ধনঝুরি পাহাড়ের গল্প
কাল রাতে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি। রাতভর তুমুল বৃষ্টি হচ্ছিল। যেন আকাশ থেকে কান্না গলে গলে পড়ছিল। স্বপ্ন দেখলাম, আমি যেন একটা বিশাল বিলের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছি। বাতাস লেগে তার বুকে খুদে খুদে ঢেউ উঠছে । শরবন বিলের পাশে। শরবনের ডগা কাঁপছে। আমি দাঁড়িয়ে আছি নলখাগড়া ঝোপের পাশে। হঠাৎ দেখলাম, আকাশ কালো করে যাযাবর পাখিরা আসছে। শীতের দেশ থেকে এসেছে ওরা। তুষার ঝড়ের তাড়া খেয়ে। ওরা ঝুপ জুপ করে হাওরে নেমে পড়ল। কত দূরের পথ সাঁই সাঁই করে পেরিয়ে এসেছে ওরা। পাইন বনের উপর দিয়ে, উপরাল পাহাড় ডিঙিয়ে। ওরা সাইবেরিয়ার বুনোহাঁস। কালো পুঁতির মতো চোখ। শুধু ইতিউতি তাকায় । যেন তাদের কেউ তাড়া করছে। ওরা নেমে পড়ল আমার চারপাশে । বিলের পানি উথলে উঠল । আর আমি অবাক হয়ে দেখলাম আমার শরীরে পালক গজাচ্ছে। ফুলের মতো পালক ফুটে উঠছে আমার শরীর থেকে। আমি যেন আস্তে আস্তে একটা বুনোহাঁস হয়ে গেলাম । তেমনি কালো পুঁতির মতো টলটলে চোখ হলো আমার । বুকের ভেতরটা যেমন হু হু করে উঠল। বুনোহাঁসদের বুকের ভেতর সারাক্ষণ বুঝি অমনি হু হু করে চাপা কান্না থাকে। উদাস ভাব থাকে।
তুষার ঝড়ে কোনো সঙ্গী হারিয়ে গেলে যেমন মন খারাপ লাগে। শীতের বাতাসে কেউ কুঁকড়ে মরে গেলে যেমন খারাপ লাগে। এটা ছোট্ট নীড় বাঁধতে না পারলে যেমন খারাপ লাগে।
এই রকম একটা দুঃখের ভাব কী সব বুনোহাঁসের মাঝেই আছে! আমার তো তখনই তাই মনে হলো। আর মনে হতেই ভীষণ কান্না পেয়ে গেল।
সেই যাযাবর পাখিদের দলে মিশে গেলাম। পাখি, আমার চারপাশে অজস্র পাখি। তারা কলকল করছে। একটা পাখি যেন আমার কাছে এসে বলল, কি নীড় বানাবে না? ওই কলমি ঝোপটার পাশে। এসো আমরা গিয়ে একটা ছোট্ট নীড় বানাই।
বিকেল ফুরিয়ে সন্ধে নামল। এক সময় ঝকঝক করে আকাশে রাজার মতো চাঁদ উঠে এলো। তার মায়াবী রুপোলি আলো ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। সেই আলোতে গান গাইল বুনোহাঁসের দল। নীড় বানাবার গান। সুখের গান। কলমি ঝোপের পাশে, নলখাগড়া ঝোপের ফাঁকে আর শরবনের মাঝে সেই গান ছড়িয়ে পড়ল। আহা, চারপাশে কী সুখ! শান্তি। সেই বুননাহাঁস সঙ্গীটা আমার কাছে এসে বলল, কতেদিন পর আজ নিশ্চিন্তে ঘুমুতে পারব আমরা। শীতের ঝড় আমাদের আর তাড়া করবে না। তুষার ঝড় আর আমাদের মেরে ফেলবে না। এত পথ চলার ক্লান্তি মুছে গেছে বিলের ভেজা বাতাসে।
কোখেকে তখন যেন একঝাঁক মেঘ এসে ঢেলে দিল চাঁদটাকে। অন্ধকার ঘনিয়ে এলো চারদিকে। আর হঠাৎ করে শুরু হলো গুলির শব্দ। শিকারিরা চুপিসারে এসেছে। আঁক বেঁধে মরতে লাগল বুনোহাঁসের দল। যারা তুষার ঝড়ের তাড়া খেয়ে হাজার হাজার মাইল পেরিয়ে এসেছে শুধু ছোট একটা নীড় বানাবার জন্য। সীসের তীব্র গুলি তাদের নরম বুকগুলো ঝাঁঝরা করে দিতে লাগল। যে বুকে ছিল চাপা কান্না। আমার সঙ্গী পাখিটা পালাতে চাইতেই একটা গুলি এসে বিধলো তার গলার কাছটায়। গলগল করে রক্ত ছিটকে পড়ল।
পাখিটা কেমন অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তার চোখে একটু আগে ছিল নীড় বাঁধার স্বপ্ন। এখন সেখানে ভয়ার্ত মৃত্যু এসে ভর করেছে। তার গলার নিচ থেকে রক্ত এসে আমাকে ভিজিয়ে দিতে লাগল। পাখিটা তার ভাঙা ডানা দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করছে। আমি আতঙ্কিত হয়ে উঠলাম। সমস্ত বিলের পানি কী বুনোহাঁসের রক্তে পলাশ ফুলের মতো টকটক লাল হয়ে যাবে?
আর তক্ষুণি ঘুম ভেঙে গেল আমার। ঘামে সমস্ত শরীর ভিজে জবজব করছে। ঘড়ি দেখলাম। তিনটে বেজে দশ। কোনোদূরের বাড়িতে একটা বাচ্চা কাঁদছে। মাঝরাতের নীরবতা ভেঙে একটা গাড়ি চলে গেল । গলাটা শুকিয়ে গেছে। ঢকঢক করে দুগ্লাস পানি খেলাম। শুধু একটানা ঘড়ির শব্দ হচ্ছে। টিকটিক। কী অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম। বিল, কলমিঝোপে, বুনোহাঁস, গুলি, রক্ত।
আমার মনে হলো, ঘরের সমস্ত দেয়ালগুলো যেন আস্তে আস্তে ফেটে যাচ্ছে। তার ভেতর থেকে গলগল করে বেরিয়ে আসছে রক্ত। কাদের এত রক্ত? বিলের সমস্ত বুনো হাঁসদের রক্ত।
বুঝলাম, বাকি রাতটুকু আমাকে নির্মুম কাটাতে হবে। ছটফট করে।
কি যে হয়েছে আজকাল। এলোমেলো সব ভাবনা ভাবি। এলোমেলো স্বপ্ন দেখি। বেশির ভাগ ভয়ের, মৃত্যুর আর রক্তের স্বপ্ন। অথচ আগে তো এমন হতো না। শান্ত ঘুম হতো।
কেন, কেন আমি আজকাল ভালো করে ঘুমুতে পারি না? ধনজুরি পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে শাদা পায়রার ঝাঁক যেমন নিশ্চিন্তে ঘুমোয়, আমি কেন তেমন পারি না?
ছোটবেলায় একবার ধনঝুরি পাহাড়ে গিয়েছিলাম। আমার কতদিনের স্বপ্ন ছিল পাহাড়ে যাবার। স্বপ্ন ছিল একটা বিশাল প্রান্তরে যাবার। পুরনো ঢাকার ছোট্ট এঁদো গলিটা ছড়িয়ে আমার মন উধাও হয়ে যেত। গলিতে শুধু শ্যাওলা ছোপ ছোপ ছোট্ট বাড়ি। ডাস্টবিনে উপচাননা ময়লা। ড্রেনের নোংরা পানিতে মরা বেড়াল।
আমার শানুমামা থাকতেন ধনঝুরি পাহাড়ে। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে কাজ করতেন। সবসময় মুখে হাসি। মানুমামা যখন আমাদের বাড়িতে আসতেন তখন আমার মনে হতো মামা তার পকেট ভরে, স্যুটকেস ভরে সবুজ অরণ্যের গন্ধ আর পাহাড়ের গন্ধ নিয়ে এসেছেন। একটা অদ্ভুত শিহরণ জাগত তখন মনে।
সেই শানুমামার সাথে আমি একবার ধনঝুরি পাহাড়ে গিয়েছিলাম। সেখানে অজস্র শাল মহুয়ার গাছ। নরম ছায়া। শালকুঁড়ি ফুটলে মিষ্টি গন্ধে সেখানকার বাতাস ভরে থাকে। উত্তর দক্ষিণের এলোমেলো বাতাসে শালকুঁড়ির গন্ধ ভাসে সেখানে। সেখানকার আকাশ ভীষণ ঝকঝকে। অপরাজিতার মতো নীল।
শুকনো শালপাতা ডাল থেকে খসে খসে পড়লে শব্দ হয়। ঝর জর, ঝরঝর। অনেক রাতে ঘুম ভেঙে গেলে পাতা ঝরার শব্দ শুনেছি। মনে হয় সমস্ত শালবনটা বুঝি কাঁদছে। সারাদিন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে যে গাছগুলো, তারা রাতের পহরে পহরে বুঝি কাঁদে। সে যে কী অদ্ভুত একটা শব্দ। বাতাসের দাপাদাপিতে ডাকবাংলোর কাচের শার্সি নড়ছে। ঘরে মৃদু আলো। কখনও তাকিয়ে দেখেছি শার্সিতে দারুণ আবেগে মুখ ঘষছে ধনঝুরি পাহাড়ের কোনো হরিণ ছানা। তাদের কাজল কালো চোখ দুটো কী ভীষণ মায়াময়। যেন সবটুকু ভালোবাসা জমে আছে ওই চোখ দুটোর মাঝে । আমি কোনোদিন ভুলব না ধনজুরি পাহাড়ের সেই হরিণদের যারা মাঝরাতে পাতা ঝরার বন পেরিয়ে আসত। বাংলোর কাচে শার্সিতে মুখ ঘষত।
এক চিলতে মহুয়া ফুলের মতো শাদা সকাল লেগে থাকত ধনঝুরি পাহাড়ের গায়ে ।
আর এক সময় সোনালি রোদে ভরে যেতে সমস্ত বন। ওখানে সাঁওতালেরা থাকত। তারা মহুয়া ফুল ভালোবাসে। মাদল বাজিয়ে গান গায়।
তারা সরল। ওই ধনঝুরি পাহাড়ের শাল মহুয়ায় গাছগুলোর মতো। সেখানে একটা আশ্চর্য জিনিস দেখেছিলাম। অজস্র শাদা পায়রা আছে সেই পাহাড়ে। এক সাথে এত পায়রা আমি আর কোথাও দেখিনি। যখন ওদের ডানায় রোদ ঝিলমিল করে উঠত, তখন ভারি চমত্তার দেখাতো । মনে হতো, সমস্ত আকাশটায় বুঝি কে যেন একরাশ সোনার কুচি ছড়িয়ে দিয়েছে।
একটা সাঁওতাল ছেলে আমাকে শাদা পায়রাদের আস্তানার কাছে নিয়ে গিয়েছিল। ওর নাম ডুংরি । ও নাকি একবার সারারাত বনের ভেতরে ঘুরে বেড়িয়েছিল। সবাই বলেছিল ডুংরিকে ভূতে পেয়েছে। কিন্তু ও বলে, পরীরা নাকি তাকে ডাক দিয়েছিল। গাছের ফাঁকে ফাঁকে পরীরা সারারাত নেচেছে। এক অদ্ভুত আলোতে তখন সমস্ত বনটা মায়াবী হয়ে উঠেছে। পরদিন ভোরে ডুংরিকে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল।
সেই ডুংরি আমাকে একদিন ধনজুরি পাহাড়ের শাদা পায়রাদের আস্তানার কাছে নিয়ে গিয়েছিল। দিনের আলো ফুরিয়ে গেলে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে আশ্রয় নেয় দুধশাদা পায়রারা। তারপর এক সময় ডানা খুঁজে ঘুমিয়ে পড়ে। আহা, আমি যদি ওই ধনঝুরি পাহাড়ের পায়রাদের মতো নিশ্চিন্তে ঘুমুতে পারতাম!
আজকাল কী যে হয়েছে, নানা এলোমেলো ভাবনা এসে ঘিরে ধরে। মাথার ভেতরে জট পাকায়। কত কী মনে আসে। দিনগুলো সব ফ্যাকাশে । মরা মাছের চোখের মতো।
মনে আছে একবার হঠাৎ করেই এক অজানা, অচেনা স্টেশনে নেমে গিয়েছিলাম। তখন যাই যাই দুপুর। ট্রেনে করে কোথায় যেন যাচ্ছিলাম। ওদিককার প্রকৃতি বড় আদিম। পরিবেশ বড় আরণ্যক।
ট্রেন এসে থামল একটা ছোট্ট স্টেশনে। কী ইচ্ছে হলো, নেমে পড়লাম। ভীষণ নিরিবিলি স্টেশন। গাছগাছালিতে ভরা। ছায়া ছায়া। যখন নামলাম তখন শেষ বিকেল। জাফরানি রং রোদ্দুর গাছগুলোর মাথায় জমে আছে।
সেখানে মানুষের ভিড় নেই। ধুলো নেই। সেখানে শুধু প্রসন্নতা। স্টেশনের পাশে রাংচিতের ঝোপ। কয়েকটা জংলা ঘুগু ডাকছিল। পেছনে একটা খেয়াঘাট। ইলিশ মাছের পেটের মতো চকচক করছে নদী।
আমি জানতাম অনেক রাতে একটা ট্রেনে আসবে অন্ধকারের সমুদ্র সাঁতরে। সেটায় চড়ে আমার গন্তব্যে যেতে পারব। না হয় বেশকিছু দেরি হলোই। তবু মন্দ কি, হুট করে একটা অজানা, অচেনা স্টেশনে নেমে পড়া। যেখানে প্রচুর গাছ। যেখানে জংলা ঘুঘু একটানা কেমন উদাস সুরে ডাকে। মন্দ কি, স্টেশনের সামনে কড়ই গাছটার নিচে চুপচাপ বসে থাকা। কী করে একটা সুমসাম দুপুর বিকেলের মাঝে মিলিয়ে যায়, তাকে অনুভব করা। একটা মিষ্টি শেষ বিকেলের স্মৃতিকে আঁকড়ে থাকা। রাশি রাশি পাতা ঝরবে। পাখিরা নীড়ে ফিরবে খড়কুটো মুখে নিয়ে।
সেই নিরিবিলি স্টেশনের নাম আমার মনে নেই। এটুকু শুধু মনে আছে, লাল কাঁকড়ের একচিলতে রাস্তা ছিল।
সেই রাস্তায় সবসময় শুকনো ঝরা পাতা জমে থাকত। সেই রাস্তা একেবেঁকে মিলিয়ে গেছেন ঘন শালবনের মাঝে । যেখানে ছোট্ট একটা গির্জা। লাল টালির ছাদ তাতে। যে গির্জার পাশে আছে কয়েকটি নিম গাছ। লাল টালির ছাদের নিমফুল পড়ে টুপটুপ করে।
এইসব টুকরো টুকরো ছবি মনে আছে। মনে আছে, রোদ ফুরিয়ে গেলে কেমন শিরশির বাতাস বইতে থাকত সেখানে। এমন বাতাস তো আমাদের শহরে কোনোদিন বয়নি। কতদিন ছোট গলির বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে থেকেছি, এমন শিরশির বাতাস তো অনুভব করিনি!
রাতের বেলায় কড়ই গাছের নিচে কাঠের বেঞ্চিটায় বসে থাকা। একটা বাতি জ্বলছে মিটমিট করে। একটা লোক ম্লান আলোতে বসে কেমন বিষন্ন গলায় গান গাইছে। আর তখন সে সময় একলা বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ যেন কেমন করে উঠবে বুকের ভেতরটা।
একলা থাকলে বুকের ভেতরটা বুনোহাঁসের মতো হু হু করে।