ব্যাপারটা নিয়ে শ্যামের বাড়িতে রীতিমতো তাদের একটা পরিবারিক সভা বসে গেল। এমন কী মধু পর্যন্ত আজ সে সভার শরিক। অবশ্য তার শরিকানা আটকে রাখা আর সম্ভব ছিল না। কৈশোরের সীমা সে আজ পেরুতে বসেছে, লায়েক হয়েছে। দরকার হলে শ্যামের সঙ্গে যুক্তি-তর্ক দিয়ে নিজের মতামত জাহির করতে শিখেছে সে।
সবাই যখন এ সভায় লখাইয়ের চিন্তিত মুখের দিকে শঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল, তখন একমাত্র তার চোখ থেকেই বিস্মিত প্রশংসা ও সম্মান ঝরে পড়ছে। লখাইয়ের দোষ তো দূরের কথা, এমন একজন সাহসী পুরুষ তার আত্মীয় এবং ঘরের লোক, এতে নিজেকে সে গৌরবান্বিত মনে করছে।
সে বলল, এতে কিন্তু আমি অন্যায্যের কিছু দেখিনে, যাই বলো। ও শালার জাতের বড় বড় হয়েছে, কিছু মানতেই চায় না।
শ্যাম ধমকে উঠল, ল্যায্য-অল্যায্যের কী বুঝিরে তুই, বড় বড় কথা বলছিস্? বিষ নেই ঢোঁড়া, তার কুলোপানা চক্কর। গোরাদের কত ক্ষ্যাতা, তুই জানিস?
কালীবউ কিন্তু দোমনা। দ্বিধাবিভক্ত মন তার দুদিকে। ছেলে মধুর বয়স এবং পৌরুষ সে আজ আর এক কথায় উড়িয়ে দিতে পারে না। শ্যামের বিচক্ষণতাও ফেলবার নয়। মূলত লখাইয়ের ব্যাপারে সে ভয় পেয়েছে, মন তার নানান দুশ্চিন্তায় আচ্ছন্ন।
মধু বাপের কথায় প্রতিবাদ করল, ক্ষ্যামতা থাকলেই তুমি যা খুশি তাই করতে পারো?
একে উৎকণ্ঠা, তায় আবার মধু পর্যন্ত বাপকে জোর করে বোেঝাতে আসছে এতে শ্যাম আরও উত্তেজিত হয়ে উঠল। চেঁচিয়ে উঠল সে, হ্যারে গুয়োটা ঠা, ক্ষ্যামতা থাকলে সব করা যায়, জগৎ ড়ুব্বে দেয়া যায়।
মধুও বলে উঠল, তবে তোমার অমন ক্ষ্যামতা শেষ করে দেয়াই ভাল।
শ্যাম এবার ক্ষিপ্ত হয়ে রুখে বলল, শোরের বাচ্চা, এক থাপ্পড়ে তোর চোপড়া ভেঙে ফেলব আমি। ক্ষ্যামতা শেষ করবে! যা না, যা-যা, খুড়ো-ভাইপোতে একবার লড়ে আয় না, দেখি ক্ষ্যামতার দৌড় কত দূর।
লখাই মধুকে বলল, তুমি চুপ যাও তো বাবা, কথা বলল না। ওতে বিবাদ বাড়বে।
কিন্তু ব্যাপারটা তাকে সত্যিই ভাবিয়ে তুলেছে। তার বারবার মনে পড়ল সেজবাবুর একটি কথা, কোম্পানির সম্বন্ধে যে, ঈশ্বর আজ ওদের সহায়, শক্তিতে ওরা আজ সিংহবাহিনী। তাই যদি সেজবাবু, তা হলে বলল, আমরা কি শেয়াল না সিংহের শিকার হরিণ। আর শিকারই যদি হই, তবে ভগবান এ প্রাণে এত জ্বালা ক্রোধ ক্ষোভ কেন দিয়েছেন, ঘৃণা কেন এত মনেযদি কোনও প্রতিশোধই নেওয়া যাবে না! আর লুকনো মনকে অনুক্ষণ পিষে রাখার মধ্যেও যদি তার একছিটে আগুন বেরিয়ে আচমকা প্রলয় বাধায়, তার জন্য এত দুশ্চিন্তার ভারও যে সহ্য হয় না।
কেবল কাঞ্চনেরই থেকে থেকে মনে পড়ছিল সেই বিচিত্র এক রাত্রির কথা। লখাইয়ের সেই দুরন্ত যন্ত্রণা, চোখে জল আর সেই সেপাই লড়াইয়ের কথা। সেই রাত্রির কথা ভাবলেই লখাই তার কাছে দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে, মনে হয়, ওর মন খ্যাপামির মধ্যে কী এক অদৃশ্য সূত্র যেন সেদিনের ঘটনার মধ্যে গ্রথিত আছে। কিন্তু সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ লখাইয়ের কাছে, সেকথা কাউকেই বলা যাবে না।
যাই হোক একথা সকলেই বুঝতে পারছিল, তাদের নিজেদের মধ্যে যতই বাদানুবাদ হোক, যতই তারা দুশ্চিন্তা করুক তাতে কিছুই আসবে যাবে না। যা হবার তা হবেই এবং তার জন্য তাদের ধুকপুকুনি নিয়ে প্রতীক্ষা করতে হবেই।
শ্যাম কেবল আপনমনে বলতে লাগল, কোম্পানি হল রাজা, তার প্রজা জমিদারে আমাদের যে সব্বোনাশ করল, তাতে মুখ ফুটে একটা কথা কেউ বলতে পারল না, বলে ক্ষ্যামতা। ওই তো পবনা চাঁড়ালের দেনার কাগজপত্তর নগিন ঘোষে বিকিয়ে দিল জমিদারকে। জমিদার লুটিশ দিয়েছে পবনাকে ভিটে ছাড়তে। কে ঠ্যাকায় অ্যাাঁ, কে ঠ্যাকায়?