দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
ভুল করে থাকলে তা স্বীকার করুন
আসি বৃহত্তর নিউইয়র্কের প্রায় মাঝখানেই থাকি, তা সত্ত্বেও আমার বাড়ির এক মিনিট হাঁটা পথের দূরত্ব একফালি চমকার জঙ্গল আছে। বসন্তকালে সেখানে চমৎকার জামগাছে ফল ধরে, কাঠবিড়ালীরা এখানে বাসা বেঁধে বাচ্চাদের নিয়ে খেলা করে। এখানে জন্মায় বিরাট ঘোড়ার মাথার সমান উঁচু দীর্ঘ ঘাস। এই সুন্দর অকলঙ্কিত একখণ্ড বনের নাম ফরেষ্ট পার্ক–আর এটা সত্যিই একটা জঙ্গল। কলম্বাস যেদিন বিকেলে আমেরিকা আবিষ্কার করেন তখন এটা যেমন ছিল আজও বোধ হয় তাই রয়ে গেছে। আমি ওই জঙ্গলে আমার ছোট্ট বুলডগ রেক্সকে নিয়ে বেড়াতে যাই। রেক্স অত্যন্ত নিরীহ হাউণ্ড কুকুর। বেড়াতে গিয়ে কারও সঙ্গে দেখা হয় না বলেই রেক্সকে আমি শিকল বেঁধে রাখি না।
একদিন পার্কে দেখা হয়ে গেল ঘোড়সওয়ার এক পুলিসের সঙ্গে, পুলিসটি তার কর্তৃত্ব দেখাতে তৎপর হয়ে উঠলো।
‘এভাবে কুকুরের শিকল খুলে নিয়ে পার্কে বেড়াচ্ছেন কেন?’ সে আমায় বেশ ধমক দিয়েই বললো। জানেন না এটা বেআইনী?
হ্যাঁ, তা জানি’, আমি স্বরেই বললাম। তবে ও কারও ক্ষতি করবে না, তাই–।’
‘আপনি ভাবেননি! আঁ! আপনি কি ভাবেন তা নিয়ে আইন মাথা ঘামায় না। কুকুরটা কোন কাঠবিড়ালীকে মেরে ফেলতে পারে বা কোন বাচ্চাকে কামড়াতে পারে। যাক, এবারের মত আপনাকে ছেড়ে দিচ্ছি। ভবিষ্যতে কোনদিন আপনার কুকুরকে শিকল ভোলা দেখলে আপনাকে জজের কাছে আপনার কথা বোঝোতে হবে।’
আমি ভীরু গলায় হুকুম তামিল করবো জানালাম।
তামিল করেছিলাম বটে–তবে মাত্র কয়েকবার। কিন্তু রেক্স শিকল পছন্দ করতো না, আর আমিও তাই। অতএব, আগের মত শিকল খুলেই রেক্সকে নিয়ে বেড়াতে লাগলাম। প্রথম প্রথম ভালোই কাটল। তারপর একদিন ফাঁদে পড়ে গেলাম। একদিন বিকেলে একটা পাহাড়ের কোলে আইন রক্ষক ভদ্রলোকের মুখোমুখি হয়ে পড়লাম। সে ঘোড়ার পিঠেই ছিল। রেক্স খোলা অবস্থায় সোজা সেই অফিসারের সামনে।
আমি তৈরি ছিলাম। জানতাম কি ঘটবে। অতএব পুলিশকে আর কথা আরম্ভ করার সুযোগ দিলাম, আমিই তা শুরু করলাম। আমি বললাম : ‘অফিসার, আপনি আমায় হাতে হাতেই ধরেছেন। আমি দোষী। আমার কোন অজুহাতই নেই, কোন ওজরও নেই। আপনি আমায় গত সপ্তাহে সাবধান করেছিলেন যে রেক্সকে যেন শিকল দিয়ে বেঁধে রাখি। না হলে জরিমানা করবেন।’
পুলিশ কর্তাটি নরম গলায় বললেন, ‘ঠিক আছে। আমি বুঝতে পারছি এই রকম ছোট্ট কোন কুকুর ছেড়ে রাখার লোভ সামলানো যায় না, যখন বিশেষ করে কেউ থাকে না।‘
‘হ্যাঁ, লোভ বলতে পারেন, আমি জবাব দিলাম। তবে এটা আইনের নিয়মে।‘
‘যাকগে, এরকম কুকুর কারও ক্ষতি করবে না’, পুলিশটি জানালেন।
‘না’ তবে সে কাঠবিড়ালী মারতে পারে, আমি বললাম।
তিনি বললেন বুঝেছি, ‘আপনি ব্যাপারটায় বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন, ‘কি করবেন আমি বলে দিচ্ছি। ওকে পাহাড়ের কাছে ছুটোছুটি করতে দিন আমি যাতে না দেখি–তাহলে সব ভুলে যাব।’
পুলিশটি মানুষ হওয়াতেই একটু আত্মগরিমা দেখাতে চাইছিলেন, তাই আমি যখন নিজেকে দোষী বলতে লাগলাম তখনই তিনি নিজের শ্রেষ্ঠত্ব বোঝানোর জন্যেই দয়া প্রদর্শন করলেন।
কিন্তু ধরুন আমি যদি আত্মপক্ষ সমর্থন করতে চাইতাম-তাহলে ব্যাপারটা কেমন দাঁড়াত? পুলিশের সঙ্গে আপনারা কখনও তর্ক করেছেন?
তাই তার সঙ্গে তর্ক করার পথে না গিয়ে আমি স্বীকার করলাম তিনিই সম্পূর্ণ ঠিক আর আমি সম্পূর্ণ ভুল করছি। আমি স্বীকারের কাজটা বেশ দ্রুত আর আন্তরিকতার সঙ্গেই করি। আমি ওঁর দিক আর উনি আমার দিকটা নিতেই ব্যাপারটা চমৎকার ভাবেই মিটে গেল। লর্ড চেষ্টারফিল্ডও বোধহয় তত মহত্ত্ব দেখাতে পারতেন না, অথচ একসপ্তাহ আগে তিনিই আমায় আইনের ভয় দেখিয়ে ছিলেন।
এমন অবস্থায় অপর ব্যক্তি বলার আগেই নিজেই দোষ স্বীকার করা ভাল নয় কি? অপরের মুখ থেকে খারাপ কথা শোনার আগে আত্মসমালোচনার কথা নিজে কানে শোনা ভাল তাই না?
অন্যে আপনার সম্বন্ধে যেসব খারাপ কথা ভাবছে বা বলতে চাইছে সেগুলোই নিজে বলে ফেলুন-আর সেটা বলে ফেলুন অন্যে তা বলার আগেই–আর এইভাবেই তার পালের হাওয়া কেড়ে নিন। এমন করলে একশ বারে নিরানব্বই বারই দেখবেন সে বেশ মহত্ব দেখিয়ে ক্ষমা করার পর্যায়ে চলে আসবে, ঠিক পুলিশটি যেমন আমার আর রেক্সের ক্ষেত্রে করেন।
ফার্দিনান্দ ওয়ারেন নামে একজন কমার্শিয়াল আর্টিষ্ট একবার বদমেজাজী একজন ক্রেতাকে এই কৌশলে বশ করেন।
নিজের কাহিনী বলতে গিয়ে তিনি জানান যে বিজ্ঞাপনের আর প্রচারের কাজে ছবি আঁকার সময় অত্যন্ত সতর্ক আর ঠিক থাকতে হয়।
তিনি বলেন : ‘কিছু শিল্প সম্পাদক চান তাদের কাজ সঙ্গে সঙ্গেই করে দেওয়া হোক। এরকম করতে গিয়ে অনেক সময়েই ভুল হয়। একজন এরকম শিল্প সম্পাদককে আমি জানতাম যিনি ছোটখোটো ভুল ধরে আনন্দ পেতেন। প্রায়ই আমি তার অফিস থেকে অতি রেগে বেরিয়ে আসতাম, সেটা সমালোচনার জন্য নয়, বরং তার আক্রমণের পদ্ধতির জন্যেই। সম্প্রতি ওই ভদ্রলোককে আমি খুব দ্রুত কিছু কাজ করে দিই। তিনি হঠাৎ আমায় টেলিফোন করে তার অফিসে যেতে বললেন। তিনি জানালেন কিছু ভুল হয়েছে। আমি পৌঁছতেই ঠিক যা ভেবেছিলাম তাই দেখলাম আর ভয়ও পেলাম। ভদ্রলোক প্রায় ক্ষিপ্ত অবস্থায় আমার উপর একহাত নিতে তৈরি। বেশ গরম হয়েই তিনি বললেন আমি এই করেছি, তাই করেছি। এতদিন যা শিখেছিলাম সেই আত্মসমালোচনা করারই সুযোগ আমার এসে গেল। অতএব আমি বললাম : আপনি যা বলছেন তা সত্য হলে আমারই ভুল হয়েছে, অপরাধের কোন ক্ষমা নেই। বহুঁকাল ধরেই আপনার জন্য ছবি আঁকছি, আমার জানা উচিত ছিল; আমি অত্যন্ত লজ্জিত।
তিনি সঙ্গে সঙ্গে আমার পক্ষ সমর্থন করতে আরম্ভ করলেন। হ্যাঁ, ঠিকই বলেছো। তবে ভুলটা এমন কিছু মারাত্মক নয়। এ হলো শুধু।
‘আমি তাঁকে বাধা দিলাম, যেকোন ভুলেই বাজে খরচ আসবে, তাছাড়া এ অতি বিরক্তিকর।’
‘তিনি কিছু আবার বলতে যেতেই বাধা দিলাম। আমার খুবই ভাল লাগছিল। জীবনে এই প্রথম আমি নিজের সমালোচনা করছিলাম এ আমার ভালোই লাগছিল।‘
‘আমার আরও সাবধান হওয়া উচিত ছিল, আমি বলে চলোম। আপনি আমায় প্রচুর কাজ দেন, আপনি সেরা জিনিসই চাইবেন। তাই সব আবার আমি নতুন করেই এঁকে দেব।’
‘না! না!’ তিনি বলে উঠলেন। ‘তোমায় আবার একাজ করতে দিতে পারি না, তিনি আমার কাজের প্রশংসা করে বললেন, সামান্য একটু অদল বদল করলেই চলবে। আমার সামান্য ভুলে কোন অর্থ ক্ষতি হয়নি। সামান্য ব্যাপার–এতে চিন্তার কিছু নেই।’
নিজেকে সমালোচনা করতেই ভদ্রলোকের সব রাগ জল হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত তিনি আমায় মধ্যাহ্নভোজে নিয়ে গেলেন। আমি বিদায় নেবার আগে আমাকে তিনি একটা চেক আর কমিশনও দিলেন।
বোকারাই কেবল নিজের ভুল সমর্থন করতে চায় না–বেশির ভাগ বোকারাই তাই করে। কিন্তু নিজের ভুল মেনে নিতে মহত্বই প্রকাশ পায় আর তাতে কাজও হয়। একটা উদাহরণ রাখছি। ইতিহাসে রবার্ট লী’য়ের সম্বন্ধে রয়েছে যে তিনি যে ভাবে গেটিসবার্গ আক্রমণের ব্যর্থতা নিজের কাঁধে নেন সেকথার তুলনা নেই, তাতে তিনি অতি মহৎ হয়েই আছেন। এ ব্যর্থতা আসে পিকেটের আক্রমণে।
পশ্চিমী দুনিয়ায় পিকেটের আক্রমণ হয়ে আছে সবচেয়ে দর্শনীয় আর আশ্চর্যজনক কোন আক্রমণ। পিকেট নিজে ছিলেন অত্যন্ত রূপবান। তাঁর মাথার পাশে ঢল নামতে থোকা থোকা চুল, প্রায় কাঁধ অবধি নামতো সে চুল। ইতালি আক্রমণের সময় নেপোলিয়ন যেরকম করতেন পিকেটও তেমনি যুদ্ধক্ষেত্রে রোজই প্রেমপত্র লিখতেন। সেনাবাহিনীর প্রত্যেকেই বিনা প্রতিবাদে মেনে চলতো তাঁর আদেশ।
পিকেটের সেনাবাহিনী শক্রব্যুহ আক্রমণ করার জন্য এগিয়ে চলতেই আচমকা শত্রুপক্ষ লুকনো জায়গা থেকে ওই সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। পিকেটের পাঁচ হাজার সেনার প্রায় পাঁচভাগের চার ভাগই তাতে ধ্বংস হয়ে যায়। সামান্য ভুলে আর অসতর্কতার ফলেই এমন মারাত্মক ব্যাপার ঘটে যায়।
পিকেটের এই আক্রমণ ইতিহাসে সোনার অক্ষরেই লেখা আছে-বীরত্বপূর্ণ যে সংগ্রামের তুলনা নেই। লী ব্যর্থ হলেন এইভাবেই। উত্তরে এগুনোর পথ ছিল না–দক্ষিণের অবস্থাও তাই।
লী নিদারুণ শোকাহত আর দুঃখিত হলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই প্রেসিডেন্ট জেফারসন ডেভিসের কাছে পদত্যাগ পত্র পাঠিয়ে দিলেন। তিনি তাতে লিখেছিলেন তার জায়গায় একজন তরুণ আর যোগ্য ব্যক্তিকেই যেন নিয়োগ করা হয়। লী যদি পিকেটের ব্যর্থতার জন্য কাউকে দোষারোপ করতে চাইতেন তাহলে সেরকম সুযোগ তিনি প্রচুর পেতেন। তার নিচের কিছু সেনাপতিরাই ব্যর্থ হন। ঘোড়সওয়ার বাহিনী পদাতিক বাহিনীকে সাহায্য করতে সময়মত আসেনি। এতেই ভুল মারাত্মক হয়ে ওঠে।
কিন্তু লী ছিলেন মহৎ, তিনি অপরকে দোষারোপ করেননি। পিকেটের হতাবশিষ্ট, রক্তাক্ত বাহিনী ফিরে আসতেই লী স্বয়ং তাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে বলেন, এ দোষ আমার, আমার নিজের দোষেই এযুদ্ধে আমাদের পরাজয় হয়েছে।’
ইতিহাসে খুব কম সেনাপতিরই এমন স্বীকারোক্তি করার সাহস দেখা গেছে।
এলবার্ট হাভার্ড এমন ধরনের একজন লেখক ছিলেন যে একটা জাতিকেই প্রায় কাঁপিয়ে তুলতেন তাঁর লেখায়। তাঁর লেখার খোঁচায় অনেকের মধ্যেই অসন্তোষ জাগতো। কিন্তু হাভার্ড মানুষের সঙ্গে তাঁর চমৎকার ব্যবহারের গুণে শত্রুকেও বন্ধু করে তুলতেন।
যেমন একটা উদাহরণ দিচ্ছি : একবার এক ক্রুদ্ধ পাঠক জানান যে তিনি হাভার্ডের মতের সঙ্গে একমত নন। তিনি হাভার্ডকে নানা বিশেষণে ভূষিত করেন। হাভার্ড কিন্তু এর জবাব দিলেন এইভাবে :
‘চিন্তা করে দেখলাম, আমার নিজের মত লেখাটার সঙ্গে মেলে না। আগে যা সব লিখেছি আজ সেগুলো আমার অনেকক্ষেত্রেই পছন্দ হয় না। আমি আনন্দিত যে আপনি লেখাটি নিয়ে ভেবেছেন। ভবিষ্যতে এদিকে এলে একবার আমার এখানে যদি আসেন তাহলে লেখাটি নিয়ে আলোচনাও করা যাবে। দূর থেকেই হাত বাড়িয়ে দিচ্ছি।
আপনার বিশ্বস্ত….।
এরকম ব্যবহার যিনি করতে পারেন তাকে কিই বা বলবেন?
যখন আমাদের কথা ঠিক হয় তখন অপরজনকে কৌশলী পথে নিজের মতের অনুসারেই করতে হবে–আর আমাদের যখন ভুল হবে–সেটা আশ্চর্যজনকভাবে প্রায়ই হয়–তখন আসুন নিজেদের ভুল দ্রুত স্বীকার করে ফেলি। এই কৌশলে যে কেবল দ্রুত, ফল দেবে তাই নয় বিশ্বাস করুন এতে খুব মজাও পাবেন আর সেটা আত্মসমর্থনের চেয়েও ভালো।
প্রাচীন সেই প্রবাদটা মনে রাখবেন : ‘লড়াই করে যথেষ্ট পাবেন না, বরং নরম হলে আশাতীতই পেতে পারবেন।‘
অতএব যদি অপরকে নিজের মতে আনতে চান তাহলে ৩নং নিয়মটা মনে রাখবেন :
‘যদি আপনি ভুল করেন, তাড়াতাড়ি বেশ আন্তরিকভাবেই স্বীকার করুন।‘