তারিখ ৩১ অক্টোবর, ১৯৭৫ সন। রাধানাথ বাবু মেঝেতে শীতলপাটির বিছানায় শুয়ে আছেন। তার পাশে শফিক কাগজ-কলম নিয়ে বসেছে। রাধানাথ বাবু জরুরি এক চিঠির ডিকটেশন দেবেন। চিঠি যাবে খন্দকার মোশতাকের হাতে।
রাধানাথ বললেন, শচীনকর্তা মারা গেছেন, এই খবর জানো?
না।
উনি আজ মারা গেছেন। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা শচীনকর্তার মৃত্যুতে যতটা শোক পেয়েছে, তার এক শ ভাগের এক ভাগ শোকও তাদের জাতির পিতার মৃত্যুতে পায় নি।
শফিক বলল, খন্দকার মোশতাক হয়তো তাকে জাতির পিতার আসন থেকে নামিয়ে দেবেন।
রাধানাথ বললেন, এটা উনি পারবেন না। সবার ক্ষমতারই সীমাবদ্ধতা আছে। খন্দকার মোশতাক তার ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জানেন।
শফিক হতাশ গলায় বলল, জানলেই ভালো।
রাধানাথ বললেন, লেখো–
মাননীয় প্রেসিডেন্ট। খন্দকার মোশতাক আহমেদ।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। লিখেছ?
জি।
এখন লেখো–
নমস্কার এবং অভিনন্দন। আশা করি আপনার মাধ্যমে দেশ দিকনির্দেশনা পাবে। আপনাকে বিশেষভাবে অনুরোধ করছি, আপনি যেন কারাগারে বন্দি আওয়ামী লীগের নেতাদের নিরাপত্তার বিষয়টি খেয়ালে রাখেন। বাংলাদেশের এখন যে অবস্থা যে-কোনো দুর্ঘটনা যে-কোনো সময় ঘটে যাবে। একটি আপ্তবাক্য আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই— ‘সবাইকে তার মুদ্রায় হিসাব দিতে হবে।’
বিনীত
রাধানাথ
শফিক বলল, খন্দকার মোশতাক সাহেব আপনাকে চেনেন?
খুব ভালোমতো চেনেন। এই চিঠি নিয়ে তুমি যাবে, সরাসরি তাঁর হাতে দিবে।
আমি বঙ্গভবনে ঢুকব কীভাবে?
সেই ব্যবস্থা আমি করব। এখন দোতলার স্টোররুমে যাও। একটা রেকর্ডপ্লেয়ার আছে। সেটা আনন। শচীনকর্তার 76 RPM এর বেশ কিছু রেকর্ড আছে। যে-কোনো একটা নিয়ে আসো। তার গান শুনে তার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাই। শফিক! আমার মন বলছে একটা সময় আসবে যখন বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ শুনে এ দেশের মানুষ তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাবে। আমি সেই দিন দেখে যেতে চাই।
রাধানাথ চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। রেকর্ডপ্লেয়ারে শচীনকর্তার গান বাজছে।
রঙ্গিলা রঙ্গিলা রঙ্গিলারে
আমারে ছাড়িয়া বন্ধু কই গেলারে।
কই গেলারে বন্ধু, কই রইলারে
আমারে ছাড়িয়া বন্ধু কই গেলারে।।
বঙ্গভবনে ঢুকতে এবং খন্দকার মোশতাকের হাতে চিঠি দিতে শফিকের মোটেই বেগ পেতে হলো না। মোশতাক মুখবন্ধ খাম হাতে নিলেন। চিঠি বের করে পড়লেন না। ভুরু কুঁচকে শফিকের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কড়া গলায় বললেন, তোমার নাম কী?
শফিক ভীত গলায় বলল, শফিক।
তুমি রাধানাথ বাবুকে চেনো কীভাবে?
আমি উনার কিছু টুকটাক কাজ করে দেই।
টুকটাক কাজ মানে কী?
ডিকটেশন নেই। উনার চোখ ভালো না। লেখাপড়া করতে সমস্যা হয়।
আমার কাছে যে চিঠি এসেছে তার ডিকটেশন তুমি নিয়েছ?
জি।
চিঠির বিষয়বস্তু তুমি জানো?
জি।
রাধানাথ বাবুকে আমার শুভেচ্ছা দেবে এবং বলবে, তিনি যদি বঙ্গভবনে এসে আমার সঙ্গে এক কাপ চা খান, তাহলে আমি খুশি হব।
জি বলব। স্যার, আমি কি এখন যেতে পারি?
খন্দকার মোশতাক বিরক্ত গলায় বললেন, তোমাকে কেউ আটকে রাখে নি।
প্রেসিডেন্ট শফিককে আটকান নি, কিন্তু একজন আটকালেন। তার নাম মেজর রশীদ। ইনি তখন বঙ্গভবনে বিশাল এক রুম দখল করে থাকেন। তার রুমের সামনে স্টেনগান হাতে দুজন সৈনিক দাঁড়িয়ে থাকে। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী গুরুত্বপূর্ণ সব আলোচনা এই ঘরেই হয়।
শফিককে মেজর রশীদের সামনে উপস্থিত করা হলো। মেজর শীতল গলায় বললেন, Who are you?
স্যার, আমার নাম শফিক।
তুমি প্রেসিডেন্ট সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছ। উনার সঙ্গে দেখা করার পাস আমি ইস্যু করি। তুমি পাস কোথায় পেলে?
শফিক ভীত গলায় বলল, পাস কোথা থেকে এসেছে আমি জানি না স্যার। প্রেসিডেন্ট সাহেব ব্যবস্থা করেছেন।
উনার সঙ্গে তোমার কী প্রয়োজন?
আমার কোনো প্রয়োজন নেই স্যার। আমি সামান্য ব্যক্তি। আমি উনার জন্যে একটা চিঠি নিয়ে এসেছিলাম।
চিঠি কে দিয়েছেন?
রাধানাথ বাবু।
Who is he?
তিনি একজন প্রেসের মালিক। প্রেসের নাম ‘আদর্শলিপি’।
চিঠিতে কী লেখা?
শফিক ইতস্তত করে বলল, চিঠিতে কী লেখা আমি জানি না স্যার।
শফিক এই মিথ্যা বলে ঘাবড়ে গেল। তার মনে হচ্ছে এই লোক তার মিথ্যা ধরে ফেলেছে।
তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? শফিক বলল, স্যার, আমি ভীতু মানুষ। এইজন্যে ভয় পাচ্ছি।
মেজর রশীদ সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, ভয় পাওয়ার মতো কোনো কারণ আছে বলে তুমি ভয় পাচ্ছ।
মেজর সাহেব নিচু গলায় তার পাশে সিভিল পোশাকে দাঁড়িয়ে থাকা একজনকে কী যেন নির্দেশ দিলেন।
তাঁর নির্দেশমতো শফিককে নিয়ে যাওয়া হলো রমনা থানায়। সেখানে পুলিশের এসপি সালাম সাহেবের হাতে তাকে তুলে দেওয়া হলো।
সালাম সাহেব হতাশ গলায় বললেন, যারা আপনাকে পাঠিয়েছেন তাঁদের হাতে বন্দিশালা নেই। সন্দেহভাজনদের তারা থানায় পাঠিয়ে দেন। এর মধ্যে দুর্ভাগ্যবানরা চলে যান আনিতে।
শফিক বলল, আনি কী?
আনি হচ্ছে আগাছা নিমূল। আপনি যদি আগাছা হয়ে থাকেন, তাহলে আপনাকে নির্মূল করা হবে। কাজটা আমরা করব না—এই ভরসা আপনাকে দিতে পারি। আপনার সান্ত্বনা বলতে এইটুকু।
শফিক বলল, স্যার, আমি কি আমার অবস্থা জানিয়ে কাউকে টেলিফোন করতে পারি?
পারেন, তবে থানার টেলিফোন এখন নষ্ট। যান, হাজতে অপেক্ষা করুন। টেলিফোন ঠিক হলে আপনাকে খবর দেওয়া হবে।
সারা দিনেও টেলিফোন ঠিক হলো না। শফিক ঠিক করল, কোনো কারণে যদি সে বেঁচে যায় তাহলে আর ঢাকায় থাকবে না। মা’র কাছে চলে যাবে।
রাত আটটায় হাজতের দরজা খুলে তাকে বের করা হলো। মিলিটারি একটা জিপ থানার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এসপি সালাম সাহেবের সঙ্গে একজন অফিসার। এই অফিসারকে শফিক বঙ্গভবনে দেখে নি।
অফিসার এসেছেন সিভিল পোশাকে। সালাম সাহেব তাকে ক্যাপ্টেন সাহেব’ বলে ডাকছেন বলেই শফিক নিশ্চিত হলো ইনি একজন ক্যাপ্টেন। এই সময়ে মেজর এবং ক্যাপ্টেনরাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শফিকের ইচ্ছা করছে ক্যাপ্টেন সাহেবের পা চেপে ধরতে। জীবন রক্ষার জন্যে শুধু পা চেপে ধরা না, পা চাটাও যায়।
ক্যাপ্টেন সাহেব কড়া গলায় বললেন, আপনি বোস্টার সাহেবকে চেনেন?
শফিক বলল, জি-না স্যার। উনি কে?
উনি বাংলাদেশে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত। আপনি তাঁকে চেনেন না, তারপরেও উনি কেন আপনার মুক্তির জন্যে সুপারিশ করলেন?
তাও আমি জানি না। আমি অতি তুচ্ছ একজন। আমার জন্যে সুপারিশ করার কেউ নেই স্যার।
ক্যাপ্টেন বললেন, যান চলে যান। You are released. আপনি চাইলে আমি আপনাকে পৌঁছে দিতে পারি।
শফিক বলল, স্যার, আপনার অনেক মেহেরবানি। আমি নিজে যেতে পারব।
বাইরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে, এইজন্যে বললাম।
শফিক বলল, বৃষ্টিতে ভিজে আমার অভ্যাস আছে স্যার।