১২. তিন দিন হল রাশেদ উকিল বাড়িতে আছে

তিন দিন হল রাশেদ উকিল বাড়িতে আছে। একতলা পাকা দালান। বাড়ির পেছনে পুকুর। চারদিকে জঙ্গল। একসময় পুকুরের ঘাট বাঁধানো ছিল। এখন ভেঙে পড়েছে।

মূল বাড়িও ভেঙেছে। কোথাও কোথাও দেয়াল ধসে পড়েছে। ছাদের অবস্থা ভয়াবহ। বৃষ্টি হলেই ছাদ চুইয়ে পানি পড়ে।

একটা ঘর মোটামুটি ঠিক আছে। তবে দরজা নেই। রাশেদ চৌকি কিনে সেখানেই বিছানা পেতেছে। বিছানা বলতে শীতল পাটি, একটা বালিশ। সে হারিকেন কিনেছে দুটা। একটা দিন-রাত সারাক্ষণই তার চৌকির নিচে জ্বালিয়ে রাখে। যেন ঘরে সাপ আসতে না পারে। রাশেদের ধারণা বাড়িভর্তি সাপ। ইটের ভাঙ্গাবাড়ি সাপদের বাসস্থানের জন্যে আদর্শ। তবে সে যেহেতু সাপদের বিরক্ত করছে না। সাপরাও সম্ভবত তাকে বিরক্ত করবে না।

বাড়ির দারা ঠিক আছে। ইদারা তেমন ভাঙে নি। ইদারার পানিও ভাল। ইদারার বাঁধানো অংশে বসে থাকতে রাশেদের ভাল লাগে। তার বাবা যখন বাড়ি থাকতেন বেশির ভাগ সময় এই জায়গায় বসে থাকতেন। মন ভাল থাকলে রাশেদের সঙ্গে গল্প করতেন, ও বাবা রাশেদ! আমার দাদা অর্থাৎ তোমার বড় বাবা জ্বীন সাধক ছিলেন এটা জান?

না।

তাঁর পালা একটা জ্বীনের মৃত্যু হয়েছিল। দাদাজান মানুষের মতো তারে কবর দেন।

কোথায়?

বাড়ির পেছনে যে জঙ্গল আছে, সেইখানে পাকা কবর আছে। কবরের গায়ে আরবিতে লেখা তালিব। মনে হয় এইটাই জ্বীনের নাম। কবর দেখতে চাইলে একদিন নিয়া যাব। অজু করে যেতে হয়। যেতে চাও?

চাই।

আচ্ছা একদিন নিয়া যাক। এই জ্বীন দাদাজানরে টাকা-পয়সা আইন্যা দেয়। তিনি পাকা ঘর তুলেন। শুনেছি ঘর তুলতেও জ্বীন সাহায্য করেছে।

এইসব কি সত্য বাবা?

জানি না।

 

রাশেদ এসেছে শুনে তার দূর সম্পর্কের চাচা হাকিম উদ্দিন দ্বিতীয় রাতে হ্যাজাক লাইট জ্বালিয়ে দেখা করতে এসেছেন। ধমক দিয়ে বলেছেন, ভাইস্তা ব্যাটা তোমার কি মাথা খারাপ হইছে? চল আমার সাথে আমার বাড়িত থাকবা। এইখানে থাকলে সাপে কাটব। বাড়িভর্তি সাপ। গত বিষুদবারে এই বাড়ির উঠানে সাপে কাটছে।

রাশেদ বলল, ব্যবস্থা নিয়েছি চাচা। কার্বলিক এসিড দিয়েছি। দুটা হারিকেন সারারাত জ্বলে। মশারি কিনেছি, রাতে মশারি খাটিয়ে ঘুমাই। এই বাড়িতে থাকা আমার জন্যে বিশেষ প্রয়োজন।

প্রয়োজনটা কি?

আমি একটা মিরাকলের জন্যে অপেক্ষা করছি। এই বাড়িতে থাকলেই মিরাকলটা ঘটবে। অন্য কোধাও থাকলে ঘটাবে না।

মিরাকল জিনিসটা কি?

অসম্ভব কোনো ঘটনা। যা হবার কথা না তা হওয়া।

ভাত খাইবা কই?

সেটা নিয়ে এখনো চিন্তা করি নি। ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

ব্যবস্থা কে করব? আসমান থাইকা টিফিন কেরিয়ার হাতে নিয়া ফিরিশতা নামব?

যদি নামে সেটাও হবে একটা মিরাকল।

হাকিম উদ্দিন বললেন, যেতে না চাও জোর করে নিব না। তিন বেলা খাওয়া আমি পাঠাব। তোমার নেংটা কালে তোমাকে দেখেছি, এখন এত বড় হইছ। শুনছি বড় ডাক্তারও না-কি হইছ। আমার শূলবেদনা আছে। ডাক্তার কবিরাজ অনেক করাইছি, ফায়দা হয় নাই। শূলবেদনার একটা চিকিৎসা দিয়া যাবা।

রাশেদ হাসতে হাসতে বলল, আমি নকল ডাক্তার চাচা। রোগ-ব্যাধির ডাক্তার না। লেখাপড়ার ডাক্তার।

ও আচ্ছা। তোমার কি কি জিনিস লাগবে বল। বাড়িতে গিয়া পাঠাব। ফুটফরমাশ খাটার জন্য একজন আসবে তার নাম ইয়াসিন। চোখে চোখে রাখবা, বিরাট চোর।

চাচা আমার কিছু লাগবে না। শুধু যদি বইপত্র কিছু থাকে পাঠিয়ে দেবেন। আমি পড়ার কিছু নিয়ে আসি নি। রাতে কিছুক্ষণ বই না পড়লে আমার ঘুম আসে না।

বইপত্র কই পাব? বাড়িতে লেখাপড়ার কোনো কারবারই নাই। বিষাদসিন্ধু থাকতে পারে। বিষাদসিন্ধু পড়বা?

হ্যাঁ পড়ব। সাদা কাগজ পাঠাতে পারবেন?

এইটা পারব। কাগজ কলম সবই আছে। যে বাড়িতে লেখাপড়া নাই, সেই বাড়িতে কাগজ কলম থাকে। যাই হোক, শখ কইরা থাকতে আসছ। পূর্ব পুরুষের বাস্তুভিটা। থাক এক রাইত। তারপর আমার এইখানে চইল্যা আসবা। আমি ঘর ঠিক কইরা রাখব। পল্লী বিদ্যুতের লাইন নিয়েছি। মাঝে মধ্যে পাখা চলে। যে গরম পড়েছে। পাখা ছাড়া গতি নাই।

 

রাশেদের তেমন কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। ঘুমুতে যাবার আগে বিষাদসিন্ধু পড়ছে। তার চাচা বিষাদসিন্ধু ছাড়াও মহুয়া সুন্দরীর কাহিনী এবং চল্লিশ আউলিয়ার কেরামত নামের দুটি বই পাঠিয়েছেন। কাগজ কলম পাঠিয়েছেন। রাশেদ বই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে চিঠি লিখছে। চিঠি লেখা হচ্ছে রূপা ব্যানার্জিকে। এক নাগারে লিখছে না। থেমে থেমে লিখছে। কারণ পাশাপাশি সে ঢাকার রূপাকেও চিঠি লিখছে। রাশেদের খুব ইচ্ছা দুটা চিঠিই যেন একই রকম হয়। সামান্য উনিশ বিশ হতে পারে। বেশি না।

রূপা (ব্যানার্জি)

কেমন আছ?

আমি পালিয়ে আছি।

এমন জায়গায় পালিয়েছি যে তুমি আমাকে খুঁজে বের করতে পারবে না।

তুমি আমার জীবনে শনি গ্রহের মত উপস্থিত হয়েছ।

তুমি ভয়ংকরভাবে আমার প্রেমে পড়েছ এটা আমি জানি। ভালবাসাবাসির ব্যাপারটা হাততালির মত। দুটা হাত লাগে। এক হাতে তালি বাজে না। অর্থাৎ একজনের ভালবাসায় হয় না।

তুমি কি জান আমার প্রতিটি দুঃস্বপ্নে তুমি থাক।

 

রূপা (ঢাকা)

কেমন আছেন?

আমি পালিয়ে আছি।

এমন জায়গায় পালিয়েছি যে একটু চেষ্টা করলেই আপনি আমাকে খুঁজে বের করতে পারবেন।

আপনি আমার জীবনে ধ্রুবতারার মত এসেছেন।

আমি ভয়ংকভাবে আপনার প্রেমে পড়েছি এটা আপনি জানেন না। ভালবাসাবাসির ব্যাপারটা হাততালির মত। দুটা হাত লাগে। এক হাতে তালি বাজে না। অর্থাৎ একজনের ভালবাসায় হয় না।

আপনি কি জানেন আপনাকে প্রায়ই আমি স্বপ্নে দেখি।

 

এই ধরনের চিঠি হুড়হুড় করে লেখা যায় না। সময় লাগে। রাশেদ সময় দিচ্ছে। দুটা চিঠির কোনটাই সে পাঠাবে না। তারপরেও আগ্রহ করে সে কেন চিঠি লিখছে তাও জানে না।

ইয়াসিন তার জন্যে তিনবেলা খাবার নিয়ে আসছে। বিস্ময়কর ব্যাপার হল প্রতিবেলাতেই পোলাও থাকছে। সকালের নাশতাতেও পোলাও। যদিও রাশেদের চাচা বলে দিয়েছেন ইয়াসিন বিরাট চোর। তার প্রমাণ এখনো পাওয়া যায় নি তবে সে অতি কর্মঠ একজন তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। একদিনে ঝোপঝাড় কেটে বাড়ির চেহারা পাল্টে ফেলেছে। সে একা কাজ করছে না, একজন এসিসটেন্টও জুটিয়েছে।

রাস্তা থেকে বাড়ি পর্যন্ত ইট বিছানো হয়েছে। এখন আর কাদা ভেঙে বাড়িতে ঢুকতে হবে না। পুকুরের ঘাট মোটামুটি ঠিক করা হয়েছে। কচুরিপানা তুলে ফেলায় পুকুরের টলটলে পানি বের হয়েছে।

রাশেদ বলল, ইয়াসিন তোমার মত কর্মী মানুষ আমি আমেরিকায় দেখেছি। বাংলাদেশে দেখিনি। তোমার কাজ করার ক্ষমতা দেখে আমি মুগ্ধ।

ইয়াসিন বলল, কিছু টেকা-পয়সা খরচ করা কি সম্ভব স্যার? দুই একটা জিনিস খরিদ করতাম।

কি খরিদ করবে?

আপনে বুকের নিচে বালিশ দিয়া লেখেন। আপনার জন্যে একটা চেয়ার, টেবিল। ছাদে পলিথিনের চাদর দিব যেন বৃষ্টির পানি চুয়াইয়া না পড়ে। কয়েকটা টিন দরকার, বেড়া দিব। একটা কেরোসিনের চুলা কিনব। চায়ের সরঞ্জাম কিনব। মাঝে-মধ্যে চা খাইবেন।

তোমার কত টাকা লাগবে বল।

হাজার দুই টেকা হইলে চলব।

তোমাকে পাঁচ হাজার টাকা দিচ্ছি। যা লাগে খরচ করবে বাকিটা তোমার। একজন কর্মী মানুষকে আমার উপহার।

ইয়াসিন কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল, হেকিম চাচার সাথে আমি দেড় বছর আছি। মাসে পনেরশ টাকা বেতন দেওয়ার কথা। এখনও এক পয়সা পাই নাই। আপনে এক দিনের পরিচয়ে এতগুলো টেকা দিলেন। স্যার বলেন আপনার জন্য কি করব?

কিছুই করতে হবেনা ইয়াসিন। তুমি খুশি হয়েছ। এতেই আমি খুশি।

স্যার আপনার জন্য কিছু একটা আমার করাই লাগবে।

রাশেদ বলল, বাড়ির পেছনের জঙ্গলায় জ্বীনের কবর বলে একটা কবর আছে। শুনেছ এ রকম কথা।

স্যার শুনেছি। কবরটা দেখৈছি। গ্রামের কিছু মেয়েছেলেরা মানত করে। কবরে মোমবাতি দেই।

এই কবরটা ভাঙতে পারবে? দেখতাম ভেতরে কি আছে।

স্যার এইটা পারব না।

রাশেদ বলল, আমার ধারণী কবরে ধন-রত্ন লুকানো। বাবার দাদাজান হঠাৎ যে কোনো উপায়ে প্রচুর ধন-রত্ন পান। তায় লুকিয়ে রাখেন জ্বীনের কবরে। যাতে ভয়ে কেউ সে দিকে না যায়।

কবর খুঁড়তে পারব না স্যার। যদি বলেন, আপনার জন্য মানুষ খুন করব। স্যার। আপনার আহর দোহাই লাগে। কবরের ধারে কাছে যাবেন না।

আচ্ছা যাব না। ঢাকা থেকে হারুন সাহেবকে নিয়ে আসব। তাকে দিয়েই ভাব। উনি রহস্য পছন্দ করেন।

ইয়াসিন ঠিক করল, বাকি জীবন সে এই মানুষটার সেবা করে কাটাবে। মানুষটা চলে গেলে সে এই বাড়িতেই থাকবে। বাড়ি দেখাশোনা করবে। জ্বিনের কবরে বাতি দিবে। ইয়াসিনের নিজেকে ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। একজন ভাল মানুষের সঙ্গে থাকা বিরাট ভাগ্যের ব্যাপার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *