১২. ভাটিপাড়া বাড়ির ছাদে

শ্রাবণ মাস।

হাসান রাজা চৌধুরী ভাটিপাড়া বাড়ির ছাদে অনেকক্ষণ হলো দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখাচ্ছে মূর্তির মতো। তার দৃষ্টি হাওরের দিকে। বিস্তীর্ণ হাওর। বড় বড় ঢেউ উঠছে। অনেক দূরে ছোট্ট একটা নৌকা। নৌকা খুব দুলছে। সন্ধ্যার দিকে হাওয়া জোরালো হয়। সমুদ্রের মতো বড় ঢেউ ওঠে।

হাসানকে ঘিরে অসংখ্য পায়। এরা এখন আর উড়ছে না। সন্ধ্যার পর পায়রা আকাশে উড়ে না। বাকবাকুম শব্দও করে না। এরা কীভাবে যেন টের পেয়ে গেছে যে সন্ধ্যা অতি রহস্যময় এক সময়।

ছোট সাব, আজান হয়েছে।

হাসান চমকে তাকাল। জায়নামাজ বগলে নিয়ে বারেক দাঁড়িয়ে আছে। বারেকের বয়স বারো। তাকে হাসানের ফুটফরমাস করার জন্যে রাখা হয়েছে। তার মুখের ভাষায় সিলেটের আঞ্চলিকতা নেই। সুন্দর শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে। কাজেকর্মে দক্ষ। সবচেয়ে বড় কথা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। চেহারা মেয়েলি। ঘাটুগানের দল থেকে তাকে আনা হয়েছে। আশেপাশে কেউ না থাকলে সে শুনগুন করে গানে টান দেয়।

যমুনার জল দেখতে কালো
ছান করিতে লাগে ভালো
যৌবন মিশিয়া গেছে জলে…

হাসান বলল, আমার অজু নাই। নামাজ পড়ব না।

অজুর পানি কি দিব?

না।

ছোট সাব, কী দেখেন?

নৌকাটা দেখি। অনেকক্ষণ এক জায়গায় আছে। বাতাসের কারণে আসতে পারছে না।

চেয়ার এনে দিব? বসবেন?

না।

বারেক চলে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার ছাদে উপস্থিত হলো। তার মাথায় কাঠের চেয়ার। হাতে এক নলের দুরবিন। এই বাড়িতে দুটা দুরবিন আছে। ঝড়বৃষ্টির সময় দুরবিনে দূরের বিপদগ্রস্ত নৌকা দেখা যায়। তখন সাহায্যের জন্যে এ বাড়ি থেকে নৌকা যায়।

হাসান চেয়ারে বসেছে। হাতে দুরবিন নিয়ে নৌকা দেখছে। বিপদগ্রস্ত কোনো নৌকা না। নৌকার মাঝি ছেলেকে নিয়ে মাছ মারতে বের হয়েছে। ছিপ ফেলেছে। হাসান বলল, সন্ধ্যাবেলায় কি মাছ আধার খায়?

বারেক বলল, সব মাছে খায় না। বোয়াল মাছে খায়। বোয়ালের পেটে ক্ষিধা বেশি। তার বুদ্ধিও কম।

মাছের মধ্যে বুদ্ধি বেশি কার?

খইলসা মাছের। খুইলসা মাছ ধরা কঠিন। ছোট সাব, চা খাবেন? চা এনে দিব?

না।

বারেক চলে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে বিশাল এক কাপ ভর্তি চা নিয়ে উপস্থিত হলো। বারেক সব কাজ নিজের মতো করে। হাসান চা খেতে চায়নি, এটাকে সে গুরুত্ব দেয়নি। তার মনে হয়েছে এই সময় চা খেতে ছোট সাহেবের ভালো লাগবে। সে চা নিয়ে এসেছে।

বারেক, লেখাপড়া জানো?

জে-না।

শিখতে চাও?

না।

কেন না?

আমার দাদাজানের নিষেধ আছে। তিনি খোয়াবে পেয়েছেন—লেখাপড়া শিখলে আমার পানিতে ডুবে মৃত্যু হবে।

সাঁতার জানো?

জানি।

ভালো জানো?

জানি। এইখান থেকে সাঁতার দিয়ে নৌকা পর্যন্ত যেতে পারবে?

পারব।

ভালো করে চিন্তা করে বলো। অনেকথানি দূর।

পারব। সময় লাগবে, কিন্তু পারব।

হাসান হাত থেকে দুরবিন নামিয়ে বলল, আচ্ছা যাও।

সত্যি যাব?

হ্যাঁ, সত্যি যাবে। তোমাকে সাঁতার দিয়ে নৌকা পর্যন্ত যেতে বলেছি, তার কারণ আছে। কারণটা পরে বলব।

হাসান চায়ের কাপে চুমুক দিল। তার দৃষ্টি আকাশে। সূর্য পশ্চিমে ডুবছে, কিন্তু লাল হয়ে আছে পুবের আকাশ। এটা একটা আশ্চর্য ঘটনা। মানুষের চারদিকে সবসময় আশ্চর্য ঘটনা ঘটতে থাকে। খুব কম মানুষই তা নজর করে।

হাওরের ঘাট থেকে বারেক সাঁতার দিতে শুরু করেছে। তার গা খালি, পরনে সাদা প্যান্ট। সাদা রঙের কারণে দূর থেকে প্যান্টিটা দেখা যাচ্ছে। হাসান চোখে দুরবিন লাগিয়ে সাঁতারুর অগ্রযাত্রা লক্ষ রাখছে। বারেক এগুচ্ছে খুব সহজ ভঙ্গিতে। তার মধ্যে কোনো তাড়াহুড়া নেই।

 

মাগরেবের নামাজ শেষ করে হাসানের বাবা হাজি সাহেব বিছানায় চাদর গায়ে শুয়ে আছেন। তার মাথার কাছের বড় জানালাটা খোলা। জানালায় পর্দা নেই। হাওরের হাওয়া ই-হু করে ঢুকছে। তার শীত করছে। জ্বর আসার পূর্বলক্ষণ। ঘরে হারিকেন জ্বলছে। হারিকেনের আলো চোখে লাগছে। সন্ধ্যাবেলা ঘর অন্ধকার করে রাখতে নেই বলেই হারিকেন জ্বলছে। একতলায় গানবাজনা হচ্ছে। গানের আওয়াজও তার কানে লাগছে। অসুস্থ অবস্থায় কোনো কিছুই ভালো লাগে না। তিনি ইচ্ছা করলেই কাউকে ডেকে গান বন্ধ করার কথা বলতে পারেন। তা তিনি বলছেন না। এই বাড়িতে কিছুদিন আগেই বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। সবকিছু আগের মতো করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তা বন্ধ করা উচিত না।

হাজি সাহেব গানের কথা শোনার চেষ্টা করছেন। গায়কের গলা শ্লেষ্যমাখা। কোনো কিছুই পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে না। খোল-করতাল এবং হারমোনিয়ামের বাদ্যই প্রবলভাবে শোনা যাচ্ছে। বৃদ্ধ গায়ক গাইছেন—

ও সুন্দর গৌরারে পিয়ারি মনচোরারে
প্রেমভাবে নাচে গৌরা ও পিয়ারি মনচোরারে
যাইতে যমুনার জলে
ও দেইখে পাইলাম প্রাণবন্ধুরে
আচা চটক লাগলরে
আমি নারীর চিত্ত বাউরা
ও পিয়ারি মনচোরারে।

হাজি সাহেবের খাস লোক সুলতান ঢুকল। তার হাতে ফরসি হুক্কা। তামাকের গন্ধ হাজি সাহেবের ভালো লাগছে। অসুস্থ অবস্থায় তামাকের গন্ধ ভালো লাগার কথা না। ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে না। হাজি সাহেব বিছানায় উঠে বসে হুক্কার নল হাতে নিলেন। একটা টান দিতেই শরীর গুলিয়ে উঠল। তিনি নল পাশে রেখে দিলেন।

সুলতান বলল, আপনার শরীরটা কি খারাপ?

হাজি সাহেব হ্য-সূচক মাথা নাড়লেন।

সুলতান বলল, ছোট সাহেব একটা পত্র লিখেছেন। পত্রটা আমার হাতে দিয়েছেন যেন পৌঁছানোর ব্যবস্থা করি।

হাজি সাহেব বিস্মিত গলায় বললেন, পত্র কাকে দিয়েছে?

ময়মনসিংহের উকিল সাহেবের মেয়েকে! তার নাম নাদিয়া। পত্রটা কি পড়ে দেখবেন?

হাজি সাহেব হা-সূচক মাথা নাড়লেন। সুলতান ফতুয়ার পকেট থেকে খামবন্ধ চিঠি বের করে হাজি সাহেবের সামনে রাখতে রাখতে বলল, রাতে কী খাবেন?

হাজি সাহেব বললেন, রাতে কিছু খাব না। একগ্লাস চিড়া ভিজা পানি আর পেঁপে। তুমি দরজা বন্ধ করে চলে যাও। গান কানে লাগতেছে।

শরীরে হাত দিয়া দেখব জ্বর কেমন?

দেখো।

সুলতান কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখল। সে খানিকটা হকচকিয়ে গেল। হাজি সাহেবের গায়ে অনেক জ্বর। জ্বর যে এত বেশি তা তাঁকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল না।

একজন ডাক্তার কি খবর দিব?

না। তুমি এখন ঘর থেকে যাও। আমি না ডাকলে আসবা না।

হাজি সাহেব চিঠি হাতে নিলেন। তাঁর পুত্র উকিল সাহেবের মেয়েকে চিঠি লিখতে পারে—এটা তিনি কল্পনাও করতে পারছেন না।

হাসান লিখেছে— নাদিয়া,

আমি হঠাৎ করে চলে এসেছি বলে আপনার সঙ্গে দেখা করে আসতে পারি নাই। তাছাড়া আপনি অসুস্থও ছিলেন। আশা করি এখন সুস্থ হয়েছেন। আপনার ভূত দেখা রহস্যের যে সমাধান আপনার শিক্ষক বিদ্যুত বাবু করেছেন তাতে আমি মুগ্ধ হয়েছি। আমি আমার মুগ্ধতা কখনোই ঠিকমতো প্রকাশ করতে পারি না। উনার কাছেও প্রকাশ করতে পারি নাই। আপনি দয়া করে আমার মুগ্ধতা তাকে জানাবেন।

আপনি আমাকে যে দড়ির ম্যাজিক দেখিয়েছিলেন, আমি সেই রহস্য ভেদ করে অত্যন্ত আনন্দ পেয়েছি। আমার খুব ইচ্ছা আপনাকে ম্যাজিকটা দেখাব।

আমাদের ভাটি অঞ্চলে বর্ষাকালে নৌকায় বেদেরা আলতা-চুড়ি বিক্রি করতে আসে। তারা সাপের খেলা দেখায় এবং অদ্ভুত সব ম্যাজিক দেখায়। আমি ঠিক করেছি তাদের কাছ থেকে কিছু মাজিক শিখে আপনাকে দেখাব। এবং আপনাকে শিখিয়ে দিব।

আমি যে আমাদের বাড়িতে আপনাকে আসার জন্যে দাওয়াত করেছি তা কি মনে আছে? কষ্ট করে যদি একবার আসেন তাহলে আনন্দ পাবেন।

এখানে আমি মোটামুটি নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করছি। বই পড়ার আনন্দ থেকেও বঞ্চিত। কারণ এখানে কোনো বই নাই। ঢাকা বা ময়মনসিংহ থেকে প্রচুর বইপত্র যে কিনব তাও সম্ভব না। কারণ বিশেষ কারণে আমি গৃহবন্দি। গৃহবন্দির কারণটি কোনো একদিন আমি আপনাকে বলব।

ইতি
হাসান রাজা চৌধুরী
ভাটিপাড়া, কইতরবাড়ি।

চিঠি শেষ করে হাজি সাহেব সুলতানকে ডাকলেন। নিচুগলায় বললেন, এই চিঠি পাঠানোর প্রয়োজন নাই। চিঠি নষ্ট করে ফেলবে এবং ছোট সাহেবকে বলবে চিঠি পাঠানো হয়েছে।

সুলতান বলল, জি অচ্ছি।

চিঠি চালাচালির বিষয় উকিল সাহেব জানলে বেজায় রাগ হবেন।

জি হবেন। রাগ হওয়ার কথা।

হাজি সাহেব বললেন, চিঠি এখনই পুড়িয়ে ফেলো। আর রাশেদাকে খবর দাও, তার সঙ্গে আমার জরুরি আলাপ আছে। সে যেন এক-দুই দিনের ভেতর চলে আসে। রাশেদার মেয়েটার নাম কী?

রেশমী।

সে কি বিবাহযোগ্য হয়েছে?

মনে হয়।

রাশেদাকে বলবে সে যেন তার মেয়েকে নিয়ে আসে।

জি আচ্ছা।

এখন বিদায় হও।

হাসান যে মামাকে খুন করেছে, রাশেদা তারই স্ত্রী। হাজি সাহেব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, রাশেদার মেয়ের সঙ্গে হাসানের বিয়ে দিবেন। যে অন্যায় হয়েছে তার কিছুটা প্রতিকার হবে। রাশেদা এতে আপত্তি করবে এরকম মনে হয় না। রাশেদা হাসানকে অত্যন্ত পছন্দ করে।

 

বারেক ফিরে এসেছে। মাথা নিচু করে হাসানের ঘরে বসে আছে। সে খানিকটা লজ্জিত। কারণ সাঁতরে তাকে নৌকা পর্যন্ত যেতে হয়নি। নৌকার মাঝি তাকে দেখতে পেয়ে নৌকা নিয়ে এগিয়ে এসে পানি থেকে টেনে তুলেছে।

হাসান আধশোয়া হয়ে খাটে বসে আছে। রাতের খাবারের ডাক এসেছে। সে জানিয়েছে খাবে না। ক্ষিধে নেই। সে উকিল সাহেবের বাড়ির প্রণব বাবুর মতো একবেলা খাওয়ার চেষ্টায় আছে। চেষ্টা ফলপ্রসূ হচ্ছে না। গভীর রাতে ক্ষুধা হচ্ছে। তখন বারেককে পাঠিয়ে খাবার আনাচ্ছে।

বারেক!

জি ছোট সাব।

তুমি তো সাঁতার খুব ভালো জানো। সাঁতরে অনেক দূর গিয়েছিলে।

বারেক চুপ করে রইল। মাথা তুলল না। হাসান বলল, পানিতে ডুবে মরার সম্ভাবনা তোমার খুবই কম। কাজেই পড়াশোনা করবে। আমি বই-খাতার ব্যবস্থা করব। ঠিক আছে?

বারেক জবাব দিল না।

হাসান বলল, মূর্খ মানুষ আর গরু ছাগলের মধ্যে কোনো তফতি নাই। গরুছাগলও পড়তে পারে না। এখন আমার দিকে চোখ তুলে তাকাও। আমার হাতে এটা কী?

দড়ি।

তাকিয়ে থাকে। দেখো আমি কী করি। দড়িটা কাচি দিয়ে মাঝখানে কাটলাম। এখন আমি ফু দিব। ফু দিলেই দড়ি জোড়া লেগে যাবে। তাকিয়ে থাকো।

বারেক তাকিয়ে থাকল। দড়ি জোড়া লাগানো দেখল। দেখে চমকৃত হলো এরকম মনে হলো না। হাসান বলল, কীভাবে হয়েছে বলো তো।

বারেক বলল, মন্ত্র দিয়া করছেন।

হাসান বলল, ঠিক বলেছ। মন্ত্র দিয়ে করেছি। লেখাপড়াও মন্ত্র। লেখাপড়া মন্ত্র দিয়ে অনেক কিছু করা যায়। বুঝেছ?

বুঝেছি।

প্রতিদিন তোমাকে একটা করে অক্ষর শিখাব। আজ থেকে শুরু। বলো ‘ক’।

বারেক ভীত গলায় বলল, ক।

হাসান কাগজে ক লিখল। বারেকের হাতে কাগজটা দিয়ে বলল, এই কাগজটা সঙ্গে রাখবে। মাঝে মাঝে কাগজটার দিকে তাকাবে আর বলবে ক’। মনে মনে বলবে না। শব্দ করে বলবে।

আচ্ছা।

টেবিলের উপর একটা বই আছে, বইটা হাতে নাও। বইয়ে যে কয়টা ক পাবে প্রত্যেকটা কলম দিয়ে কাটবে। কীভাবে কাটাবে দেখিয়ে দিচ্ছি। বইটা দাও আর কলম দাও।

হাসান একটা ক কেটে দেখাল। আর তখন সুলতান এসে বলল, বড় সাব ডাকেন। হাসান উঠে দাঁড়াল। সুলতান বলল, বড় সাবের শরীর ভালো না। বেজায় জ্বর আসছে।

হাসান কাঁচি এবং দড়ি হাতে নিল। হঠাৎ করেই তার ইচ্ছা করছে বাবাকে সে এই ম্যাজিকটা দেখাবে।

 

হাজি সাহেব খাটে হেলান দিয়ে বসেছেন। তাঁর চোখ বন্ধ। হাতে হুক্কার নল। তিনি নল মুখে দিচ্ছেন না। খাটের পাশে চেয়ার রাখা। হাসানকে ঘরে ঢুকতে দেখে তিনি চোখ মেললেন। ছেলেকে ইশারায় বসতে বললেন। হাসান বসল।

হাজি সাহেব বললেন, প্রায়ই শুনি তুমি রাতে খানা খাও না। রাতে খানা না খেলে শরীর থেকে এক চড়ুই পাখির রক্ত কমে। রাতে খানা অবশ্যই খাবে।

হাসান জবাব দিল না।

হাজি সাহেব বললেন, তোমাকে অতি জরুরি একটা বিষয় বলার জন্যে ডেকেছি। মন দিয়ে শোনো। তোমার হাতে দড়ি কী জন্যে?

আপনাকে দড়ি কাটার একটা ম্যাজিক দেখাব।

হাজি সাহেব বললেন, ম্যাজিক দেখানো বেদে-বেদেনির কাজ। তোমার কাজ। বুঝেছ?

জি।

জরুরি কথাটা এখন বলি। অপরাধ করলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। তুমি একটা বড় অপরাধ করেছ। এখন প্রায়শ্চিত্ত করবা।

কীভাবে?

তোমার মামাতো বোন রেশমাকে তুমি বিবাহ করবা। এটা আমার হুকুম।

রেশমাকে বিবাহ করব?

হুঁ। তার গায়ের রঙ শ্যামলা। শ্যামলা গাত্রবর্ণের মেয়েদের মন হয় ফর্সা।

হাসান বলল, এই মেয়ে সারাক্ষণ জানবে আমি তার বাবাকে খুন করেছি। এটা কি তার জন্যে ভালো হবে?

হাজি সাহেব বললেন, তুমি তোমার ভালো চিন্তা করবে। তার ভালো চিন্তা করার প্রয়োজন তোমার নাই। এখন দড়ি দিয়ে কী ম্যাজিক দেখাতে চেয়েছ দেখাও।

হাসান দড়ি কেটে জোড়া লাগাল। হাজি সাহেব বিস্মিত হলেন। নিজের অজান্তেই বললেন, সোবাহানআল্লাহ!

হাসান বলল, আপনি কি আরও কিছু বলবেন? আর কিছু না বললে আমি উঠব।

হাজি সাহেব বললেন, ম্যাজিকটা আরেকবার দেখাও।

হাসান বলল, কোনো ম্যাজিক দুইবার দেখানো যায় না।

হাজি সাহেব বললেন, আমি দেখাতে বললাম তুমি দেখাও।

হাসান কঠিন গলায় বলল, না।

হাজি সাহেব বললেন, তুমি আমার সঙ্গে বেয়াদবি করছ।

হাসান বলল, আপনি অন্যায় আবদার করা শুরু করেছেন। এটা উচিত না।

হাজি সাহেব বললেন, আমাকে তুমি উচিত অনুচিত শেখাও? আমি তোমার জন্মদাতা পিতা।

হাসান উঠে দাঁড়াল। হাজি সাহেব বললেন, উঠে দাঁড়িয়েছ কী জন্যে? বসো। আমার কথা শেষ হয় নাই।

হাসান বসল না, ঘর থেকে বের হয়ে গেল। হাজি সাহেব হুক্কার নল মুখে নিয়ে টানতে লাগলেন। অসুস্থ শরীরে তামাকের গন্ধ অসহনীয় লাগছে, তারপরেও তিনি ফুসফুস ভর্তি করে ধোয়া নিচ্ছেন। তার চোখ লাল হয়ে উঠেছে। সামান্য স্বাসকষ্ট হচ্ছে। তিনি চাপা গলায় ডাকলেন, সুলতান সুলতান!

সুলতান খাটের পাশে এসে দাঁড়াল। হাজি সাহেব বললেন, হাসান আমার সঙ্গে বেয়াদবি করেছে। বিরাট বেয়াদবি।

সুলতান বিড়বিড় করে বলল, বয়স কম।

হাজি সাহেব বললেন, বেয়াদবি বয়স কমের কারণে করে নাই। বিকারের কারণে করেছে। বিকার মাথায় উঠে গেলে মানুষ বেয়াদবি করে, খুন খারাপি করে। বুঝেছ?

জি।

বিকার নামানোর অনেক বুদ্ধি আছে। পাখি শিকার, জীবজন্তু শিকার। রক্ত দর্শনে বিকার কমে। আবার যৌনকর্মেও বিকার কমে। এইজন্যেই কিছুদিনের

জন্যে হলেও ঘটুপুত্র রাখা দোষের না। বুঝেছ?

জি।

বারেক নামের ছেলেটা ঘাটু দলের না?

জি।

তোমার ছোট সাহেব কি তাকে ব্যবহার করে?

না।

জেনে না বললা, -কি অনুমানে বললা?

অনুমানে বলেছি। ছোট সাহেব অন্য ধাঁচের মানুষ। ভালো মানুষ।

ভালো মানুষ, মন্দ মানুষ বিবেচনার মতো বুদ্ধি তোমার নাই।

জি, ঠিক বলেছেন।

উত্তরের দালানের যে বড় ঘরটা আছে, তার সঙ্গে টাট্টিখানা কি আছে?

আছে।

হাজি সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তোমার ছোট সাহেবকে উত্তরের ঘরে তালাবন্ধ করে রাখো। খানা দিবা জানালা দিয়া। আমার হুকুম না পাওয়া পর্যন্ত তালা খুলবা না। এটা বেয়াদবির শাস্তি।

জি আচ্ছা।

সামনে থেকে যাও। যা করতে বলছি করো।

আপনার জ্বর কি আরেকবার দেখব?

দেখো।

সুলতান কপালে হাত দিয়ে বলল, জ্বর আরও বেড়েছে।

হাজি সাহেব বললেন, জ্বর বেড়েছে, কমবে। ব্যস্ত হবার কিছু নাই।

সুলতান বলল, জ্বরের ঘোরে ছোট সাহেবের শাস্তির বিধান দিয়েছেন। জ্বর অবস্থায় বিধান দেওয়া ঠিক না।

হাজি সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, তোমাকে যা করতে বলেছি করো। আমাকে বিধান শিখাবা না।

 

হাসানকে উত্তরের ঘরে তালাবন্ধ করে রাখা হয়েছে। সে তা নিয়ে কোনোরকম উচ্চবাচ্য করছে না। উত্তরের ঘরের একটা জানালা দিয়ে হাওর দেখা যায়। সে বেশিরভাগ সময় জানালার পাশে দাঁড়িয়ে হাওর দেখে। বাকি সময়টা ঘরের এক মাথা থেকে অন্য মাথা পর্যন্ত হাঁটে। খাটের চারপাশে চক্রাকারে ঘোরে। প্রতি সন্ধ্যায় একটা খাতায় কী যেন লেখে। খাতাটার সে একটা নাম দিয়েছে মাতাল হাওয়া। হাওরের উথালপাথাল হাওয়ার কারণেই মনে হয় এমন নাম।

বারেক তার ঘরের বাইরে সারাক্ষণ বসে থাকে। রাতে চাদর পেতে তালাবন্ধ দরজার সামনেই ঘুমায়! তিনটা অক্ষর তার শেখা হয়েছে। ক, খ, গ। ঘুমের ঘোরে সে বিড়বিড় করে—ক খ গ, ক খ গ।

 

শুক্রবার সন্ধ্যায় বজরায় করে হাসানের মামি রাশেদা কইতরবাড়িতে এসেছেন। সঙ্গে তার সতেরো বছরের মেয়ে রেশমা। রেশমার মুখ গোলগাল। পাতলা ভুরু। নাক খানিকটা চাপা। শ্যামলা এই মেয়েটির চেহারায় অন্য এক ধরনের সৌন্দর্য যা ব্যাখ্যা করা কঠিন। তার চোখে চিরস্থায়ী বিষণ্ণতা।

হাজি সাহেব রাশেদাকে নিজের ঘরে ডেকে পাঠিয়েছেন। রাশেদা খাটের পাশে রাখা চেয়ারে মাথা নিচু করে বসে আছেন। হাজি সাহেব বললেন, ভালো আছ রাশেদা?

রাশেদা হা-সূচক মাথা নাড়লেন।

হাজি সাহেব বললেন, আমার ছেলের বিষয়টা কি ঠিকমতো জানো?

রাশেদা বললেন, কোন বিষয়

খুন হাসান করে নাই, আমার খাস লোক ফরিদ খুন করেছে। সে পুলিশের হেফাজতে আছে। সব স্বীকার পেয়েছে।

রাশেদা বললেন, এইসব মিথ্যা কোর্টের জন্যে, আমার জন্যে না। খুন কে করেছে আপনি যেমন জানেন আমিও জানি।

মানুষের সব জানা ঠিক না। জানায় ভুল থাকে। সেই ভুল ঠিক করতে হয়।

এইটা বলার জন্যেই কি আপনি আমাকে আনায়েছেন?

তোমাকে একটা প্রস্তাব দিব বলে আনিয়েছি।

কী প্রস্তাব?

হাজি সাহেব শান্ত গলায় বললেন, একটা বিবাহের প্রস্তাব। আমি রেশমার সঙ্গে হাসানের বিবাহ দিতে চাই।

হতভম্ব রাশেদা বললেন, এইসব কী বলেন? আপনি কি উন্মাদ হয়েছেন? উন্মাদও তো এরকম কথা বলবে না।

হাজি সাহেব নিঃশব্দে তামাক টানতে লাগলেন। রাশেদা বললেন, আপনার টাকাপয়সা আছে। ক্ষমতা আছে। ইচ্ছা করলে অনেক কিছুই করতে পারেন। নিজে খুন করে সেই দোষ অন্যের ঘাড়ে ফেলতে পারেন। আপনার কাছে আমি এবং আমার মেয়ে তুচ্ছ। তারপরেও একটা খুনির সঙ্গে আমি মেয়ের বিবাহ দিব না।

হাজি সাহেব বললেন, ঠিক আছে।

আমি আপনার এইখানে থাকব না। চলে যাব। আজই যাব।

জি সাহেব বললেন, আমি তো জোর করে তোমার মেয়ের বিবাহ দিব না। আজই চলে যেতে হবে কেন?

আমি থাকব না। আমি চলে যাব।

হাজি সাহেব বিছানায় আধশোয়া হয়ে ছিলেন, এখন উঠে বসলেন। হুক্কা নল নামিয়ে রাখতে রাখতে বললেন, এই বাড়ি থেকে তুমি যেতে পারবে না। মামলার রায় হওয়ার পরে যাবে। মামলা যেভাবে সাজানো হয়েছে, তুমি তাতে ঝামেলা করতে পারো। সেই সুযোগ তোমাকে আমি দিব না।

আমাকে আটকায়ে রাখবেন?

হ্যাঁ।

আমাকে আটকায়ে রাখার ক্ষমতা আপনার নাই।

হাজি সাহেব বললেন, গলা নামায়ে কথা বলে। তুমি উঁচুগলায় কথা বলছ। লোকজন শুনছে। এটা ঠিক না। মাথা ঠান্ডা করো। খাওয়াদাওয়া করো। তুমি আমার ছেলের শাশুড়ি হবা। তোমার এই বাড়িতে আনেক মর্যাদা।

রাশেদা বললেন, আপনি যত কিছুই করেন, আমার মেয়ে কোনোদিনই রাজি হবে না। এই জাতীয় কোনো প্রস্তাব তার কানে গেলে সে হাওরে ঝাঁপ দিয়ে পড়বে। আপনাকে শ্রাল্লার দোহাই লাগে এই ধরনের কোনো কথা যেন আমার মেয়ের কানে না যায়। এখন ইযত দিন আমি বিদায় হই।

ইযাযত দিলাম।

রাশেদা দ্রুত ঘর থেকে বের হলেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আজ রাতেই ফিরে যাবেন। ঘাটে বজরা বাধা আছে। ডিঙ্গাপুতার হাওর রাতে রাতে পাড়ি দিয়ে নিজের জায়গায় ফিরে যাওয়া। কইতরবাড়িতে আর এক মুহূর্তও থাকা যাবে না। রাতে খাওয়াদাওয়া করে বজরায় উঠবেন। রেশমাকে এই মুহূর্তে কোনো কিছু জানানোর প্রয়োজন নাই।

রাতের খাওয়ার সময় রেশমা তার মায়ের কানে ফিসফিস করে বলল, ঘটনা কী জানো মা? হাসান ভাইকে তালাবন্ধ করে রেখেছে।

রাখুক।

কী জন্যে তালাবন্ধ সেটা কেউ জানে না।

না জানুক। তুই তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ কর। আমরা আজ রাতেই ফিরব।

কেন? ঘুমে আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।

বজরায় ঘুমাবি।

রাশেদা হাজি সাহেবের কাছ থেকে বিদায় না নিয়েই বজরায় উঠলেন। বজরা ছেড়ে দিল। রেশমা ঘুমাচ্ছে। তিনি রেশমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতে থাকতে একসময় নিজেও ঘুমিয়ে পড়লেন। নৌকার দুলুনিতে তাঁর গাঢ় ঘুম হলো।

ঘুম ভাঙল ফজরের আজানের শব্দে। তিনি বজরা থেকে বের হয়ে অবাক হয়ে দেখলেন, বজরা কইতরবাড়ির ঘাটে বাঁধা। মাঝিরা কেউ নেই। তিনি স্তব্ধ হয়ে বজরার পাটাতনে দাঁড়িয়ে রইলেন। কইতরবাড়ির মসজিদ দেখা যাচ্ছে। মুসল্লিরা নামাজ পড়তে যাচ্ছে।

 

দোতলার উত্তরমুখী ঘরটা রাশেদাকে দেওয়া হয়েছে। তার স্যুটকেস, হোল্ডসল, এই ঘরে এনে রাখা হয়েছে। রাশেদা খাটের একপ্রান্তে হেলান দিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন। রেশমা জানালার শিক ধরে হাওরের দিকে তাকিয়ে আছে। একটি বিশেষ দৃশ্য তাকে মোহিত করেছে। বিশাল বকের ঝাঁক হাওরের একটা বিশেষ জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে, ফিরে আসছে, আবার যাচ্ছে। ওই জায়গাটায় কী আছে তার জানতে ইচ্ছা করছে। রাশেদা বললেন, আমাদের আটক করেছে। বিষয়টা বুঝেছিস?

রেশমা মা’র দিকে না তাকিয়ে বলল, বুঝি নাই। তার দৃষ্টি বকের দিকে।

রাশেদা বললেন, কী জন্যে আটক করেছে জানতে চাস?

চাই।

কাছে আয় বলি।

রেশমা বলল, কাছে আসব না। তুমি বলো আমি শুনছি।

রাশেদা বললেন, এরা জোর করে খুনিটার সঙ্গে তার বিবাহ দিতে চায়। তোর উপরে আদেশ—প্রয়োজনে ফাঁসিতে ঝুলবি, কবুল বলবি না।

রেশমা বলল, ফাঁসিতে ঝুলার মধ্যে আমি নাই মা।

খুনিটারে বিবাহ করবি?

কথায় কথায় খুনি বলবা না শুনতে খারাপ লাগে।

খুনিরে সাধুপুরুষ বলব?

কিছুই বলতে হবে না। আমি জানি খুনের পিছনে বিরাট ঘটনা আছে। ঘটনা জানলে হাসান ভাইরে ক্ষমা করা যাবে। একদিন আমি ঘটনা জানব।

কীভাবে জানবি?

রেশমা স্বাভাবিক গলায় বলল, বিবাহের পর উনারে জিজ্ঞাস করব। স্ত্রীর কথা উনি ফেলতে পারবেন না।

রাশেদা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, তুই কী বললি?

রেশমা বলল, তামাশা করলাম। তোমার মন মেজাজ ভালো না। এইজন্যেই তামাশা!

আর একবার যদি এমন তামাশা করস তোরে আমি জীবন্ত কবর দিব।

সকালের নাশতা চলে এসেছে। চালের আটার রুটি। ভুনা হাঁসের মাংস, পায়।

রাশেদা বললেন, সব নিয়া যাও। আমি কিছু মুখে দিব না। আমার মেয়েও মুখে দিবে না। এই বাড়িতে আমরা পানিও স্পর্শ করব না।

রেশমা বলল, আমার ভূখ লাগছে। আমি খাব। হাঁসের মাংস আমার প্রিয়।

রেশমা এখনো জানালা ধরে আছে। বক রহস্যের সমাধান হয়েছে। বকরা ঠোটে মাছ নিয়ে ফিরছে। এতক্ষণ হয়তো তারা ঝাঁক বেধে মাছ খুঁজছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *