১২. ভোর বেলা পা টিপে টিপে

ভোর বেলা পা টিপে টিপে বাসায় ফিরে যাচ্ছিলাম। হানিফ একটু আগে আমাদের বাসার কাছে নামিয়ে দিয়ে গেছে। অরু আপার বাসার কাছে আসতেই জানালার কাছে থেকে অরু আপা তীক্ষ্ণ গলায় ডাকলেন, ইবু।

আমি ভয়ানক চমকে উঠলাম। অরু আপা পাথরের মূর্তির মত জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। তাকে দেখে হঠাৎ আমার কেমন জানি ভয় লাগতে থাকে। অরু আপা ঠাণ্ডা গলায় বললেন, এদিকে আয়।

আমি আমতা আমতা করে বললাম, অরু, আপা, একটা ব্যাপারে আমার মানে এখনই বাসায়

অরু আপা ভয়ংকর মুখে তীব্র স্বরে বললেন, এদিকে আয়।

আমি এগিয়ে গেলাম। অরু আপা দরজা খুলে দিলেন। আমি ভিতরে যেতেই খপ করে আমার হান্ত ধরলেন। এত জোরে ধরলেন যে আমার হাত ব্যথা করতে থাকে। অরু আপা আমার দিকে হিংস্ৰ চোখে তাকিয়ে দাঁতে দাতে ঘষে বললেন, কাল রাতে কোথায় ছিলি?

আমি চমকে উঠে মাথা নিচু করলাম। সর্বনাশ হয়েছে, ধরা পড়ে গেছি।

কোথায় ছিলি?

আমি চুপ করে রইলাম। অরু আপা ধমকে উঠলেন, কোথায় ছিলি?

অরু, আপা আমি তোমাকে বলতে পারব না।

তোকে বলতেই হবে, অরু আপা হিংস্র গলায় বললেন, না হলে তোকে আমি খুন করে ফেলব। খুন করে ফেলব।

অরু আপকে দেখে মনে হল সত্যি আমাকে খুন করে ফেলবেন। আমি কোন রকমে বললাম, অরু, আপ

তুই জানিস সারারাত আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি? সারারাত। তুই জানিস? জানিস?

অরু আপা —

তোর বাসার সবাই জানে তুই এখানে। আমি জানি তুই পালিয়ে গেছিস বাড়ি থেকে। কোথায় ছিলি? কোথায় ছিলি কাল রাতে?

অরু আপা, আমি বলতে পারব না।

বলতেই হবে তোকে। অরু, আপা আমার হাতে ধরে এত জোরে চাপ দিলেন যে ব্যাথায় চোখের পানি এসে গেল। ভয়ংকর চেহার করে বললেন, এখন আমাকে বলতেই হবে। বলতেই হবে–

অরুণ অপা—

বলতেই হবে তোর। বলতেই হবে। কোথায় ছিলি কাল রাতে?

অরু, আপা আমি বলতে পারব না।

অরু আপা আমাকে ছেড়ে দিলেন। বুকে একটা ধাক্কা দিয়ে বললেন, যা। তুই আর কোনদিন আমার কাছে আসবি না। কোন দিন না। যা। বের হয়ে যা।

অরু আপা কখনো আমার সাথে এত কঠিন গলায় কথা বলেননি, আমার চোখে হঠাৎ পানি এসে গেল। কিন্তু আমি তো কিছুতেই অরু আপাকে সত্যি কথাটি বলতে পারব না। আসার আগে আমি আর রাশেদ কাজল ভাইয়ের গা ছুয়ে দেশের নামে প্রতিজ্ঞা করে এসেছি। আমি মাথা নিচু করে চেষ্টা করতে লাগলাম চোখের পানি লুকিয়ে রাখতে। অরু আপা দরজা খুলে বললেন, যা বের হয়ে যা। এই মুহুর্তে বের হয়ে যা।

আমি পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে অরু, আপার হাতে দিলাম। অরু, আপা জিজ্ঞেস করলেন, কি এটা?

তোমার চিঠি। শফিক ভাই দিয়েছে।

শফিক? অরু, আপা চমকে উঠে বললেন, শফিক ফিরে এসেছে। দেখা হয়েছে তোর সাথে?

তোমাকে বলতে পারব না। অরু আপা। আমরা দেশের নামে প্ৰতিজ্ঞা করেছি—

তুই– তুই মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগাযোগ করেছিস?

আমি মাথা নিচু করে রইলাম।

অরু আপা নিচু হয়ে আমার কাছে এসে হঠাৎ আমাকে বুকে চপে ধরে ভাঙা গলায় বললেন, এইটুকন ছেলে তুই, এখন তোর ঘুড়ি ওড়ানোর কথা, মাঠে বল খেলার কথা, আর তুই কি না মুক্তিবাহিনীর সাথে কাজ করিস? নিজের প্রাণ হাতে নিয়ে?

তুই? তোর মত বাচ্চা ছেলে? তোর মত বাচ্চা ছেলে?

তারপর হঠাৎ কথা নেই বাৰ্ত্তা নেই। অরু আপা আমাকে শক্ত করে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন।

 

অরু, আপা যদিও টের পেয়েছিলেন। আমি বাসা থেকে পালিয়ে অন্য কোথাও রাত কাটিয়ে এসেছি। তিনি কাউকে সেটা বলেন নি। আম্মা আব্বা তাই জানতে পারলেন না কিছু। আমি অবিশ্যি খুব সাবধানে থাকলাম সারাদিন, ভুল করে যদি বলে ফেলি, কাল রাতে মশার কামড় খেয়ে- তাহলেই হয়েছে। রাতে ভাল ঘুম হয়নি বলে দুপুরে চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু কষ্ট করে জেগে রইলাম। সারাদিন।

পরদিন সকালে আমি অভ্যাসমত আমাদের দেওয়ালে পা ঝুলিয়ে বসেছি। আব্বা একটু আগে গেছেন। মিলিটারী ঘোষণা দিয়েছে কলেজ খোলা রাখতে। কলেজে কোন ছাত্র নেই। তবু আব্বাকে গিয়ে কলেজে বসে থাকতে হয়। আব্বা প্রত্যেকদিন কলেজে যান খুব মন খারাপ করে। ফিরে আসেন আরো বেশি খারাপ করে। মনে হয় আব্বা কয়দিনের মাঝে সবকিছু ছেড়ে ছুঁড়ে চলে যাবেন। কোথায় যাবেন এখনো জানি না, মনে হয় দেশের বাড়িতে। রাস্তাঘাট এখনো নিরাপদ নয়, সেটাই সমস্যা।

আমি দেওয়ালে পা বুলিয়ে বসে থেকে একটু পরেই বুঝতে পারলাম আজ বুধবার। প্রতি বুধবারে আগে এখানে অনেক বড় বাজার বসত। আশে-পাশের সব এলাকা থেকে নানারকম সওদা নিয়ে লোকজন আসত। বুধবারে বাজারে পাওয়া যেতে না সেরকম জিনিস নেই। মিলিটারী আসার পর সেটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। গত কয়েক সপ্তাহ থেকে মনে হচ্ছে সেটা আবার আস্তে আস্তে শুরু হচ্ছে। আগের মত এত বড় নয়। কিন্তু ছোটখাট একটা বাজার বসছে। আমি দেখলাম লোকজন হাঁস, মুরগী, শাকসবজী, ডালা কুলো নিয়ে আসছে। মাথায় ফলমূলের বোঝা নিয়ে যাচ্ছে। জুন মাস, এই সকালেই কি সাংঘাতিক গরম। একজন মানুষকে দেখলাম মাথায় একটা ঝাকায় করে কলা নিয়ে যাচ্ছে, ঘামছে দীর দর করে। আমার চোখে চোখ পড়তেই লোকটা চোখ সরিয়ে নিল আর আমি হঠাৎ করে চিনে ফেললাম তাকে। কাজল ভাইদের দলে দেখেছি তাকে, একসাথে বসে গুড দিয়ে চা খেয়েছি। আমরা আগের রাতে। মাথায় কলার ঝাকায় শুধু কলা নেই, নিচে নিশ্চয়ই অস্ত্রশস্ত্র। তার মানে মুক্তিবাহিনী মিলিটারী ক্যাম্প আক্রমণ করতে আসছে। উত্তেজনায় আমার বুক ধ্বক ধ্বক করে শব্দ করতে থাকে। কখন আক্রমণ করবে? আজ রাতে? একবার ভাবলাম লোকটার পিছু পিছু যাই, দেখি কি করে, কোথায় যায়। কিন্তু গোলাম না, আমাকে যখন না চেনার ভান করেছে। আমারও না। চেনার ভান করতে হবে।

আমি ছটফট করেত থাকি। রাশেদ যদি আসত তার সাথে কথা বলা যেতো। আজ রাতেই নিশ্চয়ই আক্রমণ হবে। শফিক ভাই কি এসে গেছেন? কাদের? কোথায় আছে কে? নূর মোহাম্মদ বেকারীতে? আমি দেওয়াল থেকে লাফিয়ে নোমলাম ঠিক তখন দেখলাম রাশেদ হেঁটে হেঁটে আসছে। রাশেদের মুখ গন্তীর। আমি ছুটে গিয়ে বললাম, রাশেদ জানিস আজ রাতে। —

রাশেদ ঠোঁটে আংগুল দিয়ে বলল, শ-স—স—স, আস্তে।

আমি গলা নামিয়ে বললাম, আজ রাতে ক্যাম্পে অপারেশন হবে।

রাশেদ আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, তুই কেমন করে জানিস?

দেখলাম। একজন মুক্তিবাহিনী মাথায় কলা নিয়ে যাচ্ছে! নিচে নিশ্চয়ই সব অস্ত্রপাতি।

হ্যাঁ। রাশেদ মাথা নেড়ে বলল, একটা ঝামেলা হয়েছে।

কি ঝামেলা?

শফিক ভাই নূর মুহাম্মদ বেকারীতে চলে গেছে। লাইট মেশিন গান নিয়ে গেছেন একটা। কিন্তু –

কিন্তু কি? নূর মুহাম্মদ পাকিস্তানী?

না না। নূর মুহম্মদ ঠিক আছে। সে খাটি জয় বাংলা।

তাহলে?

শফিক ভাই বেশি গুলী নিতে পারেননি। কমপক্ষে এক ঘণ্টার মত গুলী থাকা দরকার। শফিক ভাইয়ের কাছে মাত্র দশ মিনিটের মত আছে।

আরো গুলী পৌঁছে দেয় না কেন?

পারছে না। স্কুলের কাছে কড়া পাহারা বসিয়েছে। দুইটা রাজাকারের চেকপোস্ট। একটাতে আবার কয়টা পাকিস্তানী মিলিটারী বসে থাকে। সব কিছু খুলে দেখে।

তাহলে?

অন্য সব কিছু রোড়ী। কিন্তু শফিক ভাইয়ের কাছে গুলী পৌছানো না গেলে মনে হয় পোগ্রাম ক্যান্সেল করে দিতে হবে। অপারেশানটা নির্ভর করে ছাদের বাংকারটা আটকে রাখার উপর।

তাহলে?

এখনো চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু খুব ডেঞ্জাব্বাস অবস্থা। রাশেদ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি একটা জিনিস ভাবছি।

কি?

আমরা শফিক ভাইয়ের কাছে গুলী পৌঁছে দিলে কেমন হয়?

আমরা?

হ্যাঁ আমি আর তুই। ফজলু আর আশরাফ যদি রাজি হয় তাহলে আমরা চারজন।

কিভাবে?

শরীরে গুলীর বেল্টগুলি বেঁধে উপরে শাট-প্যান্ট পরে চলে যাব। আমরা ছোট বলে সন্দেহ করবে না। কি মনে হয়?

ফজলু আর আশরাফ কি রাজি হবে?

কেন হবে না?

যদি বলে দেয়?

রাশেদ আমার দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকাল, তুই কি কাউকে বলেছিস আমরা ঐ রাতে কোথায় গিয়েছিলাম?

না। অরু আপা অবিশ্যি জেনে গেছে। শফিক ভাইয়ের চিঠি পড়ে।

কিন্তু তুই কি বলেছিস?

না।

তাহলে অন্যেরা কেন বলবে? তুই মনে করিস শুধু তোর দায়িত্ব জ্ঞান আছে অন্যদের নাই? শুধু তুই ভাল মানুষ অন্যরা খারাপ। শুধু তোর মাথায় বুদ্ধি, অন্যেরা বোকা?

আমি কি তাই বলছি নাকি?

তাহলে কি বলছিস?

বলছি যে হাজার হলেও ছোট মানুষ

ছোট হয়েছি তো কি হয়েছে? বড়রা মনে করে আমরা ছোট বলে কিছু বুঝি না। তুইও জানিস আমিও জানি সেটা ঠিক না। আমরা সব বুঝি। অনেক সময় ভান করি যে বুঝি না। কিন্তু ঠিকই বুঝি সবকিছু।

তা ঠিক।

এখন এমন একটা সময় যেটা আগে কখনো হয় নাই। রাশেদ একেবারে বড় মানুষের মত বলল, এরকম সময়ে কি করতে হয় বড়রাও জানে না যে আমাদের বলবে। এখন আমাদের নিজেদের ঠিক করতে হবে কি করব। বুঝলি?

বুঝলাম।

তাহলে চল।

কোথায়।

ফজলু আর আশরাফকে ডেকে আনি।

প্রথমে ফজুলর বাসায় গিয়ে তাকে ডেকে আনলাম। আমাদের দেখে সে খুশি হয়ে বাসা থেকে বের হয়ে এল। বলল, ভাল হল তোরা এসেছিস।

কেন?

বসে বসে লুডু খেলতে খেলতে ভ্যান্দা মারা হয়ে যাচ্ছি। আর শিউলিটা যা চোর! মইয়ের কাছে এলেই চোট্টামী করে। মই বেয়ে উঠে যায়। আবার যখন সাপের কাছে আসে–

রাশেদ মেঘ স্বরে বলল, তুই সাপ লুডু খেলিস?

ফজলু থতমত খেয়ে বলল, কেন? খেললে কি হয়?

দেশের এই অবস্থা। আমাদের এত কাজ —

কি কাজ?

মনে কর মুক্তিবাহিনীরা মিলিটারীর সাথে যুদ্ধ করবে। সে জন্যে তাদের সাহায্য দরকার। তুই সাহায্য করবি?

মুহুর্তে ফজলুর চোখ গোল আলুর মত হয়ে গেল। তেতেলাতে তোতলাতে বলল, সত্যি? সত্যি? খো–খোদার কসম?

হ্যাঁ। করবি?

ফজলু নাক দিয়ে বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, একশবার করব। কি বলিস তুই? করব না। মানে? কি করতে হবে? কি?

আস্তে। আস্তে। সব বলব। কিন্তু জানিস তো এটা কাউকে বলতে পারিব না? কাউকে না। মরে গেলেও না। যখন আমি বলি মরে গেলেও না তার মানে আসলেই মরে গেলেও না। রাজাকারদের হাতে ধরা পড়তে পারিস। মিলিটারীর হাতে ধরা পরতে পারিস। তারা বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তোকে মেরে ফেলতে পারে, নদীর তীরে দাঁড় করিয়ে গুলী করে মেরে ফেলতে পারে—কিন্তু তবু বলতে পারবি না।

খোদার কসম। বলব না। আল্লাহর কসম।

রাশেদ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বলেছিলাম না। সবাই সাহায্য করবে।

ফজলু বলল, এখন বল কি করতে হবে। বলছি। আগে দেখি আশরাফকেও পাওয়া যায় কি না।

আশরাফকে বলা মাত্র সেও রাজি হয়ে গেল। আমি ভেবেছিলাম সে হয়তো রাজি হবে না। সে ক্লাসে ফার্স্ট বয়, কখনো সে উল্টাপাল্টা জিনিস করে না। আগে রাশেদ যখন মিছিলে যেতো আশরাফ মাথা নেড়ে বলত, এত ছোট ছেলের মিছিলে যাওয়া ঠিক না। কিন্তু এটা তো আর মিছিল বা রাজনীতি না। এটা হচ্ছে দেশ আর দেশের স্বাধীনতা। মিলিটারী আর মুক্তিবাহিনী। বেঁচে থাকা আর মরে যাওয়া।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *