১২. ভোরের নমাজ শেষ হতেই

ভোরের নমাজ শেষ হতেই সর্দারজী ভেঁপু বাজাতে আরম্ভ করলেন। ভাবগতিক দেখে মনে হল তিনি মনস্থির করে ফেলেছেন আজ সন্ধ্যেয় যে করেই হোক কাবুল পৌঁছবেন।

বেতার-সায়েবের দিলও খুব চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। সর্দারজীর সঙ্গে নানা রকম গল্প জুড়ে দিলেন ও আমাকেও আফগানিস্থান সম্বন্ধে নানা কাজের খবর নানা রঙীন গুজব বলে যেতে লাগলেন। তার কতটা সত্য, কতটা কল্পনা, কতটা ডাহা মিথ্যে বুঝবার মত তথ্য আমার কাছে ছিল না, কাজেই একতরফা গল্প জমে উঠল ভালোই। তারই একটা বলতে গিয়ে ভূমিকা দিলেন, সামান্য জিনিস মানুষের সমস্ত জীবনের ধারা কি রকম অন্য পথে নিয়ে ফেলতে পারে শুনুন।

প্রায় ত্রিশ বৎসর পূর্বে এই নিমলার বাগানেই জন চল্লিশ কয়েদী আর তাদের পাহারাওয়ালারা রাত কাটিয়ে সকালবেলা দেখে একজন কি করে পালিয়েছে। পাহারাওয়ালাদের মস্তকে বজ্রাঘাত। কাবুল থেকে যতগুলো কয়েদী নিয়ে বেরিয়েছিল জলালাবাদে যদি সেই সংখ্যা না দেখাতে পারে তবে তাদের যে কি শাস্তি হতে পারে সে সম্বন্ধে তাদের আইনজ্ঞান বা পূর্ব অভিজ্ঞতা কিছুই ছিল না। কেউ বলল, ফাঁসি দেবে, কেউ বলল, গুলী করে মারবে, কেউ বলল, জ্যান্ত শরীর থেকে টেনে টেনে চামড়া তুলে ফেলবে। জেল যে হবে সে বিষয়ে কারো মনে কোনো সন্দেহ ছিল না, আর আফগান জেলের অবস্থা আর কেউ জানুক না-জানুক তারা বিলক্ষণ জানত। একবার সে জেলে ঢুকলে সাধারণত কেউ আর বেরিয়ে আসে না–যদি আসে তবে সে ফায়ারিঙ স্কোয়াডের মুখোমুখি হতে, অথবা অন্যের স্কন্ধের উপর সোয়ার হয়ে কফিনের ভিতর শুয়ে শুয়ে। আফগান জেল সম্বন্ধে তাই যেসব কথা শুনতে পাবেন তার বেশীর ভাগই কল্পনা— মরা লোকে তো আর কথা কয় না।

তা সে যাই হোক, পাহারাওয়ালারা তো ভয়ে আধমরা। শেষটায় একজন বুদ্ধি বাৎলাল যে, রাস্তার যে-কোনো একটা লোককে ধরে নিয়ে হিসেবে গোঁজামিল দিতে।

পাছে অন্য লোকে জানতে পেরে যায় তাই তারা সাততাড়াতাড়ি নিমলার বাগান ছেড়ে রাস্তায় বেরল। চতুর্দিকে নজর, কাউকে যদি একাএকি পায় তবে তাকে দিয়ে কাজ হাসিল করবে। ভোরের অন্ধকার তখনো কাটেনি। এক হতভাগা গ্রামের রাস্তার পাশে প্রয়োজনীয় কর্ম করতে এসেছিল। তাকে ধরে শিকলি, পরিয়ে নিয়ে চলল আর সকলের সঙ্গে জলালাবাদের দিকে।

সমস্ত রাস্তা ধরে তাকে ইহলোক পরলোক সকল লোকের সকল রকম ভয় দেখিয়ে পাহারাওয়ালারা শাসিয়ে বলল, জলালাবাদের জেলর তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করলে সে যেন শুধু বলে, মা খু চিহল ও পঞ্জম হস্তম অর্থাৎ আমি পঁয়তাল্লিশ নম্বরের। ব্যস, আর কিছু না।

লোকটা হয় আকাট মূর্খ ছিল, না হয় ভয় পেয়ে হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিল অথবা এও হতে পারে যে সে ভেবে নিয়েছিল যে যদি কোনো কয়েদী পালিয়ে যায়, তবে সকলের পয়লা রাস্তায় যে সামনে পড়ে তাকেই সরকারী নম্বর পুরিয়ে দিতে হয়। অথবা হয়ত ভেবে নিয়েছিল রাস্তার যে-কোনো লোককে রাজার হাতী যখন মাথায় তুলে নিয়ে সিংহাসনে বসাতে পারে তখন তাকে জেলখানায়ই বা নিয়ে যেতে পারবে না কেন?

বেতারবাণী বললেন, গল্পটা আমি কম করে জন পাঁচেকের মুখে শুনেছি। ঘটনাগুলোর বর্ণনায় বিশেষ ফেরফার হয় না কিন্তু ঐ হতভাগা কেন যে জলালাবাদের জেলরের সামনে সমস্ত ঘটনাটা খুলে বলবার চেষ্টা একবারও করল না সেই বিচিত্র।

সর্দারজী শুধালেন, অন্য কয়েদীরাও চুপ করে রইল?

বেতারওয়ালা বললেন, তাদের চুপ করে থাকার প্রচুর কারণ ছিল। সব কটা কয়েদীই ছিল একই ডাকাত দলের। তাদেরই একজন পালিয়েছে অন্য সকলের ভরসা সে যদি বাইরে থেকে তাদের জন্য কিছু করতে পারে। তার পালানোতে অন্য সকলের যখন সড় ছিল তখন তারা কিছু বললে তোল তাকে ধরিয়ে দেবারই সুবিধে করে দেওয়া হত।

তা সে যাই হোক, সেই হতভাগা তো জলালাবাদের জাহান্নমে গিয়ে ঢুকল। কিছুদিন যাওয়ার পর আর পাঁচজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে বুঝতে পারল কি বোকামিই সে করেছে। তখন একে ওকে বলে কয়ে আলা হজরত বাদশার কাছে সমস্ত ব্যাপারের বর্ণনা দিয়ে সে দরখাস্ত পাঠাবার চেষ্টা করল। কিন্তু জলালাবাদের জেলের দরখাস্ত সহজে হুজুরের কাছে পৌঁছয় না। জেলরও ভয় পেয়ে গিয়েছে, ভালো করে সনাক্ত না করে বেকসুর লোককে জেলে পোরার সাজাও হয়ত তার কপালে আছে। অথবা হয়ত ভেবেছে, সমস্তটাই গাঁজা, কিম্বা ভেবেছে, জেলের আর পাঁচজনের মত এরও মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে।

জলালাবাদের জেলের ভিতরে কাগজ-কলমের ছড়াছড়ি নয়। অনেক ঝুলোঝুলি করে সে দরখাস্ত লেখায়, তারপর সে দরখাস্তের কি গতি হয় তার খবর পর্যন্ত বেচারীর কানে এসে পৌঁছয় না।

বিশ্বাস করবেন না, এই করে করে একমাস নয় দুমাস নয়, এক বৎসর নয় দুবৎসর নয়— ঝাড়া ষোলটি বৎসর কেটে গিয়েছে। তার তখন মনের অবস্থা কি হয়েছে বলা কঠিন, তবে আন্দাজ করা বোধ করি অন্যায় নয় যে, সে তখন দরখাস্ত পাঠানোর চেষ্টা ছেড়ে দিয়েছে।

এমন সময় তামাম আফগানিস্থান জুড়ে খুব বড় একটা খুশীর জশন (পরব) উপস্থিত হল–মুইন-উস-সুলতানের (যুবরাজের) শাদী অথবা তার প্রথম ছেলে জন্মেছে। আমীর হবীব উল্লা খুশীর জোশে অনেক দান-খয়রাত করলেন ও সে খয়রাতির বরসাত কখাসুখা জেলগুলোতেও পৌঁছল। শীতকাল; আমীর তখন জলালাবাদে। ফরমান বেরল, জালালাবাদের জেলর যেন তাবৎ কয়েদীকে হুজুরের সামনে হাজির করে। হুজুর তার বেহদ মেহেরবানি ও মহব্বতের তোড়ে বে-এখতেয়ার হয়ে হুকুম দিয়ে ফেলেছেন যে খুদ তিনি হরেক কয়েদীর ফরিয়াদ-তকলিফের খানাতল্লাশি করবেন।

বিস্তর কয়েদী খালাস পেল, তারো বেশী কয়েদীর মিয়াদ কমিয়ে দেওয়া হল। করে করে শেষটায় নিমলার সেই হতভাগা হুজুরের সামনে এসে দাঁড়াল।

হুজুর শুধালেন, তু কীন্তী, তুই কে?

সে বলল, মা খু চিহল ও পঞ্জ হস্ত অর্থাৎ আমি তো পঁয়তাল্লিশ নম্বরের।

হুজুর যতই তার নামধাম কসুরসাজার কথা জিজ্ঞাসা করেন। সে ততই বলে সে শুধু পঁয়তাল্লিশ নম্বরের। ঐ এক বুলি, এক জিগির। হুজুরের সন্দেহ হল, নোকটা বুঝি পাগল। ঠাহর করবার জন্য অন্ত নানা রকমের কঠিন কঠিন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হল, সূর্য কোন্ দিকে ওঠে, কোন্ দিকে অস্ত যায়, মা ছেলেকে দুধ খাওয়ায়, না ছেলে মাকে। সব কথার ঠিক ঠিক উত্তর। দেয় কিন্তু তার নিজের কথা জিজ্ঞেস করলেই বলে, আমি তো পঁয়তাল্লিশ নম্বরের।

ষোল বছর ঐ মন্ত্র জপ করে করে তার বিশ্বাস হয়ে গিয়েছে, তার নাম নেই ধাম নাই, সাকিনঠিকানা নেই, তার পাপ নেই পুণ্য নেই, জেলের ভিতরের বন্ধন নেই, বাইরের মুক্তিও নেই— তার সম্পূর্ণ অস্তিত্ব তার সর্বৈব সত্তা ঐ এক মন্ত্রে, আমি পঁয়তাল্লিশ নম্বরের।

শত দোষ থাকলেও আমীর হবীব উল্লার একটা গুণ ছিল; কোনো জিনিসের খেই ধরলে তিনি জট না ছাড়িয়ে সন্তুষ্ট হতেন না। শেষটায় সেই ডাকাতদের যে দু-একজন তখনো বেঁচেছিল তারাই রহস্যের সমাধান করে দিল।

শুনতে পাই খালাস পাওয়ার পরও, বাকী জীবন সে ঐ পঁয়তাল্লিশ নম্বরের ভানুমতী কখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

গল্প শুনে আমার সর্বশরীর কাঁটা দিয়ে উঠল। পরিপক্ক বৃদ্ধ সর্দারজীর মুখে শুধু আল্লা মালিক, খুদা বাঁচানেওয়ালা।

ততক্ষণে চড়াই আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। কাবুল যেতে হলে যে সাত আট হাজার ফুট পাহাড় চড়তে হয় নিমলার কিছুক্ষণ পরেই। তার আরম্ভ।

শিলেট থেকে যারা শিলঙ গিয়েছেন, দেরাদুন থেকে মসৌরী, কিম্বা মহাবলেশ্বরের কাছে পশ্চিম ঘাট উত্তীর্ণ হয়েছেন তাঁদের পক্ষে এ রকম রাস্তার চুলের কাটার বাঁক, হাঁসুলি চাকের মোড় কিছু নূতন নয়–নূতনত্বটা হচ্ছে যে, এ রাস্তা কেউ মেরামত করে দেয় না, এখানে কেউ রেলিঙ বানিয়ে দেয় না, হরেক রকম সাইনবোর্ড দুদিকের পাহাড়ে সেঁটে দেয় না, বিশেষ সংকীর্ণ সংকট পেরবার জন্য সময় নির্দিষ্ট করে দুদিকের মোটর আটকানো হয় না। মাটি ধসে রাস্তা যদি বন্ধ হয়ে যায় তবে যতক্ষণ না জন আষ্টেক ড্রাইভার আটকা পড়ে আপন আপন শাবল দিয়ে রাস্তা সাফ করে নেয় ততক্ষণ পর্যন্ত পণ্ডিতমশায়ের রাধে গো ব্রজসুন্দরী, পার করো বলা ছাড়া অন্য কিছু করবার নেই। যারা শীতকালে এ রাস্তা দিয়ে গিয়েছেন তাঁদের মুখে শুনেছি যে রাস্তার বরফও নিজেদের সাফ করতে হয়। অবশ্য বরফ সাফ করাতে আভিজাত্য আছে— শুনেছি স্বয়ং হুমায়ুন বাদশাহ নাকি শের শাহের তাড়া খেয়ে কাবুল কান্দাহার যাবার পথে নিজ হাতে বরফ সাফ করেছিলেন।

শিলঙ-নৈনিতাল যাবার সময় গাড়ির ড্রাইভার অন্ততঃ এই সান্ত্বনা দেয় যে, দুর্ঘটনা বড় একটা ঘটে না। এখানে যদি কোনো ড্রাইভার এ রকম কথা বলে তবে আপনাকে শুধু দেখিয়ে দিতে হবে, রাস্তার যে-কোনো এক পাশে, হাজার ফুট গভীর খাদে দুর্ঘটনায় অপমৃত দুটো একটা মোটর গাড়ির কঙ্কাল। মনে পড়ছে কোন্ এক হিল-স্টেশনের চড়াইয়ের মুখে দেখেছিলুম, ড্রাইভারদের বুকে যমদুতের ভয় জাগাবার জন্য রাস্তার কর্তাব্যক্তিরা একখানা ভাঙা মোটর ঝুলিয়ে রেখেছেন নিচে বড় বড় হরপে লেখা, সাবধানে না চললে এই অবস্থা তোমারও হতে পারে। কাবুলের রাস্তার মুখে সে রকম ব্যাপক কোনো বন্দোবস্তের প্রয়োজন হয় না–চোখ খোলা রাখলে দুদিকে বিস্তর প্রাঞ্জল উদাহরণ দেখতে পাওয়া যায়।

সবচেয়ে চিত্তির যখন হঠাৎ বাঁক নিয়ে সামনে দেখতে পাবেন আধ মাইল লম্বা উটের লাইন। একদিকে পাহাড়ের গা, আর একদিকে হাজার ফুট গভীর খাদ, মাঝখানে গাড়ি বাদ দিয়ে রাস্তার ক্লিয়ারিঙ এক হাত। তার ভিতর দিয়ে নড়বড়ে উট দূরের কথা, শান্ত গাধাও পেরতে পারে না। চওড়া রাস্তার আশায় আধ মাইল লম্বা উটের সারিকে পিছু ঠেলে নিয়ে যাওয়াও অসম্ভব। তখন গাড়িই ব্যাক করে চলে উল্টো দিকে। সে অবস্থায় পিছনের দিকে তাকাতে পারেন এমন স্থিতপ্রজ্ঞ, এমন স্নায়ুবিহীন দুঃখেমুদ্বিগ্নমনা স্থিতধী মুনিবর আমি কখনো দেখিনি। সবাই তখন চোখ বন্ধ করে কলমা পড়ে আর মোটর না-থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকে। তারপর চোখ খুলে যা দেখে সেও পিলে-চমকানিয়া। আস্তে আস্তে একটা একটা করে উট সেই ফঁকা দিয়ে যাচ্ছে, তারপর বলা নেই কওয়া নেই একটা উট হঠাৎ আধপাক নিয়ে ফাঁকাটুকু চওড়াওড়ি বন্ধ করে দেয়। পিছনের উটগুলো সঙ্গে সঙ্গে না থেমে সমস্ত রাস্তা জুড়ে ঝামেলা লাগায়— স্রোতের জলে বাঁধ দিলে যে রকম জল চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। যে উটটা রাস্তা বন্ধ করেছে তাকে তখন সোজা করে ফের এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য জন পাঁচেক লোক সামনে থেকে টানাটানি করে, আর জন বিশেক পিছন থেকে চেঁচামেচি হৈ-হল্লা লাগায়। অবস্থাটা তখন অনেকটা ছোট গলির ভিতর আনাড়ি ড্রাইভার মোটর ঘোরাতে গিয়ে আটকা পড়ে গেলে যে রকম হয়। পার্থক্য শুধু এইটুকু যে সেখানে হাজার ফুট গভীর খাদের ভয় নেই, আর আপনি হয়ত রকে বসে বিড়ি হাতে আণ্ডা-বাচ্চা নিয়ে গুষ্ঠিসুখ অনুভব করছেন।

এই অবস্থায় যদি পিছন থেকে আর এক সার উট এসে উপস্থিত হয় তবে দটার সম্পূর্ণ খোলতাই হয়। আধ মাইল ধরে, সমস্ত রাস্তা জুড়ে তখন ঢাকা-দক্ষিণের মেলার গোরুর হাট বসে যায়।

বুখারাসমরকন্দ, শিরাজ-বদখশান সেই দয়ে মজে গিয়ে চিৎকার করে, গালাগাল দেয়, জট খোলে, ফের পাকায়, অস্ত্র সম্বণ করে দুদণ্ড জিরিয়ে নেয়, ঢেলে সেজে ফের গোড়া থেকে ঔড্র কায়দায় আরম্ভ করে

ক রে কমললোচন শ্রীহরি

খ রে খগ-আসনে মুরারি

গ রে গরুড়–

স্মৃতিশক্তির উপর নির্ভর করাই যদি সত্য নিরূপণের একমাত্র উপায় হয়, তবে আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে আমি আজও সেই রাস্তার মাঝখানে মোটরের ভিতর কনুয়ের উপর ভয় করে দু হাতে মাথা চেপে ধরে বসে আছি। জটপাকানো স্পষ্ট মনে আছে কিন্তু সেটা কি করে খুলল, মোটর আবার কি করে চলল, একদম মনে নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *