিতে সৃষ্ট সবচেয়ে জটিল বস্তু, হয়তো সবচেয়ে কাছের নক্ষত্রের মধ্যেও সে কথা সত্য। আমরা যখন মঙ্গল বা শুক্র গ্রহের প্রাণহীন ভূখণ্ডের পরিষ্কার ছবিগুলো দেখি, তখন ভেবে হতবাক হয়ে যাই যে এসব পৃষ্ঠতল শহর ও আলো বা এমনকি প্রাণের জটিল জৈব রসায়ন থেকে একেবারে বন্ধ্যা। গভীর মহাকাশে এমন অগণিত বিশ্বের অস্তিত্ব রয়েছে, যেখানে প্রাণের কোনো চিহ্ন নেই, বুদ্ধিমত্তারও কোনো অস্তিত্ব নেই। এসব কিছু দেখে আমাদের বোঝা উচিত, জীবন কত নাজুক এবং পৃথিবীতে তা বেড়ে ওঠাটা কত অলৌকিক এক ঘটনা

কোপার্নিকান প্রিন্সিপল আর অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপল কিছু অর্থে প্রকাশ করে বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি। এটা আমাদের অস্তিত্বের চরম সীমা শ্রেণিভুক্ত করে এবং মহাবিশ্বে আমাদের প্রকৃত ভূমিকা বুঝতে সহায়তা করে। কোপার্নিকান মতবাদ মহাবিশ্বের, হয়তো মাল্টিভার্সেরও বিশালতার মুখোমুখি করতে বাধ্য করে। সেখানে অ্যানথ্রোপিক মতবাদ আমাদের অনুধাবন করতে বাধ্য করে যে জীবন ও চেতনা কতটা বিরল ঘটনা।

তবে কোপার্নিকান মতবাদ আর অ্যানথ্রোপিক মতবাদের মধ্যকার এই বিতর্ক মহাবিশ্বে আমাদের ভূমিকা নির্ধারণ করতে পারে না। যতক্ষণ না আমরা এই প্রশ্নটিকে আরও বড় কোনো দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি। অর্থাৎ কোয়ান্টাম তত্ত্বের দৃষ্টিভঙ্গিতে না দেখা পর্যন্ত আমাদের ভূমিকা নির্ধারিত হয় না।

কোয়ান্টাম তাৎপর্য

কোয়ান্টাম বিজ্ঞানের জগৎ মহাবিশ্বে আমাদের ভূমিকাসংক্রান্ত এই প্রশ্নটিতে বেশ আলোকপাত করে। কিন্তু তার দৃষ্টিভঙ্গিটি আলাদা। কেউ যদি শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল সমস্যার উইগনারের ব্যাখ্যাটি মেনে নেন, তাহলে অনিবার্যভাবে সব জায়গায় চেতনার হস্তক্ষেপ দেখা যাবে। পর্যবেক্ষকদের অসীম শিকলে প্রত্যেকে তার আগের পর্যবেক্ষককে দেখছেন। এই শিকল চূড়ান্তভাবে একজন মহাজাগতিক পর্যবেক্ষকের দিকে নিয়ে যায়, সম্ভবত তিনিই স্বয়ং ঈশ্বর। এই ব্যাখ্যায় মহাবিশ্বের অস্তিত্ব আছে। কারণ, এখানে এটি পর্যবেক্ষণ করার জন্য একজন পরমেশ্বর রয়েছেন। আর হুইলারের ব্যাখ্যাটা সঠিক হলে গোটা বিশ্বটাই একটা চেতনা ও তথ্য দিয়ে শাসিত। এই ব্যাখ্যায় চেতনা হলো, একটা প্রভাবশালী শক্তি, যা অস্তিত্বের প্রকৃতি নির্ধারণ করে।

উইগনারের দৃষ্টিভঙ্গির কারণে রনি নক্স একজন সন্দেহবাদী ও ঈশ্বরকে নিয়ে নিচের কবিতাটি লিখেছেন। তিনি চিন্তা করেছেন, কোনো চত্বরে যদি একটা গাছ থাকে, কিন্তু সেটা পর্যবেক্ষণ করার মতো যদি কেউ না থাকে :

There was once a man who said, ‘God
Must think it exceedingly odd
If he finds that this tree
Continues to be
When there’s no one about in the Quad.’

এবার উত্তর লিখল এক রসিক লোক :

Dear sir, Your astonishment’s odd
I am always about in the Quad
And that’s why the tree
Will continue to be,
Since observed by Yours faithfully–God

অন্য কথায় ওই চত্বরে গাছের অস্তিত্ব আছে। কারণ, একজন কোয়ান্টাম পর্যবেক্ষক সব সময় সেখানে ওয়েভ ফাংশন কলাপস হতে দেখছেন। তিনিই স্বয়ং ঈশ্বর।

উইগনারের ব্যাখ্যাটি পদার্থবিজ্ঞানের একেবারে ভিত্তিমূলে চেতনার প্রশ্নটি উত্থাপন করে। বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ জেমস জিনসের কথার প্রতিধ্বনি করেছেন তিনি। জেমস জিনস একবার লিখেছেন, ‘৫০ বছর আগে মহাবিশ্বটিকে সাধারণত একটা যন্ত্র হিসেবে দেখা হতো…আমরা যখন দুই প্রান্তের আকারের চূড়া অতিক্রম করি, অর্থাৎ গোটা বিশ্বজগৎ বা পরমাণুর ভেতরের আকৃতিতে, তখন প্রকৃতির যান্ত্রিক ব্যাখ্যা ব্যর্থ হয়। আমরা একটা সত্তা ও পরিঘটনায় পৌছাই, যেটি কোনোক্রমেই যান্ত্রিক নয়। আমার কাছে তুলনামূলকভাবে যান্ত্রিকের চেয়ে মানসিক প্রক্রিয়া বলে মনে হয়। মহাবিশ্বকে বিশাল যন্ত্রের চেয়ে বিশাল একটা চিন্তার কাছাকাছি কিছু একটা বলে মনে হয়।’

এই ব্যাখ্যাটি হয়তো হুইলারের তত্ত্বের সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী রূপ। শুধু আমরাই মহাবিশ্বের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিইনি। মহাবিশ্বও আমাদের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে।’ অন্য কথায়, কিছু ক্ষেত্রে আমরা পর্যবেক্ষণ করার মাধ্যমে নিজেরাই আমাদের বাস্তবতা তৈরি করি। তিনি একে বলেছেন, ‘জেনেসিস বাই অবজারভারশিপ’ বা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে উৎপত্তি I হুইলারের দাবি, আমরা একটা ‘পার্টিসিপেটরি ইউনিভার্স’ বা অংশগ্রহণকারী মহাবিশ্বে বাস করি।

একই কথা প্রতিধ্বনি করেছেন নোবেল বিজয়ী জীববিজ্ঞানী জর্জ ওয়াল্ড। তিনি লিখেছেন, ‘পদার্থবিদ ছাড়া কোনো মহাবিশ্বে একটা পরমাণু হওয়া খুব দুর্ভাগা ব্যাপার। পদার্থবিদেরা পরমাণু দিয়ে তৈরি। একজন পদার্থবিদ হলেন পরমাণু সম্পর্কে জানার পারমাণবিক উপায়।’ একত্ববাদী বা ইউনিটেরিয়ান মিনিস্টার গ্যারি কোওয়ালস্কি এই বিশ্বাসকে সংক্ষেপিত করেছেন এভাবে, ‘মহাবিশ্বকে বলা যায়, নিজের অস্তিত্বকে উদ্‌যাপন করছে এবং তার নিজের সৌন্দর্য উপভোগ করছে। মানবজাতি যদি মহাবিশ্বের নিজের বাড়তে থাকা সচেতনতার একটা দিক হয়, তাহলে আমাদের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত অবশ্যই মহাবিশ্বকে নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি একে সংরক্ষিত করা ও বাঁচিয়ে রাখা। একে কোনোভাবেই লুণ্ঠন বা ধ্বংস করা নয়। কারণ, তা গড়ে উঠতে অনেক সময় লেগেছে।’

এই যুক্তিতে মহাবিশ্বের একটা উদ্দেশ্য রয়েছে : আমাদের মতো সংবেদনশীল প্রাণী সৃষ্টি করা, যারা তাকে পর্যবেক্ষণ করতে পারবে। তাই এর অস্তিত্ব আছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে মহাবিশ্বের অস্তিত্ব নির্ভর করে তার বুদ্ধিমান প্রাণী সৃষ্টির সক্ষমতার ওপর, যারা তাকে পর্যবেক্ষণ করতে পারবে। এর ফলে তার ওয়েভ ফাংশন কলাপস করবে বা ধসে পড়বে।

কোয়ান্টাম তত্ত্বের উইগনারের ব্যাখ্যায় কেউ কেউ হয়তো স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতে পারেন। তবে এর বিকল্প একটা ব্যাখ্যাও আছে। সেটি হলো বহু বিশ্বের ব্যাখ্যা। এতে মহাবিশ্বের মানবজাতির ভূমিকা সম্পর্কে একেবারেই ভিন্ন ধারণা উপস্থাপন করে। মেনি ওয়ার্ল্ড বা বহুবিশ্বের ব্যাখ্যায় শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল একই সঙ্গে মৃত ও জীবিত উভয়ই হতে পারে। কারণ, খোদ মহাবিশ্ব নিজেই এখানে বিভক্ত হয়ে যায় দুটি আলাদা মহাবিশ্বে।

মাল্টিভার্সের তাৎপর্য

বহুবিশ্ব তত্ত্বের অসীম মহাবিশ্বে সহজেই হারিয়ে যাওয়া যায়। এসব প্যারালাল কোয়ান্টাম মহাবিশ্বের নৈতিক প্রভাবগুলো অনুসন্ধান করা হয়েছে ল্যারি নিভেনের ‘অল দ্য মিরিয়াড ওয়েজ’ শিরোনামের একটা ছোট গল্পে। এ গল্পে রহস্যজনক আত্মহত্যার কিছু ঘটনার তদন্তে নামেন ডিটেকটিভ লেফটেন্যান্ট জিন ট্রিম্বল। হুট করে শহরজুড়ে যেসব লোকের আগে কোনো মানসিক সমস্যা ছিল না, তারাও সেতুর ওপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল। এমনকি নিজেদের মাথা উড়িয়ে দিল কিংবা এমনকি গণহত্যাও শুরু করল লোকেরা। ক্রসটাইম করপোরেশনের প্রতিষ্ঠাতা অ্যামব্রোস হারমন। পোকার খেলতে গিয়ে পাঁচ শ ডলার জেতার পর তিনি যখন ৩৬ তলা ভবনের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট থেকে নিচে লাফিয়ে পড়লেন, তখন রহস্য হয়ে উঠল আরও ঘনীভূত। তিনি একাধারে ধনী, প্রতাপশালী। তার যোগাযোগও ভালো। জীবনের জন্য যা দরকার সবই তাঁর ছিল। তাই তার আত্মহত্যার কোনো অর্থ খুঁজে পাওয়া গেল না। তবে একসময় ঘটনাগুলোর মধ্যে একটা প্যাটার্ন খুঁজে পেলেন গোয়েন্দা ট্রিম্বল। ক্রসটাইম করপোরেশনের বিশ ভাগ পাইলট আত্মহত্যা করেছিলেন। আত্মহত্যার ঘটনার সূত্রপাত হয় ক্রসটাইম প্রতিষ্ঠার এক মাস পর।

আরও গভীরে তলিয়ে দেখে গোয়েন্দা ট্রিম্বল দেখলেন, হারমন তাঁর দাদা- দাদির কাছ থেকে বিপুল ধনসম্পত্তি উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলেন। বেপরোয়াভাবে একে একে তছনছও করেছেন সেগুলো। সম্ভবত নিজের সব সম্পদ হারিয়ে ফেলেন তিনি। কিন্তু একটা জুয়ায় তা ফিরে পান। বেশ কয়েকজন পদার্থবিদ, ইঞ্জিনিয়ার ও দার্শনিককে একত্র করে প্যারালাল টাইম ট্র্যাকের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখেন গোয়েন্দা ট্রিম্বল। ক্রমান্বয়ে নতুন টাইমলাইনে ঢুকতে সক্ষম একটা গাড়ি তৈরি করতে পারে তারা। এরপর পাইলট অচিরেই কনফেডারেশন স্টেটস অব আমেরিকা থেকে নতুন একটা আবিষ্কার ফিরিয়ে আনেন। ক্রসটাইম করপোরেশন এরপর প্যারালাল টাইমলাইনে শত শত অভিযান পরিচালনায় টাকা ঢালতে থাকে। প্যারালাল টাইমলাইনে নতুন নতুন উদ্ভাবন খুঁজে পেয়ে সেগুলো এখানে ফিরিয়ে এনে পেটেন্ট করতে থাকে তারা। শিগগিরই ক্রসটাইপ বিলিয়ন ডলারের একটা করপোরেশনে পরিণত হয়। তাদের হাতে তখন আমাদের সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক মানের পেটেন্টগুলো। সব দেখে মনে হচ্ছিল, ক্রসটাইম তার সময়ের সবচেয়ে সফল করপোরেশন। আর সেখানে দায়িত্ব পালন করছেন হারমন।

গোয়েন্দা ট্রিম্বলের দল আবিষ্কার করে, প্রতিটি টাইমলাইনই আলাদা। তারা ক্যাথলিক সাম্রাজ্য, আমেরিনডিয়ান আমেরিকা, ইম্পেরিয়াল রাশিয়া এবং পারমাণবিক যুদ্ধে শেষ হয়ে যাওয়া অসংখ্য তেজস্ক্রিয় বিশ্ব ও অগণিত মৃত দেখতে পায়। কিন্তু একসময় এর চেয়েও বিব্রতকর বিষয় খুঁজে পাওয়া যায় : তাদের নিজেদের কার্বন কপি, যারা প্রায় তাদের মতো করে জীবনযাপন করছে। কিন্তু সেখানেও অদ্ভুত এক টুইস্ট রয়েছে। এসব বিশ্বে তারা যা-ই করুক না কেন, সেখানে সবকিছুই ঘটা সম্ভব : যতই পরিশ্রম করুক না কেন তারা হয়তো তাদের সবচেয়ে চমৎকার স্বপ্নগুলো বুঝতে পারে কিংবা তাদের সবচেয়ে ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের মধ্যেও বসবাস করতে পারে। তারা যা-ই করুক না কেন, কিছু মহাবিশ্বে তারা সফল ও অন্যগুলোতে একেবারেই ব্যর্থ। নিজেদের অসীমসংখ্যক নকল বিপরীত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সম্ভাব্য সব পরিণতিও ডেকে আনতে পারে। ইচ্ছা করলে ব্যাংক ডাকাতও হতে পারবে, কিছু মহাবিশ্বে কোনো শাস্তি না পেয়েই গটগট করে হেঁটে সবার চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়েও যেতে পারবে তারা।

টিম্বল ভাবেন, ‘এখানে ভাগ্য বলে কিছু নেই। প্রতিটি সিদ্ধান্ত দুভাবে ঘটে। কোনো সিদ্ধান্ত নিতে আপনি যেসব বিষয় বাদ দেন, সেগুলোর প্রতিটিই অন্য পছন্দ হিসেবে গড়ে ওঠে। সেগুলোর সবই ইতিহাসের সব জায়গায় ঘটে।’ একটা উপলব্ধিতে পৌঁছে টিম্বল গভীর হতাশায় ডুবে যান : মহাবিশ্বে সবকিছুই সম্ভব। তিনি বুঝতে পারেন, আমাদের ভাগ্যের ওপর শেষ পর্যন্ত আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। আমরা যে সিদ্ধান্ত নিই না কেন, ফলাফলে তাতে কিছু যায় আসে না।

একসময় হারমনের দেখানো পথ অনুসরণের সিদ্ধান্ত নেন টিম্বলও। একটা বন্দুক বের করে নিজের মাথায় তাক করেন তিনি। কিন্তু বন্দুকে ট্রিগার টানা সত্ত্বেও দেখা গেল অসীমসংখ্যক মহাবিশ্ব রয়েছে, যেগুলোতে বন্দুকের গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে, গুলিটা সিলিংয়ে গিয়ে আঘাত করছে, কোথাও আবার গোয়েন্দাপ্রবর মারাও গেছে। ট্রিম্বল শেষ পর্যন্ত অসীমসংখ্যক মহাবিশ্বে অসীমসংখ্যকভাবে জীবনযাপনের সিদ্ধান্ত নেন।

কোয়ান্টাম মাল্টিভার্সের কথা কল্পনা করার সময় আমরা ওই গল্পের টিম্বলের মতো সম্ভাবনার মুখোমুখি হই। অবশ্য ভিন্ন ভিন্ন কোয়ান্টাম মহাবিশ্ব থাকা আমাদের প্যারালাল সত্তারও নিখুঁতভাবে একই জেনেটিক কোড থাকতে পারে। তবে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে, আমাদের সুযোগ-সুবিধা, আমাদের শুরু এবং আমাদের স্বপ্নগুলো হয়তো আমাদেরকে ভিন্ন ভিন্ন পথের দিকে নিয়ে যায়। তাতেই ভিন্ন রকম হয়ে যায় জীবনের ইতিহাস ও গন্তব্য।

এই উভয়সংকটের একটা রূপ প্রায় আমাদের ওপর নির্ভরশীল। এটা সময়ের ব্যাপার মাত্র, হয়তো কয়েক দশকের মধ্যে মানুষের জেনেটিক ক্লোনিং সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। মানুষের ক্লোনিং করা চরম কঠিন কাজ (আসলে শুধু মানুষ কেন, এখনো কেউই কোনো প্রাইমেটকে পুরোপুরি ক্লোন করতে পারেনি)। পাশাপাশি এর নৈতিক প্রশ্নগুলোও বেশ বিব্রতকর। তবে কিছু ক্ষেত্রে অবশ্যম্ভাবী ব্যাপার হলো, এটা কোনো না কোনো সময় ঘটবেই। সেটি ঘটলে প্রশ্ন উঠবে : আমাদের ক্লোনগুলোর কি আত্মা আছে? আমাদের ক্লোনের কোনো কাজের জন্য কি আমরাই দায়ী? কোয়ান্টাম মহাবিশ্বে আমাদের হয়তো অসীমসংখ্যক কোয়ান্টাম ক্লোন বর্তমান থাকবে। আমাদের কিছু ক্লোন হয়তো কোনো খারাপ কাজও করে বসবে। তখন কি তাদের মন্দ কাজের জন্য আমরা দায়ী হব? আমাদের কোয়ান্টাম ক্লোনের পাপের জন্য কী আমাদের আত্মাকেও ভুগতে হবে?

এই কোয়ান্টাম অস্তিত্ব সংকটের একটা সমাধানও রয়েছে। অসীম বিশ্বের মাল্টিভার্সের দিকে একপলক তাকালে আমরা হয়তো ভাগ্যের এলোমেলো অবস্থা দেখে অভিভূত হতে পারি। কিন্তু প্রতিটি বিশ্বের ভেতর কার্যকারণের সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের নিয়ম মূল বিষয়কে ধারণ করে। পদার্থবিদদের প্রস্তাবিত মাল্টিভার্স তত্ত্বে

তত্ত্বে প্রতিটি আলাদা মহাবিশ্ব ম্যাক্রোস্কোপিক স্কেলে নিউটোনিয়ানের মতো সূত্রগুলো মেনে চলে। তাই আমাদের কৃতকর্মগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অনুমানযোগ্য পরিণতির কথা জেনেও নিজেদের মহাবিশ্বে স্বাচ্ছন্দ্যে টিকে থাকা যায়। প্রতিটি মহাবিশ্বে কার্যকারণ সূত্রগুলো গড়পড়তা কঠোরভাবে প্রযোজ্য। প্রতিটি মহাবিশ্বে আমরা যদি অপরাধ করি, তাহলে আমাদের জেলে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আমাদের সঙ্গে থাকা সমান্তরাল বাস্তবতা সম্পর্কে সৌভাগ্যক্রমে অসচেতন থেকে কাজগুলো করে যেতে হবে।

এটি আমাদেরকে সেই সন্দেহজনক গল্পের কথা মনে করিয়ে দেয়, যেগুলো মাঝেমধ্যে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করেন পদার্থবিদেরা। একদিন রাশিয়া থেকে এক পদার্থবিদকে যুক্তরাষ্ট্রের লাস ভেগাসে আনা হলো। এই পাপে পঙ্কিল নগরীর পুঁজিবাদী বৈভব আর লাম্পট্য দেখে চমকে ওঠেন তিনি। অচিরেই তিনি জুয়ার টেবিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে নিজের সব টাকাপয়সা বাজি ধরেন। তাঁকে যখন বলা হলো এতে জুয়ার কিছু কৌশল ছিল। তখন গণিত ও সম্ভাবনার সূত্রগুলো তাঁর মাথায় এল। জবাবে বললেন, ‘হ্যাঁ, সবই সত্য। কিন্তু একটা কোয়ান্টাম মহাবিশ্বে আমি ধনী হব!’ এই রুশ পদার্থবিদ হয়তো সত্যই বলেছিলেন। কিছু প্যারালাল ওয়ার্ল্ডে তিনি হয়তো কল্পনাতীত সম্পদ উপভোগ করছেন। কিন্তু এই নির্দিষ্ট মহাবিশ্বে হেরে নিঃস্ব হয়েছেন তিনি। এখানে তাঁর পরিণতি অবশ্যই তাকে ভোগ করতে হবে।

মহাবিশ্বের তাৎপর্য সম্পর্কে পদার্থবিদেরা কী ভাবেন

জীবনের অর্থ সম্পর্কিত বিতর্কটিতে স্টিভেন ওয়াইনবার্গ তাঁর দ্য ফার্স্ট থ্রি মিনিটস বইয়ের উসকানিমূলক বক্তব্যগুলো আরও বেশি নাড়া দেয়। তিনি লিখেছেন, ‘মহাবিশ্ব যত বেশি বোধগম্য হয়, তাকে তত বেশি অর্থহীন মনে হয়।…গুটিকয়েক বিষয়ের মধ্যে মহাবিশ্বকে বোঝার চেষ্টা অন্যতম, যা মানুষের জীবনকে প্রহসনের কিছুটা ওপরের স্তরে নিয়ে যায়। এতে কিছুটা ট্র্যাজেডির মাধুর্য পাওয়া যায়।’ ওয়াইনবার্গ স্বীকার করেছেন, তিনি যেসব বাক্য লিখেছেন, সেগুলোর মধ্যে এটিই সবচেয়ে উত্তপ্ত প্রতিক্রিয়া পেয়েছিল। পরে আরেকটা মন্তব্যের কারণে তিনি বিতর্কের জন্ম দেন, ‘ধর্মসহ কিংবা ধর্ম ছাড়া ভালো মানুষ ভালো আচরণ আর খারাপ মানুষ খারাপ আচরণ করতে পারে। কিন্তু একজন ভালো মানুষের খারাপ কাজ করার জন্য ধর্মের প্রয়োজন।’

স্পষ্টতই বিতর্কটা উসকে দিয়ে নারকীয় আনন্দ পেয়েছিলেন ওয়াইনবার্গ। মহাবিশ্বের মহাজাগতিক তাৎপর্যের ভেতর যারা কিছু অন্তর্দৃষ্টির দাবি করার ভান করে, তাদের খোঁচা দিয়ে মজা করেন তিনি। ‘অনেক বছর ধরে দার্শনিক বিষয়গুলোতে আমি এক আনন্দিত অসভ্য মানুষ।’, তিনি স্বীকার করেন। শেক্সপিয়ারের মতো তিনিও বিশ্বাস করেন, গোটা বিশ্বই একটা নাট্যমঞ্চ, “তবে ট্র্যাজেডির কোনো স্ক্রিপ্ট লেখা থাকে না। ট্র্যাজেডি মানেই হলো এর কোনো স্ক্রিপ্ট নেই।

ওয়াইনবার্গের কথাগুলোর প্রতিধ্বনি করেছেন অক্সফোর্ডের জীববিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স। তিনি প্রচার করেন, ‘কোনো মহাবিশ্বের অন্ধ ভৌত বলগুলো…কিছু মানুষ আঘাত পেতে পারে এবং অন্য কিছু মানুষ ভাগ্যবান ও হতে পারে। কিন্তু এতে কোনো ছন্দ বা কারণ, এমনকি কোনো ন্যায়বিচারও খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমরা যে মহাবিশ্ব পর্যবেক্ষণ করি, তা নিখুঁতভাবে সেই ধর্মই দেখায়, যা আমরা তার মধ্যে আশা করি। এতে অন্ধ, দরদহীন উদাসীনতা ছাড়া কোনো নকশা, উদ্দেশ্য, কোনো খারাপ বা ভালো কিছুই নেই।

সংক্ষেপে বলা যায়, ওয়াইনবার্গ এক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। মানুষ যদি বিশ্বাস করে মহাবিশ্বের কোনো অর্থ আছে, তাহলে সেই অর্থটা আসলে কী? মহাজগতের বিশালতার মাঝখানে উঁকি দিয়ে মহাবিশ্বে আমাদের সূর্যের চেয়ে অনেক বড় দানবীয় নক্ষত্রগুলোর জন্ম ও মৃত্যু দেখতে পান জ্যোতির্বিদেরা। মহাবিশ্ব কয়েক বিলিয়ন বছর ধরে প্রসারিত হয়ে চলেছে। এ অবস্থায় বোঝা মুশকিল, একটা অস্পষ্ট নক্ষত্রের চারপাশে ঘুরে বেড়ানো একটা খুদে গ্রহে বসবাসকারী মানবজাতির জন্য মহাবিশ্বের এসব কিছু নিখুঁতভাবে সাজানো হয়েছে।

তাঁর বক্তব্যগুলো বেশ উত্তাপের জন্ম দিলেও খুব কমসংখ্যক বিজ্ঞানী সেসবের বিরুদ্ধে লড়তে উৎসাহ বোধ করেছেন। তবু বেশ কয়েকজন নামকরা কসমোলজিস্টের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অ্যালান লাইনম্যান এবং রোর্বাতা ব্রাউয়ার। এই কসমোলজিস্টদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তাঁরা ওয়াইনবার্গের কথার সঙ্গে একমত কি না। মজার ব্যাপার হলো, মাত্র হাতে গোনা কয়েকজন ওয়াইনবার্গের দেখানো মহাবিশ্বের বিষণ্ণ চিত্র মেনে নিয়েছেন। ওয়াইনবার্গের দলের একজন হলেন লিক অবজারভেটরি বিজ্ঞানী ও সান্তা ক্রুজে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সান্ড্রা ফেবার। তিনি বলেন, ‘পৃথিবী মানুষের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে, সে কথা আমি বিশ্বাস করি না। এই গ্রহটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি হয়েছে। এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবে জীবন ও বুদ্ধিমান প্রাণীর আবির্ভাব হয়। ঠিক একইভাবে, আমার ধারণা মহাবিশ্বও কোনো প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি হয়েছে। এর ভেতরের নির্দিষ্ট একটা অংশে আমাদের উপস্থিতিটা ছিল পুরোটাই ভৌত সূত্রগুলোর প্রাকৃতিক ফলাফল। আমার মনে হয়, এই প্রশ্নে এমন কোনো প্রভাবক শক্তি নিহিত আছে, যার মানুষের অস্তিত্বের বাইরেও একটা উদ্দেশ্য রয়েছে। আমি সেটা বিশ্বাস করি না। তাই শেষ পর্যন্ত আমি ওয়াইনবার্গের সঙ্গে একমত যে মানবজাতির দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এটি পুরোপুরি অর্থহীন।’

তবে কসমোলজিস্টদের বড় একটা শিবির মনে করে, ওয়াইনবার্গের বক্তব্য একেবারে ভিত্তিহীন। তাঁদের ধারণা, মহাবিশ্বের গভীর এক অর্থ আছে। এমনকি সেগুলো স্পষ্টভাবে বলতে না পারলেও এর কোনো না কোনো অর্থ আছে বলে মনে করেন এসব কসমোলজিস্ট।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মার্গারেট জেলার বলেন, “জীবন সম্পর্কে আমার ধারণা হলো, আপনি নিজের জীবন যাপন করছেন। আর সেটি সংক্ষিপ্ত। মূল বিষয় হলো যতটা সম্ভব সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা থাকা দরকার। সেই চেষ্টাই করছি আমি। কিছু সৃজনশীল কাজ করারও চেষ্টা করছি। মানুষকে শিক্ষিত করার চেষ্টা করছি।’

তাঁদের মধ্যে অনেকে মহাবিশ্বের অর্থ খুঁজে পান। তাতে ঈশ্বরের হস্তক্ষেপও দেখতে পান। স্টিফেন হকিংয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও আলবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডন পেজ বলেন, ‘হ্যাঁ, আমি অবশ্যই বলব, এখানে একটা উদ্দেশ্য রয়েছে। সেই উদ্দেশ্যগুলো কী, তার সব জানি না। কিন্তু আমি মনে করি, ঈশ্বরের জন্য এর মধ্যে একটা উদ্দেশ্য ছিল। সেটি হলো সঙ্গ পাওয়ার জন্য মানুষকে সৃষ্টি করেছেন ঈশ্বর। আরও বড় উদ্দেশ্য হতে পারে, ঈশ্বরের সৃষ্টি খোদ ঈশ্বরকেই মহিমান্বিত করে।’ এমনকি কোয়ান্টাম ফিজিকসের বিমূর্ত নিয়মগুলোতেও ঈশ্বরের হস্তক্ষেপ দেখতে পান তিনি, ‘কিছু কিছু ক্ষেত্রে মনে হয়, ভৌত সূত্রগুলো ব্যাকরণ ও ভাষার সমতুল্য, যেগুলো ব্যবহার করার জন্য ঈশ্বর বেছে নিয়েছিলেন।’

আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব বিশ্লেষণে প্রথম দিককার অগ্রদূতদের একজন হলেন যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের চার্লস মিসনার। ডন পেজের কথার সঙ্গে তিনি একমত প্রকাশ করেন, ‘আমার মতে, ধর্মের ভেতর খুবই গুরুতর বিষয় থাকে। যেমন ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও মানুষের ভ্রাতৃত্ব। এগুলোর গুরুতর সত্য যে আমরা হয়তো একদিন ভিন্ন কোনো ভাষায় ভিন্ন কোনো পরিসরে মূল্যায়ন করতে শিখব।… তাই আমি মনে করি, এখানে বাস্তব সত্য রয়েছে। আবার মহাবিশ্বের মহিমাও অর্থবোধক। আবার আমরা এর স্রষ্টার প্রতি সম্মান ও সমীহ দেখাই। তাঁর কাছে আমরা ঋণী।’

স্রষ্টার প্রশ্ন আরেকটি বিষয় তোলে : ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে বিজ্ঞান কি কিছু বলতে পারে? ধর্মতত্ত্ববিদ পল টিলিচ একবার বলেছিলেন যে পদার্থবিদেরা হলেন একমাত্র বিজ্ঞানী, যাঁরা ‘ঈশ্বর’ শব্দটি বলতে পারেন এবং সে জন্য লজ্জায় লাল হন না। প্রকৃতপক্ষে, মানবজাতির অন্যতম বড় প্ৰশ্ন মোকাবিলায় বিজ্ঞানীদের মহলে পদার্থবিদেরা একা : এতে কি কোনো মহান নকশা আছে? তাই যদি হয়, তাহলে কি কোনো ডিজাইনার আছেন? সত্য, যুক্তি বা প্রকাশের প্রকৃত পথ কোনোটি?

অতিপারমাণবিক কণাগুলোকে কম্পনশীল স্ট্রিং বা তারের নোট হিসেবে দেখায় স্ট্রিং থিওরি। রসায়নের সূত্রগুলোর সঙ্গে এই তারের বাজানো মেলোডির মিল আছে। পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলোর সঙ্গে হারমনির মিল আছে, যা স্ট্রিংগুলোকে পরিচালনা করছে। মহাবিশ্ব হলো স্ট্রিংয়ের সিম্ফোনি। ঈশ্বরের মনকে হাইপারস্পেসের ভেতর মহাজাগতিক সংগীতের কম্পন হিসেবে দেখা যায়। এই সাদৃশ্যটি যদি সঠিক হয়, তাহলে পরের প্রশ্নটি আসবেই : এর কোনো সুরকার কি আছেন? স্ট্রিং থিওরিতে আমরা যা দেখি সেই সম্ভাব্য মহাবিশ্বের সমৃদ্ধির অনুমোদনের জন্য কেউ কি এই তত্ত্বটি ডিজাইন করেছেন? মহাবিশ্ব যদি সুষমভাবে টিউন করা একটা ঘড়ি হয়, তাহলে এর কি কোনো নির্মাতা আছেন?

এই অর্থে এই প্রশ্নটিতে কিছু আলোকপাত করে স্ট্রিং থিওরি : ঈশ্বরের কি কোনো পছন্দ ছিল? আইনস্টাইন মহাজাগতিক তত্ত্বগুলো প্রণয়ন করার সময় প্রায় সব সময়ই প্রশ্ন করেছেন, আমি হলে কীভাবে মহাবিশ্বের নকশা করতাম? এই ধারণার দিকে তাঁর ঝোঁকার কারণ সম্ভবত, এ বিষয়ে ঈশ্বরের বেছে নেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। এর সপক্ষে সমর্থন করে স্ট্রিং থিওরিও। আপেক্ষিকতার সঙ্গে কোয়ান্টাম তত্ত্ব একত্র করা হলে, আমরা এমন সব তত্ত্ব খুঁজে পাই যেগুলো গোপনীয়, কিন্তু মারাত্মক সব ত্রুটি রয়েছে। যেমন এতে ডাইভারজেন্স ও অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়, যা তত্ত্বটির প্রতিসাম্যতাগুলো বিনষ্ট করে। শুধু শক্তিশালী প্রতিসাম্যতা অন্তর্ভুক্ত করে এসব ডাইভারজেন্স বা বিচ্যুতি ও অস্বাভাবিকতাকে দূর করা যায়। আর এম- থিওরি এসব প্রতিসাম্যের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী। কাজেই একটা তত্ত্ব যেসব স্বীকার্য বা প্রয়োজনীয় শর্ত মান্য করবে বলে আমরা যেমন দাবি করি, সম্ভবত তেমন একটা একক ও অনন্য তত্ত্ব থাকতেও পারে।

প্রায়ই ওল্ড ওয়ান সম্পর্কে বিস্তারিত লিখতেন আইনস্টাইন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কেও। তাঁর কাছে দুই ধরনের ঈশ্বর ছিল। প্রথম জন তাঁর ব্যক্তিগত ঈশ্বর। এই ঈশ্বর প্রার্থনার জবাব দেন। এই ঈশ্বর হলেন আব্রাহাম, আইজ্যাক, মুসার ঈশ্বর। এই ঈশ্বর পানিকে দুই ভাগ করেছিলেন এবং অলৌকিক ঘটনাও ঘটান। তবে এই ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না বেশির ভাগ বিজ্ঞানী।

আইনস্টাইন একবার লেখেন, তিনি ‘স্পিনোজার ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন। এই ঈশ্বর নিজেকে বিদ্যমান বিষয়গুলোর ভেতর সুশৃঙ্খলভাবে প্রকাশ করেন। যে ঈশ্বর নিজেকে মানুষের ভাগ্য আর কাজ নিয়ে উদ্বিগ্ন, সেই ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না তিনি।’ স্পিনোজা ও আইনস্টাইনের ঈশ্বর হলেন, সুশৃঙ্খলার ঈশ্বর, কার্যকারণ ও যুক্তির ঈশ্বর। আইনস্টাইন লিখেছেন, ‘যে ঈশ্বর তাঁর সৃষ্টি করা বস্তুগুলোকে পুরস্কার ও শাস্তি দেন, আমি সেই ঈশ্বর কল্পনা করতে পারি না।…এটাও বিশ্বাস করতে পারি না যে কোনো ব্যক্তির দেহের মৃত্যুর পরও সে বেঁচে থাকে।

(দান্তের ইনফার্নো-তে নরকের প্রবেশপথের কাছে প্রথম বৃত্তের লোকেরা হবে শুভ ইচ্ছাশক্তি ও ভালো প্রকৃতির মানুষ, কিন্তু যারা যিশুখ্রিষ্টকে পুরোপুরি মেনে নিতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রথম বৃত্তে প্লেটো ও অ্যারিস্টটল এবং অন্যান্য মহান চিন্তাবিদ ও আলোকবর্তীদের খুঁজে পেয়েছিলেন দান্তে। পদার্থবিদ উইলজেক মন্তব্য করেছেন, ‘আমাদের সন্দেহ অনেকে, সম্ভবত বেশির ভাগ আধুনিক বিজ্ঞানীকে এই প্রথম বৃত্তে খুঁজে পাওয়া যাবে।) মার্ক টোয়েনকেও হয়তো এই প্রথম বৃত্তে দেখতে পাওয়া যাবে। টোয়েন একবার বিশ্বাসকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন এভাবে, ‘একজন বোকা মানুষ ভুল জেনেও যা বিশ্বাস করে।’

ব্যক্তিগতভাবে বিশুদ্ধ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমি মনে করি, ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে আইনস্টাইন বা স্পিনোজার শক্তিশালী যুক্তিগুলো এসেছে টেলিওলজি বা উদ্দেশ্যবাদ (বা পরম কারণবাদ) থেকে। স্ট্রিং থিওরি যদি পরীক্ষামূলকভাবে কখনো থিওরি অব এভরিথিং হিসেবে নিশ্চিত হয়, তাহলে অবশ্যই জিজ্ঞেস করতে হবে, এ সমীকরণগুলো কোথা থেকে এসেছে। আইনস্টাইনের বিশ্বাসমতো ইউনিফায়েড ফিল্ড থিওরি সত্যিই অনন্য হলে অবশ্যই জিজ্ঞেস করতে হবে যে এই অনন্যতা এসেছে কোথা থেকে। যেসব পদার্থবিদ এই ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন, তাঁরা এটাও বিশ্বাস করেন যে মহাবিশ্ব খুবই সুন্দর ও সরল। তাই চূড়ান্ত সূত্রগুলো কখনোই নিছক কোনো দুর্ঘটনা হতে পারে না। মহাবিশ্ব পুরোপুরি এলোমেলো হতে পারে, কিংবা প্রাণহীন ইলেকট্রন ও নিউট্রন দিয়ে গঠিত হতে পারে, কিন্তু কোনো প্রকার জীবসত্তা তৈরি করতে অক্ষম। সেখানে বুদ্ধিমান জীবের আবির্ভাবের কথা না হয় বাদই দিলাম।

আমি এবং আরও কিছু পদার্থবিজ্ঞানী যদি বিশ্বাস করি, বাস্তবতার চূড়ান্ত আইনগুলো হয়তো এক ইঞ্চির চেয়ে ছোট একটা ফর্মুলায় ব্যাখ্যা করা যাবে, তাহলে প্রশ্ন হলো, এই সমীকরণ এল কোথা থেকে?

মার্টিন গার্ডনার বলেছেন, ‘আপেল নিচে পড়ে কেন? কারণ, মহাকর্ষ সূত্র। মহাকর্ষ সূত্র কেন? কারণ, নির্দিষ্ট কিছু সমীকরণ, যা আপেক্ষিকতার তত্ত্বের অংশ। পদার্থবিদেরা হয়তো কোনো দিন একটা চূড়ান্ত সমীকরণ লিখতে সক্ষম হবেন। সেখান থেকে বেরিয়ে আসবে সব ভৌত সূত্রগুলো। তারপরও কেউ তখনো জিজ্ঞেস করে বসতে পারে, ‘এই সমীকরণ কেন?’

আমাদের নিজস্ব তাৎপর্য তৈরি করা

আমি চূড়ান্তভাবে বিশ্বাস করি, এমন কোনো একক সমীকরণের অস্তিত্ব আছে, যা গোটা মহাবিশ্বকে সুশৃঙ্খলভাবে, সুরেলাভাবে ব্যাখ্যা করতে পারবে। আবার সেটা কোনো নকশারও ইঙ্গিত করবে। তবে আমি বিশ্বাস করি না, এই ডিজাইনে ব্যক্তিগত কোনো তাৎপর্য দিতে পারবে মানুষ। পদার্থবিজ্ঞানের চূড়ান্ত সূত্রটি যতই চোখধাঁধানো বা মার্জিত হোক না কেন, সেটা কোটি কোটি আত্মার উন্নতি সাধন করবে না। এমনকি দিতে পারবে না কোনো মানসিক পরিপূর্ণতাও। কসমোলজি কিংবা পদার্থবিজ্ঞান থেকে এমন কোনো ম্যাজিক সূত্র আসবে না, যা জনসাধারণকে মুগ্ধ করবে এবং তাদের আধ্যাত্মিক জীবনকে সমৃদ্ধ করবে।

আমার কাছে জীবনের মানে হলো আমরা নিজেরাই নিজেদের অর্থ তৈরি করি। আমাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ কোনো উচ্চ কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেওয়ার পরিবর্তে তা রচনা করাই আমাদের নিয়তি। আইনস্টাইন একবার স্বীকার করেছিলেন, শত শত ব্যক্তি তাঁর কাছে জীবনের অর্থ উদ্ঘাটনের অনুরোধ জানিয়ে গাদা গাদা চিঠি লিখেছেন। কিন্তু তাঁদের সান্ত্বনা দেওয়ার শক্তি তাঁর নেই। অ্যালান গুথ বলেছেন, ‘এসব প্রশ্ন করা ঠিক আছে। কিন্তু কোনো পদার্থবিদের কাছ থেকে জ্ঞানীর মতো উত্তর আশা করাও উচিত নয়। আমার নিজের অনুভূতি হলো, শেষ পর্যন্ত জীবনের একটা উদ্দেশ্য আছে। আমার অনুমান, এর উদ্দেশ্য হলো আমরা স্বয়ং যে উদ্দেশ্য এতে আরোপ করি। সেটা মহাজাগতিক নকশা থেকে বেরিয়ে আসা কোনো উদ্দেশ্য নয়।’

আমি বিশ্বাস করি, সিগমুন্ড ফ্রয়েড এবং অবচেতন মনের অন্ধকার দিক সম্পর্কে তাঁর সব ধারণা সত্যের কাছে থাকে, যখন তিনি বলেন যে আমাদের মনে যারা স্থিতি ও অর্থ দেয়, সেগুলো হলো কাজ আর প্রেম। কাজ আমাদেরকে দায়িত্ব ও উদ্দেশ্যের অনুভূতি দিতে সহায়তা করে। একই সঙ্গে সহায়তা করে আমাদের শ্রম আর স্বপ্নের প্রতিও দৃঢ়ভাবে মনোযোগ দিতেও। কাজ আমাদের জীবনে শৃঙ্খলা আর কাঠামো এনে দেয়। সঙ্গে এনে দেয় আমাদেরকে গর্বের অনুভূতি, সফলতা ও পরিপূর্ণতার এক কাঠামো। আর প্রেম হলো এক অনিবার্য উপাদান, যা সমাজের বুননের মধ্যে আমাদের ধরে রাখে। প্রেম ছাড়া আমরা হারিয়ে যাই, শূন্য, শিকড়ছাড়া হয়ে যাই। আমাদের নিজেদের কাছে আমরা উদ্দেশ্যহীন মানুষ, অন্যের উদ্বেগের সঙ্গে জড়িত নই।

কাজ আর প্রেম ছাড়াও, আমি আরও দুটি উপাদানের কথা যোগ করতে চাই। সেগুলোও জীবনের অর্থ এনে দেয়। প্রথমত আমরা যে প্রতিভা নিয়ে জন্মেছি তা পূরণ করা। তবে ভাগ্যক্রমে আমরা বিভিন্ন সক্ষমতা ও শক্তি পাই। সেগুলোকে পরিপূর্ণ করে গড়ে তোলার জন্য আমাদের চেষ্টা করা উচিত। নইলে সেগুলো অবক্ষয়ের মুখে পড়ে বিনষ্ট হয়ে যায়। আমরা সবাই এমন ব্যক্তিদের জানি, যারা শৈশবে যেসব প্রতিশ্রুতি দেখায়, পরে তা পূরণ করে না। তারা পরবর্তী সময়ে কী হতে পারত, সেই চিত্রের মধ্যে তাদের অনেকেই হাবুডুবু খেতে থাকে। আমার ধারণা, ভাগ্যকে দোষারোপ না করে আমরা যে রকম ঠিক সেভাবেই আমাদের পরিস্থিতিকে মেনে নেওয়া উচিত। পাশাপাশি আমাদের সাধ্যের মধ্যে যেসব স্বপ্ন আছে, তা পূরণের চেষ্টা করা উচিত।

দ্বিতীয়ত আমরা যখন এই পৃথিবীতে এসেছি, তার তুলনায় পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার আগে একে আরও ভালো জায়গা হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করা উচিত। ব্যক্তিবিশেষে আমরা আলাদা কাজ করতে পারি। সেটা হতে পারে প্রকৃতির গুপ্ত কিছু অনুসন্ধান করে, পরিবেশ পরিষ্কার করে এবং শান্তি ও সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য কাজ করে, কিংবা নিজের কৌতূহলকে প্রতিপালন করে, হতে পারে কম্পিত কোনো তরুণ আত্মার জন্য একজন গুরু ও গাইড হিসেবেও কাজ করে।

টাইপ ১ সভ্যতার ক্রান্তিকাল

আন্তন চেখভের থ্রি সিস্টার্স নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কে কর্নেল ভারশিনিন ঘোষণা করেছিলেন, ‘এক শতক বা দুই শতক কিংবা এক হাজার বছরের মধ্যে মানুষ নতুনভাবে, এক সুখী উপায়ে বেঁচে থাকবে। সেটা দেখার জন্য আমরা হয়তো সেখানে থাকব না। কিন্তু এ কারণেই আমরা বেঁচে থাকি। এ কারণেই আমরা কাজ করি, কষ্টভোগ করি। আমরা সেটা তৈরি করছি। আমাদের অস্তিত্বের এটাই হলো আসল উদ্দেশ্য। আমাদের সুখ কেবল একটাই, শুধু এই লক্ষ্যের জন্য কাজ করে যাওয়া।’

ব্যক্তিগতভাবে, মহাবিশ্বের বিশুদ্ধ বিশালতা দেখে আমি হতাশ হই না। বরং শিহরিত হই এ কথা ভেবে যে আমাদের ঠিক পাশেই একটা আস্ত নতুন বিশ্বের অস্তিত্ব রয়েছে। আমরা এমন এক যুগে বাস করছি, যখন আমাদের মহাকাশ অনুসন্ধানী যান, টেলিস্কোপ এবং আমাদের তত্ত্ব ও সমীকরণ ব্যবহার করে মহাবিশ্বের সূচনা অনুসন্ধান করা সম্ভব হচ্ছে।

আবার আমাদের বিশ্ব যখন এ রকম বীরোচিতভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, ঠিক সেই যুগে বেঁচে আছি ভেবেও নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি। সম্ভবত মানবেতিহাসের সবচেয়ে বড় ক্রান্তিকাল, অর্থাৎ টাইপ ১ সভ্যতার ক্রান্তিকাল, সম্ভবত সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আমরা বেঁচে আছি। কিন্তু এটা মানুষের ইতিহাসের সবচেয়ে বিপজ্জনক ক্রান্তিকালও বটে।

অতীতে আমাদের পূর্বপুরুষেরা একটা কঠোর, ক্ষমাহীন বিশ্বে বসবাস করতেন। মানব ইতিহাসের বেশির ভাগ সময় মানুষের আয়ু ছিল সংক্ষিপ্ত। তারা জীবনযাপন করত নৃশংসভাবে। তাদের গড় আয়ু ছিল প্রায় ২০ বছর। রাত-দিন রোগের ভয়ে ভীত থাকত, নিয়তির করুণার ভেতর বাস করত। আমাদের পূর্বপুরুষদের হাড়গোড় পরীক্ষা করে দেখা গেছে, তারা অবিশ্বাস্য রকম জরাজীর্ণ ছিল, প্রতিদিন তাদের ভারী বোঝা বহন করতে হতো। রোগ আর ভয়াবহ দুর্ঘটনার চিহ্নও বহন করে আমাদের পূর্বপুরুষেরা। এমনকি গত শতকেও আমাদের দাদা-দাদিরা বেঁচে ছিলেন কোনো রকম আধুনিক স্যানিটেশন, অ্যান্টিবায়োটিক, জেট এয়ারপ্লেন, কম্পিউটার কিংবা অন্যান্য বিস্ময়কর ইলেকট্রনিক সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই।

তবে আমাদের নাতি-নাতনিরা পৃথিবীর প্রথম গ্রহসভ্যতার সূচনালগ্নে বাস করবে। আমরা যদি আত্মধ্বংসের জন্য বর্বর প্রবৃত্তির কাছে নিজেদের সঁপে না দিই, তাহলে আমাদের নাতি-নাতনিরা হয়তো তাদের ইচ্ছেমতো বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারবে। ক্ষুধা আর রোগ আর কখনো আমাদের গন্তব্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। আমরা পৃথিবীর সব প্রাণীকে ধ্বংস করতে পারি কিংবা পৃথিবীতেই উপলব্ধি করতে পারি স্বর্গের অনুভূতি। মানুষের ইতিহাসে প্রথমবারের জন্য এখন এই দুই অর্থ বাস্তবায়নের ক্ষমতা আছে আমাদের।

ছোটবেলায় আমি প্রায়ই ভেবে বিস্মিত হতাম যে সুদূর ভবিষ্যতে বেঁচে থাকতে কেমন লাগবে। এখন বিশ্বাস করি, যদি মানবসভ্যতার নির্দিষ্ট যেকোনো যুগে বেঁচে থাকা বেছে নিতে পারতাম, তাহলে এই যুগটাই বেছে নেব আমি। এখন মানব ইতিহাসের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর একটা যুগে রয়েছি আমরা। সর্বকালের সবচেয়ে সেরা কিছু মহাজাগতিক আবিষ্কার ও প্রযুক্তিগত উন্নতির শিখর ছুঁয়েছে এখন মানবজাতি। প্রকৃতির নৃত্যের নিষ্ক্রিয় পর্যবেক্ষক থেকে প্রকৃতির নৃত্যের কোরিওগ্রাফার হয়ে ওঠার মাধ্যমে আমরা ঐতিহাসিক ক্ৰান্তিকাল সৃষ্টি করেছি। জীবন, বস্তু ও বুদ্ধিমত্তা নিপুণভাবে ব্যবহারের ক্ষমতা রয়েছে আমাদের। তবে এই বিস্ময়কর শক্তির সঙ্গে অনেক বড় দায়িত্বও আমাদের কাঁধে এসেছে। সেটা হলো, আমাদের প্রচেষ্টার ফল যাতে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এবং সব মানবতার কল্যাণে ব্যবহার করা হয়, তা নিশ্চিত করা।

পৃথিবীতে এ পর্যন্ত যতসংখ্যক মানুষ পথ হেঁটেছে, তাদের মধ্যে এখন যে প্রজন্ম বেঁচে আছে, তারাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রজন্ম আর আগের প্রজন্মের মতো নয়। আমাদের হাতে ধরা আছে আমাদের প্রজাতির ভবিষ্যতের গন্তব্য। আমরা এখন টাইপ ১ সভ্যতা হিসেবে আমাদের প্রতিশ্রুতি পূরণে এগিয়ে যেতে পারি, নয়তো তলিয়ে যেতে পারি বিশৃঙ্খলা, দূষণ আর যুদ্ধের অতলে। আমাদের নেওয়া সিদ্ধান্তই গোটা এই শতাব্দীজুড়ে প্রতিধ্বনিত্ব হবে। বৈশ্বিক যুদ্ধ পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্র বিস্তার এবং সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত বিবাদ আমরা কীভাবে সমাধান করব, তার ওপর নির্ভর করছে টাইপ ১ সভ্যতার ভিত্তি স্থাপিত হবে, নাকি ধ্বংস হয়ে যাবে। সম্ভবত বৰ্তমান প্রজন্মের জীবনের অর্থ হলো, টাইপ ১ সভ্যতার পথে আমাদের রূপান্তরকে মসৃণ করে তোলা।

পুরোটাই নির্ভর করছে আমাদের ইচ্ছার ওপর। এটাই এখন বেঁচে থাকা প্রজন্মের উত্তরাধিকার। এটাই আমাদের নিয়তি।

তথ্যনির্দেশ

টেলিওলজি বা উদ্দেশ্যবাদ : প্রকৃতি স্পষ্ট ইঙ্গিত করে যে জগতের সৃষ্টির পেছনে একটা পরিকল্পনা আছে। এই মতবাদই টেলিওলজি বা উদ্দেশ্যবাদ বলে পরিচিত। পাশ্চাত্য দর্শনে টেলিওলজির সূচনা হয়েছিল প্লেটো ও অ্যারিস্টোটলের লেখাগুলো থেকে।

ম্যাক্রোস্কোপিক : খালি চোখে দেখার জন্য যথেষ্ট বড় কোনো বস্তু। সাধারণত ০০১ মিলিমিটারের নিচের স্কেলে ব্যবহার করা হয়। এই আয়তনের নিচের স্কেলগুলোকে বলা হয় মাইক্রোস্কোপিক বা অতিক্ষুদ্র।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *