১২. পুলিস কেলেঙ্কারি

১২. পুলিস কেলেঙ্কারি

বেলা চড়ে এলে নৌকায় রান্নার আয়োজন শুরু হয়ে গেল। বাসনপত্র কম আনা হয়েছে। তবু যাহোক কাজ চালান যেত কিন্তু ভাতটাই কিছুতেই সেদ্ধ করা যাচ্ছে না। টিপু বাসা থেকে কেরোসিনের চুলা নিয়ে এসেছিল সেটি মাঝে মাঝে হঠাৎ দপ করে বিরাট বড় শিখা নিয়ে জ্বলে ওঠে। হাত পুড়ে, গুঁড়ো মশলা চোখে ঢুকে বিচ্ছিরি অবস্থা। শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে টিপু, সলিল আর মিশুকে বসিয়ে রেখে আমি হীরা আর রবিন বেড়াতে বের হলাম। উদ্দেশ্য ডাকাতদের নৌকাটা কাছে থেকে লক্ষ্য করব, সেই ফাঁকে বাজারটাও ঘুরে আসব।

গায়ের চাদরটা খুব ভাল করে গায়ে জড়িয়ে আমি উল্টো দিক থেকে ঘুরে এসে খুব অন্যমনস্কর ভাব করতে করতে ডাকাতদের নৌকাটার দিকে এগিয়ে গেলাম। ভিতরে প্রায় খালি গায়ে বসে থাকা কালো কুচকুচে লোকগুলি আমার দিকে কড়া চোখে তাকাল। আমি উদাস ভাবে চোখ ঘুরিয়ে নৌকাটার খুব পাশে দিয়ে হেঁটে গিয়ে নদীতে হাঁটু পানিতে নেমে হাত মুখ ধুতে লাগলাম। ঠাণ্ডা পানিতে সারা শরীর শিরশির করে উঠল কিন্তু উপায় কি? আমি কান তীক্ষ্ণ করে ওদের কথাবার্তা শোনার চেষ্টা করলাম। কিন্তু চাপা গলায় ঝগড়ার সুরটাই ধরা পড়ল, কোন কথা বোঝা গেল না।

একটু পরে আমি উঠে এলাম। আড়চোখে ওদের লক্ষ্য করে শার্টের হাতা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে রবিন আর হীরার কাছে ফিরে এলাম। ওরা অল্প দূরে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। রবিন জিজ্ঞেস করল, কিছু বুঝতে পারলি?

কিচ্ছু না!

কথাবার্তা শোনা যাচ্ছিল?

না, শুধু ঝগড়া করছে। আমার দিকে এমন কড়া চোখে তাকাল—

সত্যি?

সত্যি! আর আমাকে দেখেই ওরা ফিসফিস করে কথা বলতে শুরু করল। কিচ্ছু শোনা যায় না।

এবারে তাহলে আমি ওদের কাছ থেকে ঘুরে আসি। হীরা শার্টের হাত গুটিয়ে প্রস্তুত হতে থাকে।

না, এক্ষুনি না। রবিন গম্ভীর ভাবে বলে, তাহলে সন্দেহ করবে। চল বাজার থেকে ঘুরে আসি।

আমরা বাজারটা ঘুরতে গেলাম। বুধবার করে সেখানে হাট হয় তখন নাকি বাজার খুব জমে ওঠে। আজ মাত্র সোমবার। আমরা সেই ছোট বাজারটাই ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। মাছের বাজারে মাছের আঁশটে গন্ধে থাকা যায় না। ছোট ছোট কুচো মাছের ভাগ ছ পয়সা করে দাম; একটা মাঝারি রুই মাছ হীরা দাম করল, চার টাকা, সাড়ে তিন টাকাতে দিয়ে দিতে পারে। কিছু কই মাছও আছে দেড় টাকা কুড়ি। এক পাশে আলু পটল টমেটো এই সব তরিতরকারি। দুই পয়সা দিয়ে রবিন দুটো আতা কিনল, ভারি মিষ্টি খেতে। একটা বড় বট গাছের নিচে লাল টিনের ঘরে পোস্ট অফিস, আমি একটা পোস্ট কার্ড কিনলাম নান্টুকে চিঠি লিখব বলে। রবিন অবিশ্যি চেঁচামেচি করতে লাগল এখন চিঠি লিখলে পোস্ট অফিসের ছাপ দেখে আমাদের খুঁজে বের করে। ফেলবে।

বাজারের শেষ মাথা থেকে বড় মাটির সড়ক চলে গেছে। একটু দূরে একটা পাকা দালান। বাইরে সেন্ট্রি। পাহারা দিচ্ছে দেখে বুঝতে পারলাম ওটি হচ্ছে থানা। কাছে গিয়ে দেখলাম নীল রংয়ের উপর সাদা রং দিয়ে থানার নাম লেখা। রবিন অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে আমার আর হীরার দিকে তাকাল। আমরা থানাটাতে কতজন পুলিস আছে অনুমান করার চেষ্টা করলাম, পরে প্রয়োজন হতে পারে।

হঠাৎ করে রবিনের খেয়াল হল আমরা অনেকক্ষণ হল ডাকাতের নৌকাটা ছেড়ে এসেছি, ওটাকে একনজর দেখে আসা দরকার। ছেড়েই দিল কিনা কে জানে!

তাড়াতাড়ি আমরা বাজারটার মাঝে দিয়ে হেঁটে নদীর তীরে রওনা দিলাম। মাছ বাজারের পাশে দিয়ে যাওয়ার সময় লক্ষ্য করলাম একটা খাকী পোশাক পরা ঢিলেঢালা পুলিস মাছ দাম করছে। লোকটাকে কেমন একটু চেনা চেনা মনে হল। হয়তো মিশুদের বাসায় দেখে থাকব। পা চালিয়ে নদীর তীরে এসে দেখি দূরে ডাকাতদের নৌকাটা এখনো দেখা যাচ্ছে, আরো দূরে আমাদের নৌকাটা। ডাকাতদের নৌকাটা ঢেউয়ের সাথে সাথে অল্প অল্প দোল খাচ্ছিল। একজন ডাকাত মাটির গামলায় করে কি যেন ধুয়ে ভিতরে ঢুকে গেল।

হীরা বলল, এবারে আমি যাই।

রবিন বলল, দাঁড়া আগে আমি ঘুরে আসি। তারপর শার্টটা খুলে কাঁধে ফেলে গম্ভীর ভাবে হেঁটে গেল! নৌকাটার কাছে গিয়ে গেঞ্জিটাও খুলে ফেলল, তারপর সেগুলি একটা ঝোপের উপর রেখে আস্তে আস্তে নৌকার পাশ দিয়ে নদীর পানিতে নামতে লাগল। ওর ভাব দেখে মনে হচ্ছিল গোসল করবে। নৌকাটার খুব কাছে ঘেঁষে দুটো ডুব দিয়ে উঠে ও খুব কায়দা করে গা হাত পা ডলতে লাগল। দেখে বোঝা যাচ্ছিল না কিন্তু আসলে নিশ্চয়ই ও কান খাড়া করে রেখেছে। হঠাৎ গা রগড়ানো বন্ধ করে কান খাড়া করে নৌকার দিকে ঝুঁকে পড়ল, নিশ্চয়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু শুনতে পেয়েছে। ঠিক সেই সময়ে একজন ডাকাতকে বের হতে দেখে ও বিপুল লেগে বুক ঘাড় রগড়ে রগড়ে ময়লা বের করতে লাগল, ঈশ্বরের কৃপায় সেটির ওর অভাব ছিল না। ডাকাতটি আবার ভিতরে ঢুকে গেল। আমার বুক ধুকধুক করছিল, আমি এদিক সেদিক তাকালাম। এমন সময় দেখি মাছ বাজারে দেখা সেই ঢিলেঢালা পুলিসটা হাতে এক কুড়ি কই মাছ নিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। আমি হীরাকে একটু টিপে দিয়ে গম্ভীর ভাবে একটা ঘাস ছিঁড়ে নিয়ে চিবুতে লাগলাম!

পুলিসটা আমাদের খুব কাছে এসে দাঁড়াল। আমাদের খানিকক্ষণ ভাল করে লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করল, তোমাদের বাড়ি কোথায়?

ঢাকা। কেন জানি আমার মনে হল এখন বোকার মত উত্তর দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

এখানে কোথায় এসেছ?

চাচার বাড়ি।

চাচার বাড়ি কোথায়?

হীরা ফ্যাকাসে মুখে আমার দিকে তাকাল। আমি একবার ঢোক গিললাম। ইশ! এই এলাকার একটা গ্রামের নামও জানি না! থানাটার নামটা পর্যন্ত ভাল করে পড়ে আসলাম না।

কোথায় চাচার বাড়ি? পুলিসটা আরেকটু এগিয়ে এল। মনে হল খপ করে হাত ধরে ফেলবে! আমি সন্তর্পণে একটু পিছিয়ে এসে বললাম, পলাশপুর, নাজিরপুর থানায়।

সত্যি সত্যি নাজিরপুর থানায় পলাশপুর নামে একটা গ্রাম আছে, স্কুল থেকে একবার পিকনিকে গিয়েছিলাম। তবে সেটি বহুদূরে।

পুলিসটা একটু থতমত খেয়ে বলল, তা এখানে কি করছ?

চাচার সাথে এসেছি।

চাচা কই?

মাছ কিনতে গেছেন। এক্ষুনি এসে পড়বেন। ঐ তো আমাদের নৌকা আমি একটা নৌকা দেখিয়ে দিলাম।

কতক্ষণ যে এভাবে একনাগাড়ে মিছে কথা বলতে হবে কে জানে। আর এই ব্যাটা পুলিস আমাদের পিছু লাগল কেন বুঝতে পারলাম না। সে এবারে হীরাকে ধরল। তোমার বাড়ি কোথায়?

হীরা কিছু বলার আগেই আমি বলে উঠলাম, ও আমার চাচাত ভাই। ওর আব্বার সাথেই আমরা টাউনে যাচ্ছি।

পুলিসটা একটু হতাশ হল মনে হল। তবু আমাকে জিজ্ঞেস করল, নাম কি তোমার?

খালেকুজ্জামান চৌধুরী। আমি রঞ্জুর নামটা বলে দিলাম!

তোমার?

শফিক আহমেদ।

শফিক ভাইয়ের নামটা হীরা নিজের নাম বলে চালিয়ে দিল। পুলিসটা একটু কুটিল চোখে তাকাতেই হীরা বিবর্ণ হয়ে বলল, পুরো নাম শফিক আহমেদ চৌধুরী।

আব্বার নাম?

নাজির আহমেদ চৌধুরী। এবারে হীরা আর চৌধুরী বলতে ভুল করল না।

পুলিসটা আমাদের লক্ষ্য করতে করতে বলল, এদিকে তোমাদের বয়েসী কোন ছেলেপেলে দেখেছ? একজনের হাত কাটা, আরেকজনের হাত ভাঙা? মোট ছয়জন?

হীরার চোয়াল ঝুলে পড়ল আর আমার হৃদপিণ্ড লাফিয়ে গলার কাছে উঠে ধুক ধুক করতে লাগল। পুলিসটা তাহলে আমাদেরই খোঁজ করছে! জ্বর ছিল বলে চাদর গায়ে বেরিয়েছি প্লাস্টার করা হাতটা ঢাকা, নইলে কথাবার্তা না বলে ক্যাঁক করে ঘাড় আঁকড়ে ধরত। পুলিস তাহলে আমাদের সবাইকে খোঁজ করছে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি খোঁজ পেল কেমন করে? আমি আন্দাজ করলাম, মিশুর আব্বা ডি. এস. পি., তিনিই হয়তো আশেপাশে সব থানাতে ফোন করে দিয়েছেন। আমি আড়চোখে হীরার দিকে তাকালাম হীরা আমার দিকে তাকাল। আমি একটু ঘুরে নদীতে গোসল করতে থাকা রবিনকে দেখতে গিয়ে থেমে গেলাম। পুলিসটাও যদি ওদিকে তাকায়? তাহলে বুঝতে কিছু বাকি থাকবে না! এখন যদি রবিন গোসল শেষ করে কাটা হাতটা দুলিয়ে দুলিয়ে ফিরে আসে? কিংবা বাতাসে চাদরটা উঠে গিয়ে যদি প্লাস্টার করা আমার হাতটা বেরিয়ে পড়ে? আমি চাদরটা ভাল করে জড়িয়ে হাত দুটো চাঁদরের তলাতেই ভাঁজ করে বুকের উপর রাখলাম। দেখতে এখন একটু চালিয়াৎ মনে হলেও কেউ সন্দেহ করবে না একটা হাত প্লাস্টার করা! তবুও আমার বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল।

দেখেছো, না? পুলিসটা আমাদের এরকম হতভম্ব হতে দেখে উৎফুল্ল স্বরে জিজ্ঞেস করল। আমি ঢোক গিলে মাথা নাড়লাম।

কোথায় দেখেছ? কোন্ দিকে গেছে!

এই তো এদিকে। আমি থানার পাশে ডিস্ট্রিক বোর্ডের বড় সড়কটা দেখিয়ে দিলাম।

কখন গেছে? পুলিসটা একটু উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করল।

এই তো এই মাত্র। পাঁচ মিনিটও হয়নি।

হীরা ঢোক গিলে বলল, একজনের বাম হাতটা কাটা।

আমি বললাম, না ডান হাতটা। যদিও খুব ভাল করে জানি রবিনের বাম হাতটাই কাটা।

ইশ! হীরা সত্যি সত্যি ক্ষেপে উঠে বলল, বাম হাত না? সেই যে

ধেৎ! এই দিক দিয়ে গেল, ডান হাতটা কাটা। আরেকজনের হাতে প্লাস্টার ওরও ডান হাত। আমি ডান হাতটা বের করে হীরার নাকের উপর দিয়ে ঘুরিয়ে আনলাম।

পুলিসটা আমাদের ঝগড়া থামিয়ে দিয়ে দ্রুতপায়ে থানার দিকে হেঁটে গেল। আমি খুব সন্তর্পণে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নদীর দিকে তাকালাম। রবিন শার্ট পরে এগিয়ে আসছে।

কাছে এসে রবিন উত্তেজিত মুখে কি একটা বলতে যাচ্ছিল হীরা মুখ খিঁচিয়ে উঠল আর আমি দাবড়ানি মেরে তাকে থামিয়ে দিলাম। আমার মুখে সব শুনে রবিনের চোখ কপালে উঠল, বলল, সর্বনাশ! তাড়াতাড়ি নৌকায় চল।

নৌকায় যেতে যেতে রবিন বলল, ডাকাতেরা আজ রাতে শুভাপুরে ডাকাতি করবে।

সত্যি?

হা, ইদরিস খাঁর বাড়িতে।

স্পষ্ট শুনেছিস, নিজের কানে?

না, অন্যের কানে বলে রবিন মুখ খিঁচিয়ে উঠল। কথা না বলে আমরা ছুটতে ছুটতে নৌকায় এসে উঠলাম।

নৌকায় পৌঁছে দেখি রান্নাবান্না শেষ। মিশু বাজারে গেছে আমাদের খুঁজে আনতে। সলিল আর টিপু আমাদের খুব একচোট গালি দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু আমাদের মুখে সব শুনে ফ্যাকাসে মেরে গেল। সলিল শুধু বলল, সর্বনাশ! মিশুকে যে এ এলাকার সব পুলিস চেনে, ওদের বাসাতে প্রায়ই যায়!

মিশুর জন্যে চিন্তায় পড়ে গেলাম। টিপু খুব সাবধানে নদীর তীর দিয়ে মিশুকে খুঁজতে গেল। একটু পরে ছুটতে ছুটতে হাজির হল। লাফিয়ে নৌকায় উঠে বলল, নৌকা ছাড়ো! মিশুকে পুলিস ধরেছে।

ভাটা শুরু হয়ে গিয়েছিল। দ্রুত বৈঠা ফেলে নৌকা নিয়ে আমরা সামনে অদৃশ্য হয়ে যেতে যেতে তীরের দিকে তাকালাম। একজায়গায় খুব ভিড়। নিশ্চয়ই মিশুকে যেখানে ধরা হয়েছে সেখানেই ভিড়টা। আহা বেচারা! ওকে দেখামাত্র নিশ্চয়ই চিনে ফেলেছিল, মিথ্যে কথা বলার সুযোগও পায়নি। ওর চিন্তা নেই অবিশ্যি আরামে বাসায় পৌঁছে যাবে, বাসায় একটু আধটু পিটুনি খেতে পারে, (সে তো আমরাও খাব) কিন্তু ডাকাত ধরার আনন্দ তো আর পেল না।

রবিন গলা বের করে আরেকটা নৌকাকে জিজ্ঞেস করল, শুভাপুর কোন দিকে?

নৌকার মাঝি আমরা যেদিকে যাচ্ছি সেদিকেই দেখিয়ে দিল! আমরা দ্রুত নৌকা বাইতে লাগলাম। একটু পরেই অনেক পুলিশ আমাদের খুঁজতে বের হবে তার আগেই পালিয়ে যেতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *