বৌবাজারের বেচারামবাবু বৈঠকখানায় বসিয়া আছেন। নিকটে দুই-একজন লোক কীর্তন-অঙ্গ গাইতেছেন। বাবু গোষ্ঠ, দান, মান, মাথুর খণ্ডিতা, উৎকণ্ঠিতা কলহান্তরিতা ক্রমে ক্রমে ফরমাইশ করিতেছেন। কীর্তনিয়ারা মনোহরসাহী রেনিটি ও নানা প্রকার সুরে কীর্তন করিতেছে, সে সকল শুনিয়া কেহ কেহ দশা পাইয়া একেবারে গড়াগড়ি দিতেছে। বেচারামবাবু চিত্রপুত্তলিকার ন্যায় স্তব্ধ হইয়া রহিয়াছেন এমতো সময়ে বালীর বেণীবাবু গিয়া উপস্থিত।
বেচারামবাবু অমনি কীর্তন বন্ধ করাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, আরে কত্তা বেণীভায়া। বেঁচে আছো কি? বাবুরাম নেকড়ার আগুন —ছেড়েও ছাড়ে না অথচ আমরা তাঁহার যে কর্মে যাই সেই কর্মে লণ্ডভণ্ড হইয়া আসিতে হয়। মনিরামপুরের ব্যাপারেতে ভালো আক্কেল পাইয়াছি —কথাই আছে, যে হয় ঘরের শত্রু সেই যায় বর যাত্রী।
বেণী। বাবুরামবাবুর কথা আর বলবেন না —দেক্সেক্ হওয়া গিয়াছে —ইচ্ছা হয় বালীর ঘর-দ্বার ছাড়িয়া প্রস্থান করি। “অপরম্বা কিং ভবিষ্যতি” —আর বা কপালে কি আছে।
বেচারাম। ভালো, বাবুরামের তো এই গতিক —আপনি যেমন —মন্ত্রী যেমন —সঙ্গীরা যেমন —পুত্র যেমন —সকল কর্ম-কারখানা তেমন। তাহার ছোট ছেলেটি ভালো হইতেছে এর কারণ কি ? সে যে গোবর কুঁড়ে পদ্ম ফুল।
বেণী। আপনি এ কথা জিজ্ঞাসা করিতে পারেন। — এ কথাটি অসম্ভব বটে কিন্তু ইহার বিশেষ কারণ আছে। পূর্বে আমি বরদাপ্রসাদ বিশ্বাসবাবুর পরিচয় দিয়াছি তাহা আপনার স্মরণ থাকিতে পারে। কিয়ৎকালাবধি ঐ মহাশয় বৈদ্যবাটীতে অবস্থিতি করিয়া আছেন। আমি মনের মধ্যে বিবেচনা করিয়া দেখিলাম বাবুরামবাবুর কনিষ্ঠ পুত্র রামলাল যদ্যপি মতিলালের মতো হয় তবে বাবুরামের বংশ ত্বরায় নির্বংশ হইবে কিন্তু ঐ ছেলেটি ভালো হইতে পারে, তাহার উত্তম সুযোগ হইয়াছে। এই সকল বিবেচনা করিয়া রামলালকে সঙ্গে করিয়া উক্ত বিশ্বাসবাবুর নিকট গিয়াছিলাম। ছেলেটির সেই পর্যন্ত বিশ্বাসবাবুর প্রতি ঐকান্তিক ভক্তি হওয়াতে তাঁহার নিকটেই সর্বদা পড়িয়া আছে, আপন বাটীতে বড় থাকে না। তাঁহাকে পিতার তুল্য দেখে।
বেচারাম। পূর্বে ঐ বিশ্বাসবাবুরই গুণ বর্ণনা করিয়াছিলে বটে —যাহা হউক একাধারে এত গুণ কখনও শুনি নাই, এক্ষণে তাঁহার ভালো পদ হইয়াছে —মনে গর্মি না জন্মিয়া এত নম্রতা কি প্রকারে হইল ?
বেণী। যে ব্যক্তি বাল্যকালাবধি সম্পত্তি প্রাপ্ত হয় ও কখন বিপদে না পড়িয়া কেবল সম্পদেই বাড়িতে থাকে তাহার নম্রতা প্রায় হওয়া ভার —সে ব্যক্তি অন্যের মনের গতি বুঝিতে পারে না অর্থাৎ কি বা পরের প্রিয়, কি বা পরের অপ্রিয়, তাহা তাহার কিছুমাত্র বোধ হয় না, কেবল আপন সুখে সর্বদা মত্ত থাকে —আপনাকে বড়ো দেখে ও তাহার আত্মীয়বর্গ প্রায় তাহার সম্পদেরই খাতির করিয়া থাকে। এমতো অবস্থায় মনের গর্মি বড়ো ভয়ানক হইয়া উঠে —এমতো স্থলে নম্রতা ও দয়া কখনই স্থায়ী হইতে পারে না। এই কারণে কলিকাতার বড়োমানুষের ছেলেরা প্রায় ভালো হয় না। একে বাপের বিষয়, তাতে ভারি পদ সুতরাং সকলের প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করিয়া বেড়ায়। চোট না খাইলে —বিপদে না পড়িলে মন স্থির হয় না। মনুষ্যের নম্রতা অগ্রেই আবশ্যক। নম্র না হইলে লোকে ধর্মে বাড়িতেও পারে না।
বেচারাম। বরদাবাবু এত ভালো কি প্রকারের হইলেন ?
বেণী। বরদাবাবু বাল্যাবস্থা অবধি ক্লেশে পড়িয়াছিলেন। ক্লেশে পড়িয়া পরমেশ্বরকে অনবরত ধ্যান করিতেন —এইমতো অনবরত ধ্যান করাতে তাঁহার মনে দৃঢ় সংস্কার হইয়াছে যে, যে-কর্ম পরমেশ্বরের প্রিয় তাহাই করা কর্তব্য। যে-যে কর্ম তাঁহার অপ্রিয় তাহা প্রাণ গেলেও করা কর্তব্য নহে। ঐ সংস্কার অনুসারে তিনি চলিয়া থাকেন।
বেচারাম। পরমেশ্বরের প্রিয় অপ্রিয় কর্ম তিনি কি প্রকারে স্থির করিয়াছেন।
বেণী। ঐ বিষয়ে জ্ঞান প্রাপ্ত হইবার দুই উপায়ে আছে। প্রথমতঃ, মনঃসংযম করিতে হয়। মনের সংযম নিষিদ্ধ স্থির হইয়া ধ্যান ও মনের সম্ভাব বৃদ্ধি করা অবশ্যক। স্থিরতর চিত্তে ধ্যানের দ্বারা মনকে উল্টে পাল্টে দেখতে দেখতে হিতাহিত বিবেচনা শক্তি চালনা হইতে থাকে, ঐ শক্তি যেমন প্রবল হইয়া উঠে তেমনি লোকে ঈশ্বরের অপ্রিয় কর্মে বিরত হইয়া প্রিয় কর্মেতে রত হইতে থাকে। দ্বিতীয়তঃ সাধুলোকে যাহা লিখিয়াছেন তাহা পাঠ ও আন্দোলন করিলে ঐ শক্তি ক্রমশঃ অভ্যাস হয়। বরদাবাবু আপনাকে ভালো করিবার জন্য কোনো অংশ কসুর করেন নাই। অদ্যাবধি তিনি সাধারণ লোকের ন্যায় কেবল হো হো করিয়া বেড়ান না। প্রাতঃকালে উঠিয়া নিয়ত পরমেশ্বরের উপাসনা করিয়া থাকেন —তৎকালীন তাঁহার মনে যে ভাব উদয় হয় তাহা তাঁহার নয়নের জল দ্বারাই প্রকাশ পায়। তাহার পরে তিনি আপনি কি মন্দ ও কি ভালো কর্ম করিয়াছেন তাহা সুস্থির হইয়া উল্টে পাল্টে দেখেন —তিনি আপন গুণ কখনই গ্রহণ করেন না —কোন অংশে কিঞ্চিৎমাত্র দোষ দেখিলেই অতিশয় সন্তাপিত হন কিন্তু অন্যের গুণ শ্রবণে আমোদ করেন, দোষ জানিতে পারিলে ভ্রাতৃভাবে কেবল কিছু দুঃখ প্রকাশ করেন। এইরূপ অভ্যাসের দ্বারা তাঁহার চিত্ত নির্মল ও শান্ত হইয়াছে। যে ব্যক্তি মনকে এরূপ সংযত করে সে যে ধর্মেতে বাড়িবে তাহাতে আশ্চর্য কি ?
বেচারাম। বেণী ভায়া। বরদাবাবুর কথা শুনিয়া কর্ণ জুড়াইল, এমতো লোকের সহিত একবার দেখা করিতে হইবে, দিবসে তিনি কি করিয়া থাকেন ?
বেণীবাবু। তিনি দিবসে বিষয় কর্ম করিয়া থাকেন বটে কিন্তু অন্যান্য লোকের মতো নহে। অনেকেই বিষয় কর্মে প্রবৃত্ত হইয়া কেবল পদ ও অর্থের বিষয় ভাবেন, কিন্তু তিনি তাহা বড় ভাবেন না। তাঁহার ভালো জানা আছে যে পদ ও অর্থ জলবিম্বের ন্যায় দেখিতে ভালো —শুনিতে ভালো —কিন্তু মরিলে সঙ্গে যায় না বরং সাবধানপূর্বক না চলিলে ঐ উভয় দ্বারা কুমতি জন্মিয়া থাকে, তাঁহার বিষয় কর্ম করিবার প্রাধান তাৎপর্য এই যে তদ্দ্বারা আপন ধর্মের চালনা ও পরীক্ষা করিবেন। বিষয়কর্ম করিতে গেলে লোভ, রাগ, হিংসা, অবিচার ইত্যাদি প্রবল হইয়া উঠে ও ঐ সকল রিপুর দাপটে অনেকেই মারা যায়, তাহাতে যে সামলিয়া যায় সে-ই প্রকৃত ধার্মিক। ধর্ম মুখে বলা সহজ কিন্তু কর্মের দ্বারা না দেখাইলে মুখে বলা কেবল ভণ্ডামি; বরদাবাবু সর্বদা বলিয়া থাকেন সংসার পাঠশালার স্বরূপ, বিষয় কর্মের দ্বারা মনের সদভ্যাস হইলে ধর্ম অটুট হয়।
বেচারাম। তবে কি বরদাবাবু অর্থকে অগ্রাহ্য করেন ?
বেণী। না না —অর্থকে হেয় বোধ করেন না —কিন্তু তাঁহার বিবেচনাতে ধর্ম অগ্রে অর্থ তাহার পরে, অর্থাৎ ধর্মকে বজায় রাখিয়া অর্থ উপার্জন করিতে হইবেক।
বেচারাম। বরদাবাবু রাত্রে বাড়িতে কি করেন ?
বেণী। সন্ধ্যার পর পরিবারের সহিত সদালাপ ও পড়াশুনা করিয়া থাকেন। তাঁহার সচ্চরিত্র দেখিয়া পরিবারের সকলে তাঁহার মতো হইতে চেষ্টা করে, পরিবারের প্রতি তাঁহার এমতো স্নেহ যে স্ত্রী মনে করেন এমন স্বামী যেন জন্মে জন্মে পাই, সন্তানেরা তাঁহাকে এক দণ্ড না দেখিলে ছটফট করে। বরদাবাবুর পুত্রগুলি যেমন ভালো, কন্যাগুলিও তেমনি ভালো। অনেকের বাটীতে ভায়ে-বোনে সর্বদা কচ্কচি-কলহ করিয়া থাকে। বারদাবাবুর সন্তানেরা কেহ কাহাকেও উচ্চ কথা কহে না, কি লেখার সময়, কি পড়ার সময়, কি খাবার সময়, সকল সময়ই তাহারা পরস্পর স্নেহ পূর্বক কথাবার্তা কহিয়া থাকে —বাপ-মা ভালো না হইলে সন্তান ভালো হয় না।
বেচারাম। আমি শুনিয়াছি বরদাবাবু সর্বদা পাড়ায় ঘুরিয়া বেড়ান।
বেণী। এ কথা সত্য বটে —তিনি অন্যের ক্লেশ, বিপদ অথবা পীড়া শুনিলে বাটীতে স্থির হইয়া থাকিতে পারেন না। নিকটস্থ অনেক লোকের নানা প্রকারে উপকার করিয়া থাকেন কিন্তু ঐ কথা ঘুণাক্ষরে কাহাকেও বলেন না ও অন্যের উপকার করিলে আপনাকে উপকৃত বোধ করেন।
বেচারাম। বেণী ভায়া। এমন প্রকার লোক চক্ষে দেখা দূরে থাকুক কোনো কালে কখন কানেও শুনি নাই —এমতো লোকের নিকটে বুড়ো থাকিলেও ভালো হয় —ছেলে তো ভালো হবেই। আহা। বাবুরামের ছোট ছেলেটি ভালো হইলেই বড়ো সুখজনক হইবে।