১২. পথ-কুক্কুর
আব্বা একটা চেয়ারে সোজা হয়ে বসে আছেন। বুবুন আর সুমি আব্বার পিছনে ফ্যাকাশে মুখে দাঁড়িয়ে আছে। খবির উদ্দিনের জন্য একটা গদিওয়ালা চেয়ার আনা হয়েছে, সেখানে সে দুই পা ছড়িয়ে কুৎসিত ভঙ্গিতে বসে আছে। তাকে ঘিরে আটজন মানুষ। মানুষগুলোর একেকজনের চেহারা একেক রকম কিন্তু তবু কোথায় জানি একটা মিল রয়েছে। নিষ্ঠুরতার মনে হয় নিজস্ব একটা রূপ আছে।
ইঁদুরের মতো চেহারার মানুষটা এইমাত্র ঠিক কী ঘটেছে তার একটা বর্ণনা দিল, তাদেরকে যে কীভাবে বোকা বানানো হয়েছে সেটা গোপন রাখার চেষ্টা করে লাভ হল না, তার গল্প থেকেই সেটা প্রকাশ হয়ে গেল। সবকিছু শুনে খবিরউদ্দিন মুখ শক্ত করে বলল, “কিন্তু এই পোলা আর মাইয়া এইখানে আসল কেমন করে?”
মানুষটা মাথা চুলকে বলল, “তা তো জানি না!”
খবিরউদ্দিন খেঁকিয়ে উঠে বলল, “সেটা না জানলে চলবে কেমন করে? সাথে যদি আরও কিছু পোলা-মাইয়া এসে থাকে? তারা যদি এখন পুলিশকে খবর দেয়?”
ইঁদুরের মতো মানুষটা হলুদ দাঁত বের করে হিহি করে হেসে ফেলল, “হুজুর যে কী বলেন! পুলিশকে বললেই কি আসবে? আমরা তা হলে মাসে মাসে তাদেরকে এত টাকা দেই কেন?”
“খামোশ!” খবিরউদ্দিন বিকট ধমক দিয়ে বলল, “বাজে কথা বলবি না।”
রোমশ ভুরুর মানুষটা বলল, “হুজুর যদি অনুমতি দেন তা হলে এদের পেটের মাঝে থেকে কথা বের করে ফেলি।”
খুব মজার একটা রসিকতা শুনেছে এরকম ভান করে খবিরউদ্দিন হা হা করে হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল, “সেটা খারাপ হয় না! নে, বার কর। রক্ত ফক্ত দেখতে হবে না তো?”
“জে না। শাহবাজ আলির ছুরি চাকু লাগে না।”
ইঁদুরের মতো মানুষটা চোখ ছোট ছোট করে বলল, “শাহবাজ আলির কাজ এক নম্বর। মনে নাই নির্মূল কমিটির ছেলেটার হাত কবজির কাছে কীরকম আলগা করে ফেলল?”
শাহবাজ আলি নামের মানুষটা দাড়ির মাঝে আঙুল ঢুকিয়ে কাটতে কাটতে এগিয়ে এল। লাল চোখ একবার বুবুনের দিকে তাকাল, তারপর সুমির দিকে তাকিয়ে ভারী গলায় বলল, “এই শুওরের বাচ্চা হারামখোরেরা। তোরা নিজের থেকে বলবি নাকি এক চড় মেরে চোয়াল ভেঙে সব কয়টা দাঁত আলগা বরে ফেলব?”
বুবুনের মাথায় হঠাৎ আগুন জ্বলে উঠল। সে তীব্র দৃষ্টিতে মানুষটার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমাদের সাথে কথা বলতে চাইলে ভদ্রভাবে কথা বলবেন।”
ঘরের মাঝে হঠাৎ একটা আশ্চর্য ধরনের শীতলতা নেমে আসে। শাহবাজ আলির মুখটা ভয়ংকর হয়ে উঠল, সে হিস হিস করে বলল, “যদি না বলি তা হলে কী করবি শুওরের বাচ্চারা?”
বুবুন কী-একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই সুমি বলল, “লাথি মেরে দাঁত ভেঙে দেব। কাছে আসো, তোমার দাড়ি যদি আমি টেনে না ছিঁড়ি–”
শাহবাজ আলি মনে হয় নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না, যে এরকম অবস্থায় একটা বাচ্চা তাকে এরকম কথা বলতে পারে! প্রচণ্ড রাগে কী করবে বুঝতে পারছিল না, মনে হল লাফিয়ে পড়ে তাদের টুটি চেপে ধরবে, ঠিক তখন খবিরউদ্দিন হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিল। তারপর মাথা ঘুরিয়ে বুবুন আর সুমির দিকে তাকিয়ে বলল, “এই পোলা আর মাইয়া, তোদের বাপ-মা আদব লেহাজ শেখায় নাই তোদের? মুরুব্বির সাথে কথা বলতে জানিস না?”
বুবুন আর সুমি কোনো কথা বলল না। খবিরউদ্দিন আবার বলল, “এত তেজ কোথা থেকে আসছে? বেশি তেজ যে স্বাস্থ্যের জন্যে ভালো না সেটা জানিস না?”
আব্বা হঠাৎ কী-একটা বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালেন, তাঁর মুখ দেখে মনে হল কিছু-একটা নিয়ে খুব কষ্ট হচ্ছে। খবিরউদ্দিন হঠাৎ কেমন যে, ভয় পেয়ে গেল, বলল, এই লোকটারে বেঁধে রাখিস নাই কেন?”
ইঁদুরের মতো দেখতে মানুষটা বলল, “হুজুর, এই মানুষটার বুদ্ধিশুদ্ধি কুত্তা বিলাইয়ের সমান। এরে বেঁধে রাখার কোনো দরকার নাই। এই দেখেন হুজুর—” মানুষটা এগিয়ে এসে আব্বাকে ধমক দিয়ে বলল, “তুমি দাঁড়িয়ে কেন? বসো।”
আব্বা সাথে সাথে বসে গেলেন। ইঁদুরের মতো মানুষটা বলল, “দেখলেন হুজুর? এই লোকের মেরুদণ্ড নাই। পাগল-ছাগল মানুষ।”
শাহবাজ আলি তার পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে এক পা এগিয়ে এসে খবিরউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “হুজুর যদি অনুমতি দেন।”
খবিরউদ্দিন হাত নেড়ে অনুমতি দেবার ভান করল। সাথে সাথে শাহবাজ আলি একটা মোষের মতো ছুটে এসে বুবুনের চুল ধরে নিজের কাছে টেনে আনে। তারপর বুবুনের ডান হাতটা ধরে সেটাকে পেঁচিয়ে ধরতেই তার সারা শরীর ঘুরে হাতটা পিছনে চলে এল, প্রচণ্ড যন্ত্রণায় বুবুন চিৎকার করে ওঠে, মনে হয় তার হাতটা বুঝি এক্ষুনি ভেঙে খুলে আসবে।
সুমি হঠাৎ চিতাবাঘের মতো মানুষটার উপরে লাফিয়ে পড়ল, মানুষটার হাঁটুতে সে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে লাথি মারতেই, “মাগো” বলে মানুষটা বুবুনকে ছেড়ে দিয়ে বসে পড়ে।
খবিরউদ্দিনকে ঘিরে থাকা অন্য মানুষগুলো শাহবাজ আলির কাছে ছুটে আসে, সে দুইজনের কাছে বন্দুক ছিল তারা বন্দুক দুটি বুবুন আর সুমির দিকে তাক করল, মুখ দেখে মনে হল বুঝি সত্যি সত্যি গুলি করে দেবে।
আব্বা হঠাৎ আবার উঠে দাঁড়ালেন। বিড়বিড় করে কিছু-একটা বলছেন, কী বলছেন ঠিক বোঝা গেল না। খবিরউদ্দিন আব্বার দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বলল, “তুমি দাঁড়িয়েছ কেন? বসো।”
আব্বা বসলেন না, “দাঁড়িয়েই রইলেন। সবগুলো মানুষের দিকে একবার তাকিয়ে ফিসফিস করে বললেন, “যখনি–”
“কী?” খবিরউদ্দিন ধমক দিয়ে বলল, “কী বলছ?”
“যখনি–”
“যখনি কী?”
“যখনি দাঁড়াবে তুমি–”
খবিরউদ্দিন চোখ বড় বড় করে আব্বার দিকে তাকিয়ে রইল, বোঝার চেষ্টা করল আব্বা কী বলছেন। আব্বা আবার বললেন, কবিতা আবৃত্তির সুরে, তাঁর সুন্দর গলা সারা ঘরে হঠাৎ গম গম করে উঠল,
“যখনি দাঁড়াবে তুমি সম্মুখে তাহার তখনি সে
পথ কুকুরের মতো
সংকোচে সত্রাসে যাবি মিশে।”
বুবুন চমকে উঠে আব্বার দিকে তাকাল, এ কোন আব্বা? ছেলেমানুষি ভঙ্গি জবুথবু হয়ে বসে থাকা, কিছুই তো নেই তার মাঝে! কী সুন্দর বুক উঁচু করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছেন, চেহারায় কী আশ্চর্য পৌরুষ, চোখেমুখে কী ভয়ংকর আত্মবিশ্বাস। বুবুন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না।
খবিরউদ্দিন গদিওয়ালা চেয়ার থেকে ছটফট করে ওঠার চেষ্টা করতে করতে বলল, “কী? কী বলছ তুমি?”
“রবি ঠাকুরের কবিতা। একশো বছর আগে লিখে গিয়েছিলেন।” আব্বা হাত তুলে আঙুল দিয়ে তাদের দেখিয়ে বললেন, “তোমাদের কথা লিখেছেন। তোমরা হচ্ছ পথ-কুকুর! তোমাদের সামনে আমরা যখন দাঁড়াই তখন তোমরা সংকোচে সত্রাসে যাবে মিশে!”
বুবুন হতচকিত হয়ে তার আব্বার দিকে তাকিয়ে রইল। সুমি বুবুনের হাত ধরে বলল, “চাচা ভালো হয়ে গেছেন! কী দারুণ দেখছিস?”
খবিরউদ্দিন চিৎকার করে বলল, “ধর এই লোকটাকে। বেঁধে ফেল।”
আব্বার মুখে একটা বিচিত্র হাসি ফুটে উঠল, খবিরউদ্দিন যেন খুব একটা মজার কথা বলেছে এরকম ভঙ্গি করে বললেন, “আমাকে ধরবে? তোমরা?”
খবিরউদ্দিন আবার চিৎকার করে উঠল, “দাঁড়িয়ে আছিস কেন বেকুবের দল?”
বন্দুক-হাতের মানুষ দুইজন এবারে আব্বার দিকে বন্দুক তাক করল, একজন মোটা গলায় বলল, “খামোশ। গুলি করে দেব।”
আব্বা এবারে সত্যি সত্যি হেসে ফেললেন। তারপর চোখ মটকে বললেন, “গুলি করবে? তুমি? এই চামচিৎকার দল আমাকে গুলি করবে?”
মানুষগুলো হতচকিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, আব্বা বললেন, “তুমি জান আমি যখন মুক্তিযুদ্ধে গেছি আমার বয়স তখন মোলো।” আব্বা তাঁর হাত দুটি উপরে তুলে বললেন”এই হাতে আমি মেশিনগানে গুলি করেছি, পাকিস্তানিদের বাংকারে গ্রেনেড ছুঁড়েছি। শুধু তোমাদের মতো চামচিকা রাজাকাররা না, তোমাদের বাবা পাকিস্তানি মিলিটারিরাও আমাকে মারতে পারেনি। কেন পারেনি জান?”
মানুষগুলো জানতে চাইছে কি না বোঝা গেল না, আব্বা সেটা লক্ষ্যও করলেন না, বললেন, “পারেনি তার কারণ আল্লাহ্ আমার দিকে ছিলেন! আল্লাহ্ মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে ছিলেন। আল্লাহ্ যদি তোমাদের দিকে থাকতেন তা হলে সেভেন্টিওয়ানে তোমরা জিততে। তোমরা জেতনি। তোমরা কোনোদিন জিতবে না–“
খবিরউদ্দিন দাঁড়িয়ে গেল, কাছে দাঁড়িয়ে থাকা একজনকে ধাক্কা দিয়ে বলল, “দাঁড়িয়ে আছিস কেন শুওরের বাচ্চা? থামা একে।”
বন্দুক-হাতের মানুষটা বন্দুক তুলে এবারে চিৎকার করে বলল, “চুপ কর গাদ্দার। গুলি করে দেব।”
আব্বার চোখ হঠাৎ ধ্বক করে জ্বলে উঠল। টান দিয়ে শার্টের বোতাম ছিঁড়ে আব্বা তার বুকটা বের করে ফেললেন, যে-মানুষটা বন্দুক ধরে রেখেছিল তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন, “করো গুলি।”
মানুষটা নিষ্ঠুর চোখে আব্বার দিকে তাকিয়ে ট্রিগারে হাত দিল। আব্বা আরও এক পা এগিয়ে গিয়ে বললেন, “দেখি তোমার কত বড় সাহস! করো দেখি গুলি!” আব্বা চিৎকার করে বললেন, “করো দেখি!”
বুবুন নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে রইল, মানুষটির নিষ্ঠুর মুখ বিচিত্র একধরনের জিঘাংসায়ে কুৎসিত হয়ে যাচ্ছে। আব্বার মুখে এতটুকু ভয় নেই। ভয়ংকর এক আত্মবিশ্বাস নিয়ে আব্বা আরও এক পা এগিয়ে গেলেন। বুবুন দেখতে পেল মানুষটা ট্রিগার টেনে ধরছে, সত্যিই কি গুলি করে দেবে মানুষটা? আতঙ্কে বুবুনের হৃৎস্পন্দন থেমে আসতে চায়। তাকিয়ে থাকতে পারে না সে, আর্তচিৎকার করে চোখ বন্ধ করে ফেলল। ঠিক তখন প্রচণ্ড একটা গুলির শব্দে সমস্ত ঘর কেঁপে উঠল। বুবুন দুই হাতে মুখ ঢেকে রক্ত-শীতল-করা স্বরে চিৎকার করে উঠল। মানুষটা কি মেরে ফেলেছে আব্বাকে? তার দুঃসাহসী আব্বাকে?”
হঠাৎ করে কে যেন তার কাঁধ স্পর্শ করল, বুবুন শুনল সুমি ডাকছে তাকে, “বুবুন, তাকিয়ে দ্যাখ।”
বুবুন ভয়ে ভয়ে তাকাল, দেখল তার আব্বা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। এক হাতে বন্দুক অন্য হাতে মানুষটার শার্টের কলার ধরে রেখেছেন। আব্বা তার কলার ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ময়লা আবর্জনার মতো ছুঁড়ে ফেললেন দূরে। আরো দুজন মানুষে নিয়ে সে মেঝেতে আছাড় খেয়ে পড়ল। আব্বা তখন ঘুরে তাকালেন বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে থাকা দুই নম্বর মানুষটা দিকে। আব্বা আলগোছে বন্দুকটা ধরে রেখেছেন, কী সহজেই-না সেটা হাতবদল করলেন, কেউ বলে দেয়নি কিন্তু কার বুঝতে এতটুকু দেরি হল না দুই যুগ আগে যেভাবে তাঁর হাতে অস্ত্র গর্জন করেছিল দরকার হলে ঠিক সেভাবে আবার তাঁর হাতে বন্দুক গর্জন করে উঠবে।
আব্বা পাথরের মতো শক্ত মুখে মানুষটার দিকে তাকিয়ে বললেন, “বন্দুকটা দাও।”
মানুষটা এক মুহূর্তে দ্বিধা করে আব্বার হাতে বন্দুকটা তুলে দিল। আব্বা সেটা হাতে নিয়ে হঠাৎ বুবুন আর সুমির দিকে ছুঁড়ে দিলেন। তারা প্রস্তুত ছিল না, কিন্তু ঝাঁপিয়ে পড়ে সেটা শূন্যে ধরে ফেলল। বুবুন আর সুমি কখনো বন্দুক ধরেনি, হাতে নিতেই তাদের বুকের মাঝে কেমন যেন করে ওঠে!
আব্বা আলগোছে বন্দুকটা ধরে রেখে বললেন, “সবাই লম্বা হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়। সেভেন্টিওয়ানের রতনপুর ব্রিজে এক ডজন রাজাকার এইভাবে ধরেছিলাম আমরা। কেউ পালানোর চেষ্টা করো না! তোমরা জান আমার হাত থেকে কোনো রাজাকার কখনো পালাতে পারে নাই।”
মানুষগুলো ইতস্তত করে একজন একজন করে মেঝেতে শুয়ে পড়তে থাকে। খবিরউদ্দিন ফ্যাকাশে মুখে আব্বার দিকে তাকিয়েছিল, আব্বা বন্দুকের বাঁট দিয়ে তার মাথায় টোকা দিতেই সে ধড়মড় করে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল।
সুমি দাঁড়িয়ে বলল চাচা, “ওদেরকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলি?”
আব্বা হেসে ফেলে বললেন, “চাইলে বাঁধতে পার মা। কিন্তু ওরা পালাবে।”
“কেন পালাবে না চাচা?”
“কারণ ওদের পালানোর সাহস নেই। ওরা হচ্ছে পথ-কুকুর! পথ কুকুরের সামনে যখন কেউ সাহস করে দাঁড়ায় তখন ওদের সব সাহস উবে যায়।”
বুবুন বলল, “সুমি, বেঁধে ফ্যালো তবু। আমি বন্দুকটা ধরে রেখেছি, পালানোর চেষ্টা করলেই গুলি।”
আব্বা এসে বুবুনের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “আজকের দিনের জন্যে ঠিক আছে কিন্তু বাবা আর কখানো যেন তোর বন্দুক ছুঁতে না হয়। কখানো যেন ছুঁতে না হয়। কখনো কখনো কখনো যেন ছুঁতে না হয়।”
বাইরে হঠাৎ কয়েকটা গাড়ির শব্দ শোনা গেল। আব্বা জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেই, নিচু গলায় বললেন, “পুলিশ এসেছে বুবুন।”
“সত্যি? কেমন করে এল! আমরা তো ট্রান্সমিটারের সিগনাল দিতেই পারলাম না।”
‘ট্রান্সমিটার?”
“হ্যাঁ–” বুবুন ট্রান্সমিটারের গল্প শেষ করার আগে সিঁড়িতে ভারী বুটের শব্দ শোনা গেল, দড়াম করে দরজা খুলে হঠাৎ, সেখানে অসংখ্য পুলিশ।
পুলিশের ভিড় ঠেলে জাহিদ চাচা শঙ্কিত মুখে এগিয়ে এলেন, তার পিছনে পাংশু মুখে আম্মা। বুবুন আম্মার কাছে ছুটে যাচ্ছিল, সুমি খপ করে তার হাত ধরে ফেলল, “চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক গাধা! দেখি চাচা-চাচি কী করে!”
আম্মা প্রথমে বুবুনের দিকে তারপর আব্বার দিকে তাকালেন। আব্বার দিকে তাকিয়েই হঠাৎ ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠলেন, বিস্ফারিত চোখে আব্বার দিকে তাকিয়ে থেকে ফিসফিস করে বললেন, “মাসুদ!”
আব্বা এক পা এগিয়ে এসে আম্মাকে হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে বললেন, “রওশান! তুমি ভালো ছিলে রওশান?”
আম্মা হঠাৎ দুই হাতে মুখ ঢেকে ভেউভেউ করে কাঁদতে লাগলেন। আব্বার বোতাম-ঘেঁড়া শার্ট ধরে কাঁদতে কাঁদতে ভাঙা গলায় বললেন, “এতদিন তুমি কোথায় ছিলে? কোথায় ছিলে আমাকে ছেড়ে?”
জাহিদ চাচা বুবুনের দিকে তাকিয়ে চোখ মটকে বললেন, “ইয়ংম্যান! আমি বলেছি না তোমাকে, আমি সবসময় ভুল জায়গায় চলে যাই!”
বুবুন বলল, “চাচা, এইটা ভুল জায়গা না।”
জাহিদ চাচা বললেন, “ঠিক বলেছ! এটা ঠিক জায়গা, এটা ঠিক সময়। একেবারে হান্ড্রেট পার্সেন্ট ঠিক সময়।”
ঠিক এই সময় বুবুন আর সুমি দেখতে পেল, ভিড় ঠেলে গাব্বু আর পিয়াল আসছে। বুবুন আর সুমিকে দেখে তারা ছুটে এল। পিয়াল হেসে বলল, “পুলিশ নিয়ে এসেছি কি না?”
বুবুন অবাক হয়ে বলল, “তুই? তুই পুলিশ এনেছিস?”
“হ্যাঁ। আমি আর গাব্ব। যেই রেডিওতে শুনলাম কট কট–”
“রেডিওতে শুনলি?” বুবুন অবাক হয়ে বলল, “কেমন করে শুনলি আমি তো সিগনাল দিতেই পারলাম না। তার আগেই–”
সুমি হঠাৎ খিলখিল করে হেসে বলল, “এ বেয়াদব মানুষটা মনে হয় ভুল করে অন করে ফেলেছিল।
“তাই হবে নিশ্চয়ই!” বুবুনও হাসতে শুরু করে।
হাসি জিনিসটা সংক্রামক, কিছুক্ষণের মাঝে চারজনই হাসতে শুরু করল। তাদের হাসি দেখে আম্মাও চোখ মুছে হঠাৎ একটুখানি হেসে ফেললেন।
আম্মা যখন হাসেন তখন তাকে যে কী সুন্দর দেখায়!