১২. ফরহাদ আসমানীদের বসার ঘরে বসে আছে

ফরহাদ আসমানীদের বসার ঘরে বসে আছে। একটা কাজের মেয়ে চা দিয়ে গেছে। সেই চা অনেকক্ষণ আগে শেষ হয়েছে। তার কাছে কেউ আসছে না। কলিংবেল টেপার পর নিশা দরজা খুলে দিয়েছে। সেই বলেছে—ভেতরে এসে বসুন। তার গলা অত্যন্ত শীতল। ফরহাদ সেই শীতল গলাকে গুরুত্ব দেয় নি। যার বোন ভয়াবহ রকম অসুস্থ তার গলায় কোন রকম উষ্ণতা থাকার কথা না।

ফরহাদ বলল, আসমানী কি বাসায়?

নিশা বলল, হুঁ।

বাসায় কখন এসেছে?

গতকাল সন্ধ্যায়।

আমি জানতাম না। আজ হাসপাতালে গিয়ে শুনি…।

আপাকে নিয়ে সিঙ্গাপুর যাওয়া হবে। এই জন্যেই চলে আসা।

কবে যাচ্ছ সিঙ্গাপুর?

এখনো ঠিক হয় নি। মামা চেষ্টা করছেন। যত তাড়াতাড়ি যাওয়া যায়।

আমি আসমানীর সঙ্গে একটু কথা বলব।

আপনি বসুন।

ফরহাদ বসেছে। এর মধ্যে এক ঘণ্টা সময় পার হয়েছে। তার চা খাওয়া হয়েছে। খবরের কাগজ পড়া হয়েছে। টেবিলে দুটা ম্যাগাজিন ছিল। সেই ম্যাগাজিনও শেষ হয়েছে। ভেতর থেকে কেউ আসে নি। চট করে ভেতরের ঘরে ঢুকে পরার অধিকার তার নেই। তাকে কেউ ডেকে না নিয়ে গেলে সে যেতে পারবে না। তাকে বাইরের গেস্টদের মত চুপচাপ বসে থাকতে হবে।

আসমানী নিশ্চয়ই তার ঘরে শুয়ে আছে। তার ঘরটা কখনো দেখা হয় নি। নিশ্চয়ই ঘরটা খুব সুন্দর করে সাজানো। আসমানী বলতো—তোমাকে আমার ঘরটা একদিন দেখাতে হবে। ঘরের মধ্যে একটা কুমারী গন্ধ আছে। যে কোন বুদ্ধিমান লোক ঘরে পা দিয়েই বুঝবে এখানে একটা কুমারী মেয়ে বাস করে।

বিবাহিতা মেয়ের ঘর কি অন্যরকম?

অবশ্যই অন্যরকম। বিয়ের পর তোমাকে নিয়ে আমি যে ঘরে থাকব সেই ঘরতো আমিই সাজাব তখন ডিফারেন্সটা বুঝবে।

ফরহাদ হাসতে হাসতে বলেছে, আমার তো ধারণা কোন প্রভেদ নেই। একটা হতে পারে তোমার এই ঘরে ছেলেদের কোন কাপড় নেই, এসট্রে নেই। বিয়ের পরে যে ঘরে থাকবে সেখানে আমার কাপড় থাকবে, একটা এসট্রে থাকবে।

আসমানী গম্ভীর গলায় বলেছে—তুমি এখনো ধরতে পার নি। আমি একটা ডিফারেন্সের কথা বলি——যেমন ধর কুমারী মেয়েদের দৃষ্টি থাকে ঘরের বাইরে। তারা আকাশ দেখতে পছন্দ করে। কিন্তু বিয়ের পর মেয়েদের দৃষ্টি ঘরের ভেতর কেন্দ্রীভূত হয়। কাজেই কুমারী মেয়ের খাটের অবস্থান এমন হবে যে খাটে শুয়ে আকাশ দেখা যায়। আর বিবাহিতা মেয়ের খাটটা হবে সিলিং ফ্যানের নিচে। খাটের পজিশন এমন যেন স্বামী-স্ত্রী দুজনই সমান বাতাস পায়। কেউ বেশি, কেউ কম তা যেন না হয়।

ফরহাদ হাসতে হাসতে বলেছে—তুমি তুচ্ছ সব ব্যাপার নিয়ে দিনরাত ভাব তাই না?

আমি তুচ্ছ বা জটিল কোন বিষয় নিয়েই দিনরাত ভাবি না–তোমাকে নিয়ে দিনরাত ভাবি। আচ্ছা এই যে আমি দিনরাত তোমাকে নিয়ে ভাবি এই কথাটা কি তোমার বিশ্বাস হয়েছে?

হ্যাঁ হয়েছে।

আসমানী তখন ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলেছে—তোমার ব্যাপারটা কিন্তু অন্যরকম। তুমি সারাক্ষণ আমার কথা ভাব না। তুমি নানান ধরনের ঝামেলার মধ্যে বাস কর বলে ঝামেলা নিয়ে ভাব। আমার কথা ভাব তখনই যখন আমি তোমার সামনে থাকি। এই জন্যেই তোমাকে বিয়ে করে ফেলার জন্যে আমি এত ব্যস্ত। বিয়ের পর তোমাকে বাধ্য হয়ে আমার সঙ্গে অনেক বেশি সময় থাকতে হবে। তখন বাধ্য হয়ে আমার কথা ভাবতে হবে। বলতো আমি ঠিক বললাম কি-না।

ফরহাদ উত্তর দেয় নি। তবে আসমানীর কথা সত্যি। এই যে সে এক ঘন্টা আসমানীদের বসার ঘরে বসে আছে। এই এক ঘন্টা সে শুধু আসমানীর কথা ভাবে নি। তাকে অনেক কিছু ভাবতে হয়েছে। যেমন সে বেশ কিছু সময় ধরেই তার মার কথা ভাবছে।

আসমানীদের ফ্ল্যাট বাড়ির দিকে রওনা হবার আগে ফরহাদ মা-বাবার খোঁজ নিতে গিয়েছিল। রাহেলা বেগম ছেলেকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলেছেন—নিউ মার্কেট থেকে খুব বড় একটা কাতল বা রুই মাছ কিনে দিতে পারবি? খুব দরকার। টাকা আমি দেব। এক হাজার টাকায় হবে না?

এক হাজার টাকা দামের মাছ?

খুব বড় মাছ। যেন সবার চোখে পড়ে এ রকম মাছ।

দরকার কি?

আছে দরকার আছে। মাছটা বিকাল পাঁচটা ছটার দিকে আনবি। পারবি না।

ফরহাদ শান্ত গলায় বলল, পারব কিন্তু হঠাৎ এক হাজার টাকা দামের মাছের দরকার পড়ল কেন?

জামাইয়ের বাড়িতে পরে আছি, খরচ টরচ না করলে মান থাকে না।

মান রক্ষার জন্যে এক হাজার টাকা দামের মাছ কত দিন কিনবে?

তোর সঙ্গে তর্কের ইসকুল খুলব না। তোকে যা করতে বলছি কর।

বিকেলে আমি একটা প্রাইভেট টিউশ্যানি করি। মাছটা এখন কিনে দিয়ে যাই মা?

এখন কিনলে এরা মাছটা কেটে বেঁধে ফেলবে। বড় মাছ কেটে ফেললে তার আর সৌন্দর্য কি? জামাই দেখতে পাবে না। সে অফিসে। সে বাসায় ফিরে সন্ধ্যায়।

রাহেলা মাছের জন্যে এক হাজার টাকা দিলেন। গলা নামিয়ে বললেন, যদি কিছু বেশি লাগে তুই দিয়ে দিস।

ফরহাদের মন সামান্য খারাপ হয়েছে। তার মা জামাইয়ের বাড়িতে তার সম্মান নিয়ে ব্যস্ত। অন্য কিছুই এখন আর তাঁর চোখে পড়ছে না। একবার অন্তত বলতে পারতেন, তোর কি হয়েছে বলত? তোর চোখের নিচে কালি কেন? কিংবা জিজ্ঞেস করতে পারতেন, আসমানী মেয়েটা কেমন আছে? ওকে একবার দেখতে যাব। তুই আমাকে নিয়ে যা তো। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার আসমানী সম্পর্কে কারোর কোন আগ্রহ নেই। তার বাবা এখন পর্যন্ত আসমানীর কথা কিছু জিজ্ঞেস করেন নি। আসমানী যদি টবে লাগানো কোন জাপানী ফুলের গাছ হত, তার বাবা। নিশ্চয়ই প্রতিদিন তাকে দেখতে যেতেন।

 

ফরহাদ ঘড়ি দেখল। দেড় ঘন্টার মত হয়েছে, সে বসে আছে। এদের সমস্যাটা কি? এরা তাকে বসিয়ে রেখেছে কেন?

আসমানীর মামা বসার ঘরে ঢুকলেন। ফরহাদ উঠে দাঁড়াল। কামরুল ইসলাম সাহেবকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি সারারাত ঘুমাননি। চোখের নিচে কালি। ঠোট শুকিয়ে আছে। তিনি যে দাঁড়িয়ে আছেন সেই দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিটাও অস্বাভাবিক। কেমন যেন কুঁজো হয়ে আছেন। তাঁকে খুবই ক্লান্ত লাগছে।

ফরহাদ কেমন আছ?

জি ভাল।

কামরুল ইসলাম সাহেব নিজে বসলেন না, ফরহাদকেও বসতে বললেন না। কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতে লাগলেন।

অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছ, সরি। চা দিয়েছে?

জি।

আসমানীর শরীরটা বেশ খারাপ করেছে। এত দ্রুত এতটা খারাপ করার কথা। আমার মনে হয় —মন বিকল হয়ে গেছে। মন বিকল হলে এ রকম হয়। ভয়াবহ বিপদের সামনে দাঁড়ালে সাধারণ চিন্তাশক্তি নষ্ট হয়ে যায়…।

ফরহাদ বলল, মামা আমি ওর সঙ্গে একটু কথা বলি?

কামরুল ইসলাম সাহেব ক্লান্ত নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, এইখানেই সমস্যাটা হয়েছে। ও তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছে না। এতক্ষণ তাকে বুঝাবার চেষ্টা করলাম। লাভ হয় নি।

ও কি বলছে?

তোমাকে তার অসুস্থ মুখ দেখাবে না। এইসব হাবিজাবি বলছে। যেহেতু সে চাচ্ছে না, আমার মনে হয় তোমার দেখা না করাই ভাল হবে। এম্নিতেই সে প্রচণ্ড মানসিক চাপের মধ্যে আছে। সেই চাপটা আর বাড়ানো ঠিক হবে না।

আমি কি চলে যাব?

হ্যাঁ চলে যাও। দেশের বাইরে যাবার আগে সে যদি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায় আমি তোমাকে খবর দেব।

আমি কি বিকেলে একবার আসব?

আসতে পার। তবে আমার মনে হয় না সে তোমার সঙ্গে কথা বলবে। আসমানী ভয়ংকর ধরনের জেদী মেয়ে। যা বলবে তাই।

এপার্টমেন্ট হাউসে লিফট আছে, ফরহাদ নামছে সিড়ি দিয়ে। তার কাছে মনে হচ্ছে সে নেমেই যাচ্ছে নেমেই যাচ্ছে, সিড়ি শেষ হচ্ছে না। সিড়ি দিয়ে উঠতে কষ্ট, নামতে কষ্ট না, কিন্তু এখন নামতেও কষ্ট হচ্ছে। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙ্গে আসছে। ইচ্ছে করছে রেলিং ধরে খানিকক্ষণ বিশ্রাম করতে। হঠাৎ করে খুব ঘুমও পাচ্ছে। মেসে ফিরে গিয়ে আরাম করে কিছুক্ষণ ঘুমুতে পারলে ভাল হত। চিন্তা ভাবনাহীন নিশ্চিন্ত ঘুম। কতদিন হয়ে গেল সে আরাম করে ঘুমুতে পারছে না। ঘুমিয়ে পড়তে পারলে দরদাম করে মাছ কেনার কথা ভাবতে হবে না। নান্টু ভাইয়ের কথা ভাবতে হবে না। চিলড্রেনস রাইমস, পার্ট টুর বইটা কোথায় পাওয়া যাবে তা নিয়েও ভাবতে হবে না। ফরহাদ প্রাইভেট টিউশ্যানী শুরু করেছে। তার ছাত্রর মা চিলড্রেনস রাইমস পার্ট টু বইটা না-কি কোন দোকানে খুঁজে পাচ্ছেন না। ফরহাদের দায়িত্ব বইটার খোঁজ করা।

এক বিদেশী অষুধ কোম্পানী মেডিকেল রিপ্রেজনটেটিভ চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছে। সেখানে লেখা—বেতন ভাতা আকর্ষণীয়। ছবি এবং বায়োডাটাসহ যোগাযোগ করুন। ফরহাদের কাছে বায়োডাটা আছে। ছবি নেই। থ্রি আর সাইজের ছবি তুলতে হবে। হাসি হাসি মুখের ছবি। কাউকে দিয়ে সুপারিশ করাতে পারলে ভাল হত। কোন মন্ত্রী বা এ ধরনের ক্ষমতাবান কেউ। তবে মন্ত্রীর সুপারিশে কাজ হবে না, কারণ পাঁচ হাজার দরখাস্ত যদি পড়ে সেই পাঁচ হাজারের মধ্যে চার হাজার দরখাস্তে মন্ত্রীর সুপারিশ থাকবে। বাংলাদেশের মন্ত্রীরা জুড়ালো সুপারিশ করতে খুব পছন্দ করেন। নতুন ধরনের কোন সুপারিশ যদি কেউ তার জন্যে করত। যেমন ধরা যাক—কবি শামসুর রাহমান সাহেব তার দরখাস্তের উপরে গোটা গোটা অক্ষরে তাকে নিয়ে দুলাইনের কবিতা লিখে সুপারিশ করলেন–

এই ছেলেটা ভাল এবং সৎ
তার বিষয়ে ইহাই আমার চিন্তিত অভিমত।
—শামসুর রাহমান

বাহ্ কবিতাটা তো ভাল হয়েছে। ফরহাদ ক্লান্ত ভঙ্গিতে হাঁটছে। প্রাণপণে চেষ্টা করছে—আসমানীর বিষয়ে এখন আর কিছু ভাববে না। কিছু না।

দিনটা কেমন মেঘলা মেঘলা। এ রকম মেঘলা দিনে আসমানীকে নিয়ে বেড়াতে বের হলেই আসমানী বার বার তাকাতো আকাশের দিকে এবং বলতো তোমার কি মনে হয় বৃষ্টি হবে?

ফরহাদ বেশির ভাগ সময়ই বলতো, জানি নাতো।

আমার খুব টেনশান লাগছে।

কেন?

আকাশে ঘন কাল করে মেঘ হলেই আমার টেনশান শুরু হয়। যদি বৃষ্টি না হয়, যদি বৃষ্টি না হয়।

টেনশানের কি আছে? সব মেঘে কি আর বৃষ্টি হয়?

হয় না বলেই তো টেনশান।

আসমানী আজ সঙ্গে থাকলে তার টেনশান হত। কারণ আকাশ দ্রুত কালো হচ্ছে। কালো মেঘ নিয়ে যে গানটা আছে সেটা যেন কি?

মেঘ কালো আঁধার কালো আর কলংক যে কালো।

ফরহাদ নিউ মার্কেটের দিকে রওনা হল। রাইমসের বইটা কিনে, মাছ কিনতে ঢুকবে। এর মধ্যে যদি ভালমত বৃষ্টি নামে তাহলে মাছের দাম কমে যাবে। বৃষ্টির দিনে ইলিশ মাছের দাম বাড়ে। অন্য সব মাছের দাম কমে যায়।

মানুষের মন যদি এ রকম হত যে সে একসঙ্গে একটার বেশি কোন কিছু নিয়ে ভাবতে পারে না তাহলে চমৎকার হত। মনটাকে সব সময় কোন না কোন কিছু নিয়ে ব্যস্ত রাখা যেতে পারত। কিন্তু মানুষের মন এক সঙ্গে দশ বারোটা বিষয় নিয়ে ভাবতে পারে। ফরহাদ নিশ্চিত যে যখন মাছের বাজারে ঢুকে রুই এবং কাতল মাছের দাম কমাতে ব্যস্ত থাকবে তখনো তার মনের একটা অংশ ভাববে আসমানীর কথা। কেমন আছে আসমানী? আজ যদি বৃষ্টি নামে সে কি তার বিছানার জানালা থেকে বৃষ্টি দেখবে? রোগ যন্ত্রণায় কাতর মানুষ কি বৃষ্টি পছন্দ করে?

 

দরজা খুলে রাণী অবাক। বৃষ্টিতে ভিজে জবজবে হয়ে ফরহাদ দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে কানকোয় দড়ি বাধা বিশাল একটা কাতল মাছ। ফরহাদ ব্ৰিত গলায় বলল, বাড়িতে কোন কাজের লোক আছে। মাছটা ভেতরে নেবে।

রাণী অবাক হয়ে বলল, মাছ কেন?

মা বলেছেন একটা বড় মাছ কিনে তোমাদের এখানে দিয়ে যেতে। মাকে একটু খবর দেবে?।

উনি এখন বাড়িতে নেই। পাশের বাড়িতে মিলাদ হচ্ছে—মিলাদে গেছেন। উনি যেতে চান নি আমার মা জোর করে নিয়ে গেছেন।

তুমি মাকে বলে দিও যে মাছ দিয়ে গেছি।

আপনি কি এখন চলে যাবেন?

হ্যাঁ।

বৃষ্টির মধ্যে কোথায় যাবেন? অবশ্যই যাবেন না। উনারা চলে আসবেন আমি খবর পাঠাচ্ছি।

ফরহাদ শান্ত গলায় বলল, খবর পাঠাতে হবে না। আসলে আমি মার সঙ্গে দেখা করতে চাচ্ছি না। মার সঙ্গে এখন কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। এম্নিতেই মনটা খারাপ, তাঁর সঙ্গে কথা বললে মন আরো খারাপ হয়। আমি যাই।

রানী বলল, আপনি একটু রসুন। এক মিনিট। আপনার একটা জিনিস আমার কাছে আছে। নিয়ে যান।

ফরহাদ অবাক হয়ে বলল, আমার কি জিনিস?

রাণী নীচু গলায় বলল, আপনি আপনার স্ত্রীর জন্যে বিয়ের শাড়ি কিনেছিলেন। আসমানী রঙের শাড়ি।

ফরহাদ অবাক হয়ে বলল, তোমার কাছে কি ভাবে গেল?

রাণী তার জবাব না দিয়ে চলে গেল। শাড়ির প্যাকেট হাতে ফিরে এসে বলল, আমি কিন্তু প্যাকেটটা খুলে ফেলেছিলাম। কিছু মনে করবেন না। প্যাকেটের ভেতর একটা চিঠি ছিল। চিঠিটা প্যাকেটে দিয়ে দিয়েছি।

ফরহাদ তাকিয়ে আছে। মেয়েটার ভাবভঙ্গি কেমন যেন লাগছে। তার সঙ্গে কথা বলছে কিন্তু তার দিকে তাকাচ্ছে না। মেয়েটার সঙ্গে আসমানীর চেহারার কোন মিল নেই। কিন্তু তারপরেও তাকে কেন জানি আসমানীর মত দেখাচ্ছে।

রাণী বলল, আমি শুনেছি উনি খুব অসুস্থ। আপনি আবার যখন তাঁকে দেখতে যাবেন তখন অবশ্যই শাড়ি এবং চিঠি নিয়ে যাবেন।

ও কারো সঙ্গেই দেখা করতে চাচ্ছে না। আজ আমার সঙ্গে দেখা করে নি। সকালবেলা অনেকক্ষণ বসেছিলাম।

এখন শাড়ি নিয়ে আবার যান। সকালে হয়ত মন খুব খারাপ ছিল। মানুষের মন খুব বেশিক্ষণ খারাপ থাকে না।

আসমানীর সঙ্গে মিলটা কোথায় ফরহাদ বের করতে পারছে না। গলার স্বরও অন্যরকম কিন্তু কেন জানি মনে হচ্ছে আসমানী কথা বলছে।

ফরহাদ বৃষ্টির মধ্যেই বের হয়ে গেল। রাণী বারান্দায় এসে দাঁড়াল। এই বাড়ির বারান্দা থেকে অনেক দূর দেখা যায়। মানুষটা কেমন ক্লান্ত ভঙ্গিতে বৃষ্টির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। দেখতে রাণীর কষ্ট হচ্ছে। সে কেন জানি চোখও ফিরিয়ে নিতে পারছে না। মানুষটা যদি হঠাৎ কোন কারণে পেছনে ফিরে তাহলে খুব লজ্জার ব্যাপার হবে।

রাণীর হাত কাঁপছে। বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করার ইচ্ছাটা আবার মাথা চাড়া দিচ্ছে। তার রীতিমত কান্না পাচ্ছে। তার কেন এই সমস্যা হল?

 

আশ্চর্য আসমানীকে মোটেই অসুস্থ দেখাচ্ছে না। সে খাটে হেলান দিয়ে বসেছে। চুল ছাড়া। তার লম্বা চুল বিছানা স্পর্শ করেছে। আসমানীর পরণের শাড়ির রঙ উজ্জ্বল। সবুজ জমিনে লাল ফুলের কাজ। তার অসুস্থতার একমাত্র লক্ষণ তার পায়ের উপর শাদা রঙের চাদর এবং বিছানার পাশের টেবিল ভর্তি অষুধ।

ফরহাদ বসেছে আসমানীর খাটে। বৃষ্টির ভেতর এসেছে বলে আধ ভেজা। মনে হয় তার ঠাণ্ডা লেগেছে। সে কয়েকবার হাঁচি দিল। আসমানী হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। তার চোখে চাপা কৌতুক। মনে হচ্ছে এক্ষুণী সে মজার কিছু বলবে, কিন্তু আসমানী চুপ করেই আছে। কিছু বলছে না। ফরহাদ বলল, কেমন আছ?

আসমানী সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল, সকালে তোমার সঙ্গে দেখা করিনি বলে রাগ করো না। হঠাৎ করে খুব মন খারাপ করেছিল। হঠাৎ মনে হল কি আশ্চর্য সবাই থাকবে শুধু আমি থাকব না। এটা কেমন কথা।

মন খারাপ ভাবটা কি এখন কমেছে?

না কমে নি। তবে তোমাকে দেখে খুশি হয়েছি।

তোমাকে আজ অসুস্থ মনে হচ্ছে না।

মনে না হলেও আমি ভয়াবহ অসুস্থ। আমার রোগটার নাম হচ্ছে ক্রনিক মাইলয়েড লিউকোমিয়া। এই রোগের তিনটা স্তর থাকে। আমি আছি দ্বিতীয় স্তরে।

ও।

আসমানী হাসি হাসি মুখে বলল, হাসপাতালে থাকার সময় অল্পবয়েসী একজন ডাক্তারের সঙ্গে আমার বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিল। তাকে যখন বললাম, অসুখটা কি আমি ভালমত জানতে চাই—তখন সে রাজ্যের লিটারেচর দিয়ে যেতে শুরু করল। এই রোগ বিষয়ে আমি এখন একজন বিশেষজ্ঞ। তুমি কিছু জানতে চাইলে জিজ্ঞেস করতে পার।

আমি কিছু জানতে চাচ্ছি না।

তুমি এমন গম্ভীর হয়ে আছ কেন? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তোমার AML হয়েছে।

AML টা কি?

আরেক ধরনের ব্লাড ক্যানসার—একুউট মায়ালোজেনাস লিউকোমিয়া। মায়ালোজেনাস আবার দুরকমের হয়। মাইলোমনোসাইটিক এবং পিউর মনোসাইটিক। শুনতে বিরক্ত লাগছে?

লাগছে।

আমার ইয়াং ডাক্তার সাহেবের কাছে শুনলাম বিদেশে যাদের এ ধরনের ভয়াবহ অসুখ হয় তাদেরকে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করার ব্যবস্থা থাকে। সাইকিয়াট্রিস্টরা এসে দিনের পর দিন তাদের সঙ্গে কথা বলেন। মৃত্যুর জন্যে মানসিক ভাবে প্রস্তুত করেন। হাস্যকর না?

হাস্যকর কেন?

যাদের এ ধরনের অসুখ হয় তারা মৃত্যুর জন্যে আপনা থেকেই তৈরী হয়ে যায়। সাইকিয়াট্রিস্টের দরকার রুগীর আত্মীয় স্বজনদের জন্যে। তার প্রিয়জনদের জন্যে। যেমন তোমার জন্যে দরকার হবে। তুমি এক কাজ কর বিছানায় পা তোলে আরাম করে বোস। তুমি এমন ভাবে বসেছ যে দেখে মনে হচ্ছে ভাইভা পরীক্ষা দিতে বসেছ। এবং আমি হচ্ছি ভাইভা বোর্ডের চেয়ারম্যান।

ফরহাদ পা তুলে বসল। আসমানী বলল, আমি খুব শিগগীরই চিকিৎসার জন্যে দেশের বাইরে যাচ্ছি।

কবে যাচ্ছ?

কবে তা বলব না। কারণ বললেই তুমি এয়ারপোর্টে উপস্থিত হবে। তোমাকে দেখে তখন ভয়ংকর ধরনের কষ্ট হবে। তোমাকে এখানে রেখে চলে যাচ্ছি। আর হয়তো তোমার সঙ্গে দেখা হবে না। এই কষ্টটা আমার সহ্য হবে না। যখন চাকরি করতে। চাকরির প্রয়োজন দুদিন, তিন দিনের জন্যে বাইরে যেতে তখনও সহ্য হত না। সারারাত ঘুমুতে পারতাম না। ফাঁকা ফাঁকা লাগতো। কাজেই আমি কবে দেশের বাইরে যাচ্ছি তা তোমাকে জানাব না। তুমি হঠাৎ একদিন শুনবে আমি চলে গেছি। দেখবে দরজায় বিরাট তালা ঝুলছে।

ফরহাদ কিছু বলল না। তাকিয়ে রইল আসমানীর দিকে। আসমানীর গলার স্বর কি সামান্য বদলেছে? একটু যেন অন্যরকম লাগছে। আসমানী বলল, বাবার সঙ্গে আজ তোমার দেখা হয়েছে না?

হ্যাঁ।

তাকে আগের চেয়ে অনেক হাসিখুশি লাগে নি?

বুঝতে পারি নি।

বাবা খুশি কারণ মেয়ের চিকিৎসার জন্যে তাঁকে ফ্ল্যাট বিক্রি করতে হচ্ছে না। আমার চিকিৎসার জন্যে কে টাকা দিচ্ছেন জান?

না।

আনিস সাহেব নামের এক ভদ্রলোক। তাঁর কথা তোমাকে চিঠিতে লিখেছিলাম। ঐ যে মামা যার সঙ্গে আমার বিয়ে দেবেন বলে ঠিক করে রেখেছিলেন। ভাগ্যিস ঐ ভদ্রলোক আমাদের বাসায় এসেছিলেন। আমার সঙ্গে গল্প-টল্প করেছিলেন। তা না করলে আমার প্রতি তাঁর মমতা তৈরী হত না। টাকা পয়সা দিয়ে বাবাকে সাহায্য করার জন্যেও এগিয়ে আসতেন না। আমি মাঝে মাঝে শুয়ে শুয়ে অদ্ভুত সব যোগাযোগের কথা ভাবি। মজার ব্যাপার কি জান আনিস সাহেব কিন্তু আমাকে হাসপাতালে বা বাসায় দেখতে আসেন নি। অথচ উনি ঢাকাতেই আছেন। অদ্ভুত না?

হ্যাঁ অদ্ভুত।

খুব পরিচিত অনেকেই আমাকে দেখতে আসে নি। যেমন কণা। আমার এত প্রিয় বান্ধবী। কিন্তু সে আসে নি। আবার কেউ কেউ এসেছে যাদের সঙ্গে অতি সামান্য পরিচয়। এমন একজনও এসেছে যাকে আমি কোনদিন দেখিনি।

সে কে?

খুব সুন্দর মত একটা মেয়ে। তোমাকে মনে হয় চেনে। মেয়েটা বিপদে পড়েছিল তুমি তাকে বাসায় পৌঁছে দিয়েছে। এমন কারো কথা কি মনে পড়ছে?

না। মেয়েটা তোমাকে চেনে কি ভাবে?

জানি না। জিজ্ঞেসও করি নি। আমার এখন এমন সময় যাচ্ছে যেখানে কিছু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে না। তবে আমি নিশ্চিত মেয়েটা তোমাকে খুব ভালমত চেনে। শুধু চেনে না, তোমাকে অসম্ভব পছন্দও করে। সে যেহেতু চেনে তুমিও চেন। একটু মনে করার চেষ্টা করলেই মনে পড়বে। মেয়েটার চিবুকে কাটা দাগ আছে। চোখও ছোট বড় আছে। ডান চোখটা বা চোখের চেয়ে সামান্য বড়। চট করে বোঝা যায় না, ভাল করে তাকালে বোঝা যায়।

এমন করে বর্ণনা দিচ্ছ কেন?

বর্ণনা দিচ্ছি যাতে তুমি মেয়েটাকে খুঁজে বের করতে পার।

নাম বলে নি?

নাম বলেছে কিন্তু নামটা তোমাকে বলব না। মেয়েটাকে তোমার খুঁজে বের করতে হবে।

তার কি কোন দরকার আছে?

হ্যাঁ দরকার আছে। আমার অসুখটা সারবে না। আমি চাই আমি যেমন তোমাকে ভালবেসেছি তেমন কেউ তোমাকে ভালবাসুক।

আসমানী তুমি খুবই উদ্ভট কথা বলছ?

আসমানী হাসতে হাসতে বলল, অসুখে মাথার ঠিক নেই। উদ্ভট কথা বলতেও পারি। আচ্ছা তোমার দাদাজানের সঙ্গে তোমার খুব ভাব ছিল না? তুমি তার অনেক সেবাযত্ন করতে। রাতের বেলা দাদা নাতী মিলে গুটুর গুটুর করতে। করতে না?

হ্যাঁ করতাম।

এখন কি সেই দাদাজানের কথা তুমি ভাব? ভাব না। জীবিত মানুষরা অতি দ্রুত মৃত মানুষদের কথা ভুলে যায়। এখন তোমার আমার জন্যে খুব কষ্ট হবে কারণ আমি জীবিত। আমি মারা যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমার প্রতি তোমার ভালবাসা অতি দ্রুত কমতে শুরু করবে। এত দ্রুত কমবে যে তোমার নিজেরই লজ্জা। লাগবে। আচ্ছা শোন আমি অনেকক্ষণ ধরে বকবক করেছি। এখন আমার মাথা ধরে গেছে। শরীর ঝিমঝিম করছে। তুমি কি দয়া করে উঠবে?

ফরহাদ উঠল না আগের মত বসে রইল।

আসমানী বলল, তোমার হাতের এই শাড়িটা কি আমার জন্যে?

হ্যাঁ। তোমার বিয়ের শাড়ি।

বিয়ে হলে তবে না বিয়ের শাড়ি পরব। এই শাড়ি তুমি ফিরিয়ে নিয়ে যাও। যদি ভাল হয়ে দেশে ফিরি তখন শাড়ি নিয়ে এসো। খুব আগ্রহ নিয়ে শাড়ি পরব। যদিও সেই সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

আসমানী চোখ বন্ধ করে বিছানায় এলিয়ে পড়ল। তার শরীর কাঁপছে। জগৎ সংসার অস্পষ্ট হয়ে আসছে। তার খুব ইচ্ছা করছে সে ফরহাদকে বলে—খবর্দার তুমি যাবে না। তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার পাশে শুয়ে থাকবে। যার যা ইচ্ছা ভাবুক। আমার কিছু যায় আসে না। কিন্তু তা সম্ভব না। আমরা অসম্ভবের জগতে বাস করি না।

 

রাহেলার মন আজ বেশ ভাল।

বড় মাছটা আনায় খুব কাজ হয়েছে। মাছটা শুধু যে বড় ছিল তা-না, স্বাদু মাছ ছিল। জাহানারার শাশুড়ি পর্যন্ত বললেন, অনেক দিন পর এত ভাল মাছ খেলাম। টাটকা মাছের স্বাদই আলাদা।

রাহেলা খুশি খুশি গলায় বললেন, ফরহাদকে বলব ভাল পাংগাস মাছ দিয়ে যেতে। ও মাছ চেনে। খুব সকালে আরিচা ঘাটে যাবে। ফ্রেশ মাছ কিনে নিয়ে আসবে। দেখি কাল পরশুর মধ্যে…।

জাহানারার শাশুড়ি বললেন, এইসব কি বলছেন বেয়ান। রোজ রোজ মাছ কিনতে হবে না-কি।

রাহেলা তৃপ্তির গলায় বললেন, রোজ রোজ কি আর কিনছি না-কি? আছি আর মাত্র দুই চারদিন। সবাইকে নিয়ে পাংগাস মাছ একটা না হয় খেলাম।

দুই চারদিন আছেন না-কি?

জ্বি বেয়ান। মঞ্জু বাসা ঠিক করে ফেলেছে। তার বড় ভাইকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছে। আমি খুবই রাগ করেছি। বড় ভাইকে দিয়ে খবর পাঠাবি কেন? তুই নিজে এসে দিবি না। তুই কোথাকার তালেবর?

ব্যস্ত থাকে।

ওর ব্যস্ততার কথা আমাকে বলবেন না বেয়ান। যত ব্যস্ততা বাবা-মার বেলায়। বন্ধু বান্ধবের বেলায় হাতে অবসর আছে। বেয়ান আমি ঠিক করেছি ওর বিয়ে দেব। একটা মেয়ে দেখবেন তো। মেয়েটা সুন্দর হতে হবে, আর ভাল বংশ। ছেলেতো আপনি দেখেছেন। শিক্ষক বাবার ছেলে আর কিছু থাকুক না থাকুক চরিত্র ঠিক আছে।

তাতো থাকবেই।

ওর বয়েসী ছেলেদের তো বেয়ান দেখি—মদ খাচ্ছে, গাঁজা খাচ্ছে আবার ফেনসিডিল খাচ্ছে। ওদের সঙ্গে যখন আমার দুই ছেলেকে মিলাই তখন বড় শান্তি লাগে। মনে মনে বলি—আল্লাহপাক তোমার দরবারে হাজার শুকুর।

বেয়ান আপনার কথা শুনে ভাল লাগল।

মঞ্জুর একটা ঘটনা বলি বেয়ান। একদিন রিকশা করে এসেছে। রিকশা ভাড়া দশ টাকা। আমার কাছে বলল–মা দশটা টাকা আছে। আমার কাছে সব বড় নোট। আমি দিলাম দশ টাকা! ও আল্লা তারপর থেকে দেখি কয়েকদিন পর পর ঐ রিকশাওয়ালা আসে। আমাকে সালাম করার জন্যে আসে। আমি ভাবলাম ব্যাপার কি। একদিন জিজ্ঞেস করলাম। রিকশাওয়ালা বলল, স্যার ঐ দিন তার দুঃখের কথা শুনে পাঁচশ টাকা বখশিস দিয়েছেন। এখন বেয়ান আমার কথা হল তুই যদি পাঁচশ টাকাই দিবি। তাহলে দশ টাকা ভাড়া দেয়ার জন্যে এত ব্যস্ত কেন?

রাহেলা ছেলের গল্প আরো কিছুক্ষণ করতেন, মেয়েকে ঘরে ঢুকতে দেখে থেমে গেলেন। জাহানারা থমথমে গলায় বলল, মা একটু বাইরে  এসোতো।

রাহেলা শংকিত গলায় বললেন, কি হয়েছে?

জাহানারা বলল, কিছু হয় নি একটু বাইরে এসো কথা আছে।

রাহেলা মেয়ের সঙ্গে বারান্দায় গেলেন। জাহানারা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, তোমরা কি আমার সামান্য মান সম্মানও রাখবে না?

কেন কি হয়েছে?

জাহানারা চাপা গলায় বলল, মজু ভাইয়া তোমার জামাইয়ের অফিসে গিয়েছিল। তার না-কি পার্টনারের সঙ্গে কি সমস্যা হয়েছে। দুই দিনের মধ্যে চল্লিশ হাজার টাকার জোগাড় না হলে জেলে যাবে। টাকার জন্যে তোমার জামাইয়ের অফিসে গিয়ে কান্নাকাটি করেছে। মদ খেয়ে গিয়েছিল। হুঁস জ্ঞান নেই জামাইয়ের পায়ে ধরতে যায়।

রাহেলা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন—জামাই কি টাকা দিয়েছে?

তোমার জামাইতো হাজি মুহম্মদ মহসিন না। কেউ চাইবে আর টাকা বের করে দিয়ে দেবে। সে খুবই বিরক্ত হয়েছে এবং আমার উপর রাগ করেছে।

তোর উপর রাগ করার কি আছে? তুইতো আর টাকা চাস নাই।

আমার বাপ ভাইতো চেয়েছে। পায়ে ধরে চেয়েছে। একবার চেয়েওতো কেউ চুপ করবে না। চাইতেই থাকবে।

আমাকে এইসব বলছিস কেন? আমি কি করব?

তুমি চারদিকে যে উল্টাপাল্টা গল্প করছ এইগুলি বন্ধ করবে। মঞ্জু ভাইয়ার কাছে খবর পাঠাবে সে যেন তোমার জামাইয়ের অফিসে ভুলেও না যায়। আর এখানেও যেন না আসে।

ও কোথায় থাকে তাইতো আমি জানি না।

জাহানারা কেঁদে ফেলে বলল, তুমি একটা কাজ কর মা। বাবাকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাও। তোমাদের জন্যে আমার মাথা কাটা যাচ্ছে। বাবা কি করেছে তুমি জান? দারোয়ানের কাছ থেকে একশ টাকা ধার করেছে।

রাহেলা বললেন, আমরা যাব কোথায়?

জানি না কোথায় যাবে। আমার অসহ্য লাগছে মা। মরে যেতে ইচ্ছা করছে।

জাহানারা খুব কান্নাকাটি করলেও রাহেলা স্বাভাবিক রইলেন। অন্যদিনের মতই তাকে হাসি খুশি মনে হল। আজ বৃহস্পতিবার। রাতে আক্তারী বেগম এলেন। রাহেলা মাথায় ঘোমটা দিয়ে খুবই আগ্রহের সঙ্গে ধর্মের কথা শুনতে গেলেন। যেন আজ কোন ঘটনাই ঘটে নি। আজকের আলোচনার বিষয় আছর ওয়াক্তের গুরুত্ব।

আক্তারী বেগম বলছেন—আছর ওয়াক্তের মত গুরুত্বপূর্ণ ওয়াক্ত আর নাই। কেন জানেন? জানেন না? মিলাদ, কোরানখানির দোয়া সব আছর ওয়াক্তে হয় না? কেন হয় এই কথাটাকি কখনো মনে আসে না? আচ্ছা শুনেন বলি——আছর ওয়াক্তে রোজকেয়ামত হবে। আবার এই আছর ওয়াক্তেই বাবা আদম গন্ধম ফল খেয়েছেন। ইউনুস নবী মাছের পেট থেকে কখন বের হয়েছিলেন? ঠিক আছর ওয়াক্তে। ইউনুস নবী মাছের পেট থেকে বের হয়ে প্রথম যে কাজটা করেন তা হল পাক পবিত্র হয়ে দুই রাকাত শোকরানা নামায আদায় করেন। মাছের পেটে বসে ইউনুস নবী যে দোয়াটা পড়েছিলেন, সেই দোয়াটা দিয়ে আজ আমরা জিকির করব। বলেন লা ইলাহা ইল্লা আন্তা ছোবাহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজজুয়ালেমিন।

জিকির হচ্ছে। রাহেলা বেগম চোখ বন্ধ করে গভীর মনযোগে মাথা ঝুঁকিয়ে জিকির করছেন। জাহানারা এসে মার কাঁধে হাত দিয়ে চাপা গলায় বলল, মা তুমি তোমার ঘরে যাও। মঞ্জু ভাইয়া এসেছে। তোমার ঘরে বসে আছে। তুমি অতি দ্রুত তাকে বিদায় কর। তোমার জামাই যদি শুনে সে এখানে এসেছে তাহলে খুবই রাগ করবে।

 

মঞ্জুর গায়ে ইস্ত্রী করা সার্ট প্যান্ট। জুতা জোড়া চকচক করছে, কিন্তু তাকে দেখাচ্ছে কানা তাড়য়ার মত। যে কেউ তাকে দেখে বলবে—তার জীবনের উপর দিয়ে প্রবল ঝড় বয়ে গেছে।

মঞ্জু মাকে দেখে বড়বড় করে বলল, মা আমাকে বাঁচাও। দুই দিনের মধ্যে চল্লিশ হাজার টাকা জোগাড় করতে না পারলে আমাকে জানে মেরে ফেলবে। সত্যি জানে মেরে ফেলবে। আমি যে এখানে আছি—এখানেও আমার পেছনে লোক লাগানো আছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে।

রাহেলা শুকনো গলায় বললেন, আমি টাকা পাব কোথায়?

তোমার কাছে টাকা আছে আমি জানি। দাদাজানের চন্দ্রহারটাও তোমার কাছে। এইগুলো দাও–আর তোমার মেয়ের কাছ থেকে টাকা জোগাড় করে আমাকে দাও।

তুই কি মদ খেয়ে এসেছিস? মদ ফদ কিছুই খাই নি। মদ খেতে পয়সা লাগে। মাগনা কেউ মদ খাওয়ায়। মা তুমি সময় নষ্ট করো না।

তোকেতো বললাম, আমার কাছে কিছুই নেই।

ধানাই পানাই করে লাভ হবে না মা। আমি টাকা না নিয়ে যাব না।

রাহেলা আতংক অস্থির হলেন। মঞ্জু বিশ্রী ভাবে তাকাচ্ছে। তার চোখ লাল। মুখ থেকে বিকট গন্ধ বের হচ্ছে। সে স্থির হয়ে বসতেও পারছে না। এই বসছে, এই উঠে দাঁড়াচ্ছে। রাহেলা কেঁদে ফেললেন।

মঞ্জু বলল, কেঁদে লাভ হবে না মা। বললামতো টাকা না নিয়ে আমি যাব না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *