বেতাল কহিল, মহারাজ!
চূড়াপুরে, দেবস্বামী নামে, এক ব্ৰাহ্মণ বাস করিতেন। তিনি রূপে রতিপতি, বিদ্যায় বৃহস্পতি, সম্পদে ধনপতি ছিলেন। কিয়ৎ দিন পরে, দেবস্বামী, লাবণ্যবতী নামে, এক গুণবতী ব্ৰাহ্মণতনয়ার পাণিগ্রহণ করিলেন। ঐ কন্যা রূপলাবণ্যে ভুবনবিখ্যাত ছিল। উভয়ে প্ৰণয়ে কালব্যাপন করিতে লাগিলেন।
একদা বিপ্রদম্পতী, গ্রীষ্মের প্রাদুর্ভাবপ্রযুক্ত, অট্টালিকার উপরিভাগে শয়ন করিয়া, নিদ্রা যাইতেছিলেন। সেই সময়ে, এক গন্ধৰ্ব, বিমানে আরোহণপূর্বক, আকাশপথে ভ্ৰমণ করিতেছিল। দৈবযোগে, বিপ্রকামিনীর উপর দৃষ্টিপাত হওয়াতে, সে তদীয় অলৌকিক রূপলাবণ্যদর্শনে মোহিত হইল; এবং, বিমান কিঞ্চিৎ অবতীর্ণ করিয়া, নিদ্রান্বিতা লাবণ্যবতীকে লইয়া পলায়ন করিল।
কিয়ৎ ক্ষণ বিলম্বে নিদ্রাভঙ্গ হইলে, দেবস্বামী, স্বীয় প্রেসয়ীকে পার্শ্বশায়িনী না দেখিয়া, অত্যন্ত ব্যাকুল হইয়া, ইতস্ততঃ অন্বেষণ করিতে লাগিলেন; কিন্তু কোনও সন্ধান না পাইয়া, সাতিশয় বিষন্ন ভাবে, নিশাযাপন করিলেন। পর দিন, প্ৰভাত হইবামাত্র, তিনি, অতিমাত্র ব্যগ্র ও চিন্তাকুল চিত্তে, পুনরায়, বিশেষ করিয়া, অশেষপ্রকার অনুসন্ধান করিলেন; পরিশেষে, নিতান্ত নিরাশ্বাস ও উন্মত্তপ্রায় হইয়া, সংসারাশ্রমে বিসর্জন দিয়া, সন্ন্যাসীর বেশে দেশে দেশে ভ্ৰমণ করিতে লাগিলেন।
এক দিন, দেবস্বামী, দিবা দ্বিপ্রহরের সময়, অতিশয় ক্ষুধার্ত হইয়া, এক ব্ৰাহ্মণের আলয়ে অতিথি হইলেন; কহিলেন, আমি ক্ষুধায় অত্যন্ত কাতর হইয়াছি; কিছু ভোজনীয় দ্রব্য দিয়া, আমার প্রাণরক্ষা কর। গৃহস্থ ব্ৰাহ্মণ, তৎক্ষণাৎ এক পাত্ৰ দুগ্ধে পরিপূর্ণ করিয়া, অতিথি ব্ৰাহ্মণের হস্তে অৰ্পণ করিলেন। গ্রহবৈগুণ্যবশতঃ, ইতঃপূর্বে, এক কৃষ্ণসৰ্প ঐ দুগ্ধে মুখাৰ্পণ করাতে, তাহা অতিশয় বিষাক্ত হইয়াছিল। পান করিবামাত্র, সেই বিষ, সৰ্বাঙ্গব্যাপী হইয়া, অতিথি ব্ৰাহ্মণকে ক্রমে ক্রমে অবসন্ন ও অচেতন করিতে লাগিল। তখন তিনি গৃহস্থ ব্ৰাহ্মণকে, তুমি বিষভক্ষণ করাইয়া ব্ৰহ্মহত্যা করিলে, এই বলিয়া ভূতলে পড়িলেন ও প্রাণত্যাগ করিলেন। ব্রাহ্মণ, অকস্মাৎ ব্ৰহ্মহত্যা দেখিয়া, যার পর নাই বিষন্ন হইলেন; এবং বাটীর মধ্যে প্ৰবেশিয়া, আপন পত্নীকে, তুই দুগ্ধে বিষ মিশ্ৰিত করিয়া রাখিয়াছিলি, তাহাতেই ব্ৰহ্মহত্যা হইল; তুই অতি দুর্বৃত্তা, আর তোর মুখাবলোকন করিব না; ইত্যাদি নানাপ্রকার তিরস্কার ও বহু প্ৰহার করিয়া, গৃহ হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দিলেন।
ইহা কহিয়া, বেতাল বিক্ৰমাদিত্যকে জিজ্ঞাসা করিল, মহারাজ! এ স্থলে কোন ব্যক্তি দোষভাগী হইবেক। রাজা কহিলেন, সৰ্পের মুখে স্বভাবতঃ বিষ থাকে; সুতরাং, সে দোষী হইতে পারে না; গৃহস্থ ব্ৰাহ্মণ ও তাঁহার ব্ৰাহ্মণী, সেই দুগ্ধকে বিষাক্ত বলিয়া জানিতেন না; সুতরাং, তাঁহারাও ব্ৰহ্মহত্যাপাপে লিপ্ত হইবেন না; আর, অতিথি ব্ৰাহ্মণ, সবিশেষ না জানিয়া, পান করিয়াছেন; এজন্য, তিনিও আত্মঘাতী নহেন। কিন্তু, গৃহস্থ ব্ৰাহ্মণ, সবিশেষ অনুসন্ধান না করিয়া, নিরপরাধ সহধর্মিণীকে গৃহ হইতে বহিস্কৃত করিলেন, তাহাতে তিনি, অকারণে পত্নীপরিত্যাগজন্য, দুরদৃষ্টভাগী হইবেন।
ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।