১২. বিবাহের উপর গণতান্ত্রিক প্রভাব
সাম্প্রতিককালে হিন্দুর যৌনজীবনে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। বলাবাহুল্য পাশ্চাত্য দেশের চিন্তাধারার প্রভাবেই এটা ঘটেছে। পরিবর্তনের সূচনা হয় রাজা রামমোহন রায় কর্তৃক সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন থেকে। স্বামীর মৃত্যুর পর জীবন্ত স্ত্রীকে (অধিকাংশ ক্ষেত্রে বলপূর্বক ) আহুতি দেওয়া হতো স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় । এদেশে কত অভাগিনী নারী যে এভাবে প্রাণ হারিয়েছে তার ইয়ত্ত নেই। এই নিষ্ঠুর বর্বর প্রথার উচ্ছেদের জন্য রাজা রামমোহন রায় খড়গহস্ত হন। সনাতনীসমাজের ঘোর বিরোধিতা সত্ত্বেও রাজা রামমোহন রায়ের চেষ্টা সাফল্যমণ্ডিত হয়। তিনি লর্ড ডালহাউসীকে সম্মত করতে সক্ষম হয়েছিলেন ১৮২৯ সালের ২৭নং আইন বিধিবদ্ধ করাতে। এই আইনের ফলে সতীদাহ চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। সহমরণের হাত থেকে হিন্দু বিধবা রক্ষা পেলো বটে কিন্তু তার সামনে যে পথ উন্মুক্ত রইল সেটা হচ্ছে সারা জীবন ব্রহ্মচর্যপালন করা। খুব অল্প বয়সে যেসব মেয়ে বিধবা হতো তাদেরও বাধ্য করা হতে এই কঠোর সংযমের বশীভূত হতে। এর ফলে সমাজে নানারূপ তুনীতি প্রবেশ করেছিল। বাল-বিধবার এই কঠোর জীবনের প্রতি সৌহার্দ্য হয়ে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় বদ্ধপরিকর হন, এই সকল অক্ষতযোনী বাল-বিধবার পুনরায় বিবাহ দেবার জন্য। সনাতনীসমাজ তাকেও রেহাই দিল না। কিন্তু রক্ষণশীল সমাজকে কশাঘাত করবার শক্তির অধিকারী ছিলেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। একাই তিনি রক্ষণশীল সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন। তিনি প্রবুদ্ধ করলেন তৎকালীন সরকারকে ১৮৫৬ সালের ১৫নং আইন বিধিবদ্ধ করাতে। এই আইন দ্বারা বিধবার বিবাহ বৈধ করা হলো ।
তারপর ১৮৭২ সালের ৩নং আইন দ্বারা সবর্ণ বিবাহের বাধাও দূর করা হলো। তবে এই আইন অনুযায়ী বিবাহ করতে হলে বিবাহ-ইচ্ছুক উভয় পক্ষকেই শপথ করতে হতে যে, তারা হিন্দু নন। কিন্তু ১৯২৩ সালের ৩০নং আইন দ্বারা বিধান দেওয়া হলো যে, অহিন্দু বলে ঘোষণা না করেও অসবর্ণ বিবাহ করতে পারা যাবে। এরপর রায়বাহাদুর হরবিলাস সরদা বদ্ধপরিকর হলেন হিন্দুসমাজে বাল্যবিবাহ রোধ করবার জন্ত । ১৯২৯ সালের ১৯নং আইনে নির্দেশ দেওয়া হলো যে হিন্দু-বিবাহে ছেলের উপযুক্ত বয়স নূনপক্ষে ১৮ ও মেয়ের বয়স ১৫ হওয়া চাই। ১৯৩০ সালের ১লা এপ্রিল থেকে চালু হয়ে এই আইন এখনও বলবৎ আছে। হিন্দু বিবাহ সংস্কারের জন্য দুটো বড় রকমের আইন বিধিবদ্ধ করা হয় ১৯৪৬ সালে। ওই বৎসর ১৯নং আইন দ্বারা স্ত্রীকে অধিকার দেওয়া হলো অবস্থাবিশেষে স্বামী ত্যাগের জন্য। স্বামী যদি কুৎসিত ব্যাধিতে ভোগেন, কী স্ত্রীর প্রতি এমন নিষ্ঠুর ব্যবহার করেন যাতে স্ত্রীর নিরাপত্তার অভাব ঘটে, কী স্ত্রীকে পরিত্যাগ করেন, কী আবার স্ত্রীগ্রহণ করেন, কী নিজ বাসগৃহে রক্ষিতা এনে রাখেন, কী ব্যভিচারে লিপ্ত হন, কী ধর্মান্তর গ্রহণ করেন, তাহলে ওই আইনের বলে স্ত্রী স্বচ্ছন্দে স্বামী ত্যাগ করে স্বতন্ত্র বসবাস করতে পারবেন। আর ২৮নং আইনে নির্দেশ দেওয়া হলো যে, সগোত্রে ও সমপ্রবরে বিবাহও বৈধ। স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৪৯ সালের ২১নং আইন দ্বারা বিবাহক্ষেত্রে জাতিগত, বর্ণগত, শ্রেণীগত ও সম্প্রদায়গত যত রকম বাধা-বৈষম্য ছিল তা দূরীভূত করা হলো। বিবাহ সম্পর্কে শেষ আইন বিধিবদ্ধ হয়েছে ১৯৫৫ সালে। এটাই হচ্ছে বিবাহ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আইন। এই আইনটিকে হিন্দুবিবাহ বিধি বা ১৯৫৫ সালের ২৫নং আইন বলা হয়। বৈধ বিবাহের যে সকল শর্ত এতে নির্দিষ্ট হয়েছে সেগুলো হচ্ছে ঃ
(১) বিবাহকালে স্বামীর অন্য স্ত্রী বা স্ত্রীর অন্য স্বামী জীবিত থাকবে না ।
(২) উভয়পক্ষের কেহই পাগল বা জড়বুদ্ধিসম্পন্ন হবে না।
(৩) ন্যূনপক্ষে বরের ১৮ এবং কনের ১৫ বৎসর বয়স হওয়া চাই ।
(৪) উভয়পক্ষের কেহই নিষিদ্ধ নিকট আত্মীয়ের মধ্যে হবে না।
(৫) উভয়ের কেহই সপিণ্ড হবে না।
(৬) যেস্থলে কনের বয়স ১৫ বছরের কম সেস্থলেও অভিভাবকের সম্মতির প্রয়োজন হবে।
এই আইনে আরও বলা হয়েছে যে সিদ্ধ বিবাহ অসিদ্ধ বলে সাব্যস্ত হবে। যথা :
(১) যদি স্বামী পুরুষত্বহীন হয়।
(২) যদি বিবাহের সময় কোন পক্ষ পাগল বা জড়বুদ্ধিসম্পন্ন হয় ।
(৩) যদি প্রতারণা দ্বারা বা বলপূর্বক অভিভাবক দ্বারা দরখাস্তকারীর সম্মতি নেওয়া হয়ে থাকে।
(৪) যদি বিবাহের পূর্বে স্ত্রী স্বামী ব্যতীত অপর কারোর দ্বারা গর্ভবতী হয়ে থাকে।
(৫) যদি অন্য স্ত্রী কি স্বামী বিদ্যমান থাকায় বিবাহ হয়ে থাকে।
(৬) যদি নিষিদ্ধ নিকট আত্মীয়ের মধ্যে বিবাহ হয়ে থাকে।
এ ছাড়া নিম্নলিখিত কারণগুলির মধ্যে যে কোন একটি কারণ দেখাতে পারলে আদালত বিবাহ-বিচ্ছেদেরও আদেশ দিতে পারে—
(১) স্বামী বা স্ত্রী কেউ যদি ব্যভিচারে লিপ্ত হয়।
(২) ধর্মান্তর গ্রহণের ফলে যদি আর হিন্দু না থাকে।
(৩) আদালতের কাছে বিবাহ ভঙ্গের জন্য দরখাস্ত করবার পূর্বে ক্রমান্বয়ে তিন বৎসর স্বামী কী স্ত্রী কেউ যদি বিকৃত মস্তিষ্ক হয়।
(৪) ওইরকম তিন বৎসরকাল যদি স্বামী কী স্ত্রী অনারোগ্য কুষ্ঠব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে থাকে।
(৫) ওইরকম তিন বৎসরকাল স্বামী কী স্ত্রী যদি কোন সংক্রামক যৌনব্যাধিতে আক্রান্ত হয়।
(৬) স্বামী কী স্ত্রীর কেউ যদি কোন ধর্মসম্প্রদায়ে যোগদান করে বা সংসার ত্যাগ করে।
(৭) স্বামী কী স্ত্রীর মধ্যে কেউ যদি ক্রমান্বয়ে সাত বৎসর নিরুদিষ্ট থাকে।
(৮) যেখানে জুডিসিয়াল সেপারেশনের ডিক্রীর পর উভয়পক্ষ আর স্বামী-স্ত্রীরূপে সহবাস করে নি।
(৯) যদি রেষ্টিটিউশন অভ কনজুগাল রাইটস্-এর ডিক্ৰী হবার পর কোন একপক্ষ সেই ডিক্ৰী অমান্ত করে অপর পক্ষ থেকে ক্রমান্বয়ে দু বৎসর পৃথক বসবাস করে থাকে।
এছাড়া আরও দু’ কারণে স্ত্রী আদালতের কাছে বিবাহ-বিচ্ছেদের জন্য প্রার্থনা করতে পারে। এ ছটি কারণের প্রথমটি হচ্ছে—যদি এক স্ত্রী বিদ্যমান থাকতে স্বামী অন্ত স্ত্রী গ্রহণ করে থাকে এবং আদালতে প্রার্থনা করবার সময় সে স্ত্রী জীবিত থাকে। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে—স্বামী যদি বলাৎকরণ, পুংমৈথুন বা কোনরূপ অস্বাভাবিক যৌনকর্মে লিপ্ত হয়ে থাকে। ১৯৫৫ সালের এই আইন সম্পর্কে তিনটি কথা বলা প্রয়োজন। প্রথম, বিবাহ সিদ্ধ হবার সময় থেকে তিন বছরের পূর্বে কোন পক্ষ আদালতে বিবাহবিচ্ছেদের কোন দরখাস্ত করতে পারবে না । দ্বিতীয়, আদালত কর্তৃক বিবাহ-বিচ্ছেদের নির্দেশ দেবার পর যদি তার বিপক্ষে কোন আপীল না করা হয়ে থাকে তাহলে এক বছর অপেক্ষা করে উভয়পক্ষই পুনরায় বিবাহ করতে পারে (যদি বিবাহ না করে তাহলে আদালত খোরপোশ দেবার দাবী গ্রাহ করতে পারে ) এবং তৃতীয়, আদালত কর্তৃক বিবাহ-বিচ্ছেদের নির্দেশ দেওয়া সত্বেও ওই নির্দেশের পূর্বে স্ত্রী যে সস্তান গর্ভে ধারণ করছে সে সস্তান বৈধ বলে গণ্য হবে।
বলাবাহুল্য, এসকল আইন প্রণয়নের ফলে হিন্দুবিবাহ যে মাত্র গণতান্ত্রিকতা লাভ করেছে তা নয়, হিন্দুবিবাহ নূতন মর্যাদা পেয়েছে। বিবাহিত হিন্দু নারী আজ সামাজিক বা পারিবারিক নিষ্ঠুরতা ও অবিচারের হাত থেৱে নিস্কৃতি লাভ করেছে। আজ সে শিক্ষা পেয়েছে ; আজ সে স্বাধীনতা পেয়েছে ; আজ সে পুরুষের সঙ্গে সমান পদক্ষেপ ফেলে জীবনযাত্রার পথে অগ্রসর হবার সাহস ও সুযোগ পেয়েছে। অাজ সে স্মৃতিকারদের নাগপাশ থেকে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করেছে। আজ স্মৃতিকারদের স্থান গ্রহণ করেছে বিধান সভার সদস্যরা । তাদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন যার স্মৃতিকারদের ভাষায় “অন্ত্যজ” জাতিভুক্ত। একমাত্র গণতান্ত্রিক প্রভাবেই এই যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটেছে।