১২. দ্য পেট্রনাস
হ্যারি জানে যে হারমিওনের উদ্দেশ্য ভালো, কিন্তু তাতেও তার ওর উপরে রাগ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারল না। কয়েক ঘণ্টার জন্য সে দুনিয়ার সবচেয়ে ভালো ব্রুমের মালিক ছিল, এখন ওর নাক গলানোর কারণে, সে জানে না এর পর আর কখনও ওটা দেখবে কি না। সে নিশ্চিত যে এখন ফায়ারবোল্টে খারাপ কিছু নেই, কিন্তু বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ওটার অবস্থা যে কি হবে সেটা কেউ জানে না।
রনও হারমিওনের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে আছে। তার ধারণা হচ্ছে একটা নতুন ফায়ারবোল্টকে ছিঁড়ে খুঁড়ে দেখা অপরাধের চেয়ে কম কিছু নয়। হারমিওন নিজে বিশ্বাস করে সে ভালো উদ্দেশ্যেই কাজটা করেছে, কিন্তু তারপরও সে কমনরুমে যাওয়াটা এড়িয়ে যাচ্ছে। হ্যারি এবং রন ধারণা করল যে সে লাইব্রেরিতে আশ্রয় নিয়েছে, কিন্তু ওরা ওকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করল না। স্কুলের সবাই নববর্ষের পর ফিরে এলো। ওরা অবশ্য খুশিই হলো। গ্রিফিন্ডর টাওয়ার আবার আগের মতোই জনবহুল এবং কোলাহল মুখর হয়ে উঠল।
টার্ম শুরু হওয়ার আগের রাতে হ্যারিকে খুঁজে বের করল উড।
ক্রিসমাসটা ভালো কেটেছে? সে বলল এবং তারপর কোন জবাবের জন্য অপেক্ষা না করে বসল, নিচু স্বরে আবার বলল, ক্রিসমাসের সময় আমি কিছু বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা করছিলাম, সর্বশেষ ম্যাচ খেলাটা নিয়ে। যদি ডিমেন্টাররা পরের খেলাতেও আসে… মানে আমি বলতে চাচ্ছি… তোমার ব্যাপারে আমরা ঝুঁকি বুঝতেই পারছ।
থেমে গেল উড ওকে কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে।
আমিও এটা নিয়ে ভাবছি, দ্রুত জবাব দিল হ্যারি। প্রফেসর লুপিন বলেছেন ডিমেন্টারদের তাড়ানোর ব্যাপারে তিনি আমাকে প্রশিক্ষণ দেবেন। এ সপ্তাহেই আমাদের প্রশিক্ষণ শুরু হবে; উনি বলেছিলেন ক্রিসমাসের পরে তার সময় হবে না।
আহ্, বলল উড। বেশ, সেক্ষেত্রে–সিকার হিসেবে আমি তোমাকে হারাতে চাই না। এবং তুমি কি আরেকটি নতুন ব্রুমের জন্য অর্ডার দিয়েছো?
না, বলল হ্যারি।
কি! তোমার তাড়াতাড়ি করা উচিত, তুমি জান–ওই শুটিং স্টারটা র্যাভেনক্ল–দের বিরুদ্ধে নিশ্চয়ই তুমি ব্যবহার করবে না!
ক্রিসমাসের উপহার হিসেবে ও একটা ফায়ারবোল্ট পেয়েছে, বলল রন।
ফায়ারবোল্ট? না! সিরিয়াসলি বলছ? সত্যিই ফায়ারবোল্ট?
উত্তেজিত হয়ো না অলিভার, বলল হ্যারি মুখ ভার করে। এখন আর ওটা আমার নেই। ওটাকে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। এবং তারপর ব্যাখ্যা করল কিভাবে এখন ফায়ারবোল্টটাকে কুলক্ষণের জন্য পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হচ্ছে।
অশুভ লক্ষণ? ওটাকে কীভাবে অশুভ করা যাবে?
সাইরিয়াস ব্ল্যাক, ক্লান্ত স্বরে বলল হ্যারি। ও আমার পেছনে লেগে আছে। সুতরাং প্রফেসর ম্যাকগোনাগল ভাবছেন যে সেই ওটা আমাকে পাঠিয়েছে।
কুখ্যাত একজন খুনি তার সিকারের পেছনে লেগেছে এই তথ্যটা উড়িয়ে দিয়ে উড বলল, কিন্তু ব্ল্যাক একটা ফায়ারবোল্ট কিনতে পারে না! ওতো পালাচ্ছে পুরো দেশ ওকে খুঁজছে! সে কীভাবে কোয়ালিটি কুইডিচ সাপ্লাইয়ে হেঁটে গিয়ে একটা ব্রুমস্টিক কিনবে?
আমি জানি, বলল হ্যারি, কিন্তু ম্যাকগোনাগল তবুও ওটাকে খুলে পরীক্ষা করতে চান–
ফ্যাকাশে হয়ে গেল উড।
আমি প্রফেসরের সঙ্গে কথা বলব, হ্যারি, বলল উড। যুক্তিটা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করা একটা ফায়ারবোল্ট একটা সত্যিকারের ফায়ারবোল্ট, আমাদের দলে তিনি তো, আমরা যতটা চাই গ্রিফিন্ডর বিজয়ী হোক ঠিক ততটাই চান যুক্তিটা যেন বুঝতে পারেন সেটা আমি চেষ্টা করব একটা ফায়ারবোল্ট…।
***
পরদিন থেকে ক্লাস শুরু হয়ে গেল। এই জানুয়ারির সকালে খোলা মাঠে দুই ঘণ্টা কাটানোর ইচ্ছা কারো নেই। কিন্তু হ্যাগ্রিড ওদের জন্যে স্যালাম্যান্ডার (টিকটিকি জাতীয় প্রাণী) ভর্তি বনফায়ারের আয়োজন করল। ওরা কাঠ আর পাতা দিয়ে আগুনটাকে জিইয়ে রাখল আর আগুন–প্রিয় স্যালাম্যান্ডার আগুনের মধ্যে কাঠ বেয়ে উঠানামা করল। নতুন টার্মের ডিভাইনেশন ক্লাসটা ততো মজার হলো না; প্রফেসর ট্রিলনি এখন তাদের হস্তরেখা বিষয় পড়াচ্ছেন এবং হ্যারির যে তার দেখা সবচেয়ে কম আয়ুরেখা রয়েছে এটা জানাবার ব্যাপারে তিনি একেবারেই সময় নষ্ট করেননি।
হ্যারির আগ্রহ ডিফেন্স এগেনস্ট দ্য ডার্ক আর্টস ক্লাসের ব্যাপারে; উডের সঙ্গে আলোচনার পর সে চাচ্ছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অ্যান্টি–ডিমেন্টার পাঠগুলো শুরু করতে।
ও হ্যাঁ, বললেন লুপিন, ক্লাসের শেষে হ্যারি তাকে তার প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়ে দিতেই। আচ্ছা দেখি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা আটটায় হলে কেমন হয়? ম্যাজিকের ইতিহাস ক্লাসরুমটা বেশ বড় আমাকে খুব ভালোভাবে চিন্তা করে নিতে হবে কিভাবে কি করব আমরা তো আর প্রাসাদের ভেতরে সত্যিকারের ডিমেন্টার আনতে পারি না
এখনও ওকে অসুস্থ দেখাচ্ছে, তাই না? রন বলল করিডোর দিয়ে হেঁটে ডিনারে যেতে যেতে। তোমার কি মনে হয় ওর কী হয়েছে?
ওদের পেছন থেকে একটা সরব এবং অস্থির টাহ শোনা গেল। হারমিওন, বসেছিল এক প্রস্থ বর্মের নিচে, ওর বই ব্যাগে গোছাচ্ছিল, এত বেশি বই যে ব্যাগটা বন্ধ হচ্ছিল না।
তুমি আমাদের উদ্দেশ্যে টাহ টাহ করছিলে কেন? বিরক্ত হয়ে বলল রন।
কিছু না, বলল হারমিওন অহংকারি স্বরে, কাঁধের উপর ব্যাগটা তুলে নিল।
হ্যাঁ, তুমি তাই করছিলে, বলল রন। আমি বলেছিলাম আমি ভাবছি লুপিনের কি হয়েছে, এবং তুমি
বেশ, এটাই কি হওয়ার কথা নয়? বলল হারমিওন, তার মধ্যে নিজের সম্পর্কে পাগলের মতো উঁচু ধারণা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
তুমি যদি আমাদেরকে বলতে না চাও, তাহলে বলো না, বলল রন।
বেশ, অহংকারি স্বরে বলল হারমিওন, এবং দ্রুত হেঁটে চলে গেল।
ও জানে না, বলল রন, ওর দিকে বিতৃষ্ণা নিয়ে তাকিয়ে ও শুধু চেষ্টা করছে। আমরা যেন আবার ওর সঙ্গে কথা বলি।
***
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা আটটায় হ্যারি, গ্রিফিন্ডর টারওয়ার থেকে ম্যাজিকের ইতিহাস ক্লাসরুমের উদ্দেশ্যে রওনা হল। রুমটা অন্ধকার এবং শূন্য। জাদুর কাঠি দিয়ে সে বাতিগুলো জ্বালল এবং প্রফেসর লুপিন আসার আগে পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করল। প্রফেসরের হাতে একটা বড় প্যাকিং বাক্স। ওটা তিনি রাখলেন প্রফেসর বিন-এর ডেস্কে।
ওটা কী? বলল হ্যারি।
আরেকটি বোগার্ট, বললেন লুপিন, নিজের আলখাল্লাটা খুললেন। মঙ্গলবার থেকে আমি প্রাসাদ চষে বেড়াচ্ছি এবং সৌভাগ্যবশত মিস্টার ফিলচ-এর ফাঁইলিং ক্যাবিনেটের ভেতরে এটাকে পেয়ে গেছি। এটাই হবে ডিমেন্টারদের সবচেয়ে কাছাকাছি দেখতে, এটা দিয়েই তুমি প্রাকটিস করতে পার। যখন ব্যবহার হবে না, আমার অফিসে ওটাকে রেখে দিতে পার; আমার ডেস্কের নিচে একটা কাবার্ড রয়েছে, ওটা ও পছন্দ করে।
বেশ, বলল হ্যারি, গলার স্বর দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করল যেন ও মোটেই হতাশ নয় যে লুপিন প্রকৃত ডিমেন্টারের এরকম একটা ভালো বিকল্প পেয়ে গেছেন।
তাহলে প্রফেসর লুপিন তার নিজের জাদুর কাঠিটা বের করলেন, হ্যারিকেও তারটা বের করতে ইঙ্গিত করলেন। তোমাকে যেটা শেখাতে যাব সেটা খুবই উঁচু মানের ম্যাজিক, হ্যারি–সাধারণ ম্যাজিকতন্ত্রের অনেক উপরে। একে বলা হয় পেট্রোনাস।
এটা কীভাবে কাজ করে? হ্যারিকে নার্ভাস লাগছে।
বেশ, এটা যখন সঠিকভাবে কাজ করে তখন একটা পেট্রোনাস তৈরি করে, বললেন লুপিন, ওটা হচ্ছে এক ধরনের অ্যান্টি–ডিমেন্টার, তোমার এবং ডিমেন্টারের মধ্যে বর্ম হিসেবে কাজ করে।
হঠাৎ হ্যারি নিজেকে যেন দেখল হ্যাগ্রিডের মতো বিশালাকৃতির একজনের পেছনে হাতে একটা বড়সড় গদা। প্রফেসর লুপিন বলে যাচ্ছেন, পেট্রোনাস পজিটিভ শক্তি, যে সমস্ত বিষয় বিনষ্ট করে ডিমেন্টার বেঁচে থাকে তারই বহিঃপ্রকাশ–আশা, আনন্দ, বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা–কিন্তু এর হতাশাজনক কোন বোধ নেই। সেই কারণে ডিমেন্টররা এর ক্ষতি করতে পারে না। তারপরও আমি তোমাকে সতর্ক করে দিচ্ছি হ্যারি, যে এই জাদুটা তোমার জন্য অনেক উচ্চমানের হয়ে যাবে। অনেক উপযুক্ত জাদুকরও এটাকে বেশ কঠিন বলে মনে করে।
পেট্রোনাস দেখতে কেমন? আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল হ্যারি।
যে জাদুকর এটাকে যেরকম তৈরি করে তার জন্য সেটা সেরকম।
এবং আপনি কীভাবে তৈরি করেন?
মন্ত্র উচ্চারণ করে, তখনই কাজ করবে যখন তুমি খুবই আনন্দের একটি একক স্মৃতির উপর তোমার মনটাকে নিবদ্ধ করবে সর্বশক্তি দিয়ে।
একটি আনন্দের মুহূর্তের কথা হ্যারি ভাবার চেষ্টা করল। অবশ্যই, ডার্সলিদের ওখানে ওরকম কিছু ঘটেনি। অবশেষে, প্রথম ব্রুমস্টিক চড়ার মুহূর্তটাকে সে বেছে নিল।
ঠিক আছে, সে বলল, মনে মনে চমৎকার সেই উপরে ওঠার আনন্দটাকে যন্দুর সম্ভব ভাবার চেষ্টা করল।
মন্ত্রোচ্চারণটা হচ্ছে– লুপিন তার গলা পরিষ্কার করলেন, এক্সপেক্টো পেট্রোনাম!
এক্সপেক্টো পেট্রোনাম, দম আটকে পুনরাবৃত্তি করল হ্যারি, এক্সপেক্টো পেট্রোনাম।
তোমার আনন্দ স্মৃতির উপর গভীরভাবে মনোনিবেশ করছ?
ও–হ্যাঁ– বলল হ্যারি দ্রুতই তার স্মৃতিটাকে প্রথম ব্রুমচড়ার ঘটনায় নিয়ে গেল। এক্সপেক্টো পেট্রোনো–না, পেট্রোনাম–দুঃখিত-এক্সপেক্টো পেট্রোনাম, এক্সপেক্টো পেট্রোনাম।
হঠাৎ তার জাদুর কাঠি থেকে কি যেন একটা হুশ করে বেরিয়ে গেল; যেন রূপালী গ্যাসের ঝলক।
ওটা দেখেছেন? উত্তেজিতভাবে বলল হ্যারি। কিছু একটা ঘটল!
খুব ভালো, বললেন লুপিন, মুখে মৃদু হাসি। তাহলে ঠিক আছে ডিমেন্টারের ওপর পরীক্ষা করার ব্যাপারে তৈরি?
হ্যাঁ, হ্যারি বলল, শক্ত করে ধরে আছে ওর জাদুর কাঠিটা, শূন্য ক্লাসরুমটার মাঝে নিয়ে গেল ওটাকে। ও মনটাকে হালকা করার চেষ্টা করছে, কিন্তু কিছু একটা বাধ সাধছে এখন যেকোন মুহূর্তে, তার মাকে আবার শুনতে হবে… কিন্তু ওর তো সেটা ভাবা উচিত নয়, নাকি সে আবার ওর মায়ের আর্তনাদ শুনবে, এবং ও শুনতে চায় না… অথবা চায় কী?
প্যাকিং কেসের ঢাকনাটা টেনে খুললেন লুপিন।
বাক্সের ভেতর থেকে একটা ডিমেন্টার ধীরে ধীরে উঠল, ওটার ঢাকা মুখ হ্যারির দিকে ফেরানো, চকচকে মামড়ি পড়া হাত নিজের পোশাকটাকে খামচে ধরে আছে। ক্লাসরুমের ভেতরের আলোগুলো ফুকারে নিভে গেল। বাক্স থেকে বেরিয়ে নীরবে ডিমেন্টার হ্যারির দিকে অগ্রসর হচ্ছে, লম্বা একটা খনখনে শ্বাস টানল। ওর ওপরে দিয়ে শরীর ভেদ করা ঠাণ্ডার একটা ঢেউ যেন চলে গেল
এক্সপেক্টো পেট্রোনাম! হ্যারি চিৎকার করে উঠল। এক্সপেক্টো পেট্রোনাম! এক্সপেক্টো–
ওর মনে হলো ক্লাসরুম এবং ডিমেন্টার দুটোই যেন গলে যাচ্ছে হ্যারি আবার নিচের দিকে পড়ছে ঘন সাদা কুয়াশার মধ্যে দিয়ে, এবং তার মায়ের স্বর শুনতে পাচ্ছে সে অনেক জোরে, ওর মাথার ভেতরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে না হ্যারিকে নয়! হ্যারি নয়! প্লিজ–যা করতে বল করব।
সরে দাঁড়াও–সরে দাঁড়াও, মেয়ে
হ্যারি!
ধাক্কা খেয়ে যেন বাস্তবে ফিরে এল হ্যারি। ক্লাসরুমের মেঝেতে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে সে। আলোগুলো আবার জ্বলছে জিজ্ঞেস করতে হলো না ওর কি হয়েছে।
দুঃখিত, বিড় বিড় করে বলল, ওঠে বসল, ঠাণ্ডা ঘাম ওর চশমার কাঁচের পেছন থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়ছে।
তুমি ঠিক আছে তো? বললেন লুপিন।
হ্যাঁ একটা ডেস্ক ধরে উঠে দাঁড়ালো সে।
এই নাও– একটা চকলেট ব্যাঙ ওর দিকে বাড়িয়ে ধরলেন লুপিন। আবার শুরু করার আগে এটা খেয়ে নাও। প্রথম বারেই সফল হবে আমি এটা আশা করিনি। বস্তুত, তুমি যদি পারতে তাতে বরং আমি হতবাক হতাম।
অবস্থাটা আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছে, হ্যারি বিড় বিড় করে বলল, চকলেটের মাথাটা কামড়ে নিল। এখন আমি আমার মায়ের কথা আরো জোরে শুনতে পেয়েছি এবং তাকেও–ভন্ডেমর্ট।
লুপিনকে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে।
হ্যারি, তুমি যদি আর না করতে চাও, আমি ব্যাপারটা অবশ্যই বুঝতে পারব।
আমি করব! ক্ষিপ্তভাবে বলল হ্যারি, চকলেট ব্যাঙয়ের বাকিটা মুখের ভেতর ঠেসে দিল। আমাকে পারতেই হবে! ডিমেন্টাররা যদি র্যাভেনক্লাদের বিরুদ্ধে আমাদের ম্যাচের সময় আবার হাজির হয় তাহলে কী হবে? আবার উপর থেকে পড়ে যাব, এটা আমার পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব নয়। এ খেলাটা যদি হ্যারি তাহলে আমরা কুইডিচ কাপও হারাবো।
ঠিক আছে তাহলে বললেন লুপিন। তুমি হয়তো আরেকটি স্মৃতি ভেবে নিতে পার, একটা খুবই সুখের স্মৃতি, মানে, মনোনিবেশ করার জন্য আগেরটা মনে হচ্ছে খুব শক্তিশালী ছিল না…।
গভীরভাবে চিন্তা করছে হ্যারি এবং ভেবে পেল গত বছর গ্রিফিন্ডর হাউজ যখন চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল সেই স্মৃতিটা খুবই আনন্দের। সে আবার তার জাদুর কাঠিটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরল এবং ক্লাসরুমের মাঝখানে অবস্থান নিল।
রেডি? বললেন লুপিন, এক হাতে বাক্সের ঢাকনাটা ধরে আছেন।
রেডি, বলল হ্যারি, আপ্রাণ চেষ্টা করছে গ্রিফিন্ডারের জেতার স্মৃতিটা মনের মধ্যে আনতে। এবং বাক্সটা খুললে যে কি হবে সেটা মন থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে।
গো! বললেন লুপিন, সঙ্গে সঙ্গে বাক্সের মুখটা খুলে দিলেন। রুমটা আবার বরফের মতো ঠাণ্ডা এবং অন্ধকার হয়ে গেল। ডিমেন্টার আস্তে আস্তে সামনের দিকে আসছে, খনখনে শ্বাস টানছে; পঁচনধরা একটা হাত বাড়িয়ে দিয়েছে হ্যারির দিকে।
এক্সপেক্টো পেট্রোনাম! হ্যারি চিৎকার করল। এক্সপেক্টো পেট্রোনাম! এক্সপেক্টা পেট–
সাদা কুয়াশা ওর বোধশক্তিকে আচ্ছন্ন করে ফেলল… বিশাল, অস্পষ্ট আকৃতি তার চারদিকে ঘুরছে… তারপর একটা নতুন স্বর শোনা গেল, একজন পুরুষের কণ্ঠস্বর, চিৎকার করছে, ভয়ার্ত চিৎকার
লিলি, হ্যারিকে নিয়ে পালাও! ও এসে গেছে! যাও! দৌড়াও! আমি ওকে আঁটকে রাখছি।
রুমে হোঁচট খাওয়া একটা শব্দ–সশব্দে একটা দরজা খুলে গেল জোরে–তীক্ষ্ণ অট্টহাস্য
হ্যারি! হ্যারি… জেগে ওঠ…।
হ্যারির মুখে লুপিন জোরে জোরে আঘাত করছিল। হ্যারি কেন ক্লাসরুমের ধুলোর মধ্যে পড়ে আছে এবার সে সেটা মিনিটখানেক আগেই বুঝতে পেরেছে।
আমি আমার বাবার কথা শুনতে পেলাম, বলল হ্যারি। এই প্রথমবার আমি ওঁর কথা শুনেছি–ওঁ নিজেই ভন্ডেমর্টকে মোকাবিলা করতে চেয়েছিলেন, যেন মাকে সময় দিতে চেয়েছিলেন দৌড়ানোর…।
হঠাৎ হ্যারির মনে হল ওর মুখে ঘামের সঙ্গে মিশেছে ওর চোখের জল। মুখটার নিচের দিকে নামিয়ে কাপড় দিয়ে মুছে ফেলল, ভান করল যেন জুতোর ফিতা ঠিক করছে, লুপিন যেন দেখতে না পান।
তুমি জেমস-এর কথা শুনেছো? অদ্ভুত স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন লুপিন।
হ্যা… শুকনো মুখে উঠে দাঁড়ালো হ্যারি। কেন–আপনি তো বাবাকে জানতেন না, জানতেন?
আমি–আমি জানতাম, সত্যি কথা হচ্ছে, বললেন লুপিন। হোগার্টস-এ আমরা বন্ধু ছিলাম। শোন হ্যারি–আজকের মতো এ পর্যন্তই থাক। এই জাদুটা অসম্ভব রকমের উন্নত আমার উচিত হয়নি এর জন্য তোমাকে বলা
না! বলল হ্যারি। সে আবার উঠে দাঁড়ালো। আরেকবার চেষ্টা করব, হয়তো আমি যথেষ্ট আনন্দের বিষয়ে ভাবছি না, সে কারণেই দাঁড়ান
মাথার ভেতরে ঝড়ের গতিতে চিন্তা করছে সে। একটা সত্যিকারের আনন্দের স্মৃতি যেটা একটা শক্তিশালী পেট্রোনাসে রূপান্তরিত হতে পারে।
যে মুহূর্তে সে জানতে পেরেছিল যে সে একজন জাদুকর, এবং ডার্সলিদের ছেড়ে হোগার্টস-এ যাবে! যদি এটা আনন্দের মুহূর্ত না হয়, তাহলে সে জানে না কোনটা আনন্দের মনে মনে সে গভীরভাবে ভাবতে চেষ্টা করল প্রিভেট ড্রাইভ ছেড়ে যাবে এটা যখন সে বুঝতে পারল সেই মুহূর্তের আনন্দটা, হ্যারি উঠে দাঁড়াল আবার প্যাকিং বাক্সটার মুখোমুখি দাঁড়াল।
রেডি? বললেন লুপিন, ওকে দেখে মনে হচ্ছে কাজটা তিনি করছেন নিজের বিবেকের বিরুদ্ধে। গভীরভাবে মনোনিবেশ করছ? ঠিক আছে–গো!
তৃতীয়বারের মতো বাক্সটার ঢাকনা খুললেন, ওটার ভেতর থেকে আবার ডিমেন্টার বেরিয়ে এল; ঘরটা ঠাণ্ডা এবং অন্ধকার হয়ে গেল
এক্সপেক্টো পেট্রোনাম! হ্যারি চিৎকার করল। এক্সপেক্টো পেট্রোনাম! এক্সপেক্টো পেট্রেনাম!
হ্যারির মাথার ভেতরে আবার চিৎকার শুরু হয়ে গেছে–ব্যতিক্রম হচ্ছে যে এবার মনে হলো শব্দটা আসছে একটা খারাপভাবে স্টেশন ধরা রেডিও থেকে। আস্তে এবং জোরে এবং আবার আস্তে এবং এখনও সে ডিমেন্টারটাকে দেখতে পাচ্ছে ওটা থেমে গেছে এবং তারপর হ্যারির জাদুর কাঠির মাথা থেকে একটা তীব্র রূপালী ছায়া বিস্ফোরণের মতো বেরিয়ে এলো, দাঁড়াল ওর আর ডিমেন্টারের মাঝখানে, যদিও হ্যারির মনে হচ্ছিল ওর পাগুলো ওকে আর দাঁড় করিয়ে রাখতে পারছে না, পানির মতো তরল হয়ে গেছে সে, তবুও ও দাঁড়িয়ে ছিল
অবশ্য কতক্ষণের জন্য ও নিজেও নিশ্চিত ছিল না।
রিড্ডিকুলাস! গর্জন করে উঠলেন লুপিন সামনের দিকে লাফিয়ে উঠে।
বড়সড় একটা বজ্রপাতের শব্দ শোনা গেল, এবং হ্যারির ঝাঁপসা পেট্রোনাস এবং ডিমেন্টার দুটোই অদৃশ্য হয়ে গেল; ও একটা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল, পা কাঁপছে, ক্লান্ত যেন মাইলখানেক দৌড়ে এসেছে। চোখের কোণা দিয়ে দেখতে পেল প্রফেসর লুপিন বোগার্টটাকে জোর করে প্যাকিং বাক্সের ভেতরে ঢোকাচ্ছে জাদুর কাঠির সাহায্যে; ওটা আবার রূপালী হয়ে গেছে।
অপূর্ব! বললেন লুপিন, হেঁটে গেলেন হ্যারি যেখানে বসেছিল সেখানে। অপূর্ব, হ্যারি! শুরুটা চমৎকার হয়েছে!
আমরা কী আরেকবার চেষ্টা করতে পারি? শুধু একবার?
এখন না, দৃঢ়ভাবে বললেন লুপিন। এক রাতের জন্য যথেষ্ট হয়েছে। এই যে
হ্যারির দিকে হানিডিউকস-এর সবচেয়ে ভালো চকলেট এগিয়ে দিলেন।
পুরোটা খেয়ে ফেল। না হয়, মাদাম পমফ্রে আমার পেছনে লাগবে। আগামী সপ্তাহে একই সময়ে?
ঠিক আছে, বলল হ্যারি। চকলেটটায় একটা কামড় বসালো, দেখল বাতি নেভাচ্ছেন লুপিন। হঠাৎ ওর মাথায় একটা চিন্তা এল।
প্রফেসর লুপিন? ও বলল। আপনি যদি আমার বাবাকে জানতেন তাহলে নিশ্চয়ই সাইরিয়াস ব্ল্যাককেও জানেন।
চট করে ঘুরে দাঁড়ালেন লুপিন।
এ ধারণা তোমার হলো কোত্থেকে? তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন তিনি।
না মানে–আমি বলতে চাচ্ছিলাম এই মাত্র আমি শুনেছি যে ওরা দুজনে হোগার্টস-এই ভালো বন্ধু ছিলেন…।
লুপিনের চেহারা স্বাভাবিক হলো।
হ্যাঁ, আমি ওকে জানতাম, সংক্ষেপে বললেন তিনি। অথবা আমি ভেবেছিলাম আমি তাকে জানতাম। আমার মনে হয় তোমার তাড়াতাড়ি যাওয়া উচিত, দেরি হয়ে যাচ্ছে। হ্যারি ক্লাসরুম ছেড়ে বেরিয়ে করিডোর দিয়ে কিছুদূর হেঁটে একটা কোণ ঘুরে একটা বর্মের পেছনে বসে ওর চকলেটটা শেষ করতে লাগল। এখন সে ভাবছে লুপিনকে ব্ল্যাক-এর কথা না বললেই ভালো হতো, বোঝাই যাচ্ছে এ ব্যাপারে তিনি খুব আগ্রহী নন। তারপর হ্যারির চিন্তা আবার ঘুরতে লাগল ওর মা-বাবাকে কেন্দ্র করে…।
ভেতরটা একেবারে খালি হয়ে গেছে, এরকমই বোধ হচ্ছে হ্যারির। নিজের মনের ভেতরে নিজের বাবা-মায়ের জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো আবার শুনতে পাওয়া, এ এক সাংঘাতিক অভিজ্ঞতা, এবং শুধু এই ধরনের সময়েই সে ওঁদের কথা শুনতে পায় কারণ সেই সময় সে ছিল শিশু। কিন্তু সে যদি আবার তার বাবা-মার কথা শুনতে চায় তাহলে সঠিক পেট্রোনাস তৈরি করতে পারবে না
ওরা মারা গেছেন, সে শক্তভাবে নিজেকে বলল। ওরা মারা গেছেন, এবং ওদের কথার প্রতিধ্বনি শুনলেই ওরা আর ফিরে আসবেন না। নিজের উপরে তোমার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে যদি তুমি কুইডিচ কাপটা চাও।
উঠে দাঁড়িয়ে চকলেটের শেষ অংশটুকু মুখের ভেতরে পুরে গ্রিফিন্ডর টাওয়ারের দিকে রওনা হলো হ্যারি।
***
টার্ম শুরু হওয়ার এক সপ্তাহ পরে স্লিথারিন আর র্যাভেনক্লর খেলা হলো। কোনমতে জিতল স্লিথারিন। উডের মতো গ্রিফিন্ডরের জন্যে এটা সুখবর, র্যাভেনক্লকে হারাতে পারলে ওরা দ্বিতীয় স্থানে থাকতে পারবে। সেই কারণে সে সপ্তাহে পাঁচটা প্রাকটিসের ব্যবস্থা করা হলো। তার মানে হচ্ছে এর সঙ্গে লুপিনের অ্যান্টি–ডিমেন্টার ক্লাস যুক্ত হলে, হোমওয়ার্ক করার জন্য হ্যারি সপ্তাহে একটি মাত্র রাত পাচ্ছে। তারপরও হারমিওনের মতো তার অবস্থা হয়নি। মনে হচ্ছে পড়ার বোঝা অবশেষে হারমিওনের উপরও চেপে বসেছে। প্রতি রাতে ওকে দেখা যায় কমনরুমের কোণায় কয়েকটা টেবিল জুড়ে বই ছড়ানো, কারো সঙ্গে কথা বলছে না, এবং কেউ কথা বললে বিরক্ত হচ্ছে।
ও কেমন করে পারছে? এক সন্ধ্যায় হ্যারিকে জিজ্ঞাসা করল রন। হ্যারি তখন স্নেইপের জন্য একটা রচনা লেখা শেষ করেছে। চোখ তুলে তাকাল হ্যারি, বইয়ের স্তূপের আড়ালে হারমিওনকে দেখাই যাচ্ছে না প্রায়।
কি পারছে?
ওর সব ক্লাসের! রন বলল। আমি ওকে প্রফেসর ভেক্টর-এর সঙ্গে কথা বলতে শুনেছি আজ সকালে, উনি অংকের শিক্ষক। গতকালের ক্লাস করা নিয়ে ওরা কথা বলছিল, কিন্তু হারমিওন তো ওখানে থাকতে পারে না, কারণ ওতো আমাদের সঙ্গে কেয়ার অফ ম্যাজিকেল ক্রিয়েচার ক্লাসে ছিল! এবং আর্নি ম্যাকমিলান আমাকে বলেছে ও কখনও মাগল স্ট্যাডিজ বিষয়ে ক্লাসে অনুপস্থিত থাকেনি, কিন্তু এর অর্ধেকগুলো হয় তখন যখন ডিভাইনেশন ক্লাস হয়, এবং ওগুলোতেও সে অনুপস্থিত থাকে না!
কিন্তু হারমিওনের অসম্ভব সময়সূচির রহস্য ভেদ করার সময় তখন হ্যারির হাতে ছিল না; তাকে স্নেইপের রচনাটা শেষ করতে হবে। একটু পরেই আবার বাধা পড়ল, এবার উড।
খারাপ খবর। আমি এই মাত্র ফায়ারবোল্ট নিয়ে প্রফেসর ম্যাকগোনাগল-এর সঙ্গে কথা বলে এসেছি। তিনি মানে–আমাকে একটু বকেই দিয়েছেন। বলেছেন ভুল জায়গায় আমি জোর দিচ্ছি। মনে হচ্ছে উনি ভাবছেন আমি তোমার বেঁচে থাকার চেয়ে খেলাটা জেতার ব্যাপারে বেশি আগ্রহী। এ কারণে যে, আমি ওঁকে বলেছি যে ব্রুমটা তোমাকে ফেলে দিলেও আমার কিছু আসে যায় না যদি তুমি প্রথমে মিচটা ধরতে পার। অবিশ্বাসে মাথা নাড়ল উড। সত্যি বলতে কি, উনি যেভাবে আমার দিকে চিৎকার করছিলেন তুমি হলে ভাবতে আমি নিশ্চয়ই ভয়ানক কিছু বলেছি। তারপর আমি জিজ্ঞাসা করলাম আর কতদিন ওটাকে আটকে রাখা হবে এবার উড প্রফেসর ম্যাকগোনাগলের কণ্ঠস্বর নকল করে বলল, যতদিন প্রয়োজন, উড আমার মনে হয় হ্যারি, আরেকটা নতুন ব্রুমের জন্য তোমাকে অর্ডার দিতে হবে। তুমি একটা নিম্বাস ২০০১ পেতে পার, ম্যালফয়ের মতো।
ম্যালফয় যেটাকে ভালো মনে করে সেরকম কিছু আমি কিনব না। সোজাসাপ্টা জবাব দিল হ্যারি।
***
জানুয়ারির পর ফেব্রুয়ারি এল, কিন্তু প্রবল শীতের কোন পরিবর্তন নেই। ব্ল্যাভেনক্ল-এর বিরুদ্ধে খেলাটা ক্রমেই কাছে চলে আসছে, কিন্তু এখনও হ্যারি নতুন ব্রুম-এর অর্ডার দেয়নি। সে ট্রান্সফিগিউরেশন ক্লাসের পর প্রফেসর ম্যাকগোনাগলকে ফায়ারবোল্টের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইছে, রন দাঁড়িয়ে আছে ওর পেছনে, মুখ ঘুরিয়ে হারমিওন দ্রুত চলে গেল।
না, পটার, এখনও তুমি ওটা ফেরত পেতে পার না, বললেন প্রফেসর। আমরা সাধারণ অভিশাপগুলোর ব্যাপারে ওটা পরীক্ষা করেছি, কিন্তু প্রফেসর ফ্লিটউইক বিশ্বাস করেন ওর মধ্যে হারলিং হেক্স রয়েছে। ওটা পরীক্ষা করে দেখার পর আমি তোমাকে বলব। এখন প্লিজ আমাকে বিরক্ত করো না।
আরও খারাপ হলো যে, অ্যান্টি–ডিমেন্টার ক্লাসগুলো যেরকম আশা করেছিল হ্যারি সেরকম হচ্ছে না। কয়েকটি প্রাকটিস হয়ে গেছে কিন্তু সে একটা অস্পষ্ট রূপালী ছায়ার মতো তৈরি করতে পারছে শুধু, কিন্তু তার তৈরি পেট্রোনাস ডিমেন্টারকে তাড়িয়ে দেয়ার পক্ষে খুবই দুর্বল। ওটা যা করতে পারে তা হচ্ছে লাফিয়ে পড়তে পারে ওদের মাঝখানে, আবছা মেঘের মতো। এবং হ্যারির ভেতর থেকে সব শক্তি বের করে নিয়ে, কারণ ওটাকে ওইখানে রাখতে শক্তি প্রয়োগ করতে হয়। নিজের উপরে নিজেরই রাগ হলো হ্যারির, নিজেকে দোষী মনে হলো, কারণ ও আবারও গোপনে নিজের বাবা-মায়ের কথা শোনার আকাক্ষা পোষণ করছে।
তুমি নিজের কাছে খুব বেশি প্রত্যাশা করছ, চতুর্থ সপ্তাহের প্রাকটিসের সময় কঠিন স্বরে বললেন প্রফেসর লুপিন। তের বছরের একজন জাদুকরের পক্ষে অস্পষ্ট একটা পেট্রোনাস তৈরি করাও বিরাট অর্জন। আর তো তুমি অজ্ঞান হচ্ছো না তাই না?
আমি ভেবেছিলাম ডিমেন্টারকে তাড়া বা ওইরকম কিছু করবে পেট্রোনাস, হতাশ সুরে বলল হ্যারি। ওদেরকে অদৃশ্য করে ফেলবে।
সত্যিকারের পেট্রোনাস সেটা করে বৈকি, বললেন লুপিন। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে তুমি অনেক কিছু শিখেছো। যদি তোমার পরবর্তী কুইডিচ ম্যাচে ডিমেন্টাররা আসে, তাহলে মাটিতে নামা পর্যন্ত তুমি তাদেরকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে।
কিন্তু আপনি বলেছেন যদি ওরা সংখ্যায় বেশি হয় তাহলে তো ব্যাপারটা আরো কঠিন হয়। বলল হ্যারি।
তোমার উপরে আমার সম্পূর্ণ আস্থা আছে, বললেন লুপিন হেসে। এই নাও-এটা তুমি অর্জন করেছে। থ্রি ব্রুমস্টিক থেকে একটা ড্রিঙ্ক, এটা নিশ্চয়ই। আগেও খাওনি।
নিজের ব্রিফকেস থেকে দুটো বোতল বের করলেন লুপিন।
বাটার বিয়ার! চিন্তা না করেই বলল হ্যারি। আমার খুবই পছন্দ!
লুপিনের চোখ বড় হয়ে গেল।
ওহ্, রন আর হারমিওন হাসমিড থেকে নিয়ে এসেছিল, দ্রুত মিথ্যা কথাটা বলল হ্যারি।
তাই, বললেন লুপিন, যদিও তাকে তখনও একটুও সন্দেহ করছেন বলে মনে হলো। বেশ–র্যাভেনক্লর বিরুদ্ধে গ্রিফিন্ডরের বিজয়ে চলো আমরা পান করি! অবশ্য শিক্ষক হিসেবে আমার কোন পক্ষেই থাকা উচিত নয়…দ্রুত যোগ করলেন তিনি।
নীরবে বাটার বিয়ার পান করল ওরা দুজনে। অনেক দিন ধরে হ্যারির মনের ভেতরে যে প্রশ্নটা ছিল এবার সেটা সে করল।
ডিমেন্টারের মুখের আবরণের নিচে কী আছে?
চিন্তিত মুখে বোতলটা নামিয়ে রাখলেন প্রফেসর।
হুমম… যারা জানে এবং আমাদেরকে বলতে পারে, তারা এটা বলার অবস্থায় নেই। ডিমেন্টাররা তাদের মুখের আবরণ তখনই সরায় যখন ওরা ওদের সর্বশেষ অস্ত্র প্রয়োগ করে।
এবং সেটা কী?
ওরা এটাকে বলে ডিমেন্টারস কিস, বললেন লুপিন, মুখে বাঁকা হাসি। যখন ওরা কাউকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করতে চায় তখনই এই অস্ত্র প্রয়োগ করে। আমার ধারণা আবরণের নিচে এক ধরনের মুখ আছে, কারণ ওদের শিকারের মুখের উপরে চোয়াল আটকে ভেতর থেকে আত্মাটা শুষে নেয় ওরা।
হঠাৎ করে কিছুটা বাটার বিয়ার মুখ থেকে ফেলে দিল হ্যারি।
কী–ওরা হত্যা করে?
ওহ, না, বললেন লুপিন। তার চেয়েও খারাপ। তোমার মস্তিষ্ক এবং হৃৎপিণ্ড যদি থাকে তবুও তুমি আত্মা ছাড়া বাঁচতে পারবে। কিন্তু তোমার নিজের সম্পর্কে কোন বোধ থাকবে না, কোন স্মৃতি থাকবে না, কোন … কিছুই থাকবে না। এরপর আরগ্যের আর কোন পথ থাকে না। তুমি শুধু–থাকবে। যেন একটা শূন্য খোসা। এবং তোমার আত্মা চিরদিনের জন্য… হারিয়ে গেছে।
আরও একটু বাটার বিয়ার পান করে, লুপিন বললেন, ভাগ্য সাইরিয়াস ব্ল্যাকের জন্য অপেক্ষা করছে। আজ সকালের ডেইলি প্রফেট-এ রয়েছে। মন্ত্রণালয় ডিমেন্টারকে এটা করবার জন্য অনুমতি দিয়েছে যদি ওরা ব্ল্যাককে ধরতে পারে।
বিস্ময়ে হতবাক হ্যারি বসে থাকল কয়েক মুহূর্ত নিশ্চল। কারও মুখ দিয়ে তার আত্মাটাকে শুষে বের করা হচ্ছে এটা সে ভাবতেই পারে না। কিন্তু তারপর সে ভাবল ব্ল্যাকের কথা।
তার এটা পাওনা, হঠাৎ বলল সে।
তুমি সেরকমই মনে কর? হাল্কাভাবে বললেন লুপিন। তুমি কী সত্যিই মনে কর যে এটা কারও পাওনা হতে পারে?
হ্যাঁ, উদ্ধতভাবে বলল হ্যারি। কারণ… কোন কোন জিনিসের জন্য…।
থ্রি ব্রুমস্টিক-এর ব্ল্যাক সম্পর্কে যে আলোচনা ও শুনে ফেলেছিল গোপনে, তার এখন ইচ্ছা করছে লুপিনকে সেটা বলতে। তার বাবা-মার সঙ্গে ব্ল্যাকের সেই বিশ্বাসঘাতকতার কথা। কিন্তু এটা বললে সে যে অনুমতি ছাড়া হগসমিডে গিয়েছিল সেটা প্রকাশ পেয়ে যাবে। এবং সে এও জানে তাতে লুপিন খুব খুশি হবেন না। সে বাটার বিয়ারটা শেষ করল, লুপিনকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে গেল।
হ্যারির এখন মনে হচ্ছে ডিমেন্টারদের মুখের আবরণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা না করলেই ভালো হতো। জবাবটা এত ভয়াবহ এবং এরপর থেকে তার মাথায় এমন অপ্রীতিকর চিন্তা আসতে লাগল যে ভেতর থেকে আত্মা শুষে বের করে নিলে কেমন লাগে। ভাবতে ভাবতে সোজা গিয়ে প্রফেসর ম্যাকগোনাগল-এর সঙ্গে ধাক্কা খেল।
খেয়াল করে চল, পটার!
দুঃখিত প্রফেসর
এইমাত্র আমি তোমাকে কমনরুমে খুঁজে এলাম। আমরা ফায়ারবোল্টকে ভালো করে পরীক্ষা করে দেখেছি, ওতে খারাপ কিছু নেই, কোথাও তোমার একজন ভালো বন্ধু আছে, পটার…।
হ্যারির মুখ হা হয়ে গেল। প্রফেসরের হাতে ওর ফায়ারবোল্টটা, এবং ওটাকে সবসময়ের মতোই সুন্দর দেখাচ্ছে।
আমি ওটা ফিরে পাব? দুর্বল স্বরে হ্যারি বলল। সত্যিই?
সত্যি, প্রফেসর ম্যাকগোনাগল বললেন, হাসছেন তিনি। শনিবারের খেলার আগেই এটাকে ভালো করে রপ্ত করতে হবে, পারবে না? এবং পটার–জেতার চেষ্টা করবে, করবে না? না হলে আটবারের মতো আমরা টুর্নামেন্ট থেকে বাদ পড়ে যাব এবং একথাটাই গত রাতে প্রফেসর স্নেইপ আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছে…।
হ্যারির মুখে কথা নেই। ফায়ারবোল্টটা হাতে নিয়ে গ্রিফিন্ডর টাওয়ারে উঠে যেতে লাগল। দেখল দৌড়ে আসছে রন এ কান থেকে ও কান ছড়িয়ে গেছে ওর হাসি।
তোমাকে ফেরত দিয়েছে ওটা? চমৎকার! শোন, কালকে আমি কি একবার ওতে চড়তে পারি?
হ্যা যা খুশি বলল হ্যারি কয়েক মাসের মধ্যে তার মন এত খুশি হয়নি। তোমার কি মনে হয় না–হারমিওনের সঙ্গে আমাদের মিটমাট করে ফেলা উচিত। সে আমাদেরকে সাহায্যই করতে চেয়েছিল
হ্যাঁ, ঠিক আছে, বলল রন। ও এখন কমনরুমে কাজ করছে।
গ্রিফিন্ডর টাওয়ারের করিডোরে ওদের নেভিল লংবটম-এর সঙ্গে দেখা হল। স্যার ক্যাডোগান-এর কাছে কাকুতি মিনতি করছে সে, কিন্তু তাকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না।
আমি ওইগুলো লিখে রেখেছিলাম, চোখে পানি নিয়ে বলল নেভিল, কিন্তু মনে হয় কোথাও পড়ে গেছে!
একরকম গল্পই সবাই বলে! গর্জন করে উঠলেন স্যার ক্যাডোগান। তারপর, হ্যারি আর রনকে দেখে বললেন, শুভ সন্ধ্যা, এসো এই শেকলে বাঁধা মাছরাঙা জাতীয় পাখিটার উদ্দেশ্যে তালি বাজাও, ও জোর করে চেম্বারে ঢুকতে চাচ্ছিল!
ওহ চুপ করো, রন বলল, সে, হ্যারি দাঁড়াল নেভিলের পাশাপাশি।
আমি পাসওয়ার্ডগুলো হারিয়ে ফেলেছি! নেভিল ওদেরকে বলল কাতরভাবে। ওর কাছ থেকেই আমি পাসওয়ার্ডগুলো পেয়েছিলাম কিন্তু এখন যে কোথায় ফেলেছি মনে করতে পারছি না।
অডডসভোডিকিনস, বলল হ্যারি, স্যার ক্যাডোগানকে খুবই হতাশ মনে হলো এবং অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছবিটা ঘুরিয়ে ওদেরকে কমনরুমে যেতে দিলেন। পরমুহূর্তে আকস্মিক উত্তেজনা দেখা গেল কমনরুমে, সবগুলো মাথা ঘুরে গেল হ্যারির দিকে, সবাই ঘিরে ধরেছে ওকে, ফায়ারবোল্টের প্রশংসায়।
এটা কোথায় পেলে?
আমি কী একবার চড়তে পারি?
তুমি কী কখনও চড়েছো?
র্যাভেনক্লরা পাত্তাই পাবে না। তাদের রয়েছে ক্লিনসুইপ সেভেন্স!
আমি কী শুধু একবার ধরতে পারি, হ্যারি?
এভাবে চলল দশ মিনিট। হাতে হাতে ঘুরলো ফায়ারবোল্ট। প্রশংসা করল সবাই, যার যার জায়গায় সবাই ফিরে গেল। তখন হ্যারি আর রন দেখতে পেল হারমিওন, একমাত্র সেই দৌড়ে তাদের কাছে আসেনি, ঝুঁকে পড়ে কাজ করছে সে। ওদের চোখ এড়িয়ে। হ্যারি আর রন ওর টেবিলে এগিয়ে গেল, মুখ তুলে তাকাল হারমিওন।
আমি এটা ফ্রি পেয়েছি, বলল হ্যারি, হেসে ফায়ারবোল্টটা দেখিয়ে।
দেখেছো হারমিওন? এতে খারাপ কিছু ছিল না! বলল রন।
বেশ–হতে পারে! বলল হারমিওন। আমি বোঝাতে চাচ্ছি অন্তত পক্ষে এখন তোমরা নিরাপদ!
হ্যাঁ, তাই মনে হয়, বলল হ্যারি। আমি এটা উপরতলায় রেখে আসি।
আমিই নিয়ে যাই! আগ্রহের সঙ্গে বলল রন। স্ক্যাবাসকে ইঁদুরের টনিক খাওয়াতে হবে।
ও ফায়ারবোল্টটা নিল, এমনভাবে ধরল যেন ওটা কাঁচের তৈরি, ছেলেদের হোস্টেলের দিকে নিয়ে গেল।
আমি এখানে বসতে পারি? হারমিওনকে জিজ্ঞাসা করল হ্যারি।
আমার মনে হয় পার, বলল হারমিওন চেয়ার থেকে পার্চমেন্টের একটা স্তূপ সরিয়ে।
আগোছালো টেবিলটার দিকে তাকাল হ্যারি, দীর্ঘ অ্যারিথম্যান্সি রচনাটির গা থেকে এখনও কালি শুকায়নি। আর দীর্ঘ মাগল স্ট্যাডিজ রচনা এবং রুনে অনুবাদ সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে টেবিলের উপরে।
এত কিছু পড়বে কীভাবে? হ্যারি ওকে জিজ্ঞাসা করল।
ওহ, মানে, তুমি তো বুঝতেই পারছো–অনেক খাটতে হচ্ছে, বলল হারমিওন। একেবারে কাছে থেকে হ্যারি দেখল ওকে প্রফেসর লুপিনের মতো ক্লান্ত দেখাচ্ছে।
কয়েকটি সাবজেক্ট ছেড়ে দাও না কেন? হ্যারি জিজ্ঞাসা করল। সেটা আমি করতে পারব না! বলল হারমিওন, মর্মাহত হয়েছে সে।
অ্যারিথম্যান্সি একটা ভয়াবহ সাবজেক্ট, জটিল একটা সংখ্যা চার্ট তুলে নিয়ে বলল হ্যারি।
ওহ, না, এটা চমৎকার সাবজেক্ট! গুরুত্বের সঙ্গে বলল হারমিওন। এটা আমার প্রিয় সাবজেক্ট! এটা।
কিন্তু এই সাবজেক্টে যে চমৎকারটা কি হ্যারি কখনও বুঝতে পারেনি। এবং ঠিক সেই মুহূর্তে একটা চাপা চিৎকার ছেলেদের হোস্টেলের সিঁড়ি থেকে শোনা গেল। পুরো কমনরুম নীরব হয়ে গেল। তাকিয়ে আছে, যেন সবাই পাথর, খোলা দরজার দিকে। দ্রুত ছুটে আসা পায়ের আওয়াজ শোনা গেল, যত কাছে আসছে আওয়াজ তত বাড়ছে। এরপর দেখা গেল লাফাতে লাফাতে ছুটে আসছে রন একটা বিছানার চাদর টেনে নিয়ে।
দেখ! সে চিৎকার করল, ছুটে গেল হারমিওনের টেবিলের কাছে। দেখ! ওর মুখের ওপরে চাদরটা নাড়তে নাড়তে চিৎকার করল রন।
রন, কী–?।
স্ক্যাবার্স! দেখ! স্ক্যাবার্স!
রনের কাছ থেকে দূরে সরে গেল হারমিওন, ওকে হতভম্ব দেখাচ্ছে। রনের হাতের বেডশিটটা দেখল হ্যারি। ওর মধ্যে লাল যেন একটা দাগ আছে। একটা কিছু যেটা ভয়াবহভাবে
রক্ত পাথরের নিস্তব্ধতার মধ্যে চিৎকার করল রন।
সে নেই! এবং তোমরা জান মেঝেতে কী পড়েছিল?
–না, কাঁপা স্বরে বলল হারমিওন।
হারমিওনের রুনে অনুবাদের উপর কিছু একটা ছুঁড়ে মারল রন। হারমিওন এবং হ্যারি অঁকে ওটা তুলে নিল রহস্যময় সূচালো ডগাওয়ালা আকৃতির উপর পড়েছিল লম্বা হালকা লালচে হলুদ রঙের বিড়ালের কতগুলো লোম।