নারী, তার লিঙ্গ ও শরীর
লিঙ্গ শুধু নারীপুরুষের কয়েকটি প্রত্যঙ্গে সীমাবদ্ধ নয়, লিঙ্গ শরীরের প্রতিটি কোষে ছড়ানো। নারীর প্রতিটি কোষ সংবাদ বহন করে সে নারী, পুরুষের প্রতিটি কোষ সংবাদ বহন করে সে পুরুষ। তাই পার্থক্য রয়েছে। পুরুষ ও নারীতে, তবে তা দু-মেরুর পার্থক্য নয়। প্রথাগত পুরুষতান্ত্রিক বিশ্বাসে নারীপুরুষ মেরুপ্রমাণ সুদূর আর বিপরীত; কিন্তু ওই সুদূরতা ও বৈপরীত্য জৈবিক লিঙ্গের জন্যে ততোটা নয়, যতোটা সাংস্কৃতিক লিঙ্গের জন্যে। প্রকৃতি নারীপুরুষকে বিপরীত ক’রে তৈরি করে না, সমাজই তাদের বিপরীত ক’রে তোলে। নারীপুরুষের উদ্ভব ও বিকাশও ঘটে একই রকমে, মাঝে ঘটে কিছুটা ভিন্নতা; কেউ হয় পুরুষ কেউ নারী, তবে ওই ভিন্নতাকেই পিতৃতন্ত্ৰ ক’রে তোলে প্রধান। প্রকৃতি পুরুষতান্ত্রিক নয়, সমাজই পুরুষতান্ত্রিক পুরুষাধিপত্যবাদী; মানুষের উদ্ভববিকাশের প্রক্রিয়া বিজ্ঞানসম্মতভাবে জানা গেছে সম্প্রতি, কিন্তু আজো অধিকাংশের মধ্যে টিকে আছে পুরোনো বিশ্বাস যে নারী জন্মসূত্রেই সামাজিক লিঙ্গসম্পন্ন নারী। ধর্মগ্রন্থগুলো নারীর উদ্ভব সম্পর্কে প্রচার করেছে ভ্ৰান্ত পুরাণ; দার্শনিকেরা, এমনকি বিজ্ঞানীরাও, ওই ভ্ৰান্তিকেই প্ৰকাশ করেছেন আকর্ষণীয় রূপে; এবং নারী পুরুষের কাছে কামসামগ্ৰী হিশেবে কাম্য হ’লেও তার দেহের গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যঙ্গগুলোকে, সেগুলোর ক্রিয়াকলাপকে দেখেছে ঘৃণার চোখে। নারী স্ত্রীলিঙ্গ, তার অর্থ এ নয় যে তাকে সাংস্কৃতিক নারী হয়ে উঠতে হবে। স্ত্রীলিঙ্গ ও সাংস্কৃতিক নারীর দূরত্ব অনেক, দুটি বিষম : একটি জৈবিক আরেকটি পুরুষতন্ত্রের বিধানে প্রস্তুত। নারী আজো নিজেকে জানে না, জানে না তার উদ্ভবের প্রকৃতি ও শরীরকে; তবে পুরুষতন্ত্রের মুখোমুখি দাড়ানোর জন্যে এটা জানা অত্যন্ত দরকার।
মানুষ উদ্ভূত হয় উর্বরকৃত বা নিষিক্ত একটি কোষ থেকে [দ্ৰ লিউইলিন-জোন্স (১৯৭১), উইলিয়মস (১৯৭৭), গ্যানোংগ (১৯৮৯)]। ওই কোষটি বা ডিম্বাণুটি উর্বর হওয়ার সাথে সাথে বিশ্লিষ্ট হয় দুটি অভিন্ন কোষে; ওই কোষ দুটি আবার বিশ্লিষ্ট হয়ে সৃষ্টি করে চারটি অভিন্ন কোষ। এভাবে সেগুলো বার বার বিশ্লিষ্ট হ’তে ও সৃষ্টি করতে থাকে অসংখ্য নতুন কোষ। পুরুষের বেলা তা ঘটে, ঘটে নারীর বেলা। ভাঙতে ভাঙতে আর গড়তে গড়তে কিছু কিছু কোষগুচ্ছ বিভিন্ন হয়ে ওঠে, এবং তৈরি করে বিশেষ বিশেষ তন্ত্রি বা প্রত্যঙ্গ। কোনো কোষগুচ্ছ তৈরি করে কংকাল, কোনো গুচ্ছ তৈরি করে পেশি, কোনো গুচ্ছ তৈরি করে হৃৎপিণ্ড ও রক্তনালি। কোনো গুচ্ছ তৈরি করে লাল রক্তকণিকা, কোনো গুচ্ছ তৈরি করে শাদা কণিকা। একগুচছ কোষ বহুগুণে বেড়ে তৈরি করে মস্তিষ্কের কোষ ও স্নায়ুতান্ত্র। এসব কোষই উদ্ভূত হয় মাত্র একটি গর্ভবতী ডিম্বাণু থেকে; এবং এসব কোষের প্রত্যেকটি ধারণ করে অজস্র তথ্য। এসব তথ্যের অর্ধেক আসে জনকের কাছে থেকে, সে-শুক্রাণুটির মধ্য দিয়ে যেটি গর্ভবতী করেছে ডিম্বাণুটিকে; বাকি অর্ধেক আসে জননীর কাছে থেকে ওই ডিম্বাণুর মধ্য দিয়েই। প্ৰত্যেকটি কোষ পালন করে একরাশ দায়িত্ব। কোষটিকে কী কাজ করতে হবে, সে-নির্দেশ খচিত থাকে প্রত্যেকটি কোষের কেন্দ্ৰস্থিত একধরনের পাকানো বস্তুতে। ওই পাকানো বস্তুর নাম ক্রোমোসোম। ওই ক্রোমোসোম গঠিত কয়েক কোটি গুটিকার দীর্ঘ মালায়। এগুলোর নাম জিন। জিন হচ্ছে তথ্যের ক্ষুদ্রতম একক। জিন গঠিত হয় ডিএনএ-এর [ডিঅক্সিরি বোনিউক্লেইক এসিড], পাকানো তন্ত্রিতে। কোনো একটি কোষে কাজ করে মাত্র গুটিকয় জিন, বাকিগুলো থাকে নিষ্ক্রিয়।
মানবশরীরের প্রতিটি কোষে থাকে ৪৬টি ক্রোমোসোম; তবে এর ব্যতিক্রম দুটি কোষ : একটি নারীদেহের ডিম্বাণুকোষ, অন্যটি পুরুষদেহের শুক্রাণুকোষ।। ৪৬টির মধ্যে ৪৪টি ক্রোমোসোম নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের সমস্ত শারীরিক বৈশিষ্ট্য ও ক্রিয়াকলাপ। এ-৪৪টি ক্রোমোসমের নাম অটোসোম। বাকি ২টি স্থির করে লিঙ্গ, এ-দুটি লিঙ্গ ক্রোমোসোম। লিঙ্গ ক্রোমোসোম দুটির একটিকে বলা হয় x লিঙ্গ ক্রোমোসোম; অন্যটিকে বলা হয় Y লিঙ্গ ক্রোমোসোম। নারীশরীরের কোটি কোটি কোষের প্ৰত্যেকটিতে রয়েছে ৪৪টি অটোসোম এবং ২টি X ক্রোমোসোম; পুরুষশরীরের প্ৰত্যেকটি কোষে রয়েছে ৪৪টি অটোসোম, এবং ১টি X ও ১টি Y ক্রোমোসোম। নারী হচ্ছে ৪৪টি অটোসোম + xx; পুরুষ হচ্ছে ৪৪টি অটোসোম + XY। পুরুষ তার শরীরের কোটি কোটি কোষের প্রত্যেকটিতে পৃথক নারীর থেকে, কেননা তার প্রত্যেকটি কোষে রয়েছে ১টি Y ক্রোমোসোম, যা নেই নারীর শরীরে। নারীপুরুষের পার্থক্য একটি লিঙ্গ ক্রোমোসমে। নারীপুরুষের শরীরের প্রত্যেকটি কোষেই রয়েছে ৪৬টি ক্রোমোসোম, শুধু নারীর ডিম্বাণুকোষ আর পুরুষের শুক্রাণুকোষ এর ব্যতিক্রম; এ-দুটিতে ৪৬টি ক্রোমোসোম নেই, আছে মাত্র ২৩টি ক্রোমোসোম। তাই এ-দুটির আচরণও ভিন্ন। পুরুষ নারীর থেকে ভিন্ন শুধু ১টি Y ক্রোমোসমের জন্যে; এটিই ঠিক ক’রে দেয় সন্তানটি হবে পুরুষ, না নারী। Y ক্রোমোসমটি নিয়ে গর্ব করতে পারে পুরুষাধিপত্যবাদীরা, কিন্তু এর স্বভাবচরিত্র খুব প্রশংসনীয় নয়। এটির কাজ ধনাত্মক নয়, ঋণাত্মক; এটি কিছু সৃষ্টি করে না, এটি প্রকৃতি বদলে দেয় অন্যের। যখন কোনো Y ক্রোমোসোমবাহী শুক্রাণু উর্বর বা গর্ভবতী করে কোনো ডিম্বাণুকে, তখন এটি শুধু ওই ডিম্বাণুর স্ত্রীলিঙ্গতা কমিয়ে দেয়, তাই সন্তানটি পুরুষ হয়ে ওঠে। প্রথাগত ধারণা এমন যে নারীর সাথে কিছু যোগ করলে পুরুষ হয়; আসলে নারীর থেকে কিছু বাদ দিলে হয় পুরুষ। এটি কিছু ব্যাধিরও বিকাশ ঘটায়। পুরুষ যে নারীর থেকে কম বাঁচে, এর পেছনে আছে এটি। অপরাধবিজ্ঞানীরা এর একটি সাংঘাতিক স্বভাব লক্ষ্য করেছেন। তারা দেখেছেন বড়ো বড়ো অপরাধীদের অনেকের রয়েছে একটি অতিরিক্ত Y ক্রোমোসম; তারা XYY। অপরাধের সাথে সম্ভবত Y-র রয়েছে মৌল সম্পর্ক।
ডিম্বাণু উর্বর হওয়ার দিন বিশেক পর ভ্রূণের অন্ত্রের রন্ধের দেয়ালে এক রকম কোষ দেখা দেয়। তারপর এ-কোষগুলো তন্ত্রির ভেতর দিয়ে চলে যায় অন্ত্রের রান্ধের দু-দিকে অবস্থিত নিচু পুরু এলাকায়। এ-তন্ত্রি থেকেই সৃষ্টি হয় ডিম্বাশয়। গর্ভধানের তিরিশ দিন পরে এ-কোষগুলো ওই তান্ত্রিতে স্থির হয়ে বসে, ও বাড়তে থাকে। একে বলা হয় গোনাড। গর্ভধানের ১৪০ দিন পরে গোনাডে প্ৰায় ৭০ লাখ কোষ পাওয়া যায়। এগুলোর অনেকগুলো ঢাকা থাকে আবরণে। আবরণের ভেতরে এগুলো বাড়তে থাকে, এবং অনেক কোষের মধ্যে দেখা দেয় তরল বস্তু। এগুলো ডিম্বাণু [ওসাইট]। যে-কোষগুলোতে তরল বস্তু দেখা দেয, সেগুলোকে বলে আধার বা ফলিকল। যে-কোষগুলোর আবরণ থাকে না, সেগুলো নষ্ট হয়ে যায়, এবং জন্মের সময়ে মাত্র ২০ লাখ ডিম্বাণু অবশিষ্ট থাকে। এরপরও নষ্ট হয় বহু ডিম্বাণু, বয়ঃসন্ধির সময় অবশিষ্ট থাকে ২ লাখের মতো ডিম্বাণু। ঋতুস্রাবের সূচনা থেকে ঋতুবন্ধ পর্যন্ত প্ৰতি মাসে ১২ থেকে ২০টির মতো ডিম্বাণু বিকশিত হয়, এবং সবচেয়ে বেশি যেটি বিকশিত হয়, সেটিকে বের করে দেয়া হয়। ডিম্বাশয় থেকে। এটি পরিপক্ক ডিম্ব, এটি গর্ভবতী বা নিষিক্ত হতে পারে। মাঝেমাঝে একাধিক ডিম্বাণুও বেরিয়ে পড়ে, যার ফলে জন্মে একাধিক সন্তান। ডিম্বাশয়ে বাড়ার সময় প্রতিটি ডিম্বাণু ভেঙে সৃষ্টি হয় দুটি কন্যা-ডিম্বাণু এ-দুটি আকারে সমান নয়, একটি বড়ো একটি ছোটো। প্রতিটি ডিম্বাণুতে থাকে ২৩টি ক্রোমোসোম : ২২টি অটোসোম, ও ১টি x ক্রোমোসোম। নিষিক্তির সময় বড়ো কোষটি শুক্রাণুর মাথাটিকে নিজের ভেতরে টেনে নিয়ে সৃষ্টি করে সন্তান। ছোটো কোষটি কোনো কাজ করে না।
নারীর ডিম্বাণু আদিম কোষ, তা ডিম্বাশয়ে জন্ম নেয় নারীর জন্মের অনেক আগে; পরে আর একটি ডিম্বাণুও জন্মে না। পুরুষের বেলা ঘটে অন্য রকম; যৌবনারম্ভ থেকে বুড়ো কাল পর্যন্ত পুরুষের অণ্ডাশয়ে ধারাবাহিকভাবে উৎপন্ন হ’তে থাকে। শুক্রাণু। অণ্ডকোষে পাওয়া যায় এক রকম আদিম কোষ, যার থেকে তৈরি হয়। শুক্রাণু। পরিপক্ক হওয়ার আগে সেগুলোর পরিবর্তন ঘটে বেশ কয়েকবার, এবং এ-সময় প্রতিটি শুক্রাণুতে ক্রোমোসোমের সংখ্যা অর্ধেক হ্রাস পায়। প্রতিটি পরিপক্ক শুক্রাণুতে থাকে ২৩টি ক্রোমোসোম, যার মধ্যে ২২টি অটোসোম এবং ১টি লিঙ্গ ক্রোমোসোম। শুক্রাণুর লিঙ্গ ক্রোমোসোমে থাকতে পারে ১টি X ক্রোমোসোম, বা ১টি Y ক্রোমোসোম। পুরুষের কোটি কোটি শুক্রাণুকে যদি দু-ভাগে ভাগ করে ফেলি, তবে এক ভাগের শুক্রাণুতে থাকে ২২টি অটোসোম ও ১টি X ক্রোমোসোম, এবং আরেক ভাগের শুক্রাণুতে থাকে ২২ টি অটোসোম ও ১টি Y ক্রোমোসোম। তাই যখন কোনো Y ক্রোমোসোমবাহী শুক্রাণু কোনো ডিম্বাণুকে উর্বব করে, তখন নতুন কোষটিতে থাকে ৪৪টি অটোসোম, এবং ১টি X ক্রোমোসোম ও ১টি Y ক্রোমোসোম। এর ফলে যে-শিশু জন্ম নেয়, সে হয় ছেলে। আর যদি ১টি X ক্রোমোসোমবাহী শুক্রাণু ডিম্বাণুকে উর্বর করে, তাহলে নতুন কোষটিতে থাকে ৪৪টি অটোসোম ও ২টি X ক্রোমোসোম। ফলে সন্তানটি হয় মেয়ে। তাই পিতাই নিয়ন্ত্রণ করে সন্তানের লিঙ্গ, যদিও তার কোন ধরনের শুক্রাণু গর্ভবতী করবে ডিম্বাণুকে তা নিয়ন্ত্রণের শক্তি নেই তার।
নতুন প্রাণের সঞ্চার হয় তখন, যখন মাত্র একটি শুক্রাণু উর্বর করে একটি ডিম্বাণুকে। সঙ্গমের ফলে যোনিতে স্খলিত হয় কোটি কোটি শুক্রাণু, তার মধ্যে মাত্র কয়েক হাজার পৌঁছোতে পারে জরায়ুতে। তার মাত্র কয়েক শো ঢুকতে পারে ডিম্বনালিতে, এবং তার মধ্যে মাত্র কয়েকটি ওই নালি দিয়ে সাঁতরে এগোতে পারে ডিম্বাণুর দিকে। শুক্রাণু্রা আদিম সাঁতারু। সব সাঁতারু সফল হয় না, মাত্র একটি ডিম্বাণুর শক্ত উজ্জ্বল আবরণ ভেদ ক’রে ঢুকতে পারে ডিম্বাণুর ভেতরে। যেই কোনো শুক্রাণু ডিম্বাণুর আবরণ ভেদ ক’রে ভেতরে ঢুকে পড়ে, অমনি এমনভাবে বদলে যায় আবরণটি যে তাকে ভেদ ক’রে আর কোনা শুক্রাণু ভেতরে ঢুকতে পারে না। যখন ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর ক্রোমোসোম পরস্পরের সাথে মিলেমিশে যায়, তখনই সূচনা হয় নতুন জীবনের। জিনের নিয়ন্ত্রণে তখন নতুন কোষটি বার বার ভেঙে ভেঙে সৃষ্টি করে নতুন মানব। শুক্রাণুর শরীরটি এক চমৎকার সাঁতারুর; তার থাকে একটি মাথা, একটি মাঝভাগ, একটি লেজ। মাথায় থাকে ক্রোমোসোম, মাঝভাগটি যোগায় শক্তি, লেজটি কাটে সাতার। শুক্রাণু ডিম্বাণুর কাছে পৌঁছে ডিম্বাণুর আবরণ ভেদ ক’রে ক্রোমোসোমসহ নিজের মাথাটিকে ঢুকিয়ে দেয় ডিম্বাণুর ভেতরে। সে পৌঁছে তার গন্তব্যে। মাথাটি তখন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে মাঝভাগ ও লেজ থেকে। মাঝভাগে আর লেজ আটকে থাকে আবরণে, এবং নষ্ট হয়ে যায়। ডিম্বাণুর ভেতর শুক্রাণুর মাথা ঢোকার পর তার কেন্দ্ৰস্থলটির আবরণ খসে ক্রোমোসোম বেরিয়ে পড়ে, এবং একই সাথে ডিম্বাণুর কেন্দ্ৰস্থলের আবরণও লুপ্ত হয়ে যায়। এর ফলে জননীর ২৩টি ও জনকের ২৩টি ক্রোমোসোম সম্মিলিত হয় পরস্পরের সাথে; কোষের ক্রোমোসোমের সংখ্যা হয় ৪৬৷ এভাবে মানবদেহের প্রতিটি কোষে ক্রোমোসোম থাকে ৪৬টি। নারী হচ্ছে নারী, কেননা তার শরীরের, শুধু ডিম্বকোষ ছাড়া, প্রতিটি কোষে থাকে ৪৪টি অলিঙ্গ অটোসোম আর ২টি x লিঙ্গ ক্রোমোসোম। তার শরীরে কোনো Y ক্রোমোসোম থাকে না। Y ক্রোমোসোম না থাকায় তার আভ্যন্তর ও বাহ্যিক যৌনপ্রত্যঙ্গগুলো পায় বিশেষ রূপ।
পুরুষাধিপত্যবাদীদের মনে বহু শতাব্দী ধরে একটি কুসংস্কার জমে আছে যে শুক্রাণু শ্রেষ্ঠতর ডিম্বাণুর থেকে; এবং তারা এ থেকে দর্শন তৈরি করেছে যে পুরুষ নারীর থেকে উৎকৃষ্ট। এটা এক বড়ো ভুল ও পিতৃতান্ত্রিক অপপ্রচার। ডিম্বাণু-শুক্রাণুর মধ্যে কোনোটি উৎকৃষ্ট বা নিকৃষ্ট নয় অন্যটির থেকে; ওগুলো সমান, এবং পালন করে নিজ নিজ দায়িত্ব। ডিম্বাণুর অক্রিয়তার কথা খুব বড়ো ক’রে রটানো হয়েছে, তার থেকে সিদ্ধান্তে পৌঁছোনো গেছে যে নারী অক্রিয়। ডিম্বাণু অক্রিয় নয়। ডিম্বাণু সক্রিয়ভাবে মাসে মাসে বেরিয়ে আসে ডিম্বাশয় থেকে, নিজের মধ্যে টেনে নেয় শুক্রাণুকে; দু-ধরনের কোষের সম্মিলনে জ্বলে ওঠে জীবন। জীবন কোনো বিশেষ এক ধরনের কোষের সৃষ্টি নয়। নারী অক্রিয় নয়। তার যে-অক্রিয়তা দেখা যায়, তা সাংস্কৃতিক; পুরুষের বিধানেই নারী হয়ে উঠেছে অক্রিয়। এর সাথে ডিম্বাণুর আচরণের কোনো সম্পর্ক নেই। জীবন সৃষ্টিতে শুক্রাণু-ডিম্বাণুর ভূমিকা সমান; তবে মানুষের কৃতজ্ঞ থাকার কথা ডিম্বাণুর কাছে, কেননা জীবন লালনে ডিম্বাণুর ভূমিকা অনেক বেশি। ডিম্বাণুর ভেতর শুক্রাণু প্রবেশের পর ডিম্বাণু ভ্রূণটিকে লালন করে, পুষ্টি যোগায়, তাকে বিকশিত ক’রে তোলে। এজন্যেই ডিম্বাণু আকারে অনেক বড়ো শুক্রাণুর থেকে। প্রাচীনেরা ডিম্বাণু সম্পর্কে গড়ে তুলেছেন নানা উপকথা, তাকে ক’রে তুলেছেন সন্দেহজনক ও ভীতিকর। তাদের চোখে ডিম্বাণু স্থির, যার কাজ অপেক্ষা ক’রে থাকা; আর শুক্রাণু স্বাধীন, সচল, যেনো তা বহন করে জীবনচাঞ্চল্যের বাণী। এসবই জল্পনা ডিম্বাণু আর শুক্রাণুর স্বভাব দেখে শুধু লৈঙ্গিক রাজনীতিদীক্ষরাই সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে পারে যে নারীর এলাকা ঘর, পুরুষের বাইর। ডিম্বাণু থেকে একটি নারী অনেক দূরের ব্যাপার; তাই ডিম্বাণু-শুক্রাণুর আচরণ থেকে নারীপুরুষের স্বভাব সম্পর্কে তত্ত্বসৃষ্টি নির্বুদ্ধিতা।
Y ক্রোমোসোম কী করে? এটি কাজ করে শুধু গোনাডের, অণ্ডকোষ ও ডিম্বাশয়ের, ওপর। এর অনুপস্থিতিতে ভ্রূণে বিকশিত হয় ডিম্বাশয়, উপস্থিতিতে বিকশিত হয় অণ্ডকোষ। অন্যান্য লৈঙ্গিক ভিন্নতা সৃষ্টি হয় হরমোনোর নিয়ন্ত্রণে। নারীর লিঙ্গ ক্রোমোসোম XX; এর একটি আসে জননী থেকে, অন্যটি জনক থেকে। তবে জনকের X ক্রোমোসোমটির উপস্থিতির ফলে সন্তানটি স্ত্রীলিঙ্গ হয় না, বরং স্ত্রীলিঙ্গ হয় Y-এর অনুপস্থিতির ফলে। ভ্রণে ডিম্বাশয় বা অণ্ডকোষ বিকশিত হতে লাগে সাত সপ্তাহ। এ-সময়টিতে ভ্ৰাণটি নারী নয়, পুরুষও নয়; বা বলা যেতে পারে নারী, কেননা Y-এর উপস্থিতিতে ভ্রণের গোনাড অণ্ডকোষে পরিণত হয়, আর যদি উপস্থিত না থাকে তবে তা যা ছিলো। তাই থেকে যায়, অর্থাৎ সেখানে বিকাশ ঘটে ডিম্বাশয়ের। তাই নারী ও পুরুষ উভয়েরই সূচনা ঘটে নারীরূপে, সপ্তম সপ্তাহে এসেই শুধু কোনো কোনো ভ্রূণ পুরুষ হয়ে ওঠে। নারী হচ্ছে শুরু থেকে নারী, পুরুষ হচ্ছে শুরুতে নারী তারপর পুরুষ। এ দেখে মেরি জেন শারফি (১৯৭২) সিদ্ধান্তে পৌঁচেছেন [দ্র উইলিয়ামস (SS8, So) :
‘নারী ভ্রূণের রূপতত্ত্বের প্রাথম্য আমাদের বাধ্য করে লিঙ্গভিন্নতার প্রকৃতি সম্পর্কে দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত ধারণা উল্টে দিতে; ভ্রূণতাত্ত্বিকভাবে বলা যায় যে শিশ্ন হচ্ছে অতিশায়িত ভগাঙ্কুর, অণ্ডকোষ উদ্ভূত হয় বৃহ্দোষ্ঠ থেকে, আদি লিবিডো নারীধর্মী ইত্যাদি।… সমস্ত স্তন্যপায়ীর জন্যে আধুনিক ভূণবিজ্ঞান দাবি করে হাওয়া-থেকে-উদ্ভূত-আদম পুরাণ।‘
নারীপুরুষের যৌনপ্রত্যঙ্গগুলো বিকশিত অবস্থায় খুবই ভিন্ন দেখায়, তবে ওগুলো অভিন্ন আদিম প্রত্যঙ্গের বিভিন্ন বিকাশ। আদি গোনাডের একটিই রূপ, এর কোনো লিঙ্গভেদ নেই। এর দুটি অংশ : আভ্যন্তর ভাগ বা মেডুলা; এবং বহির্ভাগ বা কর্টেক্স। Y থাকলে সপ্তম-অষ্টম সপ্তাহে মেডুলা বেড়ে হয়ে ওঠে অণ্ডকোষ, কর্টেক্সটি পড়ে থাকে অদৃশ্য চিহ্নরূপে। যদি Y না থাকে, তাহলে কটেক্স বারো সপ্তাহে বেড়ে হয়ে ওঠে ডিম্বাশয়, মেডুলা নিজেকে গুটিয়ে নেয়। ভ্রণের সপ্তম সপ্তাহে তার থাকে পুরুষ [ওলফীয় নালি] ও স্ত্রী [ম্যুলারীয় নালি] উভয় ধরনেরই আদি জননেন্দ্ৰিয় নালি। পুরুষের বেলা ওলফীয় নালি বেড়ে সৃষ্টি হয় ভাস ডেফেরেন বা শুক্রনালি, শুক্রথলে, ও বীর্যনিৰ্গম নালি। নারীর বেলা মুলারীয় নালি বেড়ে সৃষ্টি হয় জরায়ু, ফ্যালোপীয় নালি বা ডিম্বনালি, ও যোনির ওপরের অংশ। যখন পুরুষের বিকাশ ঘটে তখন মুলারীয় নালি অদৃশ্য চিহ্নের মতো পড়ে থাকে; যখন নারীর বিকাশ ঘটে তখন ওলকীয় নালি পড়ে থাকে অদৃশ্য চিহ্নের মতো। প্রতিটি পুরুষ তার দেহে বয় নারীর পরিত্যক্ত আদি যৌনপ্রত্যঙ্গ, প্রতিটি নারী বয় পুরুষের পরিত্যক্ত আদিযৌনপ্রত্যঙ্গ। নারীপুরুষের বাহ্যিক যৌনপ্রত্যঙ্গগুলোও বিকশিত হয় একই আদি প্রত্যঙ্গ থেকে; আদি একই রূপেরই ঘটে দু-রূপ বিকাশ। ভ্রূণের আট সপ্তাহ বয়স হওয়ার আগে এগুলোর কোনো ভিন্নতা থাকে না, এগুলোর সমান সম্ভাবনা থাকে নারীর বা পুরুষের যৌনাঙ্গরূপে বিকাশের। এ-সময়ে এটি হচ্ছে জননেন্দ্ৰিয় খাজের কিছু ওপরে অবস্থিত একটি যৌনকন্দ বা গুটিকা। খাজটির দু-পাশে থাকে মূত্রনালীয় ভাজ, তার পাশে থাকে৷ ঔষ্ঠ্যঅণ্ডকোষীয় স্ফীতি। নারীর বেলা কন্দটি হয়ে ওঠে ভগাঙ্কুর, মূত্রনালীয় ভাজটি ক্ষুদ্রোষ্ঠ, ঔষ্ঠ্য অণ্ডকোষীয় স্ফীতি হয় বৃহ্দোষ্ঠ। পুরুষের বেলা কন্দটি হয় শিশ্ন ও শিশ্নের শীর্ষ, মূত্রনালীয় ভাজ মূত্ররান্ধের চারপাশে মিশে যায়, ঔষ্ঠ্য অণ্ডকোষীয় স্ফীতি হয় অণ্ডকোষ। তাই নারীপুরুষের যৌনপ্রত্যঙ্গগুলো বা নারীপুরুষ হচ্ছে এক অভিন্ন আদিরূপের দু-রকম উৎসারণ।
নারীপুরুষের মধ্যে ভিন্নতার থেকে অভিন্নতাই বেশি, তবে ভিন্নতা নেই এমন নয়। ওই ভিন্নতা এমন নয় যে শরীর বা লিঙ্গই হয়ে উঠবে তাদের নিয়তি, একজন করবে আধিপত্য আরেকজন থাকবে অধীন। বাস্তবে পুরুষতন্ত্র নারীপুরুষের জৈব লিঙ্গের থেকে সাংস্কৃতিক লিঙ্গকেই ক’রে তুলেছে প্রধান। ইংরেজিতে দুটি শব্দ আছে : সেক্স ও জেন্ডার, বাঙলায় শুধুই লিঙ্গ। সেক্স জৈব লিঙ্গ, জেন্ডার হচ্ছে বিশেষ লিঙ্গের জন্যে বিশেষ সাংস্কৃতিক বিধান। স্ত্রীলিঙ্গ মানুষকে নারী, আর পুংলিঙ্গ মানুষকে পুরুষ হিশেবে গড়ে তোলা সামাজিক সাংস্কৃতিক ব্যাপার, লৈঙ্গিক রাজনীতি। সামাজিক লিঙ্গের সাথে যে জৈব লিঙ্গের সম্পর্ক নেই, তা প্রমাণিত হয় লিঙ্গদুর্ঘটনাগ্রস্তদের আচরণে। জন্ম নেয় অনেক শিশু, যারা জৈব বা মানবিক ভুলের জন্যে বিন্যস্ত হয় ভিন্ন লিঙ্গশ্রেণীতে, এবং লালিতপালিত হয় তার নতুন লিঙ্গপরিচয়ে। কোনো শিশু জৈবিকভাবে পুংলিঙ্গের, কিন্তু তার শিশ্নটি জৈব বিপর্যয়ের ফলে ঠিক মতো গড়ে ওঠে নি, বা কোনো দুর্ঘটনায় সে হারিয়ে ফেলেছে শিশ্ন, তাকে পালন করা হয়েছে মেয়েরূপে; বা কোনো জৈবিক স্ত্রীলিঙ্গ কিন্তু বিশেষ সিনড্রোমগ্ৰস্ত মেয়েদের কাউকে লালন করা হয়েছে ছেলেরূপে, কাউকে মেয়েরূপে; তখন দেখা গেছে তারা আচরণ করে তাদের নতুন লিঙ্গ অনুসারে। এদের আচরণে বোঝা যায় জৈবিক লিঙ্গের সাথে সাংস্কৃতিক লিঙ্গের বিশেষ সম্পর্ক নেই। দ্বিতীয় বছব থেকে পাঁচ বা ছ-বছর পর্যন্ত শিশুকে যে-লিঙ্গ অনুসারে লালন করা হয়, সে আয়ত্ত করে সে-লিঙ্গেরই আচরণ, তার জৈবিক লিঙ্গ যাই হোক। বিভিন্ন সংস্কৃতিতে বালিকাদেরই বিশেষভাবে দীক্ষা দেয়া হয় সাংস্কৃতিক লিঙ্গে, তারা হয়ে ওঠে নারী, তাদের স্বভাব হয়ে ওঠে নারীধর্মী। এর সাথে জৈব লিঙ্গের সম্পর্ক নেই। দ্য বোভোয়ার (১৯৪৯, ২৯৫) বলেছেন :
‘কেউ নারীরূপে জন্ম নেয় না, বরং হয়ে ওঠে নারী; সমাজে যে-নারী দেখা যায, কোনো জৈব, মনস্তাত্ত্বিক, বা আর্থনীতিক ভাগ্য তার রূপ স্থির করে না: সমগ্র সভ্যতাই উৎপাদন করে পুরুষ ও খোজাব মাঝামাঝি এ-প্ৰাণীটিকে, যাকে বলা হয় নারী।’
নারীর যৌনপ্রত্যঙ্গগুলো ঢাকা রহস্যে আর নিষেধে। নারীর শরীর যেনো আকর্ষণীয় রহস্যময় ভীতিকর দুর্গ, যার সংগঠন সে নিজে জানে না; জানাও নিষেধ। আজো মানুষের সবচেয়ে বড়ো ট্যাবো নারীর শরীর। তার একটি প্রত্যঙ্গ, স্তন, দৃষ্টিগ্রাহ্য; অধিকাংশ সংস্কৃতির পুরুষের চোখে ওটির আবেদন তীব্ৰ, যদিও আদিম সমাজের পুরুষের চোখে ওর কোনো আবেদন নেই। তবে নারীর অধিকাংশ যৌনপ্রত্যঙ্গ দেহাভ্যন্তর ও অদৃশ্য, আর যেগুলো বাহ্যিক সেগুলোও অন্তরালবর্তী। একটি নগ্ন নারীর দিকে তাকিয়ে থেকেও তার কোনো যৌনপ্রত্যঙ্গ দেখা যায় না, শুধু আভাসের ঢেউ উঠতে থাকে। বালক শিশুর শিশ্নটি বাইর থেকে দেখা যায়, ‘কী মিষ্টি’ বলে ওটি নিয়ে তার পিতামাতারা খেলাও করে, ওটিকে দেয় নানা প্রিয় ডাকনাম;–সোনা, নুনু, ধন; কিন্তু বালিকার বাহ্যিক যৌনপ্রত্যঙ্গগুলোকেও নিষিদ্ধ বস্তুর মতো ঢেকে রাখে সিন্দুকে। বালিকার যৌনপ্রত্যঙ্গের কোনটি কেমন, কোনটির কী নাম ও কী কাজ তা জানতে দেয়া হয় না বালিকাকে, জানতে চাইলে তাকে চুপ করিয়ে দেয়া হয়। যেনো ওগুলো অপার লজ্জার, ঘৃণার, অপরাধের, এমনকি পাপের। তাই নারী শৈশব থেকেই বিব্রত থাকে তার যৌনপ্রত্যঙ্গগুলো নিয়ে। ওগুলো তার লজ্জা, লজ্জাস্থান; ওগুলো দেখতে নেই, দেখাতে নেই, ছুতে নেই, ছুঁতে দিতে নেই, ওগুলোর নাম নিতে নেই। অনেক ভাষায় বাহ্যিক যৌনপ্রত্যঙ্গগুলোকে বলা হয় ‘লজ্জাস্থান’, এগুলোর চিকিৎসাশাস্ত্রীয় পরিভাষা হচ্ছে ‘পুডেনডাম’ অর্থাৎ লজ্জার বিষয়। প্রথাগত লজ্জা, ঘৃণা, পাপ আর অপরাধবোধের সাথে আরেকটি দুর্নাম জড়িত ক’রে দিয়েছেন ফ্রয়েড; তিনি নারীর যৌনপ্রত্যঙ্গগুলোতে দেখেছেন বিকলাঙ্গতা। নারীর শিশ্ন নেই, রয়েছে ভগাঙ্কুর; তাই নারী বোধ করে শিশ্নের অভাব, ভোগে খোজাগূঢ়ৈষায়, নিজেকে মনে করে বিকলাঙ্গ পুরুষ, এসব বাজে ধারণা তিনি যুক্ত ক’রে দিয়েছেন নারীর যৌনপ্রত্যঙ্গগুলোর সাথে। এসবের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। নারীর যৌনপ্রত্যঙ্গগুলো নারীর যৌনপ্রত্যঙ্গ, ওগুলো একশো ভাগ স্বাভাবিক; আর ওগুলো লজ্জা, অপরাধ, ঘৃণা বা পাপের ব্যাপার নয়। তবু কোনো নারী নিদ্বিধায় ছুঁতে পারে না তার প্রত্যঙ্গ, কেননা ওগুলো নিষিদ্ধ। প্রতিটি নারীর জানা উচিত তার আভ্যন্তর ও বাহ্যিক প্রত্যঙ্গগুলো, তবে শুধু অশিক্ষিত নারীরাই নয়, শিক্ষিত নারীরাও জানে না তাদের প্রত্যঙ্গগুলোকে ও সেগুলোর ক্রিয়াকলাপ। শৈশব থেকে তাদের বার বার দেখা দরকার নিজেদের প্রত্যঙ্গগুলো, বিশ্বাস করা দরকার যে ওগুলো কোনো নিষিদ্ধ বস্তু নয়। ওগুলো নিয়ে বিব্রত হয়ে থাকার জন্যে প্রকৃতি ওগুলো দেয় নি নারীকে।
নারীর যৌনপ্রত্যঙ্গগুলোর কয়েকটি বাহ্যিক, কয়েকটি আভ্যন্তর। তবে এগুলো এমনভাবে বিন্যস্ত যে নগ্ন হ’লেও, স্তন ছাড়া, নারী কখনো নগ্ন নয়। নারীর বাহ্যিক যৌনপ্রত্যঙ্গ এলাকার নাম যৌনাঞ্চল [ভালভা]। চমৎকার এলাকা এটি, আপলিনিয়ের এ-এলাকাকেই বলেছিলেন ‘বিশুদ্ধ ত্রিভুজ’। এ-এলাকায় রয়েছে কয়েকটি প্রত্যঙ্গ, যেগুলো পালন করে বিশেষ বিশেষ দায়িত্ব। এগুলো নারীর বাইরের যৌনপ্রত্যঙ্গ, কিন্তু বাইর থেকে দেখা যায় না, দেখার জন্যে তাকাতে হয় কাছে থেকে, দেখতে হয় আঙুল দিয়ে ফুলের পাপড়ির মতো নেড়ে নেড়ে।
বৃহ্দোষ্ঠ : এটি হচ্ছে দু-ভাঁজ চামড়া; ঠোঁট যেমন মুখগহ্বরকে ঢেকে রাখে। এ-দুটিও ঢেকে রাখে এ-দুটির মধ্যবর্তী ভগগহ্বরকে। দুটি বড়ো মোটা গোলাপপাপড়ি ব’লে মনে হতে পারে। এ-দুটিকে। শিশু ও বুড়োকালে বৃহ্দোষ্ঠ দুটি থাকে ছোটো, ভেতরে মেদ থাকে না, তবে বয়ঃসন্ধি থেকে ঋতুবন্ধ হওয়া পর্যন্ত বৃহ্দোষ্ঠ থাকে পরিপুষ্ট। ওপরের দিকে বৃহ্দোষ্ঠ দুটি মিলিত হয় এক মেদপুষ্ট অঞ্চলে, যাকে বলা হয় ভেনাসের পাহাড় মোন্স ভেনারিস] বা যোনিবিটপ। বৃহ্দোষ্ঠ, বিশেষ ক’রে মোন্স ভেনারিসের ওপর উদগত হয় যৌনকেশ।
ক্ষুদ্রোষ্ঠ : এ-দুটি মেদপুষ্ট স্পর্শকাতর চামড়ার ভাঁজ, গোলাপের ছোটো পাপড়ির মতো। ওপরের দিকে এ-দুটির একটি চলে যায়। ভগাঙ্করের ওপরে, আরেকটি ভগাঙ্কুরের নিচে; নিচের দিকে এ-দুটি মিলিত হয় পরস্পরের সাথে। বয়ঃসন্ধি থেকে ঋতুবন্ধ পর্যন্ত এটি গুপ্ত থাকে বৃহ্দোষ্ঠের আড়ালে, দেখতে হয় আঙুল দিয়ে খুলে; তবে শিশু ও বুড়োকালে এ-দুটি বেশ দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে ওঠে।
ভগাঙ্কুর : পুরুষের যেমন শিশ্ন নারীর তেমন ভগাঙ্কুর; তবে শিশ্নের যৌন ছাড়া অন্য কাজ রয়েছে, কিন্তু ভগাঙ্কুরের একমাত্র কাজ যৌনসুখ অনুভব। তাই এটি অনন্য কামপ্রত্যঙ্গ, পুরুষের এমন কোনো অনন্য কামপ্রত্যঙ্গ নেই। এটি যেহেতু শুধু কামসুখের জন্যেই, আর কোনো কাজের জন্যে নয়, তাই দেশে দেশে পিতৃতন্ত্র এর ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে এটি কেটে ফেলার বিধান দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার অনেক মুসলমান দেশে এখনো ভগাঙ্কুরছেদ বা নারীর খৎনা প্রচলিত রয়েছে। এটি কেটে ফেলার অর্থ হচ্ছে নারীর কামসুখের চিরাবসান। গত কয়েক দশকে নারীবাদীরা, ও মাস্টার্স্ ও জনসনের গবেষণা, প্রতিষ্ঠা করেছেন এর প্রাধান্য। তাঁদের মতে অরগাজম বা পুলকের জন্যে সঙ্গম অপ্রয়োজনীয়, এটি মৈথুন ক’রেই অনুভব করা সম্ভব চরম পুলক। ইলিয়েরসেন ‘আমি অভিযোগ করি’ (১৯৬৯) নামের বইতে লিখেছেন [দ্র গ্রিয়ার (১৯৭১, ৪৩)] :
‘(যৌনবিজ্ঞানীরা) পরামর্শ দেন যে সঙ্গমের অবতরণিকা হিশেবে নাড়তে হলে ভগাঙ্কুরটিকে, সঙ্গমকেই অধিকাংশ পুরুষ মনে করে ‘আসল জিনিশ’। তাদের জন্যে যা আসল জিনিশ, নারীর জন্যে তা পুরোপুরি সুখানুভূতিহীন। এটিই হচ্ছে মূল জিনিশ! যাকে বিনীত, লজ্জাশীল ও অনুগত নারীরা শতো শতো বছর ধ’রে লুকিয়ে রেখেছে।‘
এটি অবস্থিত যৌনাঞ্চলের ওপরের দিকে মধ্যস্থলে। এটি মোটা শিউলিবোঁটার মতো, এর রয়েছে তিনটি অংশ; শীর্ষ, শরীরদণ্ড, ও পা। এর শীর্ষটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর, দণ্ডটিও বেশ স্পর্শকাতর। শীর্ষ ও দণ্ড নেড়েই নারী পেতে পারে চরম পুলক। সঙ্গমে নারী পুলক বোধ করে প্রধানত শিশ্নের সাথে এটির ঘর্ষণে। অনেক নারী সঙ্গমে কোনো পুলক বোধ করে না, কিন্তু তারা ভগাঙ্কর মৈথুন ক’রে চরম পুলক লাভ করে। ভগাঙ্করের একটু নিচেই থাকে মূত্ররন্ধ।
যোনিচ্ছদ : মূত্ররন্ধের নিচে অবস্থিত নারীর যোনিমুখ, যেটি সাধারণত ঢাকা থাকে একটি পাতলা পর্দায়। পর্দাটির প্রথাগত নাম সতীচ্ছদ, তবে এটি থাকা-না-থাকা তথাকথিত সতীত্বের প্রমাণ-অপ্ৰমাণ নয়। সতীত্ব বলে কিছু নেই; এটি না থাকার অর্থ এটি নেই। এটিকে যোনিচ্ছদ বলাই ভালো। এটি এক অপ্রয়োজনীয় জিনিশ। এটি একটি পাতলা পর্দা, যাতে থাকে এক বা একাধিক ছিদ্র, যার ভেতর দিয়ে নিঃসৃত হয় ঋতুস্রাব। এটির আকার ও স্থিতিস্থাপকতা ভিন্ন হয়ে থাকে নারী থেকে নারীতে; সঙ্গম না করেও এটি ছিঁড়ে যেতে পারে, আবার বহুসঙ্গমেও থাকতে পারে অটুট। এটি ছেড়ার সময় সাধারণত কিছুটা রক্ত বেরোয়। অনেক সমাজে যোনিচ্ছদ ছেঁড়া ও রক্তক্ষরণকে মনে করা হয় নারীর সতীত্বের প্রমাণ। বাসর রাতের ভোরে তারা বিছানা খুঁজে দেখে রক্তের দাগ আছে কি-না। আরব ও আফ্রিকি সমাজে যোনিচ্ছদ ও বাসর রাতের রক্তক্ষরণ আজো চরম গুরুত্বের বিষয়। অনেক ক্ষেত্রে সেখানে কনের পিতা চরম উৎকণ্ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে বাসরঘরের দরোজায়, তার হাতে দেয়া হয় কন্যার যোনিরক্তভেজা একটি শাদা রুমাল, আর সে সেটিকে পতাকার মতো উড়িয়ে ঘোষণা করে কন্যার সতীত্ব! রক্ষা করে বংশের মান। সেখানে এখন যোনিচ্ছদ জোড়ালাগানোর শল্যচিকিৎসা ধনীদের মধ্যে খুবই জনপ্ৰিয়।
নারীর আভ্যন্তর যৌনপ্রত্যঙ্গের মধ্যে রয়েছে যোনি, জরায়ু, ডিম্বনালি বা ফ্যালোপীয় নালি, ও ডিম্বাশয়।
যোনি : এটি পুরুষের প্রধান স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্ন। পুরুষ এর প্রতি আকর্ষণ বোধ করে, এমনকি ভয় পায় ও ঘৃণা করে এটিকে। যোনি একটি পেশল নালি, এটি পেছনের দিকে উঁচু হয়ে গিয়ে জরায়ুতে পৌঁছে। এটি পেশিতে গঠিত, এবং এতে আছে রক্তবাহী শিরাজাল, যা কামোত্তেজনার সময় ফুলে ওঠে। স্বাভাবিকভাবে যোনির দেয়াল লেগে থাকে পরস্পরের সাথে; তবে এটি যেহেতু স্থিতিস্থাপক, তাই এর ভেতর দিয়ে লিঙ্গ বা ট্যাম্পূন প্রবেশের বা সন্তান প্রসবের সময় এটি বিস্ময়করভাবে প্রসারিত হয়। যোনি সাধারণত ৩.৭৫ ইঞ্চি দীর্ঘ। জরায়ুর গ্ৰীবা বা সারভি-স্য ঢুকে পড়ে এর ভেতর। যোনি প্রত্যঙ্গ হিশেবে বিস্ময়কর। এটা শুধু স্থিতিস্থাপকই নয়, এটির আছে নিজেকে নিজে পরিচ্ছন্ন রাখার শক্তি। নারীর আভ্যন্তর প্রত্যঙ্গগুলোর মধ্যে এটিই বেশি লিপ্ত হয় কামে; সাধারণ বোধে এটিই নারীর একমাত্ৰ কামপ্রত্যঙ্গ। পুরুষ এটির ভেতরে শিশ্ন ঘর্ষণ ও ধাতুপাত ক’রেই চরম সুখ পায়। এটির সব অংশ সমান স্পর্শকাতর নয়, এর মধ্যভাগের কোনো স্পর্শকাতরতাই নেই, শুরু ও শেষভাগের রয়েছে কিছুটা স্পর্শকাতরতা। তাই শুধু এটির ভেতরে সঙ্গম করা হ’লে নারী পুলক বোধ করে না। ছোটো যোনি বলে কিছু নেই, যে-কোনো যোনিতে প্রবেশ করতে পারে যে-কোনো শিশ্ন। কামোত্তেজনার সময় যোনি সিক্ত হয়, সিক্ততা শিশ্নের প্রবেশের সহায়ক। যোনি কোনো অক্রিয় প্রত্যঙ্গ নয়, সঙ্গমের সময় এটি শিশ্নকে জিভের মতো চুষতে পারে।
জরায়ু: জরায় আরো বিস্ময়কর। গৰ্ভধারণের আগে এটি দেখতে অনেকটা নাশপাতির মতো, দৈর্ঘ্যে প্রায় চার ইঞ্চি, পাশে আড়াই ইঞ্চির মতো, ওজন দু-আউন্স। গৰ্ভধারণের সময় এটির ওজন হয় আড়াই পাউন্ড, ধারণ করতে পারে সতেরো ইঞ্চি দীর্ঘ একটি শিশু। সন্তান জরায়ুতে উদ্ভূত হয় না, লালিত হয়। জরায়ু এক শূন্য পেশল আধার, এর সামনে মুত্রাশয় পেছনে মলাশয়। সামনের দিক থেকে দেখতে এটি ত্রিকোণ, আর এটি বাঁধানো গ্রন্থিল তন্তুজালে। এ-তত্ত্বজালকে বলা হয় এন্ডোমিটিয়াম। প্রতি ঋতুস্রাব্যচক্রে ঘটে এ-এন্ডোমিটিয়ামের পরিবর্তন। এর ওপরের দিকের কোণকে বলা হয় ‘করনু’বা শিং, যা ধারাবাহিকভাবে ঢুকে গেছে ডিম্বনালির ভেতর।
ডিম্বনালি বা ফ্যালোপীয় নালি : ডিম্বনালি দুটি শূন্য ছোটো নালি, দুটি দু-দিকে। চার ইঞ্চির মতো লম্বা এ-নালি দুটি দু-দিকের ডিম্বাশয়ের সাথে সংযুক্ত রাখে জরায়ুকে। ডিম্বনালি খুব গুরুত্বপূর্ণ, এরই ভেতরেই ঘটে ডিম্বাণুর গর্ভ বা উর্বরায়ণ। এ-নালিতে গৰ্ভ ঘটার পর ভ্রণ ক্রমশ স’রে গিয়ে বাস করে জরায়ুতে।
ডিম্বাশয় : ডিম্বনালির দু-প্রান্তে থাকে দুটি ডিম্বাশয়, দেখতে ডিমের মতো। দেড় ইঞ্চি লম্বা ও পাশে এক ইঞ্চির কম। শিশুবালিকার ডিম্বাশয় থাকে ছোটো, বয়ঃসন্ধির পর আকারে বাড়ে। ঋতুবন্ধের পর আবার ছোটো হয়ে যায়। এর আছে একটি কেন্দ্ৰস্থল, কেন্দ্ৰস্থলকে ঘিরে আছে কৰ্টেক্স। কটেক্সই প্রকৃত ডিম্বাশয়, যার ভেতর ঘুমিয়ে থাকে প্রায় দু-লাখের মতো ডিম্বাণু। পুরুষের যেমন অণ্ডকোষ নারীর তেমনি ডিম্বকোষ।
জৈব লিঙ্গ সত্য, তবে পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রবলতর সত্য হচ্ছে সাংস্কৃতিক লিঙ্গ। পিতৃতন্ত্র চায় পুরুষ হবে আক্রমণাত্মক, স্বাধীন, নিরাবেগ; আর নারী হবে অনাক্রমণাত্মক, দমন ক’রে রাখবে কাম: হবে অক্রিয়, সেবাশুশ্রুষাপরায়ণ, আকর্ষণীয়। সাংস্কৃতিক লিঙ্গের বিধান অনুসারে বেড়ে উঠতে হয় তাদের। বাল্যকালে তাদের লালনপালন করা হয় এ-বিধান অনুসারে, তারা দীক্ষিত হয়। এতে, এবং মানবপ্রজাতি হয়ে ওঠে। দুটি বিপরীত প্রাণীর সমষ্টি। এর পুরস্কার পায় পুরুষ, শাস্তি ভোগ করে নারী। জৈব লিঙ্গ মানুষের সামাজিক অবস্থান নির্দেশ ক’রে দেয় না, ব’লে দেয় না যে নারী অধীনে থাকবে পুরুষেব; কিন্তু সাংস্কৃতিক লিঙ্গ সৃষ্টি করা হয়েছে এ-উদ্দেশ্য থেকে যে তা সব সময় নির্দেশ করবে নারীপুরুষের অবস্থান, ঘোষণা করবে। যে পুরুষ আধিপত্যশীল নারীর ওপর। সাংস্কৃতিক লিঙ্গের ওপর গুরুত্ব আরোপ হচ্ছে লিঙ্গবাদঅর্থাৎ পুরুষ হচ্ছে পুরুষ নারী হচ্ছে নারী, যা পুরুষাধিপত্যকে মনে কবে চিরন্তন! নারীর শরীর দূষিত বা লজ্জার বস্তু নয়, একে নিয়ে বিধিনিষেধের বাড়াবাড়ি লিঙ্গবাদের প্রকাশ। নারী তার শরীর হারিয়ে ফেলেছে পুরুষ, সমাজ, রাষ্ট্রের কাছে; কিন্তু নারীকে মনে রাখতে হবে তার শরীর তার নিজস্ব সম্পত্তি, এর ওপর সে ছাড়া আর কোনো ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র, বা অলৌকিক কারো অধিকার নেই।