কেউ একজন আমাকে তিনটা ডিকশনারি পাঠিয়েছে। ইংলিশ টু ইংলিশ, ইংলিশ টু বেঙ্গলি এবং বেঙ্গলি টু বেঙ্গলি। প্রেরকের নাম শরিয়তুল্লাহ। ঠিকানা— এগারো তস্তুরিবাজার ঢাকা। আমি শরিয়তুল্লাহ নামের কাউকে চিনি না। তস্তুরিবাজারের শরিয়তুল্লাহ সাহেব জানেন না যে আমার ডিকশনারি প্রয়োজন। একজন জানেন, তিনি মালেক ভাই। তিনি তস্তুরিবাজারে থাকেন না। তিনি থাকেন রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলে।
আমার চিঠি তাঁর কাছে পৌঁছেছে এবং তিনি ব্যবস্থা নিয়েছেন। পৃথিবীতে অল্পসংখ্যক মানুষ আছে যারা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেয়। মালেক ভাই তেমন একজন।
আমি ঠিক করে ফেললাম তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাব। পুলিশ ধরলে ধরবে। জেলখানায় তার সঙ্গে থাকতে পারাও হবে ভাগ্যের ব্যাপার। তিনি সব সময় বলতেন, সব মানুষেরই কিছুদিন জেলে থাকা উচিত। জেল মানুষকে শুদ্ধ চিন্তা করতে শেখায়। পৃথিবীর মহৎ চিন্তার আশি ভাগ করা হয়েছে জেলখানায়।
তাঁর কথা শুনে আমি বলেছিলাম, যে মহৎ চিন্তা জেলখানায় করা যাবে সেই চিন্তা ঘরে বসে করা যাবে না কেন? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, মানুষ যখন শারীরিকভাবে বন্দি থাকে তখন ভারসাম্য রক্ষার জন্য প্রকৃতি তার মন মুক্ত করে দেয়। মুক্ত মন ছাড়া মহৎ চিন্তা সম্ভব না।
আমি বললাম, খারাপ চিন্তা কিংবা নিচ চিন্তা করার জন্যে আমরা কোথায় যাব?
তিনি বললেন, জেলখানা। সৎ চিন্তা যেখানে হবে অসৎ চিন্তাও সেখানেই হবে। তাছাড়া ইকুইলিব্রিয়াম হবে না। প্রকৃতি ইকুইলিব্ৰিয়াম চায়।
ডিকশনারি হাতে পাওয়ার পর পরই আমি ঠিক করেছি, মালেক ভাই জেলখানা থেকে ছাড়া পেলেই তাকে বিশ্রামের জন্যে কিছুদিন এখানে নিয়ে আসব। জেলখানার লাপসি খেয়ে খেয়ে যে অভ্যস্ত তার সামনে সপ্তম ব্যঞ্জন দিলে সে কী করবে?
মালেক ভাই কী করবেন। আমি জানি। তিনি গম্ভীর মুখে কিছুক্ষণ খাবারের দিকে তাকিয়ে থাকবেন তারপর ভারী গলায় বলবেন—
নগরের এক প্রান্তে প্রচুর খাবার কিন্তু কোনো ক্ষিধে নেই।
অন্য প্রান্তে প্রচুর ক্ষিধে কিন্তু কোনো খাবার নেই।
মালেক ভাইয়ের সামনে যতবার ভালো কোনো খাবার দেয়া হয়েছে। ততবারই তিনি এই কথা বলেছেন। কিন্তু ভালো খাবার খেয়েছেন খুব আগ্ৰহ নিয়ে। কোনো এক বাড়িতে উনি হয়তো গলদা চিংড়ি খেলেন। এই গল্প তিনি করবেন কম করে হলেও পঞ্চাশবার। মুগ্ধ গলায় বলবেন— আহা কী রান্না! স্বাদ মুখে লেগে গেছে। বাবুর্চির হাত সোনা দিয়ে বঁধিয়ে দেয়া দরকার।
সমস্যা হচ্ছে, এই বাড়িতে তাকে আনা যাচ্ছে না। কারণ আমি নিজেই চলে যাচ্ছি। আমার মন টিকছে না। আমি এখানে বিশাল এক বাড়িতে বাস করি। চারদিকে খোলা প্ৰান্তর। অথচ আমার নিজেকে সারাক্ষণ বন্দি মনে হয়। কোনো রকমে যদি জেলে ঢুকতে পারতাম তাহলে হয়তো উল্টা ব্যাপার হতো। নিজেকে মুক্ত মনে হতো।
এই বাড়িতে থাকতে না চাওয়ার পিছনে আরো একটা বড় কারণ আছে। কারণটা হাস্যকর। লীলাবতী নামের মেয়েটাকে আমি প্রতিরাতেই স্বপ্নে দেখছি। অতি বিচিত্র সব স্বপ্ন। পরশু রাতে দেখেছি দুজন নৌকায় করে কোথাও যাচ্ছি। বেশ বড় পালতোলা নৌকা। নৌকা চলছে। বাইরে রোদ। আমি রোদের হাত থেকে বাঁচার জন্যে ছাঁই-এর ভেতর শুয়ে আছি। লীলাবতী ছাই-এর বাইরে। সে বলল, চারদিকে এত সুন্দর দৃশ্য আর তুমি যােচ্ছ ঘুমাতে ঘুমাতে! উঠ তো। আমি বললাম, ঘুম পাচ্ছে তো। সে বলল, আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাও। আমি বললাম, তাহলে তুমি ভেতরে আসো। আমি বাইরে যাব না। বাইরে রোদ। সে বলল, তোমার গায়ে রোদ লাগবে না। আমি শাড়ির আঁচল দিয়ে মাথা ঢেকে রাখব।
স্বপ্নের শেষ অংশটা ভয়াবহ। আমি নৌকার গলুই-এ লীলাবতীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি। লীলাবতী রোদ থেকে আমাকে বাচানোর জন্যে আমার মুখের উপর শাড়ির আঁচল ধরে আছে। শাড়ির আঁচলের ভেতর থেকে লীলাবতীর হাসি হাসি মুখ আমি দেখতে পাচ্ছি।
এই ধরনের স্বপ্ন দেখার অর্থ একটাই— আমি সমস্যায় পড়েছি। ভয়াবহ সমস্যা। সমস্যায় পড়ার কোনো কারণ কিন্তু নেই। লীলাবতীর সঙ্গে আমার দেখা হয় না বললেই হয়। আর দেখা হলেও কথা হয় না। তবে এক সন্ধ্যায়। একটা ঘটনা ঘটেছিল। ঘটনাটা এরকম— আমি বসে অপেক্ষা করছি, আমার দুই ছাত্রী হারিকেন হাতে উপস্থিত হবে। তারা এলো না। চাঁদরে শরীর ঢেকে উপস্থিত হলো লীলাবতী। সহজ-স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আমার সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বলল, মাস্টার সাহেব, ভালো আছেন?
আমি বললাম, জি।
হাতে বেত নিয়ে বসে আছেন কেন?
আমি হাতের বেত নামিয়ে রাখলাম। একটু মনে হয় অপ্ৰস্তুত বোধ করলাম। লীলাবতী বলল, জাইতরী কইতরী দুজনই আপনাকে প্রচণ্ড ভয় পায়। এটা কি ভালো?
আমি বললাম, শিক্ষককে ভয় পাওয়া ভালো। শিক্ষক খেলার সাথি না। আমি তাদের সঙ্গে সাপ-লুড়ু খেলি না।
আপনি বেত দিয়ে তাদের মারেন?
মাঝে মাঝে শাসন করতে হয়। মানুষকে সবসময়ই কিছু অপ্রিয় প্রয়োজনীয় কাজ করতে হয়। শিক্ষকের শাসন সেরকম একটা বিষয়। অপ্রিয় কিন্তু প্রয়োজনীয়।
লীলাবতী শান্ত গলায় বলল, আপনি কিন্তু শাসন করার জন্যে তাদের মারেন না। আমি আড়াল থেকে কয়েকবার দেখেছি। আপনি তের ঘরের নামতা জিজ্ঞেস করেন। এরা দুইজনেই তের ঘরের নামতা জানে। আপনাকে ভয় পেয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলে। আপনি এই সুযোগটা গ্ৰহণ করেন।
আমি চুপ করে রইলাম। লীলাবতী তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তার চোখে সামান্য উত্তেজনাও নেই। তার তাকানোর ভঙ্গি, কথা বলার ভঙ্গি বলে দিচ্ছে সে তৈরি হয়ে এসেছে।
মাস্টার সাহেব!
জি।
তের ঘরের নামতা আপনার একটা অজুহাত। আমি একবার শুনলাম জইতরী। ঠিকই বলল চার তের বাহান্ন। তারপরেও আপনি তাকে মারলেন। আপনার সমস্যাটা কী? আপনি নিজে কি তের ঘরের নামতা জানেন? আমার তো ধারণা। আপনি নিজেই জানেন না।
বলতে বলতেই লীলাবতী হাত বাড়িয়ে টেবিলের উপরে রাখা বেতটা টেনে নিল। এবং কঠিন গলায় বলল, বলুন সাত তের কত? এক্ষুনি বলুন। এক্ষুনি বলতে না পারলে কিন্তু আপনার সমস্যা আছে।
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। কী করছে এই মেয়ে? তার হাতে বেত। সে বেতটা দোলাচ্ছে। জাইতরী-কইতরীকে পড়বার সময় আমি যেভাবে বেত দোলাতাম অবিকল সেইভাবে। লীলাবতী বলল, দেরি করবেন না এক্ষুনি বলুন।
একানব্বই। লীলাবতী হেসে ফেলে বলল, হয়েছে। আপনি কী ভেবেছিলেন? আপনাকে মারব?
লীলাবতী উঠে চলে গেল। আমার হতভম্ব ভাব কাটছে না। আমি বসেই আছি। কখন যে জাইতরী-কইতরী এসেছে, মাথা দুলিয়ে পড়তে শুরু করেছে। আমার খেয়াল নেই। আমি ওদের দিকে তাকিয়ে বললাম, কেমন আছ তোমরা?
দুই বোন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। একবার নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। কইতরীর চোখে তীব্র আতঙ্ক। আমি বুঝতে পারছি সে টেবিলের নিচ দিয়ে হাত বাড়িয়ে জইতরীর হাঁটু ধরেছে। আমি বললাম, আজ আমার শরীরটা ভালো না। আজ পড়াব না।
জইতরী ক্ষীণ গলায় বলল, স্যার, চলে যাব?
আমি বললাম, হুঁ।
আমি আমার জায়গায় বসে আছি। শুনতে পাচ্ছি মেয়ে দুটি মঞ্জু। সাহেবের ঘরে ঢুকে বিরাট হৈচৈ শুরু করেছে। তিনজন মিলে কোনো একটা খেলা বোধহয় খেলছে। মঞ্জু সাহেব অদ্ভুত ভাষায় কিছু বলছেন, মেয়ে দুটিও অদ্ভুত ভাষায় তার কথার জবাব দিচ্ছে। কিছুক্ষণ কান পেতে থেকে আমি অদ্ভুত ভাষার রহস্য উদ্ধার করলাম।
মঞ্জু, সাহেব বললেন, তিটমরা কিটি কিটরো? যার অর্থ— তোমরা কী করো? জইতরী বলল, মিটজ কিটরি। অর্থ হলো, মজা করি। বাচ্চা দুটি কী সুখেই না আছে! মঞ্জু সাহেব যে আনন্দ নিয়ে এদের সঙ্গে খেলছেন আমি কোনোদিনও এত আনন্দ নিয়ে কারো সঙ্গে খেলতে পারব না। খেলতে পারলে ভালো হতো। লীলাবতীকে বলতাম, তিটুমি কিটেমন ইটাছ? (তুমি কেমন আছ?) সে বলত, ভিটালো (ভালো)। আমি বলতাম, বিটসো (বসো)। সে বলত, কিটি কিটরেন? (কী করেন?) আমি বলতাম..
আমি রাতে ভাত খেলাম না। রাগ করে খেলাম না তা না। ভাত না খাওয়ার পেছনে একটাই উদ্দেশ্য কাজ করছিল। কোনোভাবে লীলাবতীর কাছে খবর যাবে আমি ভাত খাই নি। সে আসবে আমার কাছে। আমাকে বলবে, আমার উপরে রাগ করে ভাত খাচ্ছেন না— এটা কেমন কথা? খেতে বসুন।
লীলাবতী এলো না। আমি তিনটা পৰ্যন্ত জেগে বসে রইলাম। সেই রাতে যথারীতি আবারো লীলাবতীকে স্বপ্নে দেখলাম। আমি ভাত খাচ্ছি। সে আমার সামনে বসে আছে। তার হাতে বেত, মুখে হাসি। আমি বললাম, তুমি বেত হাতে বসে আছ কেন?
সে বলল, তুমি খাওয়া নিয়ে গণ্ডগোল করবে। আর আমি তোমার মাথায় বেতের বাড়ি দেব। বেশি করে ভাত নাও।
আমি ভাত নিলাম। সে বলল, এখন আমাকে বলো যূথি মেয়েটা কে? তুমি যতবার অসুস্থ হও ততবার যূথিকে ডাকো।
যূথি আমার খালাতো বোন। ওর বিয়ে হয়ে গেছে।
বিয়ে হোক বা কুমারী থাক, খবরদার আর কখনো যূথির নাম মুখে আনবে না।
আচ্ছা।
যদি আবার কোনোদিন যূথির নাম মুখে আনো আমি কিন্তু বেত দিয়ে তোমাকে মারব।
আমার যে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আমি সেটা বুঝতে পারছি। সুস্থ মাথার মানুষ রোজ রাতে একই ধরনের স্বপ্ন দেখবে না। স্বপ্ন ছাড়াও আমার অসুস্থতার আরো একটা লক্ষণ প্ৰকাশ পেয়েছে। দস্তয়োভস্কির ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্টের অনুবাদ এখন বন্ধ। এখন আমি খাতায় গুটিগুটি করে একটা শব্দই লিখি। শব্দটা— লীলাবতী। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা এই জিনিস। আমার হাতে লেখা এক পৃষ্ঠায় থাকে। পঁচিশ লাইন। প্রতি লাইনে লীলাবতী লেখা হয়। আটবার। অর্থাৎ পৃষ্ঠায় দুইশবার করে এই নাম লেখা হচ্ছে। আমি তিনশ’ আঠারো পৃষ্ঠা লিখে ফেলেছি। তার মানে এখন পর্যন্ত আমি ছয়ত্ৰিশ হাজার ছয়শাবার লিখলাম–লীলাবতী। খারাপ কী!
মালেক ভাই যদি শুনেন আমার এই অবস্থা, তিনি কী করবেন? প্রথমে কিছুক্ষণ হাসবেন। তার বিখ্যাত ছাদ ফাটানো হাসি। তারপর বলবেন, তোমার নাম বদলে মজনু রাখলে কেমন হয়? শোনো আনিস, জায়গির মাস্টারের সঙ্গে জায়গির বাড়ির মেয়ের প্ৰেম প্ৰায় শাশ্বত বাংলার বিষয়। এই বাংলায় এমন কোনো জায়গির শিক্ষক ছিলেন না যার সঙ্গে সেই বাড়ির কোনো মেয়ের প্রেম হয় নাই। অন্য কিছু কি করা যায় না? নতুন কিছু করো। সবচে ভালো হয়, এই লাইনটা যদি ছেড়ে দাও। তোমার ক্ষমতা আছে। ক্ষমতা ব্যবহার করো।
একমাত্র মালেক ভাই বলেছেন আমার ক্ষমতা আছে। আমি জানি, যে ক্ষমতা আছে সেই ক্ষমতা নিম্নশ্রেণীর ক্ষমতা। এই ক্ষমতার সবচে’ বড় প্রকাশ, লীলাবতী লিখে পাতা ভরানোতে সীমাবদ্ধ। কোনো বানান ভুল হবে না। লাইন সোজা হবে। প্রতি পৃষ্ঠায় দুশবার করে লেখা হবে। অক্ষরগুলিও হবে সুন্দর। এর বেশি ক্ষমতা আমার নেই। তবে এই ক্ষমতাও অগ্রাহ্য করার মতো না।