বালিশের নিচে মানকচুপাতা দিয়ে আবদুল আজিজের ছেলের মাথায় পানি ঢালছিলো শরাফত মণ্ডলের দ্বিতীয় বিবি। হুমায়ুনের ভিজে মাথায় চুলে সে বিলি কাটছে বা হাতে। ঠাণ্ডা পানির অবিরাম ধারায় ছেলেটি চোখ বন্ধ করে রয়েছে, ঘুমিয়েও পড়তে পারে। কিন্তু শরাফত ও কাদের ঘরে ঢুকতেই সে চোখ মেললো। চোখ তার টকটকে লাল, লাল রঙে যন্ত্রণার দাগ। কাদের কথা বলতে পারে না, তার খিদাও মনে হয় মরে গেছে। শরাফতের ছোটোবিবি স্বামী ও সৎ ছেলের দিকে একবার তাকিয়েই পানি ঢালা অব্যাহত রাখে। বিছানায় ছেলের শিয়রে বসেছে আজিজের বৌ হামিদা, কিছুক্ষণ পর পর আঁচলে মুখ চেপে সে কান্না সামলাচ্ছিলো। শ্বশুর ও দেওরকে দেখে ভিজে আঁচলটা মাথায় বেশি করে চাপাতে চাপাতে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে এবং ফোঁপাতে ফোঁপাতেই বলে, এই অজপাড়াগাঁয়ে ছোলেক থুয়্যা কোথায় গেলো, এখন কী করি?
অসুস্থ ছেলে এবং একমাত্র মেয়েকে বাড়িতে রেখে আবদুল আজিজ চলে গেছে কর্মস্থলে। বৌ তো তার আগে থেকেই বাড়িতে ছিলো, ভাদ্র মাসে আউশ উঠলে এসেছে, আমন ধান তোলা পর্যন্ত থাকবে। এ্যানুয়াল পরীক্ষা দিয়ে ছেলেমেয়েরা বাড়ি আসবে, এই কয়েকটা মাস মাকে ছাড়াই তাদের থাকার কথা। এখন ছোটো ছেলের ঘুসঘুসে জ্বর চলতে থাকায় তার সেবাযত্ন করা আজিজের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ছে। এসব কি পুরুষমানুষের কাজ? ওদিকে জয়পুরে আবার মাছ ভালো পাওয়া যায় না। এক পটলটাই যা মেলে, আবার পটল আর আলু ছাড়া আর সব তরকারি সেখানে নিরেস। বাজারের তরকারিতে কি আর স্বাদ হয়। এখানে বাড়িতে নিজেদের বিল, উঠানে হাঁসমুরগির লেখাজোকা নাই। মায়ের কোলে বসে দিন কয়েক শিংমাগুরের ঝোল আর ঘরের মুরগি আর খেতের তরকারি খেয়ে ছেলে ঝরঝরে হয়ে উঠবে,-এই ভরসাতেই আজিজ তাকে বাড়িতে রেখে গেলো। তা এখানে এসে ভালোর দিকেই তো যাচ্ছিলো। মেয়াদের জ্বর ঘণ্টা তিনেকের বেশি থাকে না, কটা দিন তো দুপুরের জ্বর আসতে আসতে আসরের ওক্ত পেরিয়ে যাচ্ছিলো। ছেলেটা দাদীর ন্যাওটা। অনেক রাত্রে জ্বর ছেড়ে গেলে মায়ের পাশ থেকে উঠে সোজা এসে শুয়ে পড়েছে দাদীর ঘরে, তার কোল ঘেঁষে। রোগ তো তার সেরেই যাচ্ছিলো, দাদী তাকে চুপচুপ করে এক দিন ইলিশ মাছের সর্ষেবাটা দিয়ে ভাতও খাইয়ে দিয়েছে। তাতেও কিন্তু জ্বর তখন তার বাড়ে নি।
কিন্তু আজ দুপুরবেলা থেকে তার গা গরম। রান্নাঘরে খেতে বসে কাঁপতে কাঁপতে পিঁড়ি থেকে পড়ে যাচ্ছিলো, দাদী ধরে না ফেললে মাটিতে গড়িয়েই যেতো। তারপর থেকে তার প্রবল কাঁপুনি, জ্বরও বেড়ে যাচ্ছে ধা ধা করে। সকালে তাকে বারান্দার রোদে বসতে দেখে হামিদার একটু ভয় হয়, আবদুল কাদেরকে দিয়ে থার্মোমিটারে জ্বরটাও দেখিয়ে নিলো। তেমন কিছু হলে কাদের নিশ্চয়ই বলতো। এদিকে কাদের ছাড়া বাড়িতে কেউ থার্মোমিটার দেখতে জানে না। কিন্তু গায়ে হাত দিয়েই বোঝা যায় জ্বরে তার গা পুড়ে যাচ্ছে।
উঠানের ওপারে পুবদুয়ারি ঘরে শুয়েছিলো শরাফত মণ্ডলের প্রথম বিবি, আবদুল আজিজ ও আবদুল কাদেরের মা। চিরকালের নিয়ম অনুসারে বাড়িতে অসুখ দেখেই সে শয্যা নিয়েছে। জ্বরতপ্ত মানুষের মতো অবিরাম কথা বলে চলেছে এবং সেগুলোকে প্রলাপ বলে বাতিল করা যায় না। তার কথার সিংহভাগ জুড়ে তার স্বামীর নামে নানারকম নালিশ। নাতির রোগের প্রকোপ বাড়তে বাড়তে তার নালিশ চড়ে যায়–সরাসরি গালাগালির পর্যায়ে। যেমন, সারাদিন খালি জোতজমি আর সম্পত্তি তার মাথাত কুটকুট করিচ্ছে। বেটা হামার ব্যারামি ছোলটাকে গুয়্যা গেলো, তার জন্যে একটা ওষধু লয়, পথ্যি লয়, পানিপড়া লয়, পীরমুনসি লয়। জ্বর কি তোমার কামলা কিষাণ না চাকরবাকর? তুমি হুকুম করলা আর জ্বর গেলো?
উঠান পেরিয়ে বড়োবিবির নালিশ এই ঘরে এসে ধাক্কা খায় হুমায়ুনের মায়ের বিলাপের সঙ্গে, বাবা আমার, আব্বা আমার। এখন কেমন ঠেকিচ্ছে বাবা?
মায়ের ব্যাকুল ডাকে চোখ মেলে হুমায়ুন জড়িয়ে জড়িয়ে বলে, মা, আজ ডিমভাজা দিয়া ভাত দিবা না মা?
শূন্যের সঙ্গে ডিমের সাদৃশ্য থাকায় হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষার কয়েকটা দিন ছেলেকে স্কুলে যাবার সময় ভাতের সঙ্গে ডিম দেয় নি বলে আফসোসে হামিদা হাপুস নয়নে কাঁদে এবং রোগ সেরে গেলে তাকে রোজ, এমন কি এ্যানুয়াল পরীক্ষার সময়েও দুটো করে ডিম দেওয়ার মনস্থ করে। মায়ের কান্না এবং সংকল্পকে অগ্রাহ্য করে জ্বরের ঘোরের হুমায়ুন বিড়বিড় করে, আজ খালি ডিম খায়া যাই মা। ভাত খাবো না। আজ তো হাফ ইস্কুল।
এইসব এলোমেলো কথায় সবাই ঘাবড়ে যায় এবং টিনের বেড়ায় লাগানো কাঠের তাকে থার্মোমিটার খুঁজতে গিয়ে আবদুল কাদের মেঝেতে ফেলে দেয় শরাফতের মদনমঞ্জরি বড়ি আর চ্যবনপ্রাসের দুটো কৌটা এবং ওষুধ খাবার খলনুড়ি। কিছুই ভাঙে না, এমন কি কৌটাগুলোর ঢাকনিও খুলে পড়ে না। তবে কাদেরের বুকটা কাপে। অনেকটা সময় নিয়ে ভালো করে ঝেড়ে থার্মোমিটার সে গুঁজে দেয় হুমায়ুনের বগলে। তার মাথায় পানি ঢালার বিরতি ঘটে এবং এতে এই ঘরের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা উঠান পেরিয়ে ঘা দেয় পুবদুয়ারি ঘরে। বড়োবিবি তার নালিশ ফের চড়িয়ে দেয় গালাগালিতে, এই কিপটা বুড়া কারো ব্যারাম হলে একটা পয়সাও খরচ করবি না। কঞ্জুস বুড়া পয়সা জমায় কার জন্যে? হামি কিছু বুঝি না, না? বুড়া বয়সে জোয়ান বৌ আনিছো ঘরত, তার নামে ব্যামাক সম্পত্তি লেখ্যা দেওয়ার মতলব করে। হামি বুঝি না? চান্দে চান্দে কাছারিত যায় কিসক, আমি বুঝি না? কার নামে ব্যামাক দলিল করিচ্ছে, হামি ইগলান বুঝি না? তোমার বেটাবেটি লাতিপুতি মরলে তুমি খুশি, ব্যামাক সাফ হয়া যাক, তুমি থাকো তোমার জোয়ান বৌ লিয়া!
তার অভিশাপ পৌঁছে যায় রোগীর ঘরে এবং অ বৌ, ধরো তো বলে পানির বদনা হামিদার হাতে দিয়ে ছোটোবিবি ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দা হয়ে উঠানে নামে এবং দুই হাত কোমরে রেখে দাঁড়ায় পুবদুয়ারি ঘরের দিকে মুখ করে। তারপর শুরু করে তার একটানা কথা, মুখ সামলায়া কথা কও আজিজের মাও। তোমার বুড়ার সম্পত্তিত হামি প্যাশাব করি, প্যাশা করি। বলতে বলতে তার কোমর থেকে হাঁটু পর্যন্ত সে এমনভাবে দোলায় যে মনে হয়, তার সংকল্পটি এক্ষুনি কার্যকর করতে যাচ্ছে। তবে বর্ষণ না হলেও গর্জন তার চলতেই থাকে, হামার বাপের ট্যাকা লিয়া বুড়া কতো জমি কিনিচ্ছে, সেই খবর তুমি রাখো? হামার নামে জোত করার কথা কয়া বাপজানের কাছ থাকা ট্যাকা লিয়া দলিল করে লিজের নামে। আজই বুড়া চোখ মোঞ্জে তো সম্পত্তি ভোগ করবা তুমি আর তোমার বেটাবেটি।
শরীরের রাগ ভালোভাবে ঝেড়ে ফেলে ঘরে এসে রোগীর শিয়রে বসে ছোটোবিবি কাঁসার বদনাটা ফের নিজের হাতে নেয় এবং আগের মতো একই ধারায় পানি ঢালতে থাকে হুমায়ুনের মাথায়।
কিন্তু থার্মোমিটারে জ্বর দেখে মুখ অন্ধকার করে আবদুল কাদের আড়চোখে তাকায় হামিদার দিকে, এতো পানি ঢালার পরেও ছেলেটার এতো জ্বর? বিচলিত হয়ে বড়ো বড়ো পা ফেলে খোলা থার্মোমিটার হাতেই সে চলে যায় খানকা ঘরে। সেখানে জলচৌকিতে আসরের কাজা নামাজ পড়তে বসেছে শরাফত মণ্ডল। কাদের দাড়িয়ে ছটফট করে। টের পেলেও শরাফতের নামাজের বিরাম নাই, রাকাতের পর রাকাত নামাজ সে পড়েই চলে। অনেকক্ষণ ধরে মোনাজাত করে উঠে দাঁড়িয়ে জায়নামাজ ভাজ করতে করতে শরাফত বলে, তুমি সাইলেকটা লিয়া যাও। হরেনেক সব বুঝায় বললে হরেনই সাব্যস্ত করবি; আর কোনো ডাক্তারের কাছে যাওয়া লাগে কি-না ওই কয়া দিবি। তবে ওক একবার লিয়া আসবা। বলতে বলতে শরাফত বারান্দায় যায়। বাইরে উঠানের আমতলায় বুলুর বেটাকে ডাংগুলি খেলার কাঠি চেঁছতে দেখে তাকে সে ধমক দেয়, এই ছেড়া, খালি খেল্যাই বেড়াস। গোরুর প্যাট ওঠে না কিসক রে? তখন দেখি বকনাটা চারির তলা চাটিচ্ছে, জাবনা কি তোর প্যাটত সান্দাছু? প্রায় একই স্বরে একটু নিচু গলায় ছেলেকে নির্দেশ দেয়, কামলাপাট লিয়া যাও। কাছারি থ্যাকা আসার সময় দেখলাম অজিত সাইকেল লিয়া পশ্চিমমুখে যাচ্ছে। কালুর বাপ না হয় ঘোড়াটা লিয়া তোমার সাথে যাক। হরেনের সাইকেল ঘরত না থাকলে ওই ঘোড়াত চড়া আসবি। হরেন আর বছরও ঘোড়াত করাই রোগী দেখবার গেছে, সাইকেল কিনলো তো উদিনকা।
বাড়ির সামনের পাগাড়ের ওপারে বেগুনখেতে কাজ করছিলো কালুর বাপ। বুলুর বেটা তাকে ডাকতে গেলে হঠাৎ করে হুরমতুল্লার নাতির জন্যে কাদেরের সুপারিশের কথা মনে পড়ে শরাফতের, কাদের, তখন তুমি না কার কথা কচ্ছিলা? আরে কী নাম। কল্যা? আরে মোসলমান কোন ডাক্তার, ছাইহাটার কোন ডাক্তারের কথা তখন কল্যা না?
করিমের কথা কন? আবদুল করিম? নাম ঠিকঠাক বলতে পারলেও আবদুল কাদের ওই ডাক্তারকে নাকচ করে দেয়, না না। বাজান, কী যে কন! হরেন বাবু পুরানা ডাক্তার, আগে দেখুক। খালি খালি নতুন ডাক্তারের কাছে যাওয়া–।
দরকার নাই। তুমি তখন কল্যা, তাই।
হরেন ডাক্তার পরপর দুইদিন এলো, জ্বর একটু কমে ফের দ্বিগুণ বেগে জ্বর ও কাঁপুনি হতে থাকলে টাউনের রহমত শেখের জোড়া ঘোড়ার ফিটন ভাড়া করে বাড়িতে নিয়ে আসা হলো ডাক্তার শিশির সেনকে। শিশিরবাবুর সঙ্গে এসেছে প্রশান্ত কম্পাউনডার, তার হাতে ডাক্তারের ব্যাগ। গাড়ির পিছে পিছে এসেছে চাষীপাড়ার মানুষ, মাঝিপাড়ার মানুষ। কলুপাড়ার গফুর আর গোলাবাড়ির কিছু লোক তো আছেই। মেয়েমানুষও হাজির হয়েছে মেলা। কোলে কোলে ন্যাংটা শিশুরা এবং সঙ্গে বিপুলসংখ্যক বালক বালিকা। বিলের ওপারের নিজগিরিরডাঙার মানুষও ভেঙে পড়েছে মণ্ডলবাড়িতে। এমন কি মরিচের খেত থেকে নিজেকে ছিড়ে নিয়ে হাজির হয়েছে হুরমতুল্লা। হুরমতুল্লা কিছুক্ষণ পর পর আবদুল আজিজকে খুঁজে বার করছে এবং নিয়োজিত থাকছে আজিজের ছেলে সম্বন্ধে প্রশংসা করায় এবং তার রোগ নিয়ে আক্ষেপ করায় এবং প্রশংসা ও আক্ষেপকে বিলাপে রূপ দেওয়ায়। টেলিগ্রাম পেয়ে আবদুল আজিজ এসে পৌঁছেছে শিশির ডাক্তার পোঁছুবার একটু পর; সুতরাং তার টমটমের গতি উদযাপন ও চাকা অনুসরণে উৎসাহী মানুষ বেশি পাওয়া যায় নি।
হুরমতুল্লার মেয়ে এসেছে দুই জন, ফুলজান আর সবচেয়ে ছোটোটা, ফালানি। ফুলজানের কোলে তার ছেলেটি প্রায় সবসময় ঘ্যানঘ্যান করে, মাঝে মাঝে তার কমজোরি কান্না বন্ধ হয় কেবল সে মায়ের ঘাড়ে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লে। তমিজ ঘুরঘুর করছিলো প্রশান্ত কম্পাউনঙরের পিছে পিছে। কম্পাউনডার বাবুর ভার লাঘব করতে তার হাতের ব্যাগ বহন করার জন্যে সে দুটো হাতই বাড়ালো কয়েকবার। কিন্তু প্রশান্ত তার সেবা প্রত্যাখ্যান করেছে বারবার। এমনি রূঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যাত হয় আর তমিজ একেকবার ভাবে, দূর, এর চেয়ে বরং জমিতে যাই, বিল থেকে নালা কেটে নেওয়ার কাজটা বরং এগিয়ে রাখি। কিন্তু এতো এতো মানুষ, এরকম জোড়াঘোড়ার ফিটন গাড়ি এবং ডাক্তারবাবু, কম্পাউনডার এবং সর্বোপরি তার হাতের ব্যাগের আকর্ষণ তাকে সেঁটে রাখে মণ্ডলবাড়ির সঙ্গে।
হুমায়ুনের অছিলাতেই কয়েক গ্রামের মানুষ মেয়েমানুষকে আল্লা আজ টাউনের বড়ো ডাক্তার, তার ব্রাহ্মণ কম্পাউনডার, কম্পাউনডারের হাতের ব্যাগ, জোড়া ঘোড়ার ফিটন গাড়ি প্রভৃতি এতো কাছে থেকে দেখার সুযোগ দিয়েছে। সুতরাং হুমায়ুনের প্রতি দায়িত্ব পালনে উচাটন হয়ে তারা ভিড় জমায় রোগীর ঘরের বারান্দায়, বারান্দার নিচে উঠানে, ঘরের দরজায়, এমন কি ঘরের ভেতরে পর্যন্ত। প্রশান্ত নাকে রুমাল চেপে বলে, এ কি, তামাশা নাকি? যাও, যাও। শরাফত, আবদুল কাদের ও হরেন ডাক্তারের ধাক্কাধাক্কিতে লোর্কজন উঠানে নেমে গেলে শিশির ডাক্তার স্টেথসকোপ দিয়ে হুমায়ুনকে নানাভাবে দেখে আর যতোই দেখে ততোই গম্ভীর হয়ে ওঠে। মাঝে মাঝে ঠাণ্ডা চোখে সে তাকায় হরেনের দিকে। হরেন অবশ্য কাল থেকেই ভয়ে ভয়ে আছে। কাল বিকালে বিছানায় প্রস্রাব করে ফেলেছিলো হুমায়ুন। লুঙিতে রক্তের দাগ দেখে হামিদা চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে যায় বিছানাতেই। তখনি শিশির ডাক্তারকে ডেকে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই গ্রামে শিশির সেন আজ প্রথম এলেও শরাফত মণ্ডলের ছেলেরা চিকিৎসার জন্যে টাউনে গেলে তার চেম্বারেই ধন্না দেয়। আবদুল কাদের তার মোটামুটি ভালোভাবেই চেনা। এই দুই ভাইকে বারবার নাম ধরে ডেকে ডাক্তার আজ দূরত্বটি কমিয়ে ফেলেছে। হুমায়ুনকে বাবা, বাবু, লক্ষ্মীছেলে, এইতো আমার গুডবয় বললে বাড়ির সবাই ডাক্তারের প্রতি গদগদচিত্ত হয় এবং তার ওপর নিরঙ্কুশ আস্থা পোষণ করতে থাকে।
পুবদুয়ারি ঘরে শরাফতের বড়োবিবি ডাক্তারের মুখ দেখতে না পেলেও রোগীর ঘরের আকস্মিক নীরবতা থেকে হুমায়ুনের বিপদের মাত্রা ঠিক আঁচ করে ফেলে এবং নিয়ম অনুসারে বিলাপ করতে করতে গালি দিতে থাকে শরাফত মণ্ডলকে। এই উচ্চকণ্ঠ বিলাপে প্রথমে বিব্রত ও পরে ক্ষিপ্ত হতে থাকে আবদুল কাদের। তবে মায়ের অসৌজন্যমূলক আচরণে ডাক্তার ও কম্পাউনডারের প্রতিক্রিয়া দেখতেই সে বেশি মনোযোগী ছিলো। ডাক্তারের মুখের রেখা এতোটুকু বাঁকা হয় না, কিন্তু প্রশান্ত কম্পাউনডার তার ফর্সা মুখটাকে বাঁকাচোরা করে বারবার তাকায় উঠানের ওপারে পুরদুয়ারি ঘরের দিকে এবং ডাক্তার শুনতে না পায় এমন স্বরে বিরক্তি ঝাড়ে, এরকম চাঁচালে রোগী দেখা যায়? এগুলো সব কী?
ডাক্তারবাবুকে সন্তুষ্ট রাখতে তটস্থ ছিলো আবদুল আজিজ। রোগী দেখার পর ডাক্তারবাবুর হাত ধোবার ব্যবস্থা করতে সে নিজেই বারান্দায় পানির বালতি, বদনা ও জলচৌকি নিয়ে আসে। সাবানের জন্যে ডাক্তার প্রশান্তের দিকে হাত বাড়ালে বেচারা। ব্যাগ হাতড়াতে হাতড়াতে হয়রান হয়ে পড়ে, নাঃ ব্যাগে সাবান নাই। আজকাল তার এরকম ভুল প্রায়ই হচ্ছে, বাবু এই নিয়ে কথা তুলবে টাউনে গিয়ে। প্রায় কাঁপতে কাঁপতে সে আজিজকে বলে, এদিকে দোকান নাই? সাবান পাওয়া যাবে না?
সাবান? দিচ্ছি। বলে আজিজ ঘরে গেলেও প্রশান্তের সংশয় কাটে না, কাদেরকে জিজ্ঞেস করে হাটের গোলাপি সাবান? তোমাদের ব্যবহার করা না তো?
আবদুল কাদেরের ভুরুতে গেরো পড়ে, গেরো-পড়া ভুরুর নিচে চোখজোড়া কুঁচকে সে তাকায় প্রশান্তের দিকে, আবদুল আজিজ এর মধ্যে নতুন লাইফবয় সাবান এনে দিলে ডাক্তারবাবু দুই হাতে সাবান মাখে, বদনা থেকে পানি ঢালে আবদুল আজিজ। প্রশান্তের কানের কাছে মুখ এনে কাদের বলে, লাইফবয় চলে তো? নাকি লাক্স, পালমোলিভ লাগবে? কন তো তাই না হয় দেই।
প্রশান্ত এবার হাসে বাঁকা ঠোঁটে, তোমাদের তো এখন দিন! কতো কি আমদানি হচ্ছে। তোমরা শিশির ডাক্তারকে নিয়ে আসো! ওরে বাবা! বাড়িতে তো বাবু পিয়ার্স ছাড়া মাখে না। তোমাদের ঘরে বুঝি তাও মজুত রাখো, না কি?
বাইরের ঘরে বসে ডাক্তার নীচু গলায় বলে, একটু দেরি হয়ে গেছে শরাফত মিয়া। আমার সঙ্গে কাদের যাক, ওষুধপত্র নিয়ে আসুক। হরেন ইনজেকশনটা পুশ করবে। দেখা যাক।
কাঁসার মস্ত গামলা থেকে ফুলপাতা আঁকা চিনামাটির বড়ো প্লেটে চামচ দিয়ে পায়েস ঢেলে দিতে কাদেরের বাধো বাধো ঠেকছিলো। কিন্তু দুই চামচ দেওয়ার পর ডাক্তার ব্যস বললে এই খাদ্য গ্রহণে তার সম্মতি সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হয়ে খুশিতে সে আরেক চামচ ঢালে। টাউন থেকে ডাক্তারকে নিয়ে আসার সময় ক্রিম ক্রেকার বিস্কুট ও লিপটনের চা নিয়ে এসেছিলো। পায়েসের পর বিস্কুট কয়েকটা খেয়ে চায়ে লম্বা চুমুক দিয়ে ডাক্তার বলে, আঃ! ভেরি গুড!
কিন্তু ঘরের বারান্দায় বসে-থাকা প্রশান্ত কম্পাউনডারকে কিছুই খাওয়ানো গেলো। এমন কি কিসের না কিসের হাঁড়িতে জল গরম করেছে এই ভাবনায় সে চা পর্যন্ত ছুঁয়ে দেখলো না। এতে শরাফত বা আজিজ মাথা ঘামায় না। কিন্তু প্রশান্তকে খাওয়াবার জন্যে কাদেরের যেন জেদ চেপে যায়, তো কলা চলবে তো? কলায় তো আর জাতের গন্ধ নেই।
কাদেরের এই উত্তেজনায় ঘরের ভেতর ডাক্তার হেসে ফেলে, কাদেরকে ডেকে বলে, কাদের, রাগ করো না। প্রশান্তের ছোঁয়াছুঁয়িটা একটু বেশি। ব্রাহ্মণ সন্তান, আমার বাড়িতেও কিছু মুখে দেয় না, বুঝলে? তুমি কিছু মনে করো না।
কাদের বাইরে এলে প্রশান্ত গলা নামিয়ে বলে, বাবু সায়েব মানুষ, তিনি সবই পারেন। আমরা গরিব বামুন, আমাদের অর্থবল নেই, প্রতিপত্তি নেই, জাতটা গেলে আমাদের আর থাকে কী?
কাদের বলে, জাতপাত নিয়েই থাকেন। আলাদা জাত বলেই তো আলাদা হতে চাই। আলাদা দেশ দিতে আপনাদের এতো গায়ে লাগে কেন?
ফর্সা ও রোগা প্রশান্ত ফের বাঁকা করে হাসে, আলাদা হয়ে থাকতে পারবে? আলাদা হলে তোমার ভাইয়ের চিকিৎসা করবে কে?
আবদুল কাদেরের তখন রাগ হয় বাপের ওপর, ভাইয়ের ওপর এবং খানিকটা নিজের ওপরেও বটে। স্কুলে লেখাপড়াটা ভালো করে করলেই আই এসসি পড়তে পারতো, তাহলে সোজা মেডিক্যাল কলেজে ঢুকলে ডাক্তার হয়ে বেরিয়ে আসতো কবে? ম্যাট্রিক পাস করে তো ক্যাম্বেলেও ঢুকতে পারতো। ডাক্তার হতে না পারার দুঃখে আবদুল কাদের কাতর হয়ে পড়ে। নিজেদের মধ্যে ডাক্তার থাকলে এই মালাউন কম্পাউনডারের কাছে আজ তাকে এরকম হেনস্থা হতে হয়? দুটো ভাইকেই ম্যাট্রিক যখন পাস করালোই তখন তার বাপের মাথায় এটা কি ঢুকলো না যে, ফ্যামিলিতে এখন একটা ডাক্তার অন্তত হোক। চাষের জমি বাড়াবার ফন্দি ছাড়া বুড়ার আর কোনো বুদ্ধি খোলে না।-আবদুল আজিজের বড়ো ছেলে বাবর ছাত্র তো খুব ভালো, জয়পুর হাই ইংলিশ স্কুলে হিন্দু ছেলেদের মধ্যেও তার রোল নম্বর হয় ৪/৫। হিন্দু মাস্টাররা কি তাকে ফেল করাবার জন্যে চেষ্টা করে না? তারপরেও তার এই রেজাল্ট। বাবরকে ডাক্তার করতে পারলে এই শিশির সেনেরই পসার নষ্ট হবে। এই তামাম এলাকার মোসলমান রুগীরা হুমড়ি খেয়ে পড়বে টাউনে বাবরের চেম্বারে। এই বেটা মালাউন কম্পাউনডার তার ফার্মেসিতে চাকরির জন্যে এই কাদেরের সুপারিশ চাইবে। চাইতে পারে?—ভাইপোকে বড়ো ডাক্তার বানিয়ে শিশির সেনের পসার মারা এবং প্রশান্তকে তার অধীনে চাকরি দেওয়ার সব পরিকল্পনা পণ্ড হয় তমিজের ডাক শুনে, ভাইজান!
চমকে উঠে বারান্দার নিচে তাকালে ভয়ে আঁতকে ওঠে কাদের : একি? তমিজের ঘাড়ের পাশে বিদুঘুটে একটা ঘ্যাগ গজালো কী করে? তারপর বোঝা যায়, ঘ্যাগ নয়, ওটা একটা মুণ্ডু। তমিজের খালি গতরের ওপর ঘাড় থেকে উঠে এসেছে দুটো মাথা। একটি তার চেনাজানা ও বর্তমানে তাদের বর্গাচাষা তমিজের; আর একটার ঘোলাটে চোখ, ফ্যাকাশে তামাটে মুখ জুড়ে কালচে হলুদ ছোপ। তমিজের ঘন কালো ঝাঁকড়া চুল তার দ্বিতীয় মাথাটিতে গড়িয়ে পড়েছে ফ্যাকাশে লাল আঁশ হয়ে। ওই মাথায় ঘোলা চোখের নিভু নিভু মণিজোড়া বেঁধা রয়েছে কাদেরের দিকে। ময়লাজমা ওই দুটো চোখের টিমটিম করে জ্বলা ভেঁতা মণি দুটো সামলানো কাদেরের সাধ্যের বাইরে।
ভাইজান, ফুলজানের বেটা। হুরমতুল্লার লাতি গো। নিজের দ্বিতীয় মুণ্ডুটির পরিচয় দিলে প্রথমে মনে হয়, ওটাই আসলে কথা বলছে পরিচিত তমিজের মুখ দিয়ে। ফুলজানের বেটা আস্তে আস্তে কাঁদতে আরম্ভ করলে কাদেরের কাছে দুজনে আলাদা হয়ে যায়। তমিজ বলে, ভাইজান, ছোলটার আজ ব্যায়না থ্যাকা খুব জ্বর। উদিনকার লাকান বেহুঁশ হয় নাই, কিন্তু শরীলেত মনে হয় আগুন ধরিছে। জ্বরের মদ্যে চ্যাংড়া খালি হেল্যা হেল্যা পড়ে। ডাক্তারবাবুক একবার দেখাবার চাছিনু।
শিশুটির দিকে ভালো করে তাকিয়ে কাদেরের গা শিরশির করে। অনেকদিনের কালাজ্বর ও আজকের প্রবল জ্বরে সে পেয়েছে একটা ভূতের চেহারা। কে জানে তার ওপর কারো আসর টাসর পড়লো কি-না। মোষের দিঘিতে কোদালের কোপ পড়েছে, মহাদেব কি আর কোনো দেও তার মুখে ছাই ছিটিয়ে দিলো নাকি? না-কি কাৎলাহারের খানদানি বাসিন্দা চোখ দিলো তার ওপর? এখন এই ভূতের চিকিৎসা করার অনুরোধ সে ডাক্তারবাবুকে করে কোন আক্কেলে?
এই সময় ডাঃ শিশিরকুমার সেন বারান্দা থেকে নিচে নেমে ঘোড়াগাড়ির দিকে রওয়ানা হয়ে একটু দাঁড়িয়ে সাদা বকে-ছাওয়া শিমুলগাছ দেখছিলো অভিভূত চোখে। পাশে তার আবদুল আজিজ। আজিজের চাপাস্বরের তীব্র ধমকে তমিজ সরে যায়, তবে কয়েক মুহূর্তেই সে দাঁড়ায় গিয়ে ফিটনের সঙ্গে জুতে-দিতে-থাকা জোড়া ঘোড়ার পাশে। ফুলজানের বেটা এখন মায়ের কোলে, মাতৃক্রোড়েও তার রূপের হেরফের হয় নি। তবে তমিজ মুক্ত হয়েছে ভৌতিক মুণ্ডু থেকে। তাই কাদের স্বস্তি পায়, স্বস্তির খুশিতে তার বর্গাচাষা ও দলের কর্মীকে কৃতজ্ঞতা পর্যন্ত জানায়, ফুলজানের বেটাক ভালো ঠেকলো না রে। করিম ডাক্তারের কাছে লিয়া যাস। তখন কলাম না? আমার কথা বললে পয়সা কম লিবি। যাস!
গাড়িতে ওঠার আগে ডাক্তারবাবু আবদুল আজিজের সঙ্গে রোগী সম্বন্ধে শেষবারের মতো কথাবার্তা বলছিলো। গাড়িতে এক কাঁদি শবরিকলা তুলে দেওয়ার তদারকি করছিলো শরাফত মণ্ডল নিজে। ফুলজান ডাক্তারের দিকে এগোবার চেষ্টা করলে শরাফত চাপা গলায় বকে, এই বেহায়া মাগী, তফাৎ যা, তফাৎ যা! একটু তফাৎ যেতেই . ফুলজান পড়ে প্রশান্তের সামনে। প্রশান্ত হঠাৎ শিশুটির গায়ে হাত দিয়ে বলে, জ্বর তো অনেক রে? চোখ দেখেই আমি বুঝেছি।
এতোটা লাই পেয়ে ফুলজান গদগদ হয়ে যায়, তার বাড়ন্ত গলগণ্ড থেকে কথা। গড়িয়ে পড়ে পুঁজের মতো আঠালো হয়ে, ছোলকোনার হামার বারো মাসই ব্যারাম গো বাবা ডাক্তোরবাবু। এানা ওষুধ দিয়া যান গো বাবা। পয়সা হামি সাথথ লিয়াই আসিছি। ওষুধ দিয়া যান বাবা।
সিকি দুয়ানি একানি কানা পয়সা মিলে সে সাড়ে চোদ্দ আনা পয়সা নিয়ে এসেছিলো। ছেলেটাকে কোলে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবে বলে তমিজ তার কাছ থেকে নিয়েছিলো পুরো আট আনা পয়সা, পয়সা না দিলে ডাক্তার তোমার ছেলের গাওত হাত দিবি না। এখন ফুলজানের আঁচলে বাধা সাড়ে ছয় আনা। তমিজ তো কিছু করতে পারলো না। এখন নিজেই সে মরিয়া হয়ে এসেছে ডাক্তারের কাছে। ওষুধপত্র যা দেয়। এখনি সে কিনে ফেলবে নগদ নগদ, নইলে পরে মাঝির বেটার কাছ থেকে পয়সা কি আর আদায় করতে পারবে?
দিলি তো দিনটা নষ্ট করে। প্রশান্ত রাগ করে, এখন বাড়ি গিয়ে রাতবিরেতে চান করে জলটা স্পর্শ করতে পারবো? শরতের রাতে একটু একটু ঠাণ্ডায় স্নান করার ঝুঁকি নিয়েও প্রশান্ত কিন্তু শিশুটির পেট টেপে এবং এই সিদ্ধান্তে আসে, পেটের পিলেটা তো পিপে হয়ে গেছে রে। হরেন বুঝি এই হাল করে দিয়েছে। না কী?
হরেন ডাক্তারকে অবশ্য কখনো দেখানো হয় নি। ফুলজান তবু তার সন্তানের চিকিৎসা ব্যয়ের একটি হিসাব দাখিল করে, ডাক্তোর কোবরাজ কম করনু না বাবা ডাক্তারবাবু। উদিনকা কয়েস কোবরাজেক দ্যাখানু, লগদ সাড়ে সাত আনা পয়সা খরচ হলো। মহাস্থানের ফকিরের পানিপড়া লিয়া আসিছি জষ্টি মাসোত, বাজানের আসা যাওয়া আর দরগার শিরনি বাবদ গেছে এক পয়সা কম চার আনা। আবার—
এই ব্যারাম কতোদিন হলো রে? প্রশান্ত তাকে থামিয়ে জিগ্যেস করলে ফুলজান বলে, ছোল হামার বারোম্যাসা রোগী গো। ছোলকোনা হামার বাঁচবি না!
বাঁচবে না কেন? ডাক্তার সম্বোধনটির মর্যাদা রাখতে প্রশান্ত কম্পাউনডার প্রেসক্রিপশন ছাড়ে, ব্রহ্মচারীর ইনজেকশন দিতে হবে। কালাজ্বর এখন সারে, এই ইনজেকশন দিলেই সারে। টাউনে নিয়ে আয়, দিয়ে দেবো। ছেলে তোর ঠিক বেঁচে যাবে।
ছেলের আয়ুর নিশ্চয়তা পেয়ে ফুলজানের ঘ্যাগে কাপন ওঠে, তার মোটা ও তামাটে গালে লাগে রক্তের ঝাপটা। তার মুখের সঙ্গে লাগানো শিশুটির কালচে হলুদ ছোপ-লাগা মুখে ও ঘোলাটে চোখে সেই ঝাপটার ছায়া একটুখানি হলেও পড়ে বৈ কি?