ফিরোজের জ্বর তৃতীয় দিনে নেমে গেল। তার ধারণা হয়েছিল ব্রংকাইটিস, নিউমোনিয়া এইসব কিছু একটা হয়েছে। তা নয়, ঠাণ্ডা লেগেছিল। তা তাকে তেমন কাবু করতে পারল না। এই তো আজ বেশ উঠতে বসতে পারছে। সিগারেটের তৃষ্ণা হচ্ছে। সিগারেটের তৃষ্ণা হবার মানে রোগ সেরে গেছে। সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে নিচে নেমে গেল।
হাজি সাহেব নিড়ানি হাতে বাগানে। ফুলের বাগান নয়, টমেটো গাছ লাগিয়েছিলেন। বাজারভর্তি পাকা টমেটো, কিন্তু হাজি সাহেবের গাছে সবে ফুল ফুটিছে। ফিরোজ সাহেবের ধারণা, অতিরিক্ত যত্বের কারণে এই অবস্থা।
হাজি সাহেব, কেমন আছেন?
ভাল। আপনার জ্বর সেরে গেছে নাকি?
পুরোপুরি সারেনি। সারাব-সারব করছে। আপনার গাছে ফুল ফুটেছে দেখছি। মিবাকল করে ফেলেছেন!
ফুল পর্যন্তই, ফল হয় না। ফুল ফোটে, দু’দিন পর ঝরে যায়। আপনি যাচ্ছেন কোথায়?
কোথাও না, রাস্তায়।
চা খাবেন?
না।
ঐ ব্যাপারটা কিছু করেছেন?
আপনার মেয়ের কথা বলছেন?
জি।
জ্বরে আটকা পড়ে সব জট পাকিয়ে গেছে। দেখি, কাল-পবশুর মধ্যে বেরুব।
হাজি সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, আরেকটা সম্বন্ধ এসেছে।
বলেন। কী! ছেলে কী করে?
করে না কিছু। ক্যাশ টাকা পেলে বিজনেস করবে বলেছে।
ক্যাশ টাকা কে দেবে, আপনি?
আমি ছাড়া আর কে?
একেবারেই পাত্তা দেবেন না। নেকাস্ট টাইম যখন আসবে, এক চড় দিয়ে বিদায় করে দেবেন। আমি তো ব্যবস্থা করছিই। আমি বসে আছি নাকি? ভাবেন কী আমাকে? কথা দিয়েছি না? কথার একটা দাম আছে না?
হাজি সাহেবকে দেখে মনে হচ্ছে, তিনি খুব-একটা ভরসা পাচ্ছেন না।
ঐ লোক এলে হাঁকিয়ে দেবেন, বুঝলেন, ব্যাটা আছে টাকার তালে। এদের ধরে ধরে জেলে ঢুকিয়ে দেয়া দরকার, তাহলে বিয়ের সখ ঘুচে যাবে।
রাস্তায় নেমে ফিরোজের মনে হল জ্বর আবার চেপে আসছে। রোদ চোখে লাগছে। মাথা হালকা মনে হচ্ছে। সিগারেট টান দিয়ে মনে হল এক্ষুণি বমি করে সব ভাসাবে। পেটের ভেতরে ক্রমাগত পাক দিচ্ছে। কী ভয়াবহ অবস্থা। দুটাকা দিয়ে কেনা বেনসন এ্যান্ড হেজেস। শুধুমাত্র মহাপুরুষরাই একটান দিয়ে দুটাকা দামের সিগারেট ফেলে দিতে পারেন। ফিরোজ মহাপুরুষ নয়, মহাপুরুষ হবার কোনো আগ্রহও তার নেই। সে জ্বলন্ত সিগারেট হাতে এলোমেলো পা ফেলতে লাগল।
আপনি এখানে কী করছেন?
ফিরোজ নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। মনে হচ্ছে জ্বরের ঘোরে সব তালগোল পাকিয়ে গেছে। হ্যালুসিনেশন হচ্ছে। কারণ সে যে দৃশ্যটি দেখছে, তা তার এই অবস্থায় দেখতে পাওয়ার কোনো কারণ নেই। বাংলা সিনেমাতেও এই ঘটনাটাকে নাটকীয় মনে হবে।
আপনি কী আমাকে চিনতে পারছেন না?
চিনতে পারব না কেন? আপনি, একজন অসম্ভব রাগী হৃদয়হীন অহঙ্কারী তরুণী। এখানে কী করছেন?
অপালা হেসে ফেলল। হাসতে-হাসতেই বলল, বেশ কিছুক্ষণ থেকে আপনাকে লক্ষ্য করছি। এ-রকম পাগলের মতো পা ফেলছেন কেন? আপনি কী অসুস্থ?
হ্যাঁ। তার আগে বলুন, এমন সহজ ভঙ্গিতে আপনি আমার সঙ্গে কথা বলছেন কেন? ঐ দিন এমন অপমান করলেন! নেহায়েত সাহসের অভাবে সুইসাইড করিনি।
আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না। কিসের অপমান?
ঐ যে ঐ দিন দেখা করতে গেলাম, আপনি বলে পাঠালেন দেখা হবে না। ঐ দিন মন ভাল ছিল না। কথা বলতে ভাল লাগছিল না। এতে অপমান বোধ করার কী আছে।
আজি কি আপনার মন ভাল?
হ্যাঁ, ভাল। গতকাল আমার একটা পরীক্ষা ছিল। খুব ভাল পরীক্ষা দিয়েছি।
এখানে কী করছেন?
একজনকে খুঁজছি।
আমাকে না তো?
না, আপনাকে কেন খুঁজবে? এ-রকম করে কথা বলছেন কেন?
শরীর খারাপ তো, কাজেই উল্টোপাল্টা কথা বলছি। ঐ সব ধরবেন না। আপনি একা একা হাঁটছেন, আপনার বডিগার্ডরা কোথায়? গাড়ি কোথায়?
অপালা হাসতে-হাসতে বলল, কাউকে না বলে একা একা বেরিয়েছি। একজনকে একটা গিফট দেব। ঠিকানা লেখা আছে, খুঁজে বের করতে পারছি না।
দিন ঠিকানা, এক্ষুণি বের করে দিচ্ছি।
এইভাবে লুঙ্গি পরে যাবেন? আমি এখানে দাঁড়াচ্ছি, আপনি চট করে কাপড় বদলে আসুন।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে না-থেকে আপনি বরং আমার সঙ্গে আসুন। কোথায় কীভাবে থাকি দেখে যান, কাজে লাগবে।
কী কাজে লাগবে?
বাংলাদেশে কিছু দরিদ্র মানুষও থাকে, এটা জানবেন।
আপনার ধারণা, আমি জানি না?
আমার সে-রকমই ধারণা।
খুবই আশ্চর্যে ব্যাপার, শাড়ির প্যাকেট হাতে অপালা ফিরোজের পেছনে পেছনে আসছে। অপালার ভালই লাগছে। কেন ভাল লাগছে তাও ঠিক বুঝতে পারছে না। এই মানুষটি তাকে দেখে অসম্ভব খুশি হয়েছে। তা ফুটে উঠেছে তার চোখে-মুখে, কথা বলার ভঙ্গিতে। তার সিগারেটে আগুন নেই। সেই নেভানো সিগারেটই সে টানছে এবং ধোয়া ছাড়বার মত ভঙ্গি করছে। লোকটি জানে না যে তার সিগারেট নেভানো। অপালার মনে ক্ষীণ একটা সন্দেহ খেলা করছে। এই সন্দেহটিকে প্রশ্রয় দেয়া বোধহয় ঠিক হবে না।
ফিরোজ হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। বিস্মিত গলায় বলল, আপনি সত্যি সত্যি আমার সঙ্গে আসছেন! আপনি তো আসতে বললেন।
ও হ্যাঁ, তাই তো। কথার কথা হিসেবে বলেছিলাম, সত্যি সত্যি চলে আসবেন ভাবিনি। আপনি কী রোমান হলিডে নামের কোনো ছবি দেখেছেন?
না। কেন?
যে-ঘটনাটা আমার জীবনে ঘটছে, তার সঙ্গে ঐ ছবিটার অদ্ভুত মিল আছে। ঐ ছবিতে একজন রানী এক’দিন রাজপ্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে আসেন, সারাটা দিন কাটান একজন সাধারণ মানুষের সঙ্গে। সন্ধ্যাবেলা আবার রাজপ্রাসাদে ফিরে যান।
আপনি এমনভাবে কথা বলছেন কেন?
আগেই তো বলেছি, আমি অসুস্থ, আমার মাথা এলোমেলো হয়ে আছে। যা মনে আসছে বলে ফেলছি। আপনি চলে যাবার আগে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইব। সাবধানে উঠবেন, সিঁড়িটা পিছল।
ফিরোজ অবাক হয়ে দেখল, মেয়েটা কী সুন্দর গুটি-গুট করে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে! তার মনে হল, মেয়েটির মাথাও খানিকটা এলোমেলো। কিংবা লোকজনের সঙ্গে মিশে তার অভ্যেস নেই। সাধারণ একটি মেয়ে কখনো কোনো অবস্থাতেই এমন পরিচয়ে তার ঘরে আসবে না। ব্যাপারটির অস্বাভাবিকতা মেয়েটির চোখেই পড়ছে না, কিংবা কে জানে হযত এটাই স্বাভাবিক। আচ্ছা, এটা স্বপ্নদৃশ্য নয় তো? সমস্ত ব্যাপারটা হয়ত স্বপ্নে ঘটে যাচ্ছে। না, তা নয়। ফিরোজ সেন্টের গন্ধ পাচ্ছে। ঘন নীল রঙের আকাশ দেখতে পাচ্ছে। স্বপ্ন হয় গন্ধ ও বর্ণহীন।
অপালা কৌতূহলী হয়ে দেখছে। দেখার মত কিছু নেই। অপরিচ্ছন্ন নোংরা একটি ঘর। অন্য দিন এর চেয়ে পরিষ্কার থাকে। অসুস্থ থাকার কারণে কোনো কিছুতেই হাত দেয়া হয়নি। এখনো মশারি খাটানো। মেঝেতে সিগারেটের টুকরো। ময়লা কাপড়। দু’টি শেষ না-হওয়া পেইন্টিং। রঙের টিউব, ব্ৰাশ। পিরিচে রঙ, চেয়ারে রঙ, মেঝেতে রঙ। জানালার পাশে আধা-খাওয়া চায়ের কাঁপের দিকে সারি বেঁধে লাল পিপড়ার দল যাচ্ছে। অপালা বলল, আপনি মনে হচ্ছে খুব গোছানো মানুষ।
ফিরোজ জবাব দিল না।
আপনি ড্রেস চেঞ্জ করুন, আমি বারান্দায় দাঁড়াচ্ছি।
অপালা বারান্দায় এসে দাঁড়াল। সুখী সুখী চোখে তাকিয়ে রইল রাস্তার মানুষজনদের দিকে। কত ব্যস্ত হয়েই না। এরা ছুটছে, দেখে মনে হয়। এদের কারোর বিন্দুমাত্র অবসর নেই। সবার ভীষণ তাড়া।
ফিরোজ বেরিয়ে এসে বলল, আপনাকে এনে লজ্জাই লাগছে।
অপালা বলল, আমি ভেবেছিলাম। আপনার স্ত্রীকে এ বাড়িতে দেখব। এখনো বিয়ে হয়নি?
না।
হবে তো শেষ পর্যন্ত?
হ্যাঁ, হবে।
আপনি বানিয়ে বানিয়ে এ সব বলছেন না তো?
বানিয়ে বলব কেন? আমার কী স্বাৰ্থ?
তাও তো ঠিক। আচ্ছা শুনুন, একটা মজার জিনিস দেখলাম আপনার এখানে দুটো চড়ুই পাখি চা খাচ্ছে।
ওরা আমার পোষা চড়ুই। চা খাইয়ে-খাইয়ে পোষ মানিয়েছি।
আপনি কেন বানিয়ে বানিয়ে এত মিথ্যা কথা বলেন?
চড়ুইগুলো যদি কথা বলতে পারত, তাহলে এরা বলত যে এটা সত্যি। দুর্ভাগ্যক্রমে এদের কথা আমরা বুঝি না।
বাসা খুঁজে পেতে অনেক সময় লাগল। গলির পর গলি, তস্য গলি। টিনের একটা ঘর। এর আবার নামও আছে আনন্দ কুটির।
ফিরোজ বলল, আমিও কী আসব আপনার সঙ্গে?
না, আপনি কেন আসবেন?
অপেক্ষা করব এখানে?
না, আমি নিজেই চলে যাব।
আমি না হয় থাকি, আপনাকে রিকশায় তুলে তারপর যাব।
না। কেউ অপেক্ষা করে থাকলে আমার অস্বন্তি লাগে।
ফিরোজ নিজেই দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। প্রচণ্ড জ্বরের আগমন সে টের পাচ্ছে। চোখ মেলে রাখতে পারছে না, বমি-বমি ভাব হচ্ছে। ফিরোজের ধারণা, অপালা এটা বুঝতে পেরেছে। কিন্তু সে একটি কথাও বলছে না। সহজ ভদ্রতার দু’টি কথা কি বলা যায় না? সে যদি জিজ্ঞেস করে–আপনার কী খুব খারাপ লাগছে নাকি? তাতে তো জগৎ-সংসারের কোনো ক্ষতি হবে না। ফিরোজ বলল, হয়ত ওরা বাসায় নেই, কোথাও বেড়াতে-টেড়াতে গিয়েছে। আমি দাঁড়াচ্ছি, আপনি খোঁজ নিয়ে আসুন।
অপালা হেসে ফেলল। ফিরোজ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল, আপনি হাসছেন? এখন বাচ্চাদের পরীক্ষটরীক্ষা হয়ে গেছে, এই সময়ই সবাই নানার বাড়িতে বেড়াতে যায়।
যে-বাড়িতে যাচ্ছি, তাদের বড় মেয়েটির বিয়ে, কাজেই ওরা কোথাও যাবে না। হয়ত দল বেঁধে কেনাকাটা করতে গিয়েছে। বড় মেয়ের বিয়েতে দল বেঁধে কেনাকাটা হয়। আমার বড় বোনের বিয়ের সময় দেখেছি। কাজের মেয়েটিকে পর্যন্ত আমরা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছি। ঘর তালাবন্ধ করে গেলাম, ফিরে এসে দেখি চোর সব সাফা করে দিয়েছে।
ফিরোজ সাহেব।
জি।
এখন চলে যান। প্লিজ। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আপনার সঙ্গে তর্ক করতে ভাল লাগছে না।
ফিরোজ গেল না। একটু শুধু সরে গেল। তার কেন জানি মনে হচ্ছে অপালা এক্ষুণি বেরিয়ে আসবে। তখন তার সঙ্গে অনেকক্ষণ হাঁটা যাবে। পাশাপাশি সাত পা হাটলে সাত পাকে বাঁধা পড়ে। অনেক বেশি পা হাঁটা হয়েছে। আরো হোক। সে লক্ষ পা হাঁটবে।
আশপাশে কোনো চায়ের দোকান নেই যে বসা যায়। দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। সামান্য জ্বরে শরীর বড় বেশি কাবু হয়েছে। অসুখ-অসুখ একটা গন্ধ বেরুচ্ছে গা থেকে। পেটে আবার পাক খেতে শুরু করেছ। এবার নির্ঘাত বমি হবে। অপালা ঘর থেকে বেরিয়ে দেখবে সে রাস্তায় উবু হয়ে বসে বমি করছে। সে বড় কুৎসিত দৃশ্য। এই দৃশ্য অপালাকে কিছুতেই দেখানো যায় না। ফিরোজ একটা রিকশায় উঠে পড়ল।
অপালা অনেকক্ষণ হল কড়া নেড়েছে। ভেতর থেকে মিষ্টি গলায় একটি মেয়ে বলল, কে?
অপালা কী বলবে ভেবে পেল না। সে যদি বলে–আমি অপালা। তাহলে কেউ কিছু বুঝবে না। শুধু আমি বলারও কোনো মানে নেই। সে আবার কড়া নাড়ল। ভেতর থেকে সেই মেয়েটি আবার বলল, কে? যেন জবাব না পেলে দরজা খুলবে না।
অপালা বলল, দরজাটা কী খোলা যাবে?
খুট করে দরজা খুলল, তাও পুরোপুরি নয়। অল্প একটু ফাক করে বার-তের বছরের মেয়েটি মুখ বের করে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। এই মেয়েটিকেই অপালা তাদের গেটের বাইরের দেখেছে। মেয়েটি কী যে অবাক হয়েছে! চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। নিঃশ্বাস পর্যন্ত ফেলছে না। অপালাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ছুটে ভেতরে চলে গেল। তার পরপরই অনেকগুলো পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। বাড়ির সবাই যেন একসঙ্গে ছুটে আসছে। অপালার লজ্জা করতে লাগল।
এ-বাড়িতে বোধহয় কোনো ছেলে নেই। পাঁচটি বিভিন্ন বয়সের মেয়ে তাকে ঘিরে আছে। এদের সবার মুখের দিকে খানিকক্ষণ করে তাকাল। একটি শীতল স্রোত বয়ে গেল অপালার গা দিয়ে। এই মেয়েগুলো দেখতে তার মতো, বিশেষ করে বড় মেয়েটি। অপালা কাঁপা গলায় বলল, তোমরা কেমন আছ? কেউ কোনো জবাব দিল না। বাড়ির ভেতর থেকে একজন মহিলা বললেন, ওকে ভেতরে নিয়ে আয়, ওকে ভেতরে নিয়ে আয়। বড় মেয়েটি চাপা গলায় বলল, আস, ভেতরে আসা। বলেই সে অপালার হাত ধরল। যেন সে এদের অনেক দিনের পরিচিত কেউ। অপালা বলল, তোমরা কী আমাকে চোন? তারা কেউ সে প্রশ্নের জবাব দিল না। ভেতর থেকে ভদ্রমহিলা বললেন, ওকে নিয়ে আয় ওকে ভেতরে নিয়ে আয়।
চাদর গায়ে একজন মহিলা বিছানায় শুয়ে আছেন। অপালা ঘরের ভেতর পা দেয়ামাত্র তিনি কাঁদতে শুরু করলেন। কান্নার দমকে তাঁর ছোট্ট শরীর থর-থর করে কাঁপছে। বড় মেয়েটি ছুটে গিয়ে তার মাকে ধরল। ফিসফিস করে বলল, কিছু হয় নাই মা, কিছু হয় নাই, তুমি চুপ কর। ভদ্রমহিলা চুপ করতে পারছেন না।
অপালা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, আপনি কী আমাকে চেনেন?
ভদ্রমহিলা না-সূচক মাথা নাড়লেন।
আপনি তাহলে এ-রকম করছেন কেন?
বড় মেয়েটি একটি হাতপাখা নিয়ে তার মাকে দ্রুত হাওয়া করছে। মেজো মেয়েটি অপালার হাত ধরে বলল, তুমি বস। চেয়ারটায় বস।
অপালা বসল। হাতের শাড়ির প্যাকেটটি নামিয়ে রেখে ক্লান্ত গলায় বলল, এ বাড়ির যে মেয়েটির বিয়ে, তার জন্যে এই শাড়িটা এনেছি। বিয়ের দিন তো আসতে পারব না, তাই। বেশি লোকজন আমার ভাল লাগে না।
অপালা কী বলছে নিজেও বুঝতে পারছে না। সে যেন ঘোরের মধ্যে কথা বলছে। পাঁচটি মেয়ের কেউই তার কথা শুনছে বলে মনে হল না। সাবাই চোখ বড় বড় করে অপালার দিকে তাকিয়ে আছে। শুধু বড় মেয়েটি তার মাকে নিয়ে ব্যস্ত। ভদ্রমহিলা এখন আর কোনো সাড়াশব্দ করছেন না। তার চোখ বন্ধ। হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছেন। বড় মেয়েটি তার মার গলা পর্যন্ত চাদর টেনে মৃদু স্বরে বলল, এস, আমরা পাশের ঘরে যাই।
উনি কি ঘুমিয়ে পড়ছেন?
হ্যাঁ। মার শরীর খুব খারাপ। মাঝে মাঝে তার এ রকম হয়।
উনি আমাকে দেখে এ-রকম করলেন কেন?
বড় মেয়েটি তার জবাব না-দিয়ে বলল, চল, পাশের ঘরে যাই।
অপালা বলল, না, আমি পাশের ঘরে যাব না। আমি এখন চলে যাব। আমার ভাল লাগছে। না। আমার একটুও ভাল লাগছে না।
সে উঠে দাঁড়াল। আবার বলল, তোমরা কী আমাকে চেন?
বড় মেয়েটি বলল, না, চিনি না।
সত্যি চেন না?
তোমার বাবা আমার বাবাকে অনেক সাহায্য করেছেন, সেই ভাবে চিনি। আমার বাবার কোনো টাকা-পয়সা ছিল না। প্ৰায় না খেয়ে ছিলেন। বাবা-মা আর তাদের তিন মেয়ে। তখন তোমার বাবা আমাদের সাহায্য করেন। টাকা-পয়সা দেন। বাবাকে একটা দোকান দিয়ে দেন। সেইভাবে তোমাকে চিনি।
সেই রকম চেনায় কেউ কী আমাকে তুমি বলবে?
তুমি বলায় কী রাগ করেছ?
অপালা জবাব না-দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল। সে ঠিকভাবে পা ফেলতে পারছে না। তার যেন প্রচণ্ড জ্বর আসছে। নিঃশ্বাসও ঠিকমত ফেলতে পারছে না। অপালার সঙ্গে-সঙ্গে ওরা পাঁচ জনও বেরিয়ে এসেছে। মেজো মেয়েটি অপালার হাত ধরে কী বলতে চাইল। অপালা সেই হাত কাঁপা ভঙ্গিতে সরিয়ে প্রায় ছুটে গেল রাস্তার দিকে। তার মনে হচ্ছে, সে রাস্তা পর্যন্ত যেতে পারবে না, তার আগেই জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়বে। তৃষ্ণায় তার বুক ফেটে যাচ্ছে।
পাঁচ বোন দরজা ধরে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে, যেন তারা কোনো কারণে খুব ভয় পেয়েছে।