নাথু হল ঝগড়ুর বন্ধু। ঝগড়ুর জন্য নাথু ট্যাকে করে গুণ্ডি নিয়ে আসে। ঝগডুর বউ নাথুকে দেখতে পারে না, তাই নাথুর কাজ সারা হলে ঝগড়ু ওর সঙ্গে মোমলতার তলায় বসে গল্প করে।
বোগি বলে, কেন তোমার বউ নাথুকে দেখতে পারে না, ঝগড়ু?
নাথু মুচকি হেসে বলে, আমার পা দুটো ডুবে থাকে এখানকার নদীর জলে, কিন্তু মন কোথায় থাকে ঝগড়ুর বউ জানে না, তাই আমাকে দেখতে পারে না!
কেন, নাথু, কোথায় থাকে তোমার মন?
বাতাস দিলে তোমাদের বাঁশ বনের শিরশির সরসর শব্দ শুনেছ, দিদি? বাতাস থামলে কোথায় থাকে সেই শব্দ? অমন বোকার মতো কথা জিজ্ঞেস কোরো না।
বোগি বলল, ভারি বোকা রুমুটা, নাথু। যে যা বলে তাই বিশ্বাস করে। আমি মজা করে বলেছিলাম, পুতুল ভেঙেছে কাদিস না, পুঁতে রাখ গাছ হবে। ও সত্যি পুঁতে রেখেছিল।
রুমু বলল, মোটেই আমি বোকা না। মোটেই আমি যে যা বলে বিশ্বাস করি না। খালি তুমি যা বল বিশ্বাস করি। রুমুর কান্না পাচ্ছিল।
নাথু তাড়াতাড়ি বলল, আর বিশ্বাস করবে নাই-বা কেন? কীসের গাছ হয় আর কীসের হয় না, তার তুমিই-বা কী জান, বোগিদাদা? যারই বুকের মধ্যে শেকড়ের কলি আছে তারই গাছ হয়। আমাদের গায়ের কাছে এক সাধু থাকত, তার একটা কানাকড়িও ছিল না। সেবার বান ডাকার পর দুর্ভিক্ষ হল। সে সারা গাঁকে দশ দিন খাওয়াল কী করে? খালি রাশি রাশি চকচকে পয়সা এনে দেয়। তারপর সরকারি সাহায্য এল, সবার দুঃখ ঘুচল, তখন লোকে বলল, সাধু, তুমি পয়সা জাল কর নাকি, অত নতুন পয়সা পেলে কোথায়?
তাকে নাস্তানাবুদ করল গাঁয়ের লোক, মনের দুঃখে সে আস্তানা ছেড়ে চলেই গেল! সে গেলে সবাই বলল, দাও জালিয়াত সাধুর ঘর পুড়িয়ে, ভণ্ডামি করবার জায়গা পায়নি।
ঘরে ঢুকে দেখে কয়েকটি মাটির বাসন আর একটা চট আর ঘরের মাঝখানে ছোটো একটা শুকনো গাছ। তাকে উপড়ে ফেলতেই বেরুল একটা পয়সা, তার চারদিকে গাছের শেকড় ছড়িয়ে রয়েছে। ও কীসের গাছ?
বোগি বলল, তাই বলে তো আর পয়সার বুকে শেকড়ের কলি থাকে না যে গাছ গজিয়ে উঠবে। ওটা আপনিই কেমন করে শেকড়ে জড়িয়ে গেছিল।
নাথু গাঁটরি তুলে মাথায় নিয়ে বলল, পয়সার বুকে শেকড়ের কলি না থাকলেও, দয়ার বুকে তো আছে।
নাথু, যেয়ো না, তুমি একবার কী মাছ ধরেছিলে সেই কথা বলো।
নাথু আবার গাঁটরি নামিয়ে রেখে বলল, ঝগড়ু, বলেছে বুঝি? ঝগড়ু, তুমি বড্ড বেশি কথা বল!
মনের কথা যাকে-তাকে বিলিয়ে দিতে হয় না। হ্যাঁ, তবে বোগিদাদা রুমুদিদিকে বলা যায়, ওদের চোখেও ঘোর আছে কিনা।
বলল, নাথু, বলো। ঝগড়ুকে বোকো না। ঝগড়ুর ঠাকুরদার ঠাকুরদার পাঁচটা বন ছিল। গাছপালা জন্তুজানোয়ার মৌচাক সব ভঁর ছিল। দারুণ সাহস ছিল তার; আর এই বুকের ছাতি।
একবার কুড়ল দিয়ে লম্বালম্বি ল্যাজের ডগা পর্যন্ত বাঘ চিরে ফেলেছিলেন।
একবার ডাকাতে ধরেছিল তাকে, গাঁ থেকে এক কোশ দূরে, এমনি জোরে গাল বাজিয়ে লোক ডেকেছিলেন যে ঝড় উঠেছিল, ডাকাতরা ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিল!
শুনে নাথু খুব হাসল, কে বলেছে এসব? ঝগড়ু তো? ও জেগে জেগে স্বপ্ন দেখে তাও জান না? তবে শোনো আমার মাছ ধরার গল্প।
যারা জলে জলে কাজ করে, জান তো তাদের জলের নেশা লেগে যায়, জল ছেড়ে থাকতে পারে না। আমারও হল তাই। রোজ কাপুনি দিয়ে জ্বর আসে, সে কী দারুণ শীত সে আর কী বলব, বুকের ভিতরটা পর্যন্ত হিম হয়ে যায়, তারপর বিকেল বেলায় ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে যায়। কাজও করতে পারি না, অথচ ঘরে শুয়েও থাকতে পারি না।
কেন, নাথু, শুয়ে থাকতে পার না কেন?
শুলে যে সময় চলে যায়, রুমুদিদি, একটু একটু করে সময় ফুরিয়ে যায়। শোনোই-না গল্প। আমাদের গাঁ ছেড়ে খানিকটা উত্তরে একটা আম গাছ আছে জলের কিনারায়। সেইটে ঠেস দিয়ে বসে মাছ ধরি। পোকামাকড়ের টোপ দিই না, দিদি, পোকামাকড়ে সাধারণ মাছ ওঠে।
সাধারণ মাছ উঠলে কী হয়, নাথু?
কী জ্বালা! সাধারণ মাছ তো হাটেও কিনতে পাওয়া যায়, ও দিয়ে আমি কী করব?
আচ্ছা, আচ্ছা, বলো।
একদিন আমি বঁড়শিতে একটা লাল টুকটুকে কুঁচফল গেঁথে ছিপ ফেললাম। ভারি জল তখন, আমাদের এখানে রোদ ঝকঝক করছে, কিন্তু নদীর গোড়ায় কোথায় বৃষ্টি পড়েছে, ভারি জোর স্রোত। ভাবছি এত স্রোতে মাছ পড়বে না, সারা গা রোদে পুড়ে যাচ্ছে, কিন্তু বুকের বরফ কিছুতেই গলছে না, এমনি সময় সুতোয় টান লাগল। টেনে তাকে তুলতে পারি না, হাঁপ ধরে গেল, শেষে অনেক কষ্টে তাকে ডাঙায় ওঠালাম। ওরকম মাছ তোমরা চোখে দেখনি, বোগিদাদা, রুমুদিদি। দেখবেও না কখনো।
থামলে কেন নাথু? বলো, বলো।
আঃ! থামলাম সেকথা মনে করেও গায়ে কাঁটা দিচ্ছে বলে। শোনোমন দিয়ে। মাছটা দুই হাতের কনুইয়ে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে উঠে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। রোদের আলোতে স্পষ্ট দেখলাম তার মাথা-ভরা কালচে সবুজ চুল ঘাড়ে গলায় লেপটে রয়েছে, ঠোঁট দুটো একটু ফাঁক করে বড়ো কষ্টে নিঃশ্বাস ফেলছে, মুক্তোর সারির মতো দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়াচ্ছে, ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ছে, কানের কাছে চুলের সঙ্গে বঁড়শি আটকে গেছে, সেখান থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ছে। ছোটো দু-টি কানে দুটি সোনার মাকড়ি পরা। দেখলাম পদ্মফুলের মতো হাত দুটি দিয়ে শক্ত করে ঘাস আঁকড়ে রয়েছে, নীল নীল শিরা দেখা যাচ্ছে, দিঘির মাঝখানকার মতো ঘন সবুজ চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে, বুটা কত যন্ত্রণায় উঠছে পড়ছে। কোমরের তলা থেকে মাছের মতো দেখতে, ল্যাজটার কী রঙের বাহার, ময়ূরের পেখমের মতো মেলে রয়েছে। দেখতে দেখতে আমার চোখের সামনে তার সব রং ফিকে হয়ে আসতে লাগল, নিঃশ্বাসের ওজন যেন এক-শো মন, দু-ফোঁটা চোখের জল আমার হাতে এসে পড়ল। অমনি আমার বুকের ভিতরকার বরফ গলে গেল, আমি তাড়াতাড়ি টাক থেকে আমার ছুরিটা বের করে ছিপের সুতো কেটে দিলাম। ভয় হল এখুনি বুঝি এলিয়ে পড়বে, কোলে তুলে তাকে মাঝ নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। সারা গা আমার ভিজে গেল। তারপর আর মনে নেই।
যখন জ্ঞান হল, দেখি ঘরে শুয়ে আছি, জ্বর গায়ে মাছ ধরতে যাওয়ার জন্য বাড়ির লোকেরা রাগারাগি করল। এখন যাই, বোগিদাদা রুমুদিদি। ঝগড়ুর গল্প সব সত্যি না-ও হতে পারে।ও জেগে জেগে স্বপ্ন দেখে।
যেতে যেতে থেমে বলে, এই আমার এক কানে সোনার মাকড়ি দেখছ, এটিকে পরদিন ওই আম গাছের তলায় পেয়েছিলাম।
নাথু গাঁটরি নিয়ে চলে গেল, আর ঝগড়ু হেসে বলল, জ্বরও হল গিয়ে স্বপ্নেরই জাতভাই, দাদা। স্বপ্ন দেখতে না পারলে আর পারলে কী? উঠি। গা-টা কেমন ম্যাজম্যাজ করছে, কাঠ ফেড়ে ঘাম করিয়ে শরীরটাকে ঝরঝরে করে ফেলি। কাল সারা রাত ঘুমোইনি, বোগিদাদা, চাঁদনি রাতে কুকুররাও ঘুমোয় না, আমারও চোখে ঘুম থাকে না, আমার শালার ছেলেটা কিন্তু খুব ঘুমিয়েছে।
চাঁদনি রাতে ভুলো তো ঘুমোত, ঝগড়ু।
ভুলো? সে তো সুখী কুকুর, সুখীদের ঘুমোতে বাধা নেই।
সুখী তো পালিয়ে যায় কেন, ঝগড়ু? সুখীরা পালায় না কে বলেছে দিদি? সুখীরা পালায় ওই সুখের কাছ থেকেই; দুঃখ পায় না বলে দুঃখকে খুঁজে বেড়ায়। বলব একদিন আমার বাবার বর্মা যাওয়ার কথা!