একজন মানুষের নানা রকম পরিচয় থাকে।
রশীদ আলি সাহেবের ব্যাপারে এটা খুবই সত্যি। ঘরে তিনি এক মানুষ, বাইরে সম্পূর্ণ অন্য মানুষ। অতি ভদ্র, অতি বিনয়ী। কেউ তাকে উঁচু গলায় একটা কথা বলতেও শুনেনি। একবার ফার্মগেটের সামনে এক রিকশাওয়ালা তার পয়ে রিকশার চাকা তুলে দিল। তিনি প্রচণ্ড ব্যথায় রাস্তার উপরই বসে পড়লেন। রিকশাওয়ালকে কিছু বললেন না, শুধু আহত চোখে একবার তাকালেন। চাচামিয়া কি হয়েছে, কি হয়েছে বলে তার চারপাশে লোক জমে গেল। তিনি বহু কষ্টে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন,
সেই রশীদ আলিকে আজ তার বাড়িওয়ালা কাটা কাটা কিছু কথা শুনিয়ে দিল। তিনি মাথা নিচু করে শুনে গেলেন। তিনি রাগ করছেন বা মনে কষ্ট পাচ্ছেন এটা তার চেহারা দেখে কিছু বোঝা গেল না। আলাপ-আলোচনার শেষ পর্যায়ে রশীদ আলি হাসিমুখে বললেন, ভাই সাহেব, আজ তাহলে উঠি।
রশীদ আলির বাড়িওয়ালা মুসলেম উদ্দিনের নানান রকম ব্যবসা। তার মধ্যে প্রধান ব্যবসা ঘুপসি ধরনের ফ্ল্যাট বাড়ি বানিয়ে ভাড়া দেয়া। ভাড়া তুলনামূলকভাবে সস্তা। তবে মাসের পাঁচ তারিখের ভিতর ভাড়া দিতে হয়। দুই তারিখে একবার ভাড়াটেদের কাছে ম্যানেজার যায়— আরেকবার যায় পাঁচ তারিখে। যারা ভাড়া দিতে পারে না তাদের অতি অবশ্যই উঠে যেতে হয় তার পরের মাসে। ভাড়াতে ওঠানো মুসলেম উদ্দিনের কাছে কোন ব্যাপারই না। তাঁর পোষা কিছু পাড়ার ছেলে আছে। প্রতি মাসে তিনি এদের সামান্য খরচ দেন। কাজ থাকুক না থাকুক, এই খরচ তারা দীর্ঘদন ধরেই পাচ্ছে। ভবিষ্যতেও পাবে।
রশীদ আলি সাহেবের বিলিডংয়েই বাড়িওয়ালা থাকেন। তিনতলার দুটা ফ্ল্যাটে তার সংসার ছড়ানো। সকাল বেলা তিনি ম্যানেজার পাঠিয়ে রশীদ আলিকে ডেকে পাঠালেন। প্রাথমিক কথাবার্তা লোকে ভদ্রভাবে বলে থাকে। তিনি ভদ্রতার ধরা দিয়েও গেলেন না। হুংকার দিয়ে বললেন,–আপনার ব্যাপারটা কি বলুন তো?
রশীদ আলি বললেন, আপনার কথা বুঝতে পারছি না।
বাড়ির ভেতর স্কুল খুলে বসেছেন। দফায় দফায় মেয়েরা আসছে, যাচ্ছে। যা বলে কটেজ ইন্ডস্ট্রি।
কয়েকটা মেয়েকে প্রাইভেট পড়াই–এ তো নতুন না। অনেক দিন থেকেই পড়াচ্ছি।
অনেকদিন ধরে সহ্য করেছি। আপনাকে কিছু বলিনি। আজ বললাম। এইসব চলবে না।
রশীদ আলি বললেন, অসুবিধাটা কি?
অনেক অসুবিধা। এটা রেসিডেনশিয়াল এলাকা, এটা মেয়েদের স্কুল না। শিক্ষা নিয়ে আপনি ব্যবসা শুরু করেছেন–খুব ভাল কথা, ব্যবসা করবেন। সবাই করছে, আপনি করবেন না কেন? তবে আমার এখানে না। আমি নিবিরোধী লোক, আমি নিরিবিলি পছন্দ করি। মেয়েদের চা-চুম্ব আমার পছন্দ না।
রশীদ আলি বললেন, জ্বি আচ্ছা।
এই মাসটা আপনি থাকেন, সামনের মাসে আপনি আমার বাড়ি ছেড়ে দেবেন। আমি ঠিক করেছি। এখানকার এই ফ্ল্যাট আমি ভাড়া দেব না। নিজে থাকব।
রশীদ আলি বললেন, জ্বি আচ্ছা। ভাই সাহেব, আজ তাহলে উঠি?
রশীদ আলি শান্ত মুখে নিজের ফ্ল্যাটে এলেন। ততক্ষণে পত্রিকা এসে গেছে। তিনি পত্রিকা নিয়ে বাথরুমে ঢুকলেন। আজ শুক্রবার, মেয়েরা কেউ পড়তে আসবে না। ঢ়িলাঢ়ালাভাবে দিন শুরু করা যায়। কিন্তু তিনি আজ তা পারবেন না। আজই বরং তাঁর কাজের চাপ অনেক বেশি। স্ত্রীকে দেখতে হাসপাতালে যেতে হবে, বাজার করতে হবে, ভাড়ার জন্যে নতুন বাড়ি দেখতে হবে। মোসলেম উদ্দিন সাহেবের এই ফ্ল্যাট বাড়িটা তাঁর পছন্দ ছিল। একতলায় থাকেন বলে বাড়তি অনেকখানি জায়গা পেয়েছেন। সমস্যা একটাই–প্রবল বর্ষণের সময় পানি উঠে। তিনি ঠিক করে রেখেছিলেন এবারের বর্ষা শুরুর আগে আগে বাড়ি বদল করবেন। ভেতর থেকে তেমন তাগিদ বোধ করছিলেন না। বাড়িওয়ালার কথার পর সেই তাগিদটা বোধ করছেন। বাড়ি খোজার জন্যে ছুটির দিন খুবই ভাল।
স্ত্রীকে দেখার জন্যে আজ হাসপাতালে না গেলেও হয়, তবে আজ তিনি যাবেন। মনিকার চিঠি এসেছে। সেই চিঠি তিনি সামনে থেকে তার স্ত্রীকে পড়াবেন এবং কিছু কঠিন কথা শোনাবেন। কঠিন কথাগুলি মনিকাকে শোনাতে পারলে আরাম হত। সেটা সম্ভব না বলেই মেয়ের মাকে শোনানো! মেয়েদের অপরাধের দায়ভাগ অনেকাংশে মেয়ের মাদের বহন করতে হয়। ছেলেদের অপরাধের দায়-দায়িত্ব বাবারা কিছুটা বহন করেন। মেয়েদেরটা না।
মনিকা তার মাকে লিখেছে–
মা,
আমার সশ্রদ্ধ সালাম নিবেন। আশা করি সবাইকে নিয়ে ভাল আছেন। গত সোমবার বাবার একটা চিঠি পেয়েছি। বাবা চিঠিতে লিখেছেন তিনি আমাদের ফ্ল্যাট বিক্রি করে সেই টাকা আপনাদের জামাইয়ের একাউন্টে গুরুমা করেছেন। সতেরো লক্ষ টাকা জমা হয়েছে। এই মর্মে ব্যাংকের জমার রশিদ বইয়ের ফটোকপিও পাঠিয়েছেন। যাই হোক, মা এখন একটা কথা–রিয়েল এস্টেটের দাম ঢাকায় হু হু করে বাড়ছে। আমাদের বেলায় কমে গেল কেন? আপনার জামাইয়ের এক বন্ধু কুড়ি লাখ টাকায় এপার্টমেন্ট কিনে এক বছর পর ২ত লাখ টাকায় বিক্রি করেছে। আমরা আঠারো লাখ টাকায়ায় কিনো সতেরো লাখে বিক্রি করলাম। মা, এর মানে কি? আপনার জামাই সন্দেহপ্রবণ মানুষ। সে নানান কথা বলাবলি করছে। আমি তার সব কথা উড়িয়েও দিতে পারছি না। আমি খুবই মনোকষ্টে আছি। মা, তুমি বাবাকে বলবে, কেন কম দামে ফ্ল্যাট বিক্রি করতে হল তা যেন বাবা চিঠি লিখে বিস্তারিত জানান। যার কাছে ফ্ল্যাট বিক্রি হল তার ঠিকানা এবং টেলিফোন নাম্বার আপনার জামাই গোপনে জোগাড় করার চেষ্টা করছে। তার এক চাচাতো ভাই থাকে নারায়ণগঞ্জে। তাকে সে বলেছে যেন সে গোপনে খোঁজ নিয়ে বের করে আসলে ভদ্রলোক বাবাকে ঠিক কত টাকা দিয়েছে। মা, চিন্তা কর কি লজ্জার কথা। আমি খুবই শংকিত, যদি শেষ পর্যন্ত জানা যায় যে ভদ্রলোক আসলে ১৭ লাখের বেশি টাকা দিয়েছেন। যদি এ রকম কিছু হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে। যেন আপনাদের জামাই আসল খবর না জানে। এইসব খবর লিখতেও আমার লজ্জা লাগছে। না লিখেও পারছি না।
এদিকে সমস্যার উপর সমস্যা–তোমার নাতনী ফারজানা আলাদা এক রুমের একটা বাসা ভাড়া নিয়ে ঐ দৈত্যটার সঙ্গে বাস করছে। রাতে আমার ঘুম হয় না মা। গাদা গাদা ঘুমের ট্যাবলেট খাই, তারপরেও সারারাত জেগে বসে থাকি।
তোমার অসুখের কি অবস্থা কিছুই জানি না। শুনেছি, দেশে চিকিৎসার অবস্থা খুব খারাপ। বাবা কেন তোমাকে নিয়ে সিঙ্গাপুর কিংবা ব্যাংকক যাচ্ছে না? আমি বাবাকে এই ব্যাপারে খুব কড়া করে একটা চিঠি লিখব।
ইতি
তোমার মনিকা
যে মেয়ে এ জাতীয় চিঠি লিখতে পারে তার মাকে কঠিন কঠিন কথা শোনানো যায়। অসুস্থ হলেও শোনানো যায়।
রশীদ আলি তার স্ত্রীকে কিছু শোনাতে পারলেন না। হাসপাতালে গিয়ে শুনলেন তাকে ডায়ালাইসিসের জন্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দু থেকে তিন ঘণ্টা লাগবে ডায়ালাইসিস শেষ হতো। এতক্ষণ অপেক্ষা করার মত সময় তার হাতে নেই। তিনি মতির মার হাতে মনিকার চিঠি দিয়ে হাসপাতাল থেকে বের হলেন।
নটা বাজে। কাচা বাজার এখনো জমেনি। তিনি নাপিতের দোকানে চুল কাটাতে ঢুকলেন। সালমা অভিযোগ করছিল চুল বড় হয়েছে।
আসলেই চুল লম্বা হয়েছে। ঘাড়ের কাছে কুটকুট করছে। সালমা মনে না করিয়ে দিলে আরো কিছুদিন এই লম্বা চুল নিয়েই ঘুরতেন। একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর মনে করিয়ে দেবার জন্যে একজনকে লাগে।
চুল কাটতে গিয়ে নাপিতের সঙ্গে তার কিছু সমস্যা হল। দোষ নাপিতের না, তার। নাপিত জানতে চাইল–চুলে কলপ দেয়া হবে কি-না। তিনি রাগী গলায় বললেন, কলপ দেয়ার প্রশ্ন উঠছে কেন? আমি বুড়ো হয়েছি–হয়েছি। চুলে কলপ দিয়ে জোয়ান হব কেন?
নাপিত বলল, অনেকেই দেয় এই জন্যে জিজ্ঞাস করলাম।
অনেকেই দেয় বলে আমিও দেব?
না দিলে না দিবেন। চেতেন ক্যান?
শুটকা নাপিতটাকে একটা চড় দিয়ে শুইয়ে ফেলার জন্যে তাঁর হাত নিশপিশ করতে লাগল। এটাও খারাপ লক্ষণ। নাপিত এমন কোন ভয়ংকর কথা বলেনি যে তাকে চড় দিয়ে শুইয়ে ফেলতে হবে। সে সাধারণ একটা কথা জিজ্ঞেস করেছে। সাধারণ কথাতেই রাগে শরীর কাঁপছে কেন?
নাপিতের দোকান থেকে তিনি নিউমার্কেটের কাচাবাজারে গেলেন। সাপ্তাহিক বাজার সারবেন। মাছ গোশত বেশি করে কিনে রাখলে ঝামেলা কমত। কিনতে পারছেন না। ফ্রীজের গ্যাস চলে গেছে। দোকানে পাঠিয়ে দেন গ্যাস ভরে দিতে। তিনদিনের ভেতর দেয়ার কথা–আজ আঠারো দিন হল দিচ্ছে না। আঠারো দিনেও যদি দিতে না পরে তাহলে কেন বলল, তিনদিনে দেবে। ফ্রীজের দোকানের ছেলেটাকে লাথি মেরে জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিতে পারলে মনটা শান্ত হত। আজ আর ফ্রীজের দোকানে যাওয়া যাবে না–কাল সকালে একবার যাবেন। ঐ হারামজাদাকে সাপের পা দেখাবেন। হারামজাদা শুওরের বাচ্চা–তিনদিনে ফ্ৰীজ দেয়া তোর বের করছি।
রশীদ সাহেব নিজেই নিজের রাগ দেখে অবাক হলেন। এই বয়সে এতটা রাগ হওয়া ঠিক না। স্ট্রোক হয়ে যাবে। এই বয়সটা শান্ত থাকার বয়স।
নিউমার্কেটে নেমে রিকশা ভাড়া দেয়ার সময় তিনি লক্ষ্য করলেন তার মানিব্যাগ নেই। পথে কোথাও পড়ে গেছে। কিংবা পিক পকেট হয়েছে। মানিক্যাগে টাকা ভালই ছিল। বাজার করবেন বলে তিনটা পাঁচশ টাকার নোট নিয়ে বের হয়েছেন। সঙ্গে আরো কিছু ভাংতি টাকা ছিল। বেশি না–কুড়ি পঁচিশ টাকা হবে। তিনি রিকশাওয়ালাকে শান্ত গলায় ম্যানিব্যাগ চুরির কথা বললেন। রিকশাওয়ালা বিরক্ত মুখে তাকিয়ে রইল।
তুমি আমার সঙ্গে বাসায় চল। ঐখানে টাকা দিয়ে দিব।
বাসা কই?
মগবাজার ওয়ারল্যাস অফিসের পেছনে।
মগবাজারে যমুনা।
না গেলে ভাড়া দিব কি ভাবে?
হেইডা আপনের বিষয়।
যা ভাড়া হয় তার থেকে দুটা টাকা বেশি দিব।
ঐ হানে রাস্তাত গ্যাঞ্জাম, যমুনা।
আমি তো তাহলে ভাড়াটা দিতে পারছি না।
যান, ভাড়া লাগব না।
রিকশাওয়ালা আবার হাই তুলল। তার গা ঘামে ভেজা। প্রায় দুমাইল রাস্তা সে রশীদ সাহেবকে টেনে এনেছে। ক্লান্তিতে ভেঙ্গে পড়েছে বলেই বোধ হয় ঘন ঘন হাই তুলছে। রশীদ সাহেবের মনে হল সে যে গ্যাঞ্জামের কারণে মগবাজার যেতে চাচ্ছে না–তা না, তার আসলে কিছুক্ষণ বিশ্রাম দরকার। সে রিকশার সিটে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করবে, তারপর যাবে।
রশীদ সাহেব দেখলেন। তিনি যা ভেবেছেন তাই হয়েছে। রিকশাওয়ালা সীটে উঠে বসেছে। রিকশাওয়ালারা রিকশার সীটে যাত্রীদের মত বসে না। এবং বসেই দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ে।
রশীদ সাহেব বললেন, তোমার ঠিকানা কি, থাক কোথায়?
শংকর।
শংকরে কোন জায়গায় থাক? আমি তোমার ভাড়া পাঠিয়ে দেব।
তুলা পট্টির পিছে।
তুলা পট্টিটা কোথায়?
জানি না।
নাম কি তোমার?
বছির।
বছির, আমি তোমাকে ভাড়া পাঠিয়ে দেব। আজকালের মধ্যেই পাঠাব।
বছির জবাব না দিয়ে বিড়ি ধরাল। তাকে বিড়ি টানতে দেখে রশীদ সাহেবেরও সিগারেট ধরাতে ইচ্ছে করল। সেটাও সম্ভব হচ্ছে না। মানিব্যাগের সঙ্গে সিগারেটের প্যাকেট এবং দেয়াশলাই পিক পকেট হয়েছে। রশীদ সাহেব নিউমার্কেট থেকে হেঁটে মগবাজারের দিকে রওনা হলেন। একটা রিকশা নিয়ে নিতে পারতেন। তার ইচ্ছা করছে না। সারা পথ তিনি মনে করতে করতে হাঁটলেন–
বছির
তুলাপট্টি
শংকর
বছির
তুলাপট্টি
শংকর।।
দরজা খুলে দিল কাজের মেয়ে। এই মেয়েটাকে নতুন রাখা হয়েছে। সে কোন কাজই করতে পারে না। দরজা খুলে সে দরজা ধরেই দাঁড়িয়ে আছে। দরজা থেকে না সরলে মানুষ ঢুকবে কি ভাবে? তিনি নীতিগতভাবে কাজের লোকদের সঙ্গে হৈ চৈ চিৎকার করেন না। নিজের মেধা বা বুদ্ধি খাটিয়ে এরা কিছু করে না, কাজেই এদের উপর রাগ করা অর্থহীন। তবু তিনি রাগ সামলাতে পারছেন না। তাঁর ইচ্ছা করছে কঠিন একটা ধমক দিয়ে মেয়েটার পিলে চমকে দেন। তিনি অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ঘরে কে আছে?
ছোট ভাইয়া আছে।
আর কেউ নাই?
মিলি আফা গেছে। হাসপাতালে।
বড় হাঁদারামটা কোথায়?
বড় ভাইজান আখনো ফিরে নাই।
দরজা থেকে সরে দাঁড়া। ফরহাদকে ডাক।
ফরহাদ ভয়ে ভয়ে সামনে এসে দাঁড়াল। রশীদ সাহেব থমথমে গলায় বললেন, কি করছিলি?
পড়ছিলাম।
এত পড়িস না। বেশি পড়লে বিদ্যাসাগর হয়ে যাবি।
ফরহাদ অস্বস্তি নিয়ে একবার বাবার দিকে তাকাচ্ছে–আর একবার বসার ঘরের দরজার দিকে তাকাচ্ছে। যেন এক্ষুণি দরজা দিয়ে কেউ ঢুকে তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করবে।
রশীদ সাহেব পুত্রের অস্বস্তি কিছুক্ষণ দেখলেন। তিনি আশা করেছিলেন, তার রাগটা পড়ে যাবে। পড়ল না। কেন পড়ল না। তাতেও তিনি বিস্মিত হলেন। এই বয়সে রাগ মনের উপর চেপে থাকা খুব খারাপ।
ফরহাদ!
জ্বি।
এক্ষুণি একটা রিকশা নিয়ে শংকর চলে যা।
জ্বি আচ্ছা।
সেখানে তুলাপট্টি বলে একটা জায়গা আছে। এক রিকশাওয়ালা সেখানে থাকে। তাকে খুঁজে বের করবি।
জ্বি আচ্ছা।
তাকে দশটা টাকা দিয়ে আসবি।
জ্বি আচ্ছা।
রশীদ সাহেব অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন–তাঁর পুত্র (তার ভাষায়, কনিষ্ঠ হাঁদারাম) দরজা দিয়ে বের হয়ে যাবার উপক্রম করছে। যে রিকশাওয়ালাকে তার খুঁজে বের করার কথা তার নামটা পর্যন্ত জিজ্ঞেস করার সে প্রয়োজন বোধ করেনি। সে যে শংকর যাবে তার ভাড়াও বোধহয় তার কাছে নেই। তিনি একবার ভাবলেন–ছেলেকে ভেকে রিকশাওয়ালার নামটা বলে দেবেন–তারপর মনে হল যা ইচ্ছা করমিক। হাদারামের শিক্ষা হোক। যখন কাউকে না পেয়ে ফিরে আসবে তখন আবার পাঠানো হবে। তাঁতের মাকুর মত ক্রমাগত ঘোরাফিরা করতে থাকবে।
কাজের মেয়ে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, চা খাইবেন চাচাজান? তিনি বললেন, যা সামনে থেকে।
রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। সন্ধ্যা থেকে ইলেকট্রিসিটি ছিল না। কিছুক্ষণ আগে এসেছে। ট্র্যান্সফরমার জুলে গিয়েছিল। ঠিকঠাক করতে এতক্ষণ লাগল। রশীদ সাহেব গোসল করে বারান্দায় বসে চা খাচ্ছেন। এটি তার চতুর্থ কাপ চা। তিনি চিন্তায় অস্থির হয়েছেন। যদিও অস্থিরতা প্রকাশ করছেন না। ফরহাদ সেই যে গিয়েছে এখনো ফেরেনি। তাঁর মন বলছে ছেলেটা এখনো শুকনো মুখে তুলাপট্টিতে ঘোরাঘুরি করছে। রিকশাওয়ালাকে খুঁজে পাচ্ছে না–পাওয়ার কথাও না। বাসায় ফিরে আসার সাহসও পাচ্ছে না। তার উচিত ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আরো সহজ হওয়া। সবাই তাকে যমের মত ভয় করবে। এটা কোন কাজের কথা না।
এত রাত পর্যন্ত ছেলেটা বাইরে সেটাও একটা দুঃশ্চিন্তার কথা। শহর আগের মত নেই। মুড়ি মুড়কির মত এখন ড্রাগ পাওয়া যাচ্ছে। ডাষ্টবিনের এক অংশ ভর্তি থাকে ফেনসিডিল নামের কফ সিরাপের বোতলে। এককালের ভদ্র শান্ত ছেলেরা এখন ড্রাগের পয়সা জোটানোর জন্যে আধা পাগলের মত রাস্তায় নামে। যে ভাবেই হোক কিছু টাকা জোগাড় করতে হবে। পাকের কোন অন্ধকার কোণে গায়ের সার্ট খুলে গোল হয়ে বসতে হবে। ড্রাগ নেয়ার শুরুতে শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসে। গায়ে কাপড় চোপড় থাকলে তখন হাসফাস লাগে।
ফরহাদ এদের খপ্পরে পড়েনিতো? অস্বাভাবিক কিছু না–বরং এদের খপ্পরে পড়াই স্বাভাবিক। বেকুব টাইপের ছেলে–এদের খপ্পরে পড়লে উপায় আছে? টাকা পয়সা না পেয়ে এরাতো মেরেই আধামরা করে ফেলবে।
কাজের মেয়ে ভয়ে ভয়ে বলল, খালুজান ভাত দিব?
তিনি বললেন, দাও। নিজের অস্থিরতা তিনি বাইরে প্রকাশ করবেন না। স্বাভাবিক কাজ কম করে যাবেন। রাত বারটা পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন। বারটার পর যা করার করবেন।
রাত বারোটা বাজল, একটা বাজল, দুটা বাজল। ফরহাদ বা আতাহার দুজনের কেউই ফিরল না।
ফরহাদ শংকর যায়নি। ভয় পেয়ে সে ঘর থেকে টাকা ছাড়া বের হয়ে গিয়েছিল। সন্ধ্যা পর্যন্ত সে তার এক বন্ধুর বাড়িতে কাটাল। সন্ধার পর থেকে বাসার কাছেই বনফুল মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে বসে আছে। বনফুল মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মালিকের সঙ্গে তার মোটামুটি চেনাজােনা আছে। মেহমান এলে এখান থেকে মিষ্টি নিমকি কেনা হয়। ফরহাদ ক্ষিধেয় অস্থির হয়ে বাকিতে দুটা কালোজাম, এক প্লেট দই এবং দেড়খানা নিমকি খেয়েছে। মিষ্টি তার সহ্য হয়না বলেই এরপর থেকে তার শুধু টক ঢেকুর উঠছে। গা গুলাচ্ছে। বারটার সময় মিষ্টির দোকান বন্ধ হয়ে গেলো। সে রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করতে থাকল। আতাহারের জন্যে অপেক্ষা–আতাহার এলেই এক সঙ্গে বাসায় ফিরবে। দুজন থাকলে একটা ভরসা। তাছাড়া আতাহার বন্ধ দরজা বাইরে থেকে খোলার একটা কৌশল জানে। পেনসিল কাটা ছুড়ি দরজার ফাঁক দিয়ে ঢুকিয়ে বিশেষ কায়দায় কিছুক্ষণ নাড়াচারা করলেই ছিটকিনি নিচে নেমে আসে।
রাত একটার দিকে ফরহাদ খোঁজ নিয়ে গিয়েছে–সদর দরজা বন্ধ। ভেতরের বাতি নেভানো। অর্থাৎ সবাই ঘুমুচ্ছে।
দরজা ধাক্কাধাব্ধি করে বাবার ঘুম ভাঙ্গানোর দুঃসাহস তার নেই। তারা একমাত্র ভরসা। আতাহার। সে না ফেরা পর্যন্ত তাকে রাস্তায় এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত হাঁটাহাঁটি করতে হবে।
আতাহার রাত দুটার দিকেই বাড়ির দিকে রওনা হয়েছিল–। কাওরান বাজার থেকে রিকশা বা শেয়ারের টেম্পো নেবে। এ রকম পরিকল্পনা। মোড়ে সব সময় টেম্পো পাওয়া যায়। ঢাকা শহরে টেম্পোগুলি আশীর্বাদের মত। এক টাকায় অনেক দূর যাওয়া যাচ্ছে, দ্রুত যাওয়া যাচ্ছে এবং সীটে বসে যাওয়া যাচ্ছে। কাওরান বাজার মোড় পর্যন্ত আসার আগেই একটা ঘটনা ঘটল। পুরো শহরের ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। শহর অবশ্যি অন্ধকার হল না। বরং চারদিক আচমকা ঝলমল করে উঠল–আকাশে প্রকাণ্ড রূপার থালার মত চাঁদ উঠেছে। আজ আষাঢ়ি পূর্ণিমা। এই আষাঢ় পূর্ণিমায় রাজকুমার সিদ্ধার্থ গৃহত্যাগ করেছিলেন। এই পূর্ণিমা বিশেষ একটা পূর্ণিমা। যে পূর্ণিমায় গৃহত্যাগ করতে হয়। এই পূর্ণিমায় ঘরে ফিরে যাওয়া যায় না। কাজেই সে রওনা হল মীরপুরের দিকে। বোটানিক্যাল গার্ডেনে ঢুকে পড়তে হবে। রাত দশটার পর বোটানিক্যাল গার্ডেনের গেট বন্ধ হয়ে যায়–কোন ফাঁক-ফোকর দিয়ে ঢুকে পড়ার কৌশল বের করতে হবে। তাও যদি না করা যায় মুনশি নামের একজন দারোয়ান আছে–তাকে ধরতে পারলেও কাজ হবে।
জোছনা একা দেখা যায় না। সঙ্গি লাগে।
সঙ্গিনী পাশে নিয়ে জোছনা দেখতে কেমন লাগে কে জানে। খুব ভাল লাগবে বলে মনে হয় না। মেয়েদের নিজের দিকে নজর খুব বেশি থাকে। প্রকৃতি দেখতে হলে নিজেকে সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে দেখতে হয়।
ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় সাথী নামের একটা মেয়ের সঙ্গে তার মোটামুটি পরিচয় হয়েছিল। তাকে নিয়ে সে কাশফুল দেখতে গিয়েছিল। সাভারে নদীর পাড় ঘেঁসে লক্ষ লক্ষ কাশফুল ফুটেছিল। সাথী কাশফুল দেখে যত না মুগ্ধ তার চেয়েও বেশি বিরক্ত তার শাড়িতে চোরকাঁটা ফুটছে দেখে। সে ঠোঁট সরু করে ক্রমাগত বলতে লাগলো, এ কোথায় নিয়ে এলে বল তো? চোরকাটা সূঁচের মত পায়ে লাগছে।
আতাহার বলল, চল কাশবনের ভেতর দিয়ে দৌড়াই।
সাথী বলল, কাশীবনের ভেতর দিয়ে শুধু শুধু দৌড়াব কেন?
আতাহার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটির প্রতি উৎসাহ হারিয়ে ফেলল। সাথী অবশ্যি তারপরেও কিছুদিন উৎসাহ বজায় রেখেছিল, তারপর কোন শুভক্ষণে লাল শাড়ি পরে এক ইঞ্জিনীয়ার সাহেবকে বিয়ে করে ফেলল। একদিন বিকেলে বিজয় সরণি ধরে সে সেকেন্ড ক্যাপিটেলের দিকে যাচ্ছে, হঠাৎ শুনে–আতাহার আতাহার! বলে বিবৰ্ণ গলায় কে যেন ডাকছে। আতাহার তাকিয়ে দেখে–সাথী। সাথীর পাশে হাওয়াই শাট গায়ে এক ভদ্রলোক। সাথীর স্বামী। গাড়ি থামিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে ফুচকা খাচ্ছেন। নতুন বিবাহিত স্বামীদের বেশ কিছুদিন স্ত্রীর মনোরঞ্জনের জন্যে ফুচকা চটপটি এইসব খেতে হয়। ভদ্রলোকের সেই স্টেজ চলছে।
আতাহার তাদের দিকে হাসিমুখে এগিয়ে গেল। সাথী বলল, এই, তুমি আমার বিয়েতে আসনি কেন? আমি নিজে তোমাকে কার্ড দিয়ে এসেছি, তারপরেও এলে না। এর মানে কি?
মিথ্যুক। আসলে তুমি আসনি হিংসায়।
সাথী স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল, এই শোন, বিয়ের আগে আতাহার আমার প্রেমে হাবুড়ুবু খাচ্ছিল।
ভদ্রলোক উৎসাহিত হবার মত ভঙ্গি করে বললেন, তাই নাকি?
সাথী বলল, হ্যাঁ। তারপর একদিন আমাকে ভজিয়ে ভাজিয়ে সাভারে নিয়ে গেছে কাশফুল দেখাতে।
তারপর?
কাশফুল দেখলাম। তখন সে বলে, এসো দুজনে মিলে কাশীবনের ভেতর দিয়ে দৌড়াই। আমি বললাম, পাগল হয়েছ? আমি কাশীবনের ভেতর দিয়ে শুধু শুধু দীেড়াব কেন? সে বলে কি, সৌন্দর্য দেখার জন্যে।
সাথীর স্বামী হাসতে হাসতে বললেন, সৌন্দৰ্য্য—টোন্দর্য কিছু না। ভদ্রলোকের অন্য পরিকল্পনা ছিল। সাপের হাঁচি বেদেয় চেনে। ঠিক না আতাহার সাহেব?
আতাহার কিছু বলতে পারল না, সাথী হেসে প্রায় ভেঙে পড়ল। ভদ্রলোক মানিব্যাগ থেকে কার্ড বের করে বললেন–কার্ডটা রাখুন। একদিন এসে আপনার প্রাক্তন বান্ধবীর সংসার দেখে যাবেন।
আতাহার কার্ড রাখল। হাফপ্লেট ফুচকা এবং হাফপ্লেট চটপটি খেল।
ইঞ্জিনীয়ার ঐ ভদ্রলোক কি সাথীকে কখনো জোছনা বা কাশফুল দেখাতে নিয়ে গেছেন? সাথীদের ঠিকানা লেখা কার্ডটা আতাহারের মানিব্যাগের সাইড পকেটে এখনো আছে। তার বাসায় গিয়ে উপস্থিত হলে কেমন হয়? সাথীর স্বামীকে সে বলবে, ভাই, আপনার স্ত্রীকে কি ধার দেবেন? তাকে নিয়ে জোছনা দেখব।
ইলেকট্রিসিটি এখনো আসেনি। শহর এখনো অন্ধকারে ড়ুবে আছে–তবে কিছু ফাজিল দোকানদার নিজস্ব জেনারেটার চালু করে দিয়েছে। চার্জার নামের এক বস্তু চালু হয়েছে–ইলেকট্রিসিটি না থাকলে আপনা আপনি জ্বলে ওঠে।
জেনারেটার এবং চার্জারের আলো সত্বেও দোকানটা মারাত্মক লাগছে। সিদ্ধার্থ ভাল সময়েই গৃহত্যাগ করেছেন। আতাহারের ভুরু কুঁচকে যাচ্ছে, কবিতার লাইন মাথায় আসছে আসছে করেও আসছে না–
প্রতি পূর্ণিমার মধ্যরাতে একবার আকাশের দিকে তাকাই
গৃহত্যাগি হবার মত জোছনা কি উঠেছে?
বালিকা ভুলানো জোছনা নয়।
যে জোছনায় বালিকার ছাদের রেলিং ধরে ছুটাছুটি করতে করতে বলবে–
ও মাগো, কি সুন্দর চাঁদ।
নব দম্পতির জোছনাও নয়।
যে জোছনা দেখে স্বামী গাঢ় স্বরে স্ত্রীকে বলবেন–
দেখো দেখো নীতু চাদটা তোমার মুখের মতই সুন্দর।
কাজলা দিদির স্যাঁতস্যাতে জোছনা নয়।
যে জোছনা বাসি স্মৃতিপূর্ণ ডাস্টবিন উল্টে দেয় আকাশে।
কবির জোছনা নয়। যে জোছনা দেখে কবি বলবেন–
কি আশ্চর্য রূপার থালার মত চাঁদ।
আমি সিদ্ধার্থের মত গৃহত্যাগী জোছনার জন্যে বসে আছি।
যে জোছনা দেখা মাত্র গৃহের সমস্ত দরজা খুলে যাবে–
ঘরের ভেতর ঢুকে পড়বে বিস্তৃত প্রান্তর।
প্রান্তরে হাঁটব, হাঁটব আর হাঁটব–
পূর্ণিমার চাঁদ স্থির হয়ে থাকবে মধ্য আকাশে।
চারদিক থেকে বিবিধ কণ্ঠ ডাকবে–আয় আয় আয়।
অল্প কিছুদূর এগুতেই ঝুমঝুষ্টি নেমে গেল। বর্ষাকালে হঠাৎ করে ঝুমঝুষ্টি নামে না। বৃষ্টির বেগ আস্তে আস্তে বাড়ে। হঠাৎ কুমবৃষ্টি নামে ভদ্র মাসে। হুড়মুড় করে খানিকক্ষণ বৃষ্টি হয়–আবার থেমে যায়। আবহাওয়া উল্টে-পাল্টে যাচ্ছে। গ্ৰীন হাউজ এফেক্ট। বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্যে লোকজন দৌড়াচ্ছে–আতাহারও দৌড়াচ্ছে। কোন একটা দোকানে ঢুকে পড়তে হবে।
আতাহার দৌড়ে যে দোকানে ঢুকাল তার নাম লৌহবিতান। জরাগ্রস্ত বৃদ্ধ জুলজুলি চোখে আতাহারকে দেখছে। তার চোখ কঠিন। ভুরু কুঁচকে আছে। আতাহার বলল, কেমন আছেন বুড়ো মিয়া?
বুড়ো জবাব দিল না। আতাহারের মনে পড়ল। এই বুড়োর হাত থেকে সে একটা ছাতা নিয়ে গিয়েছিল। ফেরত দেয়া হয়নি। কোথায় আছে সে ছাতা কে জানে। বর্ষাকালে লোকজন ঘর থেকে ছাতা বের করে মাথা শুকনা রাখার জন্যে নয়, হারানোর জন্যে। মিলির বাহারি ছাতাটা আজ যেমন সে রেখে এসেছে গনি সাহেবের বাড়িতে। এই ছাতা আর ফেরত পাওয়া যাবে না। জরাগ্রস্ত এই বৃদ্ধের ছাতাও ফেরত পাওয়া যাবে না।
লৌহবিতানের মালিক আবদুল্লাহ ঠিক আগের ভঙ্গিতে বসে আছেন। হাতে বই। দূর থেকে মনে হচ্ছে লোকনাথ ডাইরেক্টরি পঞ্জিকা। হোলসেল ব্যবসা যারা করে তারা পঞ্জিকা খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ে। আতাহার হাসিমুখে এগিয়ে গেল। আন্তরিক ভঙ্গিতে বলল, চিনতে পেরেছেন?
আবদুল্লাহ হাতের বই নামিয়ে বলল, জ্বি।
আমার নাম কি বলুন তো?
আপনার নাম বলতে পারব না। ঐ দিন আপনি আপনার নাম বলেননি, তবে একজনকে টেলিফোন করছিলেন–তার নাম নীতু।
আপনার স্মৃতিশক্তি অসাধারণ।
আমার স্মৃতিশক্তি অসাধারণ না। আমার স্ত্রীর নাম নীতু, এজন্যেই নীতু নামটা আমার মনে আছে। আপনি বসুন–দাঁড়িয়ে আছেন কেন? চা খাবেন?
জ্বি খাব।
আবদুল্লাহ ঘাড় ঘুরিয়ে চায়ের কথা বলল। আতাহার তার পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। বাড়িয়ে ধরল। আবদুল্লাহ বলল, আমি সিগারেট খাই না।
আতাহার সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, আপনি বলেছিলেন, আবহাওয়ার ব্যাপারে। আপনার সিক্সথ সেন্স খুব প্রবল। আগেরবার যখন এসেছিলাম। আপনি বলেছিলেন রাত দশটায় বৃষ্টি থামবে–ঐ দিন বৃষ্টি হয়েছে রাত দুটা পর্যন্ত।
নিশ্চিত করে কিছুই বলা যায় না। সম্ভাবনার কথা বলা যায়।
ঐ দিন। কিন্তু আপনি পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েই বলেছিলেন।
ভুল করেছিলাম।
আমি আপনার ছাতাটা হারিয়ে ফেলেছি।
পুরানো একটা ছাতা হারালেও কিছু না।
চা নিয়ে বুড়ো এসেছে। আজ বুড়োকে অন্যদিনের চেয়েও কাহিল মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে হাঁটতে পারছে না। চায়ের কাপ নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাবে। আতাহার এবং আবদুল্লাহ দুজনই চা শেষ করল। নিঃশব্দে। আবদুল্লাহ বলল, বৃষ্টি থেমে গেছে, আপনি ইচ্ছা করলে চলে যেতে পারেন।
আতাহার বলল, আপনার অসুবিধা না হলে খানিকক্ষণ বসি। গল্প করি।
বসুন। গল্প করুন। কিছু মনে করবেন না–আপনি কি অভিনয় করেন? টিভিতে কখনো নাটক-টাটক করেছেন, কিংবা সিনেমায়?
আতাহার বিস্মিত হয়ে বলল, না তো। অভিনয় এখনো করিনি, তবে সামান্য সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। আমার পরিচিত এক ভদ্রলোক আমাকে এক ফিল্ম ডাইরেক্টরের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। ডাইরেক্টর সাহেবের নাম মনসুর আলি। উনি একটা ছবি বানাচ্ছেন–ছবির নাম জানি দুশমন। আমার ঐ ছবিতে নায়কের রোল করার ক্ষীণ সম্ভাবনা আছে।
ক্ষীণ বলছেন কেন?
ক্ষীণ, কারণ যিনি নায়িকার রোল করবেন। তিনি ফিল্ম লাইনের বিখ্যাত এক নায়িকা। তার নাম মৌ। তিনি যদি আমাকে পছন্দ করেন। তবেই আমার নায়ক হবার সুযোগ হবে। তাঁর কাছে আমাকে একটা ইন্টারভ্যু দিতে হবে।
ইন্টারভূটা কবে?
ম্যাডাম মৌ গেছেন নেপালে। ছবির শ্যুটিং হচ্ছে। নেপাল থেকে ফিরলেই উনার সামনে ডাইরেক্টর সাহেব আমাকে নিয়ে যাবেন। আমার প্রধান কাজ হচ্ছে ম্যাডামকে খুশি করা।
ম্যাডাম বলছেন কেন?
ম্যাডাম বলছি, কারণ নায়িকাদের ম্যাডাম ছাড়া অন্য কিছু বললে তঁরা খুব রাগ করেন। এই হল সিনেমা লাইনের নিয়ম।
আবদুল্লাহ হেসে ফেলল। আতাহার মুগ্ধ হয়ে এই হাসি দেখল। কোন পুরুষমানুষ এত সুন্দর করে হাসতে পারে তার জানা ছিল না। এই ক্ষমতা প্রকৃতি অকৃপণ হাতে মেয়েদের দিয়েছে। মেয়েরা কারণ্যে-অকারণে এই ক্ষমতা ব্যবহার করে। মেয়েরা জানে না যে হাসিমুখে পুরুষদের কাছে তারা যদি কিছু চায়–পুরুষদের তা দিতেই হবে। তারা জানে না বলেই–চাইবার সময় চোখের জলে চায়, বা রাগ করে চায়। হাসে না।
আবদুল্লাহ বললেন, আপনি কি দেখছেন?
আপনার হাসি দেখছি। আপনার হাসি যে কত সুন্দর তা কি কেউ আপনাকে কখনো বলেছে?
হ্যাঁ বলেছে। তবে আমি হাসি খুব কম। অনেক দিন পর আপনার কথা শুনে হাসলাম।
আপনার চেহারা কোন অভিনেতার মত কি-না জানি না–কারণ আমি টিভি— সিনেমা দেখি না। আমার স্ত্রী বলছিল।
উনি আমাকে দেখলেন কোথায়?
আমার এই দোকানোই দেখেছে। ও প্রায়ই দোতলা থেকে নিচে নেমে আসে। পার্টিশানের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে থাকে। আপনি যখন প্রথমবার এসেছিলেন তখন সে আপনাকে দেখেছে। আপনি চলে যাবার পরে আপনার কথা জিজ্ঞেস করছিল।
ও আচ্ছা। আজো কি তিনি দেখে গেছেন?
হ্যাঁ, আপনি যখন চা খাচ্ছিলেন তখন এসে দেখে গেলো। আমাদের বিয়ের গল্পটা খুবই সুন্দর। একদিন আপনাকে বলব।
আজ বলুন। আজ আমার কোন কাজকর্ম নেই।
আজ না। আজ আপনি বৃষ্টির হাত থেকে বীচার জন্যে আমার দোকানে এসেছেন। বৃষ্টি ছাড়া শুকনা খটখাটে কোন দিন। আপনি আসবেন–আমি গল্পটা আপনাকে বলব। মোটামুটি একটা ভৌতিক প্রেমের গল্প।
আতাহার উঠে দাঁড়াল। আবদুল্লাহ বলল, আগে যে কার্ডটা দিয়েছিলাম সেটা নিশ্চয় হারিয়ে ফেলেছেন। আরেকটা রাখুন। আমাকে সব সময় টেলিফোনে পাবেন। আমি কখনো এই দোকান এবং দোকানের উপরের আমার বাড়ির বাইরে যাই না। গত পাঁচ বছরে যাইনি।
পা-নেই মানুষরাও তো বাইরে ঘোরাফিরা করে।
আমি করি না।
আতাহার যখন বের হয়ে এসেছে তখন আবার টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। বৃষ্টিতে নেমেই তার মনে হল, আজো আবদুল্লাহকে সে তার নাম দিয়ে আসেনি। আবদুল্লাহ তার নাম জানে না। সে শুধুই নীতুর নাম জানে।
বৃষ্টি জোরেসোরে নেমেছে। আবার দৌড়ে কোন দোকানঘরে আশ্রয় নিতে ইচ্ছা করছে না। নতুন কারো সঙ্গে পরিচিত হতে ইচ্ছা করছে না। বরং ইচ্ছা করছে বৃষ্টিতে ভিজতে।
আতাহার বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে এগুচ্ছে—তার মজিদের কথা মনে পড়ছে। ভাল বৃষ্টি নামলেই সে একটা ছাতা জোগাড় করতো। সেই ছাতা বগলে রেখে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে এগুত। পরিচিত—অপরিচিত অনেকেই জিজ্ঞেস করত, ছাতা বগলে রেখে বৃষ্টিতে ভিজছেন কেন? মজিদ তার উত্তরে খুবই আন্তরিক ভঙ্গিতে বলতো, এটা আমার রোদের ছাতা, বৃষ্টির ছাতা নয়। মজিদের সঙ্গে অনেকদিন দেখা হয় না।
মজিদকে সে দীর্ঘ একটা চিঠি লিখেছিল। মজিদ তার উত্তরে একটা আর্জেন্ট টেলিগ্রাম করেছে–টেলিগ্রামে লেখা–
I am well.
আমি ভাল আছি।
সেই ভাল থাকাটা কি রকম ভাল থাকা একবার গিয়ে স্বচক্ষে দেখে আসা দরকার। সাজ্জাদকে রাজি করিয়ে কোন এক গভির রাতে মজিদের নেত্রকোনার বাসায় উপস্থিত হতে হবে। মজিদের জন্যে অবশ্যই উপহার হিসেবে গাঁজা নিয়ে যেতে হবে। গাজা— বিষয়ে মজিদের সর্বশ্রেষ্ঠ উক্তি হচ্ছে–সমস্ত জগৎটাই যে ধোঁয়া তা গাজার ধোঁয়া মাথায় না গেলে বোঝা যায় না। জগতের অনিত্যতার ব্যাপারটি পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে জানানোর জন্যে সবাইকে খুব ভালমত একবার গাঁজা খাওয়ানো দরকার।
আতাহার হাঁটছে। বৃষ্টিতে সে পুরোপুরি নেয়ে উঠেছে। সে হাঁটছে নিবিকীর ভঙ্গিতে। তাঁর হাঁটার ভেতর কি কোন অস্বাভাবিকতা আছে? লোকজন কৌতূহলী চোখে তার দিকে তাকাচ্ছে। মানুষের কৌতূহলী দৃষ্টি আকর্ষণ করা সহজ ব্যাপার না। তার জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। সে শুধুমাত্র বৃষ্টিতে ভিজেই এই কাজটি করতে পারছে। জানি দুশমন ছবির পরিচালককে বলতে হবে–ভাই, নায়িকারা বৃষ্টিতে ভেজার দৃশ্য নিশ্চয়ই দু-তিনটা থাকবে–নায়কদের বৃষ্টিতে ভিজে হেঁটে যাবার দৃশ্য একটা রেখে দেবেন। তো? দেখবেন আমি কেটে বের হয়ে যাব।
বৃষ্টিতে ভেজা নিয়ে মজিদের একটা অসাধারণ কছিাড়া আছে। কছিাড়া হচ্ছে কবিতা + ছড়া? মজিদের ভাষায় কছিড়া হচ্ছে অর্ধেক কবিতা এবং অর্ধেক ছড়া।
আমার বন্ধুর বিয়ে
উপহার বগলে নিয়ে
আমি আর আতাহার
মৌচাক মোড়ে এসে বাস থেকে নামালাম
দু’ সেকেন্ড থামলাম।
টিপটিপ ঝিপঝিপ
বৃষ্টি কি পড়ছে?
আকাশের অশ্রু ফোটা ফোটা ঝরছে?
আমি আর আতাহার
বলুন কি করি আর?
উপহার বগলে নিয়ে আকাশের অশ্রু
সারা গায়ে মাখলাম।।
হি হি করে হাসলাম।।