১২. টিনের কানেস্তারায় বাড়ি পড়েছে

টিনের কানেস্তারায় বাড়ি পড়েছে। উচ্চকণ্ঠে কি যেন ঘোষণা করা হচ্ছে। কৌতূহলী হয়ে দাঁড়াতেই দেখি, বাদশা মামা বিব্রত মুখে সারা গায়ে চাদর জড়িয়ে হাঁটছেন। তার আগে আরেকজন টিনে বাড়ি দিয়ে দিয়ে উচ্চকণ্ঠে কি বলছে। আমি বললাম, কি ব্যাপার মামা?

কিছু না, কিছু না।

ঢোল দিচ্ছে কে? আপনি নাকি?

হুঁ।

কিসের জন্যে?

বাদশা মামা দাঁড়িয়ে পড়লেন। জড়িত কণ্ঠে বললেন, রহমত পাগলের জন্যে ঢোল দিচ্ছি, যদি কেউ পায় তাহলে পাঁচ টাকা পুরস্কার।

কেন, কি হয়েছে?

বাদশা মামা এড়িয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু আমি ততক্ষণে তার হাত চেপে ধরেছি। মামা অসহায়ভাবে তাকালেন আমার দিকে। আমি দৃষ্ট গলায় বললাম, বলেন কি ব্যাপার।

রঞ্জু, পাগলটাকে খেদিয়ে দেবার পর থেকে যত অশান্তি শুরু হয়েছে। ফিরিয়ে আনলে যদি সব মিটে।

মামা আমার হাত ছাড়িয়ে সামনে এগিয়ে গেলেন। বাদশা মামা আরো অনেক রকম পাগলামি করতে লাগলেন। নানাজানের একটি আম-কাঁঠালের প্রকাণ্ড বাগান ছিল। জলের দরে সেটি বেঁচে দিলেন। বিক্রির টাকা দিয়ে নাকি মসজিদ করবেন। ছোট নানীজান কাঁদো-কাঁদো হয়ে বললেন, এসব কী রে বাদশা?

বাদশা মামা কৈফিয়তের ভঙ্গিতে বললেন, তিনি নাকি স্বপ্নে দেখেছেন সাদা পোশাক পরা এক জ্যোতির্ময় পুরুষ তাকে বললেন, মসজিদ কর, সব ঠিক হবে। ছোট নানীজান বললেন, বাদশা, তুই মিথ্যা কথা বলছিস। বাদশা মামা মাথা নিচু করে চলে গেলেন। মসজিদের জন্য ইট পুড়ানো হতে লাগল। ময়মনসিংহ থেকে রাজমিস্ত্রি আসল। বিরাট মিলাদ মহফিলের মধ্যে মসজিদের কাজ শুরু হল।

নানাজানের দুটি বিল ছিল। বিলের মাছ থেকে পয়সা আসত বিস্তর। সেই টাকায় সংসার খরচ গিয়েও বেশ মোটা অংশ জমত। বিল দুটি একইসঙ্গে হাতছাড়া হয়ে গেল। কী ভাবে হল কেউ বলতে পারল না। নানীজান সারাদিন চোখের পানি ফেলতে লাগলেন।

রহিম শেখ একসঙ্গে বেশ কয়েকটি মামলা রুজু করল। সমস্তই মিথ্যা মামলা। বাদশা মামা নির্বিকার বসে আছেন মসজিদের সামনে। দেখছেন কী করে ইটের পর ইট বিছিয়ে ভিত তৈরি হচ্ছে। মামলার তদবীরের জন্য ছোট নানীজানকে নিয়ে আমিই যাওয়া-আসা করতে লাগলাম। দীর্ঘদিন মামলা চলল। দুটিতে জিত হল আমাদের, একটি রহিম শেখ পেল।

নানাজান হজ থেকে ফিরে এলেন এই সময়ে। সংসারের তখন ভরাডুবি ঘটেছে। রোজকার বাজারের টাকাতেও টানাটানি পড়তে শুরু করেছে। নানাজান কিছুই বলল না। ছয় মাসেই তার বয়স ছবছর বেড়ে গেছে। চোখের দৃষ্টি হয়েছে নিম্প্রভ, একা একা হাঁটতে পারেন না। লাঠিতে ভর না দিয়ে দাঁড়াতে পারেন না। চোখের সামনে সংসারকে ভেঙে পড়তে দেখলেন। তবু সকালেবেলায় কোরাওন শরীফ ধরে বিলম্বিত সুরে পড়তে লাগলেন। “ফাবিয়ায়ে আলা রাব্বিকুমা তুকাজ্জিবান।” অতএব তুমি আমার কোন কোন নিয়ামত অস্বীকার করিবে?

বৎসর যাবার আগেই সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশ বিক্রি করে দিতে হল। বাদশা মামার মসজিদ ততদিনে শেষ হয়েছে। মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে চমৎকার নকশি কাটা গম্বুজ। ধবধব সাদা দেয়ালে নীল হরফে লেখা কলমায়ে তৈয়ব। পাড়ার ছেলেমেয়েরা আমপারা হাতে সকালবেলাতেই মসজিদে ছবক নিতে আসে। দেখে-শুনে বাদশা মামা মহাখুশি। মহাজনের কাছ থেকে টাকা ধার করে মসজিদের সামনে পুকুর কাটিয়ে দিলেন। কি সুন্দর টলটলে জল, পুকুরে পাথরে বাঁধানো প্রশস্ত ঘাট।

বাদশা-মামাকে দেখে আমার নিজেরও ভাল লাগে। সাদা গোল টুপি পরে চোখে সুরমা দিয়ে কেমন গর্বিত ভঙ্গিতে নামাজ পড়তে যান। একদিন আমাকে ডেকে একটু ইতস্তত করে বললেন, রঞ্জু, জুমার রাত্রে তাহায্‌তের নামাজ পড়ে শুয়েছি, আমনি দেখি তোর লালমামি যেন নৌকায় করে ফিরে আসছে। আসবে ফিরে, দেখিস তুই। বাদশা মামার চোখ আনন্দে চকচক করে।

লালমামির কথা ভাবতে চাই না আমি। তবু বড়ো মনে পড়ে। কে জানে কোথায় সংসার পেতেছে তারা; নাকি যাযাবরের মত ঘুরে বেড়াচ্ছে দেশময়? কোনোদিন কী সত্যি ফিরে আসবে ধসে যাওয়া পরিবারটিকে শেষবারের মত দেখে যেতে?

নিজের কথাও আজকাল খুব ভাবি। আজন্ম যে রহস্যময়তার ভেতর বড় হয়েছি তা সরে সরে যায়। মনে হয় কিছুই রহস্য নয়। চাঁদের আলো, ভোরের প্রথম সূর্য সমস্তই রহস্যের অতীত প্রাকৃতিক নিয়মাবলী। যে নিয়মের ভেতর আমরা জন্মাই, বড় হই, দুঃখ-কষ্ট পাই। দুঃখ ও সুখ, কী তা নিয়েও ভাবতে চেষ্টা করি; মোহরের মা যখন তার আজীবন-সঞ্চিত পটুলা-পুটলি নিয়ে অশ্রুসজল চোখে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলে, ও ব্যাটা রঞ্জু যাই গো ব্যাটা। তোমার দুঃসময়ে একটা মানুষের বোঝা আর বাড়াইতাম না গো। তখন আমার কোন দুঃখবোধ হয় না। এ যেন ঘটতই। তাহলে দুঃখ কী? নতুন করে আবার সম্পত্তি বিক্রি হচ্ছে শুনে ছোট্ট নানীজান যখন উন্মাদের মত কাঁদেন তখন বুঝি এই দুঃখ, অথচ সফুরা খালা তখন হাসিমুখে বলেন, গরিব মানুষ হওয়ার অনেক রকম মজা আছে রঞ্জু, তুমি ইচ্ছামত ঘুরে বেড়াতে পারবে কেউ কিছু বলবে না। তখন সব ভাবনা-চিন্তা জট পাকিয়ে যায়।

সন্ধ্যাবেলা আমি নানাজানের হাত ধরে তাকে বেড়াতে নিয়ে যাই। হিম গেলে তাঁর কাশি হয়। খুক খুক করে কাশেন। আমি যদি বলি, চলেন ঘরে যাই। নানাজান আঁৎকে ওঠেন, না, না, আরেকটু, আরেকটু, বেড়াই। পরম নির্ভরতার সঙ্গে তিনি আমার হাত ধরে হাঁটেন। বেলাশেষের সূর্যরশ্মি তার সফেদ দাড়িতে চকচক করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *