১২. মাক্কু চোরার বউ

১২. মাক্কু চোরার বউ

দুপুরবেলা সূৰাই পুকুরে গোসল করতে নেমেছে, তখন রাশা জয়নবকে বলল, “আয় দেখি, কে বেশি সময় পানিতে ডুবে থাকতে পারে।”

জয়নব বলল, “ঠিক আছে।”

জিতু বলল, “আমিও ডুবে থাকব।”

রাশা বলল, “তোর সাথে কম্পিটিশনে যেয়ে লাভ নাই। তুই তো আর মানুষ না, তুই হচ্ছিস বাইন মাছ।”

জিতু হি হি করে হেসে বলল, “আজিব! তুমি আজিব!”

তারপর তিনজন একসাথে পানিতে ডুব দিল। রাশার একসময় যেরকম পানি নিয়ে একধরনের ভয় ছিল এখন সেটি নেই। জিতুর মতো না হলেও সে মোটামুটি পানিতে সাঁতার দিতে পারে। পানিতে ডুবে পুকুরের একমাথা থেকে প্রায় অন্যমাথায় চলে যেতে পারে। ইদানীং শুরু হয়েছে নতুন খেলা, কে কতক্ষণ পানিতে ডুবে থাকতে পারে তার কম্পিটিশন। প্রথম প্রথম কয়েক সেকেন্ড পরেই রাশা ছটফট করে পানি থেকে বের হয়ে আসত। আজকাল দীর্ঘ সময় সে নিশ্বাস না নিয়ে পানিতে ডুবে থাকতে পারে। আজকেও সে কম্পিটিশনে জয়নবকে হারিয়ে দিল। জিতুকে অবশ্যি হারানোর কোনো প্রশ্নই আসে না, কেমন করে এতক্ষণ পানির নিচে ডুবে থাকে কে জানে! দীর্ঘ সময় পর সে ভুস করে পানির নিচ থেকে বের হয়ে এলো।

রাশা বলল, “জিতু, তুই পানির নিচে এতক্ষণ কেমন করে থাকিস?”

জয়নব বলল, “বড় হয়ে মাক্কু চোরা হবি নাকি?”

রাশা বলল, “মাক্কু চোরা? আমরা যে দেখতে গিয়েছিলাম? যার পরীর মতো সুন্দর একটা বউ আছে?”

“হ্যাঁ। সে পানির নিচে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডুবে থাকতে পারে।”

“ধুর!” রাশা বলল, “কেউ পানির নিচে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডুবে থাকতে পারে না। মানুষ নিশ্বাস না নিয়ে এক-দুই মিনিটের বেশি থাকতে পারে না। অক্সিজেন লাগে।”

জিতু বলল, “মাক্কু চোরার অক্সিজেন লাগে না। মাছের মতন পানি দিয়ে নিশ্বাস নেয়।”

“খোদার কসম। মাক্কু চোরার কানকো আছে।”

“বাজে কথা বলবি না।” রাশা ধমক দিল, “মানুষের কানকো থাকে না।”

“আমি নিজের চোখে দেখেছি।” রাশা চোখ বড় বড় করে বলল, “তুই মাক্কু চোরার কানকো দেখেছিস? কোথায় আছে কানকোগুলি?”

“কানকো দেখি নাই, কিন্তু পানির নিচে ডুবে থাকতে দেখেছি। দুই ঘণ্টা পানির নিচে ছিল।”

রাশা বলল, “মিথ্যা কথা বলবি না! একজন মানুষ যদি নিশ্বাস না নিয়ে পানির নিচে দুই ঘণ্টা ডুবে থাকতে পারে তাহলে এই খেলাটা দেখিয়ে সে লাখ টাকা কামাই করতে পারবে। তার চুরি করে দিন কাটাতে হবে না।”

জিতু বলল, “মাক্কু চোরার তো চুরির নেশা। চুরি না করলে তার ভালোই লাগে না।”

“সেই কথা বল। কিন্তু পানির নিচে দুই ঘণ্টা থাকে সেই কথা বলবি না।”

“থাকে।” জিতু মুখ শক্ত করে বলল, “দুই ঘণ্টা থাকে।”

রাশা বলল, “বাজে কথা বলবি না। দেব একটা থাবড়া।“

জয়নব বলল, “বাজে কথা না, রাশা। মাক্কু চোরা আসলেই পারে।”

“হতেই পারে না।”

“সবাই দেখেছে। চুরি করে পালাচ্ছিল তখন লাফ দিয়ে পানিতে পড়ল। সেই পানি থেকে আর উঠে না। শেষে জাল ফেলে তুলেছে। পানির নিচে চুপচাপ বসে ছিল।”

“হতেই পারে না।”

“হয়েছে।” জয়নব বলল, “আমার কথা বিশ্বাস না করলে তুই অন্যদের জিজ্ঞেস করে দেখ।”

.

রাশা অন্যদের জিজ্ঞেস করে দেখল, আশ্চর্যের ব্যাপার সবাই বলল কথাটা সত্যি। এরকম ব্যাপার সবসময় শোনা কথা হয় কিন্তু এবারে রাশা কয়েকজনকে পেয়ে গেল যারা ঘটনাটা নিজের চোখে দেখেছে। সত্যি সত্যি মাক্কু চোরা দুই ঘণ্টা পানির নিচে ডুবে ছিল, রীতিমতো জাল ফেলে তুলতে হয়েছে।

রাশা তখন ঠিক করল সে মা চোরাকে গিয়ে নিজে জিজ্ঞেস করবে। একদিন দুপুরবেলা তাই জিতুকে নিয়ে রওনা দিল। সেই প্রথম যখন এসেছিল তখন একবার মাক্কু চোরার বাড়ি গিয়েছিল, মাক্কু চোরা থেকে তার পরীর মতো বউটার কথা বেশি মনে আছে।

আগেরবার যখন এসেছিল তখন মাঞ্চু চোরা বারান্দায় বসে বাঁশের চাচি দিয়ে একটা খলুই না কী যেন বানাচ্ছিল, আজকে সে পায়ের সাথে বাধিয়ে দড়ি পাকাচ্ছে, মুখের কোনায় একটা জ্বলন্ত বিড়ি। রাশা আর জিতুকে দেখে সে একটু সন্দেহের চোখে তাকাল। জিতু বলল, “মাক্কু চাচা, ভালো আছেন?”

মাক্কু চোরা বিড়ি টানতে টানতে নাক দিয়ে একধরনের অস্পষ্ট শব্দ করল।

জিতু বলল, “রাশা আপু তোমার সাথে দেখা করতে এসেছে।”

মাক্কু চোরা কোনো কথা না বলে সরু চোখে রাশার দিকে তাকাল।

জিতু বলল, “তোমার কাছে একটা জিনিস জানতে চাই।”

মাক্কু চোরা এই প্রথম একটা কথা বলল, জিজ্ঞেস করল, “কী জিনিস?”

রাশা একটু এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি নাকি নিশ্বাস না নিয়ে পানির নিচে থাকতে পারেন?”

মাক্কু চোরা কোনো কথা না বলে সরু চোখে রাশার দিকে তাকিয়ে রইল। রাশা আবার জানতে চাইল, “পারেন?”

মাক্কু চোরা এবারে অস্পষ্টভাবে মাথা নাড়ল।

“সত্যি পারেন?”

মাক্কু চোরা আবার মাথা নাড়ল।

রাশা বলল, “কিন্তু এটা তো একটা অসম্ভব ব্যাপার। কেউ নিশ্বাস না নিয়ে এক-দুই মিনিটের বেশি থাকতে পারে না। বেঁচে থাকতে হলে অক্সিজেন লাগে। ব্রেনে অক্সিজেন না গেলে ব্রেইন ড্যামেজ হয়ে যায়-”

মাক্কু চোরা কোনো কথা না বলে নিস্পৃহ ভঙ্গিতে বিড়ি টানতে টানতে আবার দড়ি পাকাতে থাকে। অক্সিজেনের অভাবে ব্রেন ড্যামেজ হয় কি না হয় তাতে কিছু আসে যায় না। রাশা বলল, “আপনি কেমন করে পানির নিচে থাকেন এটা বলবেন?”

মাক্কু চোরা রাশার কথা না শোনার ভান করে দড়ি পাকাতে থাকে। রাশা আবার বলল, “বলবেন আমাদের?”

মাক্কু চোরা এবারেও কোনো কথা বলল না। রাশা আবার বলল, “প্লিজ! বলবেন?”

মায়ূ চোরা বিড়িটা কামড়ে রেখে বিচিত্র একটা ভঙ্গিতে সেই অবস্থায় দাঁতের ফাঁক দিয়ে পিচিক করে থুতু ফেলল। বলল, “আমার ওস্তাদের দোয়ী আছে।”

“দোয়া?” রাশা অবাক হয়ে বলল, “ওস্তাদের দোয়া?”

ঘরের ভেতর থেকে এরকম সময় মাঞ্চু চোরার পরীর মতো সুন্দরী বউটা বের হয়ে এসে দরজাটা ধরে দাঁড়াল। রাশা বউটার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি ভালো আছেন?”

বউ কোনো কথা না বলে মাথা নেড়ে জানাল, সে ভালো আছে। রাশা তখন আবার মারূ চোরার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি বলছেন ওস্তাদের দোয়া। কিন্তু ওস্তাদের দোয়া থাকুক আর না থাকুক, নিশ্বাস তো নিতে হবে। শরীরে অক্সিজেন তো দিতে হবে। তা নাহলে মানুষ বাঁচবে কেমন করে?”

মাক্কু চোরা গভীর মনোযোগ দিয়ে দড়ি পাকাতে লাগল, তাকে দেখে মনে হতে থাকে রাশা যে এখানে এসেছে, ব্যাপারটা সে জানেই না। রাশা তখন হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, “ঠিক আছে, আপনি যদি না বলেন তাহলে নাই। কিন্তু যদি সত্যি সত্যি আপনি নিশ্বাস না নিয়ে এক-দুই ঘণ্টা পানির নিচে থাকতে পারেন তাহলে সেই খেলা দেখিয়ে আপনি কিন্তু লক্ষ লক্ষ টাকা কামাই করতে পারবেন।”

মাক্কু চোরা লক্ষ টাকা কামাই করতে কোনো উৎসাহ দেখাল না। গভীর মনোযোগ দিয়ে দাড়ি পাকাতে লাগল।

রাশা জিতুকে বলল, “চল জিতু যাই—”

জিতু বলল, “চল—”

রাশার পরীর মতো সুন্দরী বউটাকে বলল, “আমরা আসি তাহলে?”

বউটা অস্পষ্টভাবে মাথা নাড়াল।

রাশা আর জিতু মাক্কু চোরার বাড়ি থেকে বের হয়ে খানিক দূর গিয়েছে তখন হঠাৎ পিছন থেকে একটা শব্দ শুনল, “এই মেয়ে!”

রাশা ঘুরে তাকিয়ে দেখে মক্কু চোরার পরীর মতো সুন্দরী বউটা এগিয়ে আসছে। রাশা অবাক হয়ে তার কাছে গেল, বউটা বলল, “পানির নিচে কেমন করে থাকে সেটা জানতে এসেছিলে?”

“হ্যাঁ। কেউ তো নিশ্বাস না নিয়ে এক দুই ঘন্টা পানির নিচে থাকতে পারবে না।“

“নিশ্বাস নেয়।“

“কেমন করে নেয়?”

“সাথে একটা নল রাখে। বাঁশের নল, না হলে পেঁপে পাতার উঁটি। কিছু না পেলে পাটখড়ি। সেইটা দিয়ে পানির নিচে থেকে নিশ্বাস নেয়।“

রাশার চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, সে চোখ বড় বড় করে বলল, “কী বুদ্ধি!”

বউটার চোখ-মুখ কঠিন হয়ে উঠে, “নিচু গলায় বলে, তার ওস্তাদের দোয়া আসলে দোয়া না। সেইটা হচ্ছে লানত।“

বউটা ফিরে যাচ্ছিল তখন রাশা ডাকল, বলল, “শুনেন।“

বউটা দাঁড়াল। রাশা বলল, “আপনার মতো সুন্দরী কোনো মানুষ আমি জীবনে দেখি নাই। আপনি জানেন আপনি কত সুন্দর?”

বউটা কিছুক্ষণ চুকরে থেকে বলল, “মেয়ে তোমাকে একটা কথা বলি?”

“বলেন।“

“গরিবের ঘরে মেয়েদের সৌন্দর্য থেকে বড় অভিশাপ আর কিছু নাই। আমি সবসময় বলি, খোদা তুমি আর যাই করো, কখনো গরিব মানুষের ঘরে সুন্দরী মেয়ে দিও না।”

বউটি তারপর আর কোনো কথা না বলে হেঁটে চলে গেল। কেন জানি তার মনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেছে। কেন খারাপ হয়েছে সে বুঝতে পারছে না। রাশা বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। জিতু একসময় বলল, “চলো রাশাপু।”

রাশা একটা নিশ্বাস ফেলে অন্যমনস্কভাবে বলল, “হ্যাঁ। চল যাই।”

.

একটা নল মুখে লাগিয়ে পানির নিচে বসে নিশ্বাস নেবার ধারণাটা খুবই সোজা কিন্তু রাশা আবিষ্কার করল কাজটা মোটেই সোজা না! রাশা প্রথমবার যখন চেষ্টা করল তখন তার নাক দিয়ে পানি ঢুকে একটা বিতিকিচ্ছি অবস্থা! জিতু দাবি করল পানিটা নাক দিয়ে তার ব্রেনের ভেতরে ঢুকে গিয়েছে ব্রেনে পানি ঢুকে গেলে কী বিপদ হতে পারে সেটা নিয়েও তার ভয়ঙ্কর কিছু গল্প ছিল কিন্তু রাশা সেটাকে মোটেও পাত্তা দিল না। অন্যেরা এক-দুইবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল, কিন্তু রাশা হাল ছাড়ল না, লেগে রইল। সে আবিষ্কার করল দুই আঙুলে নাক চেপে ধরে রাখলে পানির নিচে থেকে একটা নল দিয়ে মুখ দিয়ে নিশ্বাস নেয়া যায়। মানুষ যখন নিশ্বাস-প্রশ্বাস নেয় সে তার শব্দ শুনতে পায় না কিন্তু পানির নিচে থেকে যখন নল দিয়ে সে নিশ্বাস নেয় তার পুরো শব্দটা শুনতে পায়। মনে হয় একটা ইঞ্জিন চলছে।

সপ্তাহ দুয়েকের মাঝে রাশা পানির নিচে থেকে নিশ্বাস-প্রশ্বাস নেয়ার একটা এক্সপার্ট হয়ে গেল। নল হিসেবে সে ব্যবহার করে পেঁপে গাছের পাতার গোড়ার দিকের ডাঁটিটা। রাশা ঠিক করে রেখেছে এর পরেরবার বাজারের দিকে গেলে সে একটা লম্বা রবারের নল কিনে আনবে, সেটা দিয়ে সে পুকুরের তলায় বসে বসে নিশ্বাস নেবে! কী মজাই না হবে তখন।

পানির নিচে একটা বিচিত্র জগৎ রয়ে গেছে সেটা রাশা জানত না। কিন্তু সেটা দেখা যায় না, পানির নিচে সবকিছুই অস্পষ্ট! ডুবুরিরা চোখের উপরে একটা গগলস লাগায় তাহলে চোখের সামনে সরাসরি পানি থাকে না, তখন সবকিছু পরিষ্কার দেখতে পায়। এরকম গগলস তো আর গ্রামের বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না তাই রাশা চিন্তা করছে কেমন করে সেটা তৈরি করা যায়। পানির নিচে এত চমৎকার একটা জগৎ সেটা কেউ দেখবে না, সেটা তো হতে পারে না! তাকে দেখতেই হবে।

.

সায়েন্স অলিম্পিয়াডের অঙ্কগুলো করে পাঠিয়েছে অনেক দিন হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম কয়েক দিন সে খুব উত্তেজনার মাঝে ছিল, ভেবেছিল কোনো একটা উত্তর আসবে। শেষ পর্যন্ত কোনো উত্তর আসেনি। হয়তো কুরিয়ারের লোকেরা সময়মতো পাঠায়নি, কিংবা পাঠিয়েছে কিন্তু তাদের হাতে পৌঁছায়নি। কিংবা কে জানে হয়তো সায়েন্স অলিম্পিয়াডের লোকেরা ঠিকই পেয়েছে কিন্তু তার অঙ্কগুলি সব ভুল হয়েছে। কিংবা কে জানে হয়তো তার অঙ্কগুলি শুদ্ধই হয়েছে কিন্তু অন্যদের অঙ্ক আরো অনেক বেশি শুদ্ধ হয়েছে, সে জন্যে তাকে বাতিল করে দিয়েছে। রাশা প্রথম প্রথম দুই এক সপ্তাহ আগ্রহ নিয়ে ব্যাপারটা ভুলে গেল–তার একটা কারণ স্কুলে ঠিক তখন তাদের কম্পিউটারগুলো এসে পৌঁছাল। আগে রাজ্জাক স্যারকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল, সেই স্যারের চাকরি চলে গেছে। এরপর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে গৌরী ম্যাডামকে। গৌরী ম্যাডাম মাঝখানে কোথায় গিয়ে যেন অনেক দিন ট্রেনিং নিয়ে এসেছেন, ট্রেনিংটা ঠিকমতো হয়েছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না, ম্যাডামকে কেমন জানি নার্ভাস মনে হচ্ছে।

যখন কম্পিউটারগুলো বসানো হচ্ছে তখন হেডমাস্টার আর অন্যান্য স্যার-ম্যাডামেরা ব্যস্ত হয়ে হাঁটাহাঁটি করছিলেন। একটু পর দেখা গেল শুধু গৌরী ম্যাডাম একা নার্ভাস হয়ে কম্পিউটারের ল্যাবরেটরিতে দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে কিছু কাগজ, সেগুলো দেখছেন আর উদ্বিগ্ন মুখে কম্পিউটারগুলো দেখছেন, ঠিক কোথা থেকে কিভাবে শুরু করবেন বুঝতে পারছেন না।

রাশা যখন দেখল আশেপাশে কেউ নেই তখন ল্যাবরেটরি ঘরে উঁকি দিয়ে বলল, “ম্যাডাম, আসতে পারি?”

গৌরী ম্যাডাম বললেন, “কে? রাশা? আয়।”

রাশা ভেতরে ঢুকে সারি সারি সাজিয়ে রাখা কম্পিউটারগুলো দেখে বলল, “কী সুন্দর কম্পিউটারগুলো, তাই না ম্যাডাম?”

“হ্যাঁ। তোর জন্যেই তো হলো।”

“না ম্যাডাম, শুধু আমার জন্যে হয় নাই। সবার জন্য হয়েছে।”

গৌরী ম্যাডাম মাথা চুলকে বললেন, “এতগুলো কম্পিউটার দিল, দেখেশুনে রাখার জন্যে একটা মানুষ দেওয়া দরকার ছিল না?”

“হ্যাঁ ম্যাডাম দরকার ছিল।”

“আমি একা কেমন করে এতগুলো কম্পিউটার দেখে রাখব?”

“একটা কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবে ম্যাডাম।”

“হয়ে গেলেই ভালো।” গৌরী ম্যাডাম ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেললেন।

রাশা বলল, “কবে থেকে আমাদের কম্পিউটার ক্লাস হবে?”

“শুরু করব। কয়েক দিনের মাঝেই শুরু করব।”

“ম্যাডাম-”

“কী হলো?”

“আমি একটা কম্পিউটার একটু অন করে দেখি কী কী দিয়েছে?”

“দেখবি? দেখ। সাবধান, আবার নষ্ট করে ফেলিস না যেন।”

“না ম্যাডাম, নষ্ট করব না।”

রাশা তখন এক কোনায় বসে একটা কম্পিউটার অন করল। ঝকঝকে নতুন মেশিন, এখনো নতুন প্লাস্টিকের গন্ধ বের হচ্ছে। মাত্র অপারেটিং সিস্টেম বসানো হয়েছে, দেখতে দেখতে মনিটরে সবকিছু বের হয়ে এলো। রাশা জিব চটাশ করে একটা শব্দ করল, যেন ভারি মজার একটা কিছু সে চেটে চেটে খাচ্ছে। রাশা খানিকক্ষণ কম্পিউটারটা ঘাটাঘাটি করল, তারপর আনন্দের একটা শব্দ করল, বলল, “ম্যাডাম!”

“কী হয়েছে।”

“ইন্টারনেট কানেকশান আছে ম্যাডাম। ফাটাফাটি স্পিড!”

“তাই নাকি?”

“জি ম্যাডাম। এই দেখেন-” বলে সে ঝড়ের গতিতে কি বোর্ডে হাত চালিয়ে স্ক্রিনে আইনস্টাইনের একটা ছবি নিয়ে এলো।

গৌরী ম্যাডাম দেখে বললেন, “কোথা থেকে পেলি?”

“গুগল থেকে।”

গৌরী ম্যাডাম ঠিক বুঝতে পারলেন মনে হলো না। রাশা অনেক দিন পর তার ই-মেইলগুলো চেক করল। কত মেইল এসে জমা হয়েছে। যার বেশিরভাগেরই এখন আর কোনো অর্থ নেই। সে চোখ বুলিয়ে নিয়ে একটা নিশ্বাস ফেলে।

ম্যাডাম একটু ঈর্ষান্বিত দৃষ্টিতে রাশার দিকে তাকিয়ে রইলেন, জিজ্ঞেস করলেন, “তুই কম্পিউটার চালাতে পারিস?”

“পারি ম্যাডাম। কম্পিউটার ছিল আমার এক নম্বর বন্ধু।”।

গৌরী ম্যাডাম তার কম্পিউটারের সামনে বসে খুব সাবধানে মাউসটাকে একটু নাড়ালেন, দেখেই বোঝা গেল–ম্যাডাম একেবারেই অভ্যস্ত নন। বিড়বিড় করে বললেন, “বইয়ে লিখেছে দুইবার ক্লিক করলে ওপেন হবে কিন্তু ওপেন হতে চাচ্ছে না। সমস্যাটা কী?”

রাশা ঠিক বুঝতে পারছিল না তার কিছু বলা ঠিক হবে কি না, শেষে বলেই ফেলল, “তাড়াতাড়ি দুইবার ক্লিক করতে হবে ম্যাডাম?”

“আমি তো ভাবছিলাম তাড়াতাড়িই করছি। এই কম্পিউটার মনে হয় বেশি ফাস্ট-” গৌরী ম্যাডাম নিজের রসিকতায় নিজেই একটু নার্ভাসভাবে হাসলেন।

একটু পরে আবার বিড়বিড় করে বললেন, “আমাকে বলেছিল বাংলায় লেখা যাবে! এই দ্যাখ কি বোর্ড টিপলেই শুধু ইংরেজি বের হয়। কী মুশকিল!”

রাশা আবার একটু ইতস্তত করে বলল, “ফন্টটা সিলেক্ট করা হয়নি। বাংলা একটা ফন্ট সিলেক্ট করলেই বাংলা লেখা বের হবে।”

গৌরী ম্যাডাম অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ। তাই তো।”

প্রথম প্রথম গৌরী ম্যাডাম রাশাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে একটু লজ্জা পাচ্ছিলেন, কিন্তু কিছুক্ষণের মাঝেই তার লজ্জা কেটে গেল। যখনই তার কোনো একটা সমস্যা হচ্ছিল তখনই রাশাকে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। তার কিছু কিছু প্রশ্ন এত হাস্যকর যে রাশার হাসি পেয়ে যাচ্ছিল কিন্তু সে হাসল না, গম্ভীর হয়ে গৌরী ম্যাডামকে বুঝিয়ে দিল।

গৌরী ম্যাডামও রাশাকে পেয়ে শেষ পর্যন্ত একটু সাহস পেলেন। তারা দুজনে মিলে সবগুলি কম্পিউটার অন করলেন, রাশা সবগুলিই একটু ঘাঁটাঘাটি করল, করে বলল, “ঠিক আছে ম্যাডাম!”

“গুড।”

“তাহলে কালকে থেকে কি ক্লাস হবে?”

“কালকে থেকেই?” ম্যাডামকে দুশ্চিন্তিত দেখাল, “রুটিন করতে হবে না?”

“রুটিন পর করলে হবে না ম্যাডাম? সবাই একটু দেখুক?”

গৌরী ম্যাডাম চোখ কপালে তুলে বললেন, “সর্বনাশ! ভুল জায়গায় টেপাটেপি করে পরে নষ্ট করে ফেলবে!”

‘নষ্ট করবে না ম্যাডাম। আপনি যদি বলেন তাহলে আমি থাকব। কাউকে ওল্টাপাল্টা কিছু করতে দিব না।”

“তুই থাকবি?”

“আপনি যদি বলেন।“

“ঠিক আছে তাহলে দেখি চেষ্টা করে।”

.

কাজেই রাশাকে সবসময়েই কম্পিউটার ল্যাবরেটরিতে দেখা যেতে লাগল। গৌরী ম্যাডাম যদি ক্লাস নিতেন তাহলে কম্পিউটার বিষয়টা হতো দুর্বোধ্য কঠিন একটা বস্তু। যেহেতু রাশা ছেলেমেয়েদের দেখাল তাই সবাই আবিষ্কার করল এটা আসলে একটা খেলনা। সেই খেলনা দিয়ে খেলতে এত মজা যে কেউ আগে কল্পনা করেনি।

গৌরী ম্যাডাম অসহায়ভাবে আবিষ্কার করলেন কয়েকদিনের মাঝে বাচ্চাকাচ্চারা তার থেকে অনেক বেশি জেনে গেছে। শুধু তাই নয়, কম্পিউটারে তার জ্ঞান হচ্ছে ভাসা ভাসা, ছেলেমেয়েরা কম্পিউটারের নাড়ি নক্ষত্র জানে। তারা কম্পিউটার নিয়ে এমন এমন জিনিস করতে লাগল যে তার আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল।

.

এরকম সময় একদিন হেডমাস্টার রাশাকে ডেকে পাঠালেন। রাশা একটু দুশ্চিন্তিত হয়ে হেডমাস্টারের কাছে গেল, কম্পিউটার শেখানো নিয়ে সে কিছু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে সেটা নিয়ে তাঁকে কেউ নালিশ করেছে কি না কে জানে? দরজার ফাঁক দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে রাশা বলল, “আসতে পারি স্যার?”

“আস।”

রাশা ভেতরে ঢুকে হেডমাস্টারের সামনে দাঁড়াল। হেডমাস্টার তার দিকে চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে একটা খাম হাতে তুলে নিয়ে বললেন, “ঢাকা থেকে একটা চিঠি এসেছে। সায়েন্স অলিম্পিয়াড কমিটির চিঠি”

রাশার বুকের ভেতর ছলাৎ করে উঠল, জিজ্ঞেস করল, “কী লিখেছে চিঠিতে?”

“লিখেছে ঢাকায় একটা সায়েন্স অলিম্পিয়াড হবে সেখানে তোকে সিলেক্ট করেছে। আমি ঠিক বুঝলাম না–অলিম্পিক তো হয় দৌড়াদৌড়ি না হলে লাফঝাঁপ দিয়ে। সায়েন্স দিয়ে অলিম্পিকটা কেমন করে হবে? হাতে একটা টেস্টটিউব নিয়ে দৌড়াবে? নাকি একটা মাইক্রোস্কোপ নিয়ে লাফ দিবে?” হেডস্যার কথা শেষ করে হা হা করে হাসলেন, যেন ভারি চমৎকার একটা রসিকতা হয়েছে!

রাশা বলল, “মনে হয় বিজ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন দিবে, সেইগুলোর উত্তর দিতে হবে।”

হেডস্যার হাতের চিঠিটাতে আরেকবার চোখ বুলালেন। তারপর বললেন, “ঢাকায় গেলে তোক একটা মেয়েদের হোস্টেলে রাখবে, হাতখরচের টাকা দেবে। যাতায়াতের ভাড়া দেবে–যাবি নাকি?”

রাশা তার উত্তেজনাটা চেপে রেখে বলল, “হ্যাঁ স্যার। যেতে চাই।”

হেডস্যার কান চুলকাতে চুলকাতে বললেন, “স্কুলের জন্যে একটা প্রেস্টিজ। তোর তো যাওয়াই উচিত। কিন্তু কেমন করে যাবি? তোর সাথে কে যাবে?”

রাশা একটু উদ্বিগ্ন মুখে বলল, “কাউকে না কাউকে পাওয়া যাবে না?”

“দেখি কোনো স্যারকে রাজি করতে পারি কি না।”

.

রাশা স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় সবাইকে বলল সে সায়েন্স অলিম্পিয়াডে অংশ নিতে ঢাকা যাচ্ছে। তাকে যাতায়াতের ভাড়া দেয়া হবে এবং হাত খরচ দেয়া হবে। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে মন্ত্রী আসবেন। শুনে সবাই চমৎকৃত হয়ে গেল। সবচেয়ে বেশি উত্তেজিত হলো জিতু এবং স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরে জিতু সারা গ্রামে সবাইকে খবরটা দিয়ে এলো। সবাইকে যে খবরটা সঠিকভাবে দিল তা নয়, খবর দেয়ার সময় যখন যেখানে প্রয়োজন অনেক বাড়তি ব্যাপার স্যাপার যোগ করে দিল।

জিতুর খবর প্রচারের কারণেই মনে হয় সন্ধেবেলা সালাম নানা রাশার সাথে দেখা করতে এলেন। উঠানের মাঝখান থেকে ডাক দিয়ে বললেন, “রাশ, বেটি, তুমি কোথায়?”

রাশা হ্যারিকেন হাতে বের হয়ে দেখে সালাম নানা। সে ব্যস্ত হয়ে বলল, “নানা, আপনি! আসেন, আসেন, ভিতরে আসেন।”

সালাম নানা বললেন, “না রে রাশা বসব না। জিতুর মুখে একটা খবর শুনে এসেছি। কোন মন্ত্রী নাকি তোমাকে পুরস্কার দিবে? ব্যাপারটা কি?”

রাশা লজ্জা পেয়ে গেল, বলল, “না, না, আমি মোটেই কোনো পুরস্কার পাব না! জিতু বজ্জাতটা উল্টাপাল্টা কথা বলে বেড়াচ্ছে।”

সালাম নানা হাসলেন, বললেন, “আমাদের জিতু হচ্ছে রয়টার। সে সবসময় সব রকম খবর ছড়ায়।”

“মোটেই খবর ছড়ায় না, গুজব ছড়ায়। এত বাজে কথা বলতে পারে!”

সালাম নানা বললেন, “ঠিক আছে? সে না হয় একটু বাড়িয়েচাড়িয়ে বলছে। তুমি তাহলে আসল কথাটা বলো। কিছু একটা নিশ্চয়ই হয়েছে, সেটা কী?”

“ঢাকায় একটা সায়েন্স অলিম্পিয়াড হচ্ছে, আমি সেখানে সিলেক্ট হয়েছি।”

“সায়েন্স অলিম্পিয়াড? সেটা আবার কী?”

রাশা বলল, “আমিও ভালো করে জানি না। মনে হয় বিজ্ঞানের উপরে একটা পরীক্ষার মতো হবে।”

“তোমাকে কেমন করে সিলেক্ট করল?”

“পত্রিকায় দশটা প্রশ্ন ছাপিয়ে দিয়েছিল, সেগুলো করে পাঠিয়েছিলাম।”

“বাহ!” সালাম নানা খুশিতে মাথা নেড়ে বললেন, “কী চমৎকার! আজিজ মাস্টারের যোগ্য নাতনি তুমি। এখন দেখি তুমি সেখান থেকে কী পুরস্কার আনতে পারো।”

রাশা বলল, “কত শতশত ছেলেমেয়ে আসবে। আমি কি কোনো পুরষ্কার পাব নাকি?”

“নিশ্চয়ই পাবে। আর না পেলেই কী। ওখানে যাওয়াই তো একটা বড় ব্যাপার।”

সালাম নানা তখন ক্রাচে ভর দিয়ে চলে যেতে শুরু করলেন, রাশা বললেন, “নানা, আপনি বসবেন না?”

“নাহ্ রে। যাই।”

রাশা বলল, “আমি আপনাকে একটু এগিয়ে দিয়ে আসি।”

সালাম নানা হা হা করে হাসলেন, বললেন, “তুমি আমাকে কী এগিয়ে দিবে? আমি কি বাচ্চা ছেলে নাকি?”

“না, নানা। আসলে এত সুন্দর জোছনা উঠেছে তাই আপনার সাথে একটু হাঁটি।”

“তাহলে আসো। আসলেই দেখো কী সুন্দর জোছনা। পৃথিবীতে মনে হয় জোছনার মতো সুন্দর কিছু নাই।”

রাশা সালাম নানার সাথে খালের পাড় ধরে হাঁটতে থাকে। রাশা হাঁটতে হাঁটতে বলল, “নানা।”

“বলো।”

“আমার নানা কেমন করে মারা গিয়েছিলেন আপনি জানেন?”

সালাম নানা একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, “আসলে কেউ-ই জানে না। আমরা কাছাকাছি একটা অপারেশনে এসেছিলাম। অপারেশন শেষ হয়েছে বিকেলের দিকে, তোমার নানা বলল, বাড়ির এত কাছে এসেছি একটু বউ-বাচ্চাকে দেখে আসি। আমি না করলাম, বললাম, রাজাকারদের উৎপাত বেড়েছে এখন যাওয়া ঠিক হবে না।”

“তখন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি হচ্ছিল, তোমার নানা বলল, এই বৃষ্টিতে কেউ ঘর থেকে বের হবে না। আমি যাব বাচ্চাগুলোকে একনজর দেখে চলে আসব।”

“তোমার নানা তারপর তার হাতিয়ারটা আমার হাতে দিয়ে বলল, এইটা তোমার কাছে রাখো। আমি রেখে দিলাম। এখন মনে হয় হাতিয়ারটা নিয়ে গেলেই পারত, কয়টা রাজাকারকে তো অন্তত শেষ করতে পরিত, ধরাও পড়ত না। মানুষটার সাহস ছিল সিংহের মতো।”

“যাই হোক আজিজ ভাই বাড়ি আসলেন, তোমার নানির সাথে দেখা করলেন, তোমার মাকে দেখলেন, তারপর চলে আসতে চাচ্ছিলেন, তোমার নানি তখন বললেন, এত বৃষ্টি হচ্ছে, ‘বৃষ্টিটা একটু ধরুক তখন যেন যায়।”

সালাম নানা একটু থামলেন, একটা বড় নিশ্বাস নিলেন, তারপরে বললেন, “মৃত্যু নিশ্চয়ই আজিজ ভাইয়ের পিছনে পিছনে এসেছিল তা না হলে কেন একটু দেরি করলেন? এর মাঝে রাজাকাররা এসে বাড়ি ঘেরাও করে ফেলল।”

“তারপর ঠিক কী হয়েছে কেউ ভালো করে জানে না। রাজাকারের দল তাকে ধরে নিয়ে গেল, শুনতে পেলাম মিলিটারির কাছে দিবে। কিন্তু মিলিটারির কাছে দিল না, আর কোনোদিন মানুষটার খোঁজও পাওয়া গেল না। নিশ্চয়ই তাকে ঐ রাতেই মেরে ফেলেছে।”

রাশা জিজ্ঞেস করল, “কোথায় কবর দিয়েছে কেউ জানে না?”

“না। কেউ জানে না। আসলে-”

“আসলে কী?”।

“যারা তোমার নানাকে ধরে নিয়েছিল তারা কি কবর দিয়েছে? কবর দেয় নাই, মেরে লাশটাকে কোথাও ফেলে দিয়েছে। ঐ রাজাকাররা তো মানুষ না। ওরা পশু, পশুর থেকেও খারাপ। জাহান্নামেও ওদের জায়গা হবে না।“

“সেই রাজাকারগুলোর কী হয়েছে?”

“যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা কিছু মেরে শেষ করেছে। কিছু পালিয়েছে। কিছু ধরা পড়ে জেলে গেছে। সেভেন্টি ফাইভে যখন রাজাকারদের ক্ষমা করে দিল সেগুলো ছাড়া পেয়ে এসেছে।”

“আচ্ছা নানা, এইটা কি সত্যি, আমাদের স্কুলটা যার নামে সে নাকি”

সালাম নানা একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “সত্যি। শোনা যায় তোমার নানাকে যারা ধরে নিয়ে গিয়েছিল তার মাঝে সেও নাকি ছিল।”

“একটা রাজাকারের নামে স্কুল? এটা কেমন হলো না?

“খুব অন্যায় হলো। কিন্তু কী করবে বলো? মাঝখানে কয়েকটা সরকার গেল তারা তো সেই রাজাকারদেরই তোষামোদ করেছে। আহাদ আলী সেভেন্টি ফাইভে জেলখানা থেকে ছাড়া পেয়ে ফিরে এসে কয়েক বছর চুপচাপ ছিল, তারপর চেয়ারম্যান ইলেকশান করল। টাকা কামাই করল নিজের নামে মাদ্রাসা বানাল, স্কুল-বানাল। আগে স্কুল কমিটিতে ছিল, এখন বয়স হয়েছে বাড়িতে বসে থাকে।”

“আপনি কখনো দেখেছেন নানা এই মানুষটাকে?”

“না দেখি নাই। কেন?”

“একটা রাজাকার দেখতে কেমন হয় সেটা জানার জন্যে।”

“এরা দেখতে মানুষের মতোই। নাক মুখ চোখ আছে। কিন্তু আসলে মানুষ না। আসলে এরা পশু। পশুর চাইতেও খারাপ।”

রাশা নিঃশব্দে সালাম নানার পাশে পাশে হাঁটতে থাকে। নরম মাটিতে তার ক্রাচ গেঁথে গেঁথে যাচ্ছিল, তারপরেও তার অস্পষ্ট শব্দ শোনা যায়। একটা মুক্তিযোদ্ধার কষ্টের শব্দ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *