১২. দুখী নাইট

১২. দুখী নাইট

দিন যায়।

রূপালী বৃষ্টি, ঝকঝকে রোদ, সবুজ মাঠ-ময়দান আর অপূর্ব ফুলের সম্ভার নিয়ে বসন্ত আসে শেরউডে, চলে যায়। তারপর ঝাঁঝালো হলুদ রোদ, ভ্যাপসা গরম, দীর্ঘ গোধূলি আর পাহাড়ী পরীদের কোমল রাত নিয়ে আসে গ্রীষ্ম, চলে যায়। আসে শরৎ, ফসল ওঠে কৃষকের ঘরে, সবার মনেই খুশি-খুশি ভাব, সেই সাথে আসন্ন শীতের প্রস্তুতি, সবুজ পাতাগুলো ক্রমে খয়েরী হয়ে আসে। এরপর উত্তুরে হিমেল হাওয়া ডেকে নিয়ে আসে শীত, সেই সাথে শুভ্র তুষার, বাক্স থেকে বেরোয় স্মৃতির গন্ধ মাখা গরম জামা, ঘরের কোণে চুলোয় গন-গন করে আগুন।

দিন যায়। বছরের পর বছর ঘুরে ঘুরে আসে শীত বসন্ত গ্রীষ্ম শরৎ-আগে যেমন আসতো, এখনও তেমনি আসে, ভবিষ্যতেও আসবে। কিন্তু মানুষ আসে একবারই, যখন যায় চিরকালের জন্যেই যায়; কেউ শুকনো পাতার মত ঝরে বিলীন হয়ে যায়, কেউ রেখে যায় কিছু কথা।

এক সুন্দর সকালে ঘুম থেকে উঠেই ডাক দিল রবিন লিটল জনকে। ‘দেখেছো, লিটল জন, কি তাজা বাতাসটা? চলো বেরিয়ে পড়া যাক। একদল নিয়ে তুমি রওনা হয়ে যাও পুবে, আমি আরেক দল নিয়ে যাই পশ্চিম দিকে-দুইজনেই যদি শেরউডে ভোজের জন্যে মেহমান নিয়ে ফিরতে পারি তাহলে দারুণ মজা হবে।’

‘ঠিক বলেছো, লাফিয়ে উঠলো লিটল জন। এক্কেবারে মনের মতন কথা। এক্ষুণি রওনা দিচ্ছি আমি-অতিথি না নিয়ে ফিরবো না আজ।’

একদল নিয়ে বেরিয়ে গেল লিটল জন, কিছুক্ষণের মধ্যেই আরেক দল নিয়ে রওনা হয়ে গেল রবিন হুড।

রবিনের সাথে রয়েছে উইল স্কারলেট, মাচ, ওয়াটসন, অ্যালান-এ-ডেল, উইল স্কেদলক, মিজ দ্য মিলার, এবং আরো অনেকে। জনা কুড়ি অনুচর রয়ে গেছে ভোজের আয়োজনে সন্ন্যাসী টাককে সাহায্য করার জন্যে, বাকি সবাই রয়েছে হয় রবিন, নয় লিটল জনের সাথে।

আগে আগে হাঁটছে রবিন, পিছন পিছন চলেছে আর সবাই। মাঝে মাঝে জঙ্গল ছেড়ে খোলা উপত্যকার ওপর দিয়ে ফসলের খেত আর কুটিরগুলোকে পাশ কাটিয়ে আবার গিয়ে ঢুকছে রাস্তাটা জঙ্গলে। হাঁটতে হাঁটতে ম্যান্সফীল্ড শহর ছাড়িয়ে আরো অনেক দূর চলে গেল ওরা। জঙ্গল ছাড়িয়ে খোলা জায়গায় পড়লো, তবু থামলো না রবিন, হাঁটতে হাঁটতে ডার্বিশায়ারের অ্যালবার্টনও ছাড়িয়ে গেল। অবশেষে একটা গির্জার সামনে এসে দাঁড়ালো সে। দু’দিক থেকে দুটো রাস্তা এসে মিশেছে এখানে। রাস্তার দু’পাশে ঘন ঝোপঝাড়। ঝোপের আড়ালে বসে খেয়ে নেয়া যাবে দুপুরের খাবারটা, সেই সাথে নজর রাখা যাবে দুটো রাস্তার ওপরই তাই এইখানেই কিছুক্ষণের জন্যে বিশ্রাম নেয়ার সিদ্ধান্ত নিল সে।

এত হাঁটাহাঁটিতে খিদে লেগে গেছে সবারই, দ্বিতীয়বার বলতে হলো না কাউকে, যে-যার খাবার বের করে খাওয়া শুরু করলো বিনা বাক্যব্যয়ে।

দুটো রাস্তার একটা উঁচু হয়ে উঠে গেছে পাহাড়ের মাথায়, তারপর অদৃশ্য হয়ে গেছে ওপাশে। পাহাড়ের ওপাশে কয়েকটা বাড়ির ছাত দেখা যাচ্ছে, একটা উইণ্ড মিলের পাখা ঘুরছে ধীর বাতাসে পাখার অর্ধেকটা দেখা যাচ্ছে এখান থেকে, উঠছে আবার নেমে যাচ্ছে ঘুরে।

খাওয়া শেষ করে অনেকক্ষণ বসে রইলো ওরা ঝোপের আড়ালে, কেউ কেউ শুয়ে পড়লো ঘাসের উপর; অপেক্ষা করছে ওরা, তীক্ষ্ণ নজর রেখেছে রাস্তার দিকে কিন্তু কারো দেখা নেই। শেষ পর্যন্ত যখন বিরক্ত হয়ে উঠে পড়তে যাবে রবিন, এমনি সময়ে একজন লোকের মাথা দেখা গেল পাহাড়ের উপর। এদিকেই আসছে কেউ ঘোড়ায় চেপে। লাফিয়ে উঠে বসলো রবিন। ‘নাইট! নাইট একজন!’

ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে নাইট। আরও কিছুটা কাছে আসতেই দেখা গেল যদিও পোশাক-পরিচ্ছদ খুবই দামী, চেহারায় গভীর বিষাদের চিহ্ন রয়েছে নাইটের। পোশাকটা দামী হলেও সোনার চেন বা মণিমুক্তোর কোন চিহ্ন নেই লোকটার শরীরের কোথাও। বয়স্ক লোক, মাথাটা নুয়ে রয়েছে বুকের কাছে, হাত দুটো ঝুলে আছে শরীরের দু’পাশে। হতাশ, মন্থর গতি-যেন দুনিয়ার কোথাও গিয়ে কিছুই পাওয়ার নেই তাঁর, গভীর উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তার রেখা পড়েছে তাঁর মুখে। ঢিল হয়ে রয়েছে ঘোড়ার মুখের রাশ, মাথা নিচু করে হাঁটছে ঘোড়াটা, যেন প্রভুর দুঃখে দুঃখিত সে-ও।

‘কপালটাই খারাপ আজ,’ বললো রবিন। ‘যাও বা একটা নাইট পাওয়া গেল, মনে হচ্ছে দুঃখের ভারে শুয়ে পড়বে এখুনি। তবে কাপড়-চোপড়ের অবস্থা তো মনে হচ্ছে মোটামুটি ভালই। যাই, অন্ততঃ দু’চারটে কথা বলে আসি। বলা যায় না, কিছু মালপানি মিলেও যেতে পারে, উঠে দাঁড়ালো সে। সঙ্গীদের বললো, ‘তোমরা এখানেই অপেক্ষা করো, প্রথমে আমি একা কথা বলে দেখি।’

রাস্তা পার হয়ে গির্জার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো রবিন, দুখী নাইট কাছাকাছি – আসতেই এগিয়ে গিয়ে ধরে ফেললো ঘোড়ার লাগামটা। ‘থামুন, স্যার নাইট,’ বললো সে। দু’চারটে কথা আছে আমার, শুনে যান।’

‘কে তুমি, ভাই, বললেন নাইট। ‘রাজপথের ওপর এভাবে পথিককে দাঁড় করাচ্ছো… কে তুমি?’

‘কঠিন একটা প্রশ্ন করেছেন, স্যার নাইট!’ জবাব দিল রবিন। ‘কেউ আমাকে বলে দয়ালু, কেউ বলে নিষ্ঠুর; এ বলে সৎ, ভালো লোক, ও বলে জঘন্য চরিত্রের এক চোর। কোলা ব্যাঙের গায়ে যতগুলো দাগ আছে, একটা মানুষকে তত ভাবে দেখা যায়; এটা নির্ভর করে যার-যার দেখার ভঙ্গির ওপর। আপনি কিভাবে দেখবেন সেটা আপনিই জানেন। আমার নাম রবিন হুড।’

‘আচ্ছা! তুমিই সেই স্বনামধন্য রবিন?’ নাইটের ঠোঁটের কোণে একটু যেন হাসির আভাস ফুটে উঠলো। ‘তোমার সম্পর্কে অনেক শুনেছি আমি, বেশির ভাগই ভাল কথা, তবে খারাপও যে শুনিনি তা নয়-কিন্তু সেসব ক্ষেত্রে একটু বুদ্ধি খরচ করে বুঝে নিয়েছি, কেন সেই বিশেষ ব্যক্তিটি খারাপ বলছে তোমাকে। যাই হোক, এ থেকে হয়তো অনুমান করতে পারবে তোমার সম্পর্কে আমার মনোভাব। এবার বলো, কি চাও তুমি আমার কাছে।’

আপনার ভদ্র, নম্র, মার্জিত কথাগুলো খুবই ভাল লাগলো আমার, স্যার নাইট,’ বললো রবিন। আপনার সৌজন্যে মুগ্ধ হয়ে আমি আমাদের শেরউড জঙ্গলে নিমন্ত্রণ জানাচ্ছি আপনাকে। আমাদের সাথে ভোজ খেতে হবে আজ আপনার, স্যার নাইট।’

‘অনেক ধন্যবাদ,’ বললেন নাইট। চেহারাটা আরো যেন বিষণ্ন দেখাচ্ছে। ‘কিন্তু একজন দুঃখী অতিথি তোমাদের ভাল লাগবে না। ভোজের আনন্দটাই মাটি হয়ে যাবে তোমাদের আমাকে সাথে নিলে। তার চেয়ে বরং রাস্তা ছাড়ো, আমি চলে চাই নিজের পথে।’

‘কিন্তু ব্যাপারটা আসলে একটু অন্যরকম, স্যার নাইট,’ বললো রবিন। আপনাকে নিজের পথে চলে যেতে দিতে পারি না আমরা। শেরউডের গভীর জঙ্গলে আমরা একটা সরাইখানার মত খুলেছি। কিন্তু আমাদের ওখানে অতিথি আসতে চায় না সহজে। তাই আমরা প্রায়ই অতিথির খোঁজে বেরিয়ে পড়ি, যেখানে পাই ধরে নিয়ে যাই তাদের, ভোজের পর খরচা বাবদ কিছু পাবো এই আশায়।

‘তোমার কথার অর্থ বুঝতে পারছি,’ গম্ভীর হয়ে গেলেন নাইট। ‘কিন্তু ভুল লোক ধরেছো আজ, রবিন। আমার কাছে টাকা পয়সা নেই।’

‘তাই বুঝি?’ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নাইটের চোখের দিকে তাকালো রবিন। ‘মনে হচ্ছে সত্যি কথাই বলছেন। কিন্তু তবু, স্যার নাইট, কিছু মনে করবেন না, অনেক বড় বড় বিশিষ্ট সম্মানিত ভদ্রলোককে আমি নির্জলা মিথ্যা বলতে শুনেছি কাজেই আপনার কথার সত্যতা আমি নিজে যাচাই করে দেখবো।’ এই বলে দুটো আঙুল মুখে পুরে তীক্ষ্ণ একটা শিস দিল রবিন। হুড়মুড় করে ছুটে এলো চার-কুড়ি জোয়ান। গর্বের সাথে বললো রবিন, ‘এরা সবাই আমার বিশ্বস্ত সহচর। আনন্দ বা দুঃখ যা পাই, লাভ বা লোকসান যা হয় সমান ভাগে ভাগ করে নিই আমরা। এবার বলুন তো, স্যার নাইট, ঠিক কত টাকা আছে আপনার কাছে?’

কিছুক্ষণ কোন কথা বললেন না নাইট, ধীরে ধীরে লাল হয়ে উঠছে তাঁর গাল দুটো, মাথাটা নুয়ে পড়তে চাইছে নিচের দিকে। হঠাৎ মাথা ঝাড়া দিয়ে কি যেন তাড়াবার চেষ্টা করলেন তিনি, তারপর সোজা চাইলেন রবিনের মুখের দিকে। বললেন, অযথা লজ্জা পাচ্ছি কেন? লজ্জিত হওয়া উচিত নয়। ঠিক আছে, শোনো, ভাই, মাত্র দশটা শিলিং আছে আমার থলিতে; এছাড়া স্যার রিচার্ড অফ দ্য লী-র আর কিছুই নেই সারা দুনিয়ায়।’

কথাটা শুনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সবাই বেশ কিছুক্ষণ, তারপর রবিন বললো, ‘আপনার কাছে আর টাকা পয়সা নেই…আপনি শপথ করে বলছেন?’

‘বলছি,’ মাথা ঝাঁকালেন স্যার রিচার্ড। ‘যা আছে এই আমার শেষ সম্বল, আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। শুধু থলি বলে নয়, আসলে কোথাও আর কিছু নেই। দেখো, নিজেই পরীক্ষা করে দেখো সত্যি বলছি কিনা।’ এই বলে থলিটা বের করে বাড়িয়ে দিলেন তিনি রবিনের দিকে।

‘রেখে দিন ওটা, স্যার রিচার্ড, বললো রবিন। আপনার মত এমন মিষ্টভাষী ভদ্র নাইটের কথা আমি অবিশ্বাস করতে চাই না। অত্যাচারী, অহঙ্কারী আর নিষ্ঠুর উদ্ধত ধনী লোকের মাথা আমি নত করে ছেড়ে দিই ঠিকই, কিন্তু বিনয়ী, নম্র, দুঃখী মানুষকে সাহায্য করতে চেষ্টা করি সাধ্যমত। আসুন, স্যার রিচার্ড, টাকা নেই তো কি হয়েছে, তবু আপনি আমন্ত্রিত, চলুন আমাদের সাথে যোগ দেবেন আজ শেরউডের ভোজে। আমাদের ক্ষমতা সীমিত, কিন্তু এমনও তো হতে পারে, হয়তো আমাদের সাহায্য কাজে লেগে যাবে আপনার।

‘ধন্যবাদ, বন্ধু,’ বললেন স্যার রিচার্ড। ‘তোমার সদিচ্ছার জন্যে তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। যদিও আমার দুঃখ দূর হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই, তোমার সাদর আমন্ত্রণ আমি খুশি মনেই গ্রহণ করছি।’ এই বলে ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিলেন তিনি। হাঁটতে শুরু করলো বাকি সবাই। স্যার রিচার্ডের দু’পাশে হাঁটছে রবিন হুড আর উইল স্কারলেট, বাকি সবাই চলছে পিছন পিছন।

কিছুদূর চুপচাপ হেঁটে মুখ খুললো রবিন। ‘জিজ্ঞেস করা হয়তো ঠিক হচ্ছে না, হয়তো পুরানো ক্ষত খুঁচিয়ে আপনাকে কষ্টই দেয়া হচ্ছে, তবু জিজ্ঞেস না করে পারছি না-আচ্ছা, স্যার নাইট, আজ আপনার এই অবস্থার কারণটা কি? মনের কথা বলে ফেললে হয়তো আপনার দুঃখ কিছুটা লাঘব হবে।’

‘ঠিকই বলেছো, রবিন, বলে ফেললে মনের ভার অনেকটা হালকা হয়ে যায়। তাছাড়া সবাই যখন জানে, তুমি জানলে আমার কোন ক্ষতি নেই। ব্যাপারটা হচ্ছেঃ আমি সর্বস্বান্ত হয়ে গেছি। আমার দুর্গ, জমিদারী, সব বন্ধক দিয়ে টাকা ধার করেছিলাম আমি এমেট মঠের মোহান্তের কাছে। আগামী তরশু টাকা শোধ দেয়ার শেষ তারিখ। যদি ওই তারিখের মধ্যে পুরো দেনা শোধ না করতে পারি, আমার সর্বস্ব চলে যাবে মোহান্তের হাতে। আর, একবার গিলে ফেললে এমেটের মোহান্তের হাত থেকে সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নয় কারো পক্ষেই।’

‘আমি বুঝি না,’ বললো রবিন। সূর্যের তাপে তুষার যেমন গলে, আপনাদের মত সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোকেদের হাতে পড়লে ঠিক তেমনি ভাবে কেন গলে বেরিয়ে যায় টাকা-পয়সা, ধন-দৌলত।’

‘আমার ওপর অবিচার করছো তুমি, রবিন,’ বললেন প্রৌঢ় স্যার রিচার্ড। ‘ভেবেছো, উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন করতে গিয়ে সব কিছু খুইয়ে বসেছি-ব্যাপারটা আসলে তা নয়। সবটা শুনলে বুঝতে পারবে। বিশ বছর বয়েসের এক ছেলে আছে আমার। এই বয়সেই নাইট উপাধি অর্জন করে নিয়েছে সে। গত বছর চেস্টারে নাইটদের বল্লম-যুদ্ধের আয়োজন করা হয়েছিল। আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে উপস্থিত ছিলাম সেখানে, আমার ছেলেও গিয়েছিল। গর্বের সাথে দেখছিলাম আমরা আমাদের ছেলের বীরত্বপূর্ণ লড়াই, ওর সাথে খেলতে গিয়ে একের পর এক হারছিল আর সব নাইট। অবশেষে ল্যাংকাস্টারের স্যার ওয়াল্টার নামলেন যুদ্ধে। বয়স কম হলে কি হবে, আশ্চর্য নৈপুণ্যের সাথে প্রতিটা আঘাত ঠেকিয়ে দিল আমার ছেলে। কিন্তু ও যখন পাল্টা আক্রমণ করলো, সামাল দিতে পারলেন না স্যার ওয়াল্টার, দুর্ভাগ্য আমাদের, দুটো বর্শাই ফেটে চুর চুর হয়ে গিয়েছিল, কি করে যেন আমার ছেলের বর্শার একটা চটা ওঁর চোখ দিয়ে ঢুকে মগজ পর্যন্ত পৌছে গেল। ঘোড়ার ওপর বসা অবস্থাতেই মারা গেলেন তিনি তৎক্ষণাৎ। উপস্থিত সবাই বললো এটা একটা দুর্ঘটনা মাত্র, কিন্তু স্যার ওয়াল্টারের প্রতিপত্তিশালী আত্মীয়স্বজন মানলো না সে-কথা। তারা ব্যাপারটাকে এমনই ঘোলাটে করে তুললো যে ছেলেকে নির্ঘাৎ জেল থেকে রক্ষা করার জন্যে ক্ষতিপূরণ দিলাম আমি ছয়শো পাউণ্ড। কিন্তু এতেও ওদের খাঁই মিটলো না, আইনের নানান বিদঘুটে প্যাচে ফেলে ঘোলাপানি খাইয়ে ছেড়ে দিল আমাকে। সে-সব সামলাতে গিয়ে এমেটের মোহান্তের কাছে হাত পাততে হলো আমার। বিপদের সময় সে-ও সুযোগ নিতে ছাড়লো না, সামান্য টাকার বিনিময়ে বন্ধকী দলিল করিয়ে নিল গোটা সম্পত্তির। যা হোক, ছেলেটাকে যে বাঁচাতে পেরেছি, এটুকুই আমার সান্ত্বনা। বাস্তব অবস্থাটা আমি মেনে নিয়েছি, সম্পত্তি হারিয়ে কোন দুঃখ নেই, কিন্তু এই অসম্মানজনক পরিবেশে আমার স্ত্রীর কি অবস্থা হবে তাই ভেবে মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে বার বার।’

‘আপনার ছেলে এখন কোথায়?’ জানতে চাইলো রবিন।

‘প্যালেস্টাইনে লড়াই করছে এখন আমার ছেলে। শুনেছি, খুবই বীরত্বের সাথে লড়ছে সে।’

‘সত্যিই,’ বললো রবিন, দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছেন আপনি। তা, কত টাকা ধার নিয়েছিলেন আপনি এমেটের মোহান্তের কাছ থেকে?’

‘মাত্র চারশো পাউণ্ড।’

রেগে গেল রবিন। আশ্চর্য রক্ত-চোষা লোক তো! ঘর বাড়ি দুর্গ সহ একটা গোটা জমিদারী দখল করতে যাচ্ছে ব্যাটা মাত্র চারশো পাউণ্ডের বিনিময়ে! আচ্ছা, সর্বস্ব হারিয়ে আপনি কি করবেন বলে ঠিক করেছেন?’

‘আমার জন্যে কোন চিন্তাই করি না আমি,’ বললেন স্যার রিচার্ড। ‘যেটুকু যা দুশ্চিন্তা করছি, তা শুধু আমার স্ত্রীর কথা ভেবে। কোন আত্মীয়-স্বজনের বাসায় তাদের দান ও কৃপার ওপর নির্ভর করে জীবন যাপন করতে হবে ওর। মনটা ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে, কিন্তু টু শব্দ করবে না ও, আমি জানি। সেজন্যেই খারাপ লাগছে এত। আমার কি, বুড়ো হয়ে গেছি ঠিকই, কিন্তু এখনও অক্ষম হয়ে পড়িনি-আমি ঠিক করেছি চলে যাবো প্যালেন্টাইনে, ছেলের পাশে দাঁড়িয়ে বাপ-ব্যাটা যুদ্ধ করবো একসাথে।

এতক্ষণ মন দিয়ে শুনছিল, এবার হঠাৎ কথা বলে উঠলো উইল স্কারলেট, ‘আচ্ছা, এই বিপদের সময় আপনার বন্ধু-বান্ধবরা এগিয়ে এলো না কেউ? কেউ সাহায্য করলো না?’

‘নাহ্,’ এপাশ ওপাশ মাথা নাড়লেন স্যার রিচার্ড। ‘কেউ না। যখন আমার অনেক টাকা ছিল, তখন বন্ধু বান্ধব আর আত্মীয়স্বজনের মধ্যে ভালবাসার প্রতিযোগিতা লেগে যেত, প্রত্যেকে প্রমাণ করবার চেষ্টা করতো অন্যের চেয়ে সে-ই বেশি ভালবাসে আমাকে। সবাই সরে পড়েছে এখন। কারণ ওরা জানে, শুধু যে গরীব হয়ে গিয়েছি তাই নয়, প্রবল পরাক্রান্ত শত্রু রয়েছে আমার।’ দুঃখের হাসি হাসলেন স্যার রিচার্ড, ‘ওরা জানে, আর কোনদিনই সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবো না আমি।’

‘এই বিপদে আপনার কোন বন্ধু নেই, একথা ভাববেন না, স্যার রিচার্ড, বললো রবিন হুড। ‘যারা দুর্বল, যারা পরনির্ভরশীল, তারা সরে গেছে আপনার ওপর আর নির্ভর করা যায় না বলে। গর্ব করছি না, কিন্তু আমি দুর্বলও নই, পরনির্ভরশীলও নই। দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলুন মন থেকে। আপনার এই বিপদে হয়তো আমি কোন সাহায্যে লাগতে পারবো।’

ম্লান হাসলেন স্যার রিচার্ড। মাথা নাড়লেন এপাশ ওপাশ। বললেন, ‘তোমার আশ্বাসের জন্যে তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। সাহায্য তো দূরের কথা, এটুকুও পাইনি আমি কারো কাছে গত একটা বছর। তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করছি, তোমাদের সহানুভূতি পেয়ে অনেক হালকা হয়ে গেল আমার মনটা।

গ্রীনউড গাছের নিচে ওরা যখন পৌঁছলো, তখন শেষ বিকেল। দূর থেকেই দেখতে পেল ওরা লিটল জন আর তার দলবল পৌছে গেছে সেখানে আগেই। অতিথি নিয়ে ফিরেছে ওরাও, হোরফোর্ডের লর্ড বিশপকে ধরে এনেছে রাস্তা থেকে। রেগে একেবারে টং হয়ে আছেন বিশপ, গাছের নিচে পায়চারি করে ফিরছেন, যেন মুরগীর খাঁচায় আটকা পড়া খেঁকশেয়াল! তাঁর পিছনে কালো কাপড় পরা তিনজন সন্ন্যাসী দাঁড়িয়ে রয়েছে ভীতসন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে। ছয়টা ঘোড়া বাঁধা রয়েছে গাছের ডালে। বোঝা যাচ্ছে একটায় চড়ে যাচ্ছিলেন বিশপ, বাকি পাঁচটার পিঠে বোঝাই মালপত্র। একটা মাঝারী আকারের বাক্সের ওপর চোখ পড়তেই খুশি হয়ে উঠলো রবিন হুড; লোহার পাত জড়িয়ে বাঁধা হয়েছে ওটাকে শক্তভাবে।

রবিন আর তার দলবলকে দেখেই বীরদর্পে এগিয়ে আসতে যাচ্ছিলেন লর্ড বিশণ, কিন্তু প্রহরায় মোতায়েন এক অনুচর হাতের মোটা লাঠিটা সমান্তরাল করে ধরে ঠেকালো তাঁকে। বাধ্য হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি, কিন্তু ভুরুজোড়া কুঁচকে উঠলো আরো, কঠোরতর তিরস্কারের ভাষা বেরোতে শুরু করলো তাঁর মুখ থেকে।

‘দাঁড়ান, দাঁড়ান!’ দূর থেকেই হাঁক ছাড়লো রবিন। আপনি কষ্ট করে আমার কাছে আসবেন কেন, লর্ড বিশপ, আমিই আসছি আপনার কাছে। আপনাকে এখানে দেখে আমার কী যে খুশি লাগছে তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না।’

রবিন হুড কাছে এসে দাঁড়াতেই তীব্র ভৎসনার সুরে নালিশ জানালেন হেরিফোর্ডের বিশপ। ‘একজন লর্ড বিশপের সাথে তোমাদের এটা কোন্ ধরনের ব্যবহার, আমি জানতে চাই। কারো সাথে কোন ঝগড়া নেই ফ্যাসাদ নেই, নিরীহ শান্তিপ্রিয় মানুষ আমি, চলেছিলাম রাজপথ ধরে, এই তিনজন সাধু, পাঁচটা মালটানা ঘোড়া, আর দশ জন পাহারাদার নিয়ে; এমন সময় ইয়া লম্বা বিকট চেহারার এক লোক পেছনে তিন চার কুড়ি গুণ্ডা নিয়ে হুকুম করলো আমাকে থামতে। খেয়াল করো, আমাকে হেরিফোর্ডের লর্ড বিশপকে থামতে বলছে! পেছনে চেয়ে দেখি-জাহান্নামে যাক ব্যাটারা!-সব কটা পাহারাদার স্রেফ হাওয়া হয়ে গছে। শোনো, ওই বিরাট দৈত্যের মত লোকটা আমাকে শুধু থামিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, হুমকি দিয়েছে, বাড়াবাড়ি করলে নাকি রবিন হুড আমাকে ন্যাংটো করে ছেড়ে দেবে! শুধু তাই নয়, যা ইচ্ছে তাই বিচ্ছিরী সব গাল দিয়েছে লোকটা আমাকে : মোটা পুরুত, মানুষখেকো বিশপ, অর্থলোলুপ রক্তচোষা সুদখোর… আরো কত কি! তার ওপর আমি এখানে আসার পর কোত্থেকে মোটা এক কপট- সন্ন্যাসী এসে আমার ঘাড়ে চাপড় মেরে কথা বলার চেষ্টা করেছে-যেন আমি তার ইয়ার- দোস্ত!’

‘কি বললে? মুখ সামলে কথা বলো বলে দিচ্ছি!’ এক লাফে বিশপের সামনে এসে দাঁড়ালো সন্ন্যাসী টাক। বিশপের নাকের কাছে এমন জোরে তুড়ি বাজালো যে চমকে আধ হাত সরে গেলেন বিশপ। আমি কপট সন্ন্যাসী? তোমার থেকে কোন্ দিক থেকে আমি কম সেটা বুঝিয়ে দিতে পারবে? জ্ঞানে বিদ্যায় বুদ্ধিতে…. কোন্‌টায় কম? গোটা ‘বাইবেল মুখস্থ বলতে পারি আমি, তা জানো? কুড়েঘরে জন্ম আমার, তা নইলে আজ তোমার চেয়ে অনেক অনেক উঁচুস্তরের বিশপ হতে পারতাম আমি। কপট বলার স্পর্ধা দেখিয়ো না হে, পরীক্ষায় নামলে হেরে যাবে। শুধু একটা দিকে, স্বীকার করি, কিছুটা কম আছি আমি তোমার থেকে, অত ভয়ংকর রকমের মোটা হতে পারিনি এখনও।’

ঝগড়াটে বিড়ালের মত ফুঁসে উঠলেন বিশপ এই কথায়, চোখ পাকিয়ে ভস্ম করে দেয়ার চেষ্টা করছেন তিনি সন্ন্যাসী টাককে; টাকও চোখ-মুখ পাকিয়ে এমন এক ভেংচি ধরলো যে স্যার রিচার্ড সহ হেসে উঠলো সবাই। কিন্তু রবিন গম্ভীর। ‘সরে যান, ফাদার টাক,’ বললো সে, ‘সরুন দেখি। এতবড় সম্মানিত লর্ড বিশপকে হেয় প্রতিপন্ন করা মোটেই ঠিক হচ্ছে না। আমি খুবই দুঃখিত, মাননীয় লর্ড বিশপ। আপনার সাথে আমার লোকজন এত খারাপ ব্যবহার করেছে শুনে আমি সত্যিই দুঃখিত। কোথায় লিটল জন, সামনে এসে দাঁড়াও!’

কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে সামনে এসে দঁড়ালো লিটল জন। বিশপের দিকে ফিরলো আবার রবিন। ‘এই লোকটাই দুর্ব্যবহার করেছিল আপনার সঙ্গে, লর্ড বিশপ?’

‘হ্যাঁ, এই লোকই,’ বললেন বিশপ। ‘খুবই খারাপ লোক, সন্দেহ নেই।’

‘লিটল জন, তুমি আমাদের মাননীয় লর্ডকে মোটা পুরুত বলেছো?’ রবিনের কণ্ঠে স্পষ্ট তিরস্কার।

‘বলেছি,’ নিচু গলায় বললো লিটল জন।

‘তুমি এঁকে মানুষখেকো বিশপ বলেছো?’

‘বলেছি।’ যেন অপরাধ স্বীকার করছে আসামী, এমনি ভঙ্গিতে বললো লিটল জন।

তুমি এঁকে অর্থলোলুপ রক্তচোষা সুদখোর বলেছো?’

‘বলেছি।’ কাঁদো কাঁদো হয়ে এলো লিটল জনের গলা।

‘ছি ছি, এতটা ভাবতেও পারিনি আমি!’ বলেই বিশপের দিকে ফিরলো রবিন ‘বড়ই পরিতাপের বিষয়, লর্ড বিশপ। ওর একটা কথাও অবিশ্বাস করতে পারছি না আর যাই করুক, কোনদিন মিছে কথা বলে না ও।’

গোটা জঙ্গল কাঁপিয়ে হেসে উঠলো সবাই। চিবুক থেকে শুরু করে মাথা জোড়া টাক পর্যন্ত লাল হয়ে গেল বিশপের, বার দুই মুখ খুললেন কিছু বলার জন্যে, কিন্তু আওয়াজ বেরোলো না।

‘কিছু মনে করবেন না, লর্ড বিশপ, আবার বললো রবিন, ‘আমরা একটু কর্কশ প্রকৃতির মানুষ, কিন্তু আপনি যতটা ভাবছেন ততটা খারাপ লোক নই। এখানে এমন একজনও পাবেন না যে আপনার মাথার একটা চুল স্পর্শ করবে।’ বলেই আবার সংশোধন করলো রবিন, চুল অবশ্য নেই, কিন্তু থাকলেও স্পর্শ করতো না। আমি বুঝতে পারছি, আমাদের রসিকতায় আপনি আহত বোধ করছেন, কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমরা এখানে সবাই সমান। আমাদের এখানে বিশপ নেই, ব্যারন নেই, আর্ল নেই- কারো ওপর মাতব্বরি করার কেউ নেই। আমাদের পরিচয়ঃ আমরা মানুষ। আমাদের সাথে সমান ভাবে যদি মিশতে পারেন, কথা দিচ্ছি, ভাল লাগবে আপনার।’ চারপাশে তাকালো রবিন। ‘কই, ভোজের আয়োজন কদ্দূর? যার যা যন্ত্রপাতি, নিয়ে এসো সব… ভোজের আগে খেলা দেখাবে না মেহমানদের?’

ছুটলো সবাই। কেউ ছুটলো হাঁড়ি-চুলোর দিকে, কেউ গেল লাঠি, তলোয়ার বা তীর-ধনুক আনতে। স্যার রিচার্ডকে ডেকে পরিচয় করিয়ে দিল রবিন হেরিফোর্ডের লর্ড বিশপের সাথে। আপনি জেনে সুখী হবেন, মাননীয় লর্ড বিশপ, আজকের ভোজে আর একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি, লী-র স্যার রিচার্ড উপস্থিত থাকছেন। আপনারা দু’জনই আজ আমাদের সম্মানিত অতিথি।

‘স্যার রিচার্ড, ‘ ভর্ৎসনার কণ্ঠে বললেন বিশপ, ‘সমাজের উচ্চ শ্রেণীর লোক আমরা দুজনই, দুজনেই আজ হেনস্তা হচ্ছি এইসব—’ গুণ্ডা-বদমাশ বলতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে চট করে তাকালেন বিশপ রবিনের মুখের দিকে।

‘বলুন, বলুন! যা বলতে যাচ্ছিলেন বলে ফেলুন, বিশপ, হাসতে হাসতে বললো রবিন। শেরউডে আমরা কেউ মুখে লাগাম এঁটে কথা বলি না। বলতে চেয়েছিলেনঃ এইসব চোর-গুণ্ডা-বদমাশদের হাতে, তাই না?’

‘ওই রকমেরই কিছু হয়তো বলতে চেয়েছিলাম,’ বললেন লর্ড বিশপ। কিন্তু, স্যার রিচার্ড, একটা কথা আপনাকে না বলে পারছি না, এই একটু আগে এদের কদর্য রসিকতায় আপনাকে হাসতে দেখেছি আমি। হেসে উঠে এদের আস্কারা না দিয়ে ভূকুটির মাধ্যমে এদের নিরুৎসাহিত করাই আপনার উচিত ছিল বলে আমি মনে করি।’

‘আপনার প্রতি অশ্রদ্ধা দেখানোর উদ্দেশ্যে হাসিনি আমি,’ বললেন স্যার রিচার্ড। ‘রসিকতা রসিকতাই। এটুকু বলতে পারি, ওই রসিকতা যদি আমাকে কটাক্ষ করে করা হত, তবু আমি হাসতাম।

একজন এসে গ্রীনউডের নিচে ঘাসের ওপর হরিণের চামড়া বিছিয়ে দিয়ে গেল। খুবই সমাদর করে অতিথিদের বসালো রবিন তার ওপর। নিজেও বসলো। কাছে পিঠেই রইলো দলের হোমরা-চোমরা কয়েকজনঃ লিটল জন, উইল স্কারলেট, মাচ, উইল স্টিউটলি ও অ্যালান-এ-ডেল। ফাঁকা জায়গাটার একেবারে শেষ মাথায় গাছের ডালে ঝুলিয়ে দেয়া হলো একটা মালা, একজনের পর একজন ছুঁড়তে শুরু করলো তীর। এতই আশ্চর্য নৈপুণ্য প্রদর্শন করলো ওরা সেদিন যে রীতিমত তাজ্জব হয়ে গেলেন স্যার রিচার্ড আর লর্ড বিশপ। একশো চল্লিশ গজ দুরে ঝোলানো মাত্র নয় ইঞ্চি ব্যাসের একটা মালার বৃত্ত লক্ষ্য করে তিনটে করে তীর ছুড়লো এতজন মানুষ, অথচ মাত্র দুটো তীর লাগলো মালার বাইরে, বাকি সবগুলো লক্ষ্যভেদ করলো। ইতিমধ্যেই গল্প-গুজব, হাসি-ঠাট্টায় দুই অতিথির বেদনা ও বিরক্তি যেন হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়েছে রবিন। ছেলেমানুষের মত হাততালি দিয়ে উঠছেন লর্ড বিশপ, হা হা করে প্রাণখোলা হাসি হাসছেন স্যার রিচার্ড।

‘জীবনে এমন আশ্চর্য শূটিং দেখিনি আমি,’ বললেন হেরিফোর্ডের বিশপ। ‘কিন্তু রবিন, শুনেছি, তোমার নাকি তুলনা হয় না। দেখাবে নাকি এক হাত?’

‘আঁধার হয়ে আসছে,’ বললো রবিন, ‘অস্পষ্ট হয়ে আসছে সবকিছু। ঠিক আছে, তবু দেখি চেষ্টা করে কি করতে পারি।‘

উঠে দাঁড়ালো রবিন, কোমর থেকে ছোরাটা বের করে ছোট্ট একটা হেজেলের শাখা কেটে বাকল ছাড়াতে শুরু করলো। বুড়ো আঙুলের চেয়ে সামান্য একটু মোটা হবে ছড়িটা। সেটা হাতে নিয়ে মাপা পদক্ষেপে হেঁটে চলে গেল আশি গজ দূরে। ওখানে ছড়িটা মাটিতে পুঁতে দিয়ে ফিরে আসতেই ইউ গাছের ডাল দিয়ে তৈরি রবিনের বিশাল ধনুকটা এগিয়ে দিল অ্যালান-এ-ডেল। বাঁকা করে ছিলা পরিয়ে নিল রবিন ধনুকটায়, তারপর তণ থেকে সবক’টা তীর মাটিতে নামিয়ে বেছে বেছে বের করলো একটা পছন্দসই তীর। ধনুকে তীর যোজনা করে বাম পা সামনে বাড়িয়ে তৈরি হলো সে। স্তব্ধ হয়ে গেছে সবাই, কারো মুখে টু শব্দ নেই, গাছ থেকে পাতা পড়লেও আওয়াজ শোনা যাবে এখন। ধনুক ধরা বাম হাতটা সোজা করছে রবিন, সেইসাথে ডান হাতে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তীর বাধানো ছিলাটা কানের পাশে। একটা শ্বাস নিতে যতটা সময় লাগে তার চেয়েও কম সময় নিল রবিন লক্ষ্যস্থির করতে। টংকার ধ্বনির সাথে সাথেই ছুটলো তীর। এতই দ্রুত, যে দৃষ্টি দিয়ে অনুসরণ করা গেল না ওটাকে। তীরের পিছু পিছু ছুটলো দৌড়বাজ উইল স্কেদলক, মাটি থেকে উপড়ে তুলে নিয়ে এলো হেজেল-কাঠিটা আশ্চর্য! কাঠির গায়ে বিধে রয়েছে তীরটা। প্রচণ্ড হর্ষধ্বনি উঠলো দর্শকদের মধ্যে। যারা রান্নাবান্নায় ব্যস্ত ছিল, ছুটে এলো তারাও। যোগ্য নেতার বিস্ময়কর নৈপুণ্যে গর্বে ফুলে উঠেছে সবার বুক।

কাউকে প্রশংসার কোন সুযোগ না দিয়ে বসে পড়লো রবিন, লাঠি খেলা শুরু করবার নির্দেশ দিল। লাঠি নিয়ে এগিয়ে এলো কয়েকজন। স্থান-কাল ভুলে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করছেন লর্ড বিশপ তুমুল লড়াই দেখে। এইভাবে সন্ধ্যা পেরিয়ে ঘনিয়ে এলো শেরউড জঙ্গলের আশ্চর্য সুন্দর রাত।

হার্পে সুর বেঁধে নিল এবার অ্যালান-এ-ডেল। ওর অপূর্ব কণ্ঠের গান শুনে শ্বাস রুদ্ধ হয়ে এলো শ্রোতাদের। একে একে কয়েকটা গান গাইলো সে-ভালবাসার, যুদ্ধের, মহিমার, দুঃখের। তন্ময় হয়ে শুনছে সবাই। এত সুন্দর গান কে গায় দেখার জন্যেই যেন মস্ত এক রূপালী চাঁদ উঠলো আকাশে। চিক চিক করছে এখন গাছের পাতাগুলো। মিষ্টি বাজনা, ভাবগম্ভীর গানের আবেগ, রূপালী চাঁদ আর বিশাল ওকের দোলায়িত শাখার ছন্দ মিলে আশ্চর্য এক মোহময় পরিবেশের সৃষ্টি হলো শেরউড জঙ্গলে।

অবশেষে দু’জন এসে সংবাদ দিল, খাবার তৈরি। অতিথিদের নিয়ে এগোলো রবিন। ঘাসের উপর সাদা দস্তরখান বিছিয়ে দেয়া হয়েছে, অনেকগুলো মশাল জ্বেলে আলোকিত করা হয়েছে জায়গাটা, সুস্বাদু খাবারের গন্ধে জিভে জল এসে গেল সবার। বসে পড়লো সবাই—হৈ-চৈ আর হাসি-গল্পের সাথে সাথে চললো রসনাতৃপ্তি। খাওয়া শেষ হতেই এলো টলটলে এল-ভর্তি মদের পাত্র। এমনি সময়ে সবাইকে চুপ করার নির্দেশ দিল রবিন। চুপ হয়ে গেল সবাই।

‘একটা গল্প শোনাতে চাই আমি তোমাদের সবাইকে,’ শুরু করলো রবিন। বেশি বাগাড়ম্বর না করে সংক্ষেপে স্যার রিচার্ডের দুর্ভাগ্যের কথা জানালো সে সবাইকে। সামান্য টাকার বিনিময়ে এত বিরাট জমিদারী ছিনিয়ে নেয়া হচ্ছে শুনে কঠোর হয়ে গেল রবিনের সমস্ত অনুচরের মুখ। কিন্তু বিশপের মুখটা বিবর্ণ হয়ে আসছে ক্রমেই, মদের পাত্রে চুমুক দিতেও ভুলে গেছেন, এই কাহিনীর অন্তরালে বিপদের আভাস টের পাচ্ছেন যেন তিনি। ঠিকই আঁচ করেছিলেন বিশপ, কাহিনী শেষ করে রবিন ফিরলো তাঁর দিকে। বললো, ‘আপনার কি মনে হয়, লর্ড বিশপ? এটা ঘটতে দেয়া কি উচিত হবে? সমাজের এত উঁচু আসনে অবস্থান আপনাদের, সেখান থেকে আপনাদেরই একজনকে নেমে গিয়ে মাথা নত করে অন্যের গলগ্রহ হতে হচ্ছে, সর্বস্ব খুইয়ে পথের ভিখারী হতে হচ্ছে, একজন ধার্মিক খ্রিস্টান হিসেবে এ ব্যাপারে আপনার কি বক্তব্য?’

কোন জবাব দিলেন না বিশপ, ভাবুক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন মাটির দিকে।

‘গোটা ইংল্যাণ্ডে আপনিই সবচেয়ে ধনী বিশপ,’ আবার বললো রবিন। ‘আপনি কি পারেন না এই বিপদগ্রস্ত নাইটের এমন দুঃসময়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে?’

তবু কোন জবাব দিলেন না বিশপ।

এবার লিটল জনের দিকে ফিরলো রবিন। ‘তুমি আর উইল স্টিউটলি গিয়ে মাল- টানা ঘোড়া পাঁচটাকে নিয়ে এসো এখানে।’ আলো যেখানটায় সবচেয়ে বেশি সেখান থেকে দস্তরখান সরিয়ে জায়গা করে দিল সবাই, ঘোড়া পাঁচটাকে নিয়ে ফিরে এলো লিটল জন আর উইল স্টিউটলি। হাঁক ছাড়লো রবিন, ‘মালপত্রের তালিকা কার কাছে?’

কালো পোশাক পরা তিনজন সন্ন্যাসীর মধ্যে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিটি ভয়ে ভয়ে বললো, ‘আমার কাছে আছে। দয়া করে আমাকে মারধোর করবেন না।’

‘না, ফাদার, কোন ভয় নেই,’ আশ্বাস দিল রবিন। ‘নিরীহ মানুষের কোন ক্ষতি করি না আমি কখনও। তালিকাটা দিন আমার হাতে।’ সন্ন্যাসীর কাছ থেকে মালের তালিকা নিয়ে উইল স্কারলেটের দিকে বাড়িয়ে ধরলো সে।

‘পড়ো দেখি এর এক করে।‘

শুরু করলো উইল স্কারলেটঃ

‘তিন বেল সিল্ক, অ্যাংকাস্টারের টেক্সটাইল ডিলার কুয়েন্টিনের জন্যে।’

‘এটা ছোঁবো না আমরা,’ বললো রবিন। আমরা জানি সৎপথে নিজের চেষ্টায় বড় হয়েছে সে।’ কাজেই না খুলে সিল্কের গাঁট তিনটে সরিয়ে রাখা হলো একপাশে।

‘বিউমন্টের অ্যাবির জন্যে এক বেল সিল্ক মখমল।’

‘সিল্ক মখমল দিয়ে কি করবে পুরোহিতরা?’ নিজেকেই যেন জিজ্ঞেস করলো রবিন। উত্তর দিল নিজেই, ‘ঠিক আছে, যদিও ওদের কাজে লাগছে না এসব, তবু সবটা নেব না আমরা। তিন ভাগ করে ফেল, একভাগ বিক্রি করে টাকাটা দান করা হবে গরীব-দুঃখীদের, এক ভাগ রাখবো আমরা, বাকি ভাগটা নিয়ে যা খুশি করুকগে যাক অ্যাবির সন্ন্যাসীরা।’ কথা মত তিন ভাগ করে দু’ভাগ সরিয়ে রাখা হলো আলাদা জায়গায়, বাকি একভাগ রাখা হলো সিল্কের গাঁটের পাশে।

‘দুই কুড়ি মোমবাতি, সেন্ট টমাসের উপাসনা ঘরের জন্যে।’

‘ওগুলো ওদেরই দরকার, যেমন আছে রেখে দাও কুয়েন্টিনের সিল্কের পাশে।’

এইভাবে একের পর এক পড়ে যেতে থাকলো উইল স্কারলেট, একের পর এক নির্দেশ দিয়ে যেতে থাকলো রবিন, সেই মত ভাগ হয়ে যেতে থাকলো সাথে সাথেই। কোন জিনিস স্পর্শ করলো না রবিন, কিন্তু বেশির ভাগই বস্তা খুলে তিনভাগ করা হলোঃ দানের জন্যে, নিজেদের জন্যে এবং মালিকের জন্যে। সিল্ক, মখমল, সোনার কারুকাজ করা কাপড়, দামী মদ, আরো কত কি প্রায় ভর্তি হয়ে এলো ফাঁকা জায়গাটা। এবার তালিকার সর্বশেষ আইটেম ঘোষণা করা হলোঃ

‘হেরিফোর্ডের লর্ড বিশপের একটি বাক্স।’

ঘোষণা শুনে কেঁপে উঠল বিশপের অন্তরাত্মা। বাক্সটার দিকে না তাকাবার চেষ্টা করছেন তিনি, কিন্তু অবাধ্য চোখ আঠার মত লেগে আছে ওটার গায়ে, সরাতে পারছেন না।

‘কি আছে এর ভেতর, লর্ড বিশপ?’ জানতে চাইলো রবিন।

‘মনে নেই,’ ভূ কুঁচকে জবাব দিলেন বিশপ।

হাসলো রবিন। ‘এর চাবিটা কি আপনার কাছে আছে?’

মাথা নাড়লেন বিশপ। ক্ষীণ আশা ছিল তাঁর মনে, খোলার অসুবিধে দেখে রবিন হয়তো ছোঁবে না বাক্সটা। কিন্তু মূহূর্তে রক্তশূন্য হয়ে গেল তাঁর মুখটা রবিনের পরবর্তী নির্দেশ শুনে।

‘যাও, উইল স্কারলেট, তলোয়ার নিয়ে এসো একটা,’ বললো রবিন। ‘তোমার গায়ে তো খুব জোর, দেখি ডালাটা এক কোপে কাটতে পারো কিনা।’

অল্পক্ষণেই ফিরে এলো উইল স্কারলেট মস্ত এক তলোয়ার নিয়ে। গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে কোপ মারলো সে, কিন্তু কাজ হলো না এক কোপে; লোহার পাত দিয়ে মোড়া বাক্সটা খুলতে প্রয়োজন হলো তিন কোপের। ডালাটা তুলতেই চারপাশে উপচে পড়লো একগাদা সোনার মোহর, মশালের লালচে আলোয় ঝলসে উঠলো সেগুলো। মর্মর ধ্বনির মত একটা বিস্মিত গুঞ্জন বেরোলো উপস্থিত সবার কণ্ঠ থেকে, কিন্তু যেমন ছিল তেমনি দাঁড়িয়ে রইলো সবাই, এক পা এগোলো না সামনে।

‘অ্যালান-এ-ডেল, উইল স্কারলেট আর লিটল জন, তিনজন মিলে গুণে দেখ কত আছে,’ নির্দেশ দিল রবিন।

বেশ অনেকক্ষণ লেগে গেল সব টাকা গুণে হিসেব করতে। সব শেষ হতে উইল স্কারলেট ঘোষণা করলো, মোট আছে পনেরশো সোনার গিনি। টাকা গুণতে গিয়ে এক টুকরো কাগজ পেয়েছে সে, তার উপরের লেখাটাও জোরে পড়ে শুনিয়ে দিল সে সবাইকে। সবাই শুনলো এই টাকাগুলো সংগ্রহ হয়েছে হেরিফোর্ড অঞ্চলের জনসাধারণের কাছ থেকে বিশপের আদায়কৃত খাজনা, জরিমানা ও বাজেয়াপ্তের মাধ্যমে।

বিশপের দিকে ফিরলো রবিন হুড। ‘মাননীয় লর্ড বিশপ, বাক্সের ভিতর কি আছে তা যখন আপনার মনেই ছিল না, ইচ্ছে করলে আমি আপনার মনে পড়িয়ে না দিলেও পারতাম। আপনার সামনে বাক্সটা না খুললেও চলতো। আসলে আপনাকে ন্যাংটো করে ছেড়ে দেয়ার ইচ্ছে আমার নেই। বাক্সে যা আছে তার তিন ভাগের এক ভাগ আপনি নিয়ে যেতে পারবেন। আপনার এবং আপনার লোকজনের আমোদ-প্রমোদ ও ভোজের খরচ বাবদ এক ভাগ রাখছি আমি। বাকি একভাগ যাবে দান খয়রাতে। শুনেছি, জীবনে একটা পয়সা দান করেননি আপনি কাউকে, এবার আপনাকে কিছু পুণ্য কামাই করে দেব আমরা।’

হেঁট হয়ে যাওয়া মাথা উঁচু করলেন বিশপ, কিন্তু কথা বললেন না একটাও। তিন ভাগের একটা ভাগ, ফেরত পাচ্ছেন জেনে নিজের ইষ্টদেবতাকে ধন্যবাদ দিলেন তিনি মনে মনে।

লী-র নাইট স্যার রিচার্ডের দিকে ফিরলো এবার রবিন। ‘স্যার রিচার্ড, এক ধর্ম ব্যবসায়ী রক্ত-চোষার খপ্পরে পড়ে সম্পত্তি হারাতে বসেছিলেন আপনি, ওদেরই আর একজনের উপচে পড়া টাকা দিয়ে যদি এমেটের লোভী মোহান্তকে ঠেকানো যায়, তাহলে আমার মনে হচ্ছে বিচারটা ন্যায্য হয়। কি বলেন? এখান থেকে চারশো পাউণ্ড আপনার হাতে তুলে দিচ্ছি আমরা, মোহান্তের ধার শোধ করে ছাড়িয়ে নিন আপনার সম্পত্তি।’

থ হয়ে রবিন হুডের মুখের দিকে চেয়ে রইলেন স্যার রিচার্ড অনেকক্ষণ, যেন কি বললো রবিন বুঝতে পারেননি তিনি, তারপর ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে এলো তাঁর চোখের দৃষ্টি। বললেন, ‘তোমাকে কি বলে যে ধন্যবাদ দেব, রবিন, জানি না। তোমার মহৎ মনের পরিচয় পেয়ে সত্যিই আমি আন্তরিক কৃতজ্ঞ বোধ করছি। কিছু মনে করো না, ভাই, তোমার দান আমি গ্রহণ করতে পারছি না।’

‘কেন?’

‘আমার স্ত্রীকে আত্মীয়-স্বজনের দয়া দাক্ষিণ্যের অবমাননা থেকে রক্ষা করতে আমি আরেকজনের দান গ্রহণ করতে পারি না। ভালবাসার দান হলেও না। তবে যদি ধার হিসেবে দাও, নিতে পারি। ঠিক এক বছর এক দিনের দিন ফেরত দেব আমি এই টাকা হয় তোমার কাছে, নয়তো হেরিফোর্ডের লর্ড বিশপের কাছে।’

‘বেশ,’ হাসলো রবিন, ‘ধার হিসেবেই নাহয় নেবেন। কিন্তু বিশপকে ফেরত দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আমার হাতে দেবেন, আমি বিলিয়ে দেব গরীব-দুঃখীর মধ্যে।’

রবিনের নির্দেশে একটা চামড়ার থলিতে ভরা হলো চারশো পাউণ্ড স্যার রিচার্ডের জন্যে।

উঠে দাঁড়ালেন স্যার রিচার্ড। ‘এবার আমাকে উঠতে হয়, রবিন। বেশি দেরি দেখলে উদ্বিগ্ন হবেন আমার স্ত্রী।’

সবাই উঠে দাঁড়ালো স্যার রিচার্ডের সম্মানে। রবিন বললো, ‘কিন্তু আপনাকে তো এভাবে একা ছেড়ে দেয়া যায় না, স্যার রিচার্ড। পথ হারিয়ে ফেলবেন জঙ্গলে।’

এগিয়ে এলো লিটল জন। ‘অনুমতি দিলে সাজ-পোশাক পরা বিশজন লোক নিয়ে আমি এগিয়ে দিয়ে আসতে পারি ওঁকে।’

‘ঠিকই বলেছো, লিটল জন,’ বললো রবিন, ‘যুদ্ধের পোশাক পরে নিতে বলো বিশজনকে। উপযুক্ত সম্মানের সাথে এগিয়ে দিয়ে এসো স্যার নাইটকে।’

এগিয়ে এলো উইল স্কারলেট। ‘গলায় সোনার চেন আর পায়ের গোড়ালিতে সোনার স্পার ছাড়া ঠিক মানাচ্ছে না স্যার রিচার্ডকে, ওগুলো হলে ঠিক নাইটের মতই লাগতো দেখতে।’

‘ঠিকই বলেছো, উইল স্কারলেট,’ বললো রবিন, ‘সোনার চেন আর সোনার স্পার দিয়ে সাজিয়ে দাও স্যার নাইটকে।’

এগিয়ে এলো উইল স্টিউটলি। ‘রবিন হড আর তার প্রিয় অনুচরদের তরফ থেকে স্যার রিচার্ডের স্ত্রীর জন্যে ওই মখমলের গাঁট আর সোনার কারুকাজ করা কাপড়গুলো যদি উপহার হিসেবে যায়, তাহলে কেমন হয়?’

এই প্রস্তাবে সবাই খুশি হয়ে হাততালি দিয়ে উঠলো। রবিন বললো, ‘ঠিকই বলেছো, উইল স্টিউটলি। তাই করো।’

এই প্রাণঢালা ভালোবাসার বহর দেখে বাক রুদ্ধ হয়ে গেল স্যার রিচার্ডের। স্তম্ভিত দৃষ্টিতে চারপাশে সবার মুখের দিকে চাইলেন তিনি, তারপর অতিকষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে আবেগ-কম্পিত কণ্ঠে বললেন, ‘তোমরা দেখে নিয়ো, বন্ধুগণ, তোমাদের এই ভালবাসা আর কৃপার কথা কোনদিন ভুলবে না লী-র স্যার রিচার্ড। তোমাদের জন্যে আজ থেকে আমার দুর্গ-তোরণ খোলা রইলো। যদি কোনদিন কোন প্রয়োজন পড়ে, কিংবা কোন বিপদ হয়, বিনা দ্বিধায় চলে এসো আমাদের কাছে। আমি বা আমার স্ত্রী বেঁচে থাকতে দুর্গের প্রতিটা দেয়াল গুঁড়িয়ে না দিয়ে কেউ তোমাদের গায়ে হাত তুলতে পারবে না। আমাকে তোমরা…আমি তোমাদের-’ আর কিছু বলতে পারলেন না তিনি, চট করে মুখটা ফিরিয়ে নিলেন একপাশে।

অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে লাইন করে দাঁড়ালো বিশজন অনুচর লিটল জনের পিছনে। রবিন হুড এগিয়ে এসে একটা সোনার চেন পরিয়ে দিল স্যার রিচার্ডের গলায়। ইতিমধ্যেই সোনার স্পার এঁটে দিয়েছে উইল স্কারলেট তাঁর পায়ের গোড়ালিতে। ঘোড়াটা নিয়ে এলো লিটল জন, তাতে উঠে বসলেন নাইট। কিছুক্ষণ রবিনের দিকে চেয়ে রইলেন স্যার রিচার্ড, তারপর হঠাৎ ঝুঁকে চুমো খেলেন তার গালে। বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্যে দিয়ে রওনা হয়ে গেল ওরা, মশালের আলোয় ঝকঝক করছে তীক্ষ্ণ বর্শার ফলাগুলো, চমৎকার দেখাচ্ছে। বাঁক নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল দলটা।

‘আমারও উঠতে হয়,’ বললেন হেরিফোর্ডের বিশপ। ‘রাত হয়ে যাচ্ছে অনেক।’

একটা হাত রাখলো রবিন বিশপের বাহুতে। ‘অত তাড়াহুড়ো করবেন না, লর্ড বিশপ,’ বললো সে। ‘এমেটের মোহান্তের কাছ থেকে স্যার রিচার্ড বন্ধক ছাড়িয়ে নেয়ার আগে আপনাকে আমরা হাতছাড়া করতে পারি না। আপনার তরফ থেকে কোন গোলমালে পড়ুক স্যার রিচার্ড তা চাই না বলেই তিনটে দিন আমাদের সাথে থাকছেন আপনি। শুনেছি, শিকারের খুব শখ আপনার; দেখবেন, চোখের পলকে কেটে যাবে তিন দিন। তিনটে দিন মহানন্দে কাটিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় রীতিমত খারাপই লাগবে আপনার।’

রবিনের কথাই সত্য হলো। মন খারাপ হয়ে গেল বিশপের এই মজার জীবন ছেড়ে আবার কাজকর্মের মধ্যে ফিরে যেতে হচ্ছে বলে। কিন্তু সেটা সাময়িক, বিরক্তির ভাবটাই প্রকট হয়ে রইলো তাঁর মনে। অবশিষ্ট মালপত্র সহ রওনা হয়ে গেলেন তিনি। একদল লোক দিল রবিন সাথে, যেন আর কোন ডাকাতের পাল্লায় পড়ে এটুকুও খোয়া না যায়।

যেতে যেতে প্রতিজ্ঞা করলেন বিশপ মনে মনেঃ একদিন সুযোগ পাবই, রবিন, কড়ায় গণ্ডায় শোধ তুলে নেব সেদিন। তুমি এখনও চেনোনি আমাকে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *