এরপর ভীমাপ্লাসাহেব যেদিন কনসুলেটে এলেন, সেদিন আর শর্মাজীকে দেখা গেল না। ট্যান্ডন সাহেব একটু বিস্মিত হলেন। দীর্ঘদিন ফরেন সার্ভিসে কাজ করে তার অভিজ্ঞতা হয়েছে যে একটু চালু মন্ত্রীরা ঠিক একলা দেশভ্রমণ পছন্দ করেন না।
কারণ?
কারণ একটা নয়, একাধিক। তবে শুধু উমেদারি, তাবেদারি বা খিদমতগারির জন্য নয়, নিজেদের রসনা আর বাসনা পরিতৃপ্তির জন্য।
নিজের নিজের কর্মক্ষেত্রে মন্ত্রীদের পক্ষে বেহিসেবী হওয়া যায় না। মোটা খদ্দরের তলায় মনের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলোকে বাধ্য হয়ে চাপা রাখতে হয়। এত পরিচিত সমাজে খেয়াল-খুশি চরিতার্থ করা অসম্ভব। একটু এদিক-ওদিক হলেই বিধানসভা-লোকসভায় মে আই নো স্যার বলে না জানি কে প্রশ্ন করবেন। এরপর লোক্যাল কাগজের রিপোর্টারগুলো তো আছেই।
বিহারের ভূতপূর্ব মন্ত্রী দিব্যেন্দুবিকাশ চৌধুরি মিঃ ট্যান্ডনকে এবার বলেছিলেন, আচ্ছা বলুন
তো মিঃ ট্যান্ডন, মন্ত্রী হয়েছি বলে কি আমরা রক্ত-মাংসের মানুষ নই?
সহানুভূতি জানিয়ে মিঃ ট্যান্ডন বলেছিলেন, তা তো বটেই!
কলেজের ছেলেরা মেয়েদের নিয়ে ঘুরতে পারে, অধ্যাপকরা ছাত্রীদের আদর করতে পারেন চাকুরিয়া সহকর্মী মেয়েদের নিয়ে ডায়মন্ডহারবার বা পুরী যেতে পারেন, মার্কেন্টাইল ফার্মের অফিসার ইয়ং মেয়ে স্টেনোদের নিয়ে মুসৌরী-নৈনীতাল কনফারেন্স বা সেমিনারে যেতে পারেন…।
ঝড়ের বেগে দিব্যেন্দুবিকাশের দুঃখের ইতিহাস বেরিয়ে আসে।
বেইরুটের ইন্ডিয়ান এম্বাসীর চান্সেরী বিল্ডিং-এর তিনতলায় ওই কোণার ঘরে বসেই মিঃ ট্যান্ডন ভূমধ্যসাগরের মাতাল হাওয়ার স্পর্শ অনুভব করেন। জানালা দিয়ে একবার বাইরের আকাশটা দেখেন। তারপর সান্ত্বনা দিয়ে মাঝপথে মন্তব্য করলেন, আমি আপনার কথা কোয়াইট রিয়ালাইজ করি।
একটু আস্তে হলেও উত্তেজনায় টেবিল না চাপড়ে পারলেন না দিব্যেন্দু-বিকাশ। রিয়ালাইজ কেন, অ্যাপ্রিসিয়েট করবেন আমার কথা-কারণ দেয়ার ইজ লজিক ইন মাই আর্গুমেন্ট।
দ্যাটস রাইট।
ছোটখাটো মন্ত্রীরা ছোটখাটো শিকার ধরেন। কেউ শপিং করে দেয়, কেউ ট্যাকসির বিল মেটায় আর কেউ বা বেইরুটের পৃথিবী খ্যাত নাইট ক্লাব কিটক্যাটে নিয়ে যায়।
বড় বড় কর্তাব্যক্তিরা চুনোপুঁটি শিকার করেন না।…
একজন অতি সাধারণ বিদেশযাত্রীর মতো অশোক আগরওয়ালা নামে এক ভদ্রলোক দমদম থেকে কোয়ান্টাস ফ্লাইটে ইউরোপ গেলেন। বাইরের দুনিয়ার কেউ জানল না, খেয়াল করল না। পরিচিতরা জানল, দুর্গাপুরের এক কারখানার কোলাবরেশনের জন্য অশোকবাবু বিলাইত গেলেন।
কোলাবরেশনের মকরধ্বজ খেয়ে ভারতবাসীরা স্বর্গে যাবে বলে যেসব দিব্যজ্ঞানসম্পন্ন নেতৃবৃন্দের ধারণা, তারা অশোকবাবুর পকেট ভর্তি করে ফরেন এক্সচেঞ্জ দিয়েছেন। এছাড়া
এছাড়া আবার কি?
এছাড়া এ-বি-সি অ্যান্ড একস-ওয়াই-জেড ইন্টারন্যাশনাল কনসট্রাকশন কোম্পানির ওভারসিজ ম্যানেজারের অ্যাকাউন্টে তো মাসে মাসে পাঁচশো ডলার জমছে।
তার মানে?
অশোক আগরওয়ালা আর তার বন্ধুরা হয়তো ভাবেন কেউ কিছু বোঝে না। ট্যান্ডন সাহেব মনে মনে হাসতেন। রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে বলা হল, ওভারসীজ ম্যানেজারকে মাইনে দশ হাজার টাকা প্লাস কার অ্যালাউন্স প্লাস অফিস অ্যালাউন্স প্লাস এন্টারটেনমেন্ট অ্যালাউন্স প্লাস…। ওভারসিজ ম্যানেজারকে বলা আছে, শ্রীমানজী! মাসে মাসে পাঁচশো ডলার ব্যাঙ্কে জমা রাখবে। কর্তাব্যক্তিরা বা তাদের বন্ধু-বান্ধব-হিতাকাক্ষীরা এলেই ওই ডলার খরচ হবে।
সুতরাং পকেট ভর্তি ভরেন এক্সচেঞ্জ ছাড়াও অশোকবাবুর আরো কিছু সম্ভব ছিল। একমাস ধরে ইউরোপের দেশে দেশে ঘুরে বেড়িয়ে বন্ধুদের সেবার জন্য ফুলপ্রপ ব্যবস্থা করলেন অশোকবাবু।
এক মাস পরে বন্ধুবর যেদিন ভারতের কোনো এয়ারপোর্ট থেকে বি-ও-এ-সি প্লেনে চাপলেন, সেদিন লোকে-লোকারণ্য। যেদিন ফিরে এলেন সেদিনও শত-সহস্র মানুষের ভিড়। কেউ জানল না কার নিঃস্বার্থ সেবায় তার যাত্রা সফল হল।
ট্যান্ডন সাহেব এসব জানেন, বোঝেন। ছোটখাটো সেবা-যত্ন পাবার লোভেই যে ভীমাপ্পাসাহেব শৰ্মাজীকে সঙ্গে রেখেছিলেন, তাও তিনি জানেন। আর জানেন যে, শৰ্মাজীও লিডার। কাঁচা লোক নন। একেবারে ফিনিশড প্রডাক্ট। সুতরাং তিনিও তার ওই টিটাগড়ের কারখানার ইংরেজ জেনারেল ম্যানেজার মারফত বিধি-ব্যবস্থা করেছেন ইউরোপ দর্শনের সুব্যবস্থার জন্যে। শ্রমিক-কল্যাণের জন্য বিদেশি মিল-মালিকের দল যে ইউরোপ ভ্রমণকারী কোনো কোনো লিডারের সেবা-যত্নের ব্যবস্থা করেন, তা শুধু মিঃ ট্যান্ডন নয়, সব ডিপ্লোম্যাটরাই জানেন।
তবুও মিঃ ট্যান্ডন জিজ্ঞাসা করলেন, হোয়াট হ্যাঁপেন্ড টু মিস্টার শর্মা? ওকে আজ দেখছি না যে?
আর বলবেন না! আমাদের কোনো কোনো লিডার এমন করাপটেড আর হোপলেস যে। কি বলব? ওঁর গার্ডেনরীচ ওয়ার্কশপের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মিঃ ব্রাউন অ্যাকসিডেন্টালি বার্লিনে এসেছিলেন। মার্টিনী খেতে খেতে একটু নিভৃতে দু-একটা ইস্যু নিয়ে আলোচনার জন্য কয়েক দিন…।
মিঃ ট্যান্ডন বাধা দিয়ে বললেন, না-না, আমি অত কিছু জানতে চাইনি। লেট হিম মাইন্ড হিজ ওন বিজনেস!
ইন এনি কেস ভীমাপ্পাসাহেব এবার কাজের কথায় আসেন, ওই ক্যামেরা আর বাইনোকুলারটা ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগে দিল্লি পাঠাতে হবে।
শৰ্মাজী অসৎ, কিন্তু ভীমাপ্পা সৎ। সৎ হয়েও ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগে, মাল পাচার করার অনুরোধ করতে দ্বিধা হয় না।
কূটনৈতিক জগতের এক আশ্চর্য আবিষ্কার হচ্ছে এই ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগ। কূটনৈতিক মিশনের সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ সম্পত্তি হচ্ছে এই ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগ। ওয়াশিংটনের সি-আই-এ দপ্তর থেকে মস্কোর আমেরিকান এম্বাসী মারফত এজেন্টদের কাছে যে গোপন সংকেত ও নির্দেশ যায়, তা থাকে এই ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগে। আমেরিকান এম্বাসী থেকে যে ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগ ওয়াশিংটনে যায়, তাতে থাকে রাশিয়ার অনেক গুপ্ত খবর। সারা দুনিয়া থেকে ক্রেমলিনে যেসব ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগ আসে, তাতেও ভর্তি থাকে অনেক রহস্য।
এই লেনদেনের কাহিনি সবাই জানে, সবাই বোঝে। তবে কেউ বাধা দেয় না। শান্তির সময় ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগের যাতায়াতে বাধা দেবার নিয়ম নেই, প্রথা নেই।
সাধারণত নিজের নিজের দেশের এয়ার লাইন্স এই ব্যাগ আনা-নেওয়া করে। ব্রিটিশ ফরেন অফিস বা ব্রিটিশ এম্বাসী প্যান অ্যামেরিকান বা এয়ার ফ্রান্সেও ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগ পাঠাবে না। এয়ার ক্র্যাফটের কম্যান্ডারের ব্যক্তিগত হেপাজতে এক ব্যাগ থাকে। কোনো দেশের গোয়েন্দা, পুলিশ বা কাস্টমস-এর স্পর্শ করার অধিকার নেই।
ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগে যে শুধু গোপন তথ্য যায় তা নয়। মিশনের নিত্য-নৈমিত্তিক চিঠিপত্র ও টুকিটাকি অনেক কিছু যায়। জরুরী প্রয়োজনে ডিপ্লোম্যাটদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্রও পাঠান হয়।
সে যাই হোক, ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগের রাজনৈতিক মূল্যের তুলনা নেই। প্রয়োজনের শেষ নেই। তাই তো বহু দেশ ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগের দেখাশোনা করার জন্য সঙ্গে দুএকজন ডিপ্লোম্যাটকেও পাঠায়।
ভারতবর্ষের অত ফালতু পয়সা নেই। তাছাড়া দুনিয়ার গোপন খবর লুঠপাট করে নেবার প্রয়োজনও তার নেই। তবুও তো ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগ। ফরেন মিনিস্ট্রির অনেক গোপন খবর। ও চিঠিপত্র তাতে থাকে।
ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগ এম্বাসি থেকেই যাতায়াত করে, কনসুলেট থেকে নয়। এই ব্যাগে কিছু পাঠাতে হলে কনসুলেট থেকে এম্বাসীতে পাঠাতে হবে এবং প্রয়োজনবোধে ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগে তার স্থান হবে।
বার্লিন থেকে কোনও ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগ সোজা দিল্লি যায় না। প্রথমে সব কিছুই বন-এ ইন্ডিয়ান এম্বাসীতে যাবে। তারপর সেখান থেকে নির্দিষ্ট দিনে ফ্রাঙ্কফুর্ট গিয়ে এয়ার ইন্ডিয়ার দিল্লিগামী প্লেনের কম্যান্ডারের হাতে তুলে দেওয়া হবে সেই অমূল্য ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগ।
আমাদের ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগে শুধু যে জরুরি নথিপত্র যায়, তা নয়। প্যারিস-ডিপ্লোম্যাটদের জন্য ধনে-জিরে-শুকনো লঙ্কাও ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগে যেতে পারে। আবার দিল্লিগামী ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগে জয়েন্ট সেক্রেটারির মেয়ের বিয়ের জন্য সুইস ঘড়ি বা জামাতা বাবাজীর স্কটিশ টুইডের স্যুট যায় কিনা বলা শক্ত। আরো অনেক কিছু যেতে পারে।
তবুও অপরের খেয়াল চরিতার্থ করার জন্য নিজে সেই কাজ করা সম্পূর্ণ আলাদা কথা।
একসকিউজ মী, মিঃ ভীমাপ্পা, আমাদের এখান থেকে তো কোনো ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগ দিল্লি যায় না।
ঠিক আছে, বন-এ এম্বাসীতে পাঠিয়ে দিন। ওরা ওখান থেকে আপনাদের হয়েই সেক্রেটারি মিঃ নানজাপ্পার কাছে পাঠিয়ে দেবে। তাহলেই-।
বাট স্যার, আমরা তো কোনো ব্যাগ বন-এ পাঠাই না। আপনি বরং ফেরার পথে বন-এ এম্বাসীতে দিয়ে দেবেন।
এর আগে কোনো কনসুলেটে তরুণের পোস্টিং হয়নি। দিল্লির ফরেন মিনিস্ট্রি ছাড়া বিভিন্ন এম্বাসিতে কাজ করেছে। বার্লিন আসার আগে ইউনাইটেড নেশনশ-এ ছিল। তাই তো ভেবেছিল কনসুলেটে এসে ঝামেলা অনেক কমবে, কিন্তু ভীমাপ্পার মতো নিত্য নতুন ভূতের উপদ্রবে। যে জীবন অতীষ্ঠ হবে ভাবতে পারেনি।
ভীমাপ্পাকে কোনোমতে বিদায় করার পর মিঃ ট্যান্ডনও বললেন, জানো তরুণ, ভেবেছিলাম রিটায়ার করার আগে একটু শান্তিতে দিন কাটাব, কিন্তু এদের উপদ্রবে তাও হলো না।
একটু থেমে ট্যান্ডন সাহেব আবার বললেন, সারা জীবন কোনো না কোনো অফিসার বা অ্যাম্বাসেডরের আন্ডারে কাজ করেছি। তাদের খেয়াল-খুশি চরিতার্থ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। তাই তো বার্লিনে ইন্ডিপেনডেন্ট চার্জ নিলাম, কিন্তু এখন দেখছি আগেই ভালো ছিলাম।
কথাগুলো বলার সঙ্গে সঙ্গেই একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন বার্লিনের ইন্ডিয়ান কন্সাল জেনারেল মিঃ ট্যান্ডন।
এবার তরুণ বলে, আপনি তো সামনের সপ্তাহে কনসালটেশনের জন্য বন যাচ্ছেন, তখন আমার কি দুর্গতি হবে বলুন তো?
মিঃ ট্যান্ডন হাসতে হাসতে বললেন, নার্ভাস হবার তো কিছু নেই! নেক্সট উইকে তো ডান্সার প্রীতিকুমারী ছাড়া কোনো পলিটিশিয়ান আসছেন বলে শুনিনি। সো ইউ উইল হ্যাভ এ প্লেজান্ট টাইম, আই হোপ।
হোপ তো অনেকেই অনেক কিছু করেন কিন্তু বাস্তব যে সম্পূর্ণ আলাদা।
আমাদের পিসফুল কো-একজিসটেন্স অ্যান্ড ফ্রেন্ডলি কো-অপারেশন বিদেশে যত বেশি অচল হচ্ছে ইন্ডিয়ান ডান্স আর বাজনা তত বেশি পপুলার হচ্ছে বলে শোনা যায়। ইন্ডিয়ান খবরের কাগজগুলো পড়লে মনে হয় আমাদের বাজনা আর ডান্সের ঠেলায় হলিউডে ফিল্ম তৈরি বন্ধ হয়েছে, প্যারিসের নাইট ক্লাবে খদ্দের হচ্ছে না।
ওস্তাদ সাহেবের দল সাকসেসফুল ফরেন ট্যুরের পর খুশিতে ডগমগ হয়ে বেনারসী পান-জর্দা চিবুতে চিবুতে প্রেস কনফারেন্সে বলেন, বাজনা? আহাহা, ওরা কি ভালোই বাসে! হল প্যাকড! অটোগ্রাফ দিতে হাত ব্যথা হয়ে যায়।
কোনো সাংবাদিক অবশ্য প্রশ্ন করেন না, কত ফরেন এক্সচেঞ্জ নিয়ে বাড়ি ফিরলেন? তাহলেই ঝোলা থেকে বেড়াল ছানা বেরিয়ে পড়ত!
এই প্রেস কনফারেন্সের পর কলকাতার মিউজিক কনফারেন্সগুলোতে ওস্তাদ সাহেবের রেট শেয়ার বাজারের ফাটকাকে হার মানিয়ে চড় চড় করে বাড়ে।
সুন্দরী যুবতী ডান্সারদের পয়সা খরচা করে প্রেস কনফারেন্স করতে হয় না। রিপোর্টার-ক্যামেরাম্যানরাই সুন্দরীদের দোরগোড়ায় ভিড় করেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধর্না দেবার পর মুহূর্তের জন্য সেই অমৃতলোকবাসিনী সুন্দরী দর্শনে তার ধন্য হল। আর কাগজে ছাপা মিস পদ্মাবতীর নাচ দেখার জন্য প্যারিসে ট্রাফিক জ্যাম হয়, রাশিয়ায় বলশয় থিয়েটারের টিকিট বিক্রি হয় না।
আর রোমে?
পাগল ইতালীয়নরা এয়ারপোর্টে এমন ভিড় করেছিল যে চারটে ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডিলেড হয়ে যায়।
ভালো কথা। অনেক দেশের ফিল্ম প্রডিউসার ডাইরেকটাররা আমাকে তাদের ফিল্মে নাচতে ইনভাইট করেছেন।
ব্যস! রেসের মাঠে ট্রিপল টোট! চার লাখ কালো, এক লাখ সাদা দিয়েও প্রডিউসার পদ্মাবতীর কনট্রাকট পান না।
লেক মার্কেটের পটলদা বা দর্জিপাড়ার বিধুবাবু এসব কাহিনি বিশ্বাস করলেও তরুণের মতো ইন্ডিয়ান ডিপ্লোম্যাটরা শুনলে হাসি চাপতে পারে না। নেক্সট উইকে প্রীতিকুমারীর আগমনবার্তা শুনে তাই তো তরুণ খুব বেশি সুখী হতে পারল না।
তাছাড়া তরুণ একটু ভিন্ন প্রকৃতির। কিছু কিছু ইন্ডিয়ান ডিপ্লোম্যাট আছেন যাঁরা প্রীতিকুমারীর মতো ডান্সারদের সেবা করে ধন্যবোধ করেন। প্রোগ্রামের শেষে হোটেলের নিভৃত কক্ষে দুচার। রাউন্ড ড্রিংক করার পর এদের ভাগ্যে কখনও কখনও উপরি পাওনাও জুটে যায়। তরুণদের সহকর্মী সাবারওয়াল এমনি এক নৃত্যপটীয়সীর সেবা করে ঘুম থেকে উঠতে অনেক দেরি করে। তাড়াহুড়ো করে অফিস যাবার সময় লেডিস জুতো পরে এম্বাসী গিয়েছিলেন, সে কথা ফরেন সার্ভিসের কে না জানে?
তরুণ এসব উপরি পাওনার স্বপ্ন কোনোদিন দেখেনি জীবনে। শুধু একজনেরই স্বপ্ন দেখেছে সে সারাজীবন ধরে। মনের সমস্ত সত্তা দিয়ে, মাধুরী দিয়ে যাকে সে ভালোবেসেছে, সেই ইন্দ্রাণী। ছাড়া আর কোনো নারীর স্থান নেই তরুণের জীবনে।
জীবনের ধূসর মরু-প্রান্তরের মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে বন্দনার কাছে বিরাট সম্ভাবনাপূর্ণ ইঙ্গিত পেয়েছিল তরুণ। অনেক আশা নিয়ে এসেছিল বার্লিনে। মনসুর আলির সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য করাচিতে সেকেন্ড সেক্রেটারি বড়ুয়াকে চিঠি দিয়েছিল। বড়ুয়া ছুটিতে থাকায় উত্তর এসেছে মাত্র কদিন আগে। পাকিস্তান সরকারের কোনো অফিসারের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে গেলে বিপদের সম্ভাবনা আছে বলে বড়ুয়া জানিয়েছে। বড়ুয়া লিখেছে, আমার ক্ষতির চাইতে মিঃ আলির ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাটাই বেশি। কারণ পাকিস্তান সরকার ভাবতে পারে। ওর সঙ্গে আমাদের কোনো গোপন সম্পর্ক আছে। করাচির আবহাওয়া বড়ই খারাপ। সেজন্য মিনিস্ট্রির লেভেলেই যোগাযোগ হওয়া ভালো।
বড়ুয়া চিঠির শেষে লিখেছে, আমাদের মিনিস্ট্রি থেকে পাকিস্তান ফরেন মিনিস্ট্রিতে চিঠি এলে কাজের অনেক সুবিধে হবে। প্রথম কথা হাই-কমিশনও সরকারিভাবে তদ্বির করতে পারবে। তাছাড়া সব চাইতে বড় কথা, এখন এখানে যিনি ইন্ডিয়া ডেস্কের এসব দেখাশুনা করেন, তিনি পূর্ব বাংলারই একজন মুসলমান। খুব সম্ভব ঢাকারই লোক। প্রায়ই ঢাকা যান। আমার স্থির বিশ্বাস উনি নিশ্চয়ই খুব সাহায্য করবেন।
কটা দিন এমন বিশ্রী ঝামেলার মধ্যে কাটছে যে তরুণ মিনিস্ট্রিতে একটা ফর্মাল কমিউনিকেশন পাঠাতে পারল না। ট্যান্ডন সাহেবের অনুপস্থিতিতে নিশ্চয়ই সময় পাবে না।
তরুণ বলল, ওসব ডালারের চিন্তা পরে করা যাবে। আপনি কনসালটেশনের জন্য বন-এ যাবার আগে আমার ওই চিঠির ড্রাফটটা দেখে ফাইনাল করে দেবেন, অ্যান্ড ইউ শুড সী দ্যাট ইট ইজ ইমিডিয়েটলি ডেসপ্যাঁচড টু ফরেন অফিস।
মিঃ ট্যান্ডন অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বললেন, সার্টেনলি।
একটু থেমে আবার বললেন, বেটার ডু ওয়ান থিং। তুমি আজ রাত্রে আমার ওখানে চলে এসো। ডিনারের পর দুজনে বসে ফাইনাল করে ফেলব।
তরুণ হাসতে হাসতে বলল, আপনি জানেন না আমি আজ রাত্রিরে আসছি?
তার মানে?
তার মানে আজ ভাবীজি আমার জন্য কিছু স্পেশ্যাল ডিস…।
মিঃ ট্যান্ডন হাসতে হাসতে বলেন, ডিপ্লোম্যাট হয়ে রিটায়ার করার সময়ও ডিপ্লোম্যাসিতে তোমাদের কাছে হেরে যাচ্ছি!