দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
দত্তকুলের প্রহ্লাদ
রাত্রি আন্দাজ সাড়ে আটটার সময় সাধারণ ঝিন্দী সৈনিকের বেশ পরিধান করিয়া গৌরী ও রুদ্ররূপ বাহির হইবার জন্য প্রস্তুত হইল। যে কক্ষটায় সাজসজ্জা হইতেছিল সেটা রাজার সিঙার-ঘর–অথাৎ ড্রেসিং রুম। চম্পাদেঈ ও ধনঞ্জয় উপস্থিত ছিলেন।
মাথার উপর প্রকাণ্ড জরীদার রেশমী পাগড়ি বাঁধিয়া গৌরী আয়নার সম্মুখীন হইয়া দেখিল, এ বেশে সহসা কেহ তাহাকে চিনিতে পারিবে না। চম্পা ও ধনঞ্জয়ের দিকে ফিরিয়া সহাস্যে জিজ্ঞাসা করিল–কেমন দেখাচ্ছে?
ধনঞ্জয় গলার মধ্যে কেবল একটা শব্দ করিলেন; চম্পা সপ্রশংস নেত্রে চাহিয়া বলিল— ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে। আপনি যদি ভিখিরির সাজপোশাক পরেন, তবু আপনাকে রাজার মতই দেখায়।
গৌরী মুখের একটু ভঙ্গিমা করিয়া বলিল— তা বটে। বনেদী রাজা কিনা। এখন চললাম। তুমি কিন্তু লক্ষ্মী মেয়েটির মত ঘুমিয়ে পড় গিয়ে আমার জন্য জেগে থেকো না। যদি জেগে থাকো, কাল সকালেই তোমাকে বাপের কাছে পাঠিয়ে দেব।
এতবড় শাসনবাক্যে ভীত হইয়া চম্পা ক্ষীণস্বরে বলিল— আচ্ছা।
চম্পাকে জব্দ করিবার একটা অস্ত্র পাওয়া গিয়াছে বুঝিয়া গৌরী মনে মনে হৃষ্ট হইয়া উঠিল।
ধনঞ্জয় বিরস গম্ভীরমুখে বলিলেন– আপনি ফিরে না আসা পর্যন্ত আমাকে কিন্তু জেগে থাকতে হবে।
অপরাহ্নে ধনঞ্জয়ের প্রতি রূঢ়তায় গৌরী মনে মনে একটু অনুতপ্ত হইয়াছিল, বলিল— তা বেশ তো সর্দার। কিন্তু বেশীক্ষণ জাগতে হবে না, আমরা শিগগির ফিরব।
প্রাসাদের পাশের একটি ছোট ফটক দিয়া দুইজনে পদব্রজে বাহির হইল। ফটকের শাস্ত্রী রুদ্ররূপের গলা শুনিয়াই পথ ছাড়িয়া দিল, তাহার সঙ্গীটি কে তাহা ভাল করিয়া দেখিল না।
প্রাসাদের প্রাচীর-বেষ্টনী পার হইয়া উভয়ে সিংগড়ের কেন্দ্রস্থলে—যেখানে প্রকৃত নগর—সেইদিকে যাত্রা করিল।
নগরে তখনো রাজ-অভিষেকের উৎসব সম্পূর্ণ শেষ হয় নাই, এখনো গৃহে গৃহে দীপালি জ্বলিতেছে, দোকানে দোকানে পতাকা মালা ইত্যাদি দুলিতেছে, তবু আনন্দের প্রথম উদ্দীপনা যে অনেকটা ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছে তাহাতে সন্দেহ নাই। ছোট্ট রাজ্য হইলেও রাজধানীটি বেশ বড় এবং সমৃদ্ধ। শহরের যেটি প্রধান বাজার, তাহাতে বহু লোকের ব্যস্ত গমনাগমন ও যানবাহনের অবিশ্রাম। গতায়াত বাণিজ্যলক্ষ্মীর কৃপাদৃষ্টির ইঙ্গিত করিতেছে। অপেক্ষাকৃত সঙ্কীর্ণ রাস্তার দুই ধারে উচ্চ তিন-চারতলা ইমারৎ। কলিকাতার বড়বাজারের সঙ্কুচিত সংস্করণ বলিয়া মনে হয়।
উৎসুক চক্ষে চারিদিকে দেখিতে দেখিতে গৌরী নিজের বর্তমান অবস্থার কথা প্রায় ভুলিয়া গিয়াছিল। সে যে গৌরীশঙ্কর রায়— এখানে আসিবার পর হইতে এই কথাটা একপ্রকার চাপা। পড়িয়া গিয়াছিল; অভিনয় করিতে করিতে অভিনেতাটির মনেও একটু আত্মবিস্মৃতি জন্মিয়াছিল। কিন্তু এখন সে আবার নিজের চোখ দিয়া দেখিতে দেখিতে এই নূতনত্বের রস আস্বাদন করিতে করিতে চলিল। যেন বহুদিন পরে নিজের হারানো সত্তাকে ফিরিয়া পাইল।
শহরের জনাকীর্ণ রাস্তায় তাহাদের মত বেশধারী বহু ফৌজী সিপাহী ও নায়ক হাবিলদার প্রভৃতি ক্ষুদ্র সেনানী ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল। উপরন্তু এই রাজ্যাভিষেক পর্ব উপলক্ষে জঙ্গী য়ুনিফর্ম পরা একটা ফ্যাশান হইয়া দাঁড়াইয়াছিল–তাই গৌরী ও রুদ্ররূপ কাহারো বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করিল না।
বাজারের চৌমাথায় এক পানওয়ালীর দোকানে খুশবুদার পান কিনিবার জন্য গৌরী দাঁড়াইল। দোকানের সম্মুখে বেশ ভিড় ছিল কারণ এ দোকানের পান শুধু বিখ্যাত নয়, পানওয়ালীও রূপসী এবং নবযৌবনা। রুদ্ররূপ পান কিনিবার জন্য ভিড়ের মধ্যে ঢুকিল।
বাহিরে দাঁড়াইয়া অলসভাবে এদিক ওদিক চাহিতে চাহিতে হঠাৎ গৌরীর নজরে পড়িল, অনতিদূর রাস্তার অপর পারে একটা মণিহারীর দোকান। দোকানটি বেশ বড়, কাচ-ঢাকা জানালায় বিলাতী প্রথায় বহুবিধ মূল্যবান ও চিত্তাকর্ষক পণ্য সাজানো রহিয়াছে এবং প্রবেশদ্বারের মাথার উপর বড় বড় সোনালী অক্ষরে সাইন-বোর্ড লেখা রহিয়াছে—
প্রহ্লাদচন্দ্র
দত্ত
মণিহারীর দোকান
গৌরীর একটু ধোঁকা লাগিল। প্রহ্লাদচন্দ্র দত্ত! বাঙালী নাকি? প্রহ্লাদ নামটা বাঙালীর মধ্যে খুব চলিত নয় কিন্তু প্রহ্লাদচন্দ্র! ভারতবর্ষের অন্য কোনো জাতি তো নামের মধ্যস্থলে চন্দ্র ব্যবহার করে না। শুধু প্রহ্লাদ দত্ত হইলে অন্য জাতি হওয়া সম্ভব ছিল। গৌরী উত্তেজিত হইয়া উঠিল-বাঙালীর সন্তান এই সুদূর বিদেশে আসিয়া ব্যবসা ফাঁদিয়া বসিয়াছে!
রুদ্ররূপ সুগন্ধি মশলাদার পান আনিয়া হাতে দিতেই গৌরী জিজ্ঞাসা করিল— রুদ্ররূপ, ঐ দোকানের সাইন-বোর্ড দেখছ? কোন্ দেশের লোক আন্দাজ করতে পার?
রুদ্ররূপ বলিল— না। পাঞ্জাবি হতে পারে।
গৌরী বলিল— উহু, বোধ হয় বাঙালী। এস দেখা যাক।
রাস্তা পার হইয়া উভয়ে দোকানে প্রবেশ করিল। দোকানের ভিতরটি বেশ সুপরিসর–গোটা চারেক ডে-লাইট ল্যাম্প মাথার উপর জ্বলিতেছে। দূরে ঘরের পিছন দিকে দোকানদারের গদি।
দোকানে প্রবেশ করিয়া প্রথমে গৌরী কাহাকেও দেখিতে পাইল না। তারপর দেখিল, গদির বিছানার উপর মুখোমুখি বসিয়া দুইজন লোক নিম্নস্বরে কথা কহিতেছে–তুমি না গেলে চলবে না, আমাকে এখনি ফিরতে হবে, সকালে স্টেশনে হাজির থাকা চাই। না, আজ আমি পারব না, আমার অনেক কাজ।—এক পক্ষের অনিচ্ছা ও অন্য পক্ষের সাগ্রহ উপরোধ, অস্পষ্টভাবে গৌরী শুনিতে পাইল।
রুদ্ররূপ একবার তাহাদের দিকে চাহিয়াই চোখ ফিরাইয়া লইল, মৃদুস্বরে বলিল –পেছন ফিরে দাঁড়ান, চিনতে পারবে।
দুইজনে পিছন ফিরিয়া জানালার পণ্য দেখিতে লাগিল। গৌরী জিজ্ঞাসা করিল—কে ওরা?
একজন ঝিন্দের স্টেশনমাস্টার স্বরূপদাস—অন্যটি বোধ হয় দোকানদার। চলুন, এখানে আর থেকে কাজ নেই।
একটু দাঁড়াও।
মিনিট পাঁচেক পরে স্টেশনমাস্টার অসন্তুষ্টভাবে বকিতে বকিতে চলিয়া গেল। তাহার কয়েকটা অসংলগ্ন কথা গৌরীর কানে পৌঁছিল— এই রাত্রে শক্তিগড় যাওয়া…কাল সকালেই আবার স্টেশন…
শক্তিগড় শুনিয়া গৌরী কান খাড়া করিয়াছিল, কিন্তু আর কিছু শুনিতে পাইল না।
এতক্ষণে দোকানদারের হুঁশ হইল যে, দুইজন গ্রাহক দোকানে আসিয়াছে। সে উঠিয়া আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল—ক্যা চাহিয়ে বাবুসাব?
পশ্চিমী ধরনে কাপড় ও ছিটের চুড়িদার পাঞ্জাবি পরা দোকানদারকে দেখিয়া বা তাহার কথা শুনিয়া কাহার সাধ্য আন্দাজ করে যে সে পুরাপুরি খোট্টা নয়! গৌরী তাহার সম্মুখীন হইল; তাহার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিয়া বাংলা ভাষায় বলিল— তুমি বাঙালী?
লোকটি প্রথমে একটু ভ্যাবাচাকা খাইয়া গেল, তারপর তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে গৌরীর মুখের দিকে চাহিয়াই সভয়ে দুই পা পিছাইয়া গিয়া আভূমি অবনত হইয়া অভিবাদন করিল। চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া দুইবার ঢোক গিলিয়া বলিল— হ্যাঁ, আমি বাঙালী। মহারাজ–আপনি— আপনি
চুপ। গৌরী ঠোঁটের উপর আঙুল রাখিল— তুমি কতদিন এখানে আছ?
হাতজোড় করিয়া প্রহ্লাদ বলিল—আজ্ঞে, প্রায় পনের বছর। এখানেই বসবাস করছি।
গৌরী জিজ্ঞাসা করিল— তুমি কায়স্থ? বাড়ি কোন্ জেলায়?
প্রহ্লাদ বলিল— আজ্ঞে কায়স্থ, বাড়ি বীরভূম জেলায়। কিন্তু পনের বছর দেশের মুখ দেখিনি। মাঝে মাঝে যেতে বড় ইচ্ছে করে, কিন্তু কারবার ফেলে যেতে পারি না।
দেশে তোমার আত্মীয়স্বজন কেউ নেই।
আজ্ঞে না। দুর সম্পর্কের খুড়ো জ্যাঠা যারা ছিল তারা বোধ হয় এতদিনে মরে হেজে গেছে। আমি এই দেশেই বিবাহদি করেছি।
বাংলা দেশের কায়স্থ সন্তান ঝিন্দে আসিয়া কিভাবে বিবাহদি করিয়া ফেলিল, গৌরী ঠিক বুঝিল না; কিন্তু প্রহ্লাদ লোকটিকে তাহার মনে মনে বেশ পছন্দ হইল। সে যে অত্যন্ত চতুর লোক এই সামান্য কথাবাতাতেই তাহা সে বুঝিতে পারিয়াছিল। গৌরী বলিল–বেশ বেশ, খুব খুশি হলাম। আমাকে যখন চিন্তে পেরেছ তখন বলি, আমি অপ্রকাশ্যভাবে নগর পরিদর্শন করতে বেরিয়েছি, একথা জানাজানি হয় আমার ইচ্ছা নয়। তুমি হুঁশিয়ার লোক, তোমাকে বেশী বলবার দরকার নেই।–এখন তোমার দোকানে উপহার দেবার মত ভাল জিনিস কি আছে দেখাও।
যে-আজ্ঞে মহাশয়! প্রহ্লাদ ভালমানুষের মত একটু বিনীত হাস্য করিয়া বলিল–আপনি এত সুন্দর বাংলা বলেন যে আশ্চর্য হতে হয়। বাঙালী ছাড়া এরকম বাংলা বলতে আমি আর কাউকে শুনিনি।
তাহার মুখের উপর দৃষ্টি স্থাপিত করিয়া গৌরী বলিল— তাই নাকি? তবে কি তোমার মনে হয় আমি বাঙালী?
না না—সে কি কথা মহারাজ! আমি বলছিলাম—
আমি অনেকদিন বাংলা দেশে ছিলাম, তাই ভাল বাংলা বলতে পারি—বুঝলে?
প্রহ্লাদ তাড়াতাড়ি সম্মতি-জ্ঞাপক ঘাড় নাড়িল; তারপর স্বয়ং অগ্রগামী হইয়া দোকানের বহুবিধ সৌখীন ও মহার্ঘ্য পণ্যসম্ভার দেখাইতে লাগিল।
গজদন্ত ও সোনারূপার কারুশিল্পের জন্য ঝি প্রসিদ্ধ; অধিকন্তু অন্যান্য দেশ-বিদেশের বাহারে শিল্পও আছে। গৌরী পছন্দ করিয়া কয়েকটি জিনিস কিনিল। কিনিবার প্রয়োজন ছিল বলিয়া নয়, স্বদেশবাসী দোকানদারের প্রতি মমতাবশত প্রায় পাঁচ-সাত শত টাকার জিনিস খরিদ হইয়া গেল। গৌরী মনে মনে স্থির করিল খেলনাগুলি সে চম্পাকে উপহার দিবে।
একটি বৈদ্যুতিক টর্চ গৌরীর ভারি পছন্দ হইল। হাতির দাঁতের একটি ভুট্টা–প্রায় নয় ইঞ্চি লম্বা–তাহার ভিতরটা ফাঁপা, সে পুরিবার ব্যবস্থা আছে; সম্মুখে কাচ বসানো। ভুট্টার গায়ে একটি মাত্র লাল দানা আছে, সেটি টিপিলেই বিদ্যুৎ বাতি জ্বলিয়া উঠে।
টর্চটি হাতে লইয়া গৌরী বলিল— এটা আমি সঙ্গে নিলাম। বাকীগুলো প্রাসাদে পাঠিয়ে দিও–কাল দাম পাবে।
আহ্লাদিত প্রহ্লাদ করজোড়ে বলিল—যো হুকুম।
দোকান হইতে বাহির হইয়া দুইজনে নীরবে দক্ষিণমুখে চলিল। এই পথই ঋজু রেখায় গিয়া কিস্তার পুলের উপর দিয়া ঝড়োয়ায় পৌঁছিয়াছে।
ক্রমে দোকানপাট শেষ হইয়া পথ জনবিরল হইতে আরম্ভ করিল। দুইপাশে আর ঘনসন্নিবিষ্ট বাড়ি নাই— মাঝে মঝে তরুবীথি; তরুবীথির পশ্চাতে কচিৎ দুই একখানা বড় বড় বাড়ি। অধিকাংশই ফাঁকা মাঠ।
ঝিন্দের পথে আলোকের ব্যবস্থা ভাল নয়, বিদ্যুৎ এখনো সেখানে প্রবেশ লাভ করে নাই। দূরে দূরে এক একটা কেরোসিন ল্যাম্পের স্তম্ভ; তাহা হইতে যে ক্ষীণ আলোক বিকীর্ণ হইতেছে পথ চলার পক্ষে তাহা যথেষ্ট নয়। নবক্রীত টর্চটা মাঝে মাঝে জ্বালিয়া গেীরী চলিতে লাগিল।
মাইলখানেক পথ এইভাবে চলিবার পর একটা প্রকাণ্ড কম্পাউণ্ডের লোহার রেলিং রাস্তার ধার দিয়া বহু দূর পর্যন্ত গিয়াছে দেখিয়া গৌরী টর্চের আলো ফেলিয়া ভিতরটা দেখিবার চেষ্টা করিল। বিশেষ কিছু দেখা গেল না, কেবল একটা অন্ধকার-দর্শন বাড়ির আকার অস্পষ্টভাবে চোখে পড়িল। রুদ্ররূপ বলিল—এটা উদিতের বাগানবাড়ি।
আরো কিছুদূর যাইবার পর বাগানবাড়ির উঁচু পাথরের সিংদরজা চোখে পড়িল। তাহারা সিংদরজার প্রায় সম্মুখীন হইয়াছে, এমন সময় দ্রুত অশ্বক্ষুরধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে একটা ফিটন গাড়ি কম্পাউণ্ডের ভিতর হইতে বাহির হইয়া আসিল। রাস্তায় পড়িয়াই গাড়ি বিদ্যুদ্বেগে উত্তরদিকে মোড় লইল, গৌরী ও রুদ্ররূপ লাফাইয়া সরিয়া না গেলে গাড়িখানা তাহাদের ঘাড়ের উপর আসিয়া পড়িত। গৌরী গাড়ির পথ হইতে সরিয়া গিয়াই গাড়ির উপর টর্চের আলো ফেলিল। নিমেষের জন্য একটা পরিচিত মুখ সেই আলোতে দেখা গেল; তারপর জুড়ী-ঘোড়ার গাড়ি তীরবেগে অন্ধকার পথে অদৃশ্য হইয়া গেল।
গৌরী পিছন ফিরিয়া ক্রমশ ক্ষীয়মান চক্ৰধ্বনির দিকে দৃষ্টি প্রেরণ করিয়া কহিল স্টেশনমাস্টার স্বরূপদাস। শক্তিগড়ে যাবার জন্যে ভারি তাড়া দেখছি। একটু ভাবিয়া জিজ্ঞাসা করিল—গাড়িখানা উদিতের—না?
রুদ্ররূপ বলিল— হ্যাঁ। এইখানেই উদিত সিংয়ের আস্তাবল।
গৌরী কতকটা নিজমনেই বলিল— উদিতকে কি খবর দিতে গেল কে জানে। জরুরী খবর নিশ্চয়।
একটা এলোমেলো ঠাণ্ডা হাওয়া বহিতেছিল। গৌরী আবার চলিতে আরম্ভ করিয়াছে এমন সময় উদিতের ফটকের ভিতর হইতে একখণ্ড কাগজ বাতাসে ওলট-পালট খাইতে খাইতে তাহার প্রায় পায়ের কাছে আসিয়া পড়িল। টর্চের আলো ফেলিয়া গৌরী দেখিল–একটা টেলিগ্রাম-কৌতূহলবশে তুলিয়া লইয়া পড়িল, তাহাতে লেখা রহিয়াছে–
স্বরূপদাস–স্টেশনমাস্টার ঝিন্দ্
সন্ধান পাইয়াছি, গৌরীশঙ্কর রায় বাঙালী জমিদার চেহারা অবিকল–
কিষণলাল।
টেলিগ্রামখানা মুড়িয়া গৌরী পকেটে রাখিল। একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল— যাক, জানতে পেরেছে তাহলে। এইজন্যে এত তাড়া।
পথে আর বিশেষ কোনো কথা হইল না। রুদ্ররূপ দুই-একটা প্রশ্ন করিল বটে, কিন্তু গৌরী নিজের চিন্তায় নিমগ্ন হইয়া রহিল, উত্তর দিল না। একসময় বলিল–প্রহ্লাদও তাহলে ওদের দলে।