১২. ভাত না খেয়ে বাঁচার রহস্য

ভাত না খেয়ে বাঁচার রহস্য সোহাগীর লোকজনের জানা নেই। চৈত্র মাসের দারুণ অভাবের সময়ও এরা ফেলে-ছড়িয়ে তিন বেলা ভাত খায়। এবার কার্তিক মাসেই কারো ঘরে এক দানা চাল নেই। জমি ঠিকঠাক করার সময় এসে গেছে। বীজধান দরকার। হালের গরু দরকার। সিরাজ মিয়ার মতো সম্ৰান্ত চাষীও তার কিনে রাখা ঢেউটিন জলের দামে বিক্রি করে দিল।

ঘরে ঘরে অভাব। ভেজা ধান শুকিয়ে যে-চাল করা হয়েছে সে-চালে উৎকট গন্ধ। পেটে সহ্য হয় না। মোহনগঞ্জ থেকে আটা এসেছে। আটার রুটি কারোর মুখে রোচে না। কেউ খেতে চায় না। লগ্নির কারবারীরা চড়া সুদে টাকা ধার দিতে শুরু করল।

ঠিক এই সময় কলেরা দেখা দিল। প্রথম মারা গেল ডাক্তার ফজলুল করিম সাহেবের কম্পাউণ্ডারটি। হাতির মত জোয়ান লোক দু দিনের মধ্যেই শেষ। তার পরদিনই একসঙ্গে পাঁচ জন অসুখে পড়ল। আমিন ডাক্তার দিশাহারা হয়ে পড়ল। অষুধপত্র নেই। খাবার নেই। কী ভাবে কী হবে?

রাতে ঘর বন্ধ করে বসে থাকে সবাই। ওলাউঠার সময় খুবই দুঃসময়। তখন বাইরে বেরোলে রাত-বিরাতে বিকট কিছু চোখে পড়তে পারে। চোখে পড়লেই সর্বনাশ।

ডাক্তার ফজলুল করিম সাহেব কলেরা শুরু হওয়ার চতুর্থ দিনে কাউকে কিছু না বলে চলে গেলেন। আমিন ডাক্তারের কাছে অষুধপত্র নেই। নিমতলির সিরাজুল ইসলামের কাছে লোক গিয়েছিল। তিনি এলেন না। নিমতলিতেও কলেরা লেগেছে। সেখানেকার অবস্থা ভয়াবহ। তবে সেখানে সরকারি সাহায্য এসেছে। সোহাগীতে এখনো কেউ আসে নি। কেউ বোধহয় নামও জানে না সোহাগীর।

পঞ্চম দিনে রহিমার ভেদবমি শুরু হল। আমিন ডাক্তার ছুটে গেল সঙ্গে সঙ্গে। করবার কিছু নেই। রুগীর পাশে বসে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কী-বা করা যায়?

শরিফা রহিমার মাথা কোলে নিয়ে বসে ছিল। নুরুদ্দিন অনুফার হাত ধরে বারান্দায় বসে ছিল। শরিফা ঢুকরে কেঁদে উঠল, একি সৰ্বনাশ ডাক্তার।

আল্লাহ্‌র নাম নেন, আল্লাহ্ নিকাবান।

রহিমার শরীর খুবই খারাপ হল মাঝরাত্রে। শরিফা ধরা গলায় বলল, কিছু খাইতে মন চায় ভইন?

নাহ্‌। ভইন, আমার উপরে রাগ রাইখ না।

না, আমার রাগ নাই। তোমরার সাথে আমি সুখেই আছিলাম।

শরিফা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। আমিন ডাক্তার উঠোনের চুলায় পানি সেদ্ধ কছিল। শরিফা বেরিয়ে এসে বলল, এরে নিখল সাব ডাক্তারের কাছে নিলে বালা হইয়া যাইত।

সময় নাই দোস্তাইন। সময়ের অনাটন।

রহিমা মারা গেল শেষত্রে। অনুফাকে দেখে মনে হল না সে খুব বিচলিত হয়েছে। আমিন ডাক্তার বলল, অনুফা বেটি, সিদ্ধ পানিদিয়া গোসল কর। সবজামাকাপড় পানির মইধ্যে সিদ্ধ করণ দরকার।

অনুফা কোনো আপত্তি করল না। আমিন ডাক্তার অনুফার মাথায় পানি ঢালতে লাগল। অনুফা ফিসফিস করে বলল, চাচাজী, নিখল সাব ডাক্তার আইতাছে।

কী কস তুই বেটি?

নিখল সাব ডাক্তার এই গেরামে আসছে।

সেই এক রাত্রে সোহাগীতে মারা গেল ছয় জন। গ্রামবন্ধন দেওয়ার জন্যে ফকির আনতে লোক গেছে। ফকির শুধু গ্রামবন্ধনই দেবে না, ওলাউঠাকে চালান। করে দেবে অন্য গ্রামে। অমাবস্যার রাত্রি ছাড়া তা সম্ভব নয়। ভাগ্যক্রমে আগামীকাল অমাবস্যা।

ফকির সাব সকালে এসে পৌঁছলেন। ডাক্তার রিচার্ড এ্যালেন নিকলসন এসে পৌঁছলেন দুপুরবেলা। খবর পেয়ে আমিন ডাক্তার চৌধুরীবাড়ির ভাত ফেলে ছুটে এল।

ভালে আছ আমিন?

নিখল সাব হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন। বিস্ময়ের চোটে আমিন ডাক্তারের মুখে। কথা ফুটল না। ডাক্তার নিখল সাব চুরুটে লম্বা টান দিয়ে বললেন, আমরা নিমতলি গিয়েছিলাম। সেখানে সরকারি সাহায্য এসেছে, কাজেই তোমাদের এখানে, আসলাম। আমাদের আরেকটা টীম গেছে সুশানপুকুর। তোমাদের অবস্থা কী?

স্যার, খুব খারাপ।

পানি ফুটিয়ে খাচ্ছে তোলোকজন? নিখল সাব হাসতে লাগলেন, যেন পিকনিক করতে এসেছেন।

নিখল সাব এসে পৌঁছবার পর আর একটিমাত্র রুগী মারা গেল। কৈবর্তপাড়ার নিমু গোঁসাই। এত অল্প সময়ে ওলাউঠাকে আয়ত্ত করার কৃতিত্বের সিংহভাগ পেল ধনু ফকির। ফকির সাব ওলাউঠাকে পশ্চিম দিকে চালান করেছেন। সেই কারণেই শেষ রুগীটি হয়েছে পশ্চিমের কৈবর্তপাড়ায়।

নিখল সাব ডাক্তার শুক্রবার চলে গেলেন। যাবার সময় অনুফাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন। অনুফা কোনো রকম আপত্তি করল না।

নিখল সাব ডাক্তার বারবার জিজ্ঞেস করলেন, আমিন বলেছে তোমার মায়ের ইচ্ছে ছিল, তুমি আমার স্কুলে পড়। তুমি কি যেতে চাও?

অনুফা মাথা নাড়ল। সে যেতে চায়।

কাঁদবে না?

উঁহুঁ।

নাম কী তোমার?

অনুফা।

এত আস্তে বলছ কেন? আমাকে ভয় লাগছে?

উঁহুঁ।

নৌকা ছাড়ার ঠিক আগে আগে আমিন ডাক্তার চৌধুরীদের পাগল ছেলেটাকে ধরে এনে হাজির করল। যদি নিখল সাব কোনো চিকিৎসা করতে পারে। নিখল সাব। জিজ্ঞেস করলেন,কী নাম আপনার?

চৌধুরী জমির আলি। কী অসুবিধা আপনার?

জ্বি-না, কোনো অসুবিধা নাই।

রাত্রে ভালো ঘুম হয়?

জ্বি, হয়।

অত্যন্ত শান্ত ভদ্র কথাবার্তা। নিখল সাব ডাক্তার নৌকা ছেড়ে দিলেন। বড়ো গাঙের কাছাকাছি নৌকা আসতেই অনুফা বলল, নুরু ভাই খাড়াইয়া আছে ঐখানে।

নিখল সাব অবাক হয়ে দেখলেন, নুরুদ্দিন নামের শান্ত ছেলেটা সত্যি দাঁড়িয়ে আছে। এত দূর এল কী করে?

নৌকা ভেড়াব? কথা বলবে?

নাহ্‌।

যে-মেয়েটি সারাক্ষণের জন্য একবারও কাঁদে নি, সে এইবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *