১২. পরিবাদ বা স্ক্যান্ডাল
ক. কেউ জন্মায় নারী, কেউ পুরুষ হয়ে। কিন্তু তা সত্ত্বেও মানুষের ব্যক্তিগত যৌন অভ্যাস আর তার বাহ্যিক লিঙ্গ পরিচয়, দুটো সবসময় এক হয় না। পুরুষ এবং নারীর সত্যিকারের যৌন অভ্যাস নিয়ে আজ যথেষ্ট ঝড় বইছে বিশ্বময়। বিশেষ করে আমেরিকা আর ইয়োরোপে। সেসব দেশেও মানুষের যৌন অভ্যাস এখন আর কোনও রাখঢাকের ব্যাপার নয়। পুরুষ। অথচ সে পুরুষ নয়! নারীর প্রতি তার আকর্ষণ নেই। তার আকর্ষণ, পুরুষ। কিংবা নারী। সে নারী নয়! পুরুষের বদলে তার আকর্ষণ, নারী। যাকে বলা হয় সমকামিতা। কিংবা একজন নারী বা পুরুষ, সে আকর্ষণ অনুভব করে, নারী-পুরুষ দু’জনেরই প্রতি। যাকে বলে, উভকামিতা। এই দু’ধরনের অনুভূতি নিয়ে জন্মানো মানুষ, সারা বিশ্ব জুড়েই রয়েছে। নরনারীর স্বাভাবিক যৌনজীবনের মতোই এদের জীবন। একে অস্বীকার। করার কোনও উপায় নেই। করলে ব্যক্তির জন্যে তা চরম দৈহিক ও মানসিক শাস্তির নামান্তর হয়ে উঠবে। তা সত্ত্বেও আমরা তা মেনে নিতে পারি না। আজকাল প্রচুর সমকামীদের বিয়ে হচ্ছে। তারা নিয়মিত ঘর-সংসার করছে। তবে, সমকামী আর উভকামিতার বিষয়টা কোনও পরিবারের জন্যেই সুসংবাদ নয় এবং নিঃসন্দেহে যে-কোনও বাবা-মায়ের জন্য তা হৃদয়বিদারক। কিন্তু এই অনুভূতি নিয়ে জন্মানো মানুষটির কষ্টও কি কম। বাবা কাঁদে। মা কাঁদে। বোঝায়। কিন্তু তার অনুভূতি আলাদা। তার ভিন্নতাকে সাধারণভাবে আমাদের পক্ষেও গ্রহণ করা দুরূহ। তবে স্বস্তির সংবাদ এই যে, পশ্চিমে বিষয়টি, রাজনৈতিক ও সামাজিক দিক দিয়ে দ্রুত প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। সেসব দেশে সমকামীরা বিয়ে, পালক সন্তান, সম্পত্তি সবকিছুতেই সমান অধিকার পেতে শুরু করেছে। কিন্তু পূর্বে অধিকাংশ দেশেই বিষয়টি যেমন ধর্ম-বিরুদ্ধ, তেমনি সমাজ-বিরুদ্ধ। কিন্তু তা সত্ত্বেও একে রোধ করা যাচ্ছে না।
সমকামীরা আমাদেরই আশপাশে। ছোটবেলায় হঠাৎ দেখেছি, গলির ভেতরে, ঘরের পেছনে, হঠাৎ নিরু কাকা আর নিমাই, তুলি আর মালতী, মিজান-শমসের মিজান-মালেকা। ওদেরকে দেখেছি অন্যরকম ব্যবহার করতে। হঠাৎ হয়তো ওদেরকে দেখেছি জড়িয়ে চুমু খেতে। তখন ঠিক বুঝতে পারিনি। তবে আজ বুঝি যে ওরা আসলে সম বা উভকামী।
সমকামী বা উভকামীদের হাবভাব চলাফেরা কথা বলার ভঙ্গি সব অন্যরকম। কিন্তু আমাদের রক্ষণশীল সমাজে এই নিগূঢ় সত্যকে ওদের লুকিয়ে চলতে হয়। এবং এই অনুভূতি যাদের আছে তাদের সঙ্গে অন্য লিঙ্গের মানুষের বিয়ে হলে সেই বিয়ে সবসময় টেকেও না। আর টিকলেও সুখের হয় না। আবার দেখা গ্যাছে কখনো কখনো অনেকেরই বিয়ের পাশাপাশিও গোপন জীবন চলছে। ঘরের বৌ অসুখী, অতৃপ্ত। স্বামীর এই গোপন অভ্যাস, সে জানে না। নিজের সমস্যাগুলো ঠিকমতো মোকাবিলা না করতে পারার ফলে স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের যৌনজীবনের সঙ্কট, মধ্য বয়সে পৌঁছে আরও অনেক সমস্যায় রূপ নিতে পারে। শরীরকে অস্বীকার করতে করতে, মানুষ একসময় বাধ্য হয় পরাজিত হতে, অনুভূতি এবং অভ্যাসের কাছে। শরীরের প্রতিবাদের মুখে, প্রকাশ হয়ে যায়–গোপন পরিচয়। যা সে একা বহন করে করে শেষ হয়ে যাচ্ছে। একসময় জানাজানি হয়ে যায় সেই অজানা।
অনেকেই সম বা উভয়কামিতার বিষয়টি নিজেরাও ঠিক বুঝতে পারে না, বিয়ে না হওয়া অবধি। বিয়ের পরে দ্বিতীয় শরীরের প্রতি অনীহা থেকে সমস্যার প্রথম আবিষ্কার। এবং যতই সে ভাবে ঠিক হয়ে যাবে বা সেরে যাবে, কখনোই তা ঠিকও হয় না, বা সেরেও যায় না। সম বা উভয়কামিতা দুটোই সত্য। সত্য, যা সত্য। সত্যকে অস্বীকার করা যাবে না। কিছুতেই না। কারণ ওরাও ভালোবাসে, ঠিক আপনার এবং আমার মতোই। যেমন ভালোবাসে স্বামী ও স্ত্রী। সম বা উভকামিতা, এক ধরনের প্রবৃত্তি। ক্ষুধা ক্ষুধাই।
ক্ষুধা পাকস্থলীর। ক্ষুধা যৌনাঙ্গের। তীব্র ক্ষুধা পেলে ওরা প্রতিবাদ জানাবে। পাকস্থলী আর যৌনাঙ্গ দুটো দুই জিনিস; ক্ষুধার যন্ত্রণা এক। শরীরের অন্যান্য অনুভূতির মতোই সম বা উভয়কামিতাও। যদিও এগুলো মধ্য বয়সের সমস্যার ফ্রেইমে ঠিক আঁটে না, তবুও বলা চলে এই সঙ্কটকালে এসে তীব্র হয় যে বয়সে সেটাই মধ্য বয়স। মানুষের যৌন অনুভূতি একটি মানবিক বিষয়। সূক্ষ্ম, ব্যক্তিগত এবং গোপন।
নিজেকে ভালোবাসার, ভালো লাগার বিষয়। যা স্বাভাবিক, যা প্রাপ্য। দেহের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মতো যৌনাঙ্গেরও রয়েছে নিজস্ব তাড়না। অনুভূতি ও মন। ওদের একটা আলাদা পৃথিবী আছে। ওরাই ঠিক করে নেয় কার কি চাই। যৌনাঙ্গের বুদ্ধি, অনুভূতি ও মনের বিরুদ্ধে যে-কোনও রকম বিধিনিষেধ বা বিরোধিতা, বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টির জন্যে যথেষ্ট। আর এই বিরূপ প্রতিক্রিয়াই বিশেষ করে দেখা যায় ধর্ম প্রতিষ্ঠানগুলোতে, যেখানে প্রচণ্ড রকমের ধর্মীয় অনুশাসনের কারণে মানুষের এই মৌলিক চাহিদার বিরুদ্ধে দিয়েছে নানারকম বিধিনিষেধ। লিঙ্গের ওপরে যারা ঢাকনা দিয়েছে বা ১৪৪ ধারা। চলে না। চলবে না। কিছুতেই না।
খ. চার্চের মধ্যে, ক্যাথলিক চার্চের অনুশাসনে রয়েছে যাজকদের বিয়ে বা সহবাস নিষিদ্ধ। কিন্তু ২০০২ সালের শুরু থেকে ক্যাথলিক চার্চের ভেতরে যেসব লোমহর্ষক কাহিনী আবিষ্কার হতে শুরু করেছে খোদ আমেরিকাতে, তারপরেও কি কোনও সন্দেহ থাকা উচিত যে, লিঙ্গেরও রয়েছে নিজস্ব মন ও অনুভূতি যার কাছে ধর্মীয় অনুশাসন টাসন সবই বৃথা। প্রবৃত্তির তাড়না বলে কথা। চার্চের যাজকদের হাতকড়া পরিয়ে কোর্টে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, কারণ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, বছরের পর বছর নাবালক ধর্ষণ। রামকৃষ্ণ মিশনেও রয়েছে, ক্যাথলিক চার্চের মতোই কঠোর বিধিনিষেধ। কিন্তু তাই বলে কি মিশনারিরা ক্ষুধার্ত বসে থাকে? গবেষণাশেষে যখন কোনও মতবাদ দেয়া হয়, তার বিরুদ্ধে বা পক্ষে বিতর্ক সম্ভব। কিন্তু বৈজ্ঞানিক গবেষণা ব্যতিরেকে যে-কোনও সিদ্ধান্ত ভিত্তিহীন। এবং সমাজের জন্যে অকল্যাণকর বলে তা তাৎক্ষণিকভাবে পরিত্যাজ্য হওয়া উচিত।
মাদ্রাসা শিক্ষার ক্লাসে, সম বা উভকামিতার সংবাদ সেভাবে না ছড়ালেও, ভুক্তভোগী ছেলেগুলো এর শ্রেষ্ঠ সাক্ষী। ওরাই বলবে, মৌলবীরা কি নিষ্ঠুরভাবে ধর্ষণ করে। সন্তানতুল্য কিশোরীদেরকে। চার্চ-মিশন, মাদ্রাসা, সমকামিতার পিঠস্থান এবং অভ্যেস সৃষ্টির ফ্যাক্টরি। মানুষের যৌন অনুভূতি প্রতিষ্ঠানের বিধিনিষেধ দিয়ে মস্তিষ্ক ধৌত করে উপশম করা যাবে না। লিঙ্গের অনুভূতিগুলোকে অনুশাসনের শেকল পরিয়ে ক্ষণিকের জন্য নিস্তেজ করা যাবে, কিন্তু ১৪৪ ধারা দিয়ে নিঃশেষ করা যাবে না। অবশেষে বলল রাখা ভালো যে, বিশ্বব্যাপী প্রায় সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেই চলে নিষিদ্ধ জীবন। অত্যন্ত গোপনে। মাঝে মাঝে যা গোপন থাকে না। স্ক্যান্ডাল কোথায় নেই? চার্চগুলোতে ২০০২ সালের এই তোলপাড় করা কেলেঙ্কারির সংবাদে এটাই প্রমাণ হয় যে লিঙ্গের বিরুদ্ধাচরণ সব ধর্মের মানুষের সবরকম শাসনকে তুচ্ছ করে দেয়।