প্রাচীন রাজসরকারে চুরিচামারি
প্রায় সবার জানা একটা গল্প দিয়ে শুরু করতে ক্ষতি নেই এইজন্যে যে, এই প্রাচীন গল্পে চিরকালের সত্যটি ধরা পড়েছে। মৈথিলি কবি বিদ্যাপতি অনেকগুলি গল্প লিখে, একটি গল্প-সংকলন করেন। নাম দেন পুরুষপরীক্ষা। এমনি একটি গল্পে এক চোরের কথা আছে, যে শুধু বুদ্ধির জোরে রাজদণ্ড পরিহার করতে পেরেছিল। চোরটি এক ধনী লোকের বাড়িতে সিঁদ কাটার মুখেই ধরা পড়ে।মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে সে ভাবল বাঁচবার উপায় একটা করতেই হবে; উপায় সফল হলে রক্ষা পাব, আর নিষ্ফল হলে মৃত্যুর বেশি তো কিছু হবে না। সে রাজপুরুষদের বলল–তোমরা রাজাকে গিয়ে বলল যে, আমি সোনার চাষ জানি। মরার আগে এই স্বর্ণকৃষির বিদ্যা আমি রাজাকে দিয়ে যেতে চাই। কারণ আমি মারা গেলে এ-বিদ্যা পৃথিবী থেকে লুপ্ত হবে। রাজপুরুষেরা রাজাকে সব জানাল এবং রাজা চোরের সঙ্গে মোলাকাত করে বিশ্বাস করতে বাধ্য হলেন যে, চোর এ-কাজটি করে দেখাবে। মাসখানেক সময় নিয়ে চোর নানা কারিগরি করে রাজাকে জানাল, জমি এবং সোনার বীজ দুই-ই তৈরি। এখন শুধু একজন লোক দরকার, যে বীজগুলি ছড়িয়ে দেবে জমিতে। রাজা বললেন–তুমি নিজে কেন বীজ বুনছো না বাপু। চোর বলল–এই বীজ বোনায় যদি চোরেরই অধিকার থাকবে, তাহলে কি এ-বিদ্যা জানা সত্ত্বেও আমি বসে থাকি, না চুরি করি। চোর রাজাকে প্রশ্ন ফিরিয়ে দিয়ে বলল–কেন, মহারাজা আপনিই বরঞ্চ এই বীজগুলি ছড়িয়ে দিন না জমিতে। রাজা বললেন কিন্তু বাপু! আমি যে একবার চুরি করেছিলাম। আমার বাবা গায়েনদের টাকা পাঠিয়েছিলেন আমার হাত দিয়ে, আমি সেই টাকা সরিয়েছিলাম। চোর বলল–ঠিক আছে, ঠিক আছে, তাহলে মন্ত্রীমশাইরা বুনুন। মন্ত্রীরা হেসে বলল রাজার ওপরেই আমাদের জীবিকা, রাজপুরুষেরা কি চোর না হয়ে পারেবয়ং রাজোপজীবিনঃ, কথম্ অস্তেয়িনো ভবামঃ।
পাঠকের কৌতূহল নিবারণার্থে জানাই যে, ওই রাজ্যের “চিফ জাস্টিস” পর্যন্ত ছোটোবেলায় মায়ের রাখা লুকোনো মিষ্টি চুরি করে খাওয়ার ফলে চোর সবাইকেই চোর প্রতিপন্ন করেছিল এবং শেষপর্যন্ত রাজদণ্ড থেকে বেঁচেছিল। কিন্তু আসল কথা হল, রাজপুরুষের চরিত্র, রাজার ওপরে যাঁরা জীবিকানির্বাহ করেন। এখন রাজা নেই, সরকার আছে। সরকার মানে শাসনযন্ত্র, ইংরেজিতে যাকে বলে “অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ মেশিনারি”। তা সেই শাসনযন্ত্রের যন্ত্রী পুরুষেরা যদি এমন জায়গায় বহাল থাকেন, যেখানে আলগা টাকাপয়সা আলগোছে জনগণের পকেট থেকে রাজপুরুষের পকেটে আসে, তবে সে শাসনযন্ত্রের নাম সরকারই হোক, কী রাজাই হোক, দুর্নাম হয় সরকারি কর্মচারীর। আসলে ‘ট্র্যাডিশন”-টা বহুদিনের। মিথিলার বিদ্যাপতি তো মোটেই সাত/আটশো বছর আগে কবুল করেছেন যে, রাজপুরুষেরা বুঝি চোর না হয়ে পারে না, কিন্তু আমরা জানি যে, প্রাচীনকালে, অতি প্রাচীন কালেও রাজপুরুষদের স্বভাবচরিত্তির ভালো ছিল না।
আসলে রাজ্য শাসনতন্ত্রে অভিজ্ঞ লোক মাত্রেই জানেন যে, রাজা কিংবা সরকারের কতকগুলি সাধারণ বিপদ আছে। প্রথমত অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, মড়ক, আগুন লাগা, দুর্ভিক্ষ–এগুলি যখন রাষ্ট্রের ক্ষতি করে, সেই ক্ষতিগুলিকে বলে দৈব বিপদ। কিন্তু রাজ্যে বা সরকারের শাসনে আরও এক ধরনের ক্ষতি হয় এবং সে ক্ষতি করে মানুষ। তাই এর নাম মানুষ বিপদ। নারদমুনি যুধিষ্ঠিরকে এই মানুষ বিপদ থেকে সাবধান হতে বলেছেন। কোন্ কোন্ মানুষ এই বিপদ তৈরি করতে পারে? প্রথম হলেন তারা, যাঁরা বিভিন্ন রাজকার্যে নিযুক্ত আছেন, দ্বিতীয় হল সোজাসুজি চোর, তৃতীয় রাজার শত্রুরা। চতুর্থ রাজার কাছের লোক এবং পঞ্চম রাজা নিজে–আযুক্তকেভ্য শ্চৌরেভ্যঃ পরেভ্যো রাজবল্লভা। লক্ষণীয়, এখানে নিযুক্ত রাজকর্মচারীর পাশেই সিঁদেল চোরের স্থান হওয়ায় রাজকর্মচারীদের কী চোখে দেখা হত অথবা কেমন সন্দেহ করা হত সেটা বেশ বোঝা যায়। অবশ্য রাজকর্মচারী বলতে তখনকার দিনে মন্ত্রী থেকে আরম্ভ করে একেবারে রান্নাঘরের পাঁচকটি পর্যন্ত ধরা হত, ঠিক এখন যেমন গণতন্ত্রে সেক্রেটারি থেকে আরম্ভ করে পিয়ন পর্যন্ত।
রাজা যদি নিজে কামপরতন্ত্র হন, স্বার্থান্বেষী হন, তাহলে রাজকোষে প্রজাদের জমা-করা অর্থের অপব্যবহার হতে পারে, ঠিক যেমন অপব্যবহার হতে পারে জনগণের করস্বরূপ দেওয়া অর্থের এখনকার মন্ত্রীদের হাতে। শাস্ত্রকার অবশ্য রাজাকে মোটামুটি ইন্দ্রিয়জয়ী, প্রজারঞ্জক পুরুষ হিসেবে ধরে নিয়েই অন্যান্য রাজকর্মচারীদের সম্বন্ধে প্রশ্ন তুলবেন। মন্ত্রীদের প্রসঙ্গে অনেকগুলি আদর্শ গুণের বর্ণনা করলেও বারবার তারা বলছেন–যে-মন্ত্রীই নিয়োগ করো, সে যেন অর্থের ব্যাপারে শুচি হয়। মনু মহারাজ এবং অর্থশাস্ত্রকার কৌটিল্য দুজনেই কিন্তু মনে করেন, অর্থ-সংক্রান্ত ব্যাপারে রাজকার্যের সর্বোচ্চ পদাধিকারী মন্ত্রীমশাইরা একেবারে শুদ্ধ হবেন, নইলে সমূহ বিপদ। বিশেষত, রাজকর্মের যেসব বিষয়ে টাকাপয়সার অসদ্ব্যবহার হওয়ার বিরাট সম্ভাবনা আছে, সেইসব জায়গায় এমন মন্ত্রীর বিধান দিয়েছেন শাস্ত্রকারেরা, যাঁরা অর্থের ব্যাপারে বারবার পরীক্ষিত হয়েছেন এবং যাঁরা স্বভাবতই শুদ্ধচরিত্র–পরীক্ষিতা শুচী। মনু একটা উদাহরণও দিয়েছেন, যেমন–শুচী আকরকর্মান্তে অর্থাৎ আকর বলতে সোনারুপোর উৎপত্তিস্থান এবং কর্মান্ত বলতে যেসব জায়গায় ধানচাষ, আখের চাষ ইত্যাদি হয়। অথবা নিদেনপক্ষে কারখানা। সোনার খনি কিংবা রুপোর খনিতে যে খানিকটা চুরিচামারি হবে সেটা না হয় সোনারুপোর দোষেই হল। কিন্তু প্রাচীন শাস্ত্রকারেরা জানতেন যে, ধান, পাট কিংবা অন্যান্য শস্যের ফলন কম দেখিয়ে রাজকর্মচারীরা যথেষ্ট চুরি করতে পারেন।
ঠিক এইসব জায়গাতেই নারদের সাবধান-বাণীটি মনে পড়ে–বাপু হে! তোমার রাজ্যে যারা আয়ব্যয়ের হিসেব রাখে, সেই গণনাকারী রাজপুরুষেরা এবং হিসেব-লিখিয়েরা ঠিকঠিক সময়ে টাকাপয়সা গুণে-গেঁথে রাখে তো? আসলে এই পুরো ব্যাপারটাই প্রাচীনকালের রেভিনিউ ডিপার্টমেন্টের এক্তিয়ারে পড়ে। রাজ্যশাসনে অত্যন্ত অভিজ্ঞ লোক হিসেবে অর্থশাস্ত্রকার কৌটিল্য জানতেন যে, এই বিভাগে পুকুরচুরি হতে পারে। এই বিভাগের প্রত্যেকটি চ্যানেল সম্বন্ধে তার মনোভাব অত্যন্ত কড়া। চুরি বন্ধ করার জন্য প্রত্যেক বিভাগের কোন্ জায়গা থেকে কত আয় ধরা আছে, নগরে এবং গ্রামে আয়ব্যয়ের হিসেব কী, কে কে সেখানে কাজে লেগেছে, কী কী ভেজাল মেশানো হতে পারে, এমনকি দাঁড়িপাল্লা, বাটখারা, জমি-জরিপের দড়ি খেয়াখাটের নৌকোটির ওপর পর্যন্ত কৌটিল্যের নজর আছে। কৌটিল্য বলছেন–প্রত্যেক বিভাগের আয়, ব্যয়, রাজকোষে জমা দেওয়া অর্থ কিংবা যে টাকা পাওয়া যেতে পারে এবং আয়ব্যয়ের শেষে যে উদ্বৃত্ত অর্থসব যেন খাতায় লেখা থাকে। তাছাড়া, এসব বিভাগে যেসব লোক নিযুক্ত থাকবে তারা যেন ব্রাহ্মণ না হয়, কিংবা রাজার আত্মীয় না হয়। অর্থাৎ হিসেবে গরমিল হলে শাস্তির সময় কেউ যেন ব্রাহ্মণ বলে পার না পায়, অথবা আত্মীয় বলে রাজার মমতা না হয়।
কৌটিল্যের সময়ে ফিনানসিয়াল ইয়ার শেষ হত আষাঢ় মাসের পূর্ণিমায়। ওইদিন সমস্ত হিসাবের খাতা “সিল” করে আয়ব্যয়ের উত্ত টাকা নিয়ে এসে জমা দিতে হত মহাগাণনিকের কাছে। এই জমা দেওয়ার আগে ভারপ্রাপ্ত অফিসারেরা নিজেদের মধ্যে আলাপ পর্যন্ত করতে পারবেন না। বিভিন্ন বিভাগের প্রধানদের পেছনে চর লাগানো থাকত এবং যাঁরা হিসেব লিখতেন তারা যে শুধু প্রতিদিনের হিসেব রাখতেন তা নয়; প্রতিদিনের, প্রতি পাঁচদিনের, প্রত্যেক পক্ষকালের, প্রত্যেক চারমাসের এবং শেষে এক বৎসরের আলাদা-আলাদা হিসেব রাখতেন। ছোটো কর্মচারী-করণিক যদি এই হিসেব ঠিক ঠিক মতো না লেখে এবং যেভাবে লিখতে বলা হয়েছে, সেইভাবে যদি না লেখে কিংবা আয়ব্যয়ের হিসেব অন্যরকম করে দেখায়–অন্যথা বাপি বিকল্পয়তঃ –তবে তার শাস্তি অবশ্যম্ভাবী। কৌটিল্য জানেন–করণিকের হাতে চুরিটা কীভাবে হয়। সেইজন্যে তিনি হিসেব লেখার ব্যাপারে ক্রমহীনতা পছন্দ করেন না। এক জিনিসের দুবার এনট্রি’ পছন্দ করেন না, এমনকি অন্যের বোধবিরুদ্ধভাবে হিসেব-লেখাও পছন্দ করেন না। কৌটিল্যের সময়ে উদ্বৃত্ত অর্থ যেটা রাজকোষে দেয়, সেটা খাতায় “এনট্রি” না করা মানেই ছিল চুরির দায়।
“ট্যাক্স” এর ব্যাপারটার ওপর আমাদের অর্থশাস্ত্রকারদের নজর ছিল সাংঘাতিক। পণ্ডিতেরা এমন অফিসারের সন্ধান পেয়েছেন যে, একটি পুরো রাজবর্ষের (ফিনানসিয়াল ইয়ারের সুযোগ নিয়ে করের টাকা সুদে খাঁটিয়েছে–কোশদ্ৰব্যানাং বৃদ্ধিপ্রয়োগঃ। টাকা খাটাচ্ছে খাটাও, কিন্তু একবার যদি কৌটিল্য ধরতে পারেন, তাহলে মুনাফার দ্বিগুণ আদায় করে ছাড়বেন তিনি।
আবার কর আদায়ের সময় হয়ে গেছে অথচ অফিসার করদাতার কাছ থেকে কর সংগ্রহ না করে ঘুষ খেয়েছেন, ট্যাক্সেবল নয় “সার্টিফিকেটও দিয়েছেন–এই অবস্থায় অপরাধী “অফিসার” রাজকোষের যা ক্ষতি করেছেন তার পাঁচগুণ দণ্ড বর্তাবে তার ওপর। আসলে বিভাগীয় কর্মাধ্যক্ষ, পুলিশ, করণিক–কেউই কিন্তু সন্দেহমুক্ত নয়।
নারদমুনি যুধিষ্ঠিরকে পুলিশের ব্যাপারেও খুব সাবধান থাকতে বলেছিলেন। বলেছিলেনধরো, তোমার রাজ্যে কাউকে কোনো অপরাধে অভিযুক্ত হলে ধরা হল। শুধু তাই নয়, অপরাধী যদি চোর হয়, তাকে হয়তো উপস্থিত বামাল-সমেত ধরা হল অর্থাৎ তাকে ধরার সাক্ষী-প্রমাণ সব উপস্থিত। এই অবস্থায়, নারদমুনি রীতিমতো পুলিশের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন–এই অবস্থায় তোমার রাজপুরুষদের হাত থেকে সে চোর ঘুষ দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে না তো কচিন্ন মুচ্যতে স্তেনো দ্রব্যলোভান্ নরষভ। মহাভারতের যুগের পুলিশেরা অনেক সময় ওপরওয়ালাদের চাপ সহ্য করতে না পেরে, যে চুরি করেনি তার ওপরে মিথ্যে “কে” দিয়ে কর্মকুশলতা প্রমাণ করার চেষ্টা করতেন। নারদ মুনির ধারণা, নিরাপরাধ লোক যদি চুরির দায়ে অভিযুক্ত হয়, তাহলে আপন সামাজিক মানমর্যাদা এবং উটকো ঝুটঝামেলা এড়ানোর জন্য আরও বেশি ঘুষ দেবে অথবা যে সত্যি অপরাধী, সে যদি অন্য লোককে কেসে জড়িয়ে দিতে পারে, তাহলে নিজে বাঁচল বলে সে পুলিশকে আরও ঘুষ দেবে এবং এই বেশি ঘুষের আশায়–অধিকধনলোভাৎ পুলিশও ভালো লোককে “কে” খাওয়াতে কিংবা তাকে মেরে ফেলতেও কসুর করবে না। পুলিশের তরফ থেকে এই ধরনের উদ্যোগ নারদমুনি কিন্তু সাংঘাতিক বলে মনে করেন। যুধিষ্ঠিরকে তাই তিনি সাবধান করে দিয়ে বলেছেন–তোমার দেশে ঘুষের লোভে মূর্খ রাজপুরুষেরা ভালো লোককে মেরেটেরে ফেলে না তো–অদৃষ্টশাস্ত্ৰকুশলৈ ন লোভাদ বধ্যতে শুচিঃ। পুলিশের অন্যায় আচরণ ছাড়া কাস্টমস-ডিউটির জায়গাটাও যে রাজকর্মচারীদের চক্ষুদানের জায়গা, মহাভারতের কবি সেটাও নারদমুনির মুখে খানিকটা ইঙ্গিত করেছেন। যুধিষ্ঠিরকে তিনি বলেছেন–তোমার রাজ্যে দূর দূর থেকে যেসব বণিক আসে পণ্য বিক্রি করে লাভ করার আশায়, সেইসব বণিকের বিক্রেয় পণ্যের ওপর তোমার রাজপুরুষেরা নির্ধারিত হারে শুল্ক আদায় করে তো? তোমার রাজ্যে বিদেশি ব্যবসায়ীরা ভালো ব্যবহার পায় তোতা? তাদের পণ্য বিক্রির ব্যাপারে কোনো ছলনা সহ্য করতে হয় না তো–উপিনয়ন্তি পণ্যানি উপধাভিরবঞ্চিতাঃ?
কৌটিল্য লিখেছেন–রাজকর্মচারীরা অন্তত চল্লিশ রকমভাবে রাজার। ধন আত্মসাৎ করতে পারে। এর মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ কায়দাগুলি হল–যে টাকা আগে আদায় হয়েছে, কিন্তু পরে খাতায় “এনট্রি” করা হচ্ছে। এই মাঝখানের সময়টা রাজকর্মচারীর ভোগে লাগে। ঘুষ খেয়ে করকিতে সাহায্য করা। যারা করমুক্ত, তাদের কাছ থেকে কর আদায় করা। এই টাকাটা পুরোই লাভ। কারণ, রাজা জানেন–যে করমুক্ত, তাকে হিসেবের মধ্যেই আনা হবে না। বেশি কর আদায় করে কম লিখে রাখা। যেখানে ধরুন, চাল, গম পাওয়ার কথা, সেখানে রাজকর্মী যদি খাতায় লেখে যে, “জোয়ার” পাওয়া গেছে, তাহলেও রাজপুরুষ ভালোই সংসার চালাতে পারে। আবার ধরুন রাজকোষ থেকে একজনকে পঞ্চাশ টাকা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু খাতায় লিখে রাখা হল একশ টাকা। কখনও বা। রাজবাড়ির রানিমা, রাজপুতুরদের জন্য জামাকাপড় কেনা হয়েছে এবং তার মূল্যও দেওয়া হয়েছে, কিন্তু রাজবাড়ির জাবদা খাতায় লেখা হল–”দাম দেওয়া হয়নি; রাজার সরকার পরে দামটি সরিয়ে নিলেন নিজে। রাজার প্রধান স্থপতি এক জায়গায় মন্দির কিংবা বাড়ি বানানোর জন্য লোক লাগিয়েছেন। সেখানে কর্মকরের সংখ্যা বেশি দেখিয়ে অতিরিক্ত নামগুলির জন্য দেয় টাকাটি নিজে আত্মসাৎ করলেন। দাঁড়িপাল্লা আর বাটখারার (কূটমান এবং কূটতুলা) কারসারজিতে যারা ওজনে মারছে, ঘুষ খেয়ে সেগুলি না ধরা। টাকশালের অধিপতি যিনি, তিনি স্বর্ণমুদ্রায় তামা মিশিয়ে যদি নিয়মিত সোনা মেরে গৃহিণীর সাতনরি হার গড়িয়ে দেন, তাহলেই বা ক্ষতি কী?
আসলে এই সব কিছুই চুরি। মহাভারতে, পুরাণে, সাহিত্যে এরকম, চুরির হদিশ আছে হাজার রকমের। তার কয়েকটা মাত্র উল্লেখ করেই আমরা আমাদের পুরানো কথায় ফিরে এসেছি। বিদ্যাপতির বহু আগে কৌটিল্য লিখে গেছেন–রাজসরকারের চাকুরেরা বুবি চোর না হয়ে পারে না। তিনি বলেছেন–যেমন মুখের মধ্যে জিবের তলায় যদি মধু রাখা যায়, তাহলে সেই মধুর স্বাদ একটুও নেব না বলে প্রতিজ্ঞা করলেও যেমন সে স্বাদ না নিয়ে পারা যায় না, তেমনি রাজার অর্থ-সংক্রান্ত ব্যাপারে নিযুক্ত রাজপুরুষেরাও অল্প হলেও রাজার টাকা কোনো-না-কোনো ভাবে না চেখে থাকতে পারেন না–অর্থস্তথা হ্যর্থচরেণরাজ্ঞঃ, স্বল্পো’প্যনাস্বাদয়িতুং ন শক্যঃ। আমরা বলতে পারি কুটিলমতি কৌটিল্য! তোমার বড়ো সন্দেহবাই। রাজপুরুষেরা যে চুরি করেছেন, তা তুমি জানলে কী করে। কৌটিল্য উত্তর দেবেন–জলের মধ্যে চলাচল করার সময় মাছ যেমনি ঢুকুটুকু করে জল খেলেও লোকে ধরতে পারবে না, তেমনি রাজার টাকা যেসব জায়গায় ছড়ানো রয়েছে, সেখানে রাজপুরুষেরা টাকা মারলেও সেটা বেশিরভাগ সময় ধরা যায় না–জ্ঞাতুং ন শক্যাঃ সলিলং পিবন্তঃ। কৌটিল্যের ধারণা, আকাশে উড়ে-যাওয়া পাখির গতিও জানা যেতে পারে, কিন্তু রাজকর্মচারীর চুরি জানা বড়ো কঠিন। তাই তিনি বলেন যদি দ্যাখো, হঠাৎ কোনো রাজকর্মচারী হঠাৎ ফুলেফেঁপে উঠেছে–উপচিতা–তাহলে সব বুঝেশুনে তার টাকাপয়সা নিয়ে নেবেন রাজা। সত্যি বলতে কী, শ্রমিক-আন্দোলনের সঙ্গে কৌটিল্যের যোগ ছিল কিনা কে জানে! কেননা, এই কর্মচারীদের ছাঁটাই করেননি, শুধু উঁচু “পোস্ট” থেকে নীচে নামিয়ে দিয়েছেন মাত্র বিপর্যস্যেচ্চ কর্মসু। তবে এই ছাঁটাই না করে পোস্ট থেকে নামিয়ে দেওয়ার মধ্যেও কৌটিল্যের পঁাচ আছে। কৌটিল্যের ধারণা, পদস্থ লোককে নীচে নামিয়ে দিলে সে আর টাকা খাবে না এবং চাকরিটা থাকার ফলে যা খেয়েছিল, তা উগরে দেবে–যথা না ভক্ষয়ন্ত্যর্থং ভক্ষিতং নিবন্তি বা।
আমরা আর বাড়াব না কেননা, রাজকার্যে চুরির জায়গা অনন্ত। আমি শুধু ট্র্যাডিশনের কথা বলেছি। তবে দুঃখ এই যে, ঘুষখোর এবং চোর রাজপুরুষদের ধরার জন্য কৌটিল্য পূর্ণবিস্তারিত এক গোয়েন্দা-ব্যবস্থা চালু রেখেছিলেন। কিন্তু আমাদের পবিত্র গণসমাজতন্ত্রে সেই ব্যবস্থা চাকরিজীবীদের শুধু সম্মান নষ্ট করবে, শোধরাবে না। কাজেই আমরা বলব গণতন্ত্রে সরকারি টাকা কেউ মারে না, মারতে পারে না–আইন আছে না!