১২. বৈধ অবৈধ

অবকাশ থেকে আমার সব জিনিসপত্র, আরমানিটোলা থেকে যেগুলো তুলে নেওয়া হয়েছিল, মাকে বলেছিলাম নিয়ে আসতে, বৈঠকঘরের বইয়ের আলমারিতে রাখা আমার বইগুলো তো আনবেনই, আলমারিটিও যেন আনেন। ময়মনসিংহে ট্রাক ভাড়া করে মা জিনিসপত্র ট্রাকে তুলে নিয়ে এলেন শান্তিবাগের বাড়িতে। তখন রাত অনেক হয়ে গেছে। জিনিসপত্র ঘরে ওঠানো হলে দেখি সব আছে, কেবল বইয়ের আলমারিটিই নেই। মা ক্লান্তিতে নুয়ে আছেন। ঘামছিলেন। মাকে ধমকে আরও ঘামিয়ে দিই।

‘বুকশেল্ফ আনো নাই কেন?’

মা বললেন, ‘কত চাইছি, তর বাপে দিল না। বইয়ের আলমারিটি আমার নিজের না হলেও বাপের।’ কিন্তু মেয়ে বাড়ি ভাড়া নিয়েছে, দেওয়া কি যেত না আলমারিটি! মা কেঁদে ফেলেন, ‘আমি কি করতাম! তর বাপেরে এত কইলাম। তর বাপে কিছুতেই দিল না।’

আমি চেঁচিয়ে বলি, ‘দিল না কেন? বুকশেলফে তো আমার বই ই ছিল। এহন খালি বুক শেলফের মধ্যে কী ঘোড়ার ডিম সাজাইব? সব বই তো নিয়া ‌আইছি। অবকাশে কেউ বই পড়ে? কি করব আলমারি দিয়া? খাইব?’

মা কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, ‘আমি কইছি তর বাপেরে যে এইডা দেইন, মেয়েডা কইয়া দিছে, বই রাখব। ভ্যাংচাইয়া উডে। কয় এইডা আমি বানাইছি। তার দরকার লাগলে সে কিন্যা নিব নে।’

আমার মাথায় রক্ত চড়ে যায়। ‘সে দিল না তো তুমি জোর কইরা নিয়া আইলা না কেন! ট্রাকে যখন উডাইছো আমার জিনিসপত্র, কেন ওইডাও তুইল্যা লইলা না। এহন বই যে সব আনছো, বই আমি রাখবো কই? বুকশেল্ফটাই তো সবচেয়ে দরকার ছিল। কি রকম বাপ হইছে যে একটা বুকশেল্ফ দিতে পারে না নিজের মেয়েরে!’

বাবার ওপর রাগ আমার গিয়ে পড়ে মার ওপর। মা আমার গাল খেয়ে বারান্দার অন্ধকারে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে কাঁদেন। কারও কান্না আমার সহ্য হয় না।

দুপাশে সাইডটেবিল সহ নরম স্পঞ্জের গদিঅলা নতুন একটি বড় খাট, লেখার টেবিল, চেয়ার, কাঠের সোফা কেনার সামর্থ নেই বলে বেতের সোফা, চারটে ডিজাইন করা চেয়ার সহ খাবার টেবিল, কাপড় চোপড় রাখার কাঠের আলমারি, থালবাসন রাখার আলমারি সব ধীরে ধীরে কিনে এনে বাড়িটি সাজিয়েছি। সব করেছি একা, ভাল কিন্তু অত দামি নয় জিনিস পেতে অনেক দোকান ঘুরেছি, দোকান থেকে ঠেলাগাড়িতে মাল তোলা, ঠেলাগাড়ির সঙ্গে সঙ্গে রিক্সা নিয়ে আসা, মাল ঘরে ওঠানোর ব্যবস্থা করা, কোন জায়গায় কোনটি বসবে তা ঠিক করে দেওয়া। কেউ কোনও টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করেনি। বইয়ের আলমারিটি খালি পড়ে থাকবে অবকাশে, তাই ইচ্ছে ছিল ওটি নিয়ে এসে মেঝেয় পড়ে থাকা বইগুলো রাখব। কিন্তু বাবা তা হতে দিলেন না। বাবা আমার সংসার ভাঙার বেলায় বেশ ওস্তাদ, সংসার যখন গড়ি তখন তিনি ফিরে তাকান না। ঠিক আছে, না তাকান, তাঁকে আমার জীবনের কোনও কিছুতেই কোনও প্রয়োজন নেই। আমার জীবনে তিনি তাঁর নাক যেন কখনও না গলাতে আসেন। আমার সিদ্ধান্তেই আমার জীবন চলবে, আত্মীয় স্বজন কাউকেই আমার প্রয়োজন নেই। আমাকে তাদের প্রয়োজন হতে পারে, আমার যেন কখনও কারও প্রয়োজন না হয়।

সংসার ভাবনা আমাকে ঘিরে থাকে সারাক্ষণ। মার আনা পুরোনো খাটটি পেতে দিই অন্য ঘরে, যে ঘরে আত্মীয় বা অতিথি যে কেউ এলে থাকবে। কার্পেট বিছিয়ে দিই বৈঠকঘরে। হাঁড়িপাতিল বাসন কোসন পাঠিয়ে দিই রান্নাঘরে। লিলির বড় বোন কুলসুমকে মা নিয়ে এসেছেন শান্তিবাগে। কুলসুমকে দিয়ে ঘরদোর পরিস্কার করিয়ে রান্নাঘরের জিনিসপত্র রান্নাঘরে সাজিয়ে কি করে কাটা বাছা করতে হবে, কি করে রান্না করতে হবে সব শিখিয়ে দেন। এই রান্নাঘর তো আর অবকাশের রান্নাঘরের মত নয়, এখানে বসে নয়, দাঁড়িয়ে রান্না করতে হয়, গ্যাসের চুলো, মাটির চুলো নয়। এখানে কোনও উঠোন নেই যে হাঁস মুরগি কাক পাখিদের জন্য নষ্ট হয়ে যাওয়া ভাত তরকারি ছুঁড়ে ফেলা যাবে, থাল বাসন ধুয়ে পানি ছুঁড়ে দেওয়া যাবে কোনও গাছের শিকড়ে। এখানে প্লাস্টিকের ব্যাগে বা বালতিতে ময়লা জমিয়ে রেখে বাইরের আবর্জনা ফেলার স্তূপে ফেলে দিয়ে আসতে হয়। বাড়িটি আমি মনের মত করে সাজাতে ব্যস্ত, রান্নাঘরের দিকে যাবার আমার সময় নেই, ও নিয়ে আছেন মা আর কুলসুম। আমাকে খুব যত্ন করে খাবার টেবিলে খাবার দেওয়া হয়। আমি খাবার সময় মা পাশে দাঁড়িয়ে পরেবেশন করেন। আমার কখন কি লাগবে, না চাইতেই মা এগিয়ে দেন সব। মা প্রায়ই ময়মনসিংহে চলে যান, অবকাশ থেকে চাল ডাল তেল পেঁয়াজ যতটা সম্ভব সংগ্রহ করে আনেন। আমার অজান্তেই এসব করেন। কাঁচা বাজারটা আমিই করি শান্তিনগরের বাজার থেকে। বাইরের কাজগুলো করতে অনেক সময় মিলনকে নিয়ে বেরোই। মিলন তার বোনের বাড়ি ছেড়ে আমার বাড়িতে উঠে এসেছে। বাবা তাঁর এক বন্ধুকে ধরে মিলনের জন্য একটি চাকরি যোগাড় করে দিয়েছেন। চাকরিটি মিলন করছে ঠিকই কিন্তু তার মন পড়ে থাকে ময়মনসিংহে। ইয়াসমিন ময়মনসিংহে বসে মাস্টার্স পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সপ্তাহের ছুটির দিনটি কবে আসবে পুরো সপ্তাহ মিলন তারই অপেক্ষা করে। বৃহস্পতিবার বিকেলে সে আর বাড়িতে ফেরে না, আপিস থেকেই সোজা চলে যায় ময়মনসিংহে। কখনও কখনও ছুটি ছাটায় ইয়াসমিন ঢাকায় এসে কাটিয়ে যায়। মার ঢাকা ময়মনসিংহ দৌড়োদৌড়ি করে কাটে। ময়মনসিংহে আমি পারতপক্ষে যাই না। আমি ব্যস্ত আমার চাকরি নিয়ে, লেখালেখি নিয়ে, আর নতুন সংসারটি নিয়ে।

একদিন একটি ফোন আসে হাসপাতালে। মিনারের ফোন। আর ঘণ্টা কয়েক পর সে চিরকালের জন্য চলে যাচ্ছে আমেরিকা, আমি যেন একবার তার সঙ্গে দেখা করি। সে তার বাড়ির ঠিকানা দেয়। হাসপাতাল থেকে একটি বেবি ট্যাক্সি নিয়ে যাই তার বাড়িতে। বাড়ির সামনে বেবি ট্যাক্সিটি দাঁড় করিয়ে রেখেই মিনারের সঙ্গে দেখা করতে যাই। মিনার মদ খেয়ে টাল হয়ে ছিল। গলায় অনেক গুলো চুমুর লাল দাগ। বুজে যেতে চাওয়া চোখ কোনওরকম খুলে রাখছিল। মিনারের প্রেম নিয়ে, ধনী মহিলাটির সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে আমি কোনওদিন কোনও প্রশ্ন করি নি, সেদিনও করি না। মিনার নিজেই বলে সেই মহিলাই তাকে আমেরিকা পাঠাচ্ছেন। মিনার রুদ্রর কথা তোলে, বলে রুদ্র যেদিন মারা গেল, সেদিন বিকেলে সে টিএসসিতে গিয়েছে যেখানে রুদ্রকে এনে রাখা হয়েছিল, রুদ্রকে স্পর্শ করে মিনার কেঁদেছে, একটি কথাই বার বার সে বলেছে, রুদ্র আমাকে ক্ষমা করে দিও। মিনারের মধ্যে যেমন একটি নিষ্ঠুর মিনার বাস করে, তেমনি একটি হৃদয়বান মিনারও হয়ত বাস করে। মিনারের কোন রূপটি সত্যিকারের রূপ কোনওদিন আমার জানা হয়নি। তাকে কোনওদিন আমার খুব আপন মানুষ বলে মনে হয়নি। ভেবেছিলাম তার সঙ্গে শেষ দেখাটি করেই চলে যাবো কিন্তু সে হঠাৎ করে দরজা বন্ধ করে দিয়ে আমাকে বিছানায় টেনে নেওয়ায় তক্ষুনি চলে যাওয়া সম্ভব হয়নি। বিছানায় মিনার আমাকে কেন নেয়! ধর্ষণ করতে! মিনারের শরীরের জন্য আমার শরীরে কোনওরকম আবেগ ছিল না। তার কাছে এই ব্যপারটি মজার একটি খেলার মত। জীবনের অনেক কিছুই তার কাছে নিতান্তই তুচ্ছ খেলা। আমার সঙ্গে মিনারের সম্পর্কটি মিনারের জন্য বা আমার জন্য কোনও গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিল না। তার কাছে সবচেয়ে যে জিনিসটির গুরুত্ব ছিল, সেটি বিচিন্তা। বিচিন্তা পত্রিকাটি বেশ ভাল চলছিল, কিন্তু সেটিও তার কাছে খেলা হয়ে উঠল, নদীর পাড়ের বালুতে মিছিমিছির ঘর বানানো খেলার মত, সন্ধের আগে আগে খেলাঘর পায়ে মাড়িয়ে বাড়ি চলে যাওয়ার মত করে মিনার চলে যাচ্ছে। হতে পারে বিচিন্তা ছাপতে যে মানুষটি টাকা দিচ্ছিলেন তিনি আর দেবেন না সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। হতে পারে মিনারের আর ভাল লাগছিল না পত্রিকা সম্পাদনা করতে। অথবা হেথা নয় হোথা নয়, যেথায় সোনার হরিণ আছে সেথা যেতে সে ব্যাকুল হয়ে উঠছিল তাই বিচিন্তার চিন্তা বাদ দিয়ে বিচিন্তাকে মায় দেশটাকেই টা টা বাই বাই জানিয়ে দিয়েছে। আজকাল মেধাগুলো এভাবেই পাচার হয়ে যাচ্ছে। এ দেশের ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার পদার্থবিদ অংকবিদ সব গিয়ে বিদেশের রেস্তোরাঁয় বাসন মাজে। এতে সপ্তাহ গেলে বা মাস গেলে যে কটি ডলার হাতে আসে, তা বাংলাদেশের টাকায় বেশ বড় অংকের। বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ আলী মিনার ওরফে মিনার মাহমুদ আমেরিকায় গিয়ে বাসন না মাজলেও ট্যাক্সি ড্রাইভিং এ নিজের কেরিয়ার গড়ে তুলেছে। আমার সঙ্গে দুদিন ফোনে কথা হয়েছে। মিনারই ফোন করেছিল, কাগজের সম্পর্কটির কাগুজে মিমাংসার জন্য। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম ওই একটি সম্পর্ক যে ঝুলে আছে। কাগজের সম্পর্কের মূল্য আমার কাছে নেই বলেই হয়ত মনে পড়েনি। যেরকম নিরুত্তাপ সই ছিল সম্পর্কের জন্য, সম্পর্ক ভাঙার জন্য একইরকম নিরুত্তাপ সই দিয়ে দিই। তার এক দূত এসে কাগজে সই নিয়ে যায়, সেই দূতই তাকে কাগজখানা পাঠিয়ে দেয় আমেরিকায়।

একটি জিনিস আমি লক্ষ করেছি, কারও সঙ্গে আমার সম্পর্ক একবার গড়ে উঠলে, সে যে সম্পর্কই হোক, সে সম্পর্ক অন্তত আমার দিক থেকে ভাঙে না। দীর্ঘদিন কারও ওপর আমি রাগ পুষে রাখতে পারি না। সব বরফই হৃদয়ের উত্তাপে গলে জল হয়ে যায়। কারওর ওপরই আমার ঘৃণা নেই। কেউ কোনও ভুল করলে আমি বুঝতে চেষ্টা করি কেন সে ভুলটি করেছে। নিজের ভুলগুলো নিয়েও আমার একইরকম ভাবনা। ক্ষতি করার উদ্দেশ্য কারওর যদি থাকে, আমি নিজেকে তার থেকে দূরে সরিয়ে নিই কিন্তু সম্পর্ক বিষাক্ত হতে দিই না। আমার এই চরিত্রটি অনেকটা মার চরিত্রের মত। মা খুব দ্রুত ক্ষমা করে দিতে পারেন মানুষের যে কোনও ভুল। মার চরিত্রের এই দিকটি আমার খুব অপছন্দ, কিন্তু এই চরিত্রটিই আমি গোপনে গোপনে ধারণ করে বসে আছি। মিনার যখন আমাকে দেখা করতে ডেকেছিল, আমি জানি তার সঙ্গে আমার মনের কোনও সম্পর্ক নেই, তার সঙ্গে আমি কখনই বসবাস করব না, কিন্তু সে আমার বন্ধু ছিল একসময়, একসময় সে আমাকে সামান্য হলেও আনন্দ দিয়েছিল, চলে যাওয়ার দিন কেন তাকে আমি কিছু শুভেচ্ছ! দেব না! দেখেছি, কোনও শত্রুর জন্য আমি কোনও অমঙ্গল কামনা করতে পারি না। বাবা আমার সঙ্গে অতবড় শত্রুতা করার পরও বাবার কখনও কোনও রকম ক্ষতি হোক আমি তা চাই না। মাকে সারা জীবন ধরে বাবা হেলা করেছেন, কষ্ট দিয়েছেন, তারপরও মা বাবার কোনও অমঙ্গল চান না। বাবার সামান্য সর্দিজ্বরেই অস্থির হয়ে পড়েন সেবা করতে। মা ভালবাসেন বাবাকে, সেটি একটি কারণ। কিন্তু ভালবাসার সম্পর্ক না থাকলেও মার আচরণ খুব ভিন্ন নয়। গীতা আর হাসিনা মাকে মা বলে গণ্য করে না, মাকে অপমান করতে কোনও দ্বিধা নেই তাদের, তারপরও মা ওদের জন্য পারলে জীবন দেন। আবদুস সালামের বাড়িতে মার গরুটি বড় হচ্ছিল, একদিন সালাম এসে জানাল যে গরু হারিয়ে গেছে। কেন সালামদের বাড়ির কোনও গরু হারালো না, কেবল মার গরুটি হারালো, এ প্রশ্ন মার মনে উদয় হয়েছে, কিন্তু সালাম বাড়ি এলে ঠিকই মা তাকে আদর করে খেতে বসান। লিলির মাকে গালগাল করলেন আজ, কালই তাকে নিজের পরনের শাড়িটি খুলে দিয়ে দেন। লিলি বা কুলসুমের ওপর রাগ করে গালে শক্ত চড় কষালেন, ঘণ্টাখানিক পরই মার রাগ জল হয়ে যায়। হাতে টাকা থাকলে তখন দোকানে গিয়ে লিলি বা কুলসুমের জন্য কিনে আনেন ভাল কোনও জামা বা লালফিতেঅলা সেণ্ডেল। মার চরিত্রে কোনও দৃঢ়তা নেই, যেটুকু আছে সেটুকুই পলকে ভেঙে যায়। আমার দৃঢ়তাও লক্ষ করেছি খানখান হয়ে পড়ে যখন তখন। এর কারণ কি নিঃসঙ্গতা! হয়ত বা। দৃঢ়তা তাকেই মানায় যার গায়ের জোর আর টাকার জোর আছে অথবা সমাজে একটি পোক্ত অবস্থানে বাস করার জোর আছে। যে নাইম একসময় আমার অনিষ্ট করার জন্য অথবা আমার সুখে বিঘ্ন ঘটাবার জন্য হেন কাজ নেই যে করেনি, আরমানিটোলার বাড়িঅলা আমাকে নোটিশ দিয়েছিল বাড়ি ছাড়ার, সে নাইমের ষড়যন্ত্রের কারণেই, এও শুনেছি যে সুগন্ধা পত্রিকাটির লেখাটির পেছনে এবং পত্রিকাটি বাবার হাতে পৌঁছোর পেছনে নাইমের বড় একটি অবদান আছে — সেই নাইমের সঙ্গেও আমার দেখা হয়, কথা হয়। হঠাৎ হঠাৎ সে শান্তিবাগের বাড়িতে আসে। নাইম আমার একলা থাকার শখের বারোটা বাজাতে চেয়েছিল। আমার শখের ওপর দশ টনের ট্রাক চলে গেছে, গুঁড়ো করে দিয়ে গেছে আমার শখের হাড়গোড়, তারপরও আমার শখ যায়নি। শখ যে আমি যে করেই হোক মেটাচ্ছি, তা সে শান্তিবাগের বাড়িতে এসে দেখে যায়। আমার সুখী য়চ্ছল জীবন দেখে আড়চোখে। নাইম হিংসেয় মরে, সে আমি অনুমান করি। আমার কলামের জন্য দৈনিক সাপ্তাহিক পত্রিকা থেকে অনুরোধ আবদার আসে, নাইম কিন্তু তার ভোরের কাগজে লেখার জন্য আমাকে কখনও বলে না। সে চায় না আমাকে আরও বিখ্যাত হতে দিতে। ভোরের কাগজে লিখছি না বলে আমার কোনও আক্ষেপ নেই, এমনিতে আমি অনেকগুলো পত্রিকায় লিখে কুলিয়ে উঠতে পারি না। নাইমের দোষে বা তার ভাগ্যের দোষে এত চালাক চতুর হয়েও তার পরিকল্পনা মত সব কিছু এগোয় না। ভোরের কাগজ থেকেও তাকে একসময় তাড়িয়ে দেওয়া হয়। তারপরও দমে যাওয়ার পাত্র সে নয়। নতুন উদ্যমে এবার আর পত্রিকা নয়, নিউজ এজেন্সি খুলে বসেছে। খুব ধুমধাম করে নাইম একটি বিয়ে করেছে। চট্টগ্রামের মেয়ে। বিএ পাশ। দেখে শুনে বুঝে সুঝে বিয়েটি সে করেছে। পতিব্রতা স্ত্রী হওয়ার গুণ যে মেয়ের মধ্যে আছে, তেমন মেয়েকেই ঘরে এনেছে। মেয়ে রাঁধবে বাড়বে চমৎকার, শ্বশুর শাশুড়ির যত্ন নেবে, দেবর ননদের দেখভাল করবে, স্বামী যাহা বলিবে তাহাই করিবে জাতীয় মেয়ে। এমন মেয়ে বিয়ে করেও নাইম আমার বাড়িতে আসে। আমার শরীরের দিকে সে ঝুঁকে থাকে। আমি বাধা দিই না শরীরের সম্পর্কে। দীর্ঘদিনের পুরুষস্পর্শহীন শরীরটি নাইমের স্পর্শে কেমন তির তির করে কেঁপে ওঠে। দীর্ঘদিন নিজের অবদমিত ইচ্ছেগুলো মাথা ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চায়, দীর্ঘদিন অন্যের ইচ্ছের সঙ্গে আপোস করে করে নিজের ভেতরে একটি ইচ্ছের জন্ম হয়। ইচ্ছেটি আমার, ইচ্ছেটি অন্য কারওর নয়। ইচ্ছেটিকে আমি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখি। ইচ্ছেটির হাতে হাত রেখে বসে থাকি মুখোমুখি, নিজেকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলি, ‘এ শরীর আমার, শরীর সম্পর্কিত যে কোনও সিদ্ধান্ত নেবার দায়িত্বও আমার।’ শরীরের ক্ষুধা তৃষ্ণা মেটাবার অন্য কোনও উপায় যদি আমার জানা থাকত, তবে নাইমের সঙ্গে মাসে একবার কি দুবার যে সম্পর্কটি হয়, হত না। তার পরও হয়েছে, ইচ্ছে করেছি বলে হয়েছে। সমাজের হাজার রকম যুক্তিহীন নিয়ম অস্বীকার করার মত এই নিয়মটিও আমি অস্বীকার করি যে আমার শরীর কেউ স্পর্শ করলে আমি পচে যাব। পান থেকে চুন খসলে লোকে নষ্ট বলে, অবশ্য মেয়েদের কিছু খসলেই বলে। পুরুষেরা বলে মেয়েদের অমূল্য সম্পদের নাম সতীত্ব। পুরুষেরাই সমাজের এই নিয়মগুলো তৈরি করেছে। মেয়েদের বাধ্য করা হয় বিয়ের আগে কুমারীত্ব আর বিয়ের পর সতীত্ব রক্ষা করতে। বিয়ে নামক সামাজিক নিয়মটি মেয়েদের শরীর এবং মনকে পুরুষের সম্পত্তি করে ফেলে। এই নিয়মের জালে আটকা পড়ে আছে মেয়েরা। নির্বাসিত বাহিরে অন্তরে বইটির প্রথম পাতায় একটি কথা লিখেছিলাম, শৃঙ্খল ভেঙেছি আমি, পান থেকে খসিয়েছি সংস্কারের চুন। কিন্তু সত্যিকার শৃঙ্খল ভাঙতে কি আমি পেরেছি! নাকি ভাঙার একটি গোপন ইচ্ছে নিয়েই বাস করি কেবল! শৃঙ্খল ভাঙার ইচ্ছেটি যেন কেবল বলার জন্য বলা না হয়, প্রাণপণে জীবনে তার প্রয়োগ চেয়েছিলাম। সেই কচি বয়সে আমাকে যখন বোরখা পরানোর চেষ্টা হয়েছিল, সেই যে বোরখা ছুঁড়ে ফেলেছিলাম, সংষ্কার না মানার শুরু তখনই। রিক্সার হুড মাথায় ঘোমটার মত তুলে মেয়েরা বসবে, এই নিয়ম ভেঙেও রিক্সার হুড ফেলে দিয়ে রিক্সায় চড়েছি ছোট্ট ঘিঞ্জি শহর ময়মনসিংহে। লোকে হাঁ হয়ে দেখেছে, দেখুক। মন্দ বলেছে, বলুক। আমার ইচ্ছে হয়েছে বলে করেছি, আমার ভাল লেগেছে বলে করেছি। সামাজিক নিয়মগুলোয় আমি কোনও যুক্তি পাইনি বলে করেছি। সোজা কথা। সাফ কথা। বাবা মা ছেলে পছন্দ করবেন, তারপর মেয়ের বিয়ে হবে। সেই নিয়মও মানিনি। প্রেম করতে মানা। প্রেম করেছি। স্বামী যেমনই হোক, মানিয়ে চলা নিয়ম, সেই নিয়ম মানিনি। পরপুরুষের সঙ্গে কথা বলা, আড্ডা দেওয়া, ঘনিষ্ঠ হওয়া মানা, সেই নিয়মও মানিনি। আমি আমার নিয়মে চলতে চাই। যে নিয়মটিকে আমি পালনযোগ্য মনে করি, সেটি গ্রহণ করতে চাই, বাকি নিয়ম যেগুলো আমারে আমিত্ব নষ্ট করে, সেগুলোকে বর্জন করতে চাই। কোনও অযৌক্তিক কিছুর সঙ্গে, কোনও মন্দের সঙ্গে মানিয়ে চলতে যে পারে পারুক, আমি পারি না। আমি না পেরে দেখিয়েছি আমি পারি না। খুব অল্পদিনেই আমি বুঝতে পারি, নাইম আমার শরীরে তার তৃষ্ণা মেটাচ্ছে, এতে তার লাভ হলেও আমার কোনও লাভ হচ্ছে না। আমি কোনও তৃপ্তি পাচ্ছি না এই সম্ভোগে। এর কারণ আমি একটিই খুঁজে পাই, নাইমের জন্য আমার কোনও ভালবাসা নেই। একসময় যখন তাকে ভাল লাগত, তখন তৃপ্তি হত। ভাললাগাটিও যখন ফুরিয়ে যায়, তখন সম্ভোগ নিতান্তই শারীরিক যন্ত্রণা হয়ে দাঁড়ায়। ভালবাসা না হোক ভাল লাগা বলে কিছু থাকতে হয়, কেবল শরীরের জন্যই শরীর উত্তেজিত হয় না। ধীরে ধীরে আরও একটি ইচ্ছের জন্ম হয় আমার মধ্যে, সেটি সম্ভোগের নামে শারীরিক যন্ত্রণাটি না মানার ইচ্ছে। এটিও সিদ্ধান্ত। একটি জিনিস আমার বিশ্বাসের ভেতরে পাকাপাকি জায়গা করে নিতে চাইছে, সেটি নিজের ইচ্ছের মূল্য দেওয়া। যে কোনও ব্যপারেই। হ্যাঁ, আমার শরীর সম্পূর্ণই আমার, এর ওপর কর্তৃত্ব করার অধিকার আমার ছাড়া আর কারও থাকা উচিত নয়। এ শরীর নিয়ে কি করব আমি, একে পাঁকে ফেলব নাকি মাথায় তুলব, এ আমার নিজের সিদ্ধান্তেই হবে। অন্যের সিদ্ধান্তে নয়। আমি একাধিক পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করেছি, একথা জেনে অনেক পুরুষই জুলজুল করে তাকায় আমার শরীরের দিকে। যেন শরীরটি খুব সুলভ কিছু, যেন হাত বাড়ালেই মেলে। যদি হাত বাড়ালে না মেলে, জুলজুল চোখগুলো ক্রমেই বিস্ফারিত হয়। অন্য কোনও মেয়েকে যত না কাদা ঘাঁটতে হয়, যত না কাঁটাতার পেরোতে হয় পথ চলতে, আমার বেশি হয়। কারণ পুরুষের দৃষ্টিগুলো সন্দিহান, জিভগুলো বেরিয়ে আসা, চোখগুলো লোলুপ, নাকগুলো শুকর শুকর। নারী হচ্ছে ভোগের সামগ্রী, এই কথাটি সকলের মস্তিস্কের কোষে গ্রথিত। একাধিক পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছে বলে আমি অন্যরকম জীব, আমি এই বয়সে স্বামী সন্তানহীন জীবন কাটাচ্ছি, আমার জীবনটি অস্বাভাবিক, ঠিক তাদের মা বোন খালা ফুপু বা বউদের মত আমি নই। চোখ টিপতে হাত ধরতে গায়ে ঢলতে তাই কারও কোনও শরম হয় না। তাদের আরেকটি ভাবনা কখনও হয় না যে পুরুষও ভোগের সামগ্রী হতে পারে, নারীও ভোগ করতে পারে পুরুষকে এবং এই ভাবনাটি তো একেবারেই হয় না যে আমি ইচ্ছে না করলে এক ধর্ষণ ছাড়া কারও সাধ্য নেই আমার শরীর পাওয়া।

আমার শান্তিবাগের বাড়িতে হঠাৎ একদিন শিপ্রা উদয় হয়। শিপ্রার জীবনে কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। মানুর সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর সে পড়াশোনায় মন দিয়েছিল। এতে কাজ হয়েছে, সে পিজিতে ভর্তি হয়েছে। এখন সে ঢাকায় পিজির হোস্টেলে থেকে এফসিপিএসএর ক্লাস করছে। মানু থেকে মন উঠেছে শিপ্রার, এ খুব ভাল সংবাদ কিন্তু সে নতুন করে প্রেমে পড়েছে। প্রেমিকের নাম হারুন। দেখতে ফর্সা, ছোট খাটো, ভাল ছাত্র গোছের চেহারা। হারুনও পিজিতেই পড়াশোনা করছে। হাঁটুর বয়সী না হলেও শিপ্রার বুকের বয়সী হবে হারুন। এই হারুনের সঙ্গে কী করে কী করে দু কথা হয় শিপ্রার। তারপরই ওকে লেজের মত করে নিয়ে আমার শান্তিবাগের বাড়িতে হাজির। সোফায় ঘন হয়ে বসে ফিসফিস করেই ছেড়ে দেয়নি, দুজনে শোবার ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করল। হারুনও তাকে, মানুর মত অতটা না হলেও, শিপ্রা বলে যে আনন্দ দিতে পারে। এরকম একটি চমৎকার বাড়ি পেয়ে শিপ্রা ঘন ঘন আসতে শুরু করল হারুনকে নিয়ে। মিলনও দেখে শিপ্রার কাণ্ড। সে আগেও দেখেছে তার নিজের ভাই মানুর সঙ্গে শিপ্রার মাখামাখি। মিলন আগে অনেকবার বলেছে শিপ্রাকে, মানুর কোনও প্রতিশ্রুতিতে যেন সে বিশ্বাস না করে। শিপ্রা তখন এমনই মানু -পাগল যে কারও কোনও উপদেশই তার কানে প্রবেশ করলেও অন্তরে প্রবেশ করত না। মিলনের সামনে, শিপ্রার, আমি বুঝি, হারুনের সঙ্গে সম্পর্কটি নিয়ে খানিকটা অস্বস্তি হয়। কিন্তু অচিরে সে অস্বস্তি ধুলো ধুলো ঝেড়ে ফেলার মত ঝেড়ে ফেলে। আমি বা মিলন দুজনের কেউই শিপ্রাকে অতীত অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করিয়ে দিই না। পুরোনো কথা শিপ্রাও আর মনে করতে চায় না। নতুন জীবন নিয়ে সে ব্যস্ত। একদিন হারুনের হাঁড়ির খবর নিয়ে পড়ল। হারুন কেন বলেছে যে তার সঙ্গে তার বউএর সম্পর্ক ভাল নয়, কিন্তু সে যে দেখলো দুজনকে সেদিন পার্কে বেড়াতে! হারুন হোস্টেল ছেড়ে শিপ্রাকে লুকিয়ে প্রায় রাতেই শ্বশুর বাড়ি চলে যায় রাত কাটাতে। এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় শিপ্রা রাতের ঘুম ছেড়ে দিল। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ব্যস্ত হারুনের গতিবিধি নিয়ে। কেন যায় সে এত ঘন ঘন বউএর কাছে, তবে কি তার বউকে সে ভালবাসে, কিন্তু হারুন তো শিপ্রার গা ছুঁয়ে বলেছে, তার বউএর সঙ্গে বছর দুই ধরে কোনও রকম সম্পর্ক নেই, মনের এবং শরীরের সম্পর্ক যদি থাকে কারও সঙ্গে, তবে তা শিপ্রার সঙ্গেই! বউ থাকে বউএর বাপের বাড়ি। বাচ্চাটিকে নাকি হারুন মাঝে মাঝে দেখতে যায়। কিন্তু শিপ্রার মনে সন্দেহ, কেবল বাচ্চার উদ্দেশেই যাওয়া নয়। উদ্দেশ্য বউএর সঙ্গে শোয়া। আবার শিপ্রার চোখে জল। আবার উদ্বিগ্ন সে! আবারও দুশ্চিন্তার একশ পোকা তার মাথায় কালো উকুনের মত কিলবিল করে। এই হারুনের সঙ্গেও, আমার আশঙ্কা, সম্পর্ক ঘুচবে শিপ্রার। প্রেম করবে বিয়ে হওয়া বাচ্চা কাচ্চা হওয়া পুরুষের সঙ্গে, যেখানে অবিবাহিতরাই বিশ্বস্ত হয় না, সেখানে আবার বিবাহিতকে বিশ্বস্ত করতে চাইছে সে, তাও আবার জোর জবরদস্তি করে!

‘হুমায়ুন কোথায়?’

‘ওর কথা বোলো না। ওর নাম শুনলে আমার গা ঘিনঘিন করে।’

হুমায়ুন থাকে রাজশাহী। আনন্দ হুমায়ুনের কাছে। শিপ্রার মাও চলে গেছেন রাজশাহী। খুব সংক্ষেপে তথ্যগুলো জানিয়ে শিপ্রা আবার হারুনের কথায় ফিরে এল। হারুন কি তাকে ভালবাসে না?

আমি কি করে জানব হারুন শিপ্রাকে ভালবাসে কী না! আমার নিরুত্তর মুখখানার দিকে চেয়ে শিপ্রা হঠাৎ হু হু করে কাঁদতে শুরু করে।

‘কী করব বলো তো! হারুন কি আমাকে মিথ্যে কথা বলছে যে আমাকে সে ভালবাসে!’ ‘হারুন তোমাকে ভালবাসে কি না সে তুমি বুঝবে, আমি বুঝবো কী করে!’

‘আমি তো ভেবেছিলাম ভালই বাসে, কিন্তু মনে হচ্ছে ও আমাকে মিথ্যে বলেছে।’

‘মিথ্যে যদি বলে, তবে তুমি আর লেগে আছো কেন?’

‘লেগে না থেকে যে পারি না। অনেকবার ভেবেছি ওকে ভুলে যাবো। কিন্তু ভুলতে যে পারি না।’

‘চেষ্টা করেছো?’

‘তা করেছি। লেখাপড়ায় মন দিতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু বই খুলে কেবল বসেই থাকি, মন থাকে হারুনে।’

‘বিবাহিত লোকদের নিয়ে ঝামেলা। প্রেম করলে অবিবাহিহতদের সঙ্গে কোরো।’

‘আমাদের বয়সী বা কাছাকাছি বয়সী কোন ছেলেটা আছে এখনও অবিবাহিত?’

‘ছেড়ে দাও তো। হারুন কি করল কোথায় গেল, কি বলল, মিথ্যে বলল কী সত্যি বলল, এসব নিয়ে ভাবো কেন?’

‘ভাববো না?’

‘না।’

‘তাহলে কি কেবল শরীর?’

‘সেটিই তো তোমার প্রয়োজন। ঠিক না?’

‘কিন্তু ভালবাসাহীন কোনও স্পর্শ যে আমার শরীরকে কোনও উত্তাপ দেয় না।’

শিপ্রার চোখে চোখ রেখে আমি গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করি, ‘হারুনকে কি তুমি ভালবাসো?’

শিপ্রা মাথা নাড়ে। সত্যি সত্যি সে বাসে। না বাসলে হারুন তার বউএর কাছে গেলে তার কষ্ট হয় কেন!

শিপ্রার জন্য আমার মায়া হতে থাকে। আমি তাকে কোনওরকম সান্ত্বনা দিতে পারি না। ভালবাসা ছাড়া শিপ্রাও কোনও শরীরের সম্পর্কে উৎসাহ পায় না। ভালবাসার জন্য যোগ্য কোনও মানুষ আমাদের নেই। আমরা ভালবাসা পেতে চাই, দিতে চাই। কিন্তু বারবারই পুরুষের প্রতারণার শিকার হই। তারপরও ভালবাসার শখ যায় না আমাদের। এত আঘাত পাওয়ার পরও হৃদয়ের দুয়ার খুলে বসে থাকি। ভালবাসা জিনিসটি একরকম ফাঁদ, ভাল লাগিয়ে, ভালবাসিয়ে, প্রেমে পড়িয়ে পুরুষেরা অন্যরকম এক দাসত্বের শৃঙ্খলে বাঁধে মেয়েদের। কোনও পুরুষের সঙ্গে আমার এখন ভালবাসার সম্পর্ক নেই, আমি হয়ত ততটা অনুভব করি না, কিন্তু এটি আমাকে একধরনের মুক্তি দেয়। প্রেমহীন জীবন বর্ণাঢ্য না হলেও স্বস্তিকর। আমার এখন স্বস্তিই দরকার।

এরপর একদিন খুব খুশি খুশি মুখে আমার বাড়িতে এল শিপ্রা। আমাকে জড়িয়ে ধরে উচ্ছ্বসিত আনন্দে সে জানাল যে জীবনে প্রথম সে অরগাজমের স্বাদ পেয়েছে। হারুনের সঙ্গে কবে কোথায় তার মিলন হয়েছে জিজ্ঞেস করলে সে মাথা নাড়ে। হারুন তাকে দেয়নি এটি। তবে দিয়েছে কে, অন্য আবার কার সঙ্গে তার প্রেম হল! না কারও সঙ্গে নয়। কেউ তাকে এই শীর্ষসুখ দেয়নি। সে নিজেই দিয়েছে নিজেকে। কি করে? এক মধ্য রাতে শিপ্রার শরীর জেগে উঠেছে, সে এপাশ ওপাশ করছে, তারপর নিজেই সে ঘটনাটি ঘটায়। শিপ্রা নিখূঁত বর্ণনা করে কি করে সে নিজের উত্তপ্ত শরীর শীতল করার জন্য হস্তমৈথুন করেছে। হস্তমৈথুন পুরুষের ব্যপার, সে আমি জানতাম। শিপ্রাও তাই জানত, কিন্তু নিজে সে নিজের শরীরে কোনও রকম অভিজ্ঞতা ছাড়াই যে কাজটি করেছে, তা তাকে একটি নতুন স্বাদ দিল, অরগাজমের স্বাদ। প্রথম স্বাদ।

শিপ্রার উদঘাটন করা স্বমৈথুন আমাকে আকর্ষণ করে না। শিপ্রার মত কারও প্রেমেও আমি পড়ি না। যৌনতা শিকেয় তোলা। ডাক্তারি চাকরির বাইরে যে অবসরটুকু জোটে সেটুকু আমি সাহিত্য জগতে খরচ করি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *