দ্বাদশ অধ্যায় – বিজ্ঞান চেতনায় ধর্ম ও ধর্মের ভবিষ্যৎ (Religion is the Thinking of Science & Future of Religion)
ধর্ম ও বিজ্ঞানে বৈপরীত্য ও সমন্বয়
যুক্তির চেয়ে যাদের কাছে বিশ্বাস অনেক বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ তাদের দৃষ্টিতে ধর্ম ও বিজ্ঞানে কোন বিরোধ নেই। কারণ বিশ্বাসের পরিপন্থি কোন যুক্তির আবেদন তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য করা প্রায় অসম্ভব। এই সব অবিচল বিশ্বাসীদের কাছে ধর্মের বিজ্ঞানবোধ, দর্শনবোধ, সংস্কৃতিবোধ, নৈতিকতাবোধ প্রকারন্তরে নিজ বিশ্বাসবোধে রূপান্তরিত হয়। এরা যদিও যুক্তির ভিত্তিতে সত্যকে পেতে চান সেখানেও তারা বিশ্বাসের বলয়ের বাইরে কিছু গ্রহণ করতে রাজি নন। এরা বিশ্বাস করে বলেই যুক্তি জুটিয়ে আনে। ফলে এরা দাবি করে বিজ্ঞান ধর্মের কাছে ঋণী। আমাদের বৈজ্ঞানিক চেতনা প্রায়শই অবৈজ্ঞানিক ও মৌলবাদী প্রবণতা দ্বারা আচ্ছন্ন। এগুলো বিজ্ঞানমনস্কতা এবং যৌক্তিক চিন্তার ক্ষেত্রে গভীর সংকটের জন্ম দেয়। এই সংকট অনেক যৌক্তিক মানুষের মধ্যেও স্ববিরোধিতা এবং বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। বৈজ্ঞানিক চেতনার এসব সংকট এবং বিজ্ঞানে সত্যের অবৈজ্ঞানিক ব্যবহারের বিচিত্র পথ ও পদ্ধতির স্বরূপ উন্মোচন করা এই অধ্যায়ের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। বিজ্ঞানের মৌলবাদী ব্যবহার এখন নিত্য নতুন যুক্তিতে ও অবয়বে ব্যবহৃত হচ্ছে। এইসব মৌলবাদী যুক্তির বহু প্রবক্তা এখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিনিয়ত প্রচারিত হচ্ছে মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের নানা কলাকৌশলী ও চাতুর্যপূর্ণ ধোঁকাবাজি। এরা যুক্তি দেখায়— ১. অধুনা প্রচলিত দূর পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের ধারণা এসেছে হিন্দু ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত বিভিন্ন ধরনের ‘বাণ’-এর ধারণা থেকে। ২. ‘বোরা’কে চড়ে ‘মেরাজে’ যাত্রা কিংবা দেবতাদের রথে (পুষ্পক রথ) চড়ে শূন্য ভ্রমণ থেকে এসেছে নভোযান বা উড়োজাহাজের ধারণা। ৩. হনুমানের গন্ধমাদন পর্বত বহন থেকে ক্রেনের ধারণা। ৪. শিবের হলাহল (বিষ) ) হজম করা থেকে বিষয় (antidote) সম্পর্কে ধারণা। ৫. গণেশের মাথায় হাতির মস্তক লাগানো থেকে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের (organ transplantation) ধারণা। আবাবিল পাখির পাথর বর্ষণ থেকে বিমান যুদ্ধের ধারণা ইত্যাদি।[৩০] এসব প্রচলিত বিশ্বাস, ধর্মগ্রন্থ ও মহাপুরুষদের ‘ঐশীত্ব’ প্রমাণে বিজ্ঞানের বিভ্রান্তিমূলক অপপ্রয়োগ করে এরা প্রমাণ করতে চায় ধর্মে ও বিজ্ঞানে কোন বিরোধ বা বৈপরীত্য নেই। এসব বিরোধ মীমাংসাকারীদের মধ্যে হাল আমলের মরিস বুকাইলি, আহমেদ দিদাত, ডা. জাকির নায়েক, মহাজাতক, সাঁই বাবা, শঙ্কর বাবা, ড. শমসের আলীসহ বহু স্বামী-গোস্বামীর নাম স্মরণীয় ও জনপ্রিয়। এঁরা যা বলেন, প্রকৃত সত্য কী তাই? তাহলে প্রকৃত সত্য কী? গোঁজামিলের দৌঢ় কতদূর?
[৩০. এছাড়াও আজকাল গাছের ডালপালায় ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ আকৃতি ধারণ, সমুদ্রের ঢেউয়ে আরবি অক্ষরে ‘আল্লাহ’ লেখা ফুটে ওঠা, মাছের লেজে ‘আল্লাহু আকবর’ লেখা দেখতে পাওয়া, মৌচাক, ডিম, আলু, গোশত, টমেটো ইত্যাদিতে ‘আল্লাহ’ লেখা অংকিত পাওয়া, অগ্নিদগ্ধ বাড়িঘরে কোরআন অক্ষত থাকা, ভূমিষ্ঠের পর শিশুর আল্লাহ আল্লাহ ডাক, মানুষের ফুসফুসে কলেমার নক্সা ইত্যাদি বহু বিচিত্ৰ অলৌকিক সংবাদ খবরের কাগজে ছাপা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এই তথ্যগুলি এখন বেশি পাওয়া যাচ্ছে। ফেসবুকের অপপ্রয়োগে অতিষ্ঠ হয়ে এর প্রতিষ্ঠাতা জাকারবার্গ কিছুদিন আগে এক সাক্ষাৎকারে বললেন : ‘ফেসবুক আবিষ্কার আমার জীবনের একটা বড় ভুল।’ নীল আর্মস্ট্রং বহুদিন পর তাঁর চন্দ্রাভিযানের অভিজ্ঞতা বর্ণনা দিতে গিয়ে জানালেন যে, তিনি চাঁদকে দ্বিখণ্ডিত অবস্থায় দেখেছেন, ঠিক হজরত মহম্মদ (সা.) যেভাবে তাঁর আঙ্গুলের ইশারায় দ্বিখণ্ডিত করেছিলেন। তিনি তাঁর চন্দ্রাভিযাপন সম্পর্কে আরো চমকপ্রদ তথ্য দেন। আর্মস্ট্রং বলেন, ‘যে সময় চন্দ্রযান ছাড়বে, ঐসময় খ্রিষ্টান ধর্মের নামকরা ও মান্যবর প্রাদ্রীগণ নিজেরা এসে আমাদের সবাইকে পৃথকভাবে নিয়ে আস্তে আস্তে বললেন, চন্দ্রযানে সবদেশের পতাকা নিও কিন্তু সৌদি আরবের পতাকা নিও না। কেননা তারা অখ্রিষ্টান, চাঁদে গেলে যদি বিস্ময়কর কিছু শোন ও দেখ, তবে তা অন্যথা মনে করবে এবং মনে মনে যিশুর ও মেরির নাম উচ্চারণ করবে। ভিন্ন জাতীয় স্বর শুনলে তা টেপ কর না যেন’ ইত্যাদি। আর্মস্ট্রং বলেন, বড় বড় ধর্মযাজকের কথায় আমার সৌদি আরব ও মুসলমানদের প্রতি দুর্বলতা ও কৌতুহল জেগেছিল। আমার সঙ্গীরা এ সবের গুরুত্ব দেননি। কেননা তারা ধর্ম জ্ঞানে ছিলেন উদাসীন। আমি আঙ্গুলে ও বোতামে ধারণযোগ্য ছোট ক্যাসেট সঙ্গে নিলাম।
চন্দ্রযান স্টার্ট দেয়ার সময় সব দেশের পতাকা আমার সঙ্গে নিলাম কেবল মাত্র সৌদির পতাকা নিলাম না। তার ফল হল চন্দ্রযান কিছুতেই স্টার্ট নিল না। অথচ কোথাও কোনও ত্রুটি নেই। পরে সৌদি পতাকা সঙ্গে নিলাম। সঙ্গে সঙ্গে চন্দ্রযান স্টার্ট হল। এতে করে ধর্মযাজকেরা লজ্জিত হল। তখন আমি খুব অভিভূত হলাম। সৌদি পতাকাতে ছিল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসূলূল্লাহ’-এর ক্যালিওগ্রাফি। এ কলেমা শরিফ থাকাতে পাদ্রীগণ বুঝতে পেরেছিল যে, এ কলেমার প্রভাবে চাঁদে যাবে। বাস্তবে তাই হয়েছিল। দেখা গেল চাঁদে সর্বত্র কালেমা শরিফের ক্যালিওগ্রাফি ভেসে বেড়াচ্ছে এবং আজানের সুরে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে আল্লাহর মহিমা। আমি ক্যালিওগ্রাফি শিল্পকর্মের মাধ্যমে বিষয়টিকে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি।’ (ইন্দোনেশিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তা বাশারত কর্তৃক গৃহীত সাক্ষাৎকার, ২০০8 )।]
সব ধর্মেরই একটি বড় অংশজুড়ে থাকে বিশ্বজগতের উৎপত্তি এবং রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত ব্যাখ্যা, সেটি তার পৌরাণিক অংশ। জগতের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক বোঝার জন্য সৃষ্টিস্থিতি প্রলয়ের ব্যাখ্যা মানুষের পক্ষে জরুরি। যখন জগৎ সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য সংগৃহীত হয়নি এবং কাল্পনিক ব্যাখ্যাকে যাচাই করে নেয়ার চিন্তাপদ্ধতি, ভাষা সাধিত্র প্রভৃতি উদ্ভাবিত হয়নি, তখন পৌরাণিক ব্যাখ্যার ভেতর দিয়েই মানুষের জ্ঞানান্বেষণ ও যুক্তিশীলতা প্রকাশ পেয়েছিল। কিন্তু বৈজ্ঞানিক চিন্তার উদ্ভব ও বিকাশ পৌরাণিক ব্যাখ্যার ভেতর দিয়েই মানুষের জ্ঞানান্বেষণ ও যুক্তিশীলতা প্রকাশ পেয়েছিল। কিন্তু বৈজ্ঞানিক চিন্তার উদ্ভব ও বিকাশ পৌরাণিক ব্যাখ্যাকে কালবিরুদ্ধ করে। ধর্ম যে ব্যাখ্যা দেয় সেটিকে ধর্মবিশ্বাসীরা মনে করেন প্রশ্নাতীত, প্রমাণো, নিত্য। পুরুষের মুখ থেকে ব্রাহ্মণ বেরিয়েছিল কিংবা যিহোবা ছয় দিনে বিশ্বজগৎ রচনা করেছিলেন, এসব কল্পকাহিনীকে বিশ্বাসীরা চিরন্তন সত্য বলে মনে করেন এবং কেউ সে সম্পর্কে সংশয়ী হলে তাকে ঐহিক এবং পারলৌকিক, সামাজিক এবং দৈহিক শাস্তির ভয় দেখান। অপরপক্ষে বৈজ্ঞানিককে বিস্তর অধ্যবসায় করে তথ্য সংগ্রহ করতে হয় এবং কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাই চরম সত্য বলে উপস্থাপিত হতে পারে না। তথ্য এবং যুক্তির প্রতি নিষ্ঠা বৈজ্ঞানিককে বিস্তর অধ্যবসায় করে তথ্য সংগ্রহ করতে হয় এবং কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাই চরম সত্য বলে উপস্থাপিত হতে পারে না। তথ্য এবং যুক্তির প্রতি নিষ্ঠা বৈজ্ঞানিকের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। যে ব্যাখ্যা তিনি উপস্থাপিত করেন বা গ্রহণ করেন তা যে পরে ভ্রান্ত বা অসম্পূর্ণ বলে প্রমাণিত হতে পারে এ সম্পর্কে সচেতনতা তাঁর সত্যানুসন্ধানেরই অঙ্গ। এই কারণে ধার্মিক ব্যাখ্যার পেছনে যে মনোভাব আর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার পেছনে যে মনোভাব এই দুইয়ের মধ্যে রফা সম্ভব নয়। ধর্মবিশ্বাসীরা বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসাকে দমন করার চেষ্টা আগাগোড়াই করে এসেছেন এবং যেখানে তাঁদের হাতে দমন করবার ক্ষমতা নেই সেখানে বৈজ্ঞানিক চিন্তাকে আধ্যাত্মিক প্রলেপ দিয়ে ঝাপসা করার চেষ্টা করেছেন।
বৈজ্ঞানিক মনোভাবের বিকাশের জন্য যে মানসিক বয়ঃপ্রাপ্তি এবং নিত্যজাগ্রত প্রশ্নশীলতা প্রয়োজন, অধিকাংশ মানুষের মধ্যে এখনো তা গড়ে ওঠেনি। অধিকাংশ স্ত্রী-পুরুষ এখনো পর্যন্ত আদিম মানুষ এবং শিশুর মত নিশ্চিত চরম উত্তর চায়— শিশুরা ভাবে এটি তাদের মা-বাবা দিতে পারে, বয়স্ক শিশুরা ভাবে এটি দিতে পারে পুরাণ কাহিনী, ধর্মগুরু, সাধুসন্ত। বৈজ্ঞানিক জানেন তথ্যনির্ভর সব উত্তরই আংশিক এবং শর্তাধীন কোন ব্যাখ্যাই বিচাররোর্ধ্ব বা অপরিবর্তনীয় নয়। প্রশ্ন যেখানে সীমাবদ্ধ, খণ্ডিত, সুনির্দিষ্ট সেখানে তার নির্ভরযোগ্য উত্তর সম্ভব (যেমন ম্যালেরিয়া, মহামারি প্রভৃতি ব্যাধির কারণ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে); কিন্তু যেখানে সে প্রশ্ন বহুমুখী ও ব্যাপক সেখানে তথ্য সংগ্রহে, ব্যাখ্যায়, প্রমাণে ত্রুটি বা অসম্পূর্ণতা থাকতেই পারে। বৈজ্ঞানিক সে কথা ভেবে ছাত্রদের স্তোভ দেয়ার জন্য ব্রহ্মজ্ঞতা দাবি করেন না, অপরপক্ষে চরম উত্তম অপ্রাপ্য বলে তিনি মন এবং হাত গুটিয়েও বসে থাকেন না। উপযোগী তথ্যসংগ্রহে, বিষয়মুখিতার অনুশীলনে, ধারণা এবং সাধিত্রের সূক্ষ্মতাসাধনে, প্রকল্পের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তিনি নিজেকে নিয়ত নিয়োজিত রাখেন এবং অপর বৈজ্ঞানিকদের বক্তব্য ও সমালোচনা বিশেষ যত্নের সঙ্গে অনুধাবন করেন। ধার্মিকরা তাঁদের বিশ্বাসাদি বিচারোর্ধ্ব ও অপরিবর্তনীয় মনে করার ফলে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে একত্র হয়ে পরস্পরের ধর্ম নিয়ে চর্চার উদাহরণ ক্বচিৎ চোখে পড়ে এবং ইতিহাসে ধর্মযুদ্ধের ভয়ংকরতাই অনেক বেশি প্রাবল্য বারবার দেখা যায়। অপরপক্ষে বৈজ্ঞানিকরা পরস্পরের যুক্তি, তথ্য প্রমাণাদি বিচার করে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মতৈক্যে পৌঁছতে পারেন এবং তাঁদের বিভিন্ন প্রকল্প ও ব্যাখ্যা ক্রমেই অধিকতর নির্ভরযোগ্যতা ও সর্বজনগ্রাহ্যতা অর্জন করে। প্রকৃত শিক্ষার সূত্রে বৈজ্ঞানিকতার এই মনোভাবের প্রসারের ফলে যখন পৃথিবীর অধিকাংশ স্ত্রী-পুরুষ বৌদ্ধিক বয়ঃপ্রাপ্তি লাভ করবে তখন জ্ঞানের দিক থেকে ধর্মীয় ব্যাখ্যা কালবিরুদ্ধতা তাদের কাছে সহজেই ধরা পড়বে। তবে এ কথাও সত্য ধর্মবাণীর আক্ষরিক অর্থ অনুসরণই অজ্ঞতা, আর সেই অজ্ঞতাকে বিজ্ঞান বলে চালিয়ে দেয়া মূর্খতা। স্মরণ রাখা প্রয়োজন, বিজ্ঞান (বিশেষ জ্ঞান ) অভিজ্ঞতাভিত্তিক কিন্তু ধর্ম বিশ্বাসভিত্তিক। যেমন পরকাল আমাদের অভিজ্ঞতার বাইরের ব্যাপার— এটি বিশ্বাসভিত্তিক।
বৈদিক ধর্ম ও বিজ্ঞান
সাংখ্য দর্শনে বর্ণিত সৃষ্টির ক্রম অনুসারে যখন প্রকৃতি সাম্যাবস্থা হতে বিষমতায় পরিণত হয় এবং ক্রমশ সূক্ষ্ম ভূত সকলেরই উৎপত্তির পর স্থলভূত সকলের উৎপত্তি আরম্ভ হয়ে অগ্নি পর্যন্ত উৎপন্ন হয়, এর পর নেবুলার থিওরির আরম্ভ। নেবুলার থিওরির আদিম মূল যে নেবুলা (নীহারিকা), তা আকাশ, বায়ু ও অগ্নি— এই তিন ভূতের সংঘাতে উৎপন্ন। এর থেকে জল এবং পৃথিবীর উৎপত্তি; এটি ভিন্ন সূর্যাদির উৎপত্তি সম্বন্ধে নেবুলার থিওরির মত বৈদিক জগতোৎপত্তিবাদের অনুকূল। নেবুলার থিওরির আবিষ্কার জানতেন না যে, নেবুলা কী প্রকারে উৎপন্ন হয়েছে, তিনি এও জানতেন না যে, লোক লোকান্তরের উৎপত্তির পর প্রাণিদের উৎপত্তি কীভাবে হয়েছে পরন্ত বেদ এবং আর্যগ্রন্থে এসব বিষয়ে সবিস্তারে বর্ণনা আছে (জগতের উৎপত্তি ও নেবুলার থিওরি, পৃ. ৭৬)। পৃথিবী যে গোলাকার একথা সর্বপ্রথম বলেন ভারতীয় ঋষি ভাস্কারাচার্য। তিনিই প্রথম বলেন সূর্য স্থির থাকে কিন্তু পৃথিবী সূর্যকে নিয়ে ঘোরে। আইজাক নিউটনের ৫০০ বছর পূর্বে ভাস্কারাচার্যই প্রথম মহাকর্ষ শক্তি আবিষ্কার করেন। সূর্যসিদ্ধান্ত গ্রন্থে মহাকর্ষ শক্তি বিষয়ে একটি সূত্রের প্রবর্তক তিনি। ঋষি ভাস্কারাচার্যই প্রথম বলেন, ‘পৃথিবীর আকর্ষণই শক্তির কারণেই বস্তু পৃথিবীতে পতিত হয়। তাই এই আকর্ষণের কারণে পৃথিবী, গ্রহ, নক্ষত্র চাঁদ ও সূর্য কক্ষপথে অবস্থান করে।’
হিন্দু শাস্ত্রকাররা আরো দাবি করেন পৃথিবীতে প্রথম সংগীতের উদ্ভব সামবেদ থেকে। সাম্ শব্দের অর্থ সংগীত। সামবেদের সূক্তগুলো লেখা হয়েছিল গানের ছন্দে এবং গানে গানে মন্ত্রগুলো উচ্চারিত হত। পৃথিবীতে প্রথম অংক শাস্ত্রের উদ্ভাবকও ভারতীয় ঋষি। ভারতীয় ঋষি ভাস্কারাচার্য (জ. ১১১৪ খ্রি.) প্রথম অংক শাস্ত্রের বিশদ ব্যাখ্যা দেন। জন্ম তাঁর মহারাষ্ট্রের ভিজ্জাদ গ্রামে। পাটিগণিত, বীজগণিত এবং জ্যামিতিতে তাঁর কর্ম তাঁকে অমরত্বে স্থান দিয়েছে। লীলাবতী ও বীজগণিত নামে তাঁর বিখ্যাত গাণিতিক কর্মকে অতুলনীয় ও প্রসিদ্ধ জ্ঞানের স্বাক্ষর হিসেবে গণ্য করা হয়।
এছাড়াও পৃথিবীতে প্রথম অর্থশাস্ত্রের উদ্ভাবকও ভারতীয় ঋষি চাণক্য পণ্ডিত। যেটি চাণক্যের অর্থশাস্ত্র নামে পরিচিত। পৃথিবীতে প্রথম চিকিৎসা শাস্ত্রের উদ্ভব ভারতে। এই শাস্ত্রের নাম আয়ুর্বেদ। পৃথিবী যে গোলাকার তাও প্রথম সিদ্ধান্ত ভারতীয় ঋষি ভাস্করাচার্যের। শূন্যের উদ্ভাবকও ভারতীয় পণ্ডিত আর্যভট্ট। তিনি খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে মহা সিদ্ধান্ত নামক গ্রন্থে প্রথম শূন্যের ব্যবহার তুলে ধরেন।
অণু ও পরমাণুতত্ত্বের প্রবর্তকও ভারতীয়। আচার্য কণাদ খ্রিষ্টীয় ৬০০ অব্দে ‘করণ ও পরমাণু’ তত্ত্বের প্রবর্তন করেন। তিনি বলেন যে, সকল বস্তু নয়টি উপাদান নিয়ে গঠিত। উপাদানগুলো হল— মাটি, জল, আলো, বাতাস, আকাশ (শূন্য), সময় স্থান, মন ও আত্মা। তাঁর মতে, সৃষ্টির প্রতিটি বস্তু পরমাণু নামক কণা দ্বারা গঠিত, আবার পরমাণু মিলে গঠিত হয় অণু। তাঁর বিবৃতিতেই প্রথম পারমাণবিক তত্ত্বের ধারণা পাওয়া যায়। তিনি জন ডাল্টনের ২৫০০ বছর আগে প্রথম পরমাণু, রাসায়নিক বিক্রিয়া ও পরমাণুর গতি সম্পর্কে ধারণা দেন। পৃথিবীর ও গ্রহসমূহের গতি ও মধ্যাকর্ষণ শক্তি সম্পর্কে প্রথম উল্লেখিত হয় বেদ গ্রন্থে। স্যার আইজাক নিউটন ও অন্যান্য অনেক বিজ্ঞানীদের কল্যাণে আজ এ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত যে ‘পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহসমূহ সূর্যকে কেন্দ্র করে একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘোরে। কিন্তু এর হাজার হাজার বছর আগে পৃথিবীর প্রাচীনতম ধর্মগ্রন্থ বেদ এই সম্পর্কে উল্লেখ করে :
‘অহস্ত যদপদি (যদ-অপদি) বরধত খ শচীবিরবেদ্যানাম।
সুষমপরি প্রদক্ষিণিং বিশ্যব্যে নিম্নিথা।।
(ঋগবেদ ১০.২২.18 )
অর্থাৎ পৃথিবীর নেই হস্ত বা পদ, তবুও তা গতিশীল। এর উপর অবস্থিত বস্তুসমূহ ও এরই সাথে গতিশীল। এটি সূর্যের চারদিকে ঘূর্ণায়মান।
অন্য একটি সূক্তে আছে : সবিতা যন্ত্ৰেহ পৃথিবী— মরামদক্ষস্থলে (পৃথিবী- অরামদ) সবিতাদ্যমধত (দ্যম অধ্যত)।
অশ্বমিবাদুক্ষদ (অশ্বন-ইব-অধুক্ষ ত)
ধুনমি অন্তরীক্ষ মতুরতেবাধয় সবিতা সমুদ্রম।।
(ঋগবেদ ১০.১৪৯.১)
অর্থাৎ সূর্য তার পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহসমূহকে তার আকর্ষণশক্তির সাহায্যে বেঁধে রেখেছে। এটার চারপাশে সেগুলো ঘূর্ণায়মান ঠিক যেমন প্রশিক্ষক এর চারপাশে প্রশিক্ষণরত অশ্ব বলগা দিয়ে ঘোরে।
ঋগ্বেদে আরো বলা হয়েছে, ‘হে ঈশ্বর, তোমার শক্তিবলে যাতে রয়েছে আকর্ষণ এবং গতি ক্ষমতা, তার মাধ্যমে তুমি সারা জগতে রেখেছ ভারসাম্যপূর্ণ।
(ঋগবেদ ৮.১২.২৮ )
‘হিরস্যপানি সবিতা বিকারসভির উভে দ্যবা পৃথিবী অন্তর ইযতে। অপরিবাম বাধাতে যেতিসূর্যম অভি কম্মেন রাজম ধ্যম যোতি।’
(ঋগবেদ ৮.১২.২৮)
অর্থাৎ সূর্য নিজ পথে ঘোরে এবং পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহসমূহকে আকর্ষণশক্তি দ্বারা এমন উপায়ে চালিত করে যাতে তাদের একে অপরের সাথে সংঘর্ষ না করে।
‘সূর্য ঘুরছে তার নিজ কক্ষপথে সাথে নিয়ে সকল গ্রহকে আকর্ষণশক্তির বলে।’
(যজুর্বেদ ৩৩.৪৩)
‘সূর্য ঘোরে তার নিজ কক্ষপথে এবং এর আকর্ষণশক্তি প্রভাবে অন্যান্য গ্রহসমূহ ও ঘোরে কারণ সূর্য তাদের তুলনায় অধিক ভারী (মহাকর্ষ এর উপর ভর-শক্তি সমীকরণ এর প্রভাব)।’
(ঋগবেদ ১.১৬৪.13)
এমনকি আণবিক বোমার বৈজ্ঞানিক সূত্র অনুসন্ধানও পাওয়া গেছে ভারতীয় শাস্ত্রে। আমেরিকার বিশিষ্ট তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞানী ও আণবিক বোমার জনক জুলিয়াস রবার্ট ওপেনহাইমার দ্বিতীয় বিশ্ব বিশ্বযুদ্ধকালীন ম্যানহাটন প্রকল্পের সাহায্যে প্রথম আনবিক বোমা আবিষ্কারের জন্য এনরিকে ফার্মির পাশাপাশি তাঁকেও আণবিক বোমার জনকরূপে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। ৬ জুলাই, ১৯৪৫ তারিখে নিউ মেক্সিকোতে ট্রিনিটি টেস্ট নামে পরিচিত প্রথম আণবিক বোমার সফল পরীক্ষামূলক পর্যায়ের পর ওপেনহাইমার দ্বিতীয় বিশ্ব বিশ্বযুদ্ধকালীন ম্যানহাটন প্রকল্পের সাহায্যে প্রথম আনবিক বোমা আবিষ্কারের জন্য এনরিকে ফার্মির পাশাপাশি তাঁকেও আণবিক বোমার জনকরূপে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। ওপেনহাইমার পবিত্র ধর্মগ্রন্থ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিলেন — “এখন আমি মৃত্যুর কারণ হতে পারি বিশ্বকে ধ্বংস করে দিতে পারি।’
মহাপ্রলয় সম্বন্ধে বৈদিক সিদ্ধান্ত
বৈদিক মহাপ্রলয়বাদের তাৎপর্য এই যে, প্রকৃতি বিষমতা ত্যাগ করে পুনরায় সাম্যাবস্থা প্রাপ্ত হয় এবং এই অবস্থায় সূর্য হতে তৃণ পর্যন্ত কোন বস্তুরই সত্ত্বা থাকে না। সমস্তই কারণ রূপ প্রকৃতিতে বিলীন হয়ে যায়। ক্লাসিয়াস তাঁর তাপ সিদ্ধান্তে দেখিয়েছেন যে, তাপ দুই প্রকারের। (প্রথমত) যে তাপশক্তি জগতে বিদ্যমান থেকে ক্রমাগত কাজে প্রযুক্ত হচ্ছে, যে তাপশক্তি জগতের অভ্যন্তরে প্রবিষ্ট এবং জগতের কাজ সম্বন্ধে যার অস্তিত্ব নাই বললেও চলে। কারণ এই দ্বিতীয় প্রকার তাপ দ্বারা জগতের কোন কাজই সাধিত হয় না। যে পরিমাণে প্রথমোক্ত তাপশক্তি ব্যয়িত হচ্ছে সে পরিমাণে দ্বিতীয় তাপ (শক্তি) ক্ষয় হচ্ছে অর্থাৎ কাজে প্রযুক্ত তাপ বা শক্তি ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। এইভাবে জগতের আগ্নেয় শক্তি ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। যখন আগ্নেয় শক্তি হ্রাস পেতে পেতে শূন্যাবস্থায় পর্যবসিত হবে তখন জগৎ গতিশূন্য হবে। এটাই মহাপ্রলয়। সাংখ্য দর্শনে সমর্থনকারিদের দাবি ভৌতিক বিজ্ঞান বৈদিক মহাপ্রলয়বাদকে সমর্থন করে। এরা আরও দাবি করে, মহাপ্রলয় উপস্থিত হবার পর, এবং ক্লাসিয়াসের মতানুসারে প্রকৃতি গতিশূন্য হয়ে পড়বার পর, গতিহীন জগতের পুনরায় উৎপত্তি হওয়া কী করে সম্ভব? এদের মূল বক্তব্য, জগতের পুনরুৎপত্তি স্বীকার করলে, গতিদাতাকে স্বীকার করতে হবে। অর্থাৎ বিজ্ঞান ঈশ্বরের সত্তা মানতে বাধ্য। যেহেতু যজুর্ব্বেদে আছে— ‘তদেজতি তন্নেজতি’। অর্থাৎ তিনি (ঈশ্বর) গতিদান করেন পরন্ত স্বয়ং গতিশীল হন না। (যজুর্ব্বেদ, অধ্যায় ৪০ মন্ত্র ৫)। এদের দাবি, ক্লাসিয়াসের এই তাপসিদ্ধান্ত শুরু যে, বৈদিক মহাপ্রলয়বাদেরই সমর্থক তা নয়, এই থিওরি অনুযায়ী জগতের গতিদাতাকে অর্থাৎ ঈশ্বরকে মানুষ মানতে বাধ্য।
বেদজ্ঞদের দাবি বিজ্ঞানের প্রসিদ্ধ ‘প্রকৃতিস্থিতিনিয়ম’ (প্রকৃতির রক্ষণশীলতা Law of Congervation of Matter-এর তাৎপর্য এই যে, প্রকৃতির একটি পরমাণুও নষ্ট হয় না, সমস্তই সুরক্ষিত থাকে। বৈদিকরা এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার সপক্ষে জার্মান বিজ্ঞানী আরনেস্ট হেকেল প্রদত্ত ‘প্রকৃতি তত্ত্ব’ এর ব্যাখ্যায় দাবি করেন : তিনি শুধু প্রকৃতিকেই নিত্য বলেন না, পরন্ত তিনি জগতেই স্পষ্টশব্দে নিত্য বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন (Ernest Haecl, Riddle of the Universe, P. 11 )।
জীবাত্মা সম্বন্ধে বৈদিক সিদ্ধান্ত
বেদবাদীরা বলেন, যদিও জীবাত্মার সত্তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ আছে, তথাপি উচ্চশ্রেণির বিজ্ঞানী কেবল জীবের সত্তাই নয়, অধিকন্তু তা নিত্যত্ব ও স্বীকার করে। এসব মতের সপক্ষে যেসব বিজ্ঞানীদের সমর্থন হাজির করেন তাদের মধ্যে স্যার অলিভার লজ, এ্যাডলফ হাকস্লি, জন স্টুয়ার্ট মিল ও প্রফেসর টেইট অন্যতম। স্যার অলিভার লজের মতে, ‘আমি বলতে শুধু শরীর বুঝায় না, মস্তিষ্ক চেতনাশক্তি এবং আত্মাও বুঝায়।’ কেউ কেউ বলেন যে, মস্তিষ্কই আত্মা। তাঁরা একথা বলেন কেন? এজন্য যে, যদি মস্তিষ্ক নষ্ট হয়ে যায় তবে আত্মাও চলে যায় বোধ হয়। মস্তিষ্কের নাশ হলেও তাতে আত্মা আর থাকে না, আবার তা (আত্মা) নষ্টও হয় না। এবং এও সত্য নয় যে, আত্মা শরীরে থাকে না। আত্মা শরীরেই থাকে, কিন্তু নিজেকে প্রকাশ করার সাধন মস্তিষ্ক নষ্ট হওয়ার প্রকট হতে পারে না। এটা বলা অনুচিত যে, শরীরের বিন্যাসের সঙ্গে সঙ্গে আত্মাও বিনষ্ট হয়। পৃথিবীতে যে কয়েক বৎসর বাস করি শুধু সেই কয় বৎসরই আমাদের (আত্মার) পরিমিত আয়ু নয়… এটা নিঃসন্দেহ যে, শরীরের বিন্যাসের পরেও আত্মার অবস্থিতি থাকে। (Science and Religion by Seven Men of Science p. 2০, 25 )।
প্রকৃতিবাদী হয়েও হাস্লি (Huxley) স্পষ্ট বলেছেন— ‘জীবন শরীর রচনার হেতু, তার পরিণাম নয়’ (Life is the cause and not the consequence of organisation)। হাসির এটি একটি আত্মদর্শন। জন স্টুয়ার্ট মিলের মতে, ‘আমাদের আত্মশক্তি প্রকৃতিকে (শরীরকে প্রভাবিত করে কর্ম সম্পন্ন করে। ডেকার্টের সিদ্ধান্ত যে, ‘আমি বিচার বিবেচনা করছি, অতএব আমি আছি’ (Cogito evgo sum— I think therefore I am)। অধ্যাপক টেইট (Prof. Tait) এর মতে, ‘নির্বর্ধশীলা (অবধ্যত্ব) অথবা সংরক্ষণ আত্মার প্রকৃত সত্তার প্রমাণ
বিজ্ঞানের সোপনুক্রম (Hierarchy of Science) তত্ত্বে কোঁতে বলেন, বিজ্ঞান কোন অভিযান নয়। এটা হল অসীম ও নির্দিষ্ট তৃষ্ণা। আর বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের মূলকথা হল সূত্র বা তত্ত্ব আবিষ্কার করা। চূড়ান্ত সত্য আবিষ্কার করা বিজ্ঞানের লক্ষ্য নয় এবং কোন বিজ্ঞান এটা মনেও করে না। বিজ্ঞানে শেষ বলে কোন কথা নেই। তবে সমাজবিজ্ঞানীদের দায়িত্ব হল নিয়মতান্ত্রিকভাবে সূত্র আবিষ্কারের চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। নিখিল বিশ্ব নিয়ে যারা গবেষণা করেন তারা মনে করেন যে, আজকে যেটা চিরসত্য আগামীকাল সেটার পরিবর্তন হতে পারে। এটা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যেমন সত্য, তেমনি সামাজিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও সত্য।
ওল্ড টেস্টামেন্ট অনুযায়ী ঈশ্বর সৃষ্টির মাত্র ছয় দিনের মধ্যে আদম এবং ইভকে সৃষ্টি করেছেন। সমগ্র আয়ারল্যান্ডের প্রধান ধর্মযাজক (খ্রি. ১৬২৫ থেকে খ্রি. ১৬৫০) বিশপ উশার (Bisshop Usser) আরও সঠিকভাবে সৃষ্টির মুহূর্তটি নির্ণয় করেন ৪০০৪ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ২৭ অক্টোবর সকাল ৯টায়। কিন্তু সাম্প্রতিকালের বিজ্ঞানীদের মত ভিন্ন। তাঁরা মনে করেন, মানব প্রজাতির সৃষ্টি সাম্প্রতিককালে, তবে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে বহু আগে, প্রায় ১৩.৫ বিলিয়ন বছর পূর্বে। (Stephen Hawking, The Grand Design)। মহাবিশ্বের যে একটি শুরু আছে তার প্রথম প্রকৃত বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আসে ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে। এক সময়ে বেশিরভাগ বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতেন যে মহাবিশ্ব স্থির এবং চিরকাল ধরেই আছে। এর বিপক্ষে ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে পরোক্ষ প্রমাণ আসে বিখ্যাত বিগ ব্যাং থিওরি উপস্থাপক (১৯২৫) ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্ট উইলসন অবজারবেটরির জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডউইন পি. হাবল (Edwin P. Hubble) -এর পর্যবেক্ষণ থেকে।
প্রকৃতির আচরণ সম্পর্কে অজ্ঞানতা থেকেই প্রাচীন মানুষের মধ্যে দেব দেবীর ধারণার সৃষ্টি হয়। প্রাচীন মানুষেরা মনে করত যে মানুষের জীবনের প্রতিটি দিক দেবতারা নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। প্রেম প্রীতি, যুদ্ধ এবং মহামারি, চন্দ্র ও সূর্য, আকাশ ও পৃথিবী, নদী ও সাগর, ভূমিকম্প এবং আগ্নেয়গিরি, বৃষ্টি ও বজ্রপাত ইত্যাদি সবের জন্য এক একজন দেবতা আছেন বলে তাদের বিশ্বাস ছিল। দেবতারা তুষ্ট থাকলে মানুষ শান্তিতে থাকত। আবহাওয়া ভালো থাকত, কোনরূপ প্রাকৃতিক অঘটন, রোগ মহামারি দেখা দিত না। কিন্তু দেবতারা রুষ্ট হলেই দেখা দিত খরা, মহামারি, যুদ্ধ বিগ্রহ। যেহেতু প্রকৃতির কার্যকারণ সম্পর্ক তাদের চোখে ধরা পড়ত না তাই এই সব দেবতাদের মনে হত দুৰ্জ্জেয়। মানুষ ছিল দেবতাদের অনুকম্পার পাত্র। তবে প্রায় ২৬০০ বছর আগে মাই লেটাসের থেলিস এর কাল (খ্রি. পূ. ৬২৪ খ্রি. পূর্ব. ৫৪৬ ) থেকে একটা পরিবর্তনের শুরু হল। ক্রমে এই ধারণার সৃষ্টি হল যে প্রকৃতি কতগুলি নির্দিষ্ট সুসংগত নিয়ম শৃঙ্খলার অধীন যার উদ্ঘাটন সম্ভব। এভাবেই শুরু হল দেবতা শাসিত বিশ্বের বদলে প্রাকৃতিক নিয়ম বিধি চালিত সুপরিকল্পিত বিশ্বের ধারণা। যে পরিকল্পনা মাফিক এই বিশ্বের সৃষ্টি হয়েছিল আমরা হয়ত একদিন বুঝতে পারব।
বিজ্ঞান চেতনায় ধর্ম
যে কারণে হিন্দু, বৌদ্ধ এবং কনফুসিয়াসবাদ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে উৎসাহিত করেনি সেই একই কারণে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিকেও তারা উৎসাহিত করেনি। তবে এর মধ্যে কিছুটা ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। যেমন প্রাচীন ভারতীয় পণ্ডিতরা ধর্মের তুলনামূলক অধ্যয়ন করতে গিয়ে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের চর্চা করত। আলকেমি ছিল বিজ্ঞান এবং জাদুর মাঝামাঝি একটি বিষয়, তত্ত্ববাদীরা এই বিদ্যাচর্চা করতে গিয়ে অনেক প্রায়োগিক পরীক্ষায় আশ্রয় নিত। তাছাড়া ধর্মের প্রভাব নিয়ে বা বাদ দিয়ে যাই হোক না অনেক প্রায়োগিক বিষয় আবিষ্কৃত হয় পরবর্তীকালে যেগুলোকে আরো উন্নীত করা হয়।
দেখা যায় যে, রাষ্ট্রে ধর্মের প্রভাব বেশি কিংবা কর্তৃপক্ষ ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করে সেখানে বিজ্ঞানচর্চার অবস্থা ছিল স্বভাবতই নেতিবাচক। বিজ্ঞান যেখানেই বিকশিত হয় সেখানে বিজ্ঞজনের পূর্বনির্ধারিত সত্য বলে মেনে নেওয়া মতবাদের জোয়ালে বন্দি নয়। তাই পশ্চিমা বিশ্ব আজও গ্রিকদের কাছে ঋণী। এইখানে জ্ঞানীদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ছিল। প্রায় যথার্থ বহির্বিশ্বের সংস্পর্শে এসে ক্যাথলিকবাদ দুর্বল হওয়ার পরই ইউরোপ রেনেসাঁ শক্তি অর্জন করে। মধ্যযুগে ক্যাথলিকবাদের বিজ্ঞান বিরোধিতা সর্বজনবিদিত। St. Bonaventure-এর বক্তব্যেই বিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞান সম্পর্কিত ক্যাথলিকবাদী মনোভাবের প্রতিফলন দেখা যায়। বিজ্ঞান এই চারা জীবনের অন্যান্য গাছগুলোর প্রচণ্ড ক্ষতিসাধন করেছে। কিংবা দোজকের দিকে ঠেলে দিয়েছে। (Merton, 1938, p. 433 )।
ধর্ম সবসময়ই বিজ্ঞানের বিরোধিতা করত না। ক্যালভিন পন্থিদের প্রচেষ্টাতেই যুক্তরাজ্যে সপ্তদশ শতাব্দীর ‘সোনালী যুগের’ সূচনা হয়। তারা বিভিন্ন লেখনি দ্বারা বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রাকে উৎসাহিত করেছিল। তারা বলত নিয়তি বলতে আত্মার স্বর্গীয় বা নরকীয় অবস্থান নির্ধারণ করা নয়। পৃথিবীতে সবকিছুই ঘটছে বিধাতার জ্ঞাতসারে, তবে ঘটনার পরিক্রয়ায় ঈশ্বর যখন তখন নাক গলায় না। Calvin নিজেও ইচ্ছার স্বাধীনতার প্রবক্তা ছিলেন, ঈশ্বর নিজে মানুষের অবস্থান সরাসরি জানার ইচ্ছা পোষণ করেন না, তবে সরাসরি জানতে পারে ঠিকই এবং তা জানতে পারে তার ছোট বড় নির্দেশনাসমূহের মাধ্যমে। বিদ্যাচর্চার মাধ্যমে মানুষ পক্ষান্তরে নিজের ধর্মদায়িত্বই পালন করে। তাছাড়া বিজ্ঞানচর্চার মাধ্যমেই মানুষ ঈশ্বরের রাজত্ব গড়তে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া বিজ্ঞানচর্চার মাধ্যমেই মানুষ ঈশ্বরের রাজত্ব গড়তে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। ঈশ্বরের রাজ্য প্রতিষ্ঠার এই কাজ তাকে করতে হবে বাস্তব জগতে, আশ্রমে থেকে নয়, কারণ প্রার্থনা আর যজ্ঞ দ্বারা পৃথিবীতে কোন পরিবর্তন আনা যাবে না। মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি অতি কল্যাণকর জিনিস, কারণ এর দ্বারা মানুষকে তার আবেগের লাগাম ধরে রাখতে সাহায্য করে এবং তর্কবিদ্যাচর্চার মাধ্যমেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না তাকে ঈশ্বরের সৃষ্টি নিয়েও প্রায়োগিক অধ্যয়ন করতে হবে। ক্যালভিনবাদীদের এই ধরনের লেখনি নিঃসন্দেহে বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে ধর্মের ইতিবাচক ভূমিকারই নামান্তর (Merton, 1933; Chaps 4, and 1949, Chap 14 )।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সমর্থনে এমন অন্যকোন ধর্মীয় বক্তব্য খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এসব বক্তব্যে বুদ্ধিবৃত্তিক এবং প্রায়োগিক বিদ্যাচর্চাকে ব্যক্তিগত এবং সামাজিক অভীষ্ট লক্ষ্যের মর্যাদা দেওয়া হয়। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের Puritanরা শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারসধান করে তাকে আরো প্রায়োগিক এবং বাস্তবমুখী রূপ দেয়। প্রখ্যাত ইংরেজ বিজ্ঞানীদের সংস্থা Royal Society-র অবস্থা ছিল নিম্নরূপ :
৬৮ জনের ৪২ জনই ছিল Puritan, যদিও জনসংখ্যার দিক থেকে বিবেচনা করলে তাদের সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য। তাই একটি বিজ্ঞানমুখী সংস্থার সদস্যদের ৬২ শতাংশ সদস্য puritan হওয়াটা সত্যিই অবাক করা (Merton, 1949, p. 338)।
এটা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে Puritanদের মধ্যে যারা বিজ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত ছিলেন ধর্মকে তারা তাদের কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়ার জন্য ব্যবহার করেননি। Puritan হওয়ার কারণেই তারা ছিলেন বিজ্ঞানমনস্ক। অনেক মহান বৈজ্ঞানিক এবং গণিত বিশারদ ছিলেন ধর্মযাজক। যেমন- Oughtred, Barrow, Wilkins, Ward, Ray, Grew প্রমুখ। রসায়নবিদ Boyle বাইবেলের অনুবাদের জন্য অনেক অর্থ ব্যয় করেন এবং মূল গ্রন্থ পড়ার জন্য তিনি গ্রিক, হিব্রু, সিরীয় এবং সালদীয় ভাষা শেখার মত কষ্ট স্বীকার করেন। প্রাণিবিদ Grew ও হিব্রু ভাষা শিখেন। গণিতবিদ Napier ছিলেন ধর্মতত্ত্বের ছাত্র। এদিকে মহান Newton ও বাইবেলের দ্বিতীয় ভাগের উপর বই লিখেছেন (Merton, 1938 p. 464-65) ।
লক্ষ্য রাখার বিষয় হচ্ছে যে, Calvin নিজে অর্থনীতির মত বিজ্ঞানের অগ্রগতির উপরও যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তার মতবাদের প্রভাবও উভয় জগতে ছিল সুদূরপ্রসারী, আর উভয়জগৎ ছিল একে অপরের সম্পূরক। অর্থনৈতিক অগ্রগতি নিয়ে আসে বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞান নিয়ে আসে শিল্প ও কলকারখানা।
তবে Calvin কখনো বিজ্ঞানের ধর্মের উপর অগ্রযাত্রার নেতিবাচক প্রভাব অনুমান করতে পারেন নি। বিজ্ঞান সেই ধর্মের আংশিক অঙ্গ জাদুকে প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু এতটুকুতেই ক্লান্ত না হয়ে আরো সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে ( Parsons, 1951, p.561-17)। প্রায়োগিক এবং অপ্রায়োগিক এর মাঝের রেখাটা ছিল ক্রান্তিক। এতদিন মানুষ এবং পৃথিবীর সম্বন্ধে যেসব অপ্রায়োগিক ধারণা বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে রাজত্ব করে এসেছিল বিজ্ঞান এক সময় তাদের প্রশ্নবিদ্ধ করে। ধীরে ধীরে বিজ্ঞান ও ধর্মের সংঘর্ষ প্রকাশ্য রূপ লাভ করে। একসময় সবার বিজ্ঞান ছিল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু ছিল— এই পৃথিবী এবং মানুষকে পাঠানো হয়েছে এতে রাজত্ব করতে। কিন্তু আধুনিক মহাকাশবিদ্যা প্রায়োগিক প্রমাণের ভিত্তিতে দাবি করে সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু এবং সনাতন ধারণার উৎখাত সাধন করে। তেমনি জীববিদ্যা এসে বিবর্তনবাদমূলক তত্ত্বের প্রচলন ঘটায় যা অনুমানের বিপরীত। Alfred North Whitehead বলতেন, মানুষ যারা এতদিন নিজেদের শুধুমাত্র ফেরেশতাদের চেয়ে একটু নিচু প্রকৃতির মনে করত, হঠাৎ তারা বুঝল তারা শুধুমাত্র বানরের চেয়ে একটু উপরে। তথ্যভিত্তিক কল্পনার স্রোতে সনাতন ধর্মীয় ধারণা ও অনুমান ভেসে যেতে বাধ্য হয়। Carl Beacker-এর প্রখ্যাত গ্রন্থ Heavenly City of the Eighteenth Century Philosophers এ বলেন: যে ঈশ্বর, পোপ এবং সম্রাটের সম্পর্ক সম্বন্ধীয় Thomas Aquinas-এর যুক্তি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করা অসম্ভব, তবে রাজনৈতিক অঙ্গনে এসব পরিবর্তন এসেছে যার কারণে তার মতবাদ নিয়ে আজকাল চিন্তাবিদগণ তেমন আর মাথা ঘামাচ্ছে না। নিশ্চয়ই চিন্তাধারার জগতেও বিরাট পরিবর্তন এসেছে।
বর্তমান যুগে প্রায়োগিক শিক্ষার গুরুত্ব এতই বেশি যে, মানবসমাজ অগ্রগতির স্বার্থে তাকে গ্রহণ করার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। তবে তা প্রত্যাখ্যান করা যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকলে কথা ভিন্ন। বিজ্ঞানের স্পষ্ট দৃশ্যমান অবদানের জন্য মানবজাতি আজ অভিভূত। এমনকি সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্মের অধ্যয়নও খোদ ধর্মের উপর অনেক প্রভাব ফেলতে পারে। নিরেট প্রায়োগিক হওয়ার কারণে বিজ্ঞান কখনো ধর্মকে মেনে নিতে পারে না, তবে ধর্ম, হয়ত বিজ্ঞানকে গ্রহণ করেই নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারে।
ধর্ম ও বিজ্ঞান নিয়ে আইনস্টাইনের কিছু প্রাসঙ্গিক উক্তি
‘আমার ধর্ম-প্রীতি নিয়ে যা শোনা যায় তার সবটাই মিথ্যে ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রচারিত। আমি কোন ব্যক্তি ঈশ্বরের বিশ্বাস করি না এবং এটা আমি স্পষ্টভাবে বারবার জানিয়ে এসেছি। আমার মধ্যে ধর্মীয় ভাব বলতে শুধু আছে এই অসীম রহস্যময় মহাবিশ্বের বিশালতার প্রতি এক বিস্ময়’।
(-Albert Einstein, in a letter March 24, 1954; from Albert Einstein, the Human Side, Helen Dukas and Banseh Hoffmann, eds. Princeton, New Jeresey, Princeton University Press, 1981, p. 43.)
‘আমি তো এমন ঈশ্বরের কথা ভাবতেই পারি না যে তার নিজের সৃষ্টিকে শাস্তি দেয়। যার উদ্দেশ্য বিধেয় আমাদের নিজেদের মত করে বানানো। সোজা কথায়, এরকম ঈশ্বর মানব চরিত্রের প্রতিফলন। আর মানুষ কীভাবে মৃত্যুর পরেও বেঁচে ওঠে তাও কোনভাবেই আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য নয়, যদিও ভয় পেয়ে বা ধর্মীয় অহংবোধের বশবর্তী হয়ে দুর্বলচিত্ত মানুষ তা বিশ্বাস করে। আমি এই সর্বব্যাপী জীবনের আর সুবিশাল মহাবিশ্ব নিয়ে গবেষণা করতেই ভালবাসি। এই বিশাল প্রকৃতিরাজ্যে কার্যকারণের যে সামান্য বহিঃপ্রকাশ সামনে আসে, তা খুঁজে বের করাতেই আমার আনন্দ।’
(- Albert Einstein, The World as I See It, Citatel Press, 1930.)
‘কল্যাণময়, সর্বশক্তিমান ও নীতিবাগীশ এক ব্যক্তি—ঈশ্বরের ধারণা যে অসহায় মানুষকে সান্ত্বনা ও সহায়তার জন্যই দরকার ছিল, কারোর পক্ষেই তা অস্বীকার করা সম্ভব নয়। ধারণাটি সহজ সরল হওয়ায় মানুষের মনে সহজেই স্থানও করে নিয়েছে। কিন্তু অন্যদিকে এই ধারণার দুর্বলতাও ছিল। ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে তা বারেবারে দেখা যায়। সহজ হিসাবে, যদি ঈশ্বর সর্বশক্তিমান হন, তাহলে মানুষের সব কাজ, ইচ্ছা বা চিন্তা আদপে তারই কর্তৃত্বে। তাহলে, মানুষকে কীভাবে তার কতৃকর্মের জন্য দায়ী করা সম্ভব? ঈশ্বর মানুষের বিচার করে শাস্তি বা পুরস্কার দেয় তাহলে তো নিজের কৃতকার্যেরই বিচার করছে। এর সাথে কীভাবে কল্যাণময় ও নীতিবাদী ঈশ্বরের ধারণাকে মেলানো যায়?
এক ব্যক্তি-ঈশ্বর সব প্রাকৃতিক ঘটনাবলিকে নিয়ন্ত্রণ করে—এই ধারণাকে বৈজ্ঞানিকভাবে অসত্য প্রমাণ করার কোন উপায় নেই। কারণ এই ধারণাগুলো তখন এমন সব যুক্তির আশ্রয় নেবে যেসব বিষয় বিজ্ঞান তখনও আয়ত্বে আনতে পারেনি।
নৈতিকতায় ভালোর জন্যই ধর্মপ্রচারকদের উচিত এই ব্যক্তি-ঈশ্বরের ধারণা থেকে সরে আসা। এর অর্থ হল, যে শাস্তির ভয় আর পুরস্কারের লোভ এই ধর্মপ্রচারক সাধু-সন্তের এত ক্ষমতার উৎস, তা থেকে মানুষকে মুক্ত করতে হবে।’
( – Science Philosophy and Religion, 1934 A Symposium, published by the Conference on Science, Philosophy and Religion in Their Relation to the Democratic Way of Life, Lnc., New York, 1941 )
‘ধর্মে যে সৌভ্রাতৃত্বের কথা বলা আছে, তা আদপে যুদ্ধক্ষেত্রের সৈনিকদের কাঁধে কাঁধ মেলানোর বন্ধুত্ব, অর্কেস্ট্রায় সুরে সুরে মেলানোর বন্ধুত্ব নয়।’
( – Published in Ideas and Opinions, Crown Publishers, Inc., New York, 1954 )
‘আমি তো এমন ঈশ্বরে কথা ভাবতেই পারি না যে তার নিজের সৃষ্টিকে শাস্তি দেয়। যার উদ্দেশ্য বিধেয় আমাদের নিজেদের মত করে বানানো। সোজা কথায়, এরকম ঈশ্বর মানব চরিত্রের প্রতিফলন। আর মানুষ কীভাবে মৃত্যুর পরেও বেঁচে ওঠে তাও কোনভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়, যদিও ভয় পেয়ে বা ধর্মের ইগোর বশবর্তী হয়ে দুর্বলচিত্ত মানুষ তাও বিশ্বাস করে।
( – Albert Einstein, Obituary in New York Times, 19 April 1955.)
‘ব্যক্তি ঈশ্বরের ধারণা আমার কাছে একেবারেই ভিনদেশী, এবং ক্ষেত্রবিশেষে খুবই সরল।’
(-Albert Einstein in a letter to Beatrice Frohlich, December 17, 1952; from The Expanded Quotable Einstein, p. 217.)
‘আমি একজন গভীরভাবে ধর্মনিষ্ঠ অবিশ্বাসী। এটিকে বলা যেতে পারে এক শ্রেণির নতুন ধর্ম।’
(-Albert Einstein in a letter to Hans Muchsam, March 3০, 1954; from The Expanded Quotable Einstein, p. 217.)
‘ব্যক্তি ঈশ্বরের ধারণা আমার কাছে কল্পনার নরাত্বরোপ ছাড়া আর কিছু নয়, আর এটাকে আমি একান্ত গুরুত্ব সহকারে নিতে পারি না। আমি মানবীয় বৃত্তের বাইরে কোন উদ্দেশ্য এবং গন্তব্য কল্পনা করতে পারি না। আমার চিন্তাধারা অনেকটা স্পিনোজার দর্শনের কাছাকাছি— সৌন্দর্যের প্রতি যার ছিল প্রগাঢ় প্রশস্তিবোধ, আর শৃঙ্খলার সরল যুক্তির উপর ছিল বিশ্বাস- একে আমরা আস্বাদন করতে পারি বিনম্র চিত্তে কিন্তু অসম্পূর্ণভাবে।’
( – Albert Einstein, 1947, from Banesh Hoffmann, Albert Einstein: Creator and Rebei, New York: New American Liberary, 1972, p. 95.)
‘আমি বিশ্বাস করি না যে ঈশ্বর মহাবিশ্ব নিয়ে পাশা খেলেন।’
(-Albert Einstein on Quantum Mechanics, published in London Observer, Apirl 5, 1964.)
‘কেন আপনি ভাবছেন যে ‘ঈশ্বর ইংরেজদের শাস্তি দেবেন’– এই ধারণা আমি সমর্থন করব? আমার ঈশ্বর কিংবা ইংরেজ— এ দু’জনের কারও সাথেই কোন সম্পর্ক নেই। আমার শুধু খারাপ লাগে এ ভেবে যে, ঈশ্বর তার অগণিত সন্তানদের ইচ্ছেমত শাস্তি দিতে পারেন তাদের নির্বুদ্ধিতার জন্য, অথচ যে সব নির্বুদ্ধিতার মূল কারণ আসলে ঈশ্বর স্বয়ং— একটা অযুহাতেই তিনি তা থেকে মুক্তি পেতে পারেন, আর তা হল তার অনস্তিত্ব।’
(–Albert Einstein, letter to Edgar Meyer, a Swiss colleague, January 2, 1951, from The Expanded Quotable Einstein, p. 201.)
‘যতই মানব সভ্যতা সামনের দিতে এগিয়ে যাচ্ছে, ততই আমি খুব নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারছি যে, সত্যিকার (মানবিক) ধর্মপরায়ণতা কখনোই জীবন কিংবা মৃত্যুভয়ে ভীত থাকতে পারে না, অন্ধ বিশ্বাসে নিমজ্জিত থাকতে পারে না, বরং এটি যৌক্তিক জ্ঞানের পেছনে ধাবিত হবে।’
(-Science, Philosophy and Religion, 1934 A Symposium, published by the Conference on Science, Philosophy and Religion in their Relation to the Democratic Way of Life, Inc., New York, 1941 )
‘আমি সে রকম ঈশ্বরের ধারণাকে মন থেকে মেনে নিতে পারি না যার ভিক্তি গড়ে উঠেছে মৃত্যু ভীতি থেকে কিংবা অন্ধবিশ্বাসের কাঁধে ভর করে।
(- Albert Einstein, from Einstein : The Life and Times, p. 622)
‘আমি স্পিনোজার ঈশ্বরে বিশ্বাসী নই। আমি মনে করি নৈতিকতা মানুষের জন্য ভাল কিন্তু এটা ব্যাখ্যা করার জন্য কোন অতিপ্রাকৃতিক শক্তির কল্পনা করার প্রয়োজন নেই।’
(-Albert Einstein, letter to a Baptist Pastor, from Albert Einstein the Human Side, eidted by Helen Dukes and Banesh Hoffman, Princeton University Press 1)
‘বৈজ্ঞানিক গবেষণার ভিত্তি হচ্ছে প্রাকৃতিক নিয়মকানুনের সাহায্যে সবকিছুর ব্যাখ্যা দেয়া। কাজেই এটি কার্যকারণের সাথে যুক্ত। সে কারণে, একজন বৈজ্ঞানিক গবেষক বিশ্বাস করেন না যে প্রার্থনার মাধ্যমে কোনকিছু প্রভাবিত হয়, কিংবা কোন অলৌকিক সত্ত্বার ইচ্ছা-অনিচ্ছায় কিছু ঘটে।
(-Albert Einstein in response to a child who had written him in 1936 and asked if scientists pray; from Albert Einstein : The Human Side, edited by Helen Dukas and Banesh Hoffmann, Princeton University Press. p. 32)
‘মানুষের নৈতিকতার জন্য তো ধর্মের কোন দরকার নেই, দরকার মানবিকতা, সহমর্মিতা, শিক্ষা আর সামাজিকতায়। মানুষ যদি পরকালের শাস্তির কথা ভেবে নৈতিক হয়, সেই নৈতিকতার মধ্যে মহত্ত্ব কোথায় থাকে?’
(-Albert Einstein, Religion and Science, New York Times Magazine, 9 November 1930 )।
খ্যাতনামা বিজ্ঞানীদের মধ্যে প্রাচীন যুগ থেকে আধুনিককাল পর্যন্ত অনেকেই প্রচলিত অর্থে ধার্মিক ছিলেন, কিন্তু তাঁদের ধর্ম বিশ্বাস বিজ্ঞান সাধনায় তাঁদের কাছে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি। অন্তরায় সৃষ্টি করেছিল বরং তাঁদের ধর্ম প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ। কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, কেপলার, মেন্ডেল এঁরা সকলেই ছিলেন স্ব স্ব ধর্মের প্রতি পরম অনুরক্ত। কোপার্নিকাস ও মেন্ডেল তো সরাসরি চার্চের পাদ্রী ছিলেন। ধর্মের প্রতি অবিচল আস্থা থাকা সত্ত্বেও গ্যালিলিওকে তাঁর নিজের ইনক্যুইজিশনের কাছে নিগৃহীত হতে হয়েছিল— তাঁর আজীবনের জ্ঞান-সাধনার ফসলকে নিজ মুখে ‘অসত্য’ বলে ঘোষণা করতে হয়েছিল নতজানু হয়ে। কোপার্নিকাসকে শাস্তি পেতে না হলেও তাঁর কালজয়ী সৌরকেন্দ্রিক গ্রন্থটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। নিউটন, মেন্ডেল, ডারউইন সেদিক থেকে পরম সৌভাগ্যবান যে তাঁদের প্রকাশনাগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়নি। নিউটন তো ইংল্যান্ডের চার্চের প্রতিক্রিয়ার ভয়ে প্রিন্সিপিয়ার প্রকাশ (১৬৮৭) বিলম্বিত করেছিলেন রচনা শেষ হওয়ার ২০ বছর। হয়ত এ মহাগ্রন্থ কোনদিনই প্রকাশিত হত না যদি না নিউটনের বন্ধু হ্যালি উদ্যোগ গ্রহণ করতেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর খ্যাতনামা বিজ্ঞানীদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন প্রচলিত অর্থে ধর্ম বিশ্বাসী—এই তালিকায় রয়েছেন খ্যাতনামা পরীক্ষণবিদ মাইকেল ফ্যারাডে, তাত্ত্বিক পদার্থবিদ ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল, ব্রিটিশ পদার্থবিদ উইলিয়াম উইলসন, জে জে থমসন (লর্ড কেলভিন), লর্ড রাদারফোর্ড প্রমুখ। বিবর্তনবাদের জনক স্বয়ং ডারউইন প্রথম জীবনে চার্চ অব ইংল্যান্ডের মিনিস্টার হতে চেয়েছিলেন এবং এ উদ্দেশে ক্যামব্রিজ থেকে ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দে ধর্মতত্ত্বে ডিগ্রি নিয়েছিলেন। কিন্তু বিগল জাহাজে করে সমুদ্রযাত্রা সে সিদ্ধান্তে ওলট পালট করে দিল।
বিংশ শতাব্দীতে এসে দেখা যায় যে বিজ্ঞানীদের সংখ্যা ক্রমশ ক্ষীয়মান। রিচার্ড ডকিন্স তো আরও একধাপ এগিয়ে বলেছেন সৃষ্টিশীল বিজ্ঞানী হতে হলে তাঁকে অবিশ্বাসী হতেই হবে। এতদ্সত্ত্বেও মনেপ্রাণে ঈশ্বরবিশ্বাসী নিষ্ঠাবান বৈজ্ঞানিকের সংখ্যা কিন্তু কম নয়। এদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র শাখার সরকারি ‘হিউম্যান জেনোম প্রকেল্পের’ (Human Genome Project ) প্রশাসক প্রধান, খ্যাতনামা বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানী ফ্রান্সিস এস কলিন্স সর্বপ্রধান এবং বলা যায় বাইবেলীয় ব্যক্তি ঈশ্বরবিশ্বাসী বিজ্ঞানীদের মুখপাত্র হয়ে দাঁড়িয়েছেন। সম্প্রতি তাঁর লিখিত The Language of God সুধী মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আধুনিককালের ব্যক্তি ঈশ্বরবাদী খ্যাতনামা ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের মধ্যে রয়েছেন আর্থার পিকক (Athur Peacocke ), রাসেল স্ট্যানার্ড (Russel Stannard), জন পোলকিংহোন ( John Polkinghorne) প্রমুখ।
অন্যদিকে অসংখ্য অবিশ্বাসী বিজ্ঞানীদের মুখপাত্র হয়ে আবিভূর্ত হয়েছেন খ্যাতনামা বিবর্তনবাদ বিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স। এই দলে উল্লেখযোগ্য খ্যাতনামা বিজ্ঞানীদের মধ্যে রয়েছেন কার্ল সাগান, ভিক্টর জে স্ট্রেংগার, স্টিফেন ভাইনবার্গ, পল ডেভিস, পল কার্জ, হাইসেনবার্গ, অ্যান্থনি অ্যাগুরি, ক্রেগ ভেনটার (বেসরকারি ‘হিউম্যান জেনোম প্রকল্পের’ প্রধান) প্রমুখ।
আইনস্টাইনের ধর্ম সম্পর্কে বিভিন্ন উক্তি ও লেখা বিশ্লেষণ করে তাঁর ধর্ম- চিন্তাকে আখ্যা দেয়া হয়েছে ‘কসমিক রিলিজিয়ন’ বা ‘মহাজাগতিক ধর্ম’। মহাজাগতিক ধর্মের উৎস কী-এর ভিত্তিই বা কী? সাধারণ গবেষক থেকে আইনস্টাইনের মত মহান বিজ্ঞানী পর্যন্ত যে কোন বিজ্ঞানী যখন কোন চমকপ্রদ আবিষ্কার করেন তখন তিনি এক ধরনের বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়েন এবং আনন্দ-আপ্লুত হন, যাকে বলা যায় স্বৰ্গীয়। এই স্বর্গীয় আনন্দময় অনুভূতিকেই অনেক বিজ্ঞানী বলেছেন ‘ধর্মানভূতি’। এই অর্থে প্রতিটি বিজ্ঞানীই ধর্মপ্রাণ। এই ধর্মানুভূতিকেই বিজ্ঞানীরা আখ্যা দিয়েছেন ‘কসমিক রিলিজিয়ন’ (cosmic religion) বা ‘মহাজাগতিক ধর্ম’।
ধর্মবাদীরা আইনস্টাইনের প্রথাগত ধর্মবিশ্বাস প্রমাণ করতে তাঁর একটি উক্তিকে ‘Science without religion is lame, religion without science is blind’– পূর্বাপর সমন্বয় না রেখে ভুল উদ্ধৃত করে থাকেন। প্রথমত আইনস্টাইন কথিত এই ‘religion’ বাইবেলীয় বা ইহুদি একেশ্বরবাদী ধর্ম নয়। আইনস্টাইন প্রকৃতির মধ্যে যে সুশৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা দেখে বিমোহিত হন, ঠিক ধর্মের মধ্যেও এ ধরনের নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলা তিনি দেখতে পান, আর এই অর্থেই তিনি বলে থাকেন যে প্রকৃতিতে নিয়মানুবর্তিতার অস্তিত্বে বিশ্বাস ধর্মেরই অন্তর্গত। ধর্মকে এখানে প্রতীকী অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। ‘বিজ্ঞান, দর্শন ও ধর্ম’ শিরোনামে একটি সিম্পোজিয়ামে তিনি যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন সেখানে বিষয়টিকে তিনি পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছিলেন :
To this [sphere of religion] there also the faith in the possibility that regulations valid for the world of science are rational, that is comprehensible to reasons. I cannot conceive of a genuine scientist without that profound faith. The situation may be expressed by an image: religion without science is blined
আইনস্টাইন এখানে যা বলতে চেয়েছেন তা হল ধর্মে যেমন কঠোর নিয়মনিষ্ঠতা ও শৃঙ্খলা বিদ্যমান এক প্রকৃত বিজ্ঞানীর মধ্যেও সেই শৃঙ্খলা থাকতে হবে— বিশ্বাসের মতই দৃঢ়। এক কথায় শৃঙ্খলা ব্যতীত বিজ্ঞান অগ্রসর হতে পারে না। আইনস্টাইন যে অর্থে নিজেকে ধর্মপরায়ণ বলেছেন— সেই অর্থে আমাদের ধর্মপরায়ণ হতে বাধা নেই।
কিন্তু প্রশ্ন হল ধর্ম ও ধর্মশাস্ত্রোক্ত ‘সত্যের’ সাথে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান যখন মিলবে না, তখন এক বুদ্ধিদীপ্ত মুক্তমনা মানুষ কী অবস্থান নেবেন? বাইবেলীয় ধর্মপ্রাণ ঈশ্বরভক্ত বা কোরানের ঈশ্বরে নিষ্ঠাবান বিশ্বাসীর কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে মুহূর্ত দেরি হবে না, যেমন বাইবেলীয় ঈশ্বরবাদী হেনরি মোরিস দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা দিয়েছেন : ‘When science and the Bible differ, science has obviously misinterpreted its data’। এমনিভাবে কোরান ও বৈজ্ঞানিক তথ্যের মধ্যে বিরোধ বাঁধলে তারা কোরানের মতকেই প্রাধান্য দেবেন।
সুপ্রাচীন কাল থেকেই এই জনপদ সাধুসন্তের দেশ বলে পরিচিত। ভারতবর্ষ বেদ, ধর্ম, মায়াবাদের দেশ, বেদান্ত ও উপনিষদের দেশ—একথা বহুদিন ধরেই যেমন প্রচলিত, তেমনি প্রাচীন ভারতে বিজ্ঞান চর্চারও ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল একথাও আমরা শুনতে পাই। সেকালের মুনি ঋষিরা নাকি এরোপ্লেন (পুষ্পক রথ!) আবিষ্কার করেছিলেন। টেলিভিশন (সঞ্জয়ের দিব্যদৃষ্টি) শুধু নয়, অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রও নাকি তাঁরা আবিষ্কার করেছিলেন। এসব গল্প-কাহিনীর উদাহরণ রামায়ণ-মহাভারতে অভাব নেই। কিন্তু সেই তথ্য ও সূত্রাবলির হদিশ আজকাল আর পাওয়া যায় না। আরবী ভাষায় লিখিত প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞানচর্চার চমকপ্রদ বিবরণ দিয়ে গেছেন পণ্ডিত-পর্যটক আবুল ফজল ও আলবেরুণী প্রমুখ। বৈজ্ঞানিক তথ্যকে আশ্রয় করে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান নিয়ে লেখালেখি প্রথম শুরু হয়েছিল উনিশ শতকের গোড়ায় সূচনাপর্বে— অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন ইউরোপীয় ও খ্রিষ্টান মিশনারিরাই। এবং বিজ্ঞান চর্চারও প্রবর্তন করেছিলেন তাঁরাই। উইলিয়াম জোন্স (১৭৪৬-১৭৯৪), চার্লস উইকিন্স (১৭৪৯-১৮৩৬), নাথানিয়েল ব্রাশি হ্যালহেড (১৭৫১-১৮৩০), উইলিয়াম কেরী (১৭৬১-১৮৩৪), হেনরি পিস্ ফরস্টার (১৭৬১-১৮১৫), হেনরি টমাস কোলব্রুক (১৭৬৭-১৮৩৭), ডেভিড হেয়ার (১৭৭৫-১৮৪২), হোরেস হেম্যান উইলসন (১৭৮৬-১৮৬০), জেমস ফারগুসন (১৮০৮-১৮৮৩), আলেকজান্ডার কানিংহাম (১৮১৪-১৮৯৩), রেভা. জেমস লঙ (১৮১৪-১৮৮৭), জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ার্সন (১৮৫১-১৯৪১), মনিয়র মনিয়র উইলিয়ামস্ (১৮১৯-১৮৮৯), ফ্রীডরিখ ম্যাক্সম্যুলর (১৮২৩-১৯০০) প্রমুখ ইউরোপীয় পণ্ডিতগণ প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির ইতিহাস জানার চেষ্টা করেছেন। এ দেশে বাংলাভাষায় বিজ্ঞান রচনার পথপ্রদর্শক ফেলিক্স কেরী (১৭৮৬-১৮২২), বেদ সম্বন্ধে সর্বপ্রথম গবেষণাসমৃদ্ধ গ্রন্থ প্রণেতা হেনরী টমাস কোলব্রুক, এদেশের বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায় সম্পর্কে গবেষণাগ্রন্থ রচনার পথিকৃৎ হোরেস হেম্যান উইলসন, বাংলাভাষায় সর্বপ্রথম রসায়ন গ্রন্থ প্রণেতা জন ম্যাক (১৭৯৭-১৮৪৫), বাংলাভাষায় কল্পবিজ্ঞান রচনার পথিকৃৎ জন বার্ডন স্যান্ডর্সন হ্যালডেন (১৮৯২-১৯৬৪) আমাদের ধর্ম ও বিজ্ঞান গবেষণায় স্মরণীয় হয়ে আছেন। প্রাচীন আরবী ও সংস্কৃত পুঁথি থেকে প্রাচীন ভারতে বিজ্ঞানচর্চার বিস্ময়কর তথ্য আমাদের চমৎকৃত করে।[৩১] ভাবতে অবাক লাগে দুই থেকে আড়াই হাজার বছর আগে বৌদ্ধ যুগে শুশ্রুত এবং তার ছাত্রবৃন্দ একশ কুড়ি রকমের শল্য-চিকিৎসার যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করেছিলেন, যেগুলি লোহা বা ইস্পাত দিয়ে তৈরি।
[৩১. তাই এখন দেখা যাচ্ছে, বিজ্ঞানের উদ্ভাবনে ও ক্রমোন্নতিতে যেখানে অগ্রগতি সাধিত হচ্ছে সেখানেই এসব আবিষ্কারের উৎস স্বধর্মের স্বপক্ষে প্রমাণ প্রতিষ্ঠার প্রাণপণ প্রয়াস আরও জোড়ালো হচ্ছে। প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্রের বরাত দিয়ে বলা হচ্ছে আধুনিক প্লাস্টিক সার্জারির জনক সশ্রুত। তাঁর পদ্ধতিতে দু হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে অস্ত্রোপচার চলেছিল ভারতে ও আরব বিশ্বে। এ সম্পর্কে অনেক প্রচলিত কাহিনি আছে। একটি ঘটনা এরকম :
খলিফা হারুন-অর-রসিদের আজত্বকালে শালি বিন বাহ্লা ( Salih Bin Bahlah) বাগদাদে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। সেই সময় খলিফার ভ্রাতুষ্পুত্র ইব্রাহিম বিন শালি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তার কোন জ্ঞান ছিল না। কোমা অবস্থায় ছিলেন দীর্ঘকাল। খলিফার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ভক্তিসু তার চিকিৎসা করছিলেন। কিন্তু, ফল কিছু হচ্ছিল না। তিনি বলে দিলেন, ‘কোন আশা নেই, রোগী বাঁচবে না।’ উক্ত চিকিৎসক ছিলেন গ্রিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে পারদর্শী। কোন এক পরামর্শদাতা খলিফাকে বললেন, একজন ভারতীয় পদ্ধতির চিকিৎসককে ডেকে দেখুন না। তিনি অবশ্যই কৃতকার্য হবেন। শালি-বিন-বাল্লাকে ডেকে পাঠানো হল। তিনি নাড়ি টিপলেন, বললেন— ‘দুর্ভাবনার কোন হেতু নেই। রোগী বেঁচে যাবে।’
ইতিমধ্যে রাষ্ট্র হয়ে গেল ইব্রাহিম মারা গেছে। শুনে তো খলিফার খুব রাগ। শালি এবং ভারতীয় চিকিৎসা বিদ্যাকে অভিশাপ দিলেন তিনি। শেষ শোভাযাত্রার সব প্রস্তুতি প্রায় শেষ, এমন সময় শালি এসে বললেন, ‘দয়া করে আমাকে আর একটিবার সুযোগ দিন। তিনি রোগীর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই বললেন, ‘দয়া করে জীবন্ত লোকটাকে কবর দেবেন না।’ তিনি একটা সূঁচ নিলেন। নখের নীচে বিদ্ধ করলেন। অমনি মুহূর্ষ রোগী হাতটা সরিয়ে দিল। শালি বললেন : কিছু ধুনো আর একটা হাঁপর চাই। ধুনোর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন করে দেওয়া হল ঘরটা। ইব্রাহিমের নাকে ঢোকানো হল সেই ধোঁয়া। দশ মিনিটের মধ্যেই ইব্রাহিমের শরীর চাঙ্গা হয়ে উঠতে শুরু করল। একটু পরেই তিনি হাঁচি দিলেন এবং সবাইকে চমকে দিয়ে উঠে বসলেন। অমনি চতুর্দিক থেকে ধ্বনি উঠল : ‘আল্লাহ্ আকবর।’ –আল্লাই সবচেয়ে মহান! এরপর ইব্রাহিম দীর্ঘজীবী হয়েছিলেন। (Abdul Bari, Sanskrit’s Lagacy to the Arab Intellectual Heritage)। ভারতীয় চিকিৎসকরা শারীরিক মৃত্যু আর আত্মার মৃত্যুর এ দুটোর মধ্যে পার্থক্য করতে জানতেন। আরও জানতেন কী করে কৃত্রিমভাবে শ্বাসপ্রক্রিয়াকে স্বাভাবিক করে তোলা যায়। গ্রিক পদ্ধতির চিকিৎসকদের কিন্তু এসব জানা ছিল না। তবে পৃথিবীর প্রথম চিকিৎসা শাস্ত্রের উদ্ভব আয়ুর্বেদ থেকে।]
বিজ্ঞানের প্রায়োগিক দিক বা হাতে-কলমে বিজ্ঞানচর্চা ছাড়াও বিজ্ঞানচর্চার আরও অন্যান্য মাধ্যম, জ্ঞানবিজ্ঞানের গ্রন্থরচনা ও পাঠ। বিজ্ঞান মানসিকতা গঠনের জন্য বিজ্ঞানের প্রচার সর্বোপরি আত্মসচেতন সুনাগরিক ও সুস্থ সমাজ গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন বিজ্ঞান আন্দোলন। প্রাচীন ভারতে এই বিজ্ঞানচর্চার সর্বোতমুখী প্রয়াস ও সমৃদ্ধির ইতিহাস খুবই গৌরবোজ্জ্বল। দুঃখের বিষয় প্রায় এক হাজার বছর আগে প্রাচীন ভারতের সমৃদ্ধ বিজ্ঞানচর্চা হঠাৎ-ই যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। গুরুত্ব পেল মায়াবাদ, কর্মফল প্রভৃতি। আর্যভট্ট, নাগার্জুন, শুশ্রুত-ধারা বিপরীত মানসিকতার মরুভূমিতে হারিয়ে গেল।
যদিও প্রাচীন ভারতে শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞানচর্চারও যথেষ্ট উন্নতি ঘটেছিল— একথা আমরা সকলেই জানি। বেদ, ন্যায়শাস্ত্র ও পৌরাণিক গ্রন্থমালায় বহু বৈজ্ঞানিক সূত্রাবলি ও আলোচনার উল্লেখ পাওয়া যায়। বিশ্ববিশ্রুত পদার্থবিদ ও জীববিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু (১৮৫৮-১৯৩৭) প্রণীত অব্যক্ত, প্রখ্যাত রসায়নবিদ প্রফুল্লচন্দ্র রায় (১৮৬১-১৯৪৪) প্রণীত প্রাচীন ভারতে বিজ্ঞান চর্চার নিদর্শন, ভারতীয় রসায়ন শাস্ত্র; জ্যোতিঃ পদার্থ-বিদ্যার পথিকৃৎ মেঘনাদ সাহা (১৮৯৩-১৯৫৬) প্রণীত বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি; বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞান সাধক সত্যেন্দ্রনাথ বসু (১৮৯৪-১৯৭৪) প্রণীত বিজ্ঞানের সঙ্কট প্রভৃতি গ্রন্থে এসব বরণীয় বাঙালি বিজ্ঞানীদের নিজস্ব আবিষ্কার ও উদ্ভাবনী ইতিহাস ছাড়াও তাঁদের পূর্বসুরীদের বিজ্ঞানচিন্তার ইতিহাস আমরা জানতে পারি। ‘নেচর’ এবং ‘সায়েন্স’ এর মত বিশ্বখ্যাত পত্রিকার পাশাপাশি বাঙালি বিজ্ঞানীদের সম্পাদনায় ‘সায়েন্স’ এন্ড কালচার’, ‘জ্ঞান ও বিজ্ঞান’-এর মত বিজ্ঞানগবেষণা পত্রিকা আজও প্রকাশিত হয়ে চলেছে।
প্রাচীন ভারতীয় বিজ্ঞানের অবলুপ্তি নিয়ে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় চারটি প্রধান কারণের কথা বলেছেন :
১. জাতিভেদ প্রথার জন্য হাতের কাজ থেকে মাথার কাজ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া।
২. শঙ্করাচার্যের মায়াবাদী দর্শন-ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা। এই দর্শন প্রচার ও প্রয়োগ।
৩. প্রাচীন ভারতে বিজ্ঞানচর্চার যুগগুলো অর্থাৎ লোকায়ত তথা নাস্তিক্য যুগ, জৈন ও বৌদ্ধ যুগ, এগুলোর বিরুদ্ধে মারমুখী আক্রমণ সংগঠিত করা।
৪. ব্রাহ্মণ্যবাদের দোহাই দিয়ে শঙ্করাচার্যের নির্দেশে সুশ্রুতের মরদেহ কেটে চিকিৎসা চেষ্টা বন্ধ করে দেওয়া। (Prufulla Chandra Roy, The Hindu Chemistry) ।
সাংখ্য ও পতঞ্জলিতে সৃষ্টি-রহস্যের ব্যাখ্যা ও ক্রমবিকাশের বিস্তৃত আলোচনা আমরা দেখতে পাই পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের আলোচনার মতই। বৈশেষিক ন্যায়ে পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞানের প্রণালী ও প্রকরণ নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে। চরক ও শুশ্রুতর শাস্ত্রে প্রাচীন ভারতের যৌগ (Compound) ও তার প্রস্তুত প্রণালী সম্পর্কে আমরা আলোচনা যেমন দেখি, তেমনি পতঞ্জলিতে ধাতু, লবণ, পারদ সম্পর্কিত আলোচনা দেখতে পাই। নাগার্জুনের পারদ তৈরির প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাসায়নিক যৌগের ব্যবহারের আরও উন্নতি ঘটে। রং, প্রসাধনী দ্রব্য, চিকিৎসাবিদ্যা ও ফলিত রসায়নের নানাদিকেই প্রাচীন ভারতে সমধিক উন্নতি ঘটেছিল। আধুনিক বিজ্ঞানচর্চার নবতম অবদান নলজাতকের উপাখ্যান পড়ে আমরা বিস্মিত হলেও প্রাচীন ভারতে মহর্ষি চরক ১৬ রকম জৈব পদার্থ থেকে ভ্রুণ তৈরির কথা উল্লেখ করেছেন। রাসায়নিক প্রযুক্তিবিদ্যায় বরাহমিহির যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। সে আমলে বিজ্ঞানচর্চা কেবল মাত্র ব্যবহারিক ও প্রায়োগিক দিকেই সীমাবদ্ধ ছিল না। জড় ও জীবজগৎ সম্পর্কেও তাঁরা বিশ্লেষণ আলোচনা করেছেন। এই উপমহাদেশের বিজ্ঞান সাধনার ইতিহাসে দেখা যায় বাঙালি ভূ-বিজ্ঞানী জৈনমুনি গুণিরত্ন আনুমানিক ১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দে মাটির প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। বিভিন্ন শাস্ত্রে বর্ণিত উদ্ভিদের আনন্দ ও বেদনার উল্লেখের কথাও আমরা জানতে পারি। সে আমলে চরক, পতঞ্জলি, ছন্দোক, শঙ্কর ও শুশ্রুত প্রমুখ ব্যক্তিগণ সমগ্র প্রাণিজগৎকে বেশ কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করেছিলেন। বিজ্ঞানের ইতিহাসে দেখা যায় এতদ্ঞ্চলে প্রাচীনকালে (আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ অব্দের পূর্বে) সমস্ত শারীরবৃত্তের এত সুন্দর ও প্রণালীবদ্ধ আলোচনার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর আর কোন দেশে দেখা যায় না। বিশেষত শারীরবৃত্ত ও শল্য চিকিৎসার উদ্ভব ও বিকাশে এদেশের অতুলনীয় উন্নতি ঘটেছিল। আধুনিক বিজ্ঞানের পরিপ্রেক্ষিতে তিন হাজার বৎসর পূর্বের চিকিৎসক ও শারীরবৃত্ত- বিশারদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে উন্নতি দেখা যায়, তার পরিপেক্ষিতে আয়র্বেদোক্ত জ্ঞান বিচার করলেই এর অতুলনীয় শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাচীন বৈদ্য ও ভিষকদের আশ্চর্য প্রতিভার কথা আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে পারি। ভারতীয় বিজ্ঞানের যখন এই অবস্থা তখনও পর্যন্ত ইউরোপী বিজ্ঞানের বিশেষঅগ্রগতি ঘটেনি। বিশিষ্ট বিজ্ঞানী জে.ডি. বার্নালের ভাষায় আমরা বলতে পারি : ‘While a Brilliant Cultural development was taking place in the Eastern Empire and in Islam, most of the Europe was still suffering from the confusion lift by the collapse by Roman Empire and by the Barbarians invasions’।
প্রাগৈতিহাসিককালে কেবল ভারতবর্ষেই নয়, মিশর, ব্যাবিলন, চীন, গ্রীস, আলেকজান্দ্রিয়া, রোম প্রভৃতি সভ্যতার প্রাচীনতম কেন্দ্রে বিজ্ঞানের প্রথম বিকাশ ঘটেছিল। আত্রেয় ও শুশ্রুতের কাল থেকে প্রকৃতপক্ষে ভারতে চিকিৎসা-বিজ্ঞানের ইতিহাসের সূচনা। আত্রেয় প্রবর্তিত চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রধান উদ্যোক্তা চরক। পরবর্তীকালে চরক ও শুশ্রুতের সমবেত প্রচেষ্টায় চিকিৎসা-বিজ্ঞান বিশেষত শল্য চিকিৎসার প্রভূত উন্নতি ঘটে। ত্রয়োদশ শতকের শেষভাগে যখন ভারতবর্ষে রসার্ণব, রসরতুসম্মুচ্চয় প্রকাশিত ও প্রচলিত ইউরোপে তখন রজার বেকন প্রমুখদের যুগ। ১৪৯৩ খ্রিষ্টাব্দে লাইপজিগ থেকে প্রকাশিত অ্যানাথোমিয়া গ্রন্থের আখ্যাপত্রে শব ব্যবচ্ছেদের একটি ছবি দেখতে পাওয়া গেলেও তার বহু বছর আগে (খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ বছর আগে) শুশ্রুত নরদেহ ব্যবচ্ছেদ ও তার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। প্রাচীন ভারতে বিজ্ঞানচর্চা সমধিক প্রসিদ্ধি লাভ করলেও পরবর্তীকালে এর অবনতি সম্পর্কে তথ্যসন্ধানী ঐতিহাসিকগণ অন্যতম দুটি কারণ নির্দেশ করেছেন। এর প্রথমটি হচ্ছে— ভারতীয়দের নিজেদের মধ্যে স্ব-বিরোধিতা। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে বিদেশী রাষ্ট্রের প্রভাব।
পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষের দিকে ইতালীতে রেনেসাঁসের সূত্রপাত হওয়ার পর নবজাগরণের মধ্যেই ঘটেছিল বিজ্ঞানের উন্মেষ। লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি (১৪৫২- ১৫১৯), কোপারনিকাস (১৪৭৩-১৫৩০), গ্যালিলিও (১৫৬৪-১৬৪২), কেপলার (১৫৭১-১৬৩০) প্রমুখ স্মরণীয় বরণীয় বিজ্ঞানীদের নব নব উন্মেষশালী চিন্তাধারায় নব জাগরণের সূচনা হয়েছিল।
বিজ্ঞানের সীমানা বিস্তারের কাহিনী আসলে প্রকৃতির উপর মানুষের ক্ষমতা বিস্তারের কাহিনী। যার মধ্যে প্রতিফলিত হচ্ছে মানুষের উদ্ভাবনী ও সৃজনী শক্তি। বিজ্ঞানের এ বিকাশকে বর্ণনা করবার বা ব্যাখ্যা করবার গাণিতিক বিমূর্তায়ন কিংবা উচ্চতর যুক্তির ভাষা সাধারণের কাছে নিঃসন্দেহে দুর্বোধ্য। বিজ্ঞানের জন্য চাই সাংস্কৃতিক মানের একটা নির্দিষ্টমাত্রায় উন্নয়ন। মানুষের চিন্তার বিকাশ এবং বিজ্ঞানের বিকাশ একসূত্রে গাঁথা। গ্যালিলিও, আইনস্টাইন যাকে আধুনিক বিজ্ঞানের জনক বলেছেন, নিউটন-যার গতি তত্ত্ব তিন শতাব্দী ধরে পদার্থ বিজ্ঞানকে পথ দেখিয়েছে, তাদের মত বিরল প্রতিভাধরদের অবদানে বিজ্ঞানের অভিযাত্রা দ্রুতলয়ে এগিয়ে চলেছে।
আপেক্ষিকতাবাদের আবিষ্কারক মহান দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক আলবার্ট আইনস্টাইনের (১৮৭৯-১৯৫৫) মতে, ‘মধুরতম অনুভূতি আমরা লাভ করতে পারি রহস্য সন্ধানের কৌতুহল-সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা থেকে।’ প্রকৃত শিল্পকলা এবং প্রকৃত বিজ্ঞানের সূচনাবিন্দুতে থাকে রহস্য উদ্ঘাটনের তীব্র আগ্রহ। এ আগ্রহ যার শেষ হয়ে যায়, যে আর বিস্মিত হয় না, কৌতুহলের আনন্দে কর্মচঞ্চল হয় না, সে মৃত— তার দৃষ্টিশক্তি নির্বাপিত। ধর্মের জন্ম দিয়েছে রহস্য। সন্ধানের এই অভিজ্ঞতাই সেক্ষেত্রে এ অভিজ্ঞতার মধ্যে ভয়ও যুক্ত থাকতে পারে। রহস্যময় অজানা কোন কিছুর অস্তিত্ব সম্পর্কে জানার আগ্রহ আর গভীরতা যুক্তিবোধ ও দীপ্তময় সৌন্দর্যবোধভিত্তিক আমাদের ইন্দ্রিয়লব্ধ তীব্র অনুভূতি আমরা আমাদের সত্তায় অনুভব করতে পারি তাদের আদি ও অবিকৃত রূপের মধ্যে। এই আগ্রহ ও অনুভূতি দ্বারাই গঠিত হয় প্রকৃত ধর্মবোধ। এ অর্থে এবং কেবল এ অর্থেই আমি গভীর ধর্মবোধসম্পন্ন মানুষ। আমি এমন কোন ঈশ্বর কল্পনা করতে পারি না যিনি তাঁর সৃষ্ট জীবকে পুরস্কৃত করেন কিংবা শাস্তি দেন অথবা যিনি আমাদের ইচ্ছাশক্তির মত কোন প্রকার ইচ্ছাশক্তির অধিকারী। আমি কল্পনা করতে পারি না এবং কখনও কল্পনা করতে চাইও না যে, দৈহিক মৃত্যুর পরেও কোন ব্যক্তির সত্তা বেঁচে থাকে। দুর্বল প্রকৃতির লোকেরা ভয় ও স্বার্থবোধ বশে এই ধরনের ধারণা পোষণ করতে পারে। আমি যে কাজে আনন্দ পাই তা হল, অনন্ত জীবনপ্রবাহের আর অস্তিমান জগতের বিস্ময়কর রূপ সম্পর্কে চিন্তাশক্তিকে জাগ্রত রাখা ও এসবের অস্পষ্ট আলো-আঁধারির রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য চেষ্টা করা [Ideas and Opinion : Albert Einstein] ।
আইনস্টাইনের বিজ্ঞানচেতনা মানবিকী বোধের সমতুল্য। তাঁর মতে মানুষের বোধের অভিব্যক্তি ও সঞ্জীবিত অভিজ্ঞান তখনই বেশি মানবিক হয়ে ওঠে ব্যক্তির ধর্মবোধ যখন দর্শন ও বিজ্ঞানসম্পৃক্ত হয়। ধর্ম তখন একজন মানুষের জীবনের সকল দিক স্পর্শ করে। এই অর্থে ধর্ম ও বিজ্ঞান পরস্পর পরিপূরক। তবে প্রথাগত ধর্মবিশ্বাসীদের কেউ কেউ বিজ্ঞানী আইনস্টাইন তাঁদের সহযোগী বলে প্রমাণ করার জন্য প্রায়শই প্রসঙ্গ-বিচ্যুত একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরেন। উদ্ধৃতিটি হচ্ছে : ‘ধর্ম ব্যতিরেকে বিজ্ঞান অসম্পূর্ণ, বিজ্ঞান ব্যতিরেকে ধর্ম অন্ধ।’ ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত ‘Science, Philosophy and Religion: A Symposium’ শীর্ষক প্রবন্ধে আইনস্টাইন প্রসঙ্গত বলেন : ‘Science without religion is lame, religion without science is blind’। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ধর্মের শ্যাম ও বিজ্ঞানের কুল বজায় রাখার জন্য আইনস্টাইন তাঁর ‘মহাজাগতিক ধর্মে’র সঙ্গেই বিজ্ঞানের সম্পর্কসূত্র সন্ধান করেছেন— ধর্ম নামে যা প্রচলিত তার সঙ্গে নয়।
আদিম মানুষদের অন্ধ আদিম কল্পনা, আর পরবর্তী অনেকের সুপরিকল্পিত মিথ্যাচার, কখনো কখনো মত্ততা, নানাভাবে বিধিবদ্ধ হয়ে নিয়েছে যে-বিচিত্র রূপ, তাই পরিচিত ধর্ম নামে। বার্ট্রান্ড রাসেল তাঁর Why I am not a Christian (আমি কেন খ্রিষ্টান নই) গ্রন্থে বলেছেন, “সব ধর্মই ক্ষতিকর ও অসত্য’। কোন অলৌকিক জগত থেকে কেউ ধর্ম পাঠায় নি, যদিও এটা বিশ্বাস করার নির্দেশ দিয়ে ভয় দেখানো হয়; কোন অলৌকিক জগত নেই, মানুষ নিয়ে কোন অলৌকিক সত্তার কোন উদ্বেগ নেই। মহাবিশ্বে মানুষ খুবই ক্ষুদ্র। ধর্ম অলৌকিক নয়— বিধাতার বা দেবদেবীদের প্রণীত নয়; ধর্ম লৌকিক মানুষের প্রণীত, এবং বেশ সন্ত্রাসবাদী ব্যাপার।
মানুষের জাগতিক পরিবেশ থেকে ধর্মের উদ্ভব হলেও কালে কালে ধর্ম মানুষের অবচেতন মনের গহনে প্রবেশ করে একটা স্বকীয়তা, স্বাতন্ত্র্য এবং নিজস্ব গতিশীলতা অর্জন করে। বংশ পরস্পরায় জন্মগতভাবে মানুষের সমাজচিন্তা ও সংস্কৃতিকে এভাবে প্রভাবিত করে ধর্ম অনেক সময় এমন এক স্বাধীন শক্তি অর্জন করে যে সে তখন মানুষের জাগতিক অগ্রগতিকে প্রতিহত করবার ক্ষমতা রাখে। অতএব ধর্মকে শুধুমাত্র বস্তুজগতের উপরিকাঠামো বললে ভুল হবে। সে কারণেই আমরা দেখতে পাই যে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগেও এমনকি অনেক শিক্ষিত মানুষ প্রাচীন ধর্মবিশ্বাস আঁকড়ে ধরে থাকেন। যে ঐতিহাসিক-জাগতিক পরিবেশে সে সব কল্পনাভিত্তিক বিশ্বাসের উদ্ভব হয়েছিল, সে পরিবেশে যুগান্তকারী পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু প্রাচীন পরিবেশে উৎপন্ন সে বিশ্বাস আজও অনেকখানি অপরিবর্তিত আছে। তবে সমাজ বিজ্ঞানীদের বিশ্লেষণে বলা যায়, মানুষ ধর্ম বিশ্বাস আঁকড়ে থাকলেও তাঁর অবারিত দুঃখ-কষ্ট নিরসনে কিংবা দৈব-দুর্বিপাক থেকে পরিত্রাণ পেতে ধর্মের চেয়ে বিজ্ঞান চেতনাই তাকে সঞ্জীবিত রেখেছে। বৈশ্বিক মহামারি কিংবা রাষ্ট্রীয় বিপর্যয়ে মানুষই তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বিজ্ঞান চেতনাই মানুষকে মৃত্যুঞ্জয়ী করেছে— অনাগত ভবিষ্যতেও করবে। তাই মানবিক বোধের কবি নজরুলের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই-
আরতির থালা তসবির মালা আসিবে না কোন কাজে
মানুষ করিবে মানুষের সেবা আর সবকিছু বাজে।
ধর্মের ভবিষ্যৎ
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা যখন আরও উন্নত হবে তখন সেই ভবিষ্যৎ সমাজে ধর্ম থাকবে কি থাকবে না, এ-নিয়ে অনেকেই আলোচনা করেছেন। কার্ল মার্কসের মতে, মানুষ যখন প্রকৃতির রহস্য জানতে পারবে ও সাম্যবাদী সমাজ গঠন করবে তখন ধর্ম বিলুপ্ত হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, উন্নত দেশগুলি ও কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলিতে ধর্মের প্রভাব ক্রমশই বাড়ছে। সমাজতত্ত্বাবিদেরা দেখেছেন যে রাশিয়ায় ব্রেজনেভ শাসনের শান্তিপূর্ণ যুগেই রুশ তরুণেরা বেশি করে ধর্মের দিকে ঝুঁকেছে, আমেরিকায় স্বচ্ছলতার সময়েই চার্চের সদস্যসংখ্যা বেড়েছে, চীনে ভারতীয় লেখকদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দের বই-ই বেশি বিক্রি হয়, এমনকি রাশিয়া চেকোশ্লোভাকিয়া-বুলগেরিয়া-চীনের মত কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলি রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীদের আমন্ত্রণ করে নিয়ে যাচ্ছে বক্তৃতা দেবার জন্য। এতে বোঝা যায়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার উন্নতির সাথে সাথে মানুষ ধর্মের ব্যাপারেও আগ্রহী হচ্ছে।
ধর্ম আজও কেন টিকে আছে? নিরাপত্তার অভাব হলেই যে মানুষ ধর্মের দিকে ঝোঁকে এ-কথা পুরোপুরি সত্য নয়। সংকটের সময় অনেকে ধর্মকে আঁকড়ে ধরে ঠিকই, কিন্তু ধর্ম যদি সেই সংকট নিরসনে কিছুমাত্র সহায়ক না নয়, তবে মানুষ কেন বারবার ধর্মের দিকেই ঝোঁকে? মানুষ বিনা প্রয়োজনে কোন কিছুকে মেনে নিতে চায় না। ব্যবহারিক মূল্য না থাকলে মানুষ যে-কোনও জিনিসকেই কিছুদিন পর বাতিল করে দেয়। ধর্মের ক্ষেত্রে তা ঘটেনি কেন? দ্বিতীয়ত, বিস্ময় ও জিজ্ঞাসা মানবচেতনার অন্যতম মৌল আকুতি। জ্ঞান-বিজ্ঞানের শাখাগুলি যেন এক-একটি বিশাল গ্রন্থ যার প্রথম ও শেষ পাতা হারিয়ে গেছে। এই প্রথম ও শেষ প্রশ্নের সন্ধানেই মানুষ সবচেয়ে কৌতূহলী। এই বিস্ময় ও জিজ্ঞাসার সাথে ধর্মের একটা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সম্পর্ককে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তৃতীয়ত, মানুষ সুন্দরের পূজারী। সাধারণ মানুষ করুণা, প্রেম, প্রজ্ঞা, সরলতা ইত্যাদি যে চারিত্রিক গুণাবলি শ্রদ্ধা করে সেগুলিকে মূর্ত দেখতে চায় কোন মানুষের মাঝে। অধার্মিকদের ক্ষেত্রে এ-ধরনের মানুষ কম বলে সাধারণ মানুষ স্বাভাবিকভাবেই ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের দিকে ঝোঁকে। চতুর্থত, সাধারণ মানুষ সম্পূর্ণভাবে আস্তিক বা নাস্তিক হতে পারে না। মনের একাংশে সে আস্তিক, অন্য অংশে নাস্তিক। অনেক মনোবিশ্লেষক মনে করেন, নাস্তিকতা মানুষের মুখের কথা, মনের কথা নয়। চেতন ও অবচেতন মানসিক স্তরের পারস্পরিক ক্রিয়ার ফলেই তার ব্যক্তিত্ব গঠিত। এসব কারণে ও মানুষের জীবন-জিজ্ঞাসা যতদিন থাকবে ততদিন ধর্মেরও অস্তিত্ব থাকবে।
সমাজতত্ত্ববিদরা তাঁদের কার্যনির্বাহী তত্ত্বে (functional theory) ধর্মের কতকগুলি ব্যবহারিক ভূমিকার কথা বলেছেন। প্রথমত, সমাজে মূল্যবোধ ও আচারের দ্রুত পরিবর্তন ঘটলে মানুষ অসহায়বোধ করে। ধর্ম তখন ব্যক্তিজীবনে ও সমাজজীবনে নিরাপত্তাবোধ এনে দেয়। দ্বিতীয়ত, ধর্ম অনেককে জীবনের তাৎপর্য খুঁজতে সাহায্য করে এবং মানুষকে বিধিবন্ধনহীন ভাব (anomic, normlessness) ও বিচ্ছিন্নতাবোধ (alienation) হতে রক্ষা করে। তৃতীয়ত, সামাজিক সংহতি বজায় রাখার ক্ষেত্রে ধর্মের বিশেষ অবদান আছে। চতুর্থত, দৈনন্দিন জীবনের গ্লানি-দুঃখ ব্যর্থতা জয় করতে ধর্ম সাধারণ মানুষকে সাহায্য করে। পঞ্চমত, মানুষ অনেক সময় সামাজিক ও পারিবারিক অনুশাসন লঙ্ঘন করে বা বিধি-বহিভূর্ত আচরণ করে বিবেকের দংশন অনুভব করে। এর ফলে মানসিক ভারসাম্য অপরাধবোধ থেকে মুক্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে আসতে পারে। ষষ্ঠত, ধর্ম সৃষ্টিধর্মী কল্পনাশক্তি ও সৌন্দর্যতত্ত্বের সমর্থিত শিল্পকর্মে উৎসাহ দেয়।
এভাবে ধর্ম যেহেতু মানুষের ব্যক্তিগত ও সমাজজীবনের মৌল সমস্যার সংকটে বিরাট ভূমিকা নেয়, সেজন্য আগামী পৃথিবীতেও মানুষের কাছে ধর্মের প্রয়োজন থাকবে। এই প্রয়োজনীয়তা সুখী-দুঃখী, ধনী-দরিদ্র উভয়ের মাঝে সমভাবে অনুভূত হতে পারে। এ প্রসঙ্গে রুশ ঔপন্যাসিক ও ধর্মদর্শনের অবিস্মরণীয় চিন্তক লিও টলস্টয় মক্তব্য করেছেন :
‘বড়লোকের ঈশ্বর দরকার, কারণ ওটা ছাড়া তাদের সবকিছুই আছে। আবার গরীব লোকেরও ঈশ্বর দরকার, কারণ ওটা ছাড়া তাদের আর কিছুই নেই।’
তবে সেই সাথে এটাও ঠিক কথা যে সমাজ-পরিবর্তনের সাথে ধর্ম- আচরণেও পরিবর্তন আসবে। ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে ধর্ম কোন রূপ নেবে সে-সম্বন্ধে অনুমান করার আগে আগামী বিশ্বের আনুমানিক চেহারাটা জেনে নেওয়া যাক। এ- বিষয়ে সমাজতত্ত্ববিদ ও বৈজ্ঞানিকেরা অনেক ভেবেছেন। অলডাস হাক্সলির ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড বইটির পর এ ধরনের অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে। এই বইগুলির মধ্যে আলভিন টফ্লারের ফিউচার শক্ বইটি (Alvin Toffler : Future Shock, 1970) উল্লেখযোগ্য। এই বইয়ে বর্ণিত আগামী পৃথিবীর সমাজ নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে টলার বলছেন : প্রতিটি প্রজন্মের বড় হওয়ার সাথে পূর্ববর্তী প্রজন্মের সাথে যেমন জেনারেশন গ্যাপ্ (generation gap) ঘটে যায়, আগামী বিশ্বের সাথে বর্তমান বিশ্বেরও তেমনি এই গ্যাপ দেখা দেবে। বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির দ্রুত উন্নতির ফলে ভবিষ্যতে প্রধানত চারটি বিষয়ের লক্ষণীয় পার্থক্য দেখা দেবে— বাসস্থান (places), মানবিক সম্পর্ক (people), ব্যবহার উপযোগী বস্তু (things) এবং তথ্যজ্ঞান (information)। মানুষের জীবনে দেখা দেবে ক্ষণিকতার (transience, temporatiness) বাহুল্য। নগরায়নের (urbanisation) ব্যাপকতা বাড়ছে, প্রতি দশকে শহরবাসীর সংখ্যা দ্বিগুণ হচ্ছে। ভবিষ্যতে সারা বিশ্বে এই প্রবণতা বাড়বে এবং মানুষ তখন পরিণত হবে the new nomads-এ। বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির দ্রুত উন্নতির সাথে সাথে টেকনিক্যাল ও প্রোফেশনাল ব্যক্তিদের মধ্যে এই ঝোঁক বর্তমানেই দেখা যায়। ভবিষ্যতে পৃথিবীতে এর ফলে মানুষের মধ্যে loss of commitment দেখা দেবে। মানুষ কোন বিশেষ জাতীয়, ঐতিহ্যগত, সামাজিক আদর্শে ধারক না-হয়ে বিশ্বজনীন (internation) হয়ে ওঠবে কিংবা মতাদর্শের ক্ষেত্রে ভাসমান (fluid, flying) দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেবে। টফলার প্রশ্ন করেছেন— এই পরিস্থিতিতে মানুষের ব্যক্তিগত জীবন ও সমাজ জীবনের পরিণতি কী? কোন কমিটমেন্ট ছাড়া ব্যক্তি অথবা সমাজ কি টিকে থাকতে পারবে? এই সমস্যার সাথে সাথে মানুষের মধ্যে early disaffiliation দেখা দেবে। বিবাহবিচ্ছেদের হার বাড়বে, পারিবারিক সম্পর্ক বেশিদিন টিকবে না, বন্ধুর সংখ্যা বাড়বে কিন্তু ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সংখ্যা কমবে। ফলে নিঃসঙ্গতা ও বিচ্ছিন্নতা বাড়বে, তৃপ্তিদায়ক স্থায়ী মানবিক সম্পর্ক (deep satisfying emotional involement) কমবে। তৃতীয়ত, অসংখ্য রকম ব্যবহারোপযোগী পণ্য বাজারে দেখা দেওয়ায় সমাজে ক্ষণিকতার সংস্কৃতি দেখা দেবে, অর্থাৎ মানুষ কোন জিনিসই দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করবে না। বর্তমানে ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলিতে দেখা যায়, প্রতিটি জিনিসই এমনভাবে তৈরি করা হচ্ছে যাতে সেটি কিছুদিন ব্যবহার করেই ফেলে দিতে হয়। কলম, ঘড়ি, বোতল, তোয়ালে, গাড়ি কাপড় ইত্যাদির ক্ষেত্রে এটি লক্ষ্য করা যায়। টফলার বলছেন, এর ফলে তিনটি সমস্যা মানুষের দৈনন্দিন জীবনে দেখা দেবে— পছন্দ করার ক্ষেত্রে অত্যধিক সংখ্যায় একই রকম পণ্যের উপস্থিতি, পণ্য বাছতে গিয়ে হতভম্ভকর অবস্থা, এবং সামান্য বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া। চতুর্থ, জ্ঞানের পরিধি অত্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পড়বে। প্রতি দশকে সাধারণ জ্ঞান ও তথ্যের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে এবং এভাবে মানুষের ওপর information-এর বোঝা বাড়ছে। জ্ঞানের পরিধি-বিস্তৃতি ও নিত্য নতুন জ্ঞান আবিষ্কৃত হওয়ায় মানুষের মস্তিষ্কের ওপর যে চাপ পড়বে তাকে মানুষ কতটা সহ্য করতে পারবে? প্রযুক্তি বদলে দেবে আগামী বিশ্বের মানুষের জীবনযাত্রা। সেই সাথে ধ্যান-ধারণাও। চিন্তায় আনবে নানা পরিবর্তন-বিবর্তন। ধর্ম-চিন্তায় এর প্রভাব পড়বে।
ক্লোনিংয়ের বদৌলতে শিঘ্রই জন্ম নিবে পিতৃমাতৃহীন মানব-সন্তান। মানব শরীরে প্রতিস্থাপনের জন্য টিস্যু ইঞ্জিনিয়াররা অর্ডার-মাফিক তৈরি করবে কৃত্রিম ত্বক, যকৃৎ, অস্ত্র, হৃৎপিণ্ড, নাক, কান ইত্যাদি। জিন টেস্টিংয়ের মাধ্যমে ক্যান্সার, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস রোগের আগাম লক্ষণ শনাক্ত করা যাবে। শনাক্ত করা যাবে মানুষের মনের ভাবনা ও বিশ্বাস। উপাসনালয় থেকে প্রার্থনা শেষে বহির্গমন পথে বসানো Faith Reading মেশিন শনাক্ত করে দেবে ধর্মাচারির মনের উদ্দেশ্য।
এভাবে আগামী বিশ্বের সভ্যতায় মানুষ সবদিক থেকে ক্রমাগত পরিবর্তনের মুখোমুখি হবে, এটি তাকে অসুস্থ করে তুলবে। কেবল মানসিকভাবেই নয়, শারীরিক দিক থেকেও নানান অসুখ দেখা দেবে, কারণ চোখ-কান ও দৈহিক সামর্থ্যের প্রবল চাপ পড়বে। পরিবেশে নিত্যনতুন বস্তুর আধিক্য হলে মানুষের শরীরে অ্যাড্রেনালিন বেড়ে যাবে। হৃৎপিণ্ডের কম্পন বাড়বে, হাত প্রায়ই ঠাণ্ডা হয়ে যাবে, মানুষ anxiety neurotic হয়ে পড়বে। এবং এর ফলে দুশ্চিন্তা, অব্যবস্থা চিত্তের ভাব, খিটখিটে হয়ে ওঠা, হিংসা ও নিরাসক্ত ভাব বাড়বে, হিংসাত্মক রাজনীতি ছড়িয়ে পড়বে। পণ্যের প্রাচুর্য মানুষের মধ্যে emotional withdrawal বাড়িয়ে দেবে।
আগামী বিশ্বের উন্নত সমাজের সমস্যার সমাধানে ধর্ম এক বিশেষ ভূমিকা নিতে পারে। বিলাসিতা ত্যাগ করা, স্বামী-স্ত্রী-সন্তানের সম্পর্ককে পবিত্র বলে গণ্য করা, বাঙালির পালা-পার্বণের মত উৎসব অনুষ্ঠান যান্ত্রিক সভ্যতায় জীবনের মূল্যবোধগুলির নিত্য পরিবর্তনের পাশ্চাত্ত্যদেশবাসী শাশ্বত কোন কিছুর সন্ধান করছে, এবং নিজস্ব আইডেন্টিটির খোঁজেই মানুষের মধ্যে নতুন করে ধর্মপ্রীতি দেখা যাচ্ছে। ভবিষ্যৎ সমাজেও ধর্মের এই ভূমিকা অবাহত থাকবে। বাসস্থান ও আত্মীয়-বন্ধু সম্পর্কের ক্রমাগত পরিবর্তনে এবং পণ্যের প্রাচুর্যে মানুষের মনে যে জীবনজিজ্ঞাসা জাগবে, ধর্ম তাকে সে বিষয়ে সাহায্য করতে পারবে। ব্যক্তিগত জীবনে loss of এবং early disaffiation-এর সমস্যা সমাধানে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও মানবিকতা মানুষকে রক্ষা করতে পারবে। মানুষের হতাশা-দুশ্চিন্তা-অসহিষ্ণু ভাব দূর করার জন্য কেবল ওষুধ ব্যবহার করে লাভ নেই, যদি না মানুষ তার নিজস্ব শক্তিতে এগুলি জয় করতে শেখে। ধর্মে যে অহৈতুকী প্রীতির কথা রয়েছে, প্রকৃতির প্রতি বিস্ময়বোধ রয়েছে, স্থিতপ্রজ্ঞের কথা বলা হয়েছে এবং সর্বোপরি নিরন্তর আশ্বাসের কথা আছে, এগুলি ভবিষ্যৎ মানুষের কাছে খুবই প্রয়োজনীয় হয়ে দেখা দেবে। টলার যদিও আগামী পৃথিবীর মন্দ দিকগুলি তুলে ধরেছেন, তবুও এর ভাল দিকও অনেক রয়েছে। জ্ঞানের প্রসারের সাথে সাথে মানুষ তখন আরও বেশি করে প্রকৃতির রহস্য জয় করবে এবং তার বিশ্বদৃষ্টিও প্রসারিত হবে। ফলে পুরনো সংস্কারগুলির অনেকটা দূর হবে। বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে অধিকাংশ কাজ যন্ত্রের সাহায্যে হবে এবং উদ্বৃত্ত সময় বেড়ে যাবে। ফলে ভোগের দিকে যেমন কিছু মানুষের অত্যধিক নজর থাকবে, সেই সাথে ক্রমাগত ভোগে বিতৃষ্ণা আসার ফলে মানুষ জীবন-জিজ্ঞাসু হয়ে উঠবে। স্বভাবতই সে তখন ধর্ম সম্বন্ধে আরও অনুসন্ধানী হয়ে উঠবে। ধর্মের আচার-অনুষ্ঠানে সে তৃপ্ত না থেকে আরও গভীর গিয়ে জানতে চাইবে ধর্মের মূল রহস্য। জ্ঞানের পরিধি বাড়ায় কোন একটি বই বা মানুষে সমস্ত সত্য নিহিত আছে এ- কথা জানতে না চেয়ে নিজে পরীক্ষা করে দেখতে চাইবে, সত্য কী? তবে জিজ্ঞাসুর সত্যানুসন্ধানে এই মর্মার্থ উদ্ভাসিত হোক- ‘Truth lies in the progressive expansion of meaning’ ।
মার্কসের বিশ্বাস ছিল যেদিন শ্রমিকরা জুলুমের শিকল ভেঙ্গে ফেলবে সেদিন ধর্ম ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। যেমন— শ্রমিকরা ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে পরিচালিত সমাজের নেতৃত্ব গ্রহণ করবে তখন ধর্মের আর প্রয়োজন থাকবে না। কারণ ধর্ম হচ্ছে বঞ্চিতদের আশ্রয় আর তখন বঞ্চিত বলতে কেউ থাকবে না। ধর্ম হাওয়া হয়ে যাবে কারণ তখন মানুষ বুঝবে যে পরকালের চিন্তাকে অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে। তারা এই পৃথিবীতে শ্রমিকদের স্বর্গের উন্নতিতে নিজেদেরকে উৎসর্গ করে দেবে (De George 1968 )।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় এলেও অনেক দেশেই ধর্মকর্ম বজায় থাকে। প্রথমে নেতারা মনে করেছিলেন এটা বিগত দিনের চাপ মাত্র, শীঘ্রই বাতাসে মিলিয়ে যাবে। বৃদ্ধরাই হয়ত আঁকড়ে ধরে থাকবে আর তরুণরা এটা ছেড়ে দেবে। আগামী প্রজন্ম আসতে আসতে এটা বিলীন হয়ে যাবে। নাস্তিক্যবাদ প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ মার্কসবাদীরা চায় ধর্ম আপনা আপনি নিঃশেষ হয়ে যাক। কারণ তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল এটাকে মিটিয়ে দিতে (মনে রাখতে হবে মার্কস কিন্তু নিজেকে মার্কসবাদী বলে নি। সে ধর্মের উপর নির্যাতন চালানোর পক্ষপাতিও ছিলেন না। কেননা তিনি বলেছিলেন ধর্ম আপনা আপনি বিলীন হয়ে যাবে)। সোভিয়েত ইউনিয়ন সরকার চার্চসমূহ দখল করে সেগুলোকে জাদুঘর কিংবা সরকারি অফিসে পরিণত করে। স্কুল সিলেবাস তৈরি করা হয়েছিল ধর্মকে হেয় করার জন্য এবং আগেই যেমনটা দেখেছি নিজস্ব আদলে বিবাহ প্রথারও আয়োজন করেছিল (যেখানে লেনিনের পূর্ণদৈর্ঘ্য মূর্তি থাকবে) শিশুদের ধর্মীয় দীক্ষায় বিকল্প হিসেবে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের আয়োজনও করেছিল। ধর্মযাজকদের রাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে জেলে পাঠানো হয়েছিল এবং কোন পিতা-মাতা যদি সন্তানদের ধর্মীয় শিক্ষা দান করত তাহলে তাকে গ্রেফতার কিংবা চাকুরিচ্যুত করত। তাদের সন্তানদের ছিনিয়ে নিয়ে ‘সত্য’ শিক্ষা দিতে রাষ্ট্রই তাদের লালন পালন করত।
এত জোড়জুলুম সত্ত্বেও ধর্মের শক্তি কোন অংশে কমে নি। তাই সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরও দেখা যায় রাশিয়ার তিন চতুর্থাংশ লোক বিশ্বাস করত ঈশ্বর বলতে একজন আছেন এবং এক-তৃতীয়াংশ বিশ্বাস করত স্বর্গ বলতেও কিছু আছে।
চিন্তাবিদদের অন্য একটি দল যারা সমাজতন্ত্র কিংবা কম্যুনিজম কোনকিছুতে বিশ্বাস না করে শুধুমাত্র বিজ্ঞানে বিশ্বাস করত তারাও ধর্মের অনুরূপ একটি বিলুপ্তির কথা ভেবেছিল। বিজ্ঞান যতই আগে তাড়াবে ততই সব কিছুর জবাব দিতে সক্ষম হবে। বিজ্ঞান নিয়ে আসে মানুষের চিন্তাধারায় পরিবর্তন এবং তা একসময় ধর্মের জায়গা দখল করে নিবে। তবে তা রীতিমতো ভুল প্রমাণিত হয়। এ প্রসঙ্গে ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে Anthony Wallace যিনি একজন প্রখ্যাত নৃবিজ্ঞানী ছিলেন। তিনি বলেন— ‘The evolutionary future of religion is extinction. Belief in supernatural beings…. will become only an interesting historical memory…. doomed to die out, all over the world, as a result of the increasing adquacy and diffusion of scientific knowledge’। অর্থাৎ, ধর্মের বিবর্তনমূলক ভবিষ্যৎ হচ্ছে বিলুপ্তি, অপ্রাকৃতিক সত্তায় বিশ্বাস চটকদার ঐতিহাসিক স্মৃতিতে পরিণত হবে…. পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ মুছে যাবে, আর তার পেছনে মুখ্য ভূমিকা থাকবে বৈজ্ঞানিক বিদ্যাচর্চার অপর্যাপ্ততা। Marx, Wallance এবং অন্যান্য সমাজতাত্ত্বিকরা যারা এমনটা ভেবেছিলেন তারা সবাই ভুল প্রমাণিত হয়েছেন।
মানবজাতির প্রশ্ন ছিল তারা জানে তাদের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ রয়েছে। এগুলোকে বোঝার জন্য তারা নিজেদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে চায়। জীবন নিয়ে চিন্তা করার সময় যে প্রশ্নটা সর্বপ্রথম তাদের মাথায় আসে সেটা হচ্ছে জীবনের উদ্দেশ্যটা কি? তারা জন্মায় কেন? পরকাল বলতে কি কিছু আছে? যদি তাই হয় তবে তা কেমন হবে? এসব চিন্তা সমষ্টি থেকে আরেকটি প্রশ্ন উঠে যদি ঈশ্বর বলতে কিছু থাকেন তাহলে তিনি কী চান? উনি কী চান আমরা কোন নির্দিষ্ট পন্থায় জীবনযাপন করি? বিজ্ঞান এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে অক্ষম। নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের কারণ বিজ্ঞান মানবজাতির চার প্রধান প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না। ১. ঈশ্বরের অস্তিত্ব (The existence of God), ২. জীবনের উদ্দেশ্য (The purpose of Life), ৩. নৈতিকতা (Morality), ৪. পরকাল (The existence of an afterlife)। প্রথমটার প্রশ্ন সম্বন্ধে বিজ্ঞানের কিছু বলার নেই। কোন টেস্ট টিউবের মাধ্যমে মানবশিশু জন্মালেও আল্লাহর অবদান অস্বীকার করা যায় না। দ্বিতীয়টার ব্যাপারে বলতে গেলে, বিজ্ঞান জীবনের একটা সংজ্ঞা এবং জীবিত কোষসমূহের বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করতে পারলেও জীবনের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে কিছুই বলতে পারবে না। চতুর্থটার ক্ষেত্রে বিজ্ঞান কিছুই বলতে পারবে না কারণ পরকাল নিয়ে ঘাটাঘাটি করার ন্যূনতম ইচ্ছাও বিজ্ঞানের নাই।
বিজ্ঞান কখনো ধর্মের বিকল্প হতে পারে না। রাজনৈতিক কোন ধারার পক্ষেও তা সম্ভব নয় সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে ঘুরেও মানুষ তা বুঝতে পেরেছে। আর বিজ্ঞানের এটাও প্রমাণ করার ক্ষমতা নেই যে পরিবার কিংবা প্রতিবেশীদের আঘাত করা কিংবা হত্যা করার চেয়ে তাদের ভালোবাসাই উত্তম। মৃত্যুর বর্ণনা দিতে পারবে হয়ত এবং এর জৈবিক পরিণতিও বিশ্লেষণ করতে পারবে কিন্তু কোন কাজের নৈতিক উৎকর্ষতার ন্যূনতম ব্যাখ্যা দেওয়াও তার পক্ষে সম্ভব নয়।
সন্দেহ নেই যে, মানবজাতি যতদিন থাকবে ধর্মও ততদিন থাকবে কিংবা যতদিন পর্যন্ত মানুষ কার্যকরী বিকল্প খুঁজে পাবে ততদিন পর্যন্ত ধর্ম থাকবে। তবে এসব বিকল্পের যদিও ভিন্ন ভিন্ন নাম থাকে তাদেরকেই কি ধর্মের আরেকটি রূপ বলা যায় না?
বর্তমানে অধ্যায়ে আলোনার আলোকে দেখা যাচ্ছে, ধর্মগ্রন্থ যদি যুগের চাহিদা মিটাতে না-পারে তবে সেখানে বিকল্প পথের সুড়ঙ্গ সৃষ্টি হবে সেটাই স্বাভাবিক। মানুষের স্বাধীন চিন্তা ও জ্ঞানের অগ্রগতিতে বাধাগ্রস্ত হলেই জ্ঞানতৃষ্ণা মিটানোর প্রয়োজনে জীবন জিজ্ঞাসার উত্তর অনুসন্ধানের জন্য সে আরো সন্ধিৎসু হয়ে ওঠে। এই সন্ধিৎসায়ই সৃষ্টি হয় নব নব আবিষ্কার–উন্মোচিত হয় নব নব দিগন্তের সম্ভাবনা—এগিয়ে চলে সভ্যতার অগ্রগতির চাকা। যুগ যুগ ধরে মানুষ দেখেছে বিজ্ঞানের অনুশীলনের সাফল্যে মানুষের জীবনমান এগিয়ে যাচ্ছে— ধর্মানুশীলনে নয়। ধর্মগ্রন্থ অনুশীলন করে আজ পর্যন্ত কোন ধার্মিক মানবিক কল্যাণে ব্যবহৃত হতে পারে এমন কোন কিছুই আবিষ্কার করতে পারেনি। অথচ আল কোরআনেই মহান স্রষ্টা ঘোষণা করেছেন : ‘আমি কোন কিছুই বিনা কারণে সৃষ্টি করি নাই’। তাহলে মানুষের অনিষ্ট করে এমন অসংখ্য কীট-পতঙ্গ, মশা-মাছি; জীবনবিনাশী জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প, দুর্ভিক্ষ-মহামারি ইত্যাদি সহস্র অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় আছে তা তিনি কেন সৃষ্টি করেছেন? তার উত্তর অনুসন্ধান করে এর থেকে পরিত্রাণের উপায় উদ্ভাবন কে করেছে? কোরআন গবেষকদের এখানে ভূমিকা কি? ধার্মিকদের এখানে কোন অবদান নাই কেন? ধর্মশাস্ত্রে প্রচুর পাণ্ডিত্য আছে, এমন ব্যক্তিদের মধ্যে থেকে কেন বিজ্ঞানী জন্মে না? বিজ্ঞানীদের কঠিন অনুশীলনের ফলে যখন কিছু আবিষ্কার হয়ে যায় তখন ধার্মিকরা দাবি উত্থাপন করে বলে ওঠেন, ‘ওই আবিষ্কারের ফর্মূলা আমাদের ধর্মগ্রন্থ থেকেই নেয়া হয়েছে।’ তাহলে এরা অলসচিত্তে দাবিদারের ভূমিকায়ই থাকবে চিরকাল- আবিষ্কারে এগিয়ে আসার মেধা এঁদের নেই! তাই এদের জন্য প্রার্থনা— ‘রাব্বি জিদনি এল্মা।’
নির্বাচিত গ্রন্থপঞ্জি
J. W. Draper, History of the Conflict Between Religion and Science; London, 1923
A. D. Lindsay, Religion, Science and Society in the Modern World; Oxford, 1943
Bertrant Russell, Religion and Science; New York, 1961
M. R. Thompson, Religion and Science; London, 1989
W. M. Richardson, Religion and Science History, Method, Dialogue; London, 1998
I. G. Barbour, Religion and Science Historical and Contemporary Issues, London, 1998
Dr. Parvez Hoodboy, Foreward in Science and Islam; Zeed Books, London, 1999
Syed Misbah Din, Science Under Islam Rise, Decline and Rivival; Lulu Edition, London, 2০12
স্বামী সোমেশ্বরানন্দ, ধর্ম কুসংস্কার ও লোকাচার; পুস্তক বিপণি, কলকাতা, প্ৰ. প্র. ১৯৮৩
মৌলবাদ ও বিজ্ঞান, পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ; প্র. প্র. ১৯৮৯
স্টিফেন ডব্লিউ হকিং, কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস (ভাষান্তর : শত্রুজিৎ দাশ গুপ্ত); বাউলমন প্রকাশ, কলকাতা, ১৯৯৩
জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায়, সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ভগবদ্গীতা; এলাইড পাবলিশার্স লিমিটেড, কলকাতা, প্র.প্র. ১৯৯৪
স্টিফেন হকিং, কৃষ্ণ গহ্বর এবং শিশু মহাবিশ্ব ও অন্যান্য রচনা; ভাষান্তর : শত্রুজিৎ দাশ গুপ্ত; কলকাতা, ১৯৯৫
মরিস বুকাইলি, বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান (রূপান্তর : আখতার-উল-আলম) জ্ঞানকোষ প্রকাশনী, ঢাকা ১৯৯৫
জয়ন্তানুজ বন্দোপাধ্যায়, ধর্মের ভবিষ্যৎ; এলাইড পাবলিশার্স লিমিটেড, কলকাতা, প্র.প্র. ১৯৯৫।
সমরেন্দ্র নাথ সেন, বিজ্ঞানের ইতিহাস; শৈবা প্রকাশন, কলকাতা, ১৯৯৬
গর্ডন চাইল্ড, ম্যান মেকস হিমসেলফ (ভাষান্তর : মগন দাস), দীপায়ন কলিকাতা, ১৯৯৯
মনিরুল ইসলাম, বিজ্ঞানের মৌলবাদী ব্যবহার; সংহতি (দ্বি. স.) ঢাকা ২০১১
কাজল বন্দ্যোপাধ্যায় (সম্প.) ধর্ম প্রসঙ্গে : মার্কস, এঙ্গেলস, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০১২
কাজল বন্দ্যোপাধ্যায় (সম্প.) ধর্ম প্রসঙ্গে : লেলিন, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০১২
এম. মতিউর রহমান, ধর্মদর্শন পরিচিতি; জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০১৪
গালিব আহসান খান, বিজ্ঞানের দর্শন; জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০১৪
প্রফেসর মতিয়র রহমান, সৃষ্টিরহস্য উন্মোচনে বিজ্ঞান; মুক্তচিন্তা, ঢাকা, ২০১৭