নাসিম কম্বলের উপর শুয়ে ছিল। হজ্জতে আরো কিছু কয়েদি আছে, তারা মেঝেতে গাদাগাদি করে বসা। কম্বলের বিশেষ ব্যবস্থা নাসিমের জন্যে। তাকে চেনার কোন উপায় নেই–পুলিশী মারের কারণে মুখ ফুলে বিভৎস দেখাচ্ছে। সবচে বেশি ফুলেছে না। মনে হচ্ছে নাকের হাড় ভেঙেছে। বাঁ চোখ বন্ধ হয়ে আছে। ডান চোখ অক্ষত তবে লাল হয়ে আছে। পুলিশী মারের ধরন এমন হয় যে বাইরে থেকে কিছু বোঝা যায় না। নাসিমের বেলায় ব্যতিক্রম হয়েছে। মায়ের কারণেই অন্য হাতীরা নাসিমের প্রতি মমত্রী দেখাচ্ছে। কম্বল হচ্ছে মমতার প্রকাশ। হাজতখানার একমাত্র কলটি ভাঁজ করে নাসিমকে দেয়া হয়েছে, যাতে সে শুয়ে থাকতে পারে।
ইলা হাজতের দরজার কাছে এসে দাঁড়াল সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে। প্রথম দর্শনে সে চিনতে পারল না। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। নাসিম হাসিমুখে বলল, আরে তুই, তুই কোত্থেকে? তোকে কে খবর দিল? আমি বাবুকে এত করে বললাম, তোকে যেন খবর নী দেয়া হয়। শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করবি।
তুমি করেছ কি?
মিস আল্ডারস্টেনডিং হয়ে গেছে। যাকে বলে ভুল বোঝাবুঝি।
তোমাকে এ রকম করে মেরেছে কেন?
পুলিশ ধরেছে–মরিবে না। তাও তো আমাকে কম মেরেছে।
এর নাম কম মারা?
বাদ দে বাদ দে। মেয়েছেলের এইসব জায়গায় আসাই ঠিক না। তোরা অল্পতে নাভাস হয়ে যাস। বাবুকে এত করে বলেছি যেন কাউকে কিছু না জানায়। সে মনে হয় মাইক নিয়ে ঢাকা শহরে বের হয়ে পড়েছে। দুপুরে টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার নিয়ে রুবা এসে উপস্থিত। তারপর বিশ্রী কাণ্ড। টিফিন ক্যারিয়ার ফেলে দিয়ে চিৎকার করে কান্না। হাজতখানা কি কান্নাকাটির জায়গা। দুনিয়াসুদ্ধ মানুষ তাকিয়ে দেখছে। কাঁদতে হয় বাড়িতে বসে। দরজা বন্ধ করে কাঁদবি। হাটের মধ্যে কাঁদার দরকার কি। বাবুর সঙ্গে দেখা হচ্ছে না–দেখা হলে কঠিন কিছু কথা শুনিয়ে দিতাম।
ভাইয়া কোথায়?
আমাকে বের করার জন্যে–খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে নানান জায়গায় ছোটাছুটি করছে। ভাবটা এরকম যেন আমাকে ফাঁসিতে ঝুলাচ্ছে। এক্ষুণি এখান থেকে বের করতে হবে। দুএকদিন পরে বের হলে ক্ষতি তো কিছু নেই। এত অস্থির হবার দরকার কি। আর শোন, সন্ধ্যা হয়ে গেছে তুই খামোকা এখানে দাঁড়িয়ে থাকিস। বাসায় চলে যা। তোর কি শরীর খারাপ নাকি তোকে এরকম দেখাচ্ছে কেন?
আমার শরীর ভালই আছে। নাসিম ভাই তুমি শুয়ে আছ শুয়ে থাক, তোমাকে উঠে দাঁড়াতে হবে না।
নাসিম উঠে দাঁড়াল। ইলা বলল, তোমার বাঁ চোখ এমন ফুলে আছে। চোখে কিছু হয় নি তো?
চোখ ঠিক আছে। সকালের দিকে ঝাপসা দেখছিলাম–এখন পরিষ্কার দেখতে পারছি।
তুমি একদিনও আমাকে দেখতে যাও নি নাসিম ভাই।
ছোটাছুটি করেই সময় পাই না। দেখি এইবার যাব। জামান সাহেব ভাল আছেন?
হ্যাঁ।
তাঁকে আমার সালাম দিবি। অতি ভদ্রলোক। কিছুদিন আগে রাস্তায় একবার দেখী হয়েছিল। আমাকে রেস্টুরেন্টে নিয়ে চ-সিঙাড়া খাওয়ালেন। জয়দেবপুরে একটা বাড়ি কিনেছেন বলে বললেন, ঠিকঠাক করছেন। বাড়ির পেছনে পুকুর আছে। আমি জামান সাহেবকে বললাম, আপনি ভাই ঐ পুকুরে কিছু জলপদ্ম লাগাবেন। আমাদের ইলার খুব শখ। লাগিয়েছেন জলপদ্ম?
জানি না। লাগাবে নিশ্চয়ই।
অবশ্যই লাগবে। আমি চারা জোগাড় করে দেব। কোথাও পাওয়া না গেলে বলধা গার্ডেন থেকে জোগাড় করব। কেয়ারটেকারকে ভুজং ভাজং দিয়ে ব্যবস্থা করতে হবে। এম্নিতে রাজি না হলে পা চেপে ধরব।
ইলা হেসে ফেলল। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার হাসতে হাসতে তার চোখে পানি এসে গেল। অন্যের কাছ থেকে গোপন করার মত পানি নয়। ফেঁটায় ফোঁটায় পানি আসছে।
নাসিম বিস্মিত হয়ে বলল, কি যন্ত্রণা কাঁদছিস কেন? চোখ মোছ।
ইলা শাড়ির আঁচলে চোখ ঢেকে শব্দ করে কেঁদে উঠল। থানার সেকেন্ড অফিসার কান্নার শব্দে এগিয়ে এলেন। নাসিম অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে। কি করবে বা বলবে ভেবে পাচ্ছে না। ইলা বলল, নাসিম ভাই আমি যাই।
আচ্ছা যা। তোর অবস্থা দেখে তো আমি ঘাবড়ে যাচ্ছি। শরীর মনে হয় বেশি খারাপ। এত অল্পতে কান্নাকাটির মেয়েতো তুই না। তোর সমস্যাটা কি? বল তো?
সমস্যা কিছু না। আমার বাচ্চা হবে নাসিম ভাই। তিন মাস যাচ্ছে। কাউকে বলি নি। তোমাকে প্রথম বললাম।
নাসিমের মুখ হা হয়ে গেল। মেয়েটার কি সত্যি সত্যি মাথা খারাপ হয়ে গেল? বচ্চিা হবার খবর কি হাটের মধ্যে বলার জিনিস। হাজতীরা কান পেতে শুনছে। কথাবার্তা আরেকটু সাবধানে বলা উচিত না?
নাসিম ইলাকে ধমক দিতে গিয়েও দিল না। নিজেকে সামলে নিল। একটা খুশির কথা বলেছে–এই সময় ধমাধমকি করা ঠিক হবে না। পরে এক সময় বুঝিয়ে বলতে হবে।
যাই নাসিম ভাই।
অনেকক্ষণ ধরেই তো যাই যাই করছিস। যাচ্ছিস তো না।
এইবার যাব। একটা কথা শুধু জিজ্ঞেস করে যাই। আমার বিয়ের দিন আমি তোমাকে সালাম করলাম। তখন তুমি আমার জন্যে কি দোয়া করেছিলে?
মনে নেই।
মনে করার চেষ্টা কর।
তুই বড় বিরক্ত করছিস ফুল, যা বাসায় যা।
নাসিম সেকেন্ড অফিসারের দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার মেয়েটাকে একটা রিকশা করে দিন। ওর শরীরটা খারাপ। রিকশাওয়ালাকে বলে দেবেন। যেন খুব সাবধানে নিয়ে যায় ঝাঁকুনি না দেয়। মেয়েটা খুবই অসুস্থ।
আশ্চর্যের ব্যাপার, এই সাধারণ কথাগুলি বলতে বলতে নাসিমের গলা ধরে এল। বন্ধ হয়ে যাওয়া ফুলে ওঠা চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল।