তিতলীদের বাড়ির সামনে
তিতলীদের বাড়ির সামনে বড় একটা গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। কালো রঙের গাড়ি–জানলার কাচ উঠানো বলে গাড়ির ভিতরে কে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না।
মতিন সাহেব জানালার পরদার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে আছেন। দুপুরে খাবারের পর তিনি খালি গায়ে হাতপা এলিয়ে ফুলম্পিডে ফ্যান ছেড়ে দিয়ে বড় একটা ঘুম দেন। আজো ঘুমোচ্ছিলেন। হঠাৎ ইলেট্রিসিটি চলে যাওয়ায় ফ্যান থেমে গেল, তার ঘুম ভেঙে গেল। তিনি ‘চামচিকার বাচ্চারা দেশটার বারটা বাজিয়ে দিল’ বলতে বলতে জানালার পরদা সরিয়ে কালো গাড়িটা দেখলেন। তিতলীর বিয়ের পর পর বড় বড় গাড়ির আনাগোনা শুরু হয়েছে। তিতলীর শ্বশুরবাড়ির দিকের সব আত্মীয়স্বজনেরই মনে হয়। গাড়ি আছে। রোজই কেউ না কেউ আসছে। দেখতে ভালো লাগছে। খালি হাতেও কেউ আসছে না। ঘর ভর্তি হয়ে আছে মিষ্টিতে। মিষ্টি খাওয়া তার নিষেধ। সামান্য ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে। সেই নিষেধ অমান্য করে তিনি নিয়মিত মিষ্টি খাচ্ছেন। খাওয়া শেষ হবার পর উদাস গলায় বলছেন–মিষ্টিটিষ্টি কী আছে দাও। খাওয়ার পর মিষ্টি খাওয়া রসুলে করিমের সুন্নত। সুন্নত পালন করলে স্বাস্থ্য নষ্ট হয় না।
আজ কে এসেছে? যে এসেছে সে গাড়ি থেকে নামছে না কেন? মতিন সাহেব এই বয়সেও বুকের ভেতর এক ধরনের ছেলেমানুষি উত্তেজনা অনুভব করলেন। তার সেই উত্তেজনা চরমে উঠল। যখন দেখলেন গাড়ি থেকে নামছে শওকত। তিতলীর হাসবেন্ড। কথা ছিল রুসমত না হওয়া পর্যন্ত শওকত এ বাড়িতে আসবে না। কী জন্যে এসেছে কে জানে। মতিন সাহেব ধড়মড় করে উঠে বসলেন। আলনা থেকে নিয়ে একটা পাঞ্জাবি গায়ে দিলেন। সুরাইয়াকে খবর দিতে হবে। গরমের সময় তার একটা বাজে অভ্যাস আছে–ভেতরের মেঝেতে হাতের ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়া। জামাই যদি এসে দেখে শাশুড়ি মাতারিদের মতো হা করে ঘুমোচ্ছে, মুখের ওপর মাছি ভিনভন করেছেসেই দৃশ্য সুখকর হবে না।
সুরাইয়া ঘুমোচ্ছিলেন না। রান্নাঘরে চায়ের পানি চাপিয়ে চুপচাপ বসে আছেন। মতিন সাহেব চাপা গলায় বললেন, জামাই এসেছে। জামাই। মেয়েরা কোথায়?
তিনি সুরাইয়ার জবাবের জন্যে অপেক্ষা করলেন না। মেয়েদের ঘরের দিকে ছুটে গেলেন।
তিতলী ঘরেই ছিল। নাদিয়া তার বই নিয়ে গেছে ছাদে। মুখস্থ করার কোনো ব্যাপার থাকলে সে ছাদে চলে যায়। হাঁটতে হাঁটতে সে পড়া মুখস্থ করে।
তিতলী শুয়ে ছিল। হাতপা গুটিয়ে কেন্নোর মতো শুয়ে থাকা। মাথাটা পর্যন্ত বালিশে নেই। বিয়ে হওয়া মেয়ে সবসময় সুন্দর করে সেজেণ্ডজে থাকবে–কী বিশ্ৰী ভাবেই না সে আছে! মতিন সাহেব কড়া গলায় বললেন, তিতলী ওঠ তো! জামাই এসেছেশওকত। যা কথাটথা বল, দেখা কী ব্যাপার। হাত মুখ ধুয়ে চুলটুল বেঁধে তারপর যা।
কলিংবেল বাজতে শুরু করেছে। দরজা খুলে দেবার মতো কেউ নেই। মতিন সাহেব নিজেই দরজা খোলার জন্যে গেলেন।
তিতলী শুয়ে শুয়ে কলিংবেলের শব্দ শুনছে–এক দুই তিন চার। চারবার বেল বাজল। হাসান বেল বাজাত দুবার। দুবারের বেশি। কখনো না। দরজা না খুললে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার দুবার। এই বিষয়ে হাসানের বক্তব্য হচ্ছে দুই হচ্ছে পৃথিবীর সবচে’ সুন্দর সংখ্যা। দুই মানেই আমি এবং তুমি। এটা নিশ্চয়ই হাসানের নিজের কথা না। কোনোখান থেকে শুনে এসে বলেছে। এ রকম গুছিয়ে কথা হাসান বলতে পারে না। সুরাইয়া দরজা ধরে দাঁড়ালেন। চাপা গলায় বললেন, মা শুয়ে আছিস? জামাই এসেছে। ওঠা মা।
তিতলী হাই তুলতে তুলতে বলল, তুমি এ রকম করে কথা বলছি কেন মা? জামাই এসেছে শুনে মনে হচ্ছে তুমি ভয় পাচ্ছি। জামাই এসেছে তো কী হয়েছে?
হাতমুখ ধুয়ে বসার ঘরে যা।
এত ব্যস্ত হচ্ছে কেন মা? বিয়ে যখন করেছি। বসার ঘরে নিশ্চয়ই যাব। তাড়াহুড়ার কিছু নেই। তুমি আমাকে চা খাওয়াও। চা খেয়ে তারপর যাব।
কাপড় বদলাবি না?
তুমি বললে অবশ্যই বদলাব।
সুরাইয়া ক্ষীণস্বরে বললেন–তুই এ রকম করে কথা বলছিস কেন? আমি ভালোমতোই কথা বলছি–তুমি আমাকে নিয়ে খুব ভয়ে ভয়ে আছ বলে আমার স্বাভাবিক কথাই তোমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। ভয় কোরো না মা। আমি হাস্যকর কোনো ড্রামা করব না। গলায় শাড়ি পেঁচিয়ে সিলিং ফ্যানে ঝুলে পড়া আমাকে দিয়ে হবে না। কেউ একজন আমাকে দিয়ে একটা খেলা শুরু করেছে। সেই খেলোটা শেষ পর্যন্ত খেলিব।
খেলা মানে? কী খেলা?
ও তুমি বুঝবে না মা। চা এনে দাও। চা খাব। চা খেয়ে গোসল করব। তারপর সেজেণ্ডজে শওকত সাহেবের সামনে দাঁড়াব।
সুরাইয়া চিন্তিত মুখে ফিরে এলেন। তার মন বলছে এই মেয়ে ভয়ঙ্কর কিছু করবে।
সেই ভয়ঙ্করটা কী তিনি ধরতে পারছেন না। মেয়ের জন্যে এক বৈঠকে এক শ রাকাত নামায তিনি মানত করেছেন। রুসমতের পর মেয়ে যে রাতে প্ৰথম শ্বশুরবাড়ি যাবে সেই রাতে তিনি মানত শেষ করবেন। মানত শেষ না করা পর্যন্ত তিনি শান্তি পাচ্ছেন না।
মতিন সাহেব অতি আনন্দের সঙ্গে তার জামাইয়ের সঙ্গে গল্প করছেন। তার হাতে রথম্যান সিগারেটের প্যাকেট। শওকতের ভদ্রতায় এই মুহূর্তে তিনি মোহিত। শওকত তার জন্যে এক কার্টুন রথম্যান সিগারেট এবং একটা লাইটার নিয়ে এসেছে। এমন সুন্দর লাইটার তিনি তার জন্মে দেখেন নি। কখনো দেখবেন এই আশাও করবেন না। লাইটারটা কালো রঙের। ছোট একটা লাল বোতাম আছে। বোতামে চাপ দিলেই নীলাভ অগ্নিশিখা দেখা দেয়। লাইটারের কর্মকাণ্ড এইখানেই শেষ হয়ে যায় না। যতক্ষণ অগ্নিশিখা জ্বলে ততক্ষণইটুনটুন শব্দ হতে থাকে। লাইটারটা তিনি এর মধ্যেই কয়েকবার জ্বলিয়েছেন নিভিয়েছেন। আবারো জ্বালাতে ইচ্ছে করছে। জামাইয়ের সামনে এ জাতীয় ছেলেমানুষি শোভন হবে না বলে মনের ইচ্ছা চাপা দিয়ে রেখেছেন। তিনি সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন, তারপর বাবা বল কেমন আছ?
শওকত বিনীতভাবে বলল, জ্বি ভালো।
তুমি কি ধূমপান করা? করলে আমার সামনে সিগারেট খেতে পাের। এইসব প্রিজুডিস আমার একেবারেই নেই। বিলেতে, আমেরিকায় বাপ-ছেলে এক টেবিলে বসে মদ খাচ্ছে–আর আমাদের দেশে… শ্ৰদ্ধা ভক্তি আসলে মনের ব্যাপার। তুমি আমাকে শ্ৰদ্ধা কর কি করা না তা আমার সামনে সিগারেট খাওয়া-না খাওয়া দিয়ে বিচার করা যাবে। না। তুমি কী বল?
জ্বি তা তো ঠিকই।
নাও একটা সিগারেট খাও।
আমি সিগারেট খাই না।
ভেরি গুড। এটা এমন একটা অভ্যাস যার কোনো ভালো দিক নেই–শরীর নষ্ট, স্বাস্থ্য নষ্ট, পরিবেশ নষ্ট, অর্থ নষ্ট…কোটি কোটি টাকা ধোঁয়ায় উড়ে যাচ্ছে–ভাবাই যায় না। ঠিক বলছি না?
জ্বি।
তারপর বল তোমার খবরাখবর বল।
শওকত লজ্জিত গলায় বলল, আমি একটা অনুরোধ নিয়ে এসেছিলাম।
মতিন সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, বল ব্যাপারটা কী?
আমার এক বন্ধুর বিয়ে। আমার ছোটবেলার বন্ধু। ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বিয়ে হচ্ছে গাজীপুরে। ওর খুব ইচ্ছা আমি তিতলীকে নিয়ে সেই বিয়েতে যাই…
ইচ্ছে হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। তুমি তিতলীকে নিয়ে যাও। তোমার স্ত্রীকে তুমি নিয়ে যাবে এর মধ্যে আবার অনুরোধ কী?
এখনো ফরম্যালি উঠিয়ে নেয়া হয় নি…
তুমি এইসব ব্যাপার নিয়ে একেবারেই চিন্তা করবে না। কাবিননামা তৈরি হওয়া মানে বিয়ে হয়ে যাওয়া।
ফিরতে হয়তো দেরি হবে। গাজীপুর অনেকখানি দূরে–।
হোক দেরি কোনো সমস্যা নেই। আমি রাত দুটার আগে ঘুমাই না।
আমার বন্ধু বলছিল রাতটা তার ওখানে থেকে যেতে। রাস্তাটা খারাপ। প্রায়ই ডাকাতি হয়।
রাতটা থেকে সকালে আস। কোনো সমস্যা নেই। আমি তিতলীকে বলে দিচ্ছি। তুমি চা-টা কিছু খাবে?
এক কাপ চা খেতে পারি।
বোস তুমি, আমি চায়ের কথা বলে আসি।
মতিন সাহেব উঠে দাঁড়ালেন-তার সঙ্গে শওকত উঠে দাঁড়াল। শওকতের ভদ্রতায় মতিন সাহেব। আবারো মোহিত হলেন। অসাধারণ একটা ছেলে–তিতলীর ভাগ্য ছক্কা ভাগ্য। দান ফেলেছে ছক্কা উঠে গেছে।
তিতলী লাল রঙের জামদানি শাড়ি পড়েছে। লাল শাড়িতে কালো ফুল। শাড়ির পাড়টাও কালো। যেহেতু বিয়েতে যাচ্ছে সুরাইয়া মেয়েকে কিছু গহনাও পরিয়েছেন। হাতে চারগাছ করে চুড়ি। গলায় পাথর বসানো হার। এই হার তিতলীর ফুফু। ধার দিয়েছেন। শ্বশুরবাড়ির লোকজন ক্রমাগত আসছে। বিয়ে হওয়া মেয়ে খালি গলায় থাকবে এটা ঠিক না। তিতলীর কানে সবুজ পাথরের দুটা দুল। গায়ে শাড়ির সঙ্গে কানের এই দুলজোড়া মানাচ্ছে না। কিন্তু তারপরেও দেখতে ভালো লাগছে।
তিতলী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, মা আমাকে কেমন লাগছে? সুরাইয়া সেই প্রশ্নের জবাব দিলেন না। মেয়ের বা হাতের চেটোয় হালকা করে থুথু দিলেন। এই থুথু সুন্দর দেখানোর দোষ কাটিয়ে দেয়। খুব সুন্দর কখনো ভালো না। খুব সুন্দরকে ঘিরে থাকে অসুন্দর। তিতলী বলল, মা যাচ্ছি।
বিসমিল্লাহ করে রওনা হও মা। গলার হারটা সাবধানে রাখবে। খুলে পড়ে না যায়।
পড়বে না।
শওকতের সঙ্গে ভদ্রভাবে কথা বলবি।
অবশ্যই ভদ্রভাবে কথা বলব।
চোখমুখ এমন শক্ত করে রেখেছিস কেন? মনে হচ্ছে ফাঁসি দেখতে যাচ্ছিস।। ঘর থেকে হাসিমুখে বের হ।
নতুন স্বামীর সঙ্গে হাসিমুখে বের হলে লোকজন বেহায়া ভাববে। এই জন্যে চোখমুখ শক্ত করে রেখেছি।
বিয়ে বাড়িতে মুখ এমন শক্ত করে থাকবি না।
আচ্ছা। এবার বিদায় দাও মা ঘুরে আসি।
মতিন সাহেব মেয়েকে গাড়ি পর্যন্ত উঠিয়ে দিতে গেলেন। অবাক হয়ে বললেন, গাড়ির ড্রাইভার কোথায়?
শওকত বলল, ড্রাইভার নেই। গাড়ি আমি চালাব।
মতিন সাহেব। আবারো মোহিত হলেন। জামাই গাড়ি চালিয়ে যাবে। পাশে বসে। থাকবে তিতলী। অসাধারণ দৃশ্য। দেখাতেও আনন্দ।
গাড়ি সাবধানে চালাবে বাবা। ঢাকার ট্রাফিকের যে অবস্থা। নিয়মকানুন বলে কিছু নেই। অদ্ভুত দেশ।
শওকত হাসিমুখে বলল, আপনারা কোনো দুশ্চিন্তা করবেন না। আমি খুব সাবধানী ড্রাইভার।
মতিন সাহেব তার নতুন লাইটারে আরেকটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেনসাবধান হওয়াই ভালো। সাবধানের মারা নাই।
শওকত শহর ছাড়িয়ে হাইওয়েতে না পড়া পর্যন্ত একটা কথাও বলল না। মনে হচ্ছে সে কী বলবে বা বলবে না তা গুছিয়ে নিচ্ছে। তিতলীর বসে থাকার মধ্যেও কোনো আড়ষ্টতা নেই। বাতাসে তার চুল উড়ছে। শাড়ির আঁচল উড়ছে, তার ভালোই লাগছে।
আমি একটা সিগারেট ধরালে কি তোমার খারাপ লাগবে?
জ্বি না।
আমি অবশ্যি তোমার বাবাকে বলেছি আমি সিগারেট খাই না। আসলে মাঝে মধ্যে খাই। আমি প্রফেশনাল না, এমেচারী। তারপর বল কেমন আছ?
জ্বি ভালো আছি।
বল তো আমরা কোথায় যাচ্ছি?
আপনার খুব ঘনিষ্ঠ একজন বন্ধুর বিয়েতে। গাজীপুর।
এখানেও আমি তোমার বাবাকে একটা মিথ্যা কথা বলেছি। আমরা গাজীপুর যাচ্ছি। ঠিকই কিন্তু কোনো বন্ধুর বিয়েতে যাচ্ছি না।
ও।
তোমাকে নিয়ে একটু ঘোরবার ইচ্ছা হলো। কাজেই একটা অজুহাত তৈরি করে তোমাকে বের করে নিয়ে এলাম। তুমি রাগ কর নি তো?
রাগ করব কেন?
শওকত হাসিমুখে বলল, আমার সবচেয়ে ছোট মামাকে আমরা ডাকি মিজু মামা। উনি ফটকাবাজি ব্যবসা করে কোটিপতি হয়েছেন। গাজীপুরে একটা জঙ্গল কিনে বাগানবাড়ি বানিয়েছেন। আজ রাতের জন্যে সেই বাগানবাড়ির চাবি আমার কাছে। জঙ্গল তোমার কাছে কেমন লাগে?
জানি না। জঙ্গলে তো কখনো থাকি নি।
সত্যিকার জঙ্গল অবশ্যি আমাদের দেশে নেই। সুন্দরবনে খানিকটা আছে তাও মূলটা পড়েছে ইন্ডিয়ায়। তুমি কখনো ইন্ডিয়া গিয়েছ?
জ্বি না।
আমি নিয়ে যাব। ইন্ডিয়ার উত্তরপ্রদেশে বড় বড় জঙ্গল আছে। কুমায়ুনের মানুষখেকো বাঘ বইটা পড়েছ? জিম করবেটের লেখা?
জ্বি না।
ওই বইটা পড়লে জঙ্গল সম্পর্কে ধারণা পেতে। তোমার গলার এই হারটা তো খুব সুন্দর। কী পাথর এটা?
আমি জানি না। আমার ফুফুর হার। আমার না।
যতদূর মনে হয়। জিরকন। জিরকন ছাড়া এমন ব্রাইট রেড পাথর হয় না। আমার কাছে অবশ্যি লালের চেয়ে নীল পাথর বেশি পছন্দ। একটা পাথর আছে নাম একুয়ামেরিন। অপূর্ব নীলা মনে হয় আকাশ জমাট বাঁধিয়ে পাথর তৈরি করা হয়েছে। তবে খুব হালকা পাথর। ভঙ্গুর। আমি যে বকবক করে যাচ্ছি, তোমার বিরক্তি লাগছে না তো?
জ্বি না।
তুমি মনে হয় কথা কম বল।
জ্বি না। আমি প্রচুর কথা বলি, এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
গাজীপুরে যেখানে যাচ্ছি। সেখানে ছোট মামার এক বাবুর্চি থাকে–নাম মন্তাজ মিয়া। আজ রাতে সে-ই আমাদের রেঁধে খাওয়াবে। মন্তাজ মিয়ার বিশেষত্ব কী শুনবে?
বলুন শুনি।
মিজু মামার ধারণা-মস্তাজ মিয়া হচ্ছে পৃথিবীর পাঁচজন সেরা রাধুনির একজন। ও শুধু দেশী রান্না পারে। রোস্ট টেস্ট পারে না। আমি শুনেছি তুমিও খুব ভালো রাঁধতে পার।
কার কাছে শুনলেন?
তোমার বড় ফুফু, বললেন। তোমার হাতে নাকি জাদু আছে। আরেকবার তোমাকে নিয়ে এখানে আসব সেদিন তুমি রাঁধবে। সব যোগাড় যন্ত থাকবে। তুমি শুধু রান্না চড়িয়ে দেবে। তোমার কী কী লাগবে একটা লিষ্ট করে দিলে সেইভাবে ব্যবস্থা করে রাখব। ঠিক আছে?
জ্বি ঠিক আছে।
তোমার কোন রান্না ভালো হয়? মাছ না মাংস?
আমার মনে হয় মাছ।
সর্বনাশ করেছ, মাছ তো আমি খেতেই পারি না। মাছের মধ্যে চিংড়িটা খাই। তাও যে খুব আগ্রহ করে তা না।
শওকত আরেকটা সিগারেট ধরাল। তিতলী তাকিয়ে আছে বা পাশের জানালার দিকে। গাড়িতে বসে থাকতে তার ভালোই লাগছে। লোকটা অকারণে কথা বলে ভাব জমাতে চেষ্টা করছে এটাও খারাপ লাগছে না। একবার তার ইচ্ছা করল বলে–ভাব জমানোর জন্যে অকারণ কথা বলার দরকার নেই। ভাব হবার হলে আপনাতেই হবে।
একটার পর একটা সিগারেট ধরাচ্ছি। তোমার অসুবিধা হচ্ছে না তো?
জ্বি না।
খুব সস্তা ধরনের একটা কথা তোমাকে বলার ইচ্ছে করছে তুমি কী ভাববে ভেবে বলতে অস্বন্তি বোধ করছি। এ জাতীয় কথা ছেলেরা বাংলা সিনেমায় বলে।
আপনার যা বলতে ইচ্ছে করে বলুন।
তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। সারাক্ষণ তোমার দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। তাকিয়ে থাকলে অ্যাকসিডেন্ট হবে সেই ভয়ে তাকাচ্ছি না।
গাড়ি কোথাও পার্ক করুন। পার্ক করে তাকিয়ে থাকুন।
শওকত শব্দ করে হেসে উঠল। সেই হাসি আর থামেই না।
বাগানবাড়িতে পৌঁছে শওকতের মুখের হাসি পুরোপুরি মিলিয়ে গেল। গেট তালাবন্ধ। আশপাশে কেউ নেই। ডাকাডাকি, চিৎকার, তালা ধরে ঝাঁকুনি কিছুতেই কিছু না। চারদিকে জনমানবশূন্য। তিতলী বলল, আপনি না বলেছিলেন আপনার কাছে চাবি আছে।
শওকত বিরক্তমুখে বলল, ভেতরের ঘরের চাবি। গেটের চাবি নেই। সবাইকে খবর দেয়া আছে তারপরেও এ কী অবস্থা।
গেট শেষ পর্যন্ত খুলল। দারোয়ান ভেতরে ঘুমোচ্ছিল। চোখ ডলাতে ডালতে সে এসে গেট খুলে দিল। এতে সমস্যার সমাধান হলো না। শোনা গেল মনতাজি মিয়ার জ্বর এসেছে বলে সে দুপুরে ঢাকায় চলে গেছে। রান্নার কোনো যোগাড় যন্তও নেই। সবকিছু মন্তাজের করার কথা। শওকত রাগে ফুসতে লাগল। তিতলী বলল, আপনি অস্থির হবেন না। একটা তো মোটে রাত-না খেয়ে আমি থাকতে পারব।
শওকত বিরক্ত গলায় বলল, না খেয়ে থাকবে কেন? আমি বাজারে যাচ্ছি যা পারি নিয়ে আসব–দারোয়ান রাঁধবে। তুমি একা থাকতে পারবে তো? ঠিক একাও না। দারোয়ান থাকবে। থাকতে পারবে?
পারব।
ভয়ের কিছু নেই; আর এই দারোয়ান খুব বিশ্বাসী।
আপনি বাজার করে আনুন। আমার কোনো অসুবিধা হবে না।
তুমি ঘুরে ঘুরে বাগান দেখ। শোবার ঘরে ছোটখাটো লাইব্রেরির মতো আছে। গল্পের বইটই পড়তে পার।
জ্বি আচ্ছা।
তিতলী একা একা অনেকক্ষণ হাঁটল। বাগানবাড়িটা আসলেই সুন্দর। শহরে পাখির ডাক শোনা যায় না–এখানে অনবরত পাখি ডাকছে। কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। পাখির ক্যানক্যানে ডাক খুব শ্রুতিমধুর না। শান্ত কোনো বন কি পৃথিবীতে আছে। যেখানে একটি পাখিও ডাকে না? শুধু খুব বাতাস হলে পাতার শব্দ শোনা যায়। এরকম বন থাকলে চমৎকার হতো। ভদ্রলোকের মামা–কী নাম যেন মিজু মামা, তিনি জায়গাটা খুব সুন্দর করে সাজিয়েছেন। ঝিলের মতো একটা জায়গার পাশে বসার জন্যে সিমেন্টের আসন বানিয়েছেন। দেখলেই বসতে ইচ্ছে করে। ঝিলের পানি অবশ্যি ঘোলা। পুকুর বা সিালের পানি হবে। আয়নার মতো চকচকে–যে পানি দেখামাত্ৰ হাত দিয়ে ছুতে ইচ্ছে করবে। যে পানিতে মুখ দেখতে মন চাইবে। এই পানির কাছে যেতে ইচ্ছে করে না।
মানুষেবা সঙ্গে পানির আশ্চর্য মিল আছে। কোনো কোনো মানুষকে পরিষ্কার ঝকঝকে পানির মতো মনে হয়। তাদের কাছে যেতে ইচ্ছে করে, সেই পানি ছুয়ে দেখতে ইচ্ছে করে, সেই পানিতে নিজের মুখ দেখতে ইচ্ছে করে। আবার কিছু কিছু মানুষ এই ঝিলের পানির মতো হাত দিয়ে ছোয়া দূরের কথা, কাছে যেতেও ইচ্ছে করে না। তারপরেও যেতে হয়। এই যেমন সে ঝিলের এই পানি পছন্দ করছে না, তারপরেও পানির পাশেই বসে আছে।
তিতলী তুমি এখানে?
জ্বি।
খাবারের ব্যবস্থা করেছি। ফ্লাঙ্কে করে চা নিয়ে এসেছি। দোকানের চা। ওভালটিন দেয়া, খেতে পারবে কিনা জানি না। খাবে?
জ্বি খাব।
শওকত ব্যস্ত ভঙ্গিতে চা আনতে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফ্লাঙ্ক এবং দুটা কাপ নিয়ে এল। শার্টের বুকপকেটে এক প্যাকেট বিসকিট। মনে হচ্ছে মানুষটা খুব গোছানো স্বভাবের।
তিতলী।
জ্বি।
বাগানবাড়ি কেমন লাগছে?
সুন্দর।
আমাদের গ্রামের বাড়ি কিন্তু খুব সুন্দর। বিরাট পুকুর। শান বাধানো ঘাট। পানিও খুব পরিষ্কার–তোমাকে নিয়ে যাব।
জ্বি আচ্ছা।
তুমি দেখি জ্বি এবং জুি আচ্ছা ছাড়া কোনো কথা বলছি না। মাথা ধরেছে?
জ্বি।
এই নাও প্যারাসিটামল। আমি গাড়িতেই বুঝেছি তোমার মাথা ধরেছে–একপাতা প্যারাসিটামল নিয়ে এসেছি। দাঁড়াও একটা পানির বোতল নিয়ে আসি।
শওকত ব্যস্ত ভঙ্গিতে পানির বোতল আনতে গেল। তিতলী ট্যাবলেটের পাতা হাতে নিয়ে বসে আছে। সে নিজেকে তৈরি করছে। খুব কঠিন কিছু আজ তাকে বলতে হবে। বলতে হবে খুব সহজ ভঙ্গিতে। কথাগুলো সে মনে মনে অনেকবার বলেছে। মনে মনে বলা এক কথা, আর সামনাসামনি বলা আরেক কথা। তবু তাকে বলতেই হবে।
যে কথাটা সে বলবে তা হচ্ছে–আমি আপনাকে বিয়ে করে আপনার ওপর খুব অবিচার করেছি। কারণ আমি কখনো আপনাকে আমার খুব কাছে আসতে দেব না। আমি নিজেকে সাজিয়েছি অন্য একজনের জন্য। আপনি ইচ্ছে করলে আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারেন–কিংবা সারাজীবন পুতুলের মতো সাজিয়ে রাখতেও পারেন। সেটা আপনার ইচ্ছা; তবে আমি কখনো আপনার অবাধ্য হব না। আমার কাছে আপনি যা চাবেন তাই পাবেন।
তিতলী একদৃষ্টিতে ঝিলের পানির দিকে তাকিয়ে আছে। পানিতে কিছু শুকনো পাতা পড়েছে। বাতাসে ঢেউয়ের মতো উঠেছে। পাতাগুলো ঢেউয়ে উঠছে-নামছে। দেখতে ভালো লাগছে।
তিতলী!
জ্বি।
নাও পানি নাও–তুমি কি মাথাধরার ট্যাবলেট প্রায়ই খাও?
জ্বি।
বেশি খেও না। কিডনির ক্ষতি করে।
শওকত তিতলীর পাশে বসল। তিতলী সরে গিয়ে জায়গা করে দিল। শওকত বলল, জায়গাটা খুব সুন্দর না?
জ্বি।
বাগানবাড়ি শুনতে অবশ্যি অস্বস্তি লাগে। বাগানবাড়ি শুনলেই মনে হয় নিষিদ্ধ আনন্দের জায়গা। বাগানবাড়ি না বলে খামারবাড়ি বললে মনে হয়–খুব কাজের জায়গা। A place for productive work. তিতলী তুমি কি গান পছন্দ কর?
করি।
কী ধরনের গান তোমার পছন্দ?
সব ধরনের।
নাচ? নাচ কেমন লাগে?
ভালো।
গানকে বলা হয় হৃদয়ের শব্দ, আর নাচকে কী বলা হয় জান?
জ্বি না।
নাচকে বলা হয় শরীরের সঙ্গীত। নাচ কত রকমের আছে জান?
জ্বি না।
নাচ মূলত চার রকমের–ভারত নাট্যম, কথাকলি, মণিপুরী, কত্থক। ইদানীং অবশ্যি আরো দুটা ধারা ধরা হচ্ছে–ওড়িশি, কুচিপুড়ি।
ও আচ্ছা।
এ ছাড়াও আছে–যেমন ধর লোকনৃত্য, ছৌ ছৌ, রায়বেঁশে, বাউল, ঝুমুর, কাঠিনৃত্য, ব্ৰতচারী, খেমটা, কারবা, তয়ফা, ঠুমকি, বিহু, বাংরা, গরবা…।
তিতলী মনে মনে হাসল। মানুষটা তাকে মুগ্ধ করার চেষ্টা করছে। গান, নাচ এই দুটি বিষয়ে অনেক জ্ঞানগর্ভ ব্যাপার মুখস্থ করে এসেছে। তিতলী কিছু বলবে না বলবে না ভেবেও বলে ফেলল, নাচের এইসব নামধাম। আপনি মুখস্থ করেছেন কেন?
শওকত হাসতে হাসতে বলল, এর একটা মজার ইতিহাস আছে। আরেক দিন বলব।
আচ্ছা।
তুমি কি গান গাইতে জান?
জ্বি না।
তোমার ফুফু, যে বললেন তুমি সুন্দর গান কর।
ভুল বলেছেন। আমার অনেক গুণ আছে এটা বোঝানোর জন্যে বানিয়ে বলেছেন।
তুমি যদি গান শিখতে চাও আমি শেখাবার ব্যবস্থা করব। শিখতে চাও?
জ্বি না।
এমনভাবে কথা বলছি কেন? তোমার কি মাথাধরা কমে নি? তিতলী জবাব দিল না। সে অনেক কথা বলে ফেলেছে আর ইচ্ছা করছে না।